| 26 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অসমিয়া অনুবাদ গল্প: মাতৃ । মামণি রয়সম  গোস্বামী

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

লেখক পরিচিতিঃ

অসমিয়া সাহিত্যে দ্বিতীয় জ্ঞানপীঠ বিজয়িনী ইন্দিরা গোস্বামী ওরফে মামণি রয়সম গোস্বামী ১৯৪২ সনে অসমের গুয়াহাটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।দিল্লি বিশ্ববিদ্যাল্যের আধুনিক ভারতীয় ভাষা বিভাগে অধ্যাপনারত এই অধ্যাপিকার রামায়ণী সাহিত্যের গবেষ্ক হিসেবে সমগ্র বিশ্বে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে।গল্প এবং উপন্যাস দুটিতেই সমান দক্ষ লেখিকা ‘মামরে ধরা তরোয়াল’উপন্যাসের জন্য ১৯৮৩ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।২০০০ সনে জ্ঞানপীঠ সম্মানে স্মমানিত লেখিকার অসংখ্য গল্প উপন্যাস ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।২০১১ সনে লেখিকার মৃত্যু হয়।

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস


বাইরে তখনও ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল।দরজার মুখে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয়বার মধু মাস্টার শূন্য দৃষ্টিতে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের বুকের দিকে তাকাল। এক কোণে হেলান দিয়ে রাখা ছাতিটা পুনরায় একবার মাস্টার মেলে দেখল, ওহো কোনোমতেই এটা নিয়ে বাইরে যাওয়া যাবেনা। ছাতিটা মেলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে থাকা ছোটো ছোটো ফুটোগুলি দ্বিগুণ বড়ো হয়ে মাস্টারের চোখে ধরা পড়ল। মেঝেটার বাঁদিকে থাকা ঢেঁকিশালে পিঠের গুড়ো করতে থাকা পদুমী অপলক দৃষ্টিতে মাস্টারের দিকেই তাকিয়ে ছিল। ছাতিটা নিয়ে মধু মাস্টারের মনের এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব অবস্থা দেখেই সে প্রায় চিৎকার করে বলার মতো বলল– আজ স্কুলে না গেলে কি হবে না? তার মধ্যে আজকে আবার শনিবার!

মাস্টার তার কথায় সায় দিয়ে এবার ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। ঘরের একটা কোণ থেকে আগত শিশু কন্ঠের গুণগুনানিশুনে মধু মাস্টার এবার কিন্তু স্থির থাকতে পারল না। কণ্ঠস্বরে বিতৃষ্ণা এবং কঠোরতা মেখে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকা সোণকে বাইরে নিয়ে যাবার উপদেশ দিল। কিন্তু মাস্টারের আদেশের প্রতিক্রিয়া উল্টো ভাবে হল। দ্বিগুণ উৎসাহে এবার সোণ চিৎকার করে করে কাঁদতে শুরু করল। ঘরের ভেতরে কাক ভিজে আসা পদুমি এবার চট করে ভেতরে এসে তার একটা হাত খামচে ধরে বাইরে বের করে নিয়ে গেল। মাস্টার কিছুই বলল না। হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে মাস্টার কেবল ভাবতে শুরু করল ।….

সোণের কান্না ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ।… এবার কিন্তু মাস্টারের  রাগ হল। কপালের দুপাশের রগ দুটি টনটন করে উঠল।— এই ছোট্ট শিশুটি কিছু একটা বেশি কিছু চাইলেই তাকে দিতে চায় না কেন সে। ভগবান অন্তর নামে জিনিসটা তাকে দিতে ভুলে গিয়েছে নাকি?… মধু মাস্টারের মন উড়ে গেল– একটি দিনের প্রতি। মানুষটা মাস্টারকে কথা দিয়েছিল; জীবনের শেষ মুহূর্তে মুমূর্ষ মানুষটিকে মাস্টার খুব আশ্বাসের সঙ্গে, দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে কথা দিয়েছিল । মাস্টার নিজেই দায়িত্ব নিয়েছে যখন ছেলেটির জন্য বিন্দুমাত্র চিন্তা করতে হবে না। মৃত্যু শয্যায় পড়ে থাকা মানুষটির কাছ থেকে পাঁচ বছরের ছেলেটিকে মাস্টার কোলে তুলে এক বুক আশা নিয়ে এসেছিল– কারণ মাস্টারের ধারণা ছিল এতদিনে রুদ্ধ হয়ে থাকা মাতৃত্বের সমস্ত ভালোবাসা পদুমী এই শিশুটির উপরে উজার করে দেবে। মাত্র এই একটি ভাবনাই তিল তিল করে গ্রাস করে আসা মহিলাটির বেদনার অনেকখানি উপশম ঘটবে। মধু মাস্টারও উপভোগ করবে, এতদিন কোনো বৈশিষ্ট্য ছাড়াই চলে আসা ওদের শুকনো যৌথ জীবনে নিশ্চয় আসবে একটা নতুন মাদকতা।

এক এক করে মধু মাস্টারের মনে কয়েকটি ঘটনা এসে উঁকি দিল– সেগুলি কিন্তু মধু মাস্টারের কাছে খুব একটা ছোটো ঘটনা নয়– শরীরের রক্ত ক্ষণিকের জন্য হলেও শীতল করে রেখে যাওয়া ঘটনা সেগুলি। মাস্টারের একান্ত নিজের স্কুলে পড়া কয়েকটি মেধাবী শিশুকে নিজের বাড়িতে এনে মাস্টার পড়াতে শুরু করেছিল। যেহেতু সে খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিল যে এখন থেকে যত্ন নিলে ওদের মধ্যে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার বিষয়ে কোনো দিন নিরাশ হতে হবে না। কিন্তু তার এই চেষ্টা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলতে হল। আর সেই কান্ড ঘটল একমাত্র পদুমীর জন্য ।… মাস্টার যখন মেঝেতে পার্টি পেতে বসে খাগের কলম দিয়ে কালির দোয়াতটা সামনে নিয়ে ওদেরকে ঐকিক নিয়ম, ল.সা.গু বোঝাতে আরম্ভ করে মেঝের অন্য একটি কোণে দাঁড়িয়ে পদুমী ওদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নারীর এক একটি দৃষ্টি এত মৌন ভাষাময় – এত করুণভাবে বেদনাদায়ক হতে পারে মধু মাস্টার আগে কখনও কল্পনা করতে পারেনি। ভাতের থালায় বসে মধু মাস্টার আবিষ্কার করেছিল পদুমীর চোখ জোড়া চালতা ফুলের মতো ফুলে আছে। রুক্ষ চুলের নিচে ছোটো গোলাকার মুখটা শুকনো ।

মধু মাস্টার কিন্তু কোন কথা উচ্চারণ করতে পারল না। নিজেকে অপরাধী বলে মন হওয়া মনোভাব থেকে মুক্ত করার জন্য এবং পরিস্থিতিটাকে হালকা করার জন্য মধু মাস্টার মজার কিছু কথা বলে হাসতে চেষ্টা করেছিল।দুজনেরই হাসতে চাওয়া মুখ দুটি বিকৃত হয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কিছুই হয়নি।– এরপরে আরও কয়েকদিন মধু মাস্টার পদুমীর এই ব্যবহার লক্ষ্য করল;–

একদিন বাজার থেকে ফিরে এসে মাস্টার মেঝেতে একটা দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়াল। একটা মোড়ায় বসে পড়তে আসা হরিধনের সাত বছরের পুত্রকে কোলে তুলে নিয়েছে;– দুজনেই অনেক কথায়  মগ্ন হয়ে পড়েছে। পদুমীযেন নিজের অস্তিত্বকে ভুলে গেছে। পড়তে আনা খাতা–কলম তার অনেক দূরে পড়ে আছে। মাস্টারকে দরজার মুখে দেখে দ্রুত সে পদুমির কোল থেকে নেমে আসার জন্য টানা-হেঁচড়া করতে লাগল। পদুমী একবার ফিরে তাকাল– তারপরে ধরা পড়ে যাওয়া যুগল প্রণয়ীর মতো এক দৌড়ে রান্নাঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। এরকম কয়েকটি ঘটনা, কয়েকটি দৃশ্য মধু মাস্টারের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে গেল।

… অবশেষে ওদের বাড়িতে আসতে মানা করে দেওয়ার সিদ্ধান্তটাকে কেন জানি মধু মাস্টার ভালো বলে বিবেচনা করল।

…. হঠাৎ রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা সোণার কান্নার শব্দ মধু মাস্টারের ভাবে পূর্ণযতি ফেলল। নিজের মনেই মধু মাস্টার বিড়বিড় করল — না না সব ফাঁকি। এইসব মেয়েদের বিশ্বাস করা যায় না। মৃত্যুশয্যায় শায়িত  মানুষটার বেদনাক্লিষ্ট ভয়াবহ মুখটা আশার আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, মাতৃহীনছেলেটিকে অনেক আশায়– মাস্টারের হাতে তুলে দিয়েছিল– ঠিক ততখানি আশা নিয়েই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে মাস্টার পদুমীর কোলে ছেলেটিকে তুলে দিয়েছিল– তারপরে অবাক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ মাস্টার পদুমীর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। পদুমীর সমগ্ৰ মুখমণ্ডল অসম্ভব ধরনে গম্ভীর হয়ে পড়েছিল । সে কিছু একটা বলতে চাইছিল, বলল না। কোলথেকে সেখানেই সোণকে নামিয়ে রেখে পদুমী পুনরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।


আরো পড়ুন: সংস্কার । মামণি রয়সম গোস্বামী


হ‍্যাঁ, সেদিন থেকেই সমগ্র বাড়ির পরিবেশটাই যেন আলাদা হয়ে গেল; পদুমীর চলাফেরায় মাস্টার পরিবর্তন লক্ষ্য করল। নারীর সমস্ত কোমলতায় পরিপূর্ণ মানুষটা দুদিনের মধ্যে রুক্ষ হয়ে পড়ল। মৌন হয়ে থাকা মুখটা ধীরে ধীরে মুখরা হতে শুরু করেছে। একটা দুটো করে অনেক কথাই পদুমীর মুখ থেকে মাস্টার শুনল–সোণ আসা দিনটি থেকে বাড়িতে একটা দুটো অঘটন নাকি ঘটতে শুরু করেছে; উঠোনে পা রাখার দিনই নাকি অসুখ-বিসুখ ছাড়াই সুন্দর গাভিটার বাচ্চাটা মরে গেল! অথচ ওই বাচ্চাটার পেটটা যে ফোলা ছিল তা মাস্টার অনেকদিন থেকেই লক্ষ্য করেছিল। সমস্ত গ্রামে দুধের জন্য হাহাকার, দুধ দোয়াতে গিয়ে পদুমী ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে। পদুমী  অসীম যত্নে লাগানো কাঁকরোল গাছের পাতাগুলিও নাকি বিনা কারণে শুকিয়ে যাচ্ছে। কোনোদিনই না হওয়া বাড়ির এই অমঙ্গলের কারণ একমাত্র সোণ বলেই পদুমী ধরে নিয়েছিল। সে কথা নিঃসংকোচে পদুমী মাস্টারের কাছে প্রকাশ ও করেছিল।

নীরবে মাস্টার সমস্ত কিছু শুনে গিয়েছিল। খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুতে মাস্টার সোণকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে শুরু করল।

অবশেষে একদিন স্কুলে নিয়ে গেল। বই–পেন্সিল কিনে দিল।…

… বেড়ার আড়াল থেকে প্রায়ই মাস্টার শোনে প্রফুল্লের ঠাকুর মা, বগীতরার  মায়েদের কাছে পদুমীর বলা অগ্নিদগ্ধ বাক্যবাণ।…

– কার না কার ছেলে। মাস্টার বলে একেবারে বাড়ির ভেতরে নিয়ে এল, আর এই বয়সেই ছেলেটি কতটা খেতে পারে জান– পেট নয় যেন ভোজ রান্নার থালা, যত দিতে থাকবে তত ভরাতে থাকবে! এর পরের কথাগুলি মাস্টারের আর শোনার ইচ্ছা থাকে না,– দৌড়ে গিয়ে পদুমীর মুখটা চেপে ধরতে ইচ্ছা করেছিল মাস্টারের। ধীরে ধীরে মাস্টার ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।বাড়ির সামনে গিয়ে মাস্টার দেখল ধুলোবালিতে মাখামাখি হয়ে সোণ আপন মনে খেলছে। মাস্টার দুই হাতে জড়িয়ে ধরে শিশুটিকে কোলে তুলে নিল। ধুতির আঁচল দিয়ে শরীরটা মুছে দিয়ে মাস্টার নিজেকে বলার মতো করে বলে গেল– ইস তোর মা বাবা মরেছে কিন্তু আমি তো আছি। এই দুপুর বেলা না খেয়ে তোর পেটে পিঠে এক হয়ে গেছে তবু তোর খবর নেয় নি ।

সোণ এসব কথা বিশেষ বুঝতে পারল না। সে তার হাত দুটি মাস্টারের আধ পাকা চুলের মধ্যে ঢুকিয়ে – পুনরায় খেলার জন্য নিচে নেমে যেতে চাইল।

মাস্টার এসে যখন  ঘরের ভেতরে ঢুকল বাইরের মানুষগুলি ইতিমধ্যে বাগানের পেছনদিকের ছোটো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে। রান্নাঘরের ভেতরে ইতিমধ্যে পদুমী ভাত দিতে চলেছে। মাটি খসে যাওয়া ইকরার বেড়ার ফুটোগুলিতে চোখ রেখে পদুমী  উঁকি দিয়ে দেখল মেঝেতে বসে মাস্টার সোণকে স্নান করিয়ে এনে গা মুছে দিচ্ছে। সোণের মুখে সেদিন ভক্তরা গেয়ে যাওয়া  গানের একটা কলি খইয়ের মতো ফুটছে।… মাস্টার ও কাজের ফাঁকে ফাঁকে তার সঙ্গে তাল দিচ্ছে ।– ছেলেকে এখন না দেখলেও হবে ,বড়ো হয়েছে। এদিকে ভাত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

ভাতের থালায় বসে পুনরায় মাস্টার ভাবল কাছে বসে গোগ্রাসে ভাত খেতে শুরু করা ক্ষুধার্ত ছেলেটির মুখটা দেখে দ্বিতীয়বারের জন্য মাস্টারের দুঃখ হল। কেবল দুঃখই নয় পদুমীর ওপরে মাস্টারের ভীষণ রাগ হল। সব ফাঁকি! সব ভন্ড!! আজকাল মানুষের মমতায় ঘুণে ধরেছে। নিজের মানুষটিকেই যখন বিশ্বাস করা যায় না তখন অন্য মানুষকে কীভাবে করবে? রক্ত মাংসের সম্বন্ধ না থাকার জন্য পদুমী তাকে আদর করতে জানল না, পারল না।… 

…. পদুমীর কণ্ঠস্বরে মাস্টারের চমক ভাঙল! একই আবেগে পদুমী বলছে– ছেলেটা দেখছি মানুষটাকেও আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে। তার কথায় লজ্জার আভা। মাস্টার হেসে ভাতের থালাটা সামনে টেনে নিল।

            *              *          *   

প্রথম যেদিন পদুমী এসে লজ্জিতভাবে মাস্টারকে কথাটা বলল– এক ধরনের অপূর্ব পুলক মাস্টারের মনকে মোহাচ্ছন্ন করে তুলল,– ক্ষণিকের জন্য মাস্টার সোণের অস্তিত্বকে ভুলে গেল। প্রকৃত পিতৃ হতে চলা এই প্রথম খবরটি মাস্টারের মানসিক পরিস্থিতিটাকে ওলোট-পালট করে দিল।কী করবে কী না করবে প্রথমে মাস্টার কিছুই স্থির করতে পারল না। সেদিন স্কুলেও মাস্টার পুরোপুরি মন দিতে পারল না। ছেলেগুলিকে ধমক দিয়ে অংক শেখানোর পরিবর্তে তাদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে ইচ্ছা করল, একটি নীরব মুহূর্ত  এবং এক টুকরো নীরব জায়গার খোঁজে মাস্টারের মন ব্যাকুল হয়ে উঠল।

কিন্তু মাস্টারের এই ভাবের  প্রবলতা মাত্র কয়েকদিন স্থায়ী হল। কিন্তু কিছু একটা অবুঝ ত্রাশ মাস্টারের মনকে গ্রাস করতে আরম্ভ করল। প্রতিটি দিন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মাস্টারের মনের এই সংগ্রাম বেড়ে চলল।– হায় ,এখন হয়তো নিজের রক্তমাংসের সন্তানের মাতৃ হয়ে পদুমী  হয়তো সোণের সঙ্গে  আগের চেয়েও খারাপ ব্যবহার করবে, নিদারুণ এই শিশুটির অবস্থা হয়তো এখন মৃত্যুর তুল্য হবে। বারবার মাস্টারের দৃষ্টিতে প্রতিফলিত হল– মৃত্যুশয্যায় পড়ে থাকা অসহায় একটি মানুষের একটি পান্ডুর মুখ। সেই মুখে একমাত্র মাস্টারই শেষ মুহূর্তে একটা মৃদু  হাসি ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। এখন সেই মুখের সঙ্গে মাস্টার কীভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করবে? সেই আত্মাটা কি মাস্টারকে সুখে থাকতে দেবে ! মাস্টার আর ভাবতে পারল না, তার চিন্তা শক্তি যেন লোপ পেয়েছে। হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে নিতান্ত অসহায় ভাবে মাস্টার বসে রইল । হাস্য লাস‍্যময়ী  পদুমীর আনন্দ উৎফুল্ল নতুন স্বভাবটি মাস্টারের চিন্তায় দ্বিগুণ ঘি ঢালল।– তাহলে কী করা যায় ? পুনরায় একবার বোঝানোর চেষ্টা করবে নাকি ? ও হো, না পদুমি বুঝতে চায় না। পদুমী  বুঝেও বুঝতে চায় না, জেনেও জানতে চায় না ….

বহুদিনের কাম্য দিনটি অবশেষে একদিন ঘনিয়ে এল। ত্রাস এবং উত্তেজনায় মাস্টারের বুকটা দুরু দুরু করে কাঁপতে লাগল, বন্ধ দরজাটার কাছে গিয়ে কয়েকবার সে ফিরে এল। সদ্যোজাত সন্তানের প্রথম কান্নার ধ্বনি মাস্টার কিন্তু শুনতে পেল না। বন্ধ দরজাটা যখন খুলে গেল কম্পিত পদক্ষেপে মাস্টার পদুমীর বিছানার কাছে উপস্থিত হল। একেবারে সাদা কাগজের মতো হয়ে যাওয়া পদুমীর মুখের দিকে তাকিয়ে মাস্টার বজ্রাহতের  মতো দাঁড়িয়ে রইল। কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ধাত্রী একটা সাদা চাদর দিয়ে মৃত সন্তানটিকে ঢেকে রেখেছে। মাস্টারকে সান্ত্বনা দিতে চাওয়ার চেষ্টা করে সে বলল–’ কী করবেন আপনার ভাগ্যে নেই, বাচ্চার মা যে  বেঁচে গেছে এটাই যথেষ্ট!

…. মাটির পুতুলের মতো অনেকক্ষণ মাস্টার পদুমীর বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। পদুমীর শুকনো ঠোঁটটা যেন একটু একটু নড়ছে, বন্ধ হয়ে থাকা চোখ জোড়া পদুমী কিন্তু খোলার চেষ্টা করেনি। কিছুটা ঝুঁকে মাস্টার কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। অস্পষ্ট ভাবে মাস্টার যেন শুনতে পেল, সত্যিই যেন পদুমী বলতে চাইছে–‘সোণকে আমার কাছে এনে দাও। একবার মাত্র আমি তার শরীরটা স্পর্শ করি দেখি– মাত্র একবার।’

মাস্টার ছুটে বাইরে চলে এলেন, উঠোনে খেলতে থাকা সোণকে প্রায় জোর করে ধরে এনে পদুমীর কাছে নিয়ে গেলেন!

এবার পদুমী চোখ মেলে তাকাল, কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে আসা চোখের জল মোছার কোনো চেষ্টাই করল না পদুমী। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা সোণকে টেনে নিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। তার গালে একটা চুমু খেয়ে পদুমী পুনরায় নির্বাক হয়ে পড়ে রইল।

এই অপূর্ব দৃশ্য মাস্টার দূর থেকে উপভোগ করল। একদিন এই মানুষটিকেই মাস্টার অবিশ্বাস করেছিল। সম্পূর্ণ নিজের এই মানুষটিকে মাস্টার সন্দেহও করেছিল। পাতালের গঙ্গার মতো বইতে থাকা নারী হৃদয়ের এই প্রেমের বিষয়ে সে অন্ধ ছিল।

প্রথমবারের জন্য তৃপ্তিতে মাস্টার উল্লাসিত হয়ে উঠেছিল। নিজের– একান্ত নিজের মৃত সন্তানটির কথা মাস্টার তখন সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিল।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত