| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে কিছু জানা কথা । তপন বাগচী

আনুমানিক পঠনকাল: 15 মিনিট

অনুপ্রবেশের আগে
hiralal-sen.jpg……..
অবিভক্ত বাংলার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা হীরালাল সেন (১৮৬৬-১৯১৭)
……..
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প, সংস্কৃতি, বিনোদন ও গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে তার বৈশিষ্ট্য ও ভিত্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সকলের জানা কথা, চলচ্চিত্র একই সঙ্গে আর্ট এবং ইন্ডাস্ট্রি। একই সঙ্গে মানবিক ও বাণিজ্যিক। তাই সাধারণের পক্ষে অপেক্ষাকৃত জটিল কিন্তু সবচেয়ে প্রভাবসঞ্চারী এই মাধ্যমটির প্রতি মানুষের ব্যাপক আগ্রহ ও কৌতূহল বিরাজমান।

alibaba.jpg……..
হীরালাল সেনের দীর্ঘতম ছবি আলীবাবা ও চল্লিশ চোর (১৯০৩)-এ নৃপেন্দ্র নাথ বসু ও কুসুম কুমারী
………
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দীর্ঘ গৌরবের পথপরিক্রমার বর্তমান অবস্থায় অশ্লীলতা ও ভাঁড়ামির অভিযোগ বহন করে চলছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আশির দশকের শুরু থেকে এই ধারা ক্রমশ প্রকট হয়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, রুচিমান দর্শক এখন প্রেক্ষাগৃহমুখী হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করছে না।

সারা দেশের প্রেক্ষাপটেই বলা যায় যে, অনেক প্রাচীন ও অভিজাত প্রেক্ষাগৃহ এখন বন্ধ হয়ে গেছে। কোনও কোনও মালিক প্রেক্ষাগৃহের কাঠামো পরিবর্তন করে এখন বহুতল বিপণীবিতান বানিয়ে ভিন্ন ব্যবসায় যুক্ত হতে চাইছেন। এরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবার এবং সেই নিরিখে চলচ্চিত্রের গতিপ্রকৃতি নিয়ে নতুন দিকনির্দেশনা খুঁজে বের করার সময় এসেছে।

চলচ্চিত্রশিল্পের পটভূমি
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বিষয়ভিত্তিক ধারাবিচারের আগে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্রের অবস্থা ও অবস্থান বিবেচনা করা দরকার। গণযোগাযোগের এই শক্তিশালী মাধ্যম চলচ্চিত্রের ইতিহাস সঙ্গত কারণেই খুব বেশিদিনের নয়। আজ থেকে ১১৩ বছর আগে (২৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৫) প্যারিসের হোটেল ডি ক্যাফেতে অগাস্ট লুমিয়ের (১৮৬২-১৯৫৪) ও লুই লুমিয়ের (১৮৬৪-১৯৪৮) নামে দুই ভাই চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শনী করেন। এর আগেও প্রদর্শনী হয়তো হয়েছে। কিন্তু এটিই ছিল প্রথম সফল বাণিজ্যিক প্রদর্শনী। কিংবা বলা যেতে পারে এর আগের কোনও তথ্য আমাদের হাতে নেই। তাই এই সময়কেই চলচ্চিত্রের সূচনাবিন্দু ধরা হয়। তখন একে চলচ্চিত্র বা সিনেমা নয়, বায়োস্কোপ নামেই ডাকা হত। ভারতীয় উপমহাদেশে চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী হয় এর মাসছয়েক পরে ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই। লুমিয়ের ভাইদের একজন এসে মুম্বাই শহরের ওয়াটসন হোটেলে উপমহাদেশে বায়োস্কোপের প্রথম প্রদর্শনী করেন। ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় বায়োস্কোপের প্রদর্শনী হয়।

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী
বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রথম বায়োস্কোপ প্রদর্শনী হয় কলকাতার ব্রেডফোর্ড বায়োস্কোপ কোম্পানির উদযোগে ১৮৯৮ সালের ৪ এপ্রিল বাকেরগঞ্জ জেলার ভোলা মহকুমার (অধুনা ভোলা জেলা) এসডিওর (অধুনা ডিসি) বাংলোতে। ১৭ এপ্রিল বায়োস্কোপ প্রদর্শনী হয় ঢাকায় পাটুয়াটুলীর ক্রাউন থিয়েটারে। ক্রাউন থিয়েটারের অস্তিত্ব এখন আর নেই। এই বায়োস্কোপের ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন চলচ্চিত্র ছিল। গবেষক অনুপম হায়াতের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, এই সব চলচ্চিত্রের মধ্যে ছিল মহারানী ভিক্টোরিয়ার জুবিলি মিছিল, গ্রিস ও তুরস্কের যুদ্ধ, তিনশত ফুট উঁচু থেকে প্রিন্সেস ডায়ানার লাফ, রাশিয়ার সম্রাট জারের অভিষেক, পাগলা নাপিতের ক্ষৌরকর্ম, সিংহ ও মাহুতের খেলা, ইংল্যান্ডের তুষারপাতে ক্রীড়া, ফ্রান্সের রাস্তাঘাট ও পাতাল রেলপথ ইত্যাদি। তখনও বায়োস্কোপের মাধ্যমে এই চলচ্চিত্র দেখার জন্য সাধারণ দর্শকের টিকেটের ব্যবস্থা ছিল। টিকেটের দাম ছিল আট আনা থেকে তিন টাকা।

ঢাকার পাটুয়াটুলী ছাড়াও জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়), ভিক্টোরিয়া পার্ক (বাহাদুর শাহ্ পার্ক), আহসান মঞ্জিল এবং ঢাকার বাইরে তৎকালীন মানিকগঞ্জ মহকুমার (অধুনা জেলা) বগজুরি গ্রামে, জয়দেবপুরে (অধুনা গাজীপুর জেলা) ভাওয়াল এস্টেটের রাজপ্রাসাদে, ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার (অধুনা শরিয়তপুর জেলা) পালং-এ বায়োস্কোপ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। রাজশাহী শহরের বোয়ালিয়া জমিদার শরৎকুমার রায়ের বাড়িতে বায়োস্কোপ দেখানো হয় ১৯০০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে কয়েক দিন ধরে। স্থানভেদে টিকেটের দামের তারতম্য ছিল। রাজশাহী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক হিন্দুরঞ্জিকা পত্রিকায় এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ঢাকার আরমানিটোলার পাটের গুদাম থেকে নিয়মিতভাবে বায়োস্কোপ প্রদর্শনীর গৌরবের অভিযাত্রা সূচিত হয় ১৯১৩-১৪ সালে। পরে এখানেই নির্মিত হয় ঢাকায় বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা হল পিকচার হাউজ, যা পরে শাবিস্তান হল নামে রূপান্তরিত হয়। সারণির মাধমে এই তালিকা প্রদর্শন করা যেতে পারে:

সারণি ১ : আদিপর্বে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের স্থান
ক্রম প্রদর্শনের স্থান তৎকালীন ভৌগোলিক অবস্থান বর্তমান ভৌগোলিক অবস্থান
১. এসডিওর বাংলো, ভোলা ভোলা মহকুমা, বাকেরগঞ্জ ভোলা জেলা
২. ক্রাউন থিয়েটার পাটুয়াটুলি, ঢাকা পাটুয়াটুলি, ঢাকা
৩. জগন্নাথ কলেজ জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
৪. বাহাদুর শাহ পার্ক ভিক্টোরিয়া পার্ক, ঢাকা ভিক্টোরিয়া পার্ক, ঢাকা
৫. বগজুরি গ্রাম মানিকগঞ্জ মহকুমা, ঢাকা মানিকগঞ্জ জেলা
৬. ভাওয়াল রাজপ্রাসাদ জয়দেবপুর, ঢাকা গাজীপুর জেলা
৭. পালং মাদারীপুর মহকুমা, ফরিদপুর শরিয়তপুর জেলা
৮. পাটের গুদাম, আরমানিটোলা আরমানিটোলা, ঢাকা পিকচার হাউজ/শাবিস্তান, ঢাকা
৯. শরৎবাবুর বাড়ি বোয়ালিয়া রাজশাহী

অবিভক্ত বাংলার চলচ্চিত্রের জনক
কলকাতায় যে বায়োস্কোপ কোম্পানি গঠিত হয়, তার মূল ভূমিকায় বাঙালিরা ছিল না। ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমার (অধুনা জেলা) বগজুরী গ্রামের হীরালাল সেন (১৮৬৬-১৯১৭) দ্য রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানি গঠন করে চলচ্চিত্র নির্মান ও প্রদর্শনী শুরু করেন। ১৯৯৮ সালে সালে প্রতিষ্ঠিত এই দ্য রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানিই বাঙালির প্রথম চলচ্চিত্র-প্রচেষ্টা। অবিভক্ত বাংলার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেও হীরালাল সেনের নাম নাম স্বীকৃত। বিভিন্ন স্থানে অভিনীত নাটকের খণ্ডিত অংশের চিত্রায়ণ করে ১৯০১ সালের ৯ ফেব্র“য়ারি কলকাতার ক্ল্যাসিক থিয়েটারে প্রদর্শন করেন। সেই সময়ের সীতারামআলীবাবাদোললীলাভ্রমরহরিরাজ বুদ্ধ প্রভৃতি জনপ্রিয় নাটক পরিবেশনার গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ বিশেষ অংশ ক্যামেরায় ধারণ ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে প্রদর্শন করে তিনি বাঙালির চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রবল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেন। প্রামাণ্যচিত্র, বিজ্ঞাপনচিত্র এবং সংবাদচিত্রও নির্মাণের পথিকৃৎ হিসেবেও হীরালাল সেন নমস্য ব্যক্তি।

উপমহাদেশের পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র
দাদাসাহেব ঢুণ্ডিরাজ গোবিন্দ ফালকে হলেন উপমহাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের নির্মাতা। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তিনি দাদাসাহেব ফালকে নামেই বেশি পরিচিত। ১৯১৩ সালে তাঁর নির্বাক চিত্র রাজা হরিশ্চন্দ্র মুক্তি পায়। ১৯১৬ সালে কলকাতায় ম্যাডান থিয়েটার্স কোম্পানির পক্ষ থেকে জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত প্রথম বাংলা নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিল্বমঙ্গল মুক্তি পায়। ১৯১৯ সালের ৮ নভেম্বর মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রের পরিচালকের নাম নিয়ে মতান্তর রয়েছে। কোনও কোনও গবেষক এই চলচ্চিত্রের পরিচালক হিসেবে মতান্তরে রোস্তমজি দুতিওয়ালার নাম উল্লেখ করেন। পরিচালকের ভূমিকায় যে-ই থাক, এই চলচ্চিত্রের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকার নওয়াব এস্টেটের ম্যানেজারের পুত্র প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি পরে চলচ্চিত্রের প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯২১ সালে কলকাতায় বিলাত ফেরৎ নামে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এর প্রযোজক ও অভিনেতা ছিলেন বাংলাদেশের বরিশাল জেলার ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।

ঢাকার চলচ্চিত্র নির্মাণ
১৯২৭-২৮ সালে ঢাকায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। নওয়াব পরিবারের কয়েকজন তরুণ সংস্কৃতিসেবী নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র সুকুমারী। এর পরিচালক ছিলেন জগন্নাথ কলেজের তৎকালীন ক্রীড়াশিক্ষক অম্বুজপ্রসন্ন গুপ্ত। চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা ছিলেন খাজা নসরুল্লাহ ও সৈয়দ আবদুস সোবহান। উল্লেখ্য তখন নারীদের অভিনয়ের রেওয়াজ চালু হয়নি। নাট্যমঞ্চের নারীচরিত্রেও পুরুষেরাই অভিনয় করতেন।

নওয়াব পরিবারের উদ্যোগে ঢাকায় ইস্ট বেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি গঠিত হয়। এর প্রযোজনায় অম্বুজপ্রসন্ন গুপ্ত নির্মাণ করেন নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট কিস। খাজা আজমল, খাজা আদিল, খাজা আকমল, খাজা শাহেদ, খাজা নসরুল্লাহ, শৈলেন রায় বা টোনা বাবু ছিলেন এই চলচ্চিত্রের অভিনেতা। তবে এতে নারীচরিত্রে নারীরাই অংশ নেয়। নায়িকা চরিত্রে ছিলেন লোলিটা বা বুড়ি নামের এক যৌনকর্মী। চারুবালা, দেববালা বা দেবী নামের আরও দুই যৌনকর্মী এতে অভিনয় করেন। হরিমতি নামে একজন অভিনেত্রীও এতে অভিনয় করেন। ১৯৩১ সালে এই চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ঢাকার মুকুল হলে (অধুনা আজাদ হল)। এর প্রিমিয়ার শো উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৮৮৮-১৯৮০)। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯৩৬-১৯৪২) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

বিশিষ্ট সাংবাদিক ওবায়েদ-উল হক দুঃখে যাদের জীবন গড়া (১৯৪৬) প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন হিমাদ্রী চৌধুরী ছদ্মনামে। কলকাতায় চলচ্চিত্রটি নির্মিত হলেও বাংলাদেশের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাংলাদেশী কোনও মুসলিম পরিচালকের হাতে নির্মিত এটি প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র। উদয়ন চৌধুরী ছদ্মনামে ইসমাইল মোহাম্মদ নির্মাণ করেন মানুষের ভগবান (১৯৪৭) চলচ্চিত্রটিও। দেশভাগের পরে এঁরা ঢাকায় ফিরে আসেন এবং চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহ সৃষ্টি করেন। রাজধানী ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রযোজনা-পরিবেশনা প্রতিষ্ঠান এবং স্টুডিও নির্মাণের উদ্যোগ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে নাজীর আহমদ (১৯২৫-১৯৯০) ইন আওয়ার মিডস্ট নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন, যা বাংলাদেশ-ভূথণ্ডের প্রথম তথ্যচিত্র হিসেবে স্বীকৃত।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরের বছর বছর সরকারি প্রচারচিত্র নির্মাণের জন্য জনসংযোগ বিভাগের অধীনে চলচ্চিত্র ইউনিট (১৯৫৩) গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে এখান থেকে নাজীর আহমদের পরিচালনায় নির্মিত হয় প্রামাণ্য চিত্র সালামত

নাজীর আহমদ একাধারে অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা, বেতারকর্মী ও লেখক। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্থপতি শিল্পী হামিদুর রাহমান ছিলেন তাঁর সহোদর। ১৯৫৫ সালে নাজীর আহমদের উদ্যোগে ঢাকায় প্রথম ফিল্ম ল্যাবরেটরি ও স্টুডিও চালু হয়। তিনি পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার প্রথম নির্বাহী পরিচালক হন। তাঁর কাহিনী থেকে ফতেহ লোহানী নির্মাণ করেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র আসিয়া (১৯৬০)। নবারুণ (১৯৬০) নামের একটি প্রামাণ্য চিত্র। নতুন দিগন্ত নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন নাজীর আহমদ।

১৯৫৪ সালে গঠিত হয় ইকবাল ফিল্মস এবং কো-অপারেটিভ ফিল্ম মেকার্স লিমিটেড। ইকবাল ফিল্মস-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মোহাম্মদ মোদাব্বের, মহিউদ্দিন, শহীদুল আলম, আবদুল জব্বার খান, কাজী নুরুজ্জামান প্রমুখ। ড. আবদুস সাদেক, দলিল আহমদ, আজিজুল হক, দুদু মিয়া, কবি জসীমউদ্দীন, কাজী খালেক, সারওয়ার হোসেন প্রমুখ ছিলেন কো-অপারেটিভ ফিল্ম মেকার্স লিমিটেডের সঙ্গে। দলিল আহমেদের পুত্র বুলবুল আহমেদ এবং দুধু মিয়ার পুত্র আলমগীর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।

১৯৫৪ সালে ইকবাল ফিল্মসের ব্যানারে এই ভূখণ্ডের প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ-এর কাজ শুরু করেন আবদুল জব্বার খান। কো-অপারেটিভ ফিল্ম মেকার্সের ব্যানারে স্বল্পদৈর্ঘ্য চিত্রের আপ্যায়ন-এর কাজ শুরু করেন সারোয়ার হোসেন। ১৯৫৫ সালে জুন মাসে তেজগাঁওয়ে সরকারি ফিল্ম স্টুডিও চালু হয়।

১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট আবদুল জব্বার খান পরিচালিত বাংলাদেশের প্রথম সবাক বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ মুক্তি পায়। পরিচালক নিজেই নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। নায়িকা চরিত্রে ছিলেন চট্টগ্রামের পূর্ণিমা সেন। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন ইনাম আহমেদ, নাজমা (পিয়ারী), জহরত আরা, আলী মনসুর, রফিক, নুরুল আনাম খান, সাইফুদ্দীন, বিলকিস বারী প্রমুখ। চিত্রগ্রাহক কিউ.এম জামান, সুরকার সমর দাস, কণ্ঠশিল্পী আবদুল আলীম ও মাহবুবা হাসানাত এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান (বঙ্গবন্ধু, পরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি) উত্থাপিত বিলের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (ইপিএফডিসি) প্রতিষ্ঠিত হলে এর সহযোগিতায় ১৯৫৯ সালে থেকে প্রতিবছর চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে থাকে। ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে এদেশে কোনও চলচ্চিত্র মুক্তি পায় নি। এফডিসি ছাড়াও পপুলার স্টুডিও, বারী স্টুডিও এবং বেঙ্গল স্টুডিও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পরিস্ফুটনে বিরাট ভূমিকা পালন করে।

এফডিসি প্রতিষ্ঠার পরে চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় অনেক যোগ্য ব্যক্তি এগিয়ে আসেন। ১৯৫৯ সালে ফতেহ লোহানীর আকাশ আর মাটি, মহিউদ্দিনের মাটির পাহাড়, এহতেশামের এদেশ তোমার আমার এই তিনটি বাংলা চলচ্চিত্র ছাড়াও এ.জে. কারদারের জাগো হুয়া সাভেরা উর্দু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের শুরুর দশকে নির্মিত ৫টি চলচ্চিত্রের প্রতিটিই নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শিল্পমানে উত্তীর্ণ বলেই চলচ্চিত্রবোদ্ধারা মনে করেন। অর্থাৎ আমাদের চলচ্চিত্রের অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল শুদ্ধতার অঙ্গীকার নিয়েই। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছে সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত। বেবী ইসলামের তানহাও উর্দু ভাষার নির্মিত। এটি ১৯৬০ সালে সেন্সর সার্টিফিকেট পায় কিন্তু মুক্তি পায় কিন্তু মুক্তি পায় পায় ১৯৬৪ সালে।

চলচ্চিত্রের বিষয়-আশয়
চলচ্চিত্র জীবনেরই চিত্রায়ণ। চলচ্চিত্রে বিষয় হিসেবে বেছে নেয়া হয় জীবনেরই খণ্ডচিত্র। সেই জীবনে যেমন ব্যক্তিমানুষের যাপিত কর্মধারা সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, রাগ-অনুরাগ, বিরহ-মিলন থাকে, তেমনি থাকে সামাজিক জীবনের একক হিসেবে পারিবারিক সমস্যা-সংকটের কথা। কেবল ব্যাক্তিক ও পারিবারিক জীবন নয়, সামজিক, রাষ্ট্রিক, ঐতিহাসিক, পৌরাণিক জীবনও হয়ে থাকে চলচ্চিত্রের অন্বিষ্ট বিষয়। এমনকি ফ্যান্টাসি, লোককাহিনী বা ভৌতিক কল্পকাহিনী নিয়েও নির্মিত হতে পারে সার্থক চলচ্চিত্র। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, তাতে কালানুক্রমিক বিবেচনার পাশাপশি বিষয়ভিত্তিক বিবেচনাও কমবেশি গুরুত্ব পেয়েছে। গবেষক মির্জা তারেকুল কাদের বিষয়-বিবেচনা থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে ৮টি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করেছেন। তা হলো, সামাজিক, লোকছবি, যুদ্ধ, ফ্যান্টাসি, থ্রিলার, কমেডি, ঐতিহাসিক ও শিশু। কিন্তু এই বিভাজন পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। যুদ্ধ তো ইতিহাসের অঙ্গ; তাই যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রকে ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রের পর্যায়ে ফেলা যায়। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু একটি বিশাল অধ্যায়, তাই হয়তো মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রকে তিনি আলাদা করে দেখিয়েছেন। কিন্তু কমেডি যদি পৃথক বিষয় হয়, তাহলে ট্রাজেডিও বিষয় হতে পারে। ট্রাজেডি এবং কমেডি — যে কোনও কাহিনীকেই এই দুই মোটাদাগে বিভক্ত করা যায়। সামাজিক চলচ্চিত্রেও কমেডি থাকতে পারে, লোককাহিনীতেও কমেডি থাকতে পারে। তাই কমেডি চলচ্চিত্র হিসেবে পৃথক শ্রেণীকরণে সমস্যা দিতে পারে। ফ্যান্টাসি চলচ্চিত্রও সামাজিক কিংবা লোকজ হতে পারে। তাই এই বিভাজনও স্বাতন্ত্র্য দাবি করতে পারে না। আবার ঐতিহাসিক কাহিনী নয়, কিন্তু রাজনৈতিক চেতনার প্রাবল্য নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এই ধরনের চলচ্চিত্রের শ্রেণীকরণ নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার দাঙ্গা-হাঙ্গামা কিংবা এ্যাকশন নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, যাদেরকে সামজিক ছবি হিসেবে বিবেচনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই চলচ্চিত্রের বিষয়কে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মোট দাগে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে: ১. সামাজিক, ২. রাজনৈতিক/ঐতিহাসিক, ৩. পৌরাণিক/লোককাহিনীভিত্তিক, ৪. এ্যাকশনধর্মী এবং ৫. শিশুতোষ চলচ্চিত্র।

১. সামাজিক বিষয়ভিত্তিক চলচ্চিত্র
সমাজের চলমান ঘটনাকে বিষয় হিসেবে নির্বাচন করা হয় যে চলচ্চিত্রে, তাকে সামাজিক চলচ্চিত্র বলা যেতে পারে। সকল দেশে এই ধারার চলচ্চিত্রের সংখ্যাই বেশি নির্মিত হয়ে থাকে। চলচ্চিত্রের সুস্থ ধারা নির্মাণে এই ধরনের চলচ্চিত্রের ভূমিকা বেশি।

kabari.jpg………
সুভাষ দত্তের সুতরাং ছবিতে কবরী
……..
বাংলাদেশের পূর্বপাকিস্তান পর্বে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র শুরু হয়েছে ডাকাতের কাহিনী নিয়ে। আবদুল জব্বার খান রচিত নাটক ডাকাত-এর চিত্রায়নই মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬)। এই চলচ্চিত্রে পেশাদারিত্বের ছাপ থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে এর গুরুত্ব রয়েছে। গ্রামের এক জোতদার বাবার এক সন্তান ঘটনা-পরম্পায় ডাকাতদলের খপ্পরে পড়ে তাদের মতো বেড়ে ওঠে। আরেক ছেলে পড়ালেখা করে পুলিশ হয়। কিন্তু ডাকাতদলের সঙ্গে পুলিশের সখ্য ছিল। ভাই-ভাই পরিচয় না জানলেও ডাকাত-পুলিশ সম্পর্ক ছিল। এক পর্যায়ে ডাকাত ছেলে তার সর্দারকে খুন করে। গ্রেফতার হয় অসৎ পুলিশ। কাহিনীর পরিণতি বাবার কাছে দুই ছেলেকে ফিরে পাওয়ার মধ্য দিয়ে। কাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। নাটকীয় উপাদান আছে। গ্রামীণ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আছে। আবদুল আলীমের কণ্ঠ আছে। গওহর জামিলের নৃত্য আছে। নায়িকার ভূমিকায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেয়ে আছে। ডাকাত-পুলিশের গল্প থাকায় একধরনের সাসপেন্স আছে। নির্মাণকলার সীমাবদ্ধতা থাকলেও এই চলচ্চিত্রকে অসফল বলার সুযোগ নেই। আবদুল জব্বার খান (১৯১৬-১৯৯৩) জোয়ার এলো (১৯৬২), নাচঘর (উর্দু ১৯৬৩), বাঁশরী (১৯৬৮), কাচ কাটা হীরা (১৯৭০) ও খেলারাম (১৯৭৩) নির্মাণ করে চলচ্চিত্রশিল্পে তাঁর অবদানের স্বাক্ষর রাখেন। উজালা নামে একটি চলচ্চিত্রও তিনি প্রযোজনা করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের চলচ্চিত্র বিভাগের প্রধান হিসেবে আবদুল জব্বার খান কাজ করেন। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য তিনি বাচসাস পুরস্কার, এফডিসি রজত জয়ন্তী পদক, উত্তরণ পদক, হীরালাল সেন স্মৃতি পদক, বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সম্মান পদক, ফিল্ম আর্কাইভ সম্মান প্রতীক ও রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি সম্মান পদক লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের পথিকৃৎ। তাঁর সম্মানার্থে এফডিসি-তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আবদুল জব্বার খান পাঠাগার।

১৯৫৯ সালে আখতার জং কারদার পরিচালিত উর্দুচলচ্চিত্র জাগো হুয়া সাভেরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝির কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত। এটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পুরস্কৃত ও আলোচিত হলেও বাণিজ্যিকভাবে এটি সাফল্য অর্জন করেনি। এই চলচ্চিত্রের প্রধান সহাকারী হিসেবে কাজ করেন জহির রায়হান। একই বছরে এহতেশাম নির্মাণ করেন গ্রামীণ পটভূমিতে এদেশ তোমার আমার। ফতেহ লোহানীর আকাশ আর মাটি এবং মহিউদ্দিনের মাটির পাহাড় — এই বছরের অন্যদুটি চলচ্চিত্র। কারিগরি মানের দিক থেকে চলচ্চিত্রদুটি ভালো হলেও বোম্বে ও লাহোরের চলচ্চিত্রের সঙ্গে লড়াই করে টিকতে পারেনি। ফতেহ লোহানীর আসিয়া (১৯৬০) এবং এহতেশামের রাজধানীর বুকে (১৯৬০) পঞ্চাশের দশকের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র। রাজধানীর বুকে চলচ্চিত্রটি বেশ জনপ্রিয় হয়। আসিয়া বাবসায়িক সাফল্য না-পেলেও এটি প্রেসিডেন্ট পুরস্কার ও নিগার পুরস্কার লাভ করে। গ্রামবাংলার চিরায়ত দৃশ্য নিয়ে জীবনধর্মী এই চলচ্চিত্রটি বোদ্ধা মহলে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। কেউ কেউ একে পথের পাঁচালীর অনুকরণ বলে অভিহিত করে। ফতেহ লোহানী (১৯২০-১৯৭৫) বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অগ্রণী অভিনেতা ও চিত্রপরিচালক। চলচ্চিত্রকার বিমল রায়ের হিন্দি চলচ্চিত্র হামরাহী (১৯৪৫)-তে অভিনয়ে করেন কিরণকুমার ছদ্মনামে। তিনি অভিনয় করেন রঙিলা আর্ট করপোরেশন প্রযোজিত উদয়ন চৌধুরী (ইসমাইল মোহাম্মদ) পরিচালিত জোয়ার নাটকে এবং হিমাদ্রি চৌধুরী (ওবায়েদ-উল হক) পরিচালিত দুঃখে যাদের জীবন গড়া (১৯৪৬) চলচ্চিত্রে। ঢাকা থেকে ১৯৪৯-এ মাসিক সাহিত্য পত্রিকা অগত্যা প্রকাশে তিনি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন। ঐ বছরই তিনি যোগ দেন করাচি বেতারে, পরে বিবিসি-তে। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় ফিরে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে জড়িত হন, পাশাপাশি বেতার অনুষ্ঠান, অভিনয় এবং লেখালেখিতেও অংশ নেন। পরিচালনা ছাড়াও তিনি বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র রাজা এলো শহরে (১৯৬৪)। ফতেহ লোহানী অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে মুক্তির বন্ধন (১৯৪৭), তানহা (১৯৬৪), বেহুলা (১৯৬৬), ফির মিলেন্দে হাম দোনো (১৯৬৬), আগুন নিয়ে খেলা (১৯৬৭), দরশন (১৯৬৭), জুলেখা (১৯৬৭), এতটুকু আশা (১৯৬৮) মোমের আলো (১৯৬৮), মায়ার সংসার (১৯৬৯), মিশর কুমারী (১৯৭০), তানসেন (১৯৭০) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

ষাটের দশকে সালাহ্উদ্দিনের যে নদী মরূপথে (১৯৬১), সূর্যস্নান (১৯৬২) ও ধারাপাত (১৯৬৩) প্রভৃতি সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। জহির রায়হান এই সময়ের উল্লেখযোগ্য পরিচালক। তাঁর কখনো আসেনি (১৯৬১), সোনার কাজল (১৯৬২, কলিম শরাফী সহযোগে), কাচের দেয়াল (১৯৬৩), সঙ্গম (উর্দু ১৯৯৪), বাহানা (উর্দু, ১৯৬৫) এই সময়ের উজ্জ্বল সৃষ্টি। উর্দু চলচ্চিত্রের দিকে ঝুঁকেও তিনি আবার চোখ ফেরালেন লোকজ কাহিনীর দিকে। এরপর তিনি আনোয়ারা (১৯৬৭) নির্মাণ করেন।

ষাটের দশকেই কীর্তিমান পরিচালক হিসেবে আবির্ভূত হন খান আতাউর রহমান (১৯২৯-১৯৯৭)। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কেবল পরিচালক নন, অভিনেতা, কাহিনীকার, কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার হিসেবে খ্যাতিমান। তাঁর জন্ম মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর থানার রামকান্তপুর গ্রামে, মৃত্যু ঢাকায়। তিনি ১৯৫০ সালে করাচি বেতারে চাকরি করতেন। এসময় ওস্তাদ জহুরী খানের কাছে সংগীতে তামিল নেন। সেখান থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি লন্ডনে কিছুদিন শিক্ষাগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় ফিরে এ.জে কারদারের জাগো হুয়া সাভেরা চলচ্চিত্রে প্রখ্যাত অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে প্রধান চরিত্রে রূপদান করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি অনেক দিনের চেনা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচালক হিসেব আবির্ভূত হন। তাঁর পরিচালিত রাজ সন্ন্যাসীআবার তোরা মানুষ হসুজন সখীদিন যায় কথা থাকেএখনও অনেক রাত প্রভৃতি চলচ্চিত্র বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। তিনি প্রায় পাঁচশশত গান রচনা করেন ও সুর সংযোজন করেন। বাংলাদেশের সংগীতের জগতে তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চার্য। চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃত-স্বরূপ তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও পাকিস্তান, মস্কো ও তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসব পুরস্কার লাভ করেন।

স্বাধীনতার পরে আবির্ভূত চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে আলমগীর কবির (১৯৩৮-১৯৮৯) উল্লেখযোগ্য। পিতৃপৃরুষের বাড়ি বরিশালে হলেও তাঁর জন্ম রাঙ্গামাটি শহরে। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র হলো ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), সূর্যকন্যা (১৯৭৬), সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭), রূপালী সৈকতে (১৯৭৯), মোহনা (১৯৮২), পরিণীতা (১৯৮৪) ও মহানায়ক (১৯৮৫)।

স্বাধীনতার বছর ১৯৭১ সালে এদেশে ৮টি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এর মধ্যে নজরুল ইসলামের স্বরলিপি, অশোক ঘোষের নাচের পুতুল, আলমগীর কুমকুমের স্মৃতিটুকু থাক এবং খান আতাউর রহমানের সুখ দুঃখ সামাজিক চলচ্চিত্র হিসেবে উল্লেখযোগ্য।

১৯৭২ সালে আলমগীর কবিরের ধীরে বহে মেঘনা, জহিরুল হকের রংবাজ, সুভাষ দত্তের বলাকা মন, ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশেষ মানে উন্নীত করে। এই সুস্থ ও সৃজনশীল ধারায় ১৯৭৪ সালে নির্মিত হয় নারায়ণ ঘোষ মিতার আলোর মিছিল। ১৯৭৫ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতার লাঠিয়াল, খান আতার সুজন সখী এই ধারারই প্রবাহ। ১৯৭৬ সালে ছয়টি চলচ্চিত্র বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ধারণাকেই পাল্টে দেয়। যেমন রাজেন তরফদারের পালঙ্ক, হারুনর রশীদের মেঘের অনেক রঙ, আলমগীর কবিরের সূর্যকন্যা, কবীর আনোয়ারের সুপ্রভাত, আবদুস সামাদের সূর্যগ্রহণ এবং আমজাদ হোসেনের নয়নমণি। ১৯৭৭ সালে আলমগীর কবিরের সীমানা পেরিয়ে, সুভাষ দত্তের বসুন্ধরা পরিচ্ছন্নতা ও সুস্থতার দাবিদার। ১৯৭৮ সালে আমজাদ হোসেনের গোলাপী এখন ট্রেনে এবং আবদুল্লাহ আল মামুনের সারেং বৌ শিল্পসফল চলচ্চিত্র হিসেবে নন্দিত। স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয় ১৯৭৯ সালে। মসিউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর যৌথ নির্মাণ সূর্য দীঘল বাড়ি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচয় করিয়ে দেয়। আলমগীর কবিরে রূপালী সৈকতেও এই সময়ের উৎকৃষ্ট চলচ্চিত্র। সত্তর দশক ও আশির শুরুতে সময়ে নির্মিত চলচ্চিত্র জহিরুল হকের রংবাজ (১৯৭৬), প্রাণসজনী (১৯৮২), রুহুল আমিনের বেইমান (১৯১৯৭৪), অশোক ঘোষের নাচের পুতুল (১৯৭১), সিবি জামানের শুভরাত্রি (৯১৮৫), বেবী ইসলামের চরিত্রহীন (১৯৭৫), নজরুল ইসলামের স্বরলিপি (১৯৭১), আবদুল রতিফ বাচ্চুর যাদুর বাঁশি (১৯৭৭), আবদুল্লাহ আল মামুনের সখি তুমি কার (১৯৮০), এখনই সময় (১৯৮০), সৈয়দ হাসান ইমামের লাল সবুজের পালা (১৯৮০) প্রভৃতি সম্পর্কে গবেষক আহমাদ মাযহার মন্তব্য করেছেন ‘কোনও কোনওটি বাংলাদেশের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত কমবেশি তুলে ধরেছে। শৈল্পিক দিক থেকে এগুলো তেমন উন্নত মানের না হলেও এগুলো ভালো ছবি হিসেবেই দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল।’ ১৯৮০ সালে আমজাদ হোসেনের কসাই, দিলীপ সোমের স্মৃতি তুমি বেদনা দর্শকপ্রিয়তা লাভ করতে সমর্থ হয়। আশির দশকের শুরুতেই আমাদের চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার পথে যাত্রা শুরু করে।

১৯৮১ সালে আমজাদ হোসেনের জন্ম থেকে জ্বলছি চলচ্চিত্রের সুস্থ মেজাজ বজায় রাখে। ১৯৮২ সালে চাষী নজরুল ইসলামের দেবদাস, মোস্তফা আনোয়ারের কাজল লতা, আবদুস সামাদ খোকনের বড় বাড়ির মেয়ে, মতিন রহমানের লাল কাজল, আলমগীর কবিরের মোহনা সকল অর্থে সুস্থধারার সামাজিক চলচ্চিত্র। ১৯৮৩ সালে সিবি জামানের পুরস্কার ও এজে মিন্টুর মান সম্মান, সুভাষ দত্তের নাজমা চলচ্চিত্র চলনসই।

১৯৮৪ সালে আখতারুজ্জামানের প্রিন্সেস টিনা খান, কাজী হায়াতের রাজবাড়ি, কামাল আহমেদের গৃহলক্ষ্মী, সুভাষ দত্তের সকাল সন্ধ্যা, চাষী নজরুল ইসলামের চন্দ্রনাথ, আমজাদ হোসেনের সখিনার যুদ্ধ ও ভাত দে
১৯৮৫ সালে শক্তি সামন্ত ও সৈয়দ হাসান ইমামের অবিচার, শেখ নিয়ামত আলীর দহন, রাজ্জাকের সৎভাই ও শহিদুল আমিনের রামের সুমতি দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। আশির দশকের শেষার্ধে সুভাষ দত্তের ফুলশয্যা (১৯৮৬), আলমগীর কবিরের পরিণীতা (১৯৮৬), চাষী নজরুল ইসলামের শুভদা, বুলবুল আহমেদের রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত (১৯৮৭), নারায়ণ ঘোষ মিতার হারানো সুর (১৯৮৭), আফতাব খান টুলুর দায়ী কে (১৯৮৭), কবীর আনোয়ারের তোলপাড় (১৯৮৮), মহিউদ্দিন ফারুকের বিরাজবৌ (১৯৮৮) এবং নব্বই দশকের প্রথমার্ধে সৈয়দ সালাহ্উদ্দিন জাকীর আয়না বিবির পালা (১৯৯১), এহতেশামের চাঁদনী (১৯৯১) প্রভৃতি চলচ্চিত্র আলোচিত হয়েছে।

চাষী নজরুল ইসলামের হাসন রাজা, তানভীর মোকাম্মেলের লালন (২০০৪), মোরশেদুল ইসলামের দুখাইলালসালু, আখতারুজ্জামানের পোকামাকড়ের ঘরবসতি, তারেক মাসুদের মাটির ময়না (২০০২), কাজী মোরশেদের ঘানি (২০০৮) উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সামজিক বিষয়কে অবলম্বন করে নির্মিত এই চলচ্চিত্রগুলো নির্মাণ-কুশলতায় বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে।

২. রাজনৈতিক/ঐতিহাসিক বিষয়ভিত্তিক চলচ্চিত্র
রাজনৈতিক ঘটনা কিংবা ইতিহাসের ঘটনা ও চরিত্র নিয়ে আমাদের দেশে বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ষাটের দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও গণমানুষের প্রত্যাশার কথা রূপায়িত হতে শুরু করে। তারই চূড়ান্ত শিল্পসিদ্ধি জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)। সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে জহির রায়হান যে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করলেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তা মাইলফলক হিসেবে রয়েছে। কিন্তু অগণতান্ত্রিক সরকার এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি দিতে গড়িমসি করলে রাজপথে মিছিল হয়। এক পর্যায়ে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গণচেতনার প্রতিফলন হিসেবে এই চলচ্চিত্রটি উল্লেখযোগ্য নির্মাণ। এই চলচ্চিত্র সম্পর্কে আলমগীর কবীরের মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য: In his attempt to present country’s first politically committed film he invited multi-level opposition from the Pakistani ruling clique.৪

সাম্যবাদী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সৃজনশীল সাহিত্যিক হিসেবে সুরুচির কারণে তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্রই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষ যুক্ত ছিলেন। সাহিত্যের জন্য তাঁকে আদমজী পুরস্কার ও বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রদান করা হয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি লেট দেয়ার বি লাইট নামে একটি দ্বিভাষিক চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। তাঁর আর কতদিন উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে এর কাহিনী বিন্যস্ত। চলচ্চিত্রটি অসমাপ্ত রয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশে গণহত্যার দৃশ্য নিয়ে স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১) নির্মাণ করেন। ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর তিনি ভাই সাহিত্যিক-সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে আর ঘরে ফেরেননি। ধারণা করা হয় স্বাধীনতাবিরোধীরা তাঁকে হত্যা করেছে।

আলমগীর কবীরের সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭) চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক বক্তব্য খুব সূক্ষ্মভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। বিশেষত শ্রেণীদ্বন্দ্বের কথা তুলে ধরা হয়েছে। রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে আলমগীর কবিরের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার্য। লিবারেশন ফাইটারএক সাগর রক্তের বিনিময়ে প্রভৃতি চলচ্চিত্র বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অমূল্য নির্মাণ।

১৯৭২ সালে সদ্যস্বাধীন দেশে মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলামের ওরা এগারো জন, সুভাষ দত্তের অরুণোদয়ের অগ্নিস্বাক্ষী, মমতাজ আলীর রক্তাক্ত বাংলা, আনন্দর বাঘা বাঙ্গালী উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের সাধু প্রচেষ্টা দেশপ্রেমেরই প্রকাশবহ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী ও ঘটনাপ্রকাশক চলচ্চিত্র এর পরেও নির্মিত হয়। ১৯৭৩ সালে নির্মিত আলমগীর কুমকুমের আমার জন্মভূমি ও খান আতার আবার তোরা মানুষ হ চলচ্চিত্রের বিষয়ও মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ১৯৭৪ সালে নির্মিত চাষী নজরুল ইসলামের সংগ্রামও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপ্রসূত। মোহাম্মদ আলীর বাংলার ২৪ বছর ও কার হাসি কে হাসে চলচ্চিত্রের বিষয়ও রাজনৈতিক। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে পেছনে রেখে হারুনর রশীদ যে মেঘের অনেক রঙ (১৯৭৬) নির্মাণ করেছেন আমাদের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তা গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮১ সালের এজে মিন্টুর বাঁধন হারাকলমীলতা, ১৯৮২ সালে মতিন রহমানের চিৎকার, ১৯৯৩ সালে নাসিরউদ্দিন ইউসুফের একাত্তরের যীশু, ১৯৯৪ সালে হুমায়ুন আহমেদের আগুনের পরশমণি, ১৯৯৬ সালে তানভীর মোকাম্মেলের চিত্রানদীর পাড়ে, ১৯৯৭ সালে খান আতার এখনো অনেক রাত, চাষী নজরুল ইসলামের হাঙর নদী গ্রেনেড মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এছাড়া নবাব সিরাজউদ্দৌলা প্রভৃতি চলচ্চিত্রেও ইতিহাসের চরিত্রকে উপস্থাপন করা হয়েছে।

৩. পৌরাণিক/লোককাহিনীভিত্তিক চলচ্চিত্র:
বাঙালির জীবনের সুখ-দুঃখের কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি সালাহ্উদ্দিন(১৯২৬-২০০৩) রূপবান (১৯৬৫) ও আলোমতি (১৯৬৯) চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন লোকজ কাহিনী নিয়ে। সালাহ্উদ্দিনই চলচ্চিত্রের জন্যে লোককাহিনীকে প্রথম বিবেচনা করেন। তাঁর পরিচালনায় ১৯৬৫ সালের ৫ নবেম্বর মুক্তি পায় রূপবান। তিনি পরের বছরই (১৯৬৬) রূপবান চলচ্চিত্রকে উর্দুভাষায় রূপান্তর করলেন। ১৯৬৬ সালে সফদার আলী ভুঁইয়ার রহিম বাদশা ও রূপবান, খান আতাউর রহমানের রাজা সন্ন্যাসী ইবনে মিজানের আবার বনবাসে রূপবান, সৈয়দ আউয়ালের গুনাইবিবি, বজলুর রহমানের গুনাই, আলী মনসুরের মহুয়া, রওনক চৌধুরীর ভাওয়াল সন্ন্যাসী, জহির রায়হানের বেহুলা নজরুল ইসলামের আপন দুলাল, ইবনে মিজানের জরিনা সুন্দরী এই ধারার চলচ্চিত্র।

১৯৬৭ সালে প্রাচী গোষ্ঠী পরিচালিত হীরামন চলচ্চিত্রটি রূপকথার কাহিনীর রূপায়ণ। ইবনে মিজানের জংলী মেয়ে, সফদার আলী ভুঁইয়ার কাঞ্চনমালা, আজিজুর রহমানের সাইফুলমূলক বদিউজ্জামাল, নজরুল ইসলামের আলীবাবাও এই ধারার চলচ্চিত্র। ১৯৬৮ সালে আজিজুর রহমানের মধুমালা, ইবনে মিজানের রাখাল বন্ধু, খান আতাউর রহমানের সাত ভাই চম্পা, রহিম আফরোজের সুয়োরানী দুয়োরানী, খান আতাউর রহমানের অরুণ বরুণ কিরণমালা, ইআর খানের রূপবানের রূপকথা চলচ্চিত্রগুলো লোককাহিনীর উপর ভিত্তি করে নির্মিত। ১৯৬৯ সালে মহিউদ্দিনের গাজী কালু চম্পাবতী, সালাহ্উদ্দিনের আলোমতি, নুরুল হকের বেদের মেয়ে এবং ফাল্গুনী গোষ্ঠীর পরিচালিত মলুয়া চলচ্চিত্র এই ধারার উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

১৯৭০ সালে দিলীপ সোমের মণিমালা এবং ইবনে মিজানের আমীর সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরী, ১৯৭২ সালে সিরাজুল ইসলামের নিমাই সন্ন্যাসী ও সৈয়দ হাসান ইমামের লালন ফকিরকে লোকজ আবেদনময় চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ১৯৭৪ সালে বজলুর রহমানের গোপাল ভাঁড় ও ফয়েজ চৌধুরীর মালকা বানুতে কিছু ফোকফ্যান্টাসি খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৭৬ সালে সফদর আলী ভুঁইয়ার কাজলরেখা, ১৯৭৯ সালে শেখ নজরুল ইসলামের নদের চাঁদ, ইবনে মিজানের নাগনাগিনী, আজিজুর রহমানের সাম্পানওয়ালা লোকজ কাহিনীতে অঙ্গীকার করেন।

১৯৮০ সালে এফ কবীর চৌধুরীর আলিফ লায়লা, ১৯৮১ সালে শফি বিক্রমপুরীর আলাদিন আলিবাবা সিন্দাবাদ, ১৯৮২ সালে নাজমূল হুদা মিটুর মধুমালতী, এফ কবীর চৌধুরীর পদ্মাবতী, সফদার আলী ভুঁইয়ার রসের বাইদানী, ১৯৮৩ সালে ইবনে মিজানের লাইলী মজনু, ১৯৮৫ সালে মতিন রায়হানের রাধাকুষ্ণ, মহম্মদ হান্নানের রাই বিনোদিনী, আজিজুর রহমানের রঙ্গীন রূপবান, হারুনর রশীদের গুনাই বিবি, ১৯৮৬ সালে আবদুস সামাদের শিরি ফরহাদ, এমএ মালেকের চাঁদ সওদাগর, মতিউর রহমান বাদলের চন্দ্রাবতী, ১৯৮৭ সালে রফিকুল বারী চৌধুরীর চণ্ডীদাস ও রজকিনী, শামসুদ্দীন টগরের মহুয়াসুন্দরী, ১৯৮৮ সালে আজিজুর রহমানের কাঞ্চনমালা, চাষী নজরুল ইসলামের বেহুলা লক্ষীন্দর চলচ্চিত্রের কাহিনী লোকগাথা থেকে নেয় হয়েছে। তোজাম্মেল হক বকুলের বেদের মেয়ে জোসনা চলচ্চিত্র জনপ্রিয়তার শীর্ষ স্পর্শ করে। একই বছর সাইদুর রহমান সাইদের আলোমতি প্রেমকুমার ও ইবনে মিজানের আপন দুলাল মুক্তি পায়। ১৯৯১ সালে কামরুজ্জামানের রঙ্গিন মালকা বানু, ফয়েজ চৌধুরীর রাজার মেয়ে বেদেনী, সাইদুর রহমান সাইদের মধুমালা মদনকুমার, ১৯৯২ সালে মুক্তি পায় তোজাম্মেল হক বকুলের রঙ্গিলা, আলমগীর আজমের জেলের মেয়ে রোশনী, তোজাম্মেল হক বকুলের গাড়িয়ালভাই প্রভৃতি চলচ্চিত্র লোকজ ধারা অবলমআবন করে।

১৯৯৩ সালে বেদকন্যা পক্ষীরানীগহর বাদশা বানেছা পরীনাচনাগিনী নাচনয়া বাইদানীনয়া লায়লা নয়া মজনু, ১৯৯৪ সালে নাগপঞ্চমীরূপনগরের রাজকন্যা, ১৯৯৬ সালে নাগনর্তকী, ১৯৯৭ সালে কমলার বনবাস, ১৯৯৯ সালে মোহন মালার বনবাস, ২০০৪ সালে খায়রুন সুন্দরী, ২০০৬ সালে রঙ্গিন রসের বাইদানীরাঙা বাইদানী, ২০০৭ সালে জমেলা সুন্দরী লোকজ আবহ সৃষ্টি করার জন্য নির্মিত হয়েছে। এই সকল চলচ্চিত্র সকল ক্ষেত্রে প্রচলিত লোককাহিনীকে অবলম্বন করেছে এমন ভাবার কারণ নেই। অনেক ক্ষেত্রে কবাল্পনিক ও উদ্ভট কাহিনী নিয়েও তৈরি হয়েছে এ ধরনের চলচ্চিত্র।

৪. অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্র:
চলচ্চিত্র-গবেষক মির্জা তারেকুল কাদেরের ভাষায় ১৯৮১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অধিকাংশ চলচ্চিত্রই কুরুচিপূর্ণ নৃত্যগীত, ভায়োলেন্স ও মারপিটে ভরপুর এবং উদ্ভট কাহিনীনির্ভর চলচ্চিত্র। এই মন্তব্য সর্বতোভাবে ঠিক নয়।এগুলোর মধ্যে এফ কবীর চৌধুরীর সুলতানা ডাকু, ইবনে মিজানের রাজনর্তকী প্রভৃতি কয়েকটি চলচ্চিত্র কুরুচিপূর্ণ নৃত্যগীত, ভায়োলেন্স ও মারপিট থাকলেও এই বছরের নির্মিত দিলীপ বিশ্বাসের অংশীদার, মিতার সুখের সংসার, আবদুস সামাদ খোকনের মাটির পুতুল, নূরুল হক বাচ্চুর দেনা পাওনা, চাষী নজরুল ইসলামের ভালো মানুষ, ফখরুল হাসান বৈরাগীর বিনিসুতোর মালা, শহীদুল ইসলাম খোকনের কলমিলতা, আমজাদ হোসেনের জন্ম থেকে জ্বলছি, সৈয়দ হাসান ইমামের লাল সমবুজের পালা চলচ্চিত্রকে অমনভাবে দোষারোপ করা যায় না। শোষেক্তি চলচ্চিত্রদুটিকে অবশ্য তিনি ব্যতিক্রমধর্মী চলচ্চিত্র হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে একথা ঠিক যে, আশির দশকের শুরু থেকেই অ্যাকশনধর্মী চরচ্চিত্রের জোয়ার শুরু হয়, অশ্লীলতাও শুরু হয় এই সময়ে।

১৯৮২ সালে এসএম শফির ডার্লিং, এফ কবীর চৌধুরীর সওদাগর, ইলতুৎমিশের মাই লাভ এবং ১৯৮৩ সালে এফ কবীর চৌধুরীর আবে হায়াৎশামসুদ্দীন টগরের বানজারান (১৯৮৩), দেওয়ান নজরুল ইসলামের জনি, এজে মিন্টুর চ্যালেঞ্জ, জহিরুল হকের চেনামুখ প্রভৃতি অ্যাকশন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে উদ্ভট কাহিনী, জমকালো পোশাক, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির চর্চা বৃদ্ধি পায়।

১৯৮৪ সালে মারদাঙ্গা-অশ্লীলতার জোয়ারের মধ্যেও কেউ কেউ সুস্থতার সন্ধান করেছেন । তবু মোতালেব হোসেনের সালতানাৎ, আল মাসুদের সিআইডি, মমতাজ আলী খানের নসিব এফ কবীর চৌধুরীর পদ্মাবতী প্রভৃতি চলচ্চিত্র সুস্থ ধারাকে ব্যাহত করে।

নব্বই দশকে এসে অ্যাকশনের নামে অশ্লীলতা চূড়ান্ত রূপ পায়। বিশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে প্রায় দুই দশকে মূলধারার চলচ্চিত্র বিকৃতি ও অশ্লীলতার কাছে ক্রমশ পরাজিত হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধঃপতনের আছর চলচ্চিত্রশিল্পের গায়েও পড়েছে। এই সময়ে চলচ্চিত্র নিয়ে ড. গীতিআরা নাসরীন ও ফাহমিদুল হকের পর্যবেক্ষণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ: ‌

‘আজকের সন্ত্রাসী, কুখ্যাত সন্ত্রাসী, ঢাকাইয়া মাস্তান, গোলাগুলি, বোমাহামলা, খুনী শিকদার, সিটি টেরর, কোপা শামছু, দুর্ধর্ষ খুনী ইত্যাদি অনেক নাম করা যাবে যেসব নাম প্রমাণ করে কয়েকটি গান, কয়েকটি প্রেমের দৃশ্য তুলে দিলে এসব ছবিতে সহিংসতা ছাড়া আর কিছুই থাকে না।’

অশ্লীলতা ও সহিংসতার প্রয়োগে বাঙালি দর্শক প্রেক্ষাগৃহের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।আবার স্যাটেলাইট প্রযুক্তির যুগে মানুষ ঘরে বসেই চলচ্চিত্র দেখতে পারে বলে তারা প্রেক্ষাগৃহে যেতে চাইছে না। তাই মানুষকে প্রেক্ষাগৃহে টেনে নেয়ার উপায় হিসেবে অশ্লীল ও রগরগে কাহিনী আমদানি হয় বলে অনেকে ধারণা করে। কিন্তু গোটা চলচ্চিত্রশিল্পই এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে, তা নিয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। ডেঞ্জার মিশনওরে বাবাবাঘের বাচ্চানয়া কসাইইমানদার মাস্তানঠেকাও বিচ্ছুজ্যান্ত লাশরংবাজ বাদশাগজব প্রভৃতি চলচ্চিত্র অধোগামিতার নিদর্শন হতে পারে।

৫. শিশুতোষ চলচ্চিত্র
শিশুদের উপযোগী কাহিনী কিংবা শিশুচরিত্রকে প্রাধান্য দিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রকে শিশুতোষ চরচ্চিত্র বলা যেতে পারে। স্বাধীনতার আগে ফজলুল হক পরিচালিত সান অব পাকিস্তান (১৯৬৬)-ই একমাত্র শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃত। এডভেঞ্চার কাহিনীভিত্তিক এই চলচ্চিত্রটি সিনেমাহলে তেমন চলেনি। তবে বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে এইট গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পরে ড. আশ্রাফ সিদ্দিকীর স্কুলপাঠ্য গল্প গলির ধারের ছেলেটির চলচ্চিত্রায়ণ করেন খ্যাতিমান পরিচালক সুভাষ দত্ত । ছোটদের জন্যে এটি নির্মিত হয়নি। কিন্তু দারিদ্র্যক্লিষ্ট এক কিশোরের জীবনকাহিনী বর্ণিত হওয়াও এটি শিশুকিশোরদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।

শিশুদের জন্যে চলচ্চিত্র নির্মাণ ১৯৮০ সালে শিশুতোষ চলচ্চিত্রের জন্য সুবর্ণ সময়। আজিজুর রহমানের ছুটির ঘণ্টা, বাদল রহমানের এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী এবং সালাউদ্দিন জাকীর ঘুড্ডি, খান আতাউর রহমানের ডানপিটে ছেলে নামের চারটি চলচ্চিত্রই শিশুদের মনে দাগ কাটার মতো চলচ্চিত্র। এই ধারায় আরো বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয় শিশুদের উপযোগ কাহিনী নিয়ে। খান আতাউর রহমানের একঝাঁক পাখি (১৯৮৭),রিপোর্ট কার্ড (১৯৮৮), সালাহউদ্দিন জাকীর গল্প দাদুর কথা (১৯৮২), আবদুল লতিফ বাচ্চুর লাল বেলুন (১৯৮৪), শেখ নিয়ামত আলীর রানীখালের সাঁকো (১৯৯০), রফিকুল বারী চৌধুরীর বাংলা মায়ের দামাল ছেলে (১৯৯৭), বাদল রহমানের কাঁঠালবুড়ির বাগান (১৯৯০), জাঁনেসার ওসমানের দুর্জয় (১৯৯৫), মোরশেদুল ইসলামের শরৎ ৭১ (২০০০) প্রভৃতি চলচ্চিত্র দৈর্ঘ্যে স্বল্প হলেও শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। ছোটদের উপযোগী চলচ্চিত্র হিসেবে মোরশেদুল ইসলামের দিপু নাম্বার টু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

সংহারের আগে
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বিষয়ভিত্তিক ধারাবিচার করতে হলে প্রায় প্রতিটির চলচ্চিত্রের পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন সময়-পরিসরে চলচ্চিত্র দর্শন এবং চলচ্চিত্র সম্পর্কিত আলোচনা-সমালোচনা থেকে আমাদের এই প্রতীতির সৃষ্টি হয়েছে যে, চলচ্চিত্র সমালোচনার ধারা সবল হলেও হয়তো আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প কিছুটা শিল্পপথে অগ্রসর হতে হতে পারতো। সীমিত দর্শক এবং আকাশ-সংস্কৃতির এই তারকাযুগে এখনো দেশে নতুন চলচ্চিত্র নির্মিত হয় এবং এখনো প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়, সেটাও সৌভাগ্যের।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত