শারদ অর্ঘ্য ভ্রমণ: কেতাদুরস্ত যোগিনীদের গ্রামে । ফাতিমা জাহান
বাসের পেছনে পেছনে আমি দৌঁড়াচ্ছি আর চেঁচাচ্ছি, ‘আরে ভাই রোকো, লে যাও মুঝেএএএএএ।’
ভাই, ড্রাইভার ভাই থামো ভাই, আমাকে নিয়ে যাও। আমি এই মুহুর্তে বাস মিস করতে চাইনা। দু’ সেকেন্ড দেরি হয়েছে মাত্র বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাতে তার মধ্যেই বাস ছুটে যাচ্ছে দেখলাম আমার সামনে দিয়ে। অটোরিকশা চালককে ভাড়াও মেটাইনি। আমার সাথে ঢাউস এক স্যুটকেস। সব ফেলে আমি বাসের পেছনে ছুটছি। আমার সাথে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন ছুটছে আর চিৎকার করে বাস থামাতে চাইছে। এ জীবনে আমি বহু কান্ড করেছি তার মধ্যে অন্যতম বিভিন্ন জায়গায় বাসের পেছনে ছুটে ছুটে বাস থামানো। এখন আমি যাব ভুবনেশ্বর, ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের পুরী শহর থেকে। আমার চেঁচামেচিতে বা ছুটোছুটিতে হোক কুম্ভকর্ণের ঘুম অবধি ভেঙে যায় আর এ তো সামান্য বাস। শেষমেশ আমি বাসে চড়তে পারলাম সেই ঢাউস স্যুটকেস নিয়েই। আমি সাধারণত ভ্রমণ করি ছোট একটা ব্যাকপ্যাক নিয়ে। কিন্তু এবারে আমার ভ্রমণ দীর্ঘ। ঢাকা থেকে কলকাতা, শান্তিনিকেতন, ফের কলকাতা, তারপর পুরী, ভুবনেশ্বর হয়ে আমি যাব মহারাষ্ট্র, এরপর ব্যাঙ্গালোর নিজের আস্তানায়। আমি এরকম দীর্ঘ ভ্রমণ প্রায়ই করে থাকি তবে ঢাউস স্যুটকেস ছাড়া।
বর্ষাকাল পুরী শহরের পা ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কখনো মেঘলা বা কখনো জলের বিন্দু দিয়ে ঝাপটা দিয়ে বাসের জানালায় ছবি আঁকতে। বর্ষা এক চপল স্বভাবের ঋতু। এই এক ছবিতে আছে তো সাথে সাথেই অন্য ক্যানভাসে ছবি আঁকা শুরু করে। বাইরে সতেজ গাছপালা উছলে উঠছে নতুন রঙ পেয়ে, নিখাদ সবুজ। এই বুঝি শরৎ এসে গেল, এই বুঝি ঝকঝকে নীল আকাশ দেখিয়ে জানান দিল। এইসব নানান রঙ দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ভুবনেশ্বর শহরে। শুনেছি শহরটা নাকি বড়। বড় শহরের হৃদয়ও কি আকাশের মতো বড়!
হোটেল খুঁজে পেতে বেগ পেতে হলোনা৷ রুম বুঝে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখি বাইরে সবুজ আর বরষা ঝাপিয়ে পড়েছে একসাথে। এই শহরে এক টুকরো বনানী বোধহয় আমার জন্যই রেখে দেয়া আছে।
ভুবনেশ্বর শহরে আমি থাকব সাকুল্যে চার দিন। এখনো বেলা পড়ে যায়নি। ভুবনেশ্বর শহরে আসার আগে মনে যে ছবি আঁকা আছে তা হল হরেক মন্দিরের আর তার চেয়েও আকর্ষণীয় সব পুরাতন কাহিনীর। আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে প্রথমেই যাব চৌষট্টি যোগিনীর মন্দিরে। মন্দিরে কি সত্যি সত্যিই ৬৪ জন যোগিনী বাস করে। সেরকমই শুনেছি এবার কলকাতায় কবি সমরজিৎ সিংহ এর কাছে। কবি দম্পতি প্রীতি আর সমরজিৎ এর আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম এবার কলকাতায়। সমরজিৎ বলেছিলেন তিনি সেখানে গিয়েছিলেন সন্ধ্যে বেলায়। চারিদিকে নির্জন, থমথমে ভাব। জনমানবহীন মন্দিরে গা ছমছমে আবহাওয়া। হঠাৎ সমরজিৎ এর কাঁধে পেছন থেকে কে যেন হাত রাখল। সমরজিৎ ভয়ে অস্থির। নাহ আমি আর ভাবতে পারছিনা, আমাকে এক্ষুনি যোগিনীদের মন্দিরে যেতে হবেই। সন্ধ্যের দিকে হলে আরও ভালো হয়।
মন্দিরটি ভুবনেশ্বর শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে হীরাপুর নামের একটা জায়গায় অবস্থিত। মন্দিরের দিকের রাস্তা সরু তাই ট্যাক্সি না নিয়ে অটোরিকশা নিয়ে হীরাপুর রওনা হলাম।
চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির নির্মাণ করেছিলেন ব্রহ্ম রাজবংশের রাণী হীরা দেবী। হীরাপুর জায়গাটির নামকরণ তাঁর নামেই হয়েছে। সময়টা ছিল নবম শতাব্দী। বলা হয়ে থাকে নারী হল দুর্গার আরেক রূপ। হীরা দেবীর মনে পড়ে গেল দেবী দুর্গা একসময় এক অসুরকে দমন করার জন্য ৬৪ বেশে ৬৪ যোগিনীর রূপ ধারণ করেছিলেন। সেই পুরাণ অনুসরণ করেই আমাদের দুর্গারূপী হীরার মতো বিখ্যাত রানী এক মন্দির নির্মাণের আদেশ দিলেন, নাম হল চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির। এক সময় নাকি এই মন্দিরে তন্ত্রমন্ত্রের সাধনাই বেশি হত। আমি যখন যাচ্ছিই তখন কিছু তন্ত্রমন্ত্র নিশ্চয়ই শিখে আসতে পারব।
মন্দিরে প্রবেশের পথ বেশ এবড়োখেবড়ো। দু’ পাশে সবুজ ধানক্ষেত আর মাঝখানে সরু আলের মতো পথ। মনে হচ্ছে নেমে এক দৌড়ে পার হই বাকিটা পথ। এমন সবুজ ধানক্ষেত দেখলে এর মাঝখানে গিয়ে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এই ইচ্ছে পরে পূরণ পরে করলেও হবে। আমার অটোরিকশা এখন মন্দিরের দোরে পৌঁছেছে।
আমার মনে নানা জল্পনা কল্পনা। যেহেতু যোগিনীদের মন্দির সেহেতু আমাকে বশীকরণ কেউ করবেনা তো বা উল্টো বশীকরণের মন্ত্র শিখিয়ে দিতে পারে। আচ্ছা, এখানকার যোগীরা কি শুধু নারী নাকি পুরুষও আছে? যোগিনীরা নাকি পুরুষদের ভেড়া বানিয়ে রেখে দেয়? কই মন্দিরের আশেপাশে তো কোন ভেড়া দেখতে পাচ্ছিনা। কয়েকটা গরু অবশ্য দেখেছি আসার পথে। তবে কি এরাই তেনারা?
আর কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যে হবে। আমি অটোরিকশা ছেড়ে দেইনি, আবার নিয়ে যাবে আমায় ভুবনেশ্বর। চালকের নাম অমর, কত কথা জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু মনমতো জবাব পেলামনা।
যোগিনীদের মন্দিরে প্রবেশদ্বার বলে তেমন কিছু চোখে পড়লোনা। পাশে পুকুর, নাম মহামায়া। দুর্গা দেবীর নামে নাম। এই মন্দিরের আরেক নাম মহামায়া। আর চারপাশে ঘিরে রয়েছে মায়ার মতো সবুজ গ্রাম।
খানিকটা পায়ে চলা পথ পেরিয়ে মূল মন্দির। গোলাকৃতি ছাদহীন মন্দিরটি স্যান্ডস্টোনে নির্মিত। মন্দিরটি বাইরে থেকে খুব একটা বড় বলে মনে হলোনা। প্রবেশমুখে একটা বাচ্চা মতো ছেলে ছাড়া আর কাউকে দেখলামনা। ভেতরের গোলাকার দেয়ালের খোপে খোপে সারিবদ্ধভাবে যোগিনীদের মূর্তি। কষ্টিপাথরে নির্মিত প্রত্যেকটি মূর্তির উচ্চতা হবে দেড় ফুটের কাছাকাছি। দুয়ারে যে ছেলেটি লাল চাদর আর সবুজ ধুতি পরে দাঁড়িয়ে আছে সে নাকি এ মন্দিরের পুরোহিত। আমি তো বাচ্চা ছেলে ভেবে উপেক্ষা করছিলাম। নাম তার মনোজ কুমার। আমি ফিক করে হেসে বললাম, ‘মনোজ কুমার, তুমি কি সিনেমার হিরো?’ মনোজ কুমার গট গট করে ইংরেজিতে বলল যে, সে হিন্দী সিনেমা অত্যধিক পছন্দ করে। আমি কিছু না বলতেই আমার কপালে তিলক চন্দন এঁকে দিল আর মন্দিরের যোগিনীদের সাথে পরিচয় করাতে শুরু করল। একেক যোগিনীর একেক নাম – তারা, চন্ডী, বৈভবী, নর্মদা, যমুনা, ইন্দ্রাণী, পদ্মাবতী, মহানন্দা, মহেশ্বরী, কালী, উমা, নারায়ণী, ছিন্নমস্ত, মহালক্ষী, রতীদেবী, চামুন্ডী, অদিতি, মারুতি, গঙ্গা, উমাবতী আরও কত যে নাম। মনোজ কুমার এত দ্রুত বলে গেল যে ঠিকমতো ৬৪ জনের নামও বুঝতে পারলামনা। একদম মাঝখানে মূল দেবী নাম মহামায়া। একমাত্র তাঁর অঙ্গে লাল শাড়ি, গলায় লাল জবা ফুলের মালা। প্রত্যেকেই নাচের মুদ্রার ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকের খোপায় নানা রঙ্গের জবা ফুল গোঁজা। মনোজ বলতে লাগল, ‘এই যোগিনীরা মা দুর্গারই অবতার। এক জনের থেকে আরেকজন ভিন্ন। কারণ, এঁদের কেশ সজ্জ আলাদা, পা রাখার ভঙ্গিমা আলাদা, এঁরা প্রত্যেকেই অপূর্ব সালংকারা এবং ভিন্ন ভিন্ন বস্তুর উপর দাঁড়িয়ে। কেউ অসুরের উপর দাঁড়িয়ে, কেউ মূষিক, কেউ বা কচ্ছপ অথবা পদ্মফুলের উপর।’
মন্দিরের মাঝখানে চারকোনা বেদী। ছাদসহ এই বেদীর চার স্তম্ভে যোগিনীদের আকারের চারটি খোপে বা কুলুঙ্গিতে শিবের চারটি মূর্তি উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমে মুখ করে দাঁড়িয়ে। পাশে অন্য তিন যোগিনী। এতক্ষণ গোলাকার দেয়ালের ষাট যোগিনীর সাথে পরিচয় হয়েছিল। পরিচয় পর্ব শেষ হল বাকিদের সাথে। এদের মাঝে একজন নেই। প্রথম থেকেই ছিলেননা।
আমি বারবার যোগিনীদের কেশ সজ্জা দেখে বিষ্মিত হই। এত ধরনের খোঁপা যে বাঁধা যায় এ মন্দিরে না আসলে জানা হতোনা। এ কালের হেয়ার স্টাইলিস্টরা কত কিছু যে শিখতে পারবে কেশ সজ্জা আর স্টাইল সম্পর্কে। আর মডেল, নৃত্যশিল্পীদের জন্য তো অফুরান ভাণ্ডার যোগিনীদের হাত, পায়ের ভঙ্গিমা, মুদ্রা৷
প্রত্যেক যোগিনীর অলংকার দেখে তাক লেগে যায়। এত সূক্ষ্ম খোদাই। অলংকারের নকশা নকল করে কম করে হলেও কয়েকশো ডিজাইনের অলংকার তৈরী করতে পারবেন স্বর্ণকার বা জুয়েলারি ডিজাইনার। অলংকারে অঙ্গের অঙ্গন ভরেছে বলে পোশাক বাহুল্য মনে হয়েছে, অলংকার যোগিনীদের করেছে অপরূপা। একারণেই হয়তোবা মহামায়া ছাড়া কোন যোগিনীর অঙ্গে পোশাক নেই অথচ তাদের দেখলে নির্মল, নিষ্পাপ ভাব মনে আসে।
মনোজ কুমারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে তন্ত্রসাধনা করতে মানুষজন কখন আসেন?’ মনোজ বলল, ‘আগে অনেকেই আসতেন। যখন থেকে ভারত সরকার মন্দিরটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক দপ্তরের অধিভুক্ত করে মন্দিরকে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে তখন থেকে আর তন্ত্রমন্ত্রের সাধনা হয়না।’ আমি নিরাশ হলাম। এ কেমন কথা, দেখতে এসেছি যোগিনী আর তাদের কালো জাদু এসে দেখি সব কুছ উধাও।
অবশ্য দুর্গাপূজা আর নবরাত্রির সময় মন্দিরে পুজো বেশ ঘটা করেই হয়। মহামায়া বা মূল দেবী যিনি সবার মাঝে নৃত্যরত তাঁকে উদ্দেশ্য করে পাশের পুকুর থেকে মাছ এনে বলি বা উৎসর্গ করা হয়। আগে পাঠা বলিদানের চল ছিল। কথিত আছে বলিদানের পর পূজারি আর পেছন ফিরে না তাকিয়ে মন্দির ত্যাগ করেন এবং পরদিন ভোরে পূজো দেবার সময় এসে দেখেন যে বলিদানের জায়গায় মাছের কাঁটা পড়ে রয়েছে।
এমনিতেও মনোজ কুমারের প্রতিদিন ভোর চারটের আগে মন্দিরে উপস্থিত হতে হয়। দেবীদেরকে স্নান করানো এবং মহামায়াকে নতুন কাপড় পরানো হয়, এরপর হয় পূজো। সারারাত যোগিনীরা হাওয়ার সাথে জলকেলি খেলে। আভরনের ঝংকারে মাতিয়ে তোলে মন্দিরের ছাদহীন আকাশ। আকাশ দেখে, অগ্নি দেখে, বায়ু, জল, ক্ষিতি সব হয়ে যায় তখন এই পরমা সুন্দরী যোগিনীদের মিত্র। যোগিনীরা তখন খিলখিলিয়ে হাসে, নৃত্যগীতে জাগিয়ে তোলে চরাচর। আনন্দধারা বইয়ে দিতে দিতে পঞ্চতত্ত্ব পার করে রাত।
এই আনন্দময় ভূবনে এসে অতি আহ্লাদিত হবার সাথে সাথে খানিকটা হতাশও হলাম। দেখতে এসেছিলাম যোগিনী, ডাকিনী ; এসে দেখি শূন্য মন্দিরে হাওয়া খেলে। তবুও এত স্টাইলিশ, কেতাদুরস্ত যোগিনীদের সাক্ষাৎ পাওয়া কম পুলকের বিষয় নয়। ভারতের মেয়েরা কেন যে একে তাকে স্টাইল আইকন মানে বুঝিনা। যোগিনীদের এক কেশ সজ্জাই তো তাবৎ দুনিয়াকে কাত করে দেবে।
বাইরে বেলা পড়ে আসছে। সন্ধ্যের পর মন্দিরে এখন কাউকে থাকতে দেয়না। আমি মনোযোগ দিলাম সতেজ টিয়ে পাখির পালকের মতো গ্রামের দিকে৷ উড়িষ্যা আর বাংলার গ্রামের মাঝে কোন তফাৎ নেই। সেই নির্মোহ আকাশ, এখন দুর্গা দেবীর ঘরে ফেরার অপেক্ষায় আছে, সেই কমলা রঙ মাখানো আদুরে বাতাস না ছাড়তে পারছে বরষাকে না ছাড়তে পারছে শিউলির ঝাড়ে ঝড় তুলতে। সেই পরিচিত কিশোরের মতো চঞ্চল, সতেজ ধানক্ষেত দুলে দুলে ছুটে যেতে চাইছে ধবধবে সাদা মেঘেদের সাথে৷ কোথাও কোন অমিল নেই বাড়িঘরেরও।
অটোরিকশা চালক অমর দাদা আমাকে বললেন, ‘চল তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই’। আমি ভাবলাম হয়তোবা গাঁয়ের কোন বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। হয়তোবা সেটি তাঁর নিজের বাড়ি। গাঁয়ের এক বাড়িতে নিয়ে এলেন ঠিকই তবে সেটা এক শিল্পীর বাড়ি। নিকোনো উঠোন, বেড়ার ঘর আর শিল্পীর তুলি, এমন আগে দেখিনি। এখানে বাস করে এক ঘর শিল্পী, চিত্রশিল্পী। যে সে শিল্পী নন এঁরা। বংশপরম্পরায় তালপাতায় আঁকেন সূক্ষ্ম চিত্রকর্ম। বেশিরভাগ মহাভারত বা রামায়ণ থেকে নেয়া চিত্র বা দেবদেবী। তবে গ্রামবাংলার মানুষের জীবনের অংশও তুলে ধরেন চিত্রকর্মে। আর এই সূক্ষ্মতম শিল্প ফুটিয়ে তোলা হয় তালপাতার উপর। এই শিল্পীদের পূর্বপুরুষগণ লিখতেন তালপাতার উপর পুঁথি।
বাড়ির কর্তার নাম আশীষ। তিনি এবং তাঁর পুত্ররা মিলে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই ঐতিহ্য।
ফালি ফালি করে কাটা তালপাতা সুতো দিয়ে জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয়েছে চিত্রপট। খুলুলে ভাজে ভাজে লম্বা হয়ে একেকটা ক্যানভাসের আকার ধারণ করছে। পাতার সেই ক্যানভাসে ফোটানো হয়েছে সুইয়ের মতো বাঁশের তৈরী কলমের সূক্ষ্ম আঁচড়। আশ্চর্যের ব্যাপার হল আঁচড় কাটতে কোন কলম বা পেন্সিলের ব্যবহার করা হয়না। খালি চোখে বোঝাও যায়না সূক্ষ্ম চিত্রকলা। পাতার ভেতর সৃষ্টি হওয়া রেখার উপর তখন আঙ্গুল দিয়ে ঘষে দেয়া হয় কালি। বাড়তি কালি মুছে ফেললে দেখা মেলে রেখায় রেখায় সদাহাস্যজ্বল চিত্র। রেখানির্ভর সেসব ছবিতে প্রয়োজন মতো তখন নানা রঙের কালি ব্যবহার করা হয়। তালপাতার উপর এই শিল্প শত শত বছর টিকে থাকে, নষ্ট হয়না। প্রাচীণ বৌদ্ধবিহারগুলোতে এখনও তালপাতার উপর লেখা পুঁথি সংরক্ষিত আছে
পৃথিবীতে এখন এই শিল্পের সমঝদার অনেক কমে গিয়েছে। অথচ এই শিল্প ভারতবর্ষের এক অমূল্য সম্পদ। শিল্পীদের জীবনযাপনও মানবেতর।
বাইরে সন্ধ্যে ছেয়ে যাচ্ছে আলতো করে। এই মৌসুমের সন্ধ্যাগুলোতে লেগে থাকে উৎসবের রেণু। তাঁর আগমণের আশায় এস্রাজ বাজিয়ে গান করতে থাকে পাখিরা। কিছুদিন পর আসবে মহামায়া, মা দুর্গা। সে খুশীতে ঝিরিঝিরি হাওয়া বয় গাঁয়ের শান্ত গাছগাছালির মাঝ দিয়ে, সন্ধ্যের শেষ আলো অদ্ভুত এক রঙ ছড়িয়ে দিতে থাকে এক অচেনা গাঁয়ের রাঙা পথে৷

পর্যটক, কথাসাহিত্যিক
জন্ম ঢাকায়। বেড়ে উঠা ব্যাঙ্গালোরে, পড়াশোনা ব্যাঙ্গালোর ও সিঙ্গাপুরে।
পেশায় ফিন্যানশিয়াল অ্যানালিস্ট।