| 6 অক্টোবর 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প: অচ্ছেদ্য । পার্থ ঘোষ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

ছোট্টো বনেদী শহর।  সাজানো গোছানো শহর।  শহরের প্রাণকেন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিত করে পাশাপাশি শুয়ে থাকা রেল লাইন।  যে রেল লাইন দেখিয়ে প্রাণেশ প্রণীতাকে বলল – নীতা, এই লাইন দুটো চিরকাল পাশাপাশি শুয়ে আছে, কিন্তু কেউ কারোকে আলিঙ্গন করতে পারছে না। 

প্রণীতা শুনল। লাইন বরাবর দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে। তারপর আনত নেত্র প্রাণেশের দিকে তুলে বলল – ঠিক আমাদের মত।  আমরাও কোনো দিন মিলিত হব না।

প্রাণেশ বলল – কেন,  নীতা, কেন? তুমি আমায় প্রত্যাখ্যান করছ কেন? আমি তো তোমাকে…

প্রণীতা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল – আমি তোমায় ভালোবাসিনা।  আয়নার সামনে নিজেকে দেখেছ কখনও? আমায় ডাকবে না।  আমি তোমায় ঠিক মন থেকে চাই না।  জোর করে ভালোবাসা হয় না। 

প্রাণেশ বলল – তুমি আমার ওপরটাই দেখলে নীতা।  ভেতরের দিকে একবারও তাকালে না। 

-আমার দরকার নেই। তোমার সঙ্গে আমি বন্ধুর মত মেলামেশা করি।  তোমায় বন্ধুই ভেবেছি সবসময়। তুমি সম্পর্কটাকে অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছ।  কিন্তু, বন্ধু ছাড়া আমি যে তোমায় অন্য কিছু ভাবতে পারি না। তুমি ভালো বন্ধু হতে পার প্রাণেশ; কিন্তু, প্রেমিক কখনই নয় – বলল প্রণীতা। রেগে গিয়েই বলল। ওর কথায় ক্রোধ আর ঘৃণা ঝরে পড়ল।

তবু প্রাণেশ ওকে হারিয়ে যেতে দিতে পারছিল না।  প্রণীতার ফর্সা রঙ, টিকাল নাক, গভীর চোখ, ছোটো রক্তিম ঠোঁট, ভরন্ত শরীর, সুরেলা কণ্ঠস্বর প্রাণেশকে বন্ধু হতে দিচ্ছিল না। সে প্রত্যাখ্যাত হয়েও প্রমিকের দৃষ্টিতে দেখছিল প্রণীতাকে। একটু ক্ষণ চুপ করে থেকে বলল– একবার ভেবে দেখবে না। আমি না হয় দেখতে খারাপ। কিন্তু চরিত্র, লেখাপড়া, বংশ মর্যাদা কোন দিকে তো আমার কমতি নেই।  প্লীজ্‌ প্রণীতা…

প্রণীতা একটু গলা তুলল।  আপ লোকালটা তখন যান্ত্রিক শব্দ করে ষ্টেশন ছাড়ছে।  সে বলল– আজই তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা । যা বলার বলে দিয়েছি।  আর কোন সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করবে না।

কিন্তু এতদিন যে তুমি আমার সঙ্গে ঘুরলে, সিনেমা দেখলে, রেষ্টুরেন্টে গেলে সেইসব কি সবই মিথ্যে?

-না মিথ্যে কেন হবে? বন্ধু বন্ধুর সঙ্গে তো এসব করতেই পারে। তখন তো আমরা বন্ধুই ছিলাম।  কিন্তু আজ নেই।  বন্ধুত্বের মধ্যে আজ প্রেম এসেছে।  আমি সেই প্রেমকে স্বীকার করি না। এখন আমরা আর বন্ধু নই। বন্ধুর মত আর মেলামেশা করতেও পারব না।  মন সায় দেবে না।  তার থেকে সম্পর্ক শেষ হওয়াই ভালো। 

একটু থেমে প্রণীতা পুনরায় বলল–তাছাড়া, আমার একজন প্রেমিক আছে। তার কানে এসব কথা গেলে আমাদের সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হতে পারে। তার থেকে সব শেষ হয়ে যাক। এই কথাটা সে বানিয়েই বলল প্রাণেশকে। সম্পর্কটাকে শেষ করার জন্যই । 

প্রাণেশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।  তার সেই দীর্ঘশ্বাস উড়ে গেল ডাউন প্যাসেঞ্জারের গতির সঙ্গে। সে বলল– ওকে।  তবে তাই হোক।  তবে তোমায় আমি খুব ভালোবেসে ফেলেছি।  আজ চলে যাও।  তবে কখনও ফিরে আসার মন হলে চলে এসো।  ভালোবাসা নিও, হারিয়ে যেও না।

প্রণীতা সেদিন চলে গেল সম্পর্কের জাল ছিঁড়ে।  প্রাণেশ ওর যাওয়ার পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর একাকী রেল লাইনের দিকে তাকিয়ে একাকীত্ব অনুভব করল।  কিশোর মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। চোখ ভরল জলে। ঝাপসা হল রেল লাইন। দূর দিগন্তেও ওরা পাশাপাশি, কিন্তু আলিঙ্গনাবদ্ধ নয়। ঠিক প্রাণেশ আর প্রণীতার মত।

প্রাণেশ ছেলেটা পড়াশুনোয় ভালো।  মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দোষ বলতে কালো আর বেঁটে। প্রণীতার পছন্দ না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে যখন দেখে তখন প্রাণেশকে তার পাশে চিন্তা করলেই কেমন অস্বস্তি লাগে। কখনও সে ভাবে শুধু রূপ দিয়ে মানুষকে পছন্দ অপছন্দ করাটা কি ঠিক? কিন্তু তবু নিজের চিন্তাধারাকে আয়ত্বে আনতে পারে না।

প্রাণেশকে সে বন্ধু হিসাবে পেতে চায়। ভাল বন্ধু। যদিও বন্ধুত্বের আড়ালে সামান্য প্রেমের স্বাদ যে নেই তা নয়। তবুও যেন সেটাকে সে মেনে নিতে পারে না। অবশ্য কেন পারে না সেটাও তার কাছে পরিস্কার নয়।


আরো পড়ুন: গল্প: দুই বন্ধুর অদল বদল । শুভজিৎ সরকার


বয়স কম। সেইসঙ্গে চিন্তাভাবনারও পক্ক্বতা নেই।  এই বয়সে যেমন হয় সেরকমই।  ফলে গুণ থেকে রূপটার বিচার করার ব্যাপারটাই মাথায় বেশী আসে। স্বভাবতই সেটাই করে প্রণীতা। ওর মনে হয় প্রাণেশের থেকে ভালো ছেলে পাওয়া যাবে। সুন্দর, লম্বা, স্বাস্থবান। শেষ পর্যন্ত সেরকম জুটেও যায়। 

আলাপ হল ইন্দ্রনাথের সঙ্গে। বড়লোকের ছেলে। জিম করা পেশিবহুল শরীর। চোখের চাহনীতে প্রেমের বার্তা।  কথাতেই বিশ্বজয়। একটা একরোখা ভাব। পড়াশোনার দৌঁড়ে পিছিয়ে থাকলেও, প্রতাপ আর সবজান্তা ভাবে সে অনেকটাই এগিয়ে থাকে সবার চেয়ে। যাকে প্রণীতার মনে হয় রাফ্‌ এণ্ড টাফ্‌। ফলে যা হবার তাই হল।  প্রণীতা মন দিয়েই ফেলল। ইন্দ্রনাথও প্রণীতার রূপকে প্রত্যাখ্যান করতে পারল না। সেও ডুবলো। দুজনের প্রেম হল। প্রাণেশ হারিয়ে গেল। 

প্রাণেশ তার নিজস্ব কক্ষপথে বিলীন করে দিল নিজেকে। পড়াশোনা, চাকরীর চেষ্টা করতে করতে উন্নত সিঁড়ির ধাপগুলো চিনতে শুরু করল। প্রেমের প্রত্যাখ্যান তাকে মনে একটা জোরের সঞ্চার করল। সে ভাবল শারিরীক দিক দিয়ে হেরে গেলেও মানুষ হিসেবে আর  হারবে না সে। শুরু হল প্রাণেশের পথচলা। 

এগিয়ে চলল ইন্দ্রনাথ আর প্রণীতার প্রেমও। গলাগলি, মাখামাখি থেকে রগ্‌রগে, ঢলাঢলি হয়ে একদিন প্রেমের মৃত্যু হল বিয়ের ছাদনাতলায়। 

প্রেম মরল। শুরু হল নতুন জীবন। আনন্দ জোয়ারে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল যৌথ সংসার। পৃথিবীর আলো দেখল ওদের সুখী জীবনের প্রথম সন্তান – প্রেমের ফসল।

জমিতে ফসল একবার ফলে যাবার পর জমি রুক্ষ হয় সাময়িক ভাবে। সংসারের মধ্যেও সেভাবেই যেন একটু রুক্ষতা প্রবেশ করল।  ঘোরতর সংসারী হবার পর যা হয় সেরকমই একটু খুট্‌খাট্‌, ধাক্কাধাক্কি, ঠোকাঠুকি; দুটো বাসন পাশাপাশি থাকলে যেরকম হয় আর কি। ইন্দ্রনাথ ছোটখাটো চাকরী করে। নুন আনতে পান্তা ফুরনো জীবন মানতে পারে না প্রণীতা। অল্প থেকে ক্রমশঃ বাড়তে লাগল। ঠোকাঠুকি একদিন ধাক্কাধাক্কিতে পৌচ্ছল।  মধুর বাণী কর্কশ স্বরে বদলে গেল। সহ্যশক্তি কমে যেতে লাগল। মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতায় ভাঁটা পড়তে শুরু করল। প্রাণেশের মুখটা মাঝে মাঝে মনে পড়তে লাগল প্রণীতার।

প্রাণেশ তখন অনেক গুলো ধাপ উপরে উঠে এসেছে। যেখান থেকে প্রণীতার কথা মনে পড়লেও তাকে দেখা যায় না।  পড়াশোনায় ভালো ফলাফলকে ফাইল বন্দী করে নামকরা প্রাইভেট কোম্পানীর সুপারভাইজার পদে যোগদান করেছে।  যদিও সেখানেই থেমে থাকতে সে নারাজ। চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই তার একমাত্র কাজ।  আরও, আরও উন্নতি। আরও ভালো চাকরী–সরকারী উচ্চ পদের। যেখানে পৌঁছনোর পর তাকে আর পেছনে তাকাতে হবে না।  যেখানে পৌঁছলে সে তারাদের উচ্চতায় চলে যাবে।  প্রণীতা নীচে থেকে সেই তারাকে দেখতে পাবে, কিন্তু অত ওপর থেকে সে আর প্রণীতাকে দেখতে পাবে না।  প্রাণেশের সেই উচ্চতার খোঁজে ভেসে বেড়ানটাই হল ধ্যান জ্ঞান। 

প্রেম একদিন পালাল খোলা জানালা পথে।  শুধু প্রণীতা দেখতে পেল না ঘরের কোন জানালাটা তার সঙ্গে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করল, এটাই তার আপসোস হয়ে গেল। 

প্রণীতা ফিরল মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ী। বাবা একমাত্র মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে পারল না। তাঁর অবসর প্রাপ্ত সংসারে টেনে নিল মেয়েকে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে। 

বাবার কাছে এসে প্রাণেশের কথা বেশী করে মনে পড়তে লাগল প্রণীতার।  অনেক খুঁজে একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ যোগাড় করল। কঠিন বাস্তব তাকে বোঝাল তার জীবন তার নিজের হাতে। জীবন গাড়ীর চালক বদলেছে। যে গাড়ী একদিন ড্রাইভার চালাত আজ সে গাড়ীর চালক মালিক সে নিজেই।

প্রণীতার চোখ সব জায়গায় প্রাণেশকে খুঁজতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে একদিন দেখাও পেল। না পাবার কথাও নয়: প্রাণেশ যে তারা হয়ে গেছে। উন্নতির শিখরে পৌঁছে সে সরকারী চাকুরীর গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল হয়েছে। তার সম্মান বেড়েছে, মানুষ হিসাবে দাম বেড়েছে, তার বসবার চেয়ারটার গুরুত্ব বেড়েছে। প্রণীতা সেসব খবর পেল। প্রাণেশকে চোখের দেখাও দেখল। বড় মানুষকে দেখা যায়, কিন্তু বড় মানুষ নীচের তলার মানুষকে দেখলেও অনেক সময় দেখতে পায় না।

প্রাণেশ এখন অনেক টাকা মাহিনা পায়। নিজের গাড়ীতে চলাফেরা করে। তার একপাশে থাকে তার সরকারী চাকুরে সুন্দরী স্ত্রী। অপর পাশে থাকে নামকরা ইংলিশ মিডিমামে পড়া তার একমাত্র ছেলে।

বাজার করে ফেরার পথে প্রণীতা এক ঝলক সেদিন দেখেই ফেলল তাদের। গাড়ীর ভেতর থেকে প্রাণেশ তাদের সেভাবে হয়ত দেখতে পেল না, কিংবা দেখেও দেখল না। 

গাড়ীটা প্রণীতা আর ঐন্দ্রিলার পাশ দিয়ে চলে গেল।  একটু ধূলো উড়ল।  হাওয়া লাগল ওদের গায়ে।  ধূলোর দু-একটা অণু-পরমানু প্রণীতার চোখে এসে পড়ল বোধহয়।  চোখদুটো কড়্‌কড়্‌ করে উঠল। 

প্রণীতা দেখল প্রাণেশের গাড়ী রাস্তার বাঁকের মুখে হারিয়ে গেল, তার ভবিষ্যতের মত।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত