| 26 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-১৫) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

 এবার কিছু পাড়া থেকে পাওয়া আনন্দের কথা বলি।মাঝেমাঝেই বিশেষ দিনে রাতে মাঠে আলো জ্বেলে পাড়ায় ফুটবল, ক্রিকেট খেলা হত।তাতে অংশ নিতেন কম বয়সী, বেশি বয়সী পাড়ার মানুষজন। তখন আমরা নেহাতই দর্শক। গরম বা পুজোয় স্কুলের লম্বা ছুটিতে কখনও কখনও দিনের বেলাতেই, ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের ‘গাদি’ বা ‘ কবাডি’ খেলাও হয়েছে।যদিও বয়সজনিত কারণে আমরা প্রায়শঃই বাদ যেতাম। অবশ্য সেসময়, আমাদের অন্য খেলা ছিল। বিকেলে পাড়ার বড়মাঠে দলবেঁধে একসঙ্গে ডাংগুলি,কবাডি, বুড়িবসন্ত  খেলেছি।

 লোডশেডিং হলে পাড়ার ছেলেমেয়েরা মিলে একসঙ্গে গঙ্গা স্নানে যাওয়ার মজার কথা না বললেই নয়। শুধুমাত্র একটি গামছা সম্বল করে হইহই করে সেই স্নান করতে যাবার সময় একে অপরকে বাড়ি থেকে ডাকার ছবি, আজও আমার স্মৃতিতে ভাসে।

সেসময় একটা অদ্ভুত ঐক্য মনের মধ্যে কাজ করত।  সেটা খুব সাধারণ আবার অসাধারণও বটে। সেটি হল ‘আমরা সবাই এক পাড়াতেই  থাকি…..।”

তখন পাড়ার সবাই মিলে আনন্দ করার রেওয়াজ ছিল।বাড়ি-র বড়রা অবশ্য দুঃখ করে বলতেন, “কোথায় আর সেই আন্তরিকতা আছে?সবই তো যেতে বসেছে।”

তারা পুরনো দিনের গল্প বলতেন, “আগে পাড়ায় কোন বিয়ে হলে বাড়ি শুদ্ধু সবাইকার বিয়ে দেখতে যাবার নেমন্তন্ন হত। আমরা অমনি ভাল কাপড়ে সেজেগুজে বাড়ি শুদ্ধু সবাই মিলে বিয়ে দেখতে যেতাম। পাড়ার সবাইকে খাওয়ানোর সঙ্গতি হয়ত নেই। কিন্তু নেমন্তন্ন না খেলেও, তাতে কিছু এসে যেতনা। পাড়ার কাকা,কাকিমা,জ্যেঠিমা,ঠাকুমারা বিয়েতে উপস্থিত থাকবেন না, এ ভাবাই যেতনা।”


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,বাড়ি


আমাদের সময়েও দেখেছি,পাড়ার কোন বাড়ি-র বিয়ে পৈতের অনুষ্ঠানে পাড়াশুদ্ধু লোক ঝাঁপিয়ে পড়ে সব কাজ করে দিচ্ছে। রান্নার আনাজপাতি কোটা,পান সাজার কাজে পাড়ার মহিলারা নেমে পড়েছেন।আর রাতে কোমর বেঁধে পরিবেশনের দায়িত্ব নিয়েছে পাড়ার পুরুষমানুষেরা।

সারাবছরের মধ্যে আমাদের পাড়ায় একটা দিন বিশেষ রকমের আনন্দে কাটত। সেই দিনটি ছিল পাড়ার ফিস্টের দিন। সরস্বতী পুজোর পরে পাড়ায় পাড়ায় আলুরদম ফিস্টের রেওয়াজ ছিল। আলুরদম মানে শুধুই আলুরদম,আর তা খাওয়া হবে পেটভরে।কেউ কেউ বাড়ি থেকে হাতে গড়া রুটিও নিয়ে আসবে।তবে আমরা ছোটরা শুধুই আলুরদম খাব,কব্জি ডুবিয়ে।আর ঝাল ঝাল সেই আলুরদম খেয়ে মুখে হুস্‌হাস্‌ আওয়াজ তুলব।

 বস্তা করে অনেক খোসা ওঠা নতুন আলু আসত।মাঠর একপাশে চটের ওপর বসে চটে বা ঝুড়িতে ঘসে ঘসে আমরা সেসব আলু ছাড়াতাম।পাড়ার কমবয়সী  ছেলেদের মধ্যে কেউ কেউ ভালো রান্না করতে পারত।বানানো উনুনে বড় বড় কড়ায় সেই আলুরদম রান্না হত।পিঁয়াজ দেওয়া সেই আলুরদমের স্বাদ ছিল অপূর্ব! হয়ত নুন একটু কম,কিংবা নুন একটু বেশি।সেসব ফারাক আমরা বুঝতাম না।উনুন গড়া,বাগানের চারধার ঘিরে চটের পাঁচিল দেওয়া, কিংবা আলু ছাড়িয়ে কেটে বালতিতে ফেলা ,সব পর্বেই আমরা সমান উত্তেজিত হয়ে থাকতাম।


আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-১৪) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়


এখনও মনে পড়ে ফিস্টের মাঠে পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা মিলে আলু ছাড়াবার দৃশ্য, সন্ধে হয়ে যাবার পরেও ঘুরে ঘুরে সবার একসঙ্গে খেলা করার কথা, আর রাতে ঘুমচোখে ঝাল ঝাল আলুরদম খেয়ে ক্রমাগত নাকের জলে চোখের জলে হয়ে  গলায় আওয়াজ তোলার কথা। কোন অজ্ঞাত কারণে মায়েরা খোলা মাঠের ওই ফিস্টে  আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারত না।তাদের জন্য কলাই বা কাঁসার শানকি নিয়ে বাড়ির ছোটরা এসে আলুর দম চেয়ে নিয়ে যেত।আমরা বারবার বায়না করেও তাদের মাঠে নিয়ে যেতে পারিনি।

বিকেলে, রোদ পড়ে এলে, পাড়ার সবচেয়ে বড় আড্ডার আসর বসত রকে।অনেক বাড়ি-র সামনেই ছিল রক। সেখানে এসে বিভিন্ন বয়সের মানুষ দল পাকিয়ে বসে গল্পগাছা করতেন। শ্রদ্ধেয় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদার গল্পে আমরা দেখেছি পাড়ার রকে টেনিদাকে তার দলবল নিয়ে আড্ডা মারতে।সে শুধুই গল্পকথা নয়। দশ থেকে পঞ্চাশ, সব বয়সের মানুষই তাদের দলের লোকজন নিয়ে আড্ডা দিতেন রকে।কখনও কখনও বয়স মিলেমিশে যেত।মানে দেখা যেত পাঁচ বছরের বাচ্চা আর নব্বই বছরের বুড়ো একই রকে বসে, আর জোর আড্ডা চলছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত