| 27 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমা আন্দোলন: জমা, খরচ ও ইজা

আনুমানিক পঠনকাল: 31 মিনিট

ভালো ছবি এদেশে আগেও হয়েছে-“নদী ও নারী”, “কাঁচের দেয়াল”, “সূর্য দীঘল বাড়ী”, “ধীরে বহে মেঘনা”। কিন্তু কোনো দেশে কয়েকটা ভালো ছবি তৈরী হলেই সেটাকে ঠিক আন্দোলন বলা যায় না। আন্দোলনের অভীধা তখনই দেয়া যেতে পারে যখন ছবিগুলির মাঝে কোনো একটা বিশেষ ধারা, একটা দৃষ্টিভঙ্গি, সাংগঠনিক নেতৃত্ব ও কিছু সচেতন ও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে সেরকমটি তখনই ঘটল যখন আশির দশকে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কিছু তরুণ কর্মী ১৬ মি:মি:-য়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনের একটা সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উপস্থিত হলেন। এসব ছবিগুলির বিষয়বস্তু থেকে নির্মাণ পদ্ধতি, মায় প্রদর্শন ব্যবস্থা, সব কিছুই ছিল-বিকল্প। ছবিগুলির বিষয়বস্তুগুলো ছিল একেবারেই নতুন-গরুর গাড়ীতে করে একটা মৃতদেহ নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘোরা হচ্ছে মৃতদেহটিকে তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে-“চাকা”, কিম্বা পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ববঙ্গের একটা মফস্বল শহরে একটা হিন্দু পরিবারের জীবনে কী বিপর্যয় নেমে এল-“চিত্রা নদীর পারে”। মূলধারার চলচ্চিত্র এ ধরণের বিষয় নিয়ে ছবি তৈরীর কথা কখনোই ভাবত না। আর এফডিসি-র প্রচলিত ৩৫ মি: মি:-য়ের বাইরে যেয়ে ১৬ মি:মি:-য়ে এসব কাহিনীছবির নির্মাণ ছিল একেবারেই অভিনব এক ঘটনা। এসব ছবির প্রদর্শনও ঘটেছে বিকল্পভাবে। সিনেমা হলের বাইরে ভাড়া করা কোনো মিলনায়তনে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে বা ক্লাসরুমে, এমন কী গ্রামের খোলা মাঠেও। সব বিচারেই এসব সিনেমা ছিল-বিকল্প সিনেমা। বিকল্পভাবে ছবি নির্মাণের একক ভালো প্রচেষ্টা এদেশে অতীতেও ঘটেছে-যুদ্ধের দিনগুলিতে জহির রায়হানের অসামান্য প্রামাণ্যচিত্র“স্টপ জেনোসাইড”। কিন্তু ছবি তৈরীর অর্থায়ন থেকে শুরু করে বিকল্পভাবে প্রদর্শনের সচেতন উদ্যোগ, সমগ্র প্রক্রিয়াটাই এই যে বিকল্প, সেটা স্বাধীন বাংলাদেশে“আগামী”-“হুলিয়া” ওই দু’টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি থেকেই শুরু।

এ ধারার কয়েকটা সুস্পষ্ট উপাদান ছিল। প্রথমত: ৩৫ মি:মি:-য়ে ছবি না করে ১৬ মি:মি:-য়ে বা বর্তমানে ডিজিটালে ছবি তৈরী করা; দ্বিতীয়ত: প্রথাগত বাণিজ্যিক দুই-আড়াই ঘন্টা দৈর্ঘ্যরে বদলে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে বা নানা রকম মুক্তদৈর্ঘ্যরে ছবি তৈরী করা; বাণিজ্যিক তারকাদের না নেওয়া; পেশাদার প্রযোজকদের কাছে না যেয়ে নানাভাবে ছবির অর্থায়ন করা এবং সিনেমা হলের বাইরে বিকল্পভাবে চলচ্চিত্রগুলোর প্রদর্শন। বিকল্পধারার অধিকাংশ ছবিই এসব উপাদানের অনেকগুলি, বা কয়েকটি উপাদান, ধারণ করেছে।

কেউ কেউ আমাদের এই ধারাকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ধারার ছবি এবং আমাদেরকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকার বলতে পছন্দ করেন। তবে পৃথিবীর দেশে দেশে “ইন্ডিজ” বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবির যে একটি ধারা আছে বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমার সঙ্গে তার কিছু পার্থক্য আছে। অন্যান্য দেশে ইন্ডিপেন্ডেন্ট চলচ্চিত্রনির্মাতারা স্বাধীনভাবে তাদের ছবি তৈরী করেন বটে কিন্তু প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তারা আবার প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক সার্কিটেরই দ্বারস্থ হন। কিন্তু বাংলাদেশের বিকল্পধারার নির্মাতারা ছবি তৈরী থেকে ছবিগুলি প্রদর্শনের আয়োজন এই সব কাজগুলিই করে থাকেননিজেরাই। ফলে কারো দ্বারস্থ হবার প্রয়োজন তাদের পড়ে না। না টাকাওয়ালা প্রযোজকের, না বাণিজ্যিক প্রদর্শকদের।

“পপুলার সিনেমা” একটা আলাদা ঘরানাই, আলাদা Genre হলিউড-বলিউড-টালিউড-ঢালিউড। “পপুলার সিনেমা”-র রয়েছে কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু, নিজস্ব তারকাপ্রথা, নিজস্ব নাটকীয় চলচ্চিত্র ভাষা, ছবি প্রদর্শনের নিজস্ব তরিকা ও ব্যাপক আম-দর্শক। সে অর্থে বিকল্প সিনেমা কোনো দিন “পপুলার সিনেমা” হবে না। বড় জোর জনপ্রিয় হতে পারে। তবে সে জনপ্রিয়তাও হবে সমাজের একটা সীমিত অংশের মধ্যে যারা চেতনায় অগ্রগামী। দর্শকসংখ্যা তাই আমাদের ছবিগুলিতে কমই রইবে। কারণ সব সমাজেই চেতনায় অগ্রসর মানুষদের সংখ্যা কমই থাকে। ছবি নির্মাণ ও প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এই বাস্তবতাটা মাথায় রেখেই বিকল্পনির্মাতাদেরকাজ করতে হয়।

ব্যয়বহুল প্রযুক্তিও আমরা তেমন ব্যবহার করতে পারি না যা ছবিকে দৃষ্টিনন্দন করে থাকে। মনে আছে আমার “হুলিয়া” ছবিটা তৈরী হয়েছিল প্রায় একটা ভাঙ্গা ১৬ মি: মি: বোলেক্স ক্যামেরা দিয়ে, যা ছিল প্রায় একটা Crank-ই। লেন্সগুলো তো ঝাপসা ছিলই। ক্যামেরাটার ট্যাকোমিটারটাও ছিল নষ্ট। আর সবচে বড় সমস্যা ছিল দশ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যরে বেশী কোনো শট নেয়া যেত না। দশ সেকেন্ডের বেশী শট নিলে শটের লয় যেত কমে!“হুলিয়া” ছবিটার শট ডিভিশন তাই এমনভাবে করা হয়েছিল যেন দশ সেকেন্ডের উপর কোনো শট আমাদের নিতে না হয়। ঢাকায় তখন ১৬ মি:মি: ছবি কাটা ও জোড়া লাগানোর জন্যে ভালো একটা স্প্লাইসারও পাওয়া যেত না। আমাকে ইউরোপ থেকে একটা স্প্লাইসার নিয়ে আসতে হয়েছিল। আমার এক বন্ধু বিনে পয়সায় সেটা আমাকে দিয়েছিলেন। আমাদের অবস্থা ছিল অনেকটা ওই দুঃখিনী বেহুলার মতোই;

“ধোপানী কাপড় কাচে ক্ষারে আর বলে
বেহুলা কাপড় কাচে শুধু গঙ্গাজলে।”

তবে আমরা সব সময়ই বিশ্বাস করে এসেছি যে রূপে তোমায় ভোলাব না। আমাদের ভালবাসা, শ্রম আর আন্তরিকতা দিয়ে জয় করব বাঁধাগুলি, প্রযুক্তির চটক দিয়ে নয়। এদেশে যখন যেটুকু প্রযুক্তি পাওয়া গেছে তার সৃজনশীল ব্যবহার করেই বিকল্পধারার নির্মাতাদের চলচ্চিত্র তৈরী করতে হয়েছে । এখন অবশ্য অনেক সুবিধা জুটেছে। ডিজিটাল নানা রকম সফ্টওয়ারের কল্যাণে সিনেমার পর্দায় আজ প্রায় সব কিছুই সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু শিল্প সৃষ্টির প্রশ্নে যদি কেবল অন্যদের তৈরী সফ্টওয়ারগুলোর উপরেই আমাদেরকে নির্ভর করতে হয় তাহলে আপনার নিজের সৃষ্টির কৃতিত্বটা কই ? সব কৃতিত্ব তো ওই সফ্টওয়ার আবিষ্কারকের উপরই বর্তাবে ! আপনার নিজের সৃজনশীলতা তা হলে রইল কোথায় ?

অর্থ তো আমাদের কোনো কালেই ছিল না। বিকল্প ছবি তাই সব সময়ই ছিল, এবং এখনও, স্বল্প বাজেটের ছবি। যতটুকু অর্থ না হলেই নয়। আমাদের ছবি তাই পুঁজিঘন (Capital intensive) নয়, শ্রমঘন (Labour intensive)। অর্থের স্বল্পতার অভাবটা মেটাতে হয় শ্রম দিয়ে, মেধা দিয়ে, সৃজনশীলতা দিয়ে। বলা যেতে পারে, আমাদের ছবিগুলি অনেকটাই বস্তুগত সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে মানসিক শক্তির, মাইন্ড-ওভার-ম্যাটারের বিষয়। আমাদের অর্থের যে কমতি তা’ পুষিয়ে নেওয়া হয় শ্রমশক্তি দিয়ে। আমাদের যে কোনো ছবিই তার প্রমাণ। আমার “জীবনঢুলী” ছবিতে শরণার্থীদের দেশত্যাগের দৃশ্যটি বা চুকনগর গণহত্যার দৃশ্যের কথা বলতে পারি। এসব দৃশ্যে প্রচুর সংখ্যক সাধারণ মানুষ অভিনয় করেছিলেন। শত শত নারী-পুরুষ-শিশু! কেউ কেউ আমাদেরকে পরে জিজ্ঞেস করেছেন এসব দৃশ্য তুলতে নিশ্চয়ই আপনাদের অনেক টাকা খরচ হয়েছে। মোটেই হয়নি। দৃশ্যগুলি তোলার আগে আমরা চুকনগরের আশেপাশের গ্রামাঞ্চলে দিনের পর দিন ঘুরেছি, অনেক মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছি। তারা বাসে, ভ্যানে, নৌকায়, নিজেদের খরচে এসেছেন। শুটিং হয়েছে। বাড়তি কোনো খরচই হয়নি। তাই বলছিলাম, পুঁজির অভাবটা আমাদেরকে মাথার ঘাম পায়ে ঝরিয়ে শ্রম দিয়ে মেটাতে হয়। হয়তো এভাবে ছবি তৈরী কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব!


আরো পড়ুন: প্রাগৈতিহাসিক শিকারী নারী: বাস্তব না অবাস্তব


আমাদের বিকল্প সিনেমার আন্দোলনকে অনেকে এদেশের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করেন। একটা পার্থক্য হচ্ছে এদেশে কোনো কমার্শিয়াল থিয়েটার ছিল না, যেমন পৃথিবীর অনেক দেশে রয়েছে। ফলে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন এদেশে একটা ফাঁকা মাঠ পেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমা আন্দোলনকে একটা শক্তিশালী বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র, তার বাজার, তার প্রতিষ্ঠান, তাদের তারকারা, তাদের সমর্থক পত্র-পত্রিকা, অনুগৃহীত সাংবাদিকেরা, এদের প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করেই বরফ কেটে কেটে এগোতে হয়েছে। যাত্রাটা তাই ছিল, এবং এখনও, বেশ কঠিন। দুর্গম এ পথে, পথে পথেই পাথর ছড়ানো।

মূলত: অর্থের অভাবের কারণেই আমাদের ছবিগুলি নির্মাণে এত দীর্ঘ সব সময় লেগেছে। এখনও লাগে। তারেক মাসুদ আর আমার মাঝে একটা কৌতুক ছিল। আমরা বলাবলি করতাম বাংলাদেশে আমাদের জন্যে “সিনেমা ভেরিতে” হচ্ছে “সিনেমা দেরিতে”! তারেকের “আদমসুরত” ছবিটা বানাতে সময় লেগেছিল সাত বছর, আমার “১৯৭১” ছবিটিও সাত বছর ধরে তৈরী, আর “নদীর নাম মধুমতী” লেগেছিল পাঁচ বছর। দেরির মূল কারণÑপ্রচন্ড অর্থাভাব। কর্পোরেট পুঁজি আমাদেরকে অর্থ দেয় না। যারা বিদেশী বহুজাতিক টেলিফোন কোম্পানীর জন্যে ছবি তৈরী করে, তাদেরকে অর্থ দেয় অঞ্জলি ভরে দেয়।

আমাদের ছবিগুলি লক্ষ্য করে দেখবেন যে শেষ টাইটেল কার্ডের স্ক্রলটা যেন আর ফুরোতেই চায় না! অসংখ্য নাম। কারণ আমাদের অধিকাংশ ছবিই তৈরী হয়েছে অনেক অনেক মানুষের দান, অনুদান ও ঋণ নিয়ে। ফলে কৃতজ্ঞতার টাইটেল কার্ডটা তো দীর্ঘ হবেই। এত বেশী মানুষের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকতে হয় ! এ এক ধরণের অঘোষিত ক্রাউড-ফান্ডিং বা গণ-অর্থায়ন। এবং এটা আমরা করেছি ক্রাউড-ফান্ডিং শব্দটা এদেশে প্রচলিত হওয়ার বহু আগে থেকেই, প্রায় সেই সিকি শতাব্দী আগে থেকে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রাউড ফান্ডিং-য়েও আমরা ছবি করেছি। যেমন আমার সাম্প্রতিক “সীমান্তরেখা” ছবিটি। বাংলাদেশে এই-ই প্রথম গণ-অর্থায়ন বা ক্রাউড-ফান্ডিং-য়ে একটা বড় প্রামাণ্যচিত্র সম্পন্ন হো’ল। গণঅর্থায়ন বিকল্পনির্মাতাদের জন্যে এক বিশেষ সম্ভাবনা। আর যেহেতু আমাদের সম্পদ কম, তাই অর্থ সংগ্রহ থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজগুলি সব আমাদের নিজেদেরই করতে হয়-যৌথভাবে। এ এক ধরণেরযৌথ সিনেমা-ফিল্ম কালেকটিভ।

ডিজিটাল প্রযুক্তি চলচ্চিত্র নির্মাণকে কেবল সাশ্রয়ী ও সহজই করেনি, এর প্রসার ও বিপণনকেও আজ সহজ করে তুলেছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছবি বিক্রী ও জনগণের কাছে সে ছবি পৌঁছনোর এক বিশাল সম্ভাবনা বর্তমানে সৃষ্টি হয়েছে। বিকল্প সিনেমানির্মাতাদের এই সম্ভাবনাকে সর্বাত্মকভাবে কাজে লাগানোটা শিখতে হবে। হতে হবে সাইবার প্রযুক্তিতে সুদক্ষ। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছবির প্রচার, প্রসার ও অর্থায়ন, এ এক অপার সম্ভাবনার জগৎ, এবং সত্যিকার অর্থেই, সে সম্ভাবনাÑআকাশের মতোই অসীম।

যেহেতু বাণিজ্যপুঁজির তল্পীবাহক প্রাইভেট টিভি চ্যানেলগুলো ও বাজারী পত্রিকাগুলো বিকল্প সিনেমার সংবাদ তেমন ছাপে না, সেক্ষেত্রে বিকল্প ছবির প্রচারের উপায় কী ? উপায় হচ্ছে সামাজিক গণমাধ্যম। ফেসবুকসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের সুবিধা যতটা সম্ভব নেওয়া। পুঁজির নোংরা প্রভাব থেকে এসব সামাজিক গণমাধ্যম এখনও কিছুটা মুক্ত এবং গণতান্ত্রিক। ফেসবুকে অনেক জঞ্জাল থাকলেও অনেক ভালো মানুষেরাও এতে রয়েছেন। রয়েছেন আমাদের ছবির সম্ভাব্য দর্শকেরাও। তাদের কাছে পৌঁছতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের এই যুগে সামাজিক গণমাধ্যমগুলোই হচ্ছে সবচে’ জনপ্রিয় ও বেশী প্রচারিত গণমাধ্যম এবং জনপ্রিয়তায় টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের চেয়ে উঁচুতে তার স্থান এবং বিশ্বব্যাপীই সামাজিক গণমাধ্যমগুলির গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা আজ বেড়ে চলেছে প্রায় জ্যামিতিক হারে। এটাই ভবিষ্যৎ। আমাদের বিকল্প সিনেমাওয়ালাদের এই বিকল্প গণমাধ্যমটাকে তাই কার্য্যকরভাবে ব্যবহার করা শিখতে হবে। এখানে বাড়তি সুবিধা হচ্ছে এই গণমাধ্যম অনেকটাই ফ্রী। কোনো সাংবাদিককে গোপনে কোনো খাম ধরিয়ে দিতে হয় না !

একটা জিনিস আমরা বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমানির্মাতারা কখনো করিনি। তা’ হচ্ছে ছবির দৈর্ঘ্যরে ক্ষেত্রে আপোষ। বাণিজ্যিক সিনেমা সার্কিট দ্বারা নির্ধারিত বা কর্পোরেট টেলিভিশন চ্যানেলগুলি দ্বারা ঠিক করে দেওয়া সময়সীমার দাসত্ব থেকে আমরা মুক্ত থাকতে চেয়েছি। মুক্তদৈর্ঘ্যরে আকাঙ্খা আমাদের শিল্পীমনের মুক্তির আকাঙ্খা। আমি সব সময় বিশ্বাস করে এসেছি একটা ছবির চিত্রনাট্যের দৈর্ঘ্য যতখানি হবে, সে ছবির জন্যে, ঠিক ততটা দৈর্ঘ্যই-“পূর্ণদৈর্ঘ্য”। কখনোই তা বাণিজ্যিক সিনেমা সার্কিট বা টেলিভিশন শ্লটের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা অনুযায়ী হওয়া কাম্য নয়। আমার স্বল্পদৈর্ঘ্য “হুলিয়া” মাত্র আঠাশ মিনিটের ছবি। মোর্শেদুল ইসলামের “আগামী” মাত্র পঁচিশ মিনিটের। আবার আমার“১৯৭১” ছবিটা তিন ঘন্টা পঁয়ত্রিশ মিনিটের। আমরা কোনো দিনই পুঁজির বেঁধে দেওয়া বাণিজ্যিক দৈর্ঘ্যে বিশ্বাস করিনি। দৈর্ঘ্যরে স্বাধীনতা আমাদের কাছে শিল্পীর স্বাধীনতারই অংশ।

অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমার মাধ্যমে একটা জিনিষ আমরা করতে পেরেছি। তা হচ্ছে বাণিজ্যিক সিনেমার নির্ধারিত ৩৫ মি: মি:-য়ের বদলে ১৬ মি: মি:-য়ে ছবি তৈরী করে উৎপাদন শক্তিতে পরিবর্তন এনে উৎপাদন সম্পর্কেও আমরা পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছিলাম। এর ফলে আমরা নিজেরাই আমাদের ছবির প্রিন্টের মালিক হতে পেরেছি এবং আমাদের ছবি যেখানে খুশী, যেমন খুশী, দেখানোর স্বাধীনতাটা অর্জন করেছি। তাছাড়া এদেশে সেলুলয়েডের বদলে ডিজিটাল মাধ্যমে ছবি তৈরী শুরু করে এফডিসি-র নোংরা দূর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক দাসত্ব থেকেও আমরা মুক্ত থাকতে পেরেছি। আমরা সত্যিকারভাবেই হতে পেরেছিÑস্বাধীন নির্মাতা।

তবে দুর্বলতা যেখানে তা’ হচ্ছে আমাদের সব ছবির কারিগরী ও নান্দনিক মান তেমন ভালো হয়নি। অনেক ছবিই বেশ দুর্বল। কিন্তু তারপরও দর্শক আমাদের ছবিগুলো দেখতে এসেছেন। আমাদের অনেক দুর্বল ছবিকেও তারা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন। এদেশের রুচিশীল দর্শকেরা সত্যি সত্যিই চেয়েছেন যেন আমরা সফল হই। দর্শকদের শুভাশিস আমরা তাই সব সময়েই আমাদের চারপাশে অনুভব করে এসেছি। এখনও করি।

আমরা জানি বিকল্পধারার ছবির বাজেট হতেই হবে কম। অন্যথায় কর্পোরেট পুঁজির কাছে বাঁধা পড়ে যেতে হবে। আপনি আপনার শৈল্পিক স্বাধীনতাটা হারাবেন। বিকল্প কী, আপনি তখন একজন আত্মমর্যাদাশীল শিল্পীও থাকতে পারবেন না। কর্পোরেট পুঁজির একটা সমস্যা হচ্ছে, তা’ সব কিছুকেই কলুষিত করে। আপনার ছবিকেও করবে। এ থেকে দূরে থাকতে হলে কম বাজেটে ছবি নির্মাণ করা আমাদের শিখতেই হবে। আমাদের কিছু পূর্ণদৈর্ঘ্যরে ছবি অত্যন্ত স্বল্পব্যয়ে তৈরী। আমি সব সময় বিশ্বাস করে এসেছি যে বিকল্পধারার নির্মাতাকে অর্থের জন্যে জনগণের কাছে যেতে হবে, বাণিজ্য পুঁজির কাছে নয়। জনগণের পাশে থেকে, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্যে তৈরী হতে হবে তার শিল্প। দর্শক আমাদের লক্ষ্মী। সরকার বিরূপ হলে ক্ষতি নেই। আমার একাধিক ছবি সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছিল। অন্যদেরও। এস্টাব্লিশমেন্ট আমাদের বিরোধিতা করবে সেটাই স্বাভাবিক। সে ক্ষতি সর্বনাশা নয়। কিন্তু জনগণ বিরূপ হলে বিরাট ক্ষতি। পরবর্তী ছবির জন্যে আপনি অর্থ পাবেন কোথায় ! আগের ছবির ঋণই বা শোধ করবেন কী করে ? তাই জনগণের কাছেই যেতে হবে। আর আমরা জানি জনগণ কেবল সিনেমা হলে থাকেন না, সিনেমা হলের বাইরেও থাকেন। থাকেন শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরীর মত মিলনায়তনে, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, কলেজ-স্কুলের মাঠে, খোলা ময়দানে, মায় ফসল কাটা ধানের ক্ষেতেও। এই সব জায়গাতেই ছবি দেখানোর অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। দর্শকদেরকে আমরা কেবল পকেটওয়ালা একজন জড় জীব বলে মনে করি না। মনে করি আমাদের আন্দোলনের সাথী। আমরা কখনোই ভুলি না যে সাধারণ দর্শকেরাই আমাদের শিল্পের লক্ষ্য, আমাদের পাথেয় ও সহযাত্রী।

বিকল্প সিনেমার বৈশিষ্ট্য অনেকগুলিই। প্রচলিত বিষয়বস্তুগুলির বাইরের কোনো বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরী, স্বল্প বাজেট, তারকাহীনতা, বাণিজ্যিক কাঠামোর বাইরে যেয়ে ছবি নির্মাণ ইত্যাদি। তবে সে সব তো যে কোনো ইন্ডিপেন্ডেন্ট চলচ্চিত্রনির্মাতার ক্ষেত্রেই সত্য। এবং পৃথিবীর সব দেশেই। বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমার যেটা বিশেষ আলাদা বৈশিষ্ট্য, এবং আমি মনে করি সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য, তা’ হচ্ছে এর প্রদর্শন ব্যবস্থা। নিজের ছবি নিজেই প্রজেক্টর কাঁধে করে বিভিন্ন জায়গায় দেখিয়ে বেড়ানো। এটাই বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমাকে অনন্যতা দিয়েছে। বলতে পারেন নিজস্ব উদ্যোগে বিকল্পভাবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনটাই, বাংলাদেশের বিকল্পধারার প্রাণভোমরা ওএর প্রধানতম চারিত্র্যলক্ষণ। তিরিশ বছর আগে আমাদের প্রথম দিককার ছবি “আগামী”-“হুলিয়া” থেকে অতি সাম্প্রতিক আমার “সীমান্তরেখা” পর্যন্ত আমাদের ছবিগুলি আমরা এভাবেই বিকল্পভাবে সারা দেশে প্রদর্শন করে এসেছি। আর তা থেকে অর্জন করেছি অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতাই।

একটা অভিজ্ঞতা বলি। একদিন শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরীতে আমাদের এক শো-তে যে ছেলেমেয়েরা শো-য়ের টিকিট বিক্রী করে তারা তখনও এসে পৌঁছায়নি। এদিকে কিছু দর্শক এসে পড়েছেন। আমি নিজেই তখন কাউন্টারে বসে টিকিট বিক্রি শুরু করেছি। এমন সময় আমার স্বল্প পরিচিত এক ভদ্রলোক দূর থেকে প্রায় ছুটে এলেন। আমাকে বেশ রাগত স্বরে বললেন; “আপনি নিজে কেন টিকিট বিক্রী করছেন ?” আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম; “কেন ? কী হয়েছে তাতে?” ভদ্রলোক তখন আমাকে প্রায় জোর করে একপাশে টেনে এনে বললেন; “ আপনি অমুক। আপনি নিজের হাতে টিকিট বিক্রী করলে আপনার মান থাকে ?” এটা ঠিক যে তখন আমার কিছুটা পরিচিতি হয়েছে। আমার একজন শুভানুধ্যায়ী হিসেবে তিনি আমার সম্মানহানি হওয়ার আশঙ্কায় ভীষণভাবে আশঙ্কিত! বুঝলাম একজন “খ্যাতিমান” ফিল্মমেকার নিজের হাতে তার ছবির টিকিট বিক্রী করছে এটা ওঁর মধ্যবিত্ত সংস্কারে বেঁধেছে। আমি ভদ্রলোককে বললাম; “কোনো অসুবিধে নেই। আমাদের বিকল্প সিনেমাওয়ালাদেরকে সব কাজ নিজেদেরই করতে হয়। চিত্রনাট্য লেখা, অর্থ সংগ্রহ করা, শটের লেন্স বাছাই থেকে শুরু করে ছবির শো-য়ের টিকিট বিক্রী পর্যন্তÑপুরো প্রক্রিয়াটাই”।

আরেকটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমরা বাঙ্গালীরা তো খুব বিশেষণপ্রিয়। ফলে কারো নামের আগে একেকটা বিশেষণ জুটেই যায়। কী ভাবে যেন আমার নামের আগে “আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন”(!) বিশেষণটা জুটে গিয়েছিল। এটা ঠিক যে আমার দু’একটা ছবি আন্তর্জাতিক কোনো স্বীকৃতি পেয়েছে, কিন্তু “আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র পরিচালক” বলতে যা বোঝায় আমার অর্জন মোটেই সে মাপের কিছু নয়। কিন্তু “আন্তর্জাতিক” শব্দটা বোধ হয় আমাদের এই মফস্বলী বাংলাদেশে ভালো কাটে। বিশেষ করে, খুলনা জেলার বৈঠাঘাটার মতো গ্রামীণ কোনো উপজেলা শহরে তো বটেই। তো বৈঠাঘাটায় আমাদের এক ছবির শো হবে। কলেজের অধ্যাপক বন্ধুটি তো সেই ছোট শহর বৈঠাঘাটায় ব্যাপক মাইকিংয়ের আয়োজন করেছেন “আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র পরিচালক অমুক বৈঠাঘাটায় পদার্পন করছেন ইত্যাদি ইত্যাদি”। শো-য়ের দিন তো ওই উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ সব সরকারী কর্মচারী, শিক্ষকবৃন্দ ও ওই ছোট শহরের এলিট বলতে যাঁদের বোঝায় তাঁরা সব ফুলের মালা-টালা নিয়ে বড় রাস্তায় অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন কখন সেই “আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক” এসে পৌঁছবেন ! এদিকে হয়েছে কী, ওর আগের দিন পেছনের আরেক উপজেলা দাকোপে আমাদের ছবির শো ছিল। কিন্তু আসার পথে আমাদের গাড়ীটা খারাপ হয়ে যায়। ফলে একটা ভ্যানগাড়ী চেপে পেছনের গ্রামের পথ ধরে আমরা আসছি। ভ্যান গাড়ীর উপরে ছবি দেখানোর প্রজেক্টর, পর্দা, সাউন্ড বক্স এসব। নিজেদেরকে মনে হচ্ছে অনেকটা যেন যাত্রা দলের লোক। এখন দক্ষিণ খুলনা অঞ্চলের বর্ষাকালের কাদা সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে দৃশ্যটা তারা আরো ভালো বুঝতে পারবেন। তো গ্রামের পথের হাঁটু পর্যন্ত কাদা ভেঙ্গে, কখনো ভ্যানে চড়ে, কখনো ভ্যানটা ঠেলে, সারা গায়ে কাদা মেখে এক সময় আমরা বৈঠাঘাটা শহরের পেছন দিকটায় এসে উপস্থিত হলাম। এদিকে কর্তাব্যাক্তিরা তো ফুলের মালা নিয়ে বড় রাস্তার দিকে অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন কখন এক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দামী গাড়ী থেকে “আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক”(!) এসে নামবেন। তো সারা গায়ে কাদা মেখে ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে ভ্যানগাড়ী ঠেলে আমাদের ওভাবে আসতে দেখে আমার অধ্যাপক বন্ধুটি তো প্রায় ভূত দেখার মতোই আঁৎকে উঠলেন! পরে আমাকে প্রায় দশ মিনিট ধরে বকাঝকা করেছিলেন; “এই ভাবে কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পরিচালক আসে !” উনি গত তিন দিন কত রকম বিশেষণে সাজিয়ে আমার নামে মাইকিং করেছেন। ওঁর মান-সম্মান সব যে ধুলোয় লুটিয়ে গেল!!

তো বিকল্পভাবে ছবি প্রদর্শনের মাধ্যমে আমরা অনেক কিছুই শিখেছি। এখনও শিখছি। বুঝতে পারি, কত রকম দর্শক আছে, এ দেশের আমলাতন্ত্র কী জিনিষ, আর কত বিচিত্র সব মানুষই না আছে! আমি মনে করি বিকল্পভাবে চলচ্চিত্র দেখানোর এ প্রক্রিয়ায় দর্শক ছাড়াও আমাদের দেশটি, দেশের মানুষ, দেশের মানুষের মূল্যবোধ ও সামাজিক মনস্তত্ত¡, সামগ্রিকভাবে মানবজীবন সম্পর্কেই বিকল্পনির্মাতারা অনেক কিছু শিখেছেন, প্রতি নিয়ত শিখছেন। আর যতদিন বাঁচি ততদিনই তো শিখি !

তবে নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও এভাবে বিকল্পভাবে ছবি প্রদর্শনের কিছু সাফল্য নি:সন্দেহে আছে। একটা বড় সাফল্য তো যে ছবি কত রকম হয়, কত রকম দৈর্ঘ্যরে হতে পারে, সে ব্যাপারে এ দেশের দর্শকদের অভিজ্ঞতার পরিসরটা বাড়ানো গেছে। তাছাড়া সিনেমা হলের বাইরে, যে কোনো মিলনায়তনেই যে চলচ্চিত্র দেখা ও দেখানো সম্ভব, এমন কী কোনো ক্লাসরুমে, বা খোলা মাঠেও, এসব ধারণাও বিকল্পধারার নির্মাতারাই এদেশে প্রতিষ্ঠাত করেছেন। তাছাড়া প্রামাণ্যচিত্রও যে শিল্পসম্মত হতে পারে এবং দর্শকেরা যে টাকা দিয়ে টিকিট কেটে প্রামাণ্যচিত্রও দেখতে পারেন এটাও বাংলাদেশে বিকল্পধারার নির্মাতারাই এদেশে প্রতিষ্ঠা করে ছেড়েছেন।

একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরী হলে তখন আমার একটা প্রামাণ্যচিত্রের শো চলছিল। পশ্চিবঙ্গের গৌতম ঘোষ এসেছিলেন দেখা করতে। দর্শকের ভীড় দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ছবি চলছে ?” আমি ছবিটার নাম বলাতে বিস্মিত হয়ে বললেন; “এটা ডকুমেন্টারী ফিল্ম না ?” বললাম; “হ্যাঁ।” উনি জিজ্ঞেস করলেন; “এরা টিকিট কেটে ছবি দেখছেন ?” টিকিট কাউন্টারটির দিকে ঈঙ্গিত করে বললাম; “ওই যে, দেখছেন না ?” উনি সত্যি সত্যিই খুব বিস্মিত হলেন। দু:খ করে বললেন, ওঁদের ওখানে, মানে কলকাতায় একটা ডকুমেন্টারী ছবি বানালে রোববার “নন্দন”-য়ে একটা শো হলে বন্ধু বান্ধবদেরকে ফোন করে করে ডেকে আনতে হয়। আর এখানে দর্শকেরা লাইন করে টিকিট কেটে প্রামাণ্যচিত্র দেখছে! এটা ওঁর জন্যে ছিল রীতিমতো বিস্ময়ের একটা বিষয় আর আমাদের জন্যে ছিল আনন্দের।

ছবির প্রদর্শন বিষয়ে আমার আরেকটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। তখন শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরীতে “লালসালু” ছবির শো চলছিল। অনেক দর্শক হো’ত ছবিটার শো-য়ে। দর্শকদের লাইন পাবলিক লাইব্রেরীর গেট ছাড়িয়ে বাইরের রাস্তাতেও চলে যেত মাঝে মাঝে। তো সে সময়ে একদিন দুপুরে আমার সেন্ট্রাল রোডের বাসায় একজন বয়ষ্ক ভদ্রলোক এলেন। বাড়ীটাতে লিফ্ট ছিল না। সিঁঁড়ি ভেঙ্গে হাঁপাতে হাঁপাতে উনি পাঁচতলার উপরে এলেন। নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন যে উনি “বলাকা” সিনেমা হলের মালিক হাসান সাহেব। গতকাল সন্ধ্যায় পাবলিক লাইব্রেরীতে“লালসালু” দেখতে গিয়েছিলেন। দর্শকদের ভীড় তিনি দেখেছেন। আজ উনি আমার কাছে এসেছেন যেন আমাদের ছবিটা ওঁর “বলাকা” হলে চালানো হয়। এদেশের হলমালিকেরা এক সময় “সূর্য দীঘল বাড়ী”-র মতো ছবিকেও হল থেকে নামিয়ে দিয়েছিলেন। আর আজ বিকল্পধারার নির্মাতারা এটুকু করতে পেরেছেন যে হলমালিকেরা তাদের হলে ছবি দেখানোর জন্যে বাড়ী বয়ে অনুরোধ জানাতে এসেছেন। আমাদের ছবি যে দু’একবার সিনেমা হলে দেখানো হয়েছে, হচ্ছে, সেসব ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু সিনেমা হলের কাছে তেমন যাইনি, সিনেমা হলই আমাদের কাছে এসেছে। এ ব্যাপারে আমরা পুরোই স্বাধীন। আমাদের ছবি দেখানোর জন্যে কোনো হলমালিক, বা প্রদর্শকদের সিন্ডিকেট, কারোরই দাসত্ব আমাদের করতে হয় না। তবে বর্তমানে সিনেমাহলগুলির, বিশেষ করে সিনেপ্লেক্সগুলির, টিকিটের দাম এত বেশী যা আমাদের পছন্দ নয় মোটেই। এবং আমাদের ছবির যারা সমঝদার দর্শক তারাও এরকম আয়েশী ও ব্যয়বহুল পরিবেশে তেমন যেতে চান না। ফলে আমাদের জন্যে সিনেপ্লেক্স নয়, সিনেমা হলের বাইরে বিকল্পভাবে ছবি দেখানোই হয়তো বেশী সাশ্রয়ী এবং আমাদের নিজেদের জন্যে ও আমাদের দর্শকদের জন্যেও, হৃদয়ের বেশী কাছাকাছি।

তবে বিকল্প সিনেমা প্রদর্শনে সব সময় যে আমরা সফল হতে পেরেছি তা’ নয়। ব্যর্থতারও অনেক অভিজ্ঞতা ও উপাখ্যান আমাদের রয়েছে। কিছু ছবি সফল হয়েছে, অনেক ছবি আবার হয়ওনি। অনেক ছবিতেই দর্শক বেশ কম এসেছে। আর এখন তো দর্শকের সংখ্যা খুবই কমে গেছে। তবে সামগ্রিকভাবে বিকল্পভাবে ছবি দেখানোর অভিজ্ঞতাগুলো মূলত: ইতিবাচক ও শিক্ষণীয়। তারেক মাসুদ ওর “মুক্তির গান” ও “রানওয়ে” ছবি বিভিন্ন শহর ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে ঘুরে দেখিয়ে সাফল্য পেয়েছিলেন। সম্প্রতি বিকল্পভাবে দেখানোর ক্ষেত্রে “ভুবনমাঝি” ছবিটিরও কিছু সাফল্য আছে।

বিকল্প ছবির নির্মাতাকে হতে হয় সত্যের সাধক। জীবনের সত্যই হওয়া উচিৎ তার আরাধ্য। এখন জীবনসত্যের কাছে আপনি দু’ভাবে পৌঁছতে পারেন, কাহিনীচিত্রের মাধ্যমে, আর প্রামাণ্যচিত্রে তো বটেই। বাংলাদেশে বেশ কিছু সত্যিকারের ভালো প্রামাণ্যচিত্র তৈরী হয়েছে। শ্রেণীবিভক্তি, দারিদ্র, স্বল্প গণতন্ত্র আর ধনবৈষম্যের দেশ বাংলাদেশ বিষয়বস্তুর দিক থেকে বলতে পারেন প্রামাণ্যচিত্রের জন্যে এক স্বর্ণখনি বিশেষ। তাছাড়া নবীণ নির্মাতাদের জন্যে চলচ্চিত্র শিক্ষার হাতেখড়ি হিসেবেও প্রামাণ্যচিত্র তৈরী খুবই কার্য্যকর এক পথ। খুব বেশী অর্থের প্রয়োজন পড়ে না। তবে প্রামাণ্যচিত্র দেখানোর সমস্যা রয়েছে এদেশে। এবং বেশ বড় সমস্যাই।

এদেশের বিকল্পধারায় চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনের একটা ভালো ক্ষেত্র হতে পারত প্রাইভেট টিভি চ্যানেলগুলো। পৃথিবীর অনেক দেশে সেরকমটি রয়েছে। কিন্তু এদেশের প্রাইভেট টিভি চ্যানেলগুলো বিকল্পধারার কাহিনী ছবিগুলো মাঝে মাঝে দেখালেও প্রামাণ্যচিত্র প্রায় একেবারেই দেখায় না। সাংস্কৃতিক রুচির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রাইভেট টিভি চ্যানেলগুলো আসলেই অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এটা দু:খজনক যে বর্তমানে বাংলাদেশে এত এত চ্যানেল, কিন্তু একটা টেলিভিশন চ্যানেলেও শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র নিয়ে মননশীল কোনো প্রোগ্রাম হয় না।

মনে পড়ে বাংলাদেশের এক প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের এক কর্তাব্যক্তির সঙ্গে একবার প্রামাণ্যচিত্র দেখানো নিয়ে আমার এরকম কথাবার্তা হয়েছিল। আমি ওঁকে বলেছিলাম; “আপনারা প্রামাণ্যচিত্র দেখান না কেন ?” “প্রামাণ্যচিত্র !” ভদ্রলোক এমন মুখভঙ্গী করলেন যেন প্রামাণ্যচিত্র খুব নীচু জাতের অস্পৃশ্য কিছু। আমি ওঁকে বললাম যে; “পৃথিবীর বড় বড় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোÑডিসকভারী, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, বিবিসি এরা প্রামাণ্যচিত্রই দেখায়”। এবং ইচ্ছা করেই একটা “ই” যোগ করলাম; “প্রামাণ্যচিত্রই দেখায়”। উনি তখন পাল্টা বললেন; “এই তো আপনাদের দোষ ! কেবল বিদেশের কথা বলেন।” তখন আমি ওঁকে বলি যে; “আপনি মীরপুরে যান, শান্তিনগরে যান, উত্তরা যান, দেখবেন ঘরে ঘরে মানুষ ওসব চ্যানেলই দেখে, আপনাদের ন্যাকা ন্যাকা প্যাকেজ নাটক কেউ দেখে না।” উনি অবশ্য তখন কথাটা মেনে নিলেন। তবে বাঙ্গালীর অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর সহজাত স্বভাবে বললেন; “কী করব বলেন ? প্রামাণ্যচিত্র দেখাতে চাইলে বিজ্ঞাপনদাতারা যে বিজ্ঞাপন দেয় না।” বিজ্ঞাপন ! আবারও কী কর্পোরেট পুঁজির হাতে বাঁধা পড়ে যাবে এদেশের শিল্প, আমাদের সমাজ-সত্যকে তুলে ধরার সব আন্তরিক প্রচেষ্টা। তাছাড়া যারা বিজ্ঞাপন দেয় তাদেরকে বোঝানোও তো ওঁদেরই দায়িত্ব। আর প্রামাণ্যচিত্র যে দর্শক দেখে না তা’ ঠিক নয়। আমার “তাজউদ্দীন আহমদ: নি:সঙ্গ সারথি” প্রামাণ্যচিত্রটি এক টেলিভিশন চ্যানেল দেখালে দর্শকদের কাছ থেকে সেই চ্যানেলে বেশ কয়েক হাজার ই-মেইল এসেছিল। সংখ্যাটি এত বেশী ছিল যে ওদের সার্ভার জ্যাম হয়ে গিয়েছিল !

বিকল্পভাবে সিনেমা দেখানোর অনেক বাঁধার মধ্যে এদেশের সেন্সর ব্যবস্থাটাও এক বড় বাঁধা। বিশেষ করে রাজনৈতিক সেন্সর। প্রায় সব বিকল্পধারার নির্মাতারাই সেন্সর বোর্ডের হাতে নানাভাবে ভুগেছেন। সেন্সর বোর্ড আমার নিজেরও একাধিক ছবি আটকে দিয়েছিল। “নদীর নাম মধুমতী”-র মুক্তির জন্যে আমাকে হাইকোর্টে যেতে হয়েছিল। হাইকোর্টে রীট করেই “কর্ণফুলীর কান্না” প্রামাণ্যচিত্রটিকে মুক্ত করতে হয়েছিল।

আর সেন্সর সনদ থাকলেও যে রাষ্ট্রশক্তির দিক থেকে ছবি দেখানোর ক্ষেত্রে বাঁধা ঘটতে পারে এরকম উদাহরণও আছে।সেবার চট্টগ্রামের মুসলিম হলে “লালসালু” ছবির প্রদর্শনী হবে। আমরা তো সকালে ব্যানার-পোস্টার-পর্দা লাগিয়ে, প্রজেক্টর বসিয়ে, তৈরী হয়ে রয়েছি। এমন সময় একজন পুলিশ অফিসার এক গাড়ী পুলিশ নিয়ে নামলেন। পুলিশ অফিসারটি জানালেন আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। কী কথা ? না, এ ছবি দেখানো যাবে না।

– “‘লালসালু’ সেন্সর সনদ পাওয়া ছবি। কেন দেখানো যাবে না ?”
– “না, দেখানো যাবে না। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মানা আছে।”
– “কী মানা ? দেখি আপনার কাছে কী কাগজ আছে ?”
– “কাগজ নেই। তবে দেখানো যাবে না।”
তর্ক-বিতর্ক, হৈ-চৈ। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকেরা তো রয়েছেই, যারা অধিকাংশই টগবগে তরুণ ছাত্রছাত্রী। এছাড়া অনেক দর্শকও তখন এসে পড়েছেন। তাদের সঙ্গে পুলিশের লোকজনের সমানে কথা কাটাকাটি চলছে। বেশ উত্তেজনাকর অবস্থা ! তখন নিরুপায় পুলিশ অফিসারটি আমাকে বললেন; “আপনি বরং আমাদের সঙ্গে ডিসি সাহেবের অফিসে চলেন। উনি যা বলেন তাই হবে।” তো আমি যেয়ে পুলিশের গাড়ীতে উঠলাম। ডিসি-র সঙ্গে দেখা করব। এদিকে হয়েছে কী ? আমাকে পুলিশদের সঙ্গে গাড়ীতে উঠতে দেখে আশেপাশের মানুষেরা ভেবেছেন আমাকে বুঝি পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে ! ফলে পুলিশের গাড়ীকে ঘিরে রীতিমতো উত্তেজনাময় ভীড়। কেউ কেউ শ্লোগান দেয়া শুরু করেছেন। তখন বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হোল; “আমাকে কেউ গ্রেপ্তার করেনি। আমি স্বেচ্ছায় ডিসি-র অফিসে যাচ্ছি। আপনারা শান্ত হোন।”

আরেকটা অভিজ্ঞতা খুলনায়। আমার নিজের জেলা শহরে। ওই “লালসালু” প্রদর্শন নিয়েই। কিছুদিন আগে মৌলবাদীদের বাঁধার কারণে সিলেটে “লালসালু” দেখানো যায়নি বলে আমি খুব বিরক্ত ছিলাম। আমরা ঠিক করেছিলাম খুলনার প্রদর্শনীটি আমরা খুব সফলভাবে করব। স্থানীয় আয়োজক ছিলেন খুলনার সাংবাদিকেরা। শো হবে খুলনাপ্রেস ক্লাবের মিলনায়তনে। আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই “লালসালু”-র শো নিয়ে শহরে কিছু গুঞ্জন, কিছু উত্তেজনা। শো-য়ের দিন বাড়ী থেকে বের হওয়ার সময় আমার বাসার গেটের সামনে দেখি এক গাড়ীভর্তি পুলিশ। এক মহিলা পুলিশ অফিসার গাড়ী থেকে নেমে আমাকে ভদ্রভাবে বললেন; “আপনি ছবির প্রদর্শনীতে যাবেন না।” Ñ “কেন ?” Ñ“উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ।” আমি নানা জায়গায় টেলিফোন করলাম। সমস্যা বেশ জটিলই বুঝলাম। খুলনার পুলিশ কমিশনারের অফিস থেকে একজন আমাকে বললেন; “আপনি অনুষ্ঠানে যাবেন না। আমাদের কাছে গোপন খবর আছে “লালসালু”-র শো হলে বোমা মারা হবে। “লালসালু”-র শো করার অনুমতি তাই দেয়া যাবে না।” খুলনার সাংবাদিকেরাও খুব দৌড়াদৌড়ি করলেন। কিন্তু শো আর করা গেল না। আমি মনে বেশ দুঃখই পেয়েছিলাম। কারণ খুলনা আমার নিজের বাল্য-কৈশোরের প্রিয় শহর। তবে মৌলবাদীদের হুমকী যে খুব ফাঁকা আওয়াজ ছিল না তা বোঝা যায়। কারণ কিছু দিন পরে “লালসালু”-র প্রদর্শনীর অন্যতম মূল আয়োজক খুলনা প্রেস ক্লাবে-র তৎকালীন সভাপতি আমার বন্ধু মাণিক সাহাকে ইসলামী মৌলবাদীরা বোমা মেরে খুন করেছিল।

এ দু’টো অভিজ্ঞতার কথা বললাম এ কারণে যে এদেশে বিকল্প সিনেমার প্রদর্শনী কোনো গোলাপবিছানো পথ নয়। এটা কেবলই একটা বিনোদনমূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয়, একটা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানও। এবং বেশ ঝুঁকিপূর্ণ একটা রাজনৈতিক অনুষ্ঠান।

তবে শুধু প্রদর্শন নয়, বাঁধা শুটিং-য়ের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। যেমন নড়াইলে আমাদের “চিত্রা নদীর পারে” ছবির শুটিং মাঝপথে আটকে দেওয়া হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো সৃষ্টি করছিল নানা বাঁধা। পরে স্থানীয় সাম্প্রদায়িক শক্তির চাপে ও প্রশাসনের মেরুদন্ডহীনতার কারণে শুটিং-য়ের কাজ পুরো শেষ না করেই আমাদেরকে নড়াইল ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল।

আরেকটা বিষয়েও আমরা বিকল্পধারার নির্মাতারা এদেশে খুব ভুগি। তা হচ্ছে আমাদের ছবিগুলোর বস্তুনিষ্ঠ নৈব্যর্ক্তিক সমালোচনা, যে সমালোচনা থেকে আমরাও কিছু শিখতে পারতাম, তার ঘোরতর অভাব। সমালোচনার নামে এদেশে যা হয় তা’ হচ্ছে উপরভাসা কিছু ফেসবুকীয় মন্তব্য বা নিছক স্তুতি কিম্বা ছবিটির নির্মাতার নানা খুঁত খুঁজে বেড়ানো! এদেশে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচকদের সংগঠন ঋওচজঊঝঈও-র একটা শাখা আছে বটে। কিন্তু এদেরকে কোনো চলচ্চিত্র সমালোচনা করতে আমরা দেখি না। সংগঠনটি মূলত: পরিণত হয়েছে কেবল একটা বিদেশযাত্রা সমিতিতে। দেশে ভালো চলচ্চিত্রনির্মাতা চাইলে শিক্ষিত ও রুচিশীল চলচ্চিত্র সমালোচকদের খুবই প্রয়োজন যারা উন্নত চলচ্চিত্র সমালোচনা লিখে আমাদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারবেন। বাংলাদেশে একজন জর্জ শার্দুল বা পলিন কেলের মত বোদ্ধা সমালোচক হবে না জানি, কিন্তু একজন চিদানন্দ দাসগুপ্ত বা সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় তো কেউ হতে পারতেন !

বিকল্পধারায় চলচ্চিত্র তৈরী ও প্রদর্শনে আমাদের নিজস্ব কিছু দর্শন আছে। তবে আমরা সচেতন থাকি যে স্ক্যান্ডিনেভিয়ারডগমা-তত্তে¡র প্রবক্তাদের মতো আমরা নিজেরাই যেন নিজেদের উপর সে সব সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন অতিরিক্ত কঠোরভাবে চাপিয়ে দিয়ে নিজেরাই যেন আবার সেসব নিয়মনীতির হাতে বন্দী হয়ে না যাই। আমরা নিজেরাই যেন কোনো “প্রতিষ্ঠান” না হয়ে যাই। তবে সম্পদের দারিদ্র্য অলঙ্ঘনীয় কিছু নিয়ম আমাদের উপর চাপিয়েই দিয়েছে। যেমন ব্যয়বহুল কোনো সেট আমরা তৈরী করতে পারি না। কিম্বা ব্যয়বহুল খুব উন্নত ক্যামেরাও আমরা ব্যবহার করতে পারি না। তাছাড়া একটা ভালো বাজেটের বড় ছবির ক্ষেত্রে যেখানে পঞ্চাশ-ষাট দিন শুটিং হয়ে থাকে সেখানে পঁচিশ-তিরিশ দিনের বেশী শুটিং করার অর্থই থাকে না আমাদের। তাছাড়া আমাদের অনেক ছবিরই শুটিং অনুপাত ছিল ১:১। বড় জোর ২:১। দারিদ্র্য আমাদেরকে মিতব্যয়ী হতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে নিজেদের মতো করে ছবি তৈরীর এক নির্মাণপ্রক্রিয়া সৃষ্টি করে নিতে, এক নিজস্ব চলচ্চিত্রভাষাই, যা স্বল্পব্যয়ী এবং শ্রমঘন, পুঁজিঘন নয় মোটেই। পুঁজির অভাবটা আমাদের ফিল্ম ইউনিটে আমরা গায়ে-গতরে পুষিয়ে নেবার চেষ্টা করি। বলতে পারেন, এ এক ভিন্ন ধরণের চলচ্চিত্র নির্মাণই।

আর অর্থ আয় ? মানে বাংলাদেশে শিল্পসম্মত সিনেমা বানিয়ে টাকা উপার্জন ? এটাই যদি আপনার মনোবাসনা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে বলব, আপনার অন্য পেশায় যাওয়াই ভাল হবেÑজমি বা ফ্লাট কেনাবেচা, আদম ব্যাপারীগিরি, নিদেনপক্ষে মৌলভীবাজারে কাঁচামালের ব্যবসা। কারণ আর্ট ফিল্ম বানিয়ে পৃথিবীর কে কবে ধনী হতে পেরেছে ? ভালো ছবি বানাতে সত্যজিৎ রায়কে বউয়ের গহনা, মায় ওঁর একান্ত প্রিয় আর্টের বইগুলোও বিক্রী করে দিতে হয়েছিল। ঋত্বিক ঘটকের হাতে দৈনিক বাজার খরচের টাকা সপ্তাহে ক’দিন থাকত তা দু’আঙ্গুলে গুণেই বলে দেওয়া যাবে ! সব দেবীর মধ্যে শিল্পদেবীর খাই সবচে বেশী। ভক্তের কাছে তার আত্মত্যাগের দাবীও তাই সবচে বেশী। শিল্প সৃষ্টি তাই খুব কঠিন কাজ। আর স্বল্পবাজেটে বিকল্পধারায় শিল্পসম্মত ছবি তৈরী তো আরো কঠিন। আমরা এটা হাড়ে হাড়েই জানি, টের পাই প্রতি মুহূর্তেই, যে আমাদের পথে পথে পাথর ছড়ানো। বঙ্কিমের “আনন্দমঠ”-য়ে চরিত্রকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তোমার পণ কী ? জবাব ছিলÑসর্বস্ব। বিকল্প সিনেমা এমনই এক কঠিন যাত্রাপথ যেখানে শিল্প সৃষ্টি ও সচ্ছলতার মধ্যে মাঝামাঝি কোনো পথ নেই। হয় আপনাকে পুরোটা দিতে হবে, না হয় আপনাকে ব্যর্থ হতে হবে। আর আপনি ত্যাগে যতটা ব্যর্থ হবেন, যতটা সমঝোতা করবেন, পর্দায় আপনার ব্যর্থতা ঠিক ততখানিই ফুটে বের হবে। একটা আপনাকে ছাড়তেই হবে। কোন্টা ছাড়বেন, ঠিক করুন। জীবন কঠিন, শিল্প আরো কঠিন।

বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমার একটা ব্যর্থতা হচ্ছে নতুনদের আমরা তেমন টানতে পারিনি। তার অন্যতম একটা কারণ হচ্ছে নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশে কর্পোরেট পুঁজির ব্যাপক বিকাশ। সে সময় থেকে আন্তর্জাতিক ফোন কোম্পানীগুলো তাদের বিশাল পুঁজি নিয়ে বাজারে এল। তাদের তো সবই দরকারÑমায় চিত্রনির্মাতাও। ইদানীং ব্যবসা-বাণিজ্যের বিজ্ঞাপনী জগৎটাও অনেক বেড়েছেবাংলাদেশে। সংখ্যায় ও প্রাচুর্য্য।ে ফলে গত দুই দশকে অনেক সম্ভাবনাময় নির্মাতাকে বিজ্ঞাপনের এই লোভনীয় জগতে হারিয়েছিআমরা। আরেকটি কারণ হচ্ছে, দেশে বাম-আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়া। চিরকাল আদর্শবাদী, ত্যাগী ও সাংগঠনিক কাজে দক্ষ তরুণেরা বামধারা থেকেই এসেছে। কিন্তু বর্তমানে বাম-আন্দোলন দুর্বল হয়ে যাওয়াতে বাংলাদেশের সব ধরণের প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বিকল্প সিনেমাও তার ব্যতিক্রম নয়।

এখন বিকল্প সিনেমার বিষয়বস্তু কী হবে ? আমাদের এক বড় মাপের সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পশ্চাৎপদ বাঙ্গালী মুসলমানদের নিয়ে লিখতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, প্রয়োজনে আমি আমার শিল্পকে পিছিয়ে রেখেও আমাদের সমাজের পশ্চাৎপদ চেতনার মানুষদের কথা অর্থাৎ তৎকালীন মুসলমান সমাজ নিয়ে বলতে চাই। বলেছেনও। আর ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে ওঁর সাহিত্যই ছিল সেরা। তারেক মাসুদ পশ্চাৎপদ মাদ্রাসা-চেতনা নিয়ে অসামান্য এক ছবি তৈরী করেছেনÑ“মাটির ময়না”। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা এক ছবি। অতি-আধুনিকতা, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এসব ঠিক আছে, তবে বিকল্পধারার শিল্পীকে জনগণের সাথে, জনগণের মাঝে থাকতে হবে। তার কাজ ধণিক শ্রেণীর মানুষদের জন্যে “ফীল গুড মুভী” তৈরী করা নয়, সমাজের বঞ্চিত ও অবহেলিতদের কথা বলা। আর এক্ষেত্রে আধুনিক পশ্চিমা নানা মতবাদকে অলঙ্ঘনীয় ভেবে লাভ নেই আমাদের। কারণ আমাদের সমাজ তো সে পর্যায়ে নেই। একবার ইউরোপে এক আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে যাবার সুযোগ ঘটেছিল আমার। তো আফ্রিকা থেকে আসা একজন কৃষ্ণাঙ্গ সাহিত্যিক আমার পাশে বসা। ভদ্রলোক একজন কবি ও গ্রামীণ একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। সেমিনারে এক সাদা চামড়ার সাহেব তো পোস্ট-মডার্নিজম নিয়ে দাঁত খটমট নানা কথা বলেই যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে আফ্রিকার কবিটি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন; “তুমি কিছু বুঝলে ?” বললাম; “অল্প অল্প।” উনি আমাকে বললেন; “এত পোস্ট-মডার্ন বুঝে আমাদের কী লাভ বল? যেখানে আমার গ্রামে কোনো পোস্ট-অফিসই নেই !” তবে সিনেমা যেহেতু একটা আন্তর্জাতিক শিল্পমাধ্যম, ফলে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের হালচাল সম্পর্কে আপনাকে জানতে হবে, কিন্তু পা-টা রাখতে হবে এদেশের জলকাদার মাটিতে।

এটা ভুলে যাওয়া মোটেই ঠিক হবে না যে কেবল নির্মাতাদের দ্বারাই বিকল্প সিনেমা তৈরী হয়নি। বাংলাদেশে বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে আনোয়ার হোসেন, মকসুদুল বারী, মিশুক মুনীরের মতো চিত্রগ্রাহকেরা, পরিশ্রমী সম্পাদকেরা ও আন্তরিক অভিনেতা-অভিনেত্রীরা, যারা মূলত: গ্রæপ থিয়েটার থেকে এসেছেন, তাঁদেরও রয়েছে বিরাট অবদান। তাঁরা সকলেই প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন। এছাড়া সব সময়ই ছিল এক ঝাঁক ঝকঝকে তরুণ-তরুণী, মূলত: ফিল্ম সোসাইটি বা শর্ট ফিল্ম ফোরামের কর্মীরা, যাদের চোখে মুখে ছিল আগামীর স্বপ্ন। বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমার ক্ষেত্রে এদের সবার অবদান বিশাল।

জ্যাঁ ককতো স্বপ্ন দেখতেন ক্যামেরার দাম যখন কলমের দামের মতো হবে এবং ফিল্মের দাম হবে কালির দামের মতো, কেবল তখনই চলচ্চিত্র একটা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শিল্প হয়ে উঠবে। ডিজিটাল ক্যামেরার ব্যাপক বিকাশ ও এ ধরণের ক্যামেরা বর্তমানে সহজলভ্য হওয়ায় সিনেমা আজ সে সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে। আপনার মোবাইল ফোন দিয়েই আপনি এখন একটা গোটা ফিল্ম বানাতে পারেন। তবে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি তৈরীর খরচের খাত তো কেবল ক্যামেরা নয়, অন্যান্য আয়োজনেরও খরচ আছে। আর তাও কিছু কম নয়। সে টাকাটাও বা আসবে কোত্থেকে ? একটা ভরসা সরকারী অনুদান। অনুদানের টাকার পরিমাণটা কম বটে, কিন্তু ছবি শুরু তো করা যায়। অর্থের আরেক উৎস হতে পারত বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা নানাসংষ্কৃতিমনা ফাউন্ডেশন, ভালো ছবির ক্ষেত্রে পশ্চিমা দুনিয়ায় যেরকমটি অনেক রয়েছে। কিন্তু দু:খজনক যে বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের ধনী পরিবারগুলো ব্যবসা করে বা দূর্নীতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করলেও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয়ের মতো রুচি বা শিক্ষা তাদের এখনও গড়ে ওঠেনি। তারা মূলতঃ মসজিদ-মাদ্রাসা বানাতে টাকা খরচ করে। এক ধরণের পাপস্খালন ! সে মাদ্রাসায় অবশ্য তাদের নিজেদের বাড়ীর ছেলেদের পড়াবে না। সেখানে পড়বে কেবল গরীবদের সন্তানেরা এবং ধর্মের আফিমে বুঁদ হয়ে থাকবে। হয়তো জঙ্গী হবে !

বাংলাদেশে লন্ডনের ন্যাশনাল ফিল্ম সেন্টার বা কলকাতার “নন্দন”-য়ের মতো একটা ফিল্ম সেন্টার নেই বলে আমরা খুবই ব্যথিত। দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যাপারে আমরা দাবী জানিয়ে আসছি, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রতিশ্রæতিও দেয়াহয়েছে, তারপরও হচ্ছে না। দেশে উন্নত চলচ্চিত্র সংস্কৃতি চাইলে একটা ন্যাশনাল ফিল্ম সেন্টার থাকাটা খুবই প্রয়োজনীয়। এই ফিল্ম সেন্টারকে ঘিরেই গড়ে উঠবে নতুন প্রজন্মের সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণীরা যারা ভবিষ্যতে এদেশে শিল্পসম্মত সিনেমার হাল ধরবে। আমাদের মতো স্বল্প গণতন্ত্রের দেশে সরকার হচ্ছে সবচে বড় সামাজিক সংগঠনÑক্ষমতায় ও সম্পদে। ফলে ন্যাশনাল ফিল্ম সেন্টারের মতো একটা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গঠনে সরকার বড়ভাবে এগিয়ে আসবে এটাই আমরা আশা করি।

দীর্ঘদিন বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম বিকল্প সিনেমার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। কিন্তু সংগঠনটি বর্তমানে সাংগঠনিকভাবে, ও আদর্শিকভাবেও, কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিকল্পনির্মাতা ও নির্মাণকর্মীদের সংগঠন হিসেবে তার প্রধান যে দায়িত্ব ছিল বিকল্পভাবে ছবি নির্মাণ ও প্রদর্শনে নিজেকে নিয়োজিত রাখা তা থেকে সরে এসে সংগঠনটি ক্রমশ:ই যেন কেবল একটা ফেস্টিভ্যাল-আয়োজক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে পড়ছে। চলচ্চিত্র উৎসব একটা প্রয়োজনীয় ব্যাপার। আর শর্ট ফিল্ম ফোরাম আয়োজিত ফেস্টিভ্যালটার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা একটা ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র উৎসব যেখানে নির্মাতারা ও নির্মাণকর্মীরা নিজেরাই এই উৎসবটার আয়োজন করে থাকে। তবে শর্ট ফিল্ম ফোরাম কী কেবলই একটা চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে ? বিকল্প সিনেমার নির্মাণ ও প্রচারে কী রাখবে না উদ্যোগী ভূমিকা যেমনটি অতীতে সে রেখেছিল ? তাছাড়া ফেস্টিভ্যাল প্রয়োজনীয় বুঝি, এবং তা’ হতেও হবে। মেয়ের বিয়ে দিতেই হবে। তবে একশ ভরি জড়োয়া গহনা দিয়ে বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করেও মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায়, আবার গরিবের ঘরের মেয়ের মতো অতিথিদের কেবল শরবত খাইয়েও বিয়ে হতে পারে। প্রথম দিকে শর্ট ফিল্ম ফোরামের চলচ্চিত্র উৎসবগুলো খুব স্বল্প ব্যয়েই হয়েছিল। এখন খরচ বাড়ালেই আশঙ্কা সৃষ্টি হয় যারা টাকা দেবে সেই কর্পোরেট পুঁজি বা তাদের মধ্যস্থতাকারীদের হাতে জিম্মী হয়ে পড়ার। শর্ট ফিল্ম ফোরামের আদি নীতি ও আদর্শ থেকে সরে এসে তাদের মতো হয়ে ওঠার! রূপকথার সেই, আয়না তুমি কার? যখন যার তখন তার; তৈরী হয় নিজের মূল আদর্শ থেকে সরে যাওয়ায় ঘোর আশংকাও। শর্ট ফিল্ম ফোরামকে এই বিপদটি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। বিকল্পধারার নির্মাতাদের ছবি নির্মাণে অনেক আর্থিক অনটন থাকে। তাদের আয়োজিত চলচ্চিত্র উৎসবেরও বেশী ব্যয়বহুল হবার প্রয়োজনটাই বা কী ?

বিকল্প সিনেমা আন্দোলনের সঙ্গে এদেশের জনগণের একটা আত্মিক সম্পৃক্তি আগে বেশ গভীরভাবেই ছিল। আশির দশকে জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে, আরো অনেকের মতো, বিকল্প সিনেমার নির্মাতারা, নির্মাণকর্মীরা আর তাদের সংগঠন বাংলাদেশশর্ট ফিল্ম ফোরামও খুব শক্তভাবেই রাজপথের আন্দোলনে ছিল। দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গেও বিকল্পধারার নির্মাতারা সম্পর্কিত ছিলেননানাভাবে। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর আরো অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠনের মতো শর্ট ফিল্ম ফোরামের সদস্য হিসেবে আমরাও জনগণের কাছ থেকে অর্থ, কাপড় এসব সংগ্রহ করে বন্যার্তদের মাঝে বিলি করেছি। একটা ঘটনার কথা বলি। ১৯৮৮-র বন্যার সময় আমরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় পর্দা লাগিয়ে আমাদের ছবিগুলো দেখিয়ে বন্যার্তদের জন্যে অর্থ সংগ্রহ করতাম। মানুষ এক টাকা-দু’টাকা যে যা পারেন দিতেন। পুরনো ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কে একদিন ছবির প্রদর্শনীর পর আমরা গামছা পেতে টাকা তুলছি। এক দরিদ্র রিক্সাওয়ালা কোমর থেকে আট আনা পয়সা বের করে দিলেন। আমাদের ছবি দেখেই পয়সাটা দিয়েছেন। আমরা এরকম অনেক খুচরো পয়সা পেতাম। দিনের শেষে টেবিলে জড়ো করে আমাদেরকে এসব খুচরো পয়সা গুণতে হোত। আমি অর্থের দায়িত্বে ছিলাম। ফলে এ বিষয়টা আমি জানি। তো শর্ট ফিল্ম ফোরাম জনগণের সঙ্গে এরকম ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্তই একটা প্রতিষ্ঠান ছিল। জনগণের সঙ্গে এরকম অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পৃক্ত একটা স্বাধীন সংগঠন যেন কখনোই কোনো কর্পোরেট হাউজের বাড়তি একটা হাতে পরিণত না হয় সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে, যেমনটি হয়েছে এদেশের কোনো কোনো চলচ্চিত্র সংগঠন কিম্বা কোনো কোনো চলচ্চিত্র উৎসব কমিটি।

এটা দু:খজনক যে এদেশে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন প্রায় থমকে গেছে। ফেডারেশনের কিছু কিছু কর্তাব্যক্তির নেতা হওয়ার খায়েশ ও পদ-আঁকড়ে-থাকার মানসিকতা এই আন্দোলনটার বিকাশকে খর্ব করেছে। বর্তমানে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের বড় সঙ্কট হচ্ছে যে তরুণদের আর তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। এ ধরণের ধন্যবাদহীন কাজে ইদানীংকার তরুণেরা তেমন আর আসতে চায় না। তারা তাৎক্ষণিক প্রাপ্তি চায়। তারা খুব তাড়াতাড়িই “চলচ্চিত্রনির্মাতা”(!) হয়ে উঠতে চায়। হয়তো জানে না, নির্মাতা হওয়ার আগে থাকে এক দীর্ঘ ও পরিশ্রমী শিক্ষানবিশী পর্ব। আর ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনই হতে পারে সেই শিক্ষানবিশী কালের সবচে কার্য্যকর এক ক্ষেত্র। তরুণদের জানা প্রয়োজন যে আলমগীর কবির, তারেক মাসুদ, মোর্শেদুল ইসলাম, এদেশে যারা কিছু ভাল ছবি বানিয়েছেন তারা সবাই ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন থেকেই এসেছেন।

বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন; “আমরা বাঙ্গালীরা যখন একা লড়ি তখন দশজনের মতো লড়ি। আর দশজনে যখন লড়ি তখন একার মতোও লড়ি না।” সংগঠন গড়ার ক্ষেত্রে বাঙ্গালীর যৌথতাবোধের এই অভাব ছাড়াও যুগে যুগেই যেসব সমস্যা বাঙ্গালীদের সংগঠন-প্রচেষ্টাকে ক্ষতি করেছে, যেমন উপদলীয় কোন্দল, পদের মোহ,নিজের পাতে ঝোল টানার চেষ্টা, পারস্পরিক ঈর্ষা, দু:খজনক যে এসব ক্ষতিকর দিকগুলি থেকে আমাদের চলচ্চিত্রিক সংগঠনগুলিও মুক্ত থাকতে পারেনি। অথচ এদেশে বিকল্প সিনেমার নৌকাটা নূহ নবীর নৌকার মতোই অনেক বড়। এখানে সবার জন্যেই জায়গা আছে। ধাক্কাধাক্কির কোনো দরকার নেই। কাউকে ঠেলে ফেলে দেবার চেষ্টারও দরকার নেই। প্রত্যেকেই তার যোগ্যতা অনুযায়ীই সম্মান পাবে। তবে প্রত্যেককেই আবার, তার নিজের ভার ও দায়িত্ব, নিজেকেই বহন করতে হবে। বাইবেলে যেমনটি বলে, প্রত্যেকে বহন করবে তার নিজের নিজের ক্রশ!

আমি নিজে সব সময় চেষ্টা করেছি কোনো পদে না থেকে দায়িত্বগুলো পালন করার। আমার সারা জীবনের সাধনাটাই তাই। অনেকে বলেন, আপনি তো কোনো কমিটি বা পদে থাকেন না। না, থাকি না। কিন্তু সাংগাঠনিক কাজ তো কম করি না! বলতে পারেন যে কমিটির সদস্য হওয়া ও যেনতেন ভাবে তা’ আঁকড়ে ধরে রাখার বাঙ্গালীদের অসুস্থ প্রবণতাটার বিরুদ্ধে এটা আমার একান্ত নিজস্ব এক ধরণের প্রতিবাদই। এই পদে না থেকেও কাজ করা। স্বীকারে দ্বিধা নেই, সর্বদা সে কাজে তেমন সফল হইনি। বিষয়টা মানুষকে তেমন বোঝাতে পারিনি যে পদে না থেকেও দায়িত্বপূর্ণ কাজ করা যায়। এদেশে অনেকেই সেটা বুঝতেই পারেন না। কী চলচ্চিত্র শিক্ষার প্রসারে, কী চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালিখি করে, কী ফিল্ম ইনস্টিটিউট বা ফিল্ম সেন্টার গড়ে, আমি অবশ্য চিরকাল, পদহীনভাবেই, কাজ করে গেছি। ভবিষ্যতেও সেরকমই করে যাবার ইচ্ছে।

এটা ভালো সংবাদ যে দেশে সরকারী উদ্যোগে একটা ফিল্ম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বেশ কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়েও বর্তমানে ফিল্ম পড়ানো হয়। ব্যক্তিগত পর্যায়েও দু’একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট কাজ করছে। কিন্তু সিনেমা শিল্প, আরো সব শাস্ত্রের মতোই, একগুরুমুখী বিদ্যা। গুরুই মূল, দালানকোঠা নয়। বাংলাদেশে ভালো চলচ্চিত্রশিক্ষার বড় এক সমস্যা হচ্ছে, দেশে ভালো শিক্ষকের অভাব। যেহেতু চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে প্রকৃত শিক্ষা দেবার উপযোগী শিক্ষক বাংলাদেশে খুবই কম, ফলে মূলত: নাট্যতত্ত¡ ও গণমাধ্যমে পাস করা ব্যক্তিরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলচ্চিত্র পড়াচ্ছেন। সিনেমা ঠিক গণমাধ্যম নয়, এটা একটা শিল্পমাধ্যম। নাটক তো নয়ই। ফলে নাট্যতত্ত¡ বা গণমাধ্যমের শিক্ষকদের দিয়ে চলচ্চিত্র শেখানোর চেষ্টা, এ অনেকটা পাখী দিয়ে হালচাষ করার মতো ! ফলে সে জমির ফসল সেরকমই হচ্ছে বা ছাত্ররাও শিখছে খুব সীমিতভাবে। সিনেমা মূলত: একটা প্রযুক্তিনির্ভর মাধ্যম। সে প্রযুক্তিটা না জানা থাকলে সিনেমার ভাষা ও নন্দনতত্ত¡ সম্পর্কেও তেমন কিছু জানাবোঝা যায় না। আর প্রযুক্তিনির্ভর সেই চলচ্চিত্রের ভাষা ও নন্দনতত্ত¡কে শেখানোর মত উপযুক্ত শিক্ষক বাংলাদেশে খুব হাতে গোনাই। ফলে ছাত্ররা অনেক আগ্রহ নিয়ে ও অনেক ব্যয় করে সিনেমা শিখতে এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলেও তেমন কিছু শিখছে না। অথবা নিজেদের শিক্ষকদের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেরে হতাশ হচ্ছে।

পুরস্কার নিয়ে একটা মাতামাতি আছে বাংলাদেশে। পুরস্কারের লোভে কিছু লোকেরা নানারকম খুদকুড়ো ছড়ায় ! দুঃখজনক যে মন্ত্রণালয়ের কিছু আমলা, এমন কী কিছু বুদ্ধিজীবীও, সে সব খুদকুড়ো খুঁটে খেতে সদা তৎপর। ফলে পুরস্কারের নামে এদেশে নানা অনৈতিক কার্যকলাপ অহরহই ঘটে চলেছে। দুঃখজনক হয় যখন সে অনিয়ম ঘটে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের ক্ষেত্রেও, দেশের প্রধানমন্ত্রীই স্বয়ং যে পুরস্কার তুলে দেন! এটা খুবই বেদনাদায়ক হবে যদি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয়ভাবে দেয়া পুরস্কারও ক্রমে একটা কৌতূকের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় !!

আর যেসব বুদ্ধিজীবীদেরকে পুরস্কার কমিটিতে নেয়া হয় তাদের অনেকেরই চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়া ও আধুনিক সিনেমার ভাষা সম্পর্কে তেমন জ্ঞান থাকে না। অন্যান্য ক্ষেত্রে হয়তো তাঁরা খ্যাতিমান কিন্তু চলচ্চিত্রের ব্যাপারে প্রায় অজ্ঞ এরকম মানুষকেও চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটিতে রাখা হয়। সৈয়দ হাসান ইমাম ভাই আমাকে একবার পুরস্কার কমিটির এরকম একজন সদস্যার কথা বলেছিলেন। ভদ্রমহিলা ভাল গান গাইতেন। জাতীয়ভাবে পরিচিত। সেই সুবাদে তিনি চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটির সদস্যা হয়েছেন। এখন নম্বর দেবার সময় উনি ওঁর পাশে বসা হাসান ইমাম ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলেন; “হাসান ভাই, চিত্রনাট্য আর চিত্রগ্রহণ কী এক জিনিষ ? কোন্ ঘরে নম্বর দেব !” প্রশ্ন শুনে হাসান ইমাম ভাইয়ের তো চেয়ার থেকে পড়ে যাবার অবস্থা ! আবার অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক রয়েছেন যারা আসলেই বুদ্ধিদীপ্ত ও অন্যান্য মাধ্যমে সুশিক্ষিত তবে চলচ্চিত্র সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞান আবার খুবই উপরভাসা। এটা বোঝা যায় একটা উদাহরণ থেকে। বাংলাদেশের একটা বহুলপঠিত দৈনিক পত্রিকা মাঝে মাঝে এদেশের কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীর একটা ছোট সাক্ষাৎকার ছাপে। মানে উনি কী বই পড়তে ভালবাসেন, কী গান শুনতে ভালবাসেন, কী সিনেমা ওঁর প্রিয়, এসব আর কী ? আমি কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ্য করি, সাহিত্য পাঠের ব্যাপারে এঁদের অনেকেরই রুচি বেশ উন্নত, দেশ-বিদেশের ভালো ভালো গল্প-উপন্যাস তাঁরা পড়েছেন, অন্তত: নাম জানেন। গানের ব্যাপারেও তাঁদের রুচি ও জ্ঞান মন্দ নয়। কিন্তু সিনেমার ব্যাপার এলেই দেখা যায় তাঁদের রুচি খুবই মফস্বলীয়। যেমন অনেকের কাছেই পৃথিবীর সেরা চলচ্চিত্র হচ্ছে টালিগঞ্জের ষাট দশকের উত্তম-সুচিত্রার বাণিজ্যিক ছবিগুলি, কিম্বা বড়জোর, সেই বছর পঞ্চাশেক আগে গ্রেগরী পেক-অড্রে হেপবার্ন জুটির ওই যে আধা-বাণিজ্যিক একটা ছবি হলিউড বানিয়েছিল, সেই “রোমান হলিডে”! এঁদের সম্পর্কে বলা যায়, ঋত্বিকের চরিত্রটি যেরকমটি বলেছিল, এরা “দেশভাগ দেখেনি, যুদ্ধ দেখেনি, দাঙ্গা দেখেনি, দূর্ভিক্ষ দেখেনি”, তেমনি এঁরা “সিটিজেন কেন” দেখেননি, “দি সেভেন্থ সীল” দেখেননি, “ব্যাটলশিপ পতেমকিন”-য়ের নাম শোনেননি। অথচ এঁরা বাংলাদেশের সেরা বুদ্ধিজীবী এবং এঁদের অনেকেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটির সদস্য হন বা হয়েছেন। ফলে পুরস্কার নিয়ে অত মাতামাতির কিছু নেই। পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে চার হাজার চলচ্চিত্র উৎসব হয় আর তার কিছু উৎসব খুবই ফালতু। সে সব উৎসবের পুরস্কারও তেমনি অর্থহীন। দেশে ইদানীং আবার এক নতুন আপদ দেখা যাচ্ছে। নানা উৎসবের নাম করে এ ওকে পুরস্কার দিচ্ছে! ছাত্রজীবনে আমরা যাকে বলতাম, “পপিচুস”, অর্থাৎ “পরস্পর-পিঠ-চুলকানো-সমিতি”! বিকল্পধারার নির্মাতাদের এসব থেকে যোজন যোজন দূরে থাকাটা বাঞ্চনীয়।

আসলে পুরস্কার তেমন কিছুই প্রমাণ বা অপ্রমাণ করে না। অনেক দুর্বল ছবিই নানা লবিং-য়ের কারণে পুরস্কার পেয়ে যেতে পারে, আবার অনেক শিল্পসম্মত ছবিও পায় না। ফলে কোনো চলচ্চিত্র উৎসবের পুরস্কারই কোনো ছবির শিল্পবিচারের মাপকাঠি নয়। ঋত্বিক ঘটকের ছবি কী পুরস্কার পেয়েছে! তবুও, আজো ঋত্বিকের ছবি নিয়েই বেশী গবেষণা হচ্ছে, লোকে বই-কেতাব লিখছে। অথচ সে সময়কালের রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় পুরস্কার পাওয়া অনেক ছবির কথা লোকে ভুলেই গেছে। কোনো ছবির শিল্প হয়ে উঠতে পারাটাই বড় কথা, পুরস্কারের সংখ্যা নয়। বিকল্পধারার একজন নির্মাতাকে পুরস্কারের এই কাঙালপনার উর্ধ্বে উঠতেই হবে। তাকে শিল্প সৃষ্টি করতে হবে। হতে হবে শিল্পী।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বর্তমানে একটা বিতর্ক বেশ প্রখর। তা হচ্ছে বিদেশী ছবি, বিশেষ করে ভারতীয় ছবি, দেখানো বা না দেখানো। বলিউডের সিনেমা খুব উন্নত কোনো সিনেমা নয়, হলিউডের গরিবী অনুকরণ মাত্র। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি চলচ্চিত্রের নামে আমাদের এফডিসি যথেষ্টই গর্ভ¯্রাব সৃষ্টি করে চলেছে, বলিউড থেকে নতুন গর্ভ¯্রাব আর আমদানীর দরকার নেই। আর প্রতিযোগিতা ? বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিযোগিতাকে ভয় পেলে চলবে ? আমাদের এই গরীব দেশের গার্মেন্টস শিল্পকে তো বিশ্বের তাবৎ বড় বড় সুপারপাওয়ার দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই টিঁকে থাকতে ও বিজয়ী হতে হচ্ছে। আমাদের বিকল্পধারার ছবিগুলিকেও তো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শত শত কোটি টাকা ব্যয়ের ছবিগুলির সঙ্গেই প্রতিযোগিতা করতে হয়।সেক্ষেত্রে কেন এফডিসি-র এসব তৃতীয় শ্রেণীর বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রগুলোকে যুগের পর যুগে ধরে এরকম প্রতিযোগিতাহীন পুতু পুতু ভাবে লালন করতে হবে? আর যদি প্রতিযোগিতায় এতই ভয়, তাহলে এমনটি করা যেতে পারে যে বাংলাদেশের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পাঁচটি ছবি ও ভারতের জাতীয় পুরস্কার পাওয়া পাঁচটি ছবি বিনিময় করে পরস্পরের দেশে চালানো। মাত্র পাঁচটি ছবির প্রতিযোগিতা যে শিল্প ধারণ করতে পারবে না, সে আবার কেমন শিল্প ?

ওই যে জীবনান্দ দাশ বলেছিলেন “জগতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকুরী”। চাকুরী করে শিল্প হয় না। বিকল্প পথে এলে জীবনের অনেক কিছুই ছাড়তে হবে। রবীন্দ্রনাথের কথাই; “আমাকে যে সব দিতে হবে/ সে তো আমি জানি।” সব দিতে কে কে রাজি আছেন ? যদি থাকেন, তাহলেই এ ধারার কাজে নেমে পড়–ন। আর রাজী না থাকলে, বুঝতে হবে শিল্প সৃষ্টি ঠিক আপনার কাজ নয়। বিকল্প সিনেমা তো নয়ই। আন্দ্রে ভাইদার “দি কন্ডাকটার” ছবির বৃদ্ধ পিয়ানোবাদক শিল্পীটি পিয়ানোবাদক-হতে-চাওয়া তার মেয়ের প্রেমিক যুবকটিকে বলেছিলেন; “এটা তোমার লাইন নয়, অ্যাডাম। তুমি অন্য কোনো কাজে চলে যাও।”ওই যে জীবনান্দ দাশ বলেছিলেন; সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি! তেমনি সকলেই শিল্পী নন, নন সৃজনশীল। যারা অন্তরে শিল্পী নন, সৃজনশীল নন, তারা স্বকল্প, বিকল্প, কোনো ধারার সিনেমাতেই তেমন কোনো অবদান রাখতে পারবেন না। এক পর্যায়ে তারা হতাশ হবেন, তখন নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে পরনিন্দা-পরচর্চা করবেন, অন্যদের জন্যে সমস্যা সৃষ্টি করবেন। বিকল্প সিনেমার জগৎ ছেড়ে চাকুরী, ব্যবসা বা অন্য পেশায় যাওয়াই তাদের জন্যে ভালো হবে।

আর সত্যিকারের সৃজনশীল তাড়না যার ভেতরে আছে সৃষ্টি সে করবেই। কারণ অন্যথায় তো সে রাতে ঘুমোতেই পারবে না! অন্যেরা চলচ্চিত্র নিয়ে কথাবার্তা বলবে, নানা রকম পরিকল্পনা করবে, অনেক বাজেট তৈরী করবে, কিন্তু সিনেমা সৃষ্টি হবে না ! ছবি বানাতে গেলে ক্যামেরা নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে, নদীর কিনারে, বস্তীতে, হাটে-মাঠে ঘুরতে হয়, কেবল আজিজ সুপার মার্কেট বা শিল্পকলা একাডেমীর আড্ডায় ঘোরাফেরা করলে ছবি তৈরী হবে না। সৃষ্টিশীলতার এ এমন এক ঘোরের জগৎ যে আপনার পরিবার বা বউ আপনাকে ভুল বুঝবে, সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে সঠিক বিয়েটা আপনি করেননি, আপনার প্রেমিকা আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে, বুঝবেন সঠিক প্রেমটি করেননি, আপনার বন্ধুরা দূরে সরে চলে যাবে, তারা হয়তো সঠিক বন্ধু ছিল না। আপনাকে চালিত করবে শুধুই কেবল আপনার সৃষ্টিশীলতার তাড়না। তা আপনাকে নিয়ত উদ্বেলিত করবে, উত্তেজিত করবে, ক্ষেপিয়ে বেড়াবে। তবে মনের গভীরে ওই বিশ্বাসটা রেখে এগোতে হবে, শান্তিনিকেতনের সাদা দাড়িওয়ালা সেই বৃদ্ধটিরই কথা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরযাঁর নাম, যে“ডড়ৎশ ডরষষ ডরহ”। কাজটাই বিজয়ী হবে। কথা, অহং বা অভিমান নয়। তাই কাজগুলো করে ফেলাটা জরুরী। সব কিছু ছেড়ে।

ছবি তৈরীর নানা রকম সুযোগ অবশ্য তরুণদের সামনে ইদানীং তৈরী হচ্ছে যা আগে ছিল না। তবে সুযোগ তারই সামনে আসে যে প্রস্তুত থাকে। ওই যে হ্যামলেট বলেছিল;“জবধফরহবংং রং ধষষ”। আর মনে রাখতে হবে সুযোগ সর্বদাই আসে কোনো একটা কাজের আবরণে। প্রথমে মনে হবে যেন এটা একটা কঠিন কাজ। কিন্তু তার আড়ালেই ঢাকা থাকে সুযোগ। এবং কাজটা যত কঠিন, সুযোগ ও সম্ভাবনাও ততই বেশী।

কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো নানাভাবে এদেশের বিকল্পধারার ছবিকে ক্ষতি করার চেষ্টা করে থাকে। করবেও। তারা শত্রæ চেনে। প্রথমত: তারা ক্ষতি করে আমাদের ছবিগুলি সম্পর্কে তাদের পত্রিকাগুলোতে নানা নেতিবাচক সমালোচনা ছাপিয়ে। অথবা, নীরবতা দিয়ে এসব ছবির মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করে। ইংরেজীতে যাকে বলে “করষষ নু ংরষবহপব”। আর এ ব্যাপারে কর্পোরেট পুঁজির হয়ে কাজ করে তাদের পেটোয়া জনপ্রিয় বাজারী পত্রিকাগুলো বা টিভি চ্যানেলগুলো আর এসব পত্রিকার মেধাহীন বা অতিচালাক সাংবাদিকেরা। এসব চলচ্চিত্র সাংবাদিকেরা মূলত: সেই সব ছবি নির্মাতাদের ছবি নিয়েই লেখালিখি করে যাদের কাছ থেকে তাদেরঘটে থাকে কোনো প্রাপ্তিযোগ। বিকল্পধারার নির্মাতাদের তা’ দেবার রুচি বা অর্থ থাকে না। ফলে তাদের কাজ সম্পর্কে এসব পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলোর রয়েছে এক ধরণের নিষ্পৃহ নীরবতা বা গোপন শত্রæতা।

তাই এটা ধরেই নিতে হবে যে কর্পোরেট মিডিয়া আমাদের সহায়তা করবে না। তাদের চ্যানেলগুলো আমাদের ছবি তেমন দেখাবে না। আর দেখালেও যে অর্থটা দেবে, তার অঙ্কটা হাস্যকর। আর কর্পোরেট স্বার্থের বড় বড় পত্রিকাগুলোও আমাদের ছবির খবর পারতপক্ষে ছাপবে না, যদি না তাদের সাংবাদিকদের জন্যে আলাদা খামের ব্যবস্থা আপনি না করেন। যারা বিজ্ঞাপন চিত্রের জগত থেকে ছবি বানাতে এসেছেন, বহুজাতিক টেলিফোন ও দেশী-বিদেশী অন্যান্য কোম্পানীর বদৌলতে, তারা বেশ ধনী। ফলে তাদের দেয়া খামগুলো বেশ মোটাই হয়। ফলে তাদের তৈরী নি¤œমানের ছবিগুলোও এসব পত্রিকায় ব্যাপক প্রচার পায় এবং এসব মধ্যমমানী নির্মাতাদেরকে রীতিমতো তারকা বানিয়ে ফেলা হয়।

বিকল্প সিনেমার ক্ষতি করার আরেকটা পদ্ধতি হচ্ছে শুরুতেই খুব আজেবাজে একটা লেখা লিখে কোনো ছবিকে ধ্বংস করার চেষ্টা। খুব আজেবাজে লেখা কারণ পরিপূর্ণ একটা চলচ্চিত্র সমালোচনা লেখার বিদ্যা ও মেধা এসব সমালোচকদের তেমন থাকে না। এটা আবার ঘটে আমাদের এই ধারারই কাছাকাছি কারো দ্বারা। ঈর্ষা অন্ধ ! চীনারা খুব প্রাচীন জ্ঞানী জাতি। ওদের একটা প্রবাদ আছে; “সেই সেরা বন্ধু যে আমার দু:খেই শুধু দু:খিত হয় না, আমার সুখেও সমভাবে সুখী হয়।” বন্ধুর আনন্দে সমানভাবে সুখী হতে পারা, সব রকম ঈর্ষার উর্ধ্বে উঠে সমভাবে আনন্দিত হওয়া, সেটাই বন্ধুত্বের সবচে’ বড় পরিচয়। আপনার দু:খে অনেকেই সমবেদনা দেখাতে পারে, সেটা বন্ধুত্বের বড় কোনো মাপকাঠি নয়। আপনার আনন্দে যে সমানভাবে আনন্দিত হতে পারে, প্রকৃত বন্ধু সেই-ই। প্রাচীন চীনারা নি:সন্দেহেই খুব জ্ঞানী ছিলেন!

আমাকে অনেক সময়ই নতুনদের কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। কার কাজ কেমন ? ইত্যাদি। যারা বেশ কিছু ছবি বানিয়েছেন তারাও তাদের কাজ সম্পর্কে মতামত জিজ্ঞেস করেন। মুখে বলেন; “খোলাখুলি সমালোচনা করবেন কিন্তু”। তবে অভিজ্ঞতায় জানি, মানুষ যখন তার কাজ সম্পর্কে মতামত দেবার কথা বলে, তখন মুখে সমালোচনা-শুনতে-চাই এ কথা বললেও আসলে শুনতে চায় প্রশংসা। মা যেমন তার নিজের সন্তানের দুর্নাম সইতে পারে না, তেমনি কোনো শিল্পীই তার সৃষ্টির সমালোচনা সইতে পারে না। ফলে ওপথে না হেঁটে আমি বরং নতুন প্রজন্মের নির্মাতা ও তাদের ছবি সম্পর্কে আমার দুটো সাধারণ উপলব্ধি বলি। এক, যারা বিজ্ঞাপন জগৎ থেকে ছবি তৈরী করতে এসেছেন তাদের ছবিতে ইমেজগুলি ভালো থাকে। ইমেজের ব্যাপারে তাদের যতœ ও দক্ষতা থাকে। কিন্তু গল্পের বাঁধুনি ও গল্পটির প্লট, থীম ও চরিত্রগুলির বিকাশ যথাযথভাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাদের সমস্যা রয়ে যায়। কারণ দশ-পনেরো সেকেন্ডের একটা গল্পের ইঙ্গিত, বিজ্ঞাপনী ছবিতে যেমনটি থাকে, বলতে পারাটা সহজ, কিন্তু দুই ঘন্টা ধরে একটা গল্পকে তার সকল যৌক্তিকতা, চরিত্রদের আন্ত:সম্পর্ক ও সামাজিক বাস্তবতাসহ পর্দায় বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরা সহজ কাজ নয় মোটেই। আর যারা মঞ্চ নাটকের জগৎ থেকে এসেছেন, তাদের ছবিতে অভিনয় ও সংলাপ ভালো থাকলেও ইমেজ আবার বেশ দুর্বলথাকে। আর ছবি হয় বড্ড বেশী সংলাপময়। এক ধরণের “টকীজ”। এবং চলচ্চিত্রের ছাত্র মাত্রেই জানেন “টকীজ” কোনো উন্নত সিনেমা নয়।

একটা সমাজে সত্যিকারের সৃজনশীল মানুষ খুব বেশী থাকে না। একটা সভ্য রাষ্ট্র ও সমাজের কর্তব্য থাকে একজন শিল্পীর সৃজনশীলতার বিকাশ ও প্রকাশে সর্বাত্মক ভূমিকা রাখা। আর রাষ্ট্র যদি তা না রাখে আমাদের কর্তব্য হবে পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে আসা, পরস্পরকে সাহায্যের মাধ্যমে যৌথভাবে এগিয়ে চলা। সে কারণেই আমরা যৌথ সিনেমার কথা বলেছি। বর্তমানে এ বিষয়টা আরো জোর দিয়ে বলছি। কারণ এদেশের কর্পোরেট পুঁজি দ্রæত বিকশিত হচ্ছে এবং তারা বিকল্প সিনেমাকে গিলে খেতে চায়। টিঁকে থাকতে হলে কর্পোরেট পুঁজিসৃষ্ট ব্যক্তিস্বার্থের বিপরীতে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যৌথভাবে সিনেমা তৈরী করা, এক ধরণেরÑফিল্ম কালেকটিভ। বিকল্প সিনেমার নির্মাতাদের নিজেদেরকে যৌথভাবে এ ধরণের ফিল্ম কালেকটিভ-য়ে সংগঠিত হতে হবে। একা একা লড়তে গেলে তাদের অবস্থা ‘মহাভারত’-য়ের অভিমন্যুর মতোই হবে। কর্পোরেট পুঁজির বুহ্যের ভেতরে হয়তো ঢুকতে পারবেন, কিন্তু বের আর হতে পারবেন না।

আসলে চলচ্চিত্র নির্মাণটাই তো একটা যৌথ কাজ। অনেক যতœ করে আমাদেরকে আমাদের নিজস্ব একটা ফিল্ম ইউনিট গড়ে তুলতে হয়। আমি নিজে প্রায় পঁচিশ বছর ধরে একই ফিল্ম ইউনিট নিয়ে কাজ করেছি। কোনো ভাঙ্গন ধরেনি। যৌথ কাজের প্রধান দিকটিই হচ্ছে, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে কাজ করা। হতে হবে সম্পূর্ণভাবে ঈর্ষা ও অসূয়মুক্ত। তবে সৃজনশীল কোনো মাধ্যমেই যৌথভাবে কাজ করাটা তেমন সহজ নয়। যৌথভাবে ছবি নির্মাণ যেমন কঠিন তার চেয়েও কঠিন যৌথভাবে কোনো চলচ্চিত্র-আন্দোলন বা শিল্প-আন্দোলন গড়ে তোলা। কারণ শিল্পীরা হন আত্মকেন্দ্রিক, অভিমানী, ভোগেন নানা রকম অহংয়ে। অনেকে হন অসূয়মনোভাবাপন্ন। সিনেমায় কাজটা আরো বেশী কঠিন, কারণ এখানে অর্থ ও খ্যাতির প্রশ্নটা জড়িত। বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমার আন্দোলন গত তিন দশক ধরে এই কঠিন কাজটাই এদেশে করে চলেছে। হয়তো সর্বদা সফল হয়নি। কিন্তু এটাও সত্য আমাদের ঐক্যে কোনো ভাঙ্গন ধরেনি। কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন “দশ বছরে সঙ্ঘ ভেঙ্গে যায়।” বাংলাদেশের বহু সাংস্কৃতিক সংগঠন দ্বিধা, এমন কী ত্রিধা বিভক্ত হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম কখনো ভাঙ্গেনি। যদিও কখনো কখনো কেন্দ্রাতিগ কিছু প্রবণতা দেখা গেছে, তারপরও বাংলাদেশশর্ট ফিল্ম ফোরাম অখন্ডই আছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ বড় কম সাফল্য নয়।

শুরুটা আদর্শই ছিল। সামরিক শাসনের সময়কালে এজিট প্রপ ধারায় তৈরী “আগামী”-“হুলিয়া” এসব ছোট ছবি সে যুগের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাদের ভূমিকা রেখেছে। আমরা সব সময় বিশ্বাস করে এসেছি বিকল্পধারার নির্মাতারা এমন ছবি করবে যা শাসকশ্রেণীর পক্ষে নয়, কথা বলবে জনগণের সপক্ষে, বিশেষ করে জনগণের বঞ্চিত অংশগুলির কথা তারা তুলে ধরবে। তারা হয়ে উঠবে ভাষাহীনদের কন্ঠÑাড়রপব ঃড় ঃযব াড়রপবষবংং। অনেক সংকটের মধ্যেও আমরা আশা রাখি নতুনেরা অন্তত: সবাই কর্পোরেট পুঁজির কাছে বিকোবে না। হারাবে না বিদেশী ফেস্টিভ্যালের মোহনীয় জগতে। কিছু তরুণ সব সময়ই থাকবে যারা এদেশের বঞ্চিত জনগণের জন্যে, জনগণের স্বার্থে, ছবি তৈরী করতে চাইবে, আঁকতে চাইবে আমাদের দু:খিনী বাংলা মায়ের প্রকৃত রূপ ও সঙ্কট। আর তারা ছবি তৈরী করবে বিকল্প ধারাতেই।

যখন আমাদের সুদিন তখন জোর কদমে সামনে এগিয়ে চলা চাই। যখন রাষ্ট্র, সমাজ আর সময় অনুকূল নয়, তখন নিজের অবস্থান ঠিক রেখে লড়াই করতে হবে কৌশলে, গ্রামসি যাকে বলতেন “পরিখা যুদ্ধ”। দেশে ইসলামী মৌলবাদ আর ধর্মান্ধতা যে হারে বাড়ছে তাতে আমরা যদি এখনই কোনো যুদ্ধজয় নাও করতে পারি, তবু যাতে হেরে না যাই, তাই নিজেদের অবস্থানে দৃঢ় থেকে “পরিখা যুদ্ধ”-টা চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের ক্ষেত্রে সে যুদ্ধটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনার নানা রকম ছবি তৈরী করে দেশের সর্বত্র তা বিকল্পভাবে ছড়িয়ে দেয়া। এক অসাম্প্রদায়িক ও আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দেশে এক সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটানোতে আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী অবদান রেখে চলা। আমাদের মতো ধর্মান্ধ ও স্বল্প গণতন্ত্রের দেশে নিপীড়িত ও বঞ্চিত সংখ্যালঘুদের কথা বিকল্প চলচ্চিত্র নির্মাতাদেরকেই সাহস করে বলতে হবে। আমার সীমিত শক্তি নিয়ে আমি সব সময়ই তাই এদেশের সংখ্যালঘুদের দূরবস্থা নিয়ে ছবি তৈরীর চেষ্টা করে এসেছি। মুসলমান শাসকশ্রেণীর হাতে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের দূরবস্থা নিয়েÑ“চিত্রা নদীর পারে”, বাংলাদেশী শাসকদের হাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃতাত্তি¡ক সংখ্যালঘু চাকমা-মার্মাদের সমস্যা নিয়েÑ“কর্ণফুলীর কান্না”, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা ভাষিক সংখ্যালঘু উর্দূভাষী মুসলমান বা বিহারীদের জীবনের সমস্যা নিয়েÑ“স্বপ্নভূমি”। আমরা বিশ্বাস করি একজন শিল্পী মুসলমান নন, হিন্দু নন, বাঙ্গালীও নন। তিনি কেবল মানবতার শিল্পী। বিকল্পধারার নির্মাতাদের এই বিশ্বাসটা মনের ভেতরে রাখতে হবে। অন্যথায় লালন বা রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমরা কী ই-বা শিখলাম ! যেখানেই মানবতার বিপর্যয়, সেখানেই রইবেন বিকল্পধারার নির্মাতারা। এ ব্যাপারে আমাদের নিজেদের বিবেককে রাখতে হবে স্ফটিক স্বচ্ছ। আমি বিশ্বাস করি আত্মা স্বচ্ছ না থাকলে শিল্প সৃষ্টি করা যায় না। শাসকশ্রেণীর কৃপা লাভের আশায় আত্মা যেন কলুষিত না হয়। আর শাসকদের দরবারে বেশী না যাওয়াই ভাল। মধ্যযুগের পারস্যের সুফী সাধক আলেম মাওরী সুফিয়ানের ওই কথাটা আমি তাই মনের ভেতরে মাঝে মাঝেই আওড়াই; “রাজাদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ যিনি শিল্পী-সাহিত্যিকদের সাহচর্য্য চান, আর শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি নিকৃষ্ট যিনি রাজার সাহচর্য্য চান”। যারা শিল্পী হতে চান তাদের বঙ্গভবন, গণভবন, মন্ত্রণালয়, এসব জায়গায় বেশী ঘোরাফেরা না করাই ভাল।

ডিজিটাল প্রযুক্তি চলচ্চিত্রনির্মাণের প্রক্রিয়াটার এতই বি-রহস্যকরণ ঘটিয়েছে, বিশেষ করে ইরানের সৃজনশীল সব নির্মাতাদের দ্বারা, যে গদার হয়তো যথার্থই বলেছেন সিনেমার জন্ম হয়েছিল গ্রিফিথের হাতে, মৃত্যু ঘটল কিয়ারোস্তামির হাতে ! হ্যাঁ, পুরনো কায়দার বিশাল সব যন্ত্রপাতি, কৃত্রিম সেটের সিনেমা তৈরীর দিন শেষ। এখনকার ক্যামেরা পালকের মতোই হালকা। তবে সিনেমা হালকা হলে চলবে না, হওয়া চাই কিয়ারোস্তামির ছবির মতোই বহুস্তরবিশিষ্ট, হওয়া চাই মায়াকোভঙ্কির ইজের-পরা-মেঘের মতোইÑগভীর।

বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমার হয়তো অনেক ব্যর্থতা আছে, কিন্তু কিছু সাফল্য তো আছেই। এফডিসি-ওয়ালারা সব সময়ই আমাদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। বলেছে ১৬ মি:মি: বা ডিজিটালে আবার সিনেমা হয় না কী ! বলেছে সিনেমা হলে না দেখানো হলে তা আবার সিনেমা না কী !! বর্তমানে চক্র ঘুরে গেছে। কিছু দিন আগে এফডিসি-র কিছু বাঘা নির্মাতা আমার বাসায় এসেছিলেন। বেশ বিনয়ের সঙ্গেই বললেন, এফডিসি-র সিনেমা তো প্রায় ধ্বংসের পথে। আমরা তো কোনো পথই খুঁজে পাচ্ছি না। আপনারা আমাদেরকে পথ দেখান। আমি ওঁদেরকে বলেছি, কাউকে পথ দেখানোর যোগ্যতা আমার নেই। আমি বরং দেশে-বিদেশে আমার কিছু অভিজ্ঞতার কথা আপনাদের বলি। তারা মন দিয়েই আমার কথা শুনেছিলেন। আমাদের ধারার ছবির কিছু সাফল্য না থাকলে তাঁরা কী আর আমার কাছে আসতেন ! অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, এদেশে ভালো ছবির জন্যে কী কী করা উচিৎ ? আমাদের চলচ্চিত্রগুলি, আমাদের লেখালিখি, আমাদের সাংগঠনিক কাজগুলি বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ার চেষ্টাগুলি কী এই বার্তা প্রতিনিয়ত দিচ্ছে না যে এদেশে সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশে ঠিক কী কী করা উচিৎ ?

জীবনে সময় খুব মূল্যবান। এবং ধীমান মানুষেরা গুরুত্বপূর্ণ কাজেই সময় ব্যয় করে। এফডিসি-তে অনেক কিছুই আছে যা আমার পছন্দের নয়। কিন্তু একটা জিনিষ আমার বেশ পছন্দের। তা’ হচ্ছে ওখানে একটা সাইনবোর্ডের একটা উদ্বৃতি। উদ্ধৃতিটি হচ্ছে;

Small minds discuss people

Average minds discuss events

Great minds discuss ideas

Greatest of mind works in silence

 

ঈস ! এফডিসি-র লোকজনেরা যদি এই সাইনবোর্ডটা মন দিয়ে পড়তেন বা ওদের নিজেদের জীবনে অনুসরণ করতেন! তবে কেবল এফডিসি-র নির্মাতাদের জন্যে নয়, একই বিষয় বিকল্প সিনেমানির্মাতাদের জন্যেও প্রযোজ্য। সিনেমা বানাতে বেশী কথা, বেশী হৈ চৈয়ের দরকার নেই। হৈ চৈ হবে কেবল শুটিং-য়ের সময়টায়। বাকী কাজটা নির্মাতার নিজস্ব নিমগ্ন কাজের সময়। তাহলেই কিছু সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা।

জমা-খরচ তো হো’ল, এখন ইজা, মানে হাতে রইল কী ? শুধুই কী পেন্সিল ! না, তা নয়। রয়েছে সুবিশাল ও বৈচিত্র্যময় এক অভিজ্ঞতা যা থেকে আগামী দিনের তরুণেরা অনেক কিছুই শিখতে পারবেন।

বাংলাদেশের বিকল্পধারায় কতগুলো ধ্রæপদী ছবি হয়েছে, এই ধারা দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে কতটা পৌঁছতে পেরেছে, কতটা গভীর ও সুদূরপ্রসারী হতে পেরেছে আমাদের সংস্কৃতিতে বিকল্প সিনেমার প্রভাব, কেবল সেসব বিচারই বিকল্পধারার আন্দোলনের সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি নয়। বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমা একটা ধারা, একটা মডেল। এখন অন্য কেউ যদি এই ধারাটাকে অনুসরণ করে, এখান থেকে কিছু শেখে এবং তারা যদি আমাদের সংগঠন না-ও করে, এমন কী আমাদের বিরুদ্ধ পক্ষও হয়, কিন্তু আমাদের কর্মপন্থাগুলি যদি অনুসরণ করে, তবে তা আমাদের বিকল্পধারারই সাফল্য বলে মনে করতে হবে। এদেশে এখন অনেক চলচ্চিত্রকার রয়েছেন, বিশেষ করে বয়সে তরুণ, যারা নিজেদেরকে হয়তো ঠিক “বিকল্পধারার চলচ্চিত্রকার” বলেন না, কিন্তু তাদের ছবি তৈরীর প্রক্রিয়া ও সেসব ছবির প্রদর্শনের ব্যাপারে তারা আমাদের শুরু করা পথের অনেক কিছুই আজ অনুসরণ করে চলেছেন। সেটাও তো আমাদের বিকল্পধারারই এক ধরণের সফলতা।

একটা জিনিষ মনে রাখতে হবে, প্রতিষ্ঠান থাকলেই তার বিকল্প থাকবে। প্রতিষ্ঠান তার রূপ, চরিত্র ও ধরণ পাল্টালে বিকল্পও তার রূপ, চরিত্র ও ধরণ পাল্টাবে। এ এক নিয়ত ছায়াযুদ্ধ! যেখানেই প্রতিষ্ঠান সেখানেই তার বিকল্প। তা’ সে চলচ্চিত্র নির্মাণ, প্রচার ও প্রদর্শন যেখানেই হোক। ফলে আমাদেরকেও নিয়ত পাল্টাতে হবে। হচ্ছে। এক সময় ভালো ছবি বানিয়েছি কেবল সেই আত্মপ্রসাদ নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আর একটা ব্যাপারেও সতর্ক থাকাটা জরুরী। তা’ হচ্ছে বিকল্পও এক সময় মূলধারা হয়ে উঠতে পারে। তখন প্রয়োজন তারও বিকল্প। প্রতিনিয়ত নিজেকে নবায়ন করা, যুগোপযোগী করা, জন-বান্ধব করা। এমন হতে পারে যে এক সময় বিকল্পধারার যারা বড় প্রবক্তা ছিলেন জীবনের চাপে তারা পরিবর্তিত হয়ে গেছেন। ব্যক্তি পতনশীল, পচনশীলও। কিন্তু সত্য ও শিল্প পতনশীল নয়, পচনশীল তো নয়ই। ব্যক্তি হয়তো ঝরে পড়তে পারেন, বসে পড়তে পারেন, কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাণের একটা ধারা হিসেবে বিকল্পধারাটা এদেশে টিঁকেই থাকবে।

এটা ঠিক যে বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমা তার জন্মলগ্নে যে সম্ভাবনা দেখিয়েছিল পরিণতি সে রকম হয়নি। সব কিছু আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়নি। তবে খুব দূরেও যায়নি। আমাদের বয়স হয়েছে। তবুও আমরা এখনও ময়দান ছেড়ে যাইনি। তবে আমরা সব সময় ভরসা রাখি এদেশের তারুণ্যের উপর। বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা পৃথিবীর যে কোনো দেশের তরুণদের সমকক্ষ। তারা পারে না এমন কাজ নেই। এ কথা আমি ভুলি না যে বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের বয়স মাত্র তেইশ বছর ! এবং তারা অনেক সময়ই পৃথিবীর অনেক বাঘা বাঘা দেশকে হারিয়ে দেয়। এক যুগের তরুণেরা বাংলাদেশে এই বিকল্প ধারার আন্দোলন শুরু করেছিল, আরেক যুগের তরুণেরা সেটা এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। নদীমাতৃক দেশ আমাদের। আমরা জানি ভাঁটা যেমন আসে, তেমনি জোয়ারও এক সময় আসবেই। এবং আসে অবধারিতভাবেই। তাই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সব যুগেই, সব কালে, তরুণেরা প্রতিবাদী হবেই। তারা তাদের স্বপ্নের ছবি বানাতে চাইবে। এবং বানাবে বিকল্পধারাতেই।

আর যারা দেশে-বিদেশে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়ার সুযোগ পেয়েছে বা চলচ্চিত্রের মতো একটা সর্বাধুনিক শিল্পমাধ্যমটিহাতেকলমে শেখবার সুযোগ পেয়েছে, শুধুমাত্র সুবিধাপ্রাপ্ত সেরকম কিছু ব্যক্তিরা নয়, আজ সবাই-ই হোক নির্মাতা। বর্তমানের আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি, এই ডিজিটাল যুগ, আমাদের সামনে সে সম্ভাবনা আজ সৃষ্টি করেছে। আসুন এই নতুন যুগকে স্বাগত জানাই। শত বছর আগে এক বাঙ্গালী, আমাদের মাণিকগঞ্জের বকজুড়ি গাঁয়ের ছেলে হীরালাল সেন যা শুরু করেছিলেন, সেই চলচ্চিত্র মাধ্যমটি আজ শতগুণে বিকশিত-প্রভাবে, প্রযুক্তিতে। তাকে আজ আমরা সারা বাংলায় আরো ছড়িয়ে দিই। চলচ্চিত্র শুধু সিনেমা হলে বা টেলিভিশনের পর্দায় নয়, সৃষ্টি হোক, প্রচারিত হোক, ইউটিউবে, ল্যাপটপে, মোবাইল ফোনে। ছবি হোক ঘরের দেয়ালে, মুক্ত আকাশে। ছবি হোক আমাদের হৃদয়ের গভীরে গভীরে। এই স্বপ্নই আমি দেখি।

আসলে বিকল্প সিনেমা একটা স্বপ্নেরই নাম। শুরুটা হয়েও ছিল এক স্বপ্ন দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে স্বাধীনতা, অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি ও গণতন্ত্রের বিকাশের স্বপ্ন নিয়ে। সত্তর-আশির দশকে আমরা যারা বড় হয়েছি, সোনার বাংলার স্বপ্ন আমরা কখনও ভুলিনি। সোনার বাংলা গড়বে সোনার মানুষেরা। আর সে সোনার মানুষেরা হবে বিশ্ব মানবতায় সমৃদ্ধ, বাঙ্গালীর সাংস্কৃতিক চেতনায় ঋদ্ধ, এবং তাদের উন্নত সেই সংস্কৃতি চেতনায় আমরা সর্বাধুনিক শিল্পমাধ্যম চলচ্চিত্রকে রাখতে চাই খুব বড় এক জায়গায়। কারণ চলচ্চিত্র হবে আগামী প্রজন্মের সবচেয়ে প্রিয় শিল্পমাধ্যম। তো সেই শিল্পিত সোনার বাংলার স্বপ্ন জারী থাকুক। জারী থাকুক বিকল্প সিনেমার স্বপ্নগুলিও।

* লেখাটি বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটি ফেডারেশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তৃতা হিসেবে ২০১৭ সালে পঠিত।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত