| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
পাঠ প্রতিক্রিয়া

অস্বস্তিকর নীরবতায় সাহসী উচ্চারণ । তৌহিদ রিয়াদ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

স্মৃতিশক্তি  খারপ নয়  নেহাতই,  ঐ যে একটা কথা আছে ভুলে যাওয়ার  অনেক সুবিধা  সহজ হয়ে যায় যাপনের ধারাপাত।   মস্তিষ্কের নিউরনে স্মৃতির কালবৈশাখী মানেই নানা প্রশ্নের  মুখোমুখি হওয়া।  এখন আবার  যোগ হয়েছে ফেইসবুকের  মেমোরিস অপশন । প্রতিদিন  ঘড়িতে রাত বারোটা বাজতে না বাজতেই আমাদের সামনে হাজির করে পুরানো হিসেবের খাতা। তার মানে দাঁড়াচ্ছে মুক্তি নেই, যতই যন্ত্রণাময় ঘটনা হোক অতীতের মুখোমুখি একবার হতেই হবে।

যেহেতু পালানোর  নেই কোন পথ, সত্যরে ভালবাসা ছাড়া আর কোন বিকল্পও নেই।  ৩০ মার্চ  ক্যালেন্ডারে প্রবেশ করার সাথে সাথে ফেইসবুক মেমোরিতে ওয়াশিকুর রহমান বাবুর ছবিটা আমার সামনে এসে হাজির।  খানিক তাকিয়ে রইলাম ছবিটির দিকে,  যেনো অস্বস্তি নিয়েই কুশল বিনিময় করলাম।  হ্যা সে ওয়াশিকুর বাবু যাকে স্রেফ লেখালেখির জন্য খুন হয়ে যেতে হয়েছিলো।

শুধুই কি ওয়াশিকুর?  ২০১৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি রাত নটা থেকে এদেশে শুরু হয়েছিলো রক্তের হোলি খেলা।  হত্যার উৎসবের বলি হয়েছে রাজিব হায়দার  থেকে অভিজিৎ রায়, প্রান দিতে হয়েছে বুয়েটের  আরিফ রায়হান দীপ,  অনন্ত বিজয়, নীলাদ্রি নিলয়, নাজিম উদ্দিন , জুলহাস মান্নান, মাহবুব রাব্বি তনয় শুধুই কি লেখক  কিংবা এ্যাক্টিভিস্ট  প্রাণ গেছে ইতালিয়ান নাগরিক তাভেল্লা সিজার , জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও।

এসব হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতায়  ২০১৬ সালে ঘটে  যাওয়া হোলি আর্টিজানে জংগি হামলা,  শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজে তান্ডব , রক্ষা পায়নি মহরমের তাজিয়া মিছিলও।  বাংলাদেশের উপর যেনো  ভর করেছিলো এক প্রদোষকাল।  এসবের  মধ্যে নিয়মিতঁ বিরতিতে ঘটে চলেছে  সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস।  মোদ্দা কথা হলো এসব ঘটনার প্রতিঘাতে সমাজের বিভাজন রেখাটা স্পষ্ট হয়ে গেলো।

তবে  একটা কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কিছু বছরের এই তান্ডব ভুলিয়ে দেয়ার একটা রাজনীতি  দেশে চলমান রয়েছে।  এসব হত্যাকান্ডের পক্ষে সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্মতি তৈরীর প্রকল্পওগুলো বেশ জোরেশোরেই চলছে, আর এসব অদৃশ্যমান কিছু নয়।

এসব সম্মতি উৎপাদনমুলুক প্রকল্পগুলোতে দেশের  প্রথম সারির গণমাধ্যম,  সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালকরাও জড়িত এটাও আমরা দেখতে পেয়েছি।

এসব ঘটনার উৎমুল  ২০১৩ সালের শাহবাগের আন্দোলন। ঐ লড়াইয়ের প্রতিক্রিয়া  হচ্ছে হত্যাকান্ডগুলো এবং  সেই আন্দলোনের অভিঘাত  হলো বর্তমানের   সামাজিক বিভাজন।

যুদ্ধাপরাধীদের  ন্যায্য বিচার ও ট্রাইবুনালের আইন সংশোধনের দাবীতে গড়ে উঠেছিলো আন্দোলনটি। প্রায় চার দশকের অমীমাংসিত অন্যায়ের  সুরাহা করার প্রত্যয়ে তৈরী হওয়া আন্দলোনের প্রতি নিরুঙ্কুশ সমর্থন ছিল গণ মানুষের।  বিরুদ্ধ শক্তিও  নিশ্চুপ ছিলনা, তারাও সামনে এনেছিলো হেফাজতে ইসলামের মতো সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিকে।

বাংলাদেশের ভবিষৎ রাজনীতিকে বুঝতে হলে ২০১৩ সালের এই দুটো টিপিং পয়েন্টের চরিত্রও বুঝতে হবে।  শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে নীরবতার রাজনীতি আছে, এড়িয়ে যাওয়ার প্রবনতা স্পষ্ট। কারণ এই আন্দোলনটা পালটে  দিয়েছে ক্ষমতার সমীকরণ যার প্রভাব পড়েছে সামাজিক অঙ্গনেও বিস্তারিত  ব্যাখার সঠিক জায়গা এটি নয় তবুও নোকতা  হিসাবে রইলো এই আলাপটি।

আর যেহেতু সবকিছুই রাজনীতির অংশ, নীরবতাও। ফলে সাহিত্য থেকে সিনেমা সবখানেই এই সময়কালের কথা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা একদম সুস্পষ্ট। যদিও কিছু চলচ্চিত্র তৈরী হয়েছে তবে তার রিপ্রেজেন্টেশনের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন আছে।

এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী একটা উদাহরণ তৈরী করেছেন  অদিতি ফাল্গুনি , সরব হয়েছেন এসব হত্যাকান্ডের সম্মতিসুচক  নীরবতার বিরুদ্ধে। তার উপন্যাস ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদ উপন্যাসটিতে সাহসের সাথে তুলে এনেছেন  সেই সময়টিকে। নাহ  ভুল বললাম, উনার ক্যানভাসটা আরো বিশাল, তিনি আসলে মানব ইতিহাসের দ্বন্দ আর তার ফলাফলে   রক্তক্ষরণের ঠিকুজি উদ্ধারে এক স্নায়ুক্ষয়ী জার্নি করেছেন।

এটুকু বুঝি ঘোর প্রদোষকালেই বসবাস আমাদের।  দমবন্ধ করা অসৃজনের কালের খাচায় বন্দী।

তবুও মাঝে মাঝে দেখা যায় আলোর রেখা। এই যেমন দিল্লির হিংসায়  সাক্ষাৎ  চৈতন্য রুপে   ধরা দেন প্রেমাকান্ত ।

আবার   দেখা যায়  সুদূর মরু  রাজ্যে বাদশাহ সালমানের ছায়ায় যেন ফিরে এলো উসমান আর তার ক্ষমতা পোক্ত করার নেশায় টুকরো হয়ে যান খাসোগি। রেহাই পান না তার ভাইয়েরাও।

আর প্রদোষকালে চেপে বসেছে  দেশে দেশে   অসুস্থ বিকারগ্রস্ত শাসকেরা।  এই কোন নয় সুখের সময়।

ঠিক  এমন  একটা সময়ে  অদিতি ফাল্গুনীর একটা  উপন্যাস ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে পড়ার সুযোগ হয়েছে।

বাংলাদেশের

গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস থেকে বাংলাাদেশের প্রথা বিরোধী  লেখক হুমায়ুন আজাদ, সাম্প্রতিক সময়ে মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত থাকাদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে গড়ে উঠা শাহবাগ আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে মুক্তচিন্তার ব্লগার হত্যা  আবার টাইম ট্রাভেল করলে দেখা যাবে  পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে শ্রী চৈতন্যের হত্যা অথবা রাজপুত রাজকন্যা মীরার জীবনদান। ক্যাথড্রাল হত্যা থেকে হোলি আর্টিজানের রক্তের হোলি খেলা।

২০১৪ সালে  নির্বাচন পরবর্তী সময়ে অভয়নগরের আক্রোশ আর দেশে না ছাড়তে হিন্দু প্রতিবেশীর কাছে  এক তরুণ মুসলিম ছেলের আকুতি,  রংপুরে জাপানি নাগরিক হত্যা। ভারতের যুক্তিবাদী লেখক গৌরী লঙ্কেশের ট্র্যাজেডি।  কি উঠে আসেনি এই উপন্যাসে?

ঢাকার   হোসনি দালানে মহরমের তাজিয়া  মিছিলে বোমা হামলা থেকে ইসলামের খলিফাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, বিশ্বাস যে  ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এসব উপখ্যানই উঠে এসেছে ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে।

আমার বিবেচনায় পৃথিবীতে চিন্তার ইতিহাসে যে দ্বন্দ্ব  তারই একটি ডকু ফিকশন এটি। এর আঙ্গিক বিচার করে  একটা কথায় বলতে পারি, এই উপন্যাস পড়ে টাইম ট্রাভেলের অভিজ্ঞতা হয়েছে।

এই অ্যাখানে  উঠে এসেছে বিভিন্ন সময়ের চিত্র।   এই উপন্যাসে প্রতিটি উপখ্যানরে চরিত্রই যেন একেকজন সুত্রধর।  লেখক অন্তত মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।

দুটো উদাহরণ দিলে পুরো বিষয়টি বোঝা যাবে। যেমন পদার্থ বিজ্ঞানী সুজেয় চৌধুরীকে নিয়ে পদার্থবিদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল  এবং মুখোমুখি বসিবার সেই জ্যোতিবিজ্ঞানীর অংশটুকুতে অতীত আর বর্তমান মেলবন্ধনের যে বর্ণনা , পাঠককে ভাবতে বাধ্য করবে।  সেখানে সুজয় চৌধুরী আর পারসিয়ান বিজ্ঞানী আল বিরুনির আড্ডার ছলে শোনা যাবে  জ্ঞান রাজ্যের ভীষণ অতৃপ্ত  দুই মুসাফিরের পিপাসার কথার।

আবার রোমান আইনের ক্লাসের যে উপখ্যান সেখানে আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ চরিত্র আরিফ, সঞ্জীব এবং  ল্যুডমিলা এবং শিক্ষক  গিয়াসের আলোচনাটি পড়লে রোম থেকে শুরু করে উপমহাদেশের শ্রেণী বিভাজনের গল্প, আবার সঞ্জীবের বোনের বিয়ে সঙ্কটটিও আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে এই  একুশ শতকেও প্রথার কারাগার থেকে মুক্ত হতে পারিনি আমরা।

উঠে এসেছে আরব সংস্কৃতি আর খলিফাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। তাতে নেই বাড়াবাড়ি একদম , ইতিহাসের নিরিখে, নৈব্যক্তিকতার পরিচয় দিয়ে পাঠককে  অনেক কঠিন সত্যের মুখোমুখি করেছেন অদিতি ফাল্গুনি।

আবার তার লেখায় উঠে এসেছে তাব্রিসের মায়ের আর্তনাদ। তরুণদের সামনে নেই কোন আদর্শ,  ইতিাহাস বিমুখ একটা ভোগসর্বস্ব সামাজিক কাঠামোতে পরিবর্তন না আনলে আরো অনেক তাব্রিসের  মায়ের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠবে চরাচর, এই সাবধানী বাণীও শুনিয়েছেন তিনি।

এই বইয়ের অ্যাাখান উপখ্যানের স্তরে  স্তরে রয়েছে  পাঠকের চিন্তার খোরাক।  এর আঙ্গিক ও  প্রকাশভঙ্গিতেও আছে নতুনত্ব। পাঠককের ভাবার জন্য আছে যথেষ্ট স্পেস।

ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে উপন্যাসটির বিশাল ক্যানভাসে উঠে এসেছে পৃথিবীর চিন্তার ইতিহাস ও দ্বান্দিক রুপটি। আর  এক্ষেত্রে  তুলে আনতে বেশ নির্মোহ থেকেছেন লেখক।

তাই একথা বলতে হয়, উপন্যাসের  কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো সময়। আর পাঠক হিসেবে বেশ ভালভাবেই কানেক্ট করতে পেরেছি, ব্যক্তিগতভাবে খুঁজে পেয়েছি নিজেকে। আমার লড়াই আর সহযোদ্ধা হারানোর যন্ত্রণাটা তিনি স্পর্শ করেছেন অদিতি। বিশ্বাস করি আমার মতো অনেকেই কানেক্ট করতে পারবেন।

শেষ করার আগে  একটা কথা উল্লেখ করা অবশ্যই কর্তব্য, এই উপন্যাসটি নিয়ে দেশের  সাহিত্যজগৎ অবিশ্বাস্যভাবে নীরব।  পাঠক হিসেবে মনে করি  এই নীরবতা বরং সমসাময়িক লেখকদের নীচতাই  প্রমাণ করে ,উপন্যাসটি  বিষয়বস্তু আর ভাষার নমনীয়তার কারণেই বাংলা সাহিত্যে স্থায়ীভাবেই জায়গা করে নেবে। জনপ্রিয়তা সবসময় সত্য কথা বলেনা।

ও হ্যাঁ শেষ কথা হলো, বিনয়ী হয়ে খুব দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করা যায় কঠিন সত্য এটাই এই উপন্যাসের সারকথা ।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত