| 6 মে 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য গল্প: মঞ্জুদি । ফাহমিদা বারী

আনুমানিক পঠনকাল: 27 মিনিট

‘আচ্ছা মঞ্জুরিমা মানে মঞ্জুদি’র গল্প কি করেছি তোমার কাছে?’

‘কোন মঞ্জুদি?’ ঘাড়টাকে ভারী নিজস্ব কায়দায় একপাশে হেলিয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো তন্মা। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। কায়দাটা আমার ভীষণ প্রিয়। আমি বলি সুচিত্রা সেন স্টাইল।

‘মঞ্জুদি আমাদের পাড়াতে এক বিল্ডিঙয়েই থাকতো। আমরা থাকতাম চারতলায়, মঞ্জুদিরা দোতলায়…’

‘ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ… মনে পড়েছে। উনার গল্প করেছো তো! একবার না, দুই দুইবার! ঐ যে তোমার বড়ভাই পছন্দ করত যাকে। মেয়েটার ঘটনাটা ঘটার পরে তোমার বড়ভাই…’

‘হুউউম।’ কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। বুকের চাপধরা ব্যথাটা ফিরে আসছে একটু একটু করে। ইদানিং প্রায়ই এই ব্যথাটা ফিরে ফিরে আসে। খুব পুরনো কিছু কষ্ট দিয়ে মুড়ে রেখেছি ক্ষতস্থানটা। সময়ের পরত সেটাকে আরো আঁটসাঁট করে বাঁধতে পারছে না। উল্টো দিন যত গড়িয়ে চলেছে, বাঁধনগুলো কেমন যেন আলগা হতে শুরু করেছে। বেরিয়ে আসছে চাপ চাপ রক্ত। ব্যথার তীব্রতায় মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে আমার।

হঠাৎ তন্মা মৌনতা ভঙ্গ করলো। বললো, ‘আচ্ছা, তুমি কিন্তু কখনোই উনার পুরো গল্পটা শোনাওনি আমাকে! শুধু শেষটুকু বলেছ সবসময়। হয়ত মাঝখান থেকে একটু আধটু খাবলা মেরে। আমি পুরো গল্পটা শুনতে চাই! আজ বলবে?’

‘গল্প!’ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। যে জীবনটা একদিন সত্যি ছিল, আজ তা গল্প হয়ে গেছে! মাঝে কতগুলো দিন পেরিয়ে গেছে! প্রায় ত্রিশ বছর! মধ্য চল্লিশের দিকে ধেয়ে চলেছে আমার বয়স। দাদা বেঁচে থাকলে বয়স হতো পঞ্চান্নের কাছাকাছি। চাকরিবাকরি করলে হয়ত রিটায়েরমেন্টের দিন ঘনিয়ে আসত। অথচ সেই পঁচিশেই থমকে গেল জীবন চাকা!

মঞ্জুদি আর আমার দাদা রনকের জীবনের সেই গল্পটা মনে মনে আরেকবার আত্মস্থ করে নিলাম। একটা পাথর যেন চেপে বসতে চাইছে বুকের একেবারে মধ্যিখানে। পাশেই তন্মা আগ্রহভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি পাথরটাকে বহু কষ্টে টেনে হিঁচড়ে একপাশে সরিয়ে রেখে বলতে আরম্ভ করলাম।

‘মঞ্জুদির পুরো নাম ছিল মঞ্জুরিমা। নামটা একটু অন্যরকম। সচরাচর এমন নাম শোনা যায় না।

মঞ্জুদির মা বাবা দুজনেই ছিল শিল্পমনা মানুষ। আমাদের মা-বাবারা যখন সংসারের সপ্তব্যঞ্জনে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে সব সূক্ষ্ণ আর সুকুমার বোধগুলোতে স্থূলতার পর্দা চড়িয়ে ফেলেছে, তখন মঞ্জুদির পরিবারটা আসলেই অন্যরকম ছিল। মাসে দু’মাসে একটা বাংলা সিনেমা হলে গিয়ে দেখাই যখন সেই সময়ের মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র বিলাসিতা ছিল, তখন মঞ্জুদিদের বাসা থেকে প্রায়ই মজলিশী আড্ডা আর বিরিয়ানির সুবাস ভেসে আসত। মঞ্জুদির মা নাকি একসময় রেডিওতে গান গাইত। আর উনার বাবার নাকি অল্পবিস্তর লেখালেখির অভ্যাস ছিল। তাই শিল্প জগতের অনেকের সাথেই তাদের ওঠাবসা ছিল। মঞ্জুদির বাবার সরকারি অফিসের নিতান্তই গোবেচারা চাকরিটা ছিল ওপরের লেবাস মাত্র। তাদের আসল পরিচয় এই শিল্প সাহিত্যাঙ্গগনের সাথেই জড়িত ছিল।

এই বিষয়গুলো আর দশটা সাধারণ পরিবারের কাছে খুব বেশি সাধারণ ঘটনা ছিল না। মঞ্জুদিদের পরিবার নিয়ে মা-বাবাকে অনেক কথাবার্তা বলতে শুনেছি। বাবা বলত, ‘আরে! সিরাজ সাহেব তো পাড়াটাকে একেবারে বিলাতী পাড়া বানিয়ে দিলো! গোলাপী পানির গন্ধ ভেসে আসে, টের পাও না?’

মা ঠোঁট উল্টিয়ে বলত, ‘ওসব কি আমরা খাই নাকি রোজ রোজ গন্ধ নিই যে বলতে পারব? ছেলেমেয়েদের সামনে…ছি ছি ছি!’

মঞ্জুদির ছোট একটা ভাই ছিল। বয়সে আমার চেয়েও তিন বছরের ছোট। আর মঞ্জুদির বয়স তখন কত হবে? আঠার উনিশের বেশি নয় মোটেও। ছিপছিপে ডানাকাটা সুন্দরী। নাকমুখের গড়ন একেবারে নিখুঁত। কবি সাহিত্যিকদের লেখায় উঠে আসে এমন রূপের বর্ণনা। অবশ্য আমার তখনও সেই রূপের কদর বোঝার বয়স হয়নি। নানা জনের আলাপচারিতায় এসব কথা প্রায়ই উঠে আসত। পাড়ার তরুণদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া মঞ্জুদিকে নিয়ে আমাদের পাড়ায় আলাপ আলোচনা লেগেই থাকত। মঞ্জুদিদের পরিবারের অন্যরকম আধুনিকতা দেখে সবাই বাঁকা কথা বলত ঠিকই, কিন্তু সেদিক থেকে চোখ সরানোও অসম্ভব ছিল সবার পক্ষে।

মা বলত, মঞ্জুদির নামটাতেই নাকি হিন্দুয়ানির ছোঁয়া আছে। কথার কথা নিশ্চয়ই! মুসলমানের মেয়ের নাম কি মঞ্জুরিমা হতে পারে না? আমি তো আমার বড়ভাইকে দাদা ডাকতাম, মঞ্জুদিকে দিদি ডাকতাম। আসলে আপু ভাইয়া এসব ডাকতে আমার কেন জানি খুব একটা ভালো লাগত না। দাদা দিদি ডাকগুলো আমার কাছে খুব মিষ্টি লাগত। মা অবশ্য আমার এই ডাক নিয়ে আপত্তি করেনি। আর আপত্তি করলেই বা শুনছে কে? ঐ বয়সেই আমি ছিলাম আপন মর্জির রাজা। আমি মোটেও আমার রনকদার মতো ছিলাম না!

আমার মা সেকেলে গোছের মানুষ ছিল। তার জগত সংসার সীমাবদ্ধ ছিল রান্নাবান্না, বাচ্চাকাচ্চা প্রতিপালন আর অল্পস্বল্প নাটক সিনেমা দেখার মধ্যেই।

অবশ্য সেই সময়ে তো বিনোদনের এত রকম মাধ্যম ছিল না! ডিশের লাইন ছিল না। টিভির চ্যানেল বলতেই ছিল বিটিভি। আমরা রাজশাহীতে থাকতাম বলে অবশ্য দূরদর্শন দেখতে পেতাম। সেখানে সপ্তাহে একটা কলকাতার বাংলা সিনেমা বরাদ্দ ছিল। সেটার জন্য সারা সপ্তাহ জুড়ে সে কী আয়োজন! যেদিন উত্তম সুচিত্রার সিনেমা দেখাত, সেদিন তো কথাই নেই! বিকেল হতে হতেই মায়ের সব কাজকর্ম করা সারা। সন্ধ্যে সাতটার অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে যেত সবাই। তবু সময় যেন ফুরাতেই চাইত না!

তো… যা বলছিলাম। আমার মায়ের কাছে এই মঞ্জুরিমা নামটা নিয়ে আর নামের আড়ালের মানুষগুলোকে নিয়ে নানারকম শ্লেষভরা কথাবার্তা শুনতাম।

তখন কতই বা বয়স ছিল আমার! দশ কী এগার! মায়ের আশেপাশেই ঘুরঘুর করতাম বেশিরভাগ সময়। মা প্রতিবেশিনীদের সাথে যতরকম গল্প করত আমি ছিলাম সেগুলোর অন্যতম নীরব শ্রোতা। বয়সে ছোট ছিলাম বলে কেউ আমাকে ক্ষতিকর মনে করত না। তাই নির্দিধায় আমার সামনেই সবরকম গল্প চলত। পরকীয়া থেকে বিষক্রিয়া কিছুই বাদ থাকত না। কার ছেলের দিকে মা-বাপের নজর নেই, কার মেয়ে বেশি সেজেগুজে এর ওর সাথে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করতে যাচ্ছে, কোন বাড়ির বউয়ের কেনাকাটার বাই বেশি…এসব গল্প শুনতে আমার কাছেও বেশ লাগত। চানাচুরের মতো কুড়মুড়ে স্বাদের ছিল সেই গল্পগুলো। স্বাদের রেশ কাটতে চাইত না কিছুতেই। আমি গল্পগুলো শুনে মেমরি সেলে ঢুকিয়ে রাখতাম। যেখানে যেটা খরচ করা দরকার, বেশি ভাবনাচিন্তা না করে সেটা করে ফেলতাম।

তাদের এইসব গল্পের মাঝখানেই মাকে কত দিন বলতে শুনেছি, ‘এই মঞ্জুর মায়ের আক্কেলের কথা আর কী বলব! দিনরাত এদের বাসায় মানুষজনের ভিড়বাট্টা লেগেই আছে! এত কারা আসে বাসায়? ঘরে সোমত্ত মেয়ে…বাপ মায়ের হুঁশই নাই! দিনরাত হাজার পদের লোকজনের ভিড় লাগায়ে রাখছে! এদের সামনেই মা মেয়ে ছোট ছোট জামাকাপড় পরে বাইরে আসে। মায়ে আবার হাতকাটা ব্লাউজও পরে! লাজলজ্জা সব ধুলায় লুটাপুটি খায়। মেয়ের নামটাও তো ঠিকমত রাখতে পারেনি! মঞ্জুরি আবার মুসলমানের মেয়ের নাম হয় নাকি! নামই রাখছে এই পদের, মেয়েরে আর কী দেখেশুনে রাখবে! মেয়ে কোথায় কী প্রেমকানন বানায়ে বসে আছে, মঞ্জুর মায়ের কি সেসব দিকে কোনো হুঁশ আছে?’

আশপাশ থেকে সম্মতিসূচক নানারকম ধ্বনি ভেসে আসত। ঠিকই তো! জাত পাত ধর্মকর্ম নিয়েই যার মাথাব্যথা নাই, তার মেয়ে উচ্ছন্নে গেলেই বা এত কীসের মাথাব্যথা!

মঞ্জুদি আর তার মাকে নিয়ে আমার মায়েদের আড্ডা সবসময় বেশ সরগরম থাকতো।

এর অবশ্য কিছু বিশেষ কারণ ছিল। আমরা যে সরকারি কোয়ার্টার থাকতাম, তার বাসিন্দারা সবাই ছিল মধ্যবিত্ত। সরকারি চাকরিতে যারা মাঝামাঝি থেকে নিচের দিকে অবস্থান করে, মূলত তারাই এই কোয়ার্টারের বাসিন্দা।

আমাদের প্রায় প্রতিটি পরিবারের ছেলেমেয়েরাই একই রকম বেশভূষা আচার আচরণ আর চালচলনে অভ্যস্ত। এর মধ্যে মঞ্জুদিরা ছিল একেবারে অন্যরকম। আমাদের মা খালারা সাদামাটা শাড়ি পরতেন। ব্লাউজের রকমারি ফ্যাশনবোধ তাদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। মঞ্জুদির মা যেসব শাড়ি ব্লাউজ পরতেন, বলাইবাহুল্য সেগুলো দেখে আমাদের মা খালাদের চোখ টাটাত। আমার বাবা কিংবা পাড়ার অন্য বয়স্ক পুরুষদের কাছে সেই সাজপোষাক বড় মনোরম ছিল। তারা যে চলতে ফিরতে চোখ বাঁকিয়ে এদিকে সেদিকে তাকাতেন, সেসব গল্প তো আমি আমার মায়েদের আড্ডায় বিস্তর শুনেছি।

আমাদের পাশের বাসার আন্টি রুমাদির মাকে সোজাসাপ্টাই বলত, ‘এই যে ভাবী, আপনার কর্তাটাকে একটু দেখেশুনে রাখবেন বুঝেছেন? হাওয়া কিন্তু খুব খারাপ! এদিকে সেদিকে তাকাতে তাকাতে গেলে খালি নর্দমায় পড়েই পার পাওয়া যাবে না। এর পরে কিন্তু একেবারে হাড়গোড় ভেঙে একসা হবে, বুঝেছেন?’

এই গল্পটা আমরা ছোটরাও জানি। আর আমাদের মা খালাদের তো কারোরই জানতে বাকি নেই। কাজেই কাউকে আর কিছু বলতে হলো না। আঁচলে মুখ ঢেকে কেউ কেউ হাসি লুকাল। রুমাদির মায়ের চেহারা হলো দেখার মতো। মুখটাকে হাঁড়ির মতো থোবড়া বানিয়ে আক্রমনকারীর দিকে তাকিয়ে রইল।

ঘটনাটা ছিল এরকম। সেদিন সকালে মঞ্জুদির মা একটু সেজেগুজে নিজের ছেলেকে নিয়ে মার্কেট থেকে ফিরছিল। তখনকার দিনের মার্কেট তো আর এখনকার মতো এমন এসি সুসজ্জিত ছিল না। নিউমার্কেট বা সাহেববাজারে গিয়ে একটু ঘোরাঘুরি আর দরদাম করে সস্তার বাসনকোসন ফুলদানি আর কয়েক গাছি ইমিটেশনের চুড়ি কিনে নিয়ে এসে এক গ্লাস লাচ্ছি খেয়েই তৃপ্ত মনে বাসার পথ ধরতে হতো। মঞ্জুদির মা ও হয়ত সেই কাজ করেই ফিরছিল। সেদিন প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। যাকে বলে একেবারে ফুটিফাটা গরম। রোদটাও ছিল ভীষণ চড়া। আন্টি গরমের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে সেদিন একটু বেশিই কুল সাজ দিয়েছিল। সাদা রঙের সুতি কাপড়ের ওপরে কী সব ফুল লতাপাতার বাহারি নকশা। গায়ে হাতকাটা রঙিন ব্লাউজ। চোখে বড়সড় সানগ্লাস, গলায় কাঠের মালা। এছাড়া চোখমুখের হালকা মেকআপ তো ধরার মধ্যেই পড়ে না! আন্টি বাসাতেই হালকা লিপস্টিক লাগিয়ে রাখত সবসময়। বাইরে যেতে হলে তো সেটাতে আরো কয়েক পর্দা রঙ চড়বেই! এ আর বিচিত্র কী?

মার্কেট থেকে রিক্সায় করে বাসায় ফিরছিল আন্টি। বাসার কাছে এসে রিক্সা থামতেই মঞ্জুদির ভাই পল্টু এক লাফে রিক্সা থেকে নেমে বাসার ভেতরে ঢুকে গেল। আন্টি তখন রিক্সায় বসে ভাড়া গুনছে। ঘামে তার সারা মুখ চুপচুপ করছে। গলা বেয়ে নেমে আসছে ঘামের ধারা। ফর্সা মুখচোখে ভিজে ভিজে একটা ভাব। শাড়ির আঁচল দিয়ে মাঝে মাঝেই মুখ আর গলা মুছে নিচ্ছেন তিনি।

আমরা ছেলেছোকরারা তখন আশেপাশেই খেলাধুলা করছিলাম। আমাদের মধ্যে দু’চারজন ছিল মারাত্মক রকমের ইঁচড়েপাকা। আমি কোন দলে ছিলাম, সেটা না হয় নাই বলি। যাহোক, রুমাদির বাবা হাফিজ আংকেলও ঠিক সেই সময়েই কোথায় থেকে যেন ফিরছিল। দূর থেকে মঞ্জুদির মাকে ওমন মোহনীয় বেশে রিক্সায় বসে থাকতে দেখে আংকেলের মন হয়ত একটু উচাটন হয়ে থাকতে পারে। তিনি যে হাঁ করে আন্টির দিকে তাকাতে তাকাতেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিলেন সেটা ঐখানে উপস্থিত কাকপক্ষীও বুঝতে পেরেছিল। হঠাৎ ঝপ করে একটা শব্দ হতেই আমরা সবাই সচকিত হয়ে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি, পেছন থেকে আসা একটা সাইকেলের গুঁতা খেয়ে আংকেল একেবারে সোজা পাশের ড্রেনে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

হঠাৎ চারপাশ থেকে হো হো হাসির শব্দে পুরো পাড়া সচকিত। আমরা তো হাসছিই, তাকিয়ে দেখি এদিক ওদিকের কয়েকটা বারান্দা থেকে কয়েক জোড়া চোখও তখন এদিকেই তাকিয়ে আছে। প্রত্যেকেরই মুখে দন্ত বিকশিত হাসি। আংকেল কালো কালো দলাপাকানো ময়লাপানির ভেতর থেকেই হুঙ্কার ছাড়ল, ‘এ্যাই ছোঁড়া! দেখে রাস্তা পার হতে পারিস না? তুই যে পেছনে আছিস সেটা বেল টিপে বলতে হবে না? আমার কি পেছনে আরেক জোড়া চোখ আছে? বদ ছোঁড়া!’

যাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলা, সে হচ্ছে পাড়ার দুধওয়ালা। প্রতিদিন এই সময়ের দিকেই সে আসে। সে কিন্তু অপরাধবোধে কাঁচুমাচু হয়ে নেই মোটেও। বরং উলটো আংকেলকে দু’ কথা শুনিয়ে দিলো, ‘এ্যাহ্‌! আমার কী দোষ? আপনে যদি সামনে তাকাইয়া বেহুঁশ হইয়া যান, তাইলে আমার কিছু করার আছে? কয়বার বেল দিছি আমি, হেইডা জানেন?’

আংকেল ভীষণ অপমানিত হলো এই কথায়। এবারে আরো জোরে হুংকার দিয়ে উঠল, ‘চুপ ব্যাটা পাজি বদমাশ!’

আশেপাশে তখন হাসির রোল পড়ে গেছে। গজরাতে গজরাতে ড্রেন থেকে উঠতে উঠতে আংকেল বলেই চলেছে, ‘তোরে যদি আমি না দেখছি তাইলে দেখিস!’

দুধওয়ালা ছেলেটার তখনো বিকার নেই। এদিক ওদিকের নীরব সমর্থন পেয়ে এবারে সেও আর সবার সাথে হাসিতে যোগ দিয়েছে। হয়ত বুঝতে পেরেছে, তার ভয়ের কিছু নেই। কারণ আশেপাশে আরো অনেক সাক্ষীসাবুদ আছে। তাই সাহসে ভর করে সেও তখন বলেই চলেছে,’আপনে আর কী দ্যাখবেন! ওখন থেইকা এট্টু রাস্তাডা দেইখা পার হইয়েন তাইলেই হইব!’

মঞ্জুদির মাও তখন আর সবার সাথে পুরো ঘটনা বেশ উপভোগ করল। আপন মনে হাসতে হাসতে নিজের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন তিনি। আশেপাশের পাড়া প্রতিবেশিদের মধ্যে এই গল্প বেশ জমে গেল। কারণে অকারণে সবাই এই গল্প একে অন্যকে শুনিয়ে মজা নিতে লাগল।

বলতে বসেছি মঞ্জুদির গল্প। অথচ এদিক ওদিকের প্যাঁচাল পেড়েই সময় নষ্ট করে ফেলছি। আসলে মঞ্জুদিদের বাসার প্রত্যেককে নিয়েই বুঝি এমন আলাদা করে গল্প বলা যাবে। সে যাক! আমি আজ শুধু মঞ্জুদির গল্পটাই বলি।

মঞ্জুদির মায়ের মতো তার মেয়েকে দেখেও সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। পাড়ার ছেলেদের মাথা নষ্ট ছিল তার জন্য, এ’কথা তো আগেই বলেছি। আমার ভার্সিটি পড়ুয়া বড়ভাই রনকও ভেতরে ভেতরে মঞ্জুদিকে পছন্দ করত। তবে সেই কথা জেনেছি বেশ পরে। রনকদা ব্যাপারটা অনেকদিন নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু শেষমেষ একদিন সেটা বের হয়ে পড়েছিল। সেই গল্পে পরে আসছি। তার আগে মঞ্জুদি সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলে নিই।

সংস্কৃতিমনা পরিবারে জন্ম বলেই হয়ত মঞ্জুদি কিন্তু খুব একটা রক্ষণশীল কিংবা শুচিবাই ছিল না এসব ব্যাপারে। ছেলেরা একটু আধটু তাকাবে, শিস দিবে…এসব যেন খুব সাধারণ ব্যাপার। ছেলেদের সাথে বেশ সহজভাবে কথা বলতে পারত মঞ্জুদি। সাধারণত এই বয়সের মেয়েদের মধ্যে যে একটা সহজাত সঙ্কোচের ব্যাপার থাকে, সেটা তার মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। তবে মঞ্জুদির মনটা ছিল খুব ভালো। আকাশের মতো উদার। কেউ তার কাছে কোনো ব্যাপারে সাহায্য চাইলে না করা নেই। সেটা তার আয়ত্তের মধ্যে থাকলে মঞ্জুদি এগিয়ে আসতে পিছ পা হতো না কখনো।

ব্যাপারটা কেমন ছিল একটু বুঝিয়ে বলি।

আমাদের পাড়ার আফজাল আংকেল একটু বদমেজাজী ছিল। আংকেলের বয়স তেমন বেশি ছিল না। আমার রনকদার চেয়ে খুব বেশি হলে ছয় সাত বছরের বড় হবে হয়ত! আংকেল অল্প বয়সেই চাকরিতে বেশ ভালো অবস্থান তৈরি করেছিল। আমার বাবা বলত, ‘আফজাল হলো এক নাম্বারের সুবিধাবাদী মানুষ। যেখানে তেল ঢাললে সুযোগ সুবিধা মিলবে, সেখানেই সমানে তেল ঢালতে থাকে!’

এই আফজাল আংকেল চাকরিতে ঢুকতে না ঢুকতেই বিয়ে করে ফেলল। তার এই বিয়ে নিয়েও অবশ্য অনেক কানাঘুষা চলত। সব কথা বুঝতে পারতাম না। যেটুকু কানে আসত, জোড়াতালি দিয়ে বুঝেছি যে, মেয়েটা সম্ভবত আফজাল আংকেলের বিয়ে করা বউ ছিল না। তার গার্লফ্রেণ্ড ছিল সম্ভবত, পরে এক সাথে থাকতে শুরু করে। মানুষ মনে করে, মেয়েটার সাথে আংকেলের বিয়ে হয়েছে।

বুঝতেই পারছ, যে সময়ের কথা বলছি তখন লিভ ইন পানি পান্তা ব্যাপার ছিল না। কাজেই বিষয়টা গোপন করারই চেষ্টা চালানো হয়েছিল। কিন্তু কথায় আছে, এসব কথা নাকি বাতাসের আগে ছড়ায়। কাজেই কে বা কারা যে ভেতরের আসল তথ্য ফাঁস করে ফেলেছিল তা বলা মুশকিল।

সেই মেয়েটা, মানে আফজাল আংকেলের সম্ভাব্য স্ত্রী তেমন একটা বাইরে বের টের হতো না। হয়ত নিজেকে লুকিয়ে রাখার দিকেই তার মনোযোগ বেশি ছিল। যাও বা একটু আধটু বের হতো, কারো সাথে খুব বেশি কথাবার্তা বলত না। কাজেই মুখরোচক গল্পগুলো আলো বাতাস পেয়ে তরতরিয়ে বেড়ে উঠছিল।

একদিন আফজাল আংকেলের বাসায় কী নিয়ে যেন তুমুল গণ্ডগোল বাঁধল। সেই গণ্ডগোলে অবশ্য তার স্ত্রীর(!) গলা তেমন একটা শোনা গেল না। শুধু আংকেলই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলছিল, ‘একেবারে বের করে দিব। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব বাসা থেকে! আমার মুখে মুখে কথা! মুখ একেবারে ভেঙে দিব!’

ছোট পাড়া, গায়ে গায়ে লাগানো সব বাসা। এমন চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আশেপাশের বাসা থেকে উৎসুক মুখগুলো দুদ্দাড় বাইরে বেরিয়ে পড়ল। কেউ কেউ আরেকটু ভালো করে শোনার আশায় বাইরে এসে উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিলো। আফজাল আংকেল কিন্তু বলেই চুপ থাকল না, মেয়েটাকে সত্যি সত্যিই বাসা থেকে বের করে দিলো।

অসহায়ের মতো বাসা থেকে বের হয়ে মেয়েটা এদিক ওদিকে তাকাতে লাগল।

বোঝাই যাচ্ছিল, তার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। পাড়ায় এমন গল্পও চালু ছিল, মেয়েটা আফজাল আংকেলের জন্য বাসা থেকে বের হয়ে এসেছে। নিজের মা-বাবার কাছেও তার ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। পাড়ার আন্টিরা, যাদেরকে মেয়েটা এতদিন মুখরোচক সব গল্প সরবরাহ করে আসছিল, তারা সবাই মেয়েটাকে দূর থেকেই দেখতে লাগল। কাছে এসে কেউ একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করল না, মেয়েটাকে তার স্বামী(!) কেন বাসা থেকে বের করে দিলো! এখন সে কোথায় যাবে বা তার কাছে পথের ভাড়াটুকু আছে কী না! বলতে খারাপ লাগছে, তবু না বলে পারছি না, আমি আমার মাকেও সেই দূর থেকে শুধু দেখে যাওয়া আন্টিদের মধ্যেই দেখতে পেলাম।

হঠাৎ আমরা দেখলাম, মঞ্জুদি তার মায়ের সাথে কী নিয়ে জানি তর্ক করছে। আন্টি বলছে, ‘…না না এটা ঠিক হবে না। পরে একটা ঝামেলা হবে।’ মঞ্জুদি তার মাকে কী বলে যেন বোঝাচ্ছে আর বলছে, ‘কিছু হলে দেখা যাবে মা! দরকার হলে পুলিশ এসে দেখবে। তবু এভাবে কিছু না করে বসে থাকা ঠিক হচ্ছে না!’

এসব কথাবার্তার মাঝখানেই মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়েছে। হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে মঞ্জুদি হনহন করে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আপনি আমাদের বাসায় আসেন। চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে!’

আশেপাশে আফজাল আংকেল ছিল না। মেয়েটাকে বাসা থেকে বের করে দিয়ে আংকেল নিজে আর ঘর থেকে বের হয়নি। কেউ অবশ্য তাকে বের হয়ে আসতেও বলেনি।

আমাদের প্রত্যেকের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে দিয়েই মঞ্জুদি মেয়েটাকে নিজেদের বাসায় নিয়ে গেল। তার পেছনে পেছনে মঞ্জুদির মা ও গেল। সকলেই নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। কিন্তু ভালোমন্দ কিছুই বলার মুখ ছিল না কারো। মনে মনে কিন্তু প্রত্যেকেই স্বীকার করতে বাধ্য হলো, মঞ্জুদি মানুষটা মোটেও হালকাফুলকা ধরনের মানুষ নয়। তার মধ্যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার একটা অন্যরকম শক্তি আছে।

সেই ঘটনার রেশ অনেকদূর পর্যন্ত ডালপালা ছড়িয়েছিল। মঞ্জুদিদের বাসায় গিয়ে মেয়েটা সব কথা খুলে বলেছিল। আফজাল আংকেল কীভাবে মিথ্যে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল এবং সেই ফাঁদে পড়ে মেয়েটাও কীভাবে তার বাবার বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের হয়ে এসেছিল…সবকিছু সবিস্তারে বর্ণনা করেছিল। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের বাসায় নিয়ে এসে তাকে স্ত্রী পরিচয়ে লুকিয়ে রেখেছিল। অনৈতিক সম্পর্কের জালে মেয়েটা এমনভাবেই জড়িয়ে গিয়েছিল যে, তার আর সভ্য সমাজে মুখ দেখানোর কোনো উপায় ছিল না। নিজের মা-বাবার কাছে ফিরে যাওয়া তো একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার ছিল।

মঞ্জুদি আর তার মা-বাবা মেয়েটাকে কিছু সময়ের জন্য নিজেদের কাছে রেখেছিল। এই ব্যাপারে আফজাল আংকেলের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল সেটা জানা যায়নি। তিনি তার নিজের মতো অফিস করছিলেন। কে কী বলল না বলল, তাতে তার কিছু আসে যায় না! তাছাড়া বাবা বলত, আংকেলের নাকি ভালো পলিটিক্যাল জোর আছে। তাই এমনিতেও কাউকে তোয়াজ করে চলত না।

সেই সময়ে প্রায়ই দেখতাম, মঞ্জুদি বারান্দায় বসে মেয়েটার সাথে গল্প করছে।

আমি মঞ্জুদির ভাই পল্টুর কাছে গিয়ে মাঝে মাঝে ওর খেলনাগুলো দিয়ে খেলে আসতাম। মঞ্জুদিদের বাসায় আমার অবাধ যাতায়াত ছিল। আমাকে খুব স্নেহ করত মঞ্জুদি। আমি গেলেই জোর করে বসিয়ে কিছু না কিছু মজার খাবার খাওয়াতো। একদিন গিয়ে দেখি, মঞ্জুদি আফজাল আংকেলের সেই নামধারী বউয়ের মাথার চুলে তেল লাগিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটার চোখমুখ বিষণ্ন। মঞ্জুদি এটা ওটা বলে মেয়েটাকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করছে।

আরেকদিন দেখি পাড়াতে এক মহা ধুন্দুমার কাণ্ড। পুলিশ এসে আফজাল আংকেলকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মঞ্জুদির মা-বাবা আর মঞ্জুদি স্বয়ং গিয়ে নাকি পুলিশের কাছে এফ আই আর করে এসেছে। অভিযোগ গুরুতর। প্রতারণা করে দিনের পর দিন বাসায় রেখে ধর্ষণ। এই অভিযোগের কথা আমরা পিচ্চিরাও কীভাবে যেন জেনে গিয়েছিলাম। আমাদের কাছে তো কেউ এত খুলেমেলে সব কথা বলত না। ঐ যে আগেই বলেছি, আমাদের গ্রুপে কিছু ইঁচড়েপাকা ছিল। এরা কীভাবে কীভাবে যেন সব ভেতরের খবর উদ্ধার করে ফেলত। আমরা আমাদের মতো করে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে চেষ্টা করলাম। বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিয়ে করেনি। অথচ স্বামী স্ত্রীর মতো বাস করেছে। এই অভিযোগ যে মারাত্মক গুরুতর, সেটা ভালোভাবে না বুঝলেও বড়দের মুখচোখ দেখে আন্দাজ করলাম হাল্কাফুল্কা কিছু হবে না অন্তত।

আফজাল আংকেল বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিয়ে তো করেইনি, উল্টো অন্য মেয়েদের সাথেও নাকি নানাভাবে জড়িয়ে পড়ছিল। মেয়েটা এসব নিয়ে প্রতিবাদ জানাতেই আফজাল আংকেল তাকে বাসা থেকেই বের করে দিয়েছে। অশ্রাব্য অকথ্য সব কথাবার্তা শুনিয়েছে। ‘ছিনাল, করিস তো মাগীগিরি…তোরে আমি বিয়া করুম! যা গিয়া আরেকটা ভাতার জুটায়ে নে!’ এই রকম নোংরা সেসব কথা। কাজেই প্রতারণা ধর্ষণ এবুউজমেন্ট আরো কী কী সব যেন অভিযোগ এনে পুলিশ সাতসকালেই আফজাল আংকেলকে একেবারে টেনে হিঁচড়ে বাসা থেকে বের করে আনল।

আংকেল তখন অফিসের জন্য রেডি হচ্ছিল। এতসব কাণ্ড কারখানা করেও তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। মজা করার ছিল করে নিয়েছে। এত ভাবনাচিন্তা করার কী আছে?

আংকেল ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেনি, এই ঘটনার জন্য তাকে এভাবে ধরা পড়তে হবে! পুলিশের ভ্যানে উঠতে উঠতে আংকেল হাত পা ছুঁড়ে অনেক আস্ফালন করেছিল। ‘দেখে নিব! শিল্পী পরিবারের বেশ ধরে রেখে ভেতরে ভেতরে কী করিস তোরা, আমি জানি না? মাগীর দালালগিরি করবি নাকি এইবার? যা, নিজের মেয়েরেও এই লাইনে লাগায়ে দে! ভালো কামাইতে পারব!…একবার বাইর হই আমি! দাঁড়া!’

পাড়ার সবাই চোখ বড় বড় করে এই দৃশ্য দেখল। কিন্তু মঞ্জুদিদের বাসার কেউ বারান্দা বা জানালা কোনো জায়গা থেকেই উঁকিঝুঁকি মারল না। এসব কথাবার্তা শুনে তাদের প্রতিক্রিয়াটা দেখার জন্য সবার জান ছটফট করছিল। কিন্তু সেই ইচ্ছের আগুনে পানি ছিটিয়ে যা বলার আফজাল আংকেল একাই বলে গেল। পুলিশ মাঝপথে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এ্যাই চোপ! আর একটা কথা বললে ঘুষি মেরে এখানেই ভবলীলা সাঙ্গ করে দিব! তুই যাতে আর এই জিন্দেগীতে বাইর না হইতে পারিস তার ব্যবস্থা করে দিব দাঁড়া! চোরের বাপের বড় গলা! এ্যাহ্‌!’

কিছুদিন পরে মেয়েটার মা-বাবা এসে তাকে নিজেদের কাছে নিয়ে গেল। যাওয়ার আগে মঞ্জুদিকে জড়িয়ে ধরে মেয়েটার সে কী কান্না! তার জীবনে মঞ্জুদি আর তার পরিবার হয়ত আশীর্বাদের মতো নেমে এসেছিল। যার জীবন একরকম ভেসেই গিয়েছিল, হয়ত মঞ্জুদির কারণেই সে আবার তার জীবনে মাথা তুলে বাঁচতে পারবে। সমাজ তাকে বাঁচতে দিবে কী না, সেটা পরের কথা…কিন্তু আশা করতে দোষ তো কিছ ছিল না!

এই হলো মঞ্জুদি। এমনিতে সাদামাটা, সবার সাথেই হাসিমুখে কথা বলে। কেউ কোনো ব্যাপারে সাহায্য চাইলে এগিয়ে আসতে কার্পণ্য করে না। সেটা যে ধরণের সাহায্যই হোক না কেন! আর শুধু মানুষ কেন, পশুপাখির প্রতিও মঞ্জুদির মায়া ছিল অন্যরকম। আমি স্কুল থেকে ফেরার পথে কতদিন দেখেছি, মঞ্জুদি তাদের বারান্দার কার্ণিশে কাক আর শালিকের জন্য ভাত ছিটিয়ে রাখছে। রাস্তায় কুকুরদের দেখেও তাকে ব্যাগ থেকে বিস্কুটের প্যাকেট বের করতে দেখেছি। আমি দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখতাম। কেমন যেন পাগলাটে মনে হতো মঞ্জুদিকে। একটু যেন আত্মভোলা। জগত সংসারকে দেখত নিজের আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে।

মানুষ হিসেবে মঞ্জুদি অহংকারী, এ’কথা তার শত্রুও বলতে পারবে না। অথচ নিজের দৈহিক আকর্ষণ আর রূপ সম্পর্কেও মঞ্জুদি ভালোমতই সজাগ ছিল। ছেলেরা যে তাকে বার বার আড়ে আড়ে দেখে, এটা তার অজানা ছিল না। কিন্তু সেটাকে সে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিল। আগুনের মতো প্রখর ব্যক্তিত্ব আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করার শক্তি ছিল মঞ্জুদির মধ্যে, যেটা তার মুখশ্রীকেও ছাপিয়ে বের হয়ে আসত। এইজন্যই হয়ত মঞ্জুদির আকর্ষণ ছিল অপ্রতিরোধ্য।

কিন্তু অন্যের সন্তান যতই ভালো হোক না কেন, তার স্বভাবের মধ্যে দশটা খুঁত বাছতে না পারলে মানুষের যেন ভাত হজম হতে চায় না। নিজের সন্তানের খবর নাই, মানুষের যত চিন্তা যত অভিযোগ সব শুধু অন্যের সন্তানকে নিয়েই। মঞ্জুদির অন্যরকম ব্যক্তিত্ত আর রূপে পাড়ার আন্টিরা তাই নানারকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেই চলত তাকে নিয়ে।

কলেজের সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ত মঞ্জুদি। লেখাপড়ায় সাধারণ ছিল। তেমন একটা সিরিয়াস স্টুডেণ্ট নয়। প্রায় নিয়মিতই বান্ধবীদের সাথে ছাদে বসে আড্ডা মারত। মাঝে মাঝে অন্য পাড়াতেও যেতে দেখতাম। মঞ্জুদি বাইরে বের হলেই হুলুস্থূল অবস্থা। ছেলে ছোকরাদের মোটামুটি ইদ লেগে যেত তখন। শিষ বাজাতে বাজাতে সাইকেলের মহড়া আর চোখের দৃষ্টি দিয়ে একেবারে ভাজা ভাজা করে ফেলা হতো বেচারীকে। মঞ্জুদি কোনোদিকে না তাকিয়ে রাজহংসীর মতো গ্রীবা বাঁকিয়ে হেঁটে যেত। দেখে মনে হতো যেন এক রাজকুমারী, যার আশেপাশে পাণিপ্রার্থী অগণিত যুবক। রাজকুমারীর একটুখানি দৃষ্টি দাক্ষিণ্যে বর্ণিল হয়ে উঠতে পারে তাদের অলস বিকেলগুলো। মাঝে মাঝে সেই দৃষ্টির দাক্ষিণ্য যে কারো দিকেই পড়ত না, তা নয়। যার দিকে পড়ত তাকে তখন অন্যরা ঘিরে ধরতো কিছু একটা খাওয়ানোর জন্য।

মা বিকেলবেলা বারান্দায় রোদে শুকাতে দেওয়া কাপড় তুলতে এলে কদাচিত এই দৃশ্যে তারও চোখ আটকে যেত। আপনমনে গজগজ করতে শুনেছি মাকে, ‘একদিকে মা আরেকদিকে মেয়ে! পাড়াটাকে ঢংগীপাড়া বানাতে বাকি রেখেছে দুজন! যখন তখন কোমর দুলিয়ে এদিক ওদিক হাওয়া খেতে বেরিয়ে পড়া! লেখাপড়ার নামে লবডঙ্কা… কচি কচি ছেলেগুলোর ভবিষ্যত চিবিয়ে খাচ্ছে একেবারে!’

যেন দামড়া দামড়া ছেলেগুলো নিজেদের ভবিষ্যত এগিয়ে দিয়েছে মঞ্জুদির দিকে, কচকচিয়ে খাওয়ার জন্য!

মা কথাগুলো বলেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে রনকদাকে ডাক দিতেন। ‘এই রনক, তুই কোথায়? পড়াশুনা করছিস তো? যখন তখন বারান্দায় এসে বসে থাকার দরকার নেই বুঝেছিস? আশেপাশে সব হুর পরি ডাইনিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজের জীবন যদি বাঁচাতে চাস, তাহলে হুঁশজ্ঞান জায়গামত থাকে যেন!’

মায়ের ভবিষ্যৎবাণীতে যে কাজ হয়নি, সেটা আর মাত্র কিছুদিন পরে সকলেই টের পেয়ে গিয়েছিল! কিন্তু সেই গল্পে যাওয়ার আগে আমার ভাই রনক সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন।

রনকদা আমার মা-বাবার অতি বাধ্য ছেলে ছিল। কিছু ছেলে আছে না, যাদের জীবনটাই উৎসর্গ করা থাকে পড়ালেখার জন্য? রনকদা ছিল সেই টাইপের একজন। দিনরাত নাকের সামনে বই ঝুলিয়ে রেখে দিত। আমার এত বিরক্ত লাগত দেখে! আমি যখন জন্মাই, তখন রনকদা ক্লাস এইটে পড়ে। দিনে দিনে যত বড় হয়েছি, বুদ্ধিশুদ্ধি হয়েছে, ততই আমি আমার এই বড় ভাইয়ের কাণ্ডকারখানায় ত্যক্ত বিরক্ত হয়েছি। মানুষ এত ছাগলামার্কা কীভাবে হয়? একটা কোনো বন্ধু বান্ধব নেই, প্রিয় কোনো শখ নেই। শুধু দিনরাত পড়ার টেবিলে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা। এত পড়ত দেখে সবাই ধরেই নিয়েছিল রনকদা মস্ত কিছু একটা হবে। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কিংবা বড় কোনো সায়েন্টিস্ট!

পাড়ার সবাই মা-বাবাকে বহুত তোয়াজ করে বলত, ‘সত্যি, আপনাদের ছেলে তো একেবারে একটা চ্যাম্প! ও নির্ঘাৎ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কিছু একটা হবেই হবে দেখবেন! কপাল বটে আপনাদের! আমাদেরটাকে দেখুন না! দিনরাত পড়ে আছে খেলাধুলা আর আড্ডাবাজি নিয়ে। কী যে আছে কপালে কে জানে! রনকের কাছে এসে বসে থাকলেও তো দেখে দেখে অন্তত কিছু শিখত!’

এসব কথায় মা-বাবার মুখের রোশনাই দিনকে দিন চকচকে হয়ে উঠত। তখনকার সময়ে মস্ত কিছু হওয়া মানেই লোকে বুঝত ডাক্তার নয়ত ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। এই দুইয়ের কোনোটা হতে না পারলে বুঝতে হবে, পালে ঠিকমত হাওয়া লাগেনি।

কাজেই ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য রনকদা একেবারে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। মা-বাবাও পেছনে থেকে যতরকম অনুপ্রেরণার বাতাস দেওয়া সম্ভব, দিয়ে যেতে লাগল। ‘এই তো পারবি তো! তুই না পারলে কে পারবে? তুই হচ্ছিস আমাদের হিরার টুকরা ছেলে, জিত তো তোর হবেই! পিছিয়ে পড়লে হবে না বাবা! জোর লাগায়ে ঝুলে থাক!’

রনকদা শরীরের সমস্ত জোর লাগায়ে লেগে থাকল, কিছুতেই যাতে ঘোড়ার পিঠ থেকে পিছলে না পড়তে হয়। তার পড়ালেখার অত্যাচারে আমার নিজের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। মা-বাবা কিছু হলেই আমাকে উপদেশ দিত, ‘দাদার মতো হতে হবে, বুঝলি? দিনরাত মেহনত করতে হবে! জানপ্রাণ দিয়ে পড়তে হবে!’

আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড় হলো। আমি পড়ি মাত্র ক্লাস সেভেনে! এখনই লেখাপড়ার জন্য জীবন দিতে হলে তো জীবনে আর এমনিতেও কিছুই থাকবে না! কাজেই রনকদার গুডিবয় ইমেজ আমার জীবনটাকেও ছ্যাড়াব্যাড়া করে দিচ্ছিল প্রায়। একটি ঘটনা আবার সবকিছু ব্যালান্স করে দিলো।

এত কিছুর পরেও যখন মেডিক্যাল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং কোথাও রনকদা টিকতে পারল না, তখন মা-বাবার হাওয়া ফুশ করে বেরিয়ে গেল। যাবতীয় উৎসাহ উদ্দীপনা এক নিমেষেই ফুরিয়ে গেল। আমিও জানে বেঁচে গেলাম। যাক বাবা, আমার ওপর থেকে তো এবারে অত্যাচারের খড়গটা নেমে আসবে!

পাড়া প্রতিবেশিরাও একে একে রনকদার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। নিবেই তো! এত পড়েও যেই ছেলে প্রায় কোনো ভর্তি পরীক্ষাতেই টিকতে পারল না, সে তো দেখা যাচ্ছে ছাত্র বিশেষ সুবিধার নয়! এসএসসি এইচএসসিতে স্টার মার্কস পেয়ে তবু কিছুটা মান বেঁচেছিল। ভর্তি পরীক্ষার ব্যর্থতা রনকদার সবকিছু একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল। বেচারা মানসিকভাবেও খুব ভেঙে পড়ল। মা-বাবা তো রাগ করেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু একই ঘরে থাকার সুবাদে আমি কেবল বুঝতে পেরেছিলাম, রনকদা আস্তে আস্তে কেমন জানি পালটে যাচ্ছে।

প্রচণ্ড প্রত্যাশার মুখে কেউ যেন একরাশ ছাই ফেলে দিয়েছে! সেই ছাইয়ের একরাশ ধোঁয়া উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায় তার চারপাশে। তার জগতটাই কেমন যেন ধোঁয়াটে হয়ে এসেছে সেই ধুম্রজালে!

রনকদা প্রায়ই কেমন জানি আনমনা হয়ে থাকে এখন। মাঝে মাঝে অল্পতেই রেগে যায়, যা আগে কখনো রাগত না। আগে কখনোই সিগারেট খেতে দেখিনি রনকদাকে। ইদানিং স্কুল থেকে ঘরে ফিরলে সিগারেটের বোটকা গন্ধটা ভক করে নাকে আসে। গন্ধের তীব্রতায় আমার গা গুলিয়ে আসে। ব্যাপারটা মা-বাবাও নিশ্চয়ই খেয়াল করেছে। রনকদার প্রতি এখন তাদের ব্যবহার আশ্চর্যরকম ঠান্ডা। রনকদা কী করছে না করছে এসব ব্যাপারে যেন তাদের আর কোনোই দায়দায়িত্ব নেই। প্রত্যাশা পূরণের কেন্দ্রবিন্দু থেকে কেউ যেন এক ধাক্কায় রনকদাকে অজানা কোনো খাদে নামিয়ে এনেছে। মা-বাবার এই নিস্পৃহতা রনকদাকে ভীষণভাবে আহত করছে, এটা আমি ভালোই বুঝতে পারি। নিজেকে কেমন যেন অপ্রয়োজনীয় ভাবতে শুরু করেছে রনকদা।

শেষমেষ রাজশাহী ভার্সিটিতে ওয়েটিং লিস্টের একেবারে শেষ প্রান্ত থেকে কোনোরকমে টিকে গেল রনকদা। শেষের দিকের একটা সাবজেক্টে ভর্তি হতে পেরে অবশেষে তার মান ইজ্জত ডুবতে ডুবতে কোনোক্রমে বেঁচে গেল। আমি ভেবেছিলাম, হয়ত এই ধাক্কাটা খেয়ে রনকদার ভালোরকম একটা শিক্ষা হয়েছে। এবারে হয়ত পড়ালেখা নিয়ে আর আগের মতো পাগলামিটা করবে না। কিন্তু কীসের কী! বাস্তবে দেখা গেল, ঘটনা একেবারে উলটো! রনকদা ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই আবার পুরোপুরি আগের ফর্মে ফিরে গেল। এখন সে আগের চেয়েও পড়ার বইয়ে আরও বেশি করে নাকমুখ ডুবিয়ে রাখে। ফলে সবাই বুঝে গেল, কিছু একটা নিয়ে আপদমস্তক ডুবে থাকাই হচ্ছে রনকদার স্বভাব। বন্ধু বান্ধব কিংবা বান্ধবী এসব নিয়ে যেহেতু মাথাব্যথা নেই, কাজেই পড়ালেখার সাথেই তার সবরকমের বোঝাপড়া।

প্রত্যাশার ঘোড়ায় জিন পরিয়ে অবশেষে মা-বাবাও এখন একটু থিতু হয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের আটপৌরে সাদামাটা জীবনটাতে আবার একটু স্থিরতা ফিরে এসেছে।

ভালোই চলছিল সবকিছু। ঝামেলা বাঁধল একদিন, যেদিন মঞ্জুদি হঠাৎ একটা কাজে আমাদের বাসায় এসে হাজির হলো।

ছুটির দিন ছিল সেইদিন। আমি রনকদা মা-বাবা সবাই বাসায়। মা ছাদে কুমড়ো বড়ি বসাতে গিয়েছিল। পরিশ্রমের কাজ, সময়ও লাগে প্রচুর। বাবা তাদের ঘরে বসে আয়েশ করে পেপার পড়ছিল। আমি পড়া ফাঁকি দিয়ে মেঝেতে বসে মার্বেলের টিপ প্র্যাক্টিস করছিলাম। আর রনকদা যথারীতি চোখের সামনে কী একটা পড়ার বই ঝুলিয়ে তন্ময় হয়ে বসেছিল। কলিংবেল বাজতেই আমি এক দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। ভাবলাম মা বুঝি এসেছে ছাদ থেকে। তাই যাওয়ার আগে তড়িঘড়ি মার্বেলগুলোকে লুকিয়ে ফেলতে ভুল করলাম না। দরজা খুলে দিয়ে থ মেরে গেলাম। মা নয়, দরজায় দাঁড়িয়ে আছে মঞ্জুদি!

একেবারেই অপ্রত্যাশিত ব্যাপার। মঞ্জুদি আমাদের বাসায় কখনোই আসে না। আসবেই বা কেন! আমরা দুই ভাই। বোন নেই কোনো। তাই আমাদের বাসায় আসার তেমন কোনো কারণ নেই মঞ্জুদির। তাছাড়া মা মোটেও মঞ্জুদি আর তার মা-বাবাকে পছন্দ করত না। তার সেই অপছন্দটা নিশ্চয়ই মঞ্জুদিও বুঝতে পারত।

মঞ্জুদিকে দেখে আমি তো হাঁ হয়েই দাঁড়িয়ে ছিলাম। মঞ্জুদিই মিষ্টি করে হেসে আমার গাল টিপে বলল, ‘কীরে কনক, তোদের বাসায় আসতে বলবি না আমাকে?’

আমি সাথে সাথে সপ্রতিভ ভাবে উত্তর দিলাম, ‘তুমি আসছো আমাদের বাসায়! কেন আসতে বলব না? আসো আসো ঢুকো শিগগিরই!’

আমি মঞ্জুদিকে খুবই পছন্দ করতাম। মনে মনে চাইতাম, ইস! মঞ্জুদির সাথে যদি রনকদার বিয়েটিয়ে হতো কী ভালোই না হতো তাহলে! মঞ্জুদিকে আমি ভাবী বলে ডাকতে পারতাম! এত সুন্দর ভাবী আমার, পাড়ায় আমার প্রেস্টিজটা কত ওপরে থাকত!

বয়সের তুলনায় খুবই পরিপক্ক ভাবনা ছিল বটে। কিন্তু ইঁচড়েপাকাদের সাথে মিশে মিশে আমিও যে ভেতরে ভেতরে পেকে ঝুনা হয়ে গিয়েছিলাম, তা কে জানত!

মঞ্জুদি মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘ওরে বাবা! তুই এত কথা পারিস! কই শিখলি এত কথা? ইয়ে কনক, তোর দাদা রনকদা বাসায় আছেন? আমি উনার কাছ থেকে কয়েকটা গল্পের বই নিতাম। দ্যাখ না, কিচ্ছু পড়ার মতো পাচ্ছি না! এদিকে বান্ধবীদের কাছেও নতুন কোনো বই নেই। তুই না বলছিলি, তোর দাদার কাছে অনেক গল্পের বই আছে? আমাকে পড়তে দিবে?’

এমন কথা বলছিলাম নাকি? আমি অবশ্য সেটা মনে করতে পারলাম না। তবে কথা সত্য। রনকদা শুধু যে পড়ার বইয়েই নাকমুখ ডুবিয়ে রাখত তাই নয়, গল্পের বইয়ের প্রতিও তার একইরকম নেশা ছিল। আমাদের ঘরের একটা দেওয়ালের সাথে সেঁটে রাখা আলমিরায় রাশি রাশি গল্পের বই।

বললাম, ‘হ্যাঁ আছেই তো! আসো আমাদের ঘরে আসো। রনকদা ঘরেই আছে! তুমি চাইলে পড়তে দিবে না কেন?’

আগেই বলেছি, মঞ্জুদির স্বভাবে আলগা সঙ্কোচ টংকোচ প্রায় ছিলই না বলতে গেলে। সবার সাথেই খুব সহজ স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারত। আমার সাথে সাথে একেবারেই নিঃসঙ্কোচে চলে এলো আমাদের ঘরে। রনকদা তন্ময় হয়ে পড়ছিল। হঠাৎ চুড়ির আওয়াজে হয়ত তন্ময়তা কেটে গিয়ে থাকবে। এক ঝটকায় পাশে তাকিয়ে মঞ্জুদিকে দেখে রনকদা একেবারে ভূত দেখার মতোই চমকে উঠল। কী বলবে কিছুই বুঝতে পারল না। রনকদার চেহারায় বিহ্বলতা আর মুগ্ধতা তখন মাখামাখি হয়ে মিশে ছিল। আমি একটু অবাক হলাম মনে মনে। আমার রনকদা আবার বই ছাড়া অন্য কিছুকে দেখেও মুগ্ধ হয় তাহলে!

তবে যাই হোক, আমি তো আমার ভ্যাবলাকান্ত রনকদাকে ভালোমতই চিনতাম! সে যে এমন একটা মেয়েকে সোজা তার ঘরে চলে আসতে দেখে কিছুই বলতে পারবে না, এ আর কী এমন নতুন কথা!

মঞ্জুদিই হাসিমুখে বলল, ‘রনকদা, আপনার অনুমতি না নিয়েই চলে এলাম! এই কনক বলছিল আপনার নাকি অনেক গল্পের বই আছে! আমাকে কিছু বই দিবেন পড়ার জন্য? পড়েই আবার ফেরত দিয়ে যাব। প্রমিজ করছি একটাও মেরে দিব না! হা হা হা…’

রনকদা তখন চোখের ইশারায় কোনোমতে তার বইয়ের আলমিরাটা দেখিয়ে দিয়ে কী যেন মিনমিন করে বলল। ভাব দেখে বোঝা গেল, পারলে পুরো আলমিরাটাই মঞ্জুদিকে দিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত তখন রনকদা। মঞ্জুদি হাসিমুখে আলমিরার দিকে এগিয়ে গেল। তার সুন্দর সুন্দর আঙুলগুলো খেলে বেড়াতে লাগল বইগুলোর ভাঁজে ভাঁজে। খুব দ্রুতই বই পছন্দ করা হয়ে গেল মঞ্জুদির। সব মিলিয়ে ছয়টার মতো বই নিলো সেদিন। বই পছন্দ করা শেষে রনকদার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাব্বাহ! এত বই আপনার রনকদা! আমাকে মাঝে মাঝেই আসতে হবে বুঝতে পেরেছি!’

রনকদা তখনো কিছু বলতে পারল না। এতটাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে থাকল যে, মঞ্জুদি চলে যাওয়ার আগেও নিছক ভদ্রতাসূচকভাবেও দু’একটা কথা তার মুখ দিয়ে বেরুল না না। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে রনকদার ভাবসাব দেখছিলাম আর ভেতরে ভেতরে হাসিতে ফেটে পড়ছিলাম। সত্যি আমার এই রনকদাটা একেবারেই ক্যাবলাকান্ত! একে দিয়ে আসলেই কিছু হবে না!

মা ছাদ থেকে ফিরল আরো প্রায় আধঘন্টা পরে। বাসায় পা দিয়েই মা কেমন অদ্ভুতভাবে এদিক সেদিকে তাকাতে লাগল। ভ্রুদুটো কেমন যেন কুঁচকে গেল। নাক টেনে টেনে কিছু একটার ঘ্রাণ নিয়ে আমাকে বলল, ‘কে এসেছিল রে বাসায়?’

মঞ্জুদির মিষ্টি পারফিউমের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে ঘরময়। বিষয়টা আমার মাথাতেই ছিল না যে, এটা মায়ের পক্ষে টের পাওয়া কোনো ব্যাপারই না! আমি কেন যেন একটু ভয় পেলাম। মা যে কী বলে বসবে আল্লাহ জানে! তবু মনের ভয় চেপে রেখে সত্যি কথাই বললাম, ‘মঞ্জদি এসেছিল!’

‘ক…কে এসেছিল? মঞ্জু? মঞ্জু এই বাসায় কেন আসবে? কার কাছে এসেছিল? আমাকে ডাকলি না কেন?’

দুনিয়ার প্রশ্ন একসাথে! আমি সংক্ষেপে বললাম, ‘গল্পের বই চাইতে এসেছিল রনকদার কাছে।’

‘কী! সারা পাড়ার মাথা চিবিয়ে এখন রনকের কাছে গল্পের বই চাইতে এসেছে? দিয়েছে তোর ভাই?’

‘হুম, দিবে না কেন?’

‘চুপ পাজি! মুখে মুখে কথা শিখেছিস! দিবে না কেন! তুই কিছু বুঝিস এসবের?’ আমাকে গালমন্দ করেই মা আমাদের ঘরের দিকে রওয়ানা দিলো।

পেছনে পেছনে আমিও গেলাম। রনকদা তখন পড়ার বই থেকে মুখ সরিয়ে গল্পের বইয়ের আলমিরার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কেমন যেন ঘোরলাগা একটা ভাব। চন্দ্রাহত শব্দটাও বুঝি বলা যায়। মা একটু থমকে দাঁড়িয়ে রনকদার এই মূর্তি দেখল।

তারপর সশব্দে ঘরে ঢুকেই কর্কশ গলায় বলল, ‘মঞ্জু কেন এসেছিলরে এই বাসায়? গল্পের বই নিতে? ভড়ং আর কী! ওসব বই টই কিছু না! মাথা চিবিয়ে খাওয়ার জন্য আর কচি কচি মাথা বাকী নেই তো, তাই এই বাসায় পা পড়েছে! খবরদার রনক, তোর ভালোর জন্য বলে দিলাম, ঐদিকে চোখ দিয়েছিস তো মরেছিস! নিজের লেখাপড়া নিয়ে যেমন আছিস খুব ভালো আছিস। ভুলেও ঐ আগুনের দিকে হাত বাড়াবি না। একেবারে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবি বুঝেছিস? মনে থাকবে তো?’

রনকদা যেন কিছুই বুঝতে পারছে না, এমন ভ্যাবাচ্যাকার মতো তাকিয়ে রইল। রনকদা কিছু না বুঝতে পারলেও মা আর আমি কিন্তু যা বোঝার বুঝে গিয়েছিলাম। আমি পিচ্চি হলেও রনকদার চেয়ে বুদ্ধিশুদ্ধিতে কয়েকগুণ এগিয়ে ছিলাম, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

একটু পরে বাবা ঘর থেকে হাঁক ছাড়ল, ‘কী ব্যাপার শাহিন? এত চেঁচামেচি করছ কেন? কী হয়েছে?’

মা তাচ্ছিল্যের একটা ভঙ্গি মুখেচোখে ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘এখানে এত বড় একটা ভূমিকম্প হয়ে গেল, আর তুমি এইমাত্র কাঁপুনি টের পাইলা!’

‘এ্যাঁ! ভূমিকম্প! কই কিছু বুঝলাম না তো!’

মায়ের সাবধানবাণী রনকদার কানে আদৌ গিয়েছে কী না, সেই প্রশ্ন এখন একেবারেই অবান্তর। কিন্তু সেদিনের পর থেকে রনকদার জীবনটাই আমূল বদলে গেল।

আগে রনকদা কখনো বাসার ছাদে উঠত কী না সন্দেহ। ইদানিং প্রায়ই তাকে ছাদে উঠতে দেখি। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, মঞ্জুদিও নিয়মিতই একটা সময়ে ছাদে ওঠে। বলাইবাহুল্য রনকদার ছাদে ঘুরঘুর করার সময়টাও সেই সময়ের আশেপাশেই। দুজনের মাঝে মাঝেই হুটহাট দেখা হয়ে যেতে লাগল। দেখা হলেই আমার রনকদা কাঁচুমাচু একটা ভাব করে বোঝাতে চাইত, ‘আরে তুমি! আমি তো এমনি একটু ছাদে ঘুরতে এসেছিলাম! তোমার সাথে দেখা হয়ে যাবে তা তো ভাবিনি!’

মঞ্জুদি কিন্তু তার সহজাত স্বাচ্ছন্দ্যেই রনকদার সাথে কথা বলত। আমার দাদার ভাব দেখে মনে হতো, সে বুঝি মাত্র কিছুদিন আগেই ভাজা মাছ উল্টেপাল্টে খেতে শিখেছে।

এরপর থেকে প্রায়ই তাদের মধ্যে এই বই আদানপ্রদান চলতে লাগল। তবে এই আদানপ্রদান এখন আর আমাদের বাসায় চলে না, বেশিরভাগ দিন ছাদেই চলে। মঞ্জুদি দেখি রনকদার সাথে হেসে হেসে অনেক কথা বলে। রনকদার কাছে লেখাপড়া নিয়েও নানারকম টিপস জানতে চায়। কী করলে পড়ায় মন বসবে, এসব নিয়ে চিন্তিত মুখে রনকদার কাছে পরামর্শ চায়। আমার দাদাও এই সুযোগে বেশ রয়েসয়ে লম্বা লেকচার ছাড়ে। অবস্থা দেখে মনে হয়, রনকদা সম্ভবত জীবনে এই প্রথম কারো সাথে দুটো মনের কথা খুলে বলার মতো সঙ্গী পেয়েছে। এতদিন কেউ যেন রনকদার কাছে কিছু জানতেই চায়নি!

এসব দেখে মনে মনে খুব হাসি পায় আমার। আবার ভালোও লাগে। তাদের দুজনকে একসাথে দেখলেই আমিও বার বার এটা সেটার অযুহাতে ছাদে গিয়ে আশেপাশেই ঘুর ঘুর করতে থাকি। দুজনকে একসাথে দেখতে খুব ভালো লাগে আমার। মনের মধ্যকার সুপ্ত ইচ্ছাটা আশার আলো দেখতে পেয়ে নড়েচড়ে বসে আবার।

মঞ্জুদির রাজসিক সৌন্দর্যের পাশেও আমার রনকদা কিন্তু একেবারে ম্লান হয়ে যায় না। আজেবাজে কুঅভ্যাসের কাছে তখনও বশ্যতা স্বীকার করেনি রনকদা। তার বন্ধুরা ততদিনে সিগারেট গাঁজা এটা সেটা কত কী ধরে বসে আছে। আমার দাদা সেসব দিকে তখনও নভিশ। মাঝে কিছুদিন সিগারেটের ফাঁদে পড়েছিল বটে, কিন্তু ভাগ্য আবার তাকে সুরাস্তায় ফিরিয়ে আনতে পেরেছে।

কুঅভ্যাসে অভ্যস্ত হয়নি বলেই হয়ত রনকদার চেহারাতে আশ্চর্য একটা সারল্য ছিল। আর দাদা দেখতে শুনতেও সুপুরুষ ছিল। লম্বা চওড়া সুঠাম দেহ আর এক মাথা ঝাঁকড়া চুলের আমার রনকদা শুধু আরেকটু স্মার্ট হলেই হতো। এটুকুর ঘাটতিই আমার ভেতরটাতে গিয়ে মাঝে মধ্যে খচখচ করত। মঞ্জুদি আশাকরি একটু আধটু ক্যাবলাকান্ত দাদাকে দিয়েই দিব্যি চালিয়ে নিতে পারবে।

আমার মনের মধ্যেও খুশির হাওয়া লাগে। আর রনকদার কথা তো কী বলব! ইদানিং তার বেশভূষা আর চালচলনেও অন্যরকম একটা পরিবর্তন এসেছে। মুখের সামনে বই এঁটে রাখার মন্দ স্বভাব এখন অনেকখানিই বিদায় নিয়েছে। আগের মতো ‘যা খুশি তাই কিছু একটা পরে নিলেই হলো’ এই মনোভাবটাও পাল্টেছে। এখন রনকদা বেশ সময় নিয়ে সাজপোষাক পরে। চুলগুলোকে যত্ন নিয়ে আঁচড়ায়। মাঝে মাঝে ব্যাকব্রাশও করে। চেহারার খোলতাই এটুকুতেই দিব্যি ফুটে বেরোয় ইদানিং।

মা চোখ সরু করে রনকদার কাণ্ড কীর্তি দেখে। আমাকে যদি কিছু জিজ্ঞেস করে বসে, এই ভেবে আমি মায়ের আশেপাশেই থাকি না। ছেলেটা সবে একটু লাইনে আসছে, মা হয়ত এবারেও একটা বাগড়া দিয়ে ছাড়বে!

রনকদার সাথে এখন মঞ্জুদির পথেঘাটে প্রায়ই দেখা হয়।

দুজনেই এমন একটা ভাব করে যেন কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গেছে! তাদের মধ্যকার সম্পর্কের রসায়নটা যে কী, সেটা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। রনকদা তো ভালোমতই ডুবে গেছে! কিন্তু মঞ্জুদিও কি একইভাবে হাবুডুবু খাচ্ছে কী না, তা বলতে পারি না। কারণ মঞ্জুদিকে তো দেখি সবার সাথেই হাসিমুখে স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্য রেখে গল্প করতে। পাড়ার অন্য কয়েকজন ভদ্র ছেলের সাথেও মঞ্জুদি বেশ গল্পগুজব করে। হাসিঠাট্টাও করতে দেখেছি। কারো কাছেই আলগা অহংকারী ভাব দেখায় না। কাজেই রনকদার প্রতি তার আলাদা কোনো টান আছে কী না সেটা আমি বুঝব কেমন করে? তবে মনে মনে তক্কে তক্কে থাকতাম। এটা যেন আমাকে বুঝতেই হবে!

একদিন সেই সুযোগটাও এসে গেল! সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।

রনকদা যে ইদানিং মঞ্জুদির সাথে গল্পগুজব করছে এটা অবশেষে মা বুঝতে পেরেছে। শুধু বুঝতেই পারেনি, দুজনকে ছাদে গল্পরত অবস্থায় হাতেনাতে ধরেও ফেলেছে! সামনাসামনি বেশি কিছু না বললেও ঘরে এসে রনকদার মাথা ভাঙতে শুধু বাকি রেখেছে মা। গজরাতে গজরাতে বলেছে, ‘শেষ পর্যন্ত ঐ পচা শামুকেই পা কাটলি! আর কোনো জায়গা পেলি না পা ফেলার জন্য? কুলাঙ্গার ছেলে! তুই জানিস ওদের মা-মেয়েকে বাইরে কী বলে লোকে? বারোভাতারি কাকে বলে জানিস?’

আমি যে আশেপাশে আছি মায়ের যেন কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। এত অশ্রাব্য সব কথা বলতে লাগল যে, আমি পর্যন্ত লজ্জা পেয়ে গেলাম। আর রনকদার দিকে তো তাকানোই যাচ্ছে না। তবে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা গেল রনকদার মধ্যে। আগে কখনো কোনো কিছু নিয়েই রনকদাকে প্রতিবাদ করতে দেখিনি। আজ মায়ের এই কথা শুনে রনকদা কিন্তু একেবারে চুপ করে থাকল না। বেশ গম্ভীর গলায় বলল, ‘এসব কী ধরণের কথা? কারো সাথে কথা বললেই কিছু হয়ে গেল? মানুষ সম্পর্কে এমন বাজে কথা বলার মানে আছে কোনো?’

মা এবারে অগ্নিমূর্তি ধরল। যেই ছেলে কখনো চোখ তুলে তাকায়নি আগে, সেই ছেলে কী না এমন কথা বলতে শিখে গেছে!

সেদিন সারাদিন না খেয়ে থাকল মা। রাতে বাবা বাসায় ফিরে মাকে খাওয়ানোর জন্য অনেক সাধ্য সাধনা করল। কিন্তু মায়ের এক কথা, ‘চোখের সামনে ঐ ডাইনি আমার ছেলেটাকে বশ করে ফেলল, আমার আর বেঁচে থেকে কী হবে! খাওয়ার দরকার নেই আমার! সব খাওয়া এখন ঐ ডাইনিই খাক!’

রনকদাকে কিন্তু তেমন একটা বিচলিত দেখা গেল না এই ঘটনায়। সে দিব্যি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খেয়ে দেয়ে উঠে গেল। এত কষ্ট করে অভিমান দেখায়েও কোনো লাভ হলো না দেখে মা ও একসময় স্বাভাবিক হতে বাধ্য হলো। কিন্তু রনকদার সঙ্গে মায়ের কথাবার্তা একরকম বন্ধ হয়ে গেল।

মায়ের এই অতিরিক্ত খবরদারির কারণেই মঞ্জুদি আর কোনোদিনই আমাদের বাসায় আসেনি। ছাদে দেখা হওয়ার পর মায়ের চোখেমুখে অন্যরকম প্রতিক্রিয়া দেখতে পেয়েছিল মঞ্জুদি। তাই ছাদেও এখন আর কথাবার্তা হয় না মঞ্জুদি আর রনকদার। আমি মনে মনে আশাহত হলাম। মায়ের ওপরে ভেতরে ভেতরে ভীষণ রাগ জন্মাল। এত সুন্দর একটা প্রেমের কুঁড়ি অঙ্কুরেই বুঝি নষ্ট হয়ে গেল মায়ের জন্য!

একদিন স্কুল থেকে ফিরছিলাম। হঠাৎ চারতলার বারান্দা থেকে ডাক ভেসে এলো, ‘এ্যাই কনক একটু শুনে যা তো!’

ওপরে তাকিয়ে দেখি মঞ্জুদি। আমার বুকের মধ্যে ধবক করে উঠল। মঞ্জুদি আমাকে ডাকছে কেন? মা আবার কিছু করেছে নাকি? ওদের বাসায় গিয়ে আজেবাজে কথাবার্তা বলে আসেনি তো? মা কি এতটা বাড়াবাড়ি করবে? নানারকম ভাবনা এসে ভিড় করছিল মাথায়। দৌড় লাগালাম মঞ্জুদিদের বাসার দিকে। হাঁপাতে হাঁপাতে ওপরে গিয়েই দেখি মঞ্জুদি আগেই দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাকে দেখে একটু অপরাধীর মতো ভঙ্গি করল। তারপর একটু লাজুক মুখে বলল, ‘এই বইগুলো তোর রনকদাকে দিস। বলিস আমি পড়তে বলেছি। আর সাথে এইটাও!’

আমি তাকিয়ে দেখি একটা ভাঁজ করা কাগজ আর কয়েকটা বই এগিয়ে দিয়েছে মঞ্জুদি। আমার মনের মধ্যে আবার আশার মরিচবাতি জ্বলতে শুরু করল। তাহলে তো ঠিকই আছে! আমিই শুধু শুধু ভেবে মরছিলাম।

নিচে নামতে নামতেই সেই কাগজের ভাঁজ খুলে পড়ে ফেললাম, ‘আজ বিকেলবেলা একবার বড়মাঠের কাছে আসতে পারবেন? একটু কথা ছিল।’

ইয়াহু! আমি খুশিতে সিঁড়িতে নামতে নামতেই দু’লাফ দিলাম। প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। শেষ মুহূর্তে সিঁড়ির হাতলে হাত না থাকলে ওখানেই আমার কর্ম কাবার হয়ে যেত। কিন্তু মনের খুশিকে আটকে রাখা আজ ভয়ানক মুশকিল হয়ে গেল আমার পক্ষে। মঞ্জুদির দিক থেকেও তাহলে পালে হাওয়া লেগে গেছে! কী মজা! মা যতই হম্বিতম্বি করুক না কেন, মঞ্জুদি আমার মঞ্জুভাবী না হয়ে কই যাবে!

রনকদাকে এসে তার সম্পত্তি ঠিকঠাকমতো বুঝে দিলাম। নিজের জামা জুতা ব্যাগ ছাড়তে ছাড়তে খুবই নির্লিপ্ত একটা চাহনি দিয়ে রনকদাকে আড়ে আড়ে দেখতে লাগলাম। রনকদার ভেতরের খুশি তখন আর আটকে থাকতে চাইছে না কিছুতেই। দেখেই বুঝতে পারছি, বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা আজ কতখানি কষ্টের ব্যাপার তার জন্য।

মায়ের রক্তচক্ষুকে অনেকটা উপেক্ষা করেই এর পর থেকে রনকদা আর মঞ্জুদির এখানে সেখানে গল্পগুজব বই দেওয়া নেওয়া এসব চলতে লাগল। মন দেওয়া নেওয়াটাও একইসাথে হয়ে গেল কী না তা অবশ্য বুঝতে পারিনি। কিন্তু দুজনের মুখের হাসি, চোখের ইশারা এসবকিছু যে সেদিকেই ইঙ্গিত করে তা বুঝতে খুব বেশি বুঝদার হওয়ার দরকার পড়ে না। আমি হলাম তাদের বার্তাবাহক। রনকদাও নানারকম মিষ্টিমধুর বার্তা লিখে মঞ্জুদিকে পাঠাতে লাগল। লোভ সামলাতে পারি না। খুলে টুক করে পড়ে ফেলি। রনকদা লেখে, ‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস, তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ!’ মঞ্জুদি উত্তরে লেখে, ‘যত ভাঙে তত ভালো

যত স্রোত বইয়ে যায়… তুমি তত ব’য়ে যাও,

আমি তত ব’য়ে চলি,

তবুও কেহই কারু নয়।’

ভাবে ভরা উত্তর মঞ্জুদির। তবু ভালোবাসা না থাকলে কি আর এমন উত্তর আসে?

এদিকে আমাদের পাড়াতে তখন অন্যরকম গুনগুন চলছে। রনকের মতো নিষ্পাপ একটা ছেলের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে, এই মর্মে পাড়ার চিন্তিত আন্টিরা আমার মায়ের কাছে স্মারকনামা পেশ করল। মা দেখেশুনে একেবারে চুপ মেরে গেল। মিন মিন করে শুধু একবার বলল, ‘ডাইনি তো রক্ত চুষেই ছাড়বে! আমার যা করার ছিল করছি। ছেলে বেশি লায়েক হয়ে গেছে। বেশি আর কী করব? যার কপালে যেটা আছে, সেটা খণ্ডাবে কে?’

মঞ্জুদি কিন্তু পাড়ার অন্য ছেলেদের সাথেও হেসে হেসে কথা বলে তখনো। একদিন দেখলাম রনকদা খুব উত্তেজিত গলায় মঞ্জুদিকে কী সব জানি বলছে। আমি দূর থেকে প্রায়ই এই দুজনকে লক্ষ করতাম। কিন্তু সেদিন মনে হলো হাওয়াটা যেন বেশিই গরম। ভালো করে বোঝার জন্য আমি আরেকটু তাদের দুজনের দিকে সরে গেলাম। নিজেদের আলাপে তারা এতটাই মেতে ছিল যে আমাকে কেউ খেয়ালই করল না!

রনকদা উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলছে, ‘ওদের সাথে এত কীসের আড্ডা তোমার? আজেবাজে ছেলে সব!’

‘আজেবাজে হবে কেন? আর আপনি আমাকে শেখাতে পারেন না আমি কার সাথে মিশব কার সাথে মিশব না!’

‘কেন? তোমাকে কিছু বলার অধিকার নেই আমার? এতদিন ধরে আমাদের মধ্যে যে রিলেশনটা তৈরি হলো…’

‘এক মিনিট! কীসের রিলেশন? আপনার মাথা ঠিক আছে তো? আমি কোনো রিলেশনের প্রতিশ্রুতি দিইনি আপনাকে। সিম্পল গল্পগুজব করেছি মাত্র। এটাকে আপনি যদি অন্যকিছু মনে করেন তাহলে আমার কিছু বলার নাই!’

আমি সেখান থেকে সরে এলাম। এইসব কথাবার্তা আর শুনতে ইচ্ছে করছিল না। বুঝতে পারলাম, ঘটনা একটু প্যাঁচ খেয়ে গেছে। মঞ্জুদিই বা এসব কী বলছে? এতদিন ধরে মেলামেশা করে এখন আবার এ কী ধরনের কথাবার্তা?

মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। রনকদার অবস্থা অনেক বেশি খারাপ। সেদিন রাতে অনেক দিন পর রনকদাকে সিগারেট খেতে দেখলাম। লেখাপড়ার সাথে সম্পর্ক আগেই কমে এসেছিল, এখন একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। দু’দিন পরে দেখি, ইউনিভার্সিটিতেও আর যাচ্ছে না। মা তো সেই কবে থেকেই দাদার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। এবারে হাল বেহাল দেখে বাবা একদিন অনেকক্ষণ ধরে নসিহত করল। রনকদা হ্যাঁ না কিছুই বলল না, কোনো প্রতিবাদ করল না। কিন্তু নিজেকে পাল্টালও না।

মা একা একাই রান্নাঘরে বসে গজগজ করত আর চোখের পানি মুছত। ‘আগেই বলেছি ওরা ডাইনি! মা মেয়ে দুটাই ডাইনি! যাকে ধরে একেবারে শেষ করে দেয়! ছেলেটা শুনল না আমার কথা! সব শেষ হয়ে গেল!’

আমারও কিছু ভালো লাগত না। মঞ্জুদি কি সত্যিই খুব খারাপ? মা যেটা বলে আসলেই কি তাই? ডাইনি? তাই যদি না হবে তাহলে রনকদার সাথে এরকম কেন করল? পাড়ার অন্য ছেলেদের সাথেও কেন ওরকম হেসে হেসে গল্প করে মঞ্জুদি? একসাথে কি সবার সাথেই একইরকম ভাবে মেশা যায় নাকি? এটা আমার মতো বাচ্চা ছেলেও বোঝে, আর মঞ্জুদি বোঝে না?

এরইমধ্যে আরেক ঘটনা ঘটল। আফজাল আংকেল জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গেল। তার আগে থেকেই অনেক লাইনঘাট। পলিটিকাল লোকজনের সাথে ওঠাবসা। তাদেরকে ধরেই নাকি জেল থেকে বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়েই একদিন খুল্লামখুল্লা ঘোষণা দিয়ে দিলো, যাদের জন্য আজ তার এই দূর্গতি আগে তাদের বারোটা বাজাবে তারপর অন্য কথা!

মঞ্জুদি কিংবা তার পরিবারের ওপরেই এই হুমকি গেল। কিন্তু তাদের প্রতিক্রিয়া বোঝা গেল না। মঞ্জুদি আগের মতোই সেজেগুজে পাড়ায় ঘোরাঘুরি করে।

ইদানিং পাড়ায় কিছু নতুন ধরণের উটকো ছেলেছোকরার আমদানি হয়েছে। তারা খুবই উশৃংখল ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলে, মেয়েদের দেখলে অশ্রাব্য সব অঙ্গভঙ্গি করে। আজেবাজে নানারকম মন্তব্য করে। পাড়ার অন্য মেয়েরা একেবারেই বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিলো। তাদের মা-বাবারা কেউ আর বাসার বাইরে পা ফেলতে দেয় না তাদের। তবু মঞ্জুদিদের কথা তো আলাদা! তারা কোনো কিছু নিয়েই বেশি মাথা ঘামায় না। সবাই বলাবলি করে, এই ছেলেগুলো নাকি আফজাল আংকেলের ভাড়া করা সব গুণ্ডা। মঞ্জুদিকে টাইট দেওয়ার জন্যই পাড়ায় এদের আগমন ঘটেছে।

মাকে বাসায় একা একা বলতে শুনেছি, ‘দিক মাগীর মুখে ঝামা ঘষে। পরের ছেলেকে নিয়ে ছিবড়ে বানানোর মজা টের পাক এবার!’

রনকদা এখন আর মোটেও বাইরে বের হয় না। ইউনিভার্সিটি যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ। তার জীবনটা এখন মোটামুটি স্থবির। মা-বাবা একরকম সব আশাই ছেড়ে দিয়েছে। মঞ্জুদিকে নিয়ে এই যে এতরকম কানাঘুষা চলছে, এসব নিয়েও যেন কোনো মাথাব্যথা নেই রনকদার।

এর মাঝেই একদিন কী মনে করে যেন বেশ অনেকক্ষণ ধরে বাইরে ঘোরাঘুরি করে এলো রনকদা। আমরা ভাবলাম, দাদা বুঝি আবার নিজেকে ফিরে পেতে চাইছে। মা-বাবাকেও একটু খুশি খুশি মনে হলো ব্যাপারটাতে। সবকিছু ভুলে ছেলে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসুক, তারা তখন সেটাই চাইছেন।

ঐদিন বিকেলের দিকে বাইরে থেকে ঘুরে এসে রনকদা আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিলো। আমি দেখলাম, চিঠিটা একটা খামে ভরা। ওপরে মঞ্জুদির নাম লেখা। দাদা বলল, ‘আজকেই দিস!’

আমি প্রথমে কিছু বললাম না। কিন্তু মনের মধ্যে অনেকরকম প্রশ্ন এসে জমা হলো। এতদিন পরে রনকদা আবার কেন মঞ্জুদিকে চিঠি দিচ্ছে! মঞ্জুদিকে ভুলে গেলেই তো ভালো হয় এখন! আমার মনের ভাব খেয়াল করেই রনকদা বুঝি কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলল, ‘তুই বলবি একটু যেন খুলে দেখে। আমার ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইব। আজকের পর আর বিরক্ত করব না।’

আমি আর কিছু বলতে গেলাম না। আমার কাজ বার্তাবাহকের। বার্তাবাহকের এত কিছু না জানলেও চলে।

চিঠিটা মঞ্জুদির হাতে তুলে দিয়েই সেখান থেকে সরে পড়লাম। মঞ্জুদি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার তাকিয়েছিল আমার দিকে। আমি সেইদিকে দৃষ্টিপাত না করেই নিজের পথ ধরলাম।

সেদিন সন্ধার পর থেকে মঞ্জুদিকে আর কেউ কোথাও খুঁজে পেল না।

রাত থেকেই খোঁজ খোঁজ। চারদিকে অনেক লোক নেমে পড়ল মঞ্জুদিকে খুঁজতে। মঞ্জুদির মা-বাবা পাগলের মতো হয়ে গেল। কিন্তু হাজার খুঁজেও লাভ হলো না। মঞ্জুদি কোত্থাও নেই!

পরদিন সকালে আশেপাশের চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল আমার। মঞ্জুদিকে নাকি বড়মাঠের পাশের একটা ঝোঁপের ভেতরে পাওয়া গেছে। মৃতা…ধর্ষিতা। কয়েকটা বন্য শিয়ালের দল মঞ্জুদির শরীরটাকে নিয়ে যা খুশি তাই করেছে। ঝোঁপের আড়ালে কাঁটার ভাঁজে নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে মঞ্জুদি। চোখদুটো খোলা। যেন খোলাচোখে তাকিয়ে সবাইকে ডেকে ডেকে বলছে, ‘আচ্ছা আমার অপরাধটা কী বল তো? কেন ওরা আমার সাথে এমন করল?’

আমি সবকিছু শুনে বাসায় এসে দেখি মা-বাবা মঞ্জুদির লাশ দেখতে বের হয়েছে। দাদা পাথরমুখে বসে আছে নিজের ঘরে। গতকাল সারারাত রনকদা জেগে বসে ছিল। আমার মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে গেছে। দেখেছি দাদা এক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে কোনো প্রশ্ন নেই। শুধু একরাশ শূন্যতা!

কিছু না বলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কত কী স্বপ্ন দেখেছিলাম মনে মনে! অথচ কী থেকে কী হয়ে গেল! বাইরে একা একা ঘুরতে লাগলাম। সবাই তখন মঞ্জুদির লাশের পাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। লাশের গায়ে কোনো কাপড় ছিল না। সকালে পুলিশ এসেই আগে সেটাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। মঞ্জুদির মা-বাবা শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে। তাদেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আজ কারো কাছেই নেই!

আমি দূরে আমাকে মা-বাবাকে দেখতে পেলাম। আজ যেন মায়ের মুখেও বিষাদের ছায়া। অথচ দু’দিন আগেই মা তো নিজেই মঞ্জুদিকে উদ্দেশ্য করে কত কী বলেছে!

পুলিশ অনেক কথা জিজ্ঞেস করল সবাইকে। কেউ সঠিকভাবে কিছুই বলতে পারল না। গতকাল সন্ধার দিকে দু’একজন মঞ্জুদিকে এদিকে আসতে দেখেছে। সাথে কেউ ছিল না।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, সকাল থেকেই আফজাল আংকেল আর সেই সব নতুন আমদানি হওয়া ছেলেগুলোকেও কেউ কোথাও আর খুঁজে পেল না। অথচ গত কিছুদিন ধরেই এই ছেলেগুলো সারা দিনমান এই পাড়াতেই চক্কর কেটেছে। পুলিশ সবকিছু নোট করে নিল। বোঝা যাচ্ছে, এই ব্যাপারটাতে এদেরই হাত আছে। হয়ত সবার অনুমানই সঠিক। ছেলেগুলো এই উদ্দেশ্যেই পাড়াতে এসেছিল। মঞ্জুদির ওপরে প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে! আর তাদেরকে নিয়ে এসেছিল এই আফজাল আংকেলই।

বিষণ্নমনে আমরা বাসায় ফিরে এলাম। আমার হাত পা চলতে চাইছে না। কী দেখলাম তখনো যেন পুরোপুরি মাথায় ঢুকছে না। আমার ছোট মনে তীব্র ছায়াপাত করে গেল সবকিছু। মায়ের চোখেও পানি। বাবার মুখ থমথমে। বাসায় ঢুকে একটু কেমন জানি খটকা লাগল সবার। দরজা খোলা। একেবারে হাট করে খোলা। কিন্তু রনকদা কোথায়? মা হঠাৎ রনকদাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল। ‘রনক…রনক কই? দরজা খোলা ক্যান?’

তাড়াতাড়ি আমি আমাদের ঘরে ঢুকলাম। ঘরে ঢুকে একটা তীব্র চিৎকার দিলাম। রনকদা ফ্যানের সাথে ফাঁশ লাগিয়ে ঝুলছে!

আমার চিৎকার শুনে মা-বাবা দৌড়ে এলো। রনকদাকে দেখে মা গগনবিদারী এক আর্তচিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল!’

গল্প শেষ করলাম। তন্মা তখনো তন্ময় হয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। বললাম, ‘গল্প শেষ তন্মা। আর কিছু বলার নেই আমার!’

তন্মা চুপ করে রইল। কারোই যেন আর কিছুই বলার নেই। অস্তগামী সূর্যটা টকটকে লাল চোখে দেখছে আমাদের। আমি বললাম, ‘চলো ওঠা যাক। আর ভালো লাগছে না এখানে!’

তন্মা উঠতে উঠতে বলল, ‘আচ্ছা তুমি তো চিঠিটা খুলেছিল তাই না? কী লেখা ছিল চিঠিটাতে?’

আমি চুপ করে রইলাম। তন্মা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর নিজেই বলল, ‘তোমার রনকদাই মঞ্জুদিকে সেই ঝোপের কাছে যেতে বলেছিল তাই না? বলেছিল, শেষবারের মতো কিছু কথা বলবে। ক্ষমা চাইবে…তার ভুলের জন্য। মঞ্জুদিকে যেতে বলেও তোমার রনকদা নিজে সেখানে যায়নি। তাই না? ঠিক বলেছি না?’

আমি কিছু বললাম না। আমার নীরবতাকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল তন্মা। তারপর আপনমনেই বলল, ‘ইস! তুমি যদি ঐ চিঠিটা উনাকে না দিতে সেদিন! তাহলে হয়ত মঞ্জুদি আর রনকদা দুজনেই আজ বেঁচে থাকত! সবকিছু ভুলে গিয়ে যে যে যার মতো জীবনটাকে গুছিয়ে নিত!’

সূর্যটা ডুবে গেছে। বালুকাবেলায় খালি পায়ে হাঁটছি দুজন। গভীর দাগ ফেলে রেখে যাচ্ছি চলার পথে। যেতে যেতে মনে হলো, সেদিন যে বিকেলের পর থেকেই ঐ ছেলেগুলো ঝোপের আশেপাশে বসে আড্ডা দিচ্ছিল সেই কথাটাও তো আমি জানতাম। মঞ্জুদিকে চিঠিটা দিয়ে ফিরে আসার পথেও আরেকবার গিয়ে দেখে এসেছি। তারা তখনো সেখানেই বসে আড্ডা মারছিল।

মঞ্জুদিকে খুব ভালোবাসতাম আমি। তাকে গিয়ে বলে আসতে পারতাম, ‘আজকে ওখানে যেও না মঞ্জুদি। রনকদা মিথ্যে কথা বলেছে। সে আজ ওখানে যাবে না!’

কথাটা বলতে চেয়েও বলতে পারিনি। মনে মনে আমিও কি চাইছিলাম, মঞ্জুদির একটা উচিত শিক্ষা হোক? কেন আমার রনকদার সাথে ওমন করল মঞ্জুদি?

তন্মার দিকে তাকিয়ে দেখি ও এক মনে সূর্যের দিকেই তাকিয়ে আছে তখনো। একবার ইচ্ছে হলো, কথাটা তন্মাকে বলি। ওর কাছে বলে আজ অন্তত হালকা করি নিজেকে।

পর মুহূর্তেই মত পাল্টালাম। থাক! কিছু সত্য নিজের ভেতরেই থাক! সেগুলোকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে আনলে বর্তমানটাই অন্তসারশূন্য হয়ে যাবে। মঞ্জুদিকে উদ্দেশ্য করে মনে মনে আরেকবার বললাম,

‘ক্ষমা করো মঞ্জুদি!’

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত