| 6 অক্টোবর 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য অনুবাদ: নিজেরই মূর্তি । রাজেন্দ্র যাদব

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

 

লেখক পরিচিতি:

উত্তর প্রদেশের আগ্রায় ১৯২৯ সালের ২৮ আগষ্ট রাজেন্দ্র যাদব জন্মগ্রহণ করেন। রাজেন্দ্র যাদব এমন একটি নাম, যেখানে তাঁকে বাদ দিয়ে হিন্দি গদ্যসাহিত্যের আলোচনা কখনোই সম্পূর্ণ হতে পারে না। তিনি উপন্যাসের পাশাপাশি অজস্র ছোটগল্পও লিখেছেন। ‘নঈ কহানি’ হিন্দি গদ্যসাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন তিনি। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘প্রেত বোলতে হ্যায়’ প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। পরবর্তী সময়ে উপন্যাসের নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় ‘খুলা আকাশ’। ১৯৬৯ সালে এই উপন্যাসকেই চলচ্চিত্রে রূপায়িত করেন বাসু চ্যাটার্জি ‘খুলে আসমান’। ‘উখড়ে হুয়ে লোগ’, ‘কুলটা’, ‘শহ্ অওর মাত’, ‘অনদেখে অনজান পুল’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য অন্যান্য কয়েকটি উপন্যাসের নাম।

প্রেমচন্দ প্রতিষ্ঠিত ‘হংস'(১৯৩০-৫৩) নামের সাহিত্য পত্রিকাটিকে নতুন করে প্রেমচন্দেরই জন্মদিন ৩১ জুলাই ১৯৮৬ সাল থেকে পুনঃপ্রকাশ ও সম্পাদনার দায়িত্ব নেন রাজেন্দ্র যাদব। হিন্দি গদ্যসাহিত্যে নিরলস পরীক্ষা নিরীক্ষা ও তাকে লালন-প্রশ্রয়ে তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবরে নিউ দিল্লিতে রাজেন্দ্র যাদবের জীবনাবসান হয়।

‘অপনী হী মূর্তি’ মূল হিন্দি গল্পের অনুবাদ : স্বপন নাগ


 

স্ট্যাচুটার সামনে সে দাঁড়িয়েছিল। স্ট্যাচুটা তার নিজের।

শহরের বড় ও ব্যস্ত চৌমাথায় একটা উঁচু স্তম্ভের ওপর ক্রেনের সাহায্যে কাল বসানো হবে স্ট্যাচুটাকে। বিশাল এই স্ট্যাচুটি অন্তত বিশ ফুটের কম নয়। অনেক চেষ্টা করেও মাটি থেকে মূর্তিটার হাঁটু অব্দি হাত যায় তার। স্ট্যাচুটার গরিমা দূরে দাঁড়িয়ে সত্যিই দেখবার মত। সবচেয়ে দুর্লভ আর দামি পাথরের বড় একটা ব্লক থেকে কেটে আনা হয়েছে বিদেশ থেকে। আনা হয়েছে দেশেরই নামী এক শিল্পীর তদারকিতে। মূর্তি স্থাপন উপলক্ষে তৈরি হয়েছে ফান্ড। সেই ফান্ডে জমা পড়েছে শহরের বড় বড় শিল্পপতিদের অনুদানও। যদি নিজেই সে এই স্ট্যাচু তৈরির ব্যাপারে আগ্রহ না দেখাত, শেষমেশ সম্ভব হত না একাজটির হয়ে-ওঠা। স্বভাবতই মনে মনে খুব খুশি হচ্ছিল সে।

সে অনেকক্ষণ ধরে দূর থেকে স্ট্যাচুটার দিকে তাকিয়ে রইল – মূর্তিটার মুখে যেন প্রতিজ্ঞা, নিষ্ঠা আর ত্যাগের ছটা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। পোষাকে সাদাসিধে আর সুরুচি, দাঁড়িয়ে-থাকার মধ্যে সুন্দর এক আভিজাত্য ও নম্রতার মিশেল… আর চোখ দুটো বানানো এমনই, যেদিক থেকেই দেখো, মনে হবে যেন সেদিকেই তাকিয়ে আছে। দেখে যেন গভীর শ্রদ্ধায় তার নিজেরই মাথা ঝুঁকে আসতে চাইছে। মনেই হচ্ছে না, এ মূর্তি তার নিজের। মনে হচ্ছে যেন অন্য কেউ, অনেক দূরের, অনেক বড় আর খুব মহান … সে নিজেই যখন বিশ্বাস করতে পারছে না, অন্য লোকেরা অথবা আগামী প্রজন্ম বিশ্বাস করবে তো যে এমন মহান একজন মানুষ সত্যি সত্যিই একদিন পৃথিবীতে ছিল !

বেঁচে থাকতে থাকতেই নিজের স্ট্যাচু বানানো এবং তার আবরণ উন্মোচন নিজেই করা – ব্যাপারটায় প্রথম প্রথম বেশ অস্বস্তিতে ছিল সে। কিন্তু পরেই মনে হল এরকম উদাহরণ কিন্তু পৃথিবীতে ভুরি ভুরি আছে। দক্ষিণ ভারতে, বিশেষ করে তামিলনাড়ুতে তো অনেক নেতা, সামাজিক কর্মকর্তাদের মূর্তি তাদের জীবদ্দশাতেই বসানো হয়েছে। এমনকি সেসব মূর্তির আবরণ উন্মোচনও করেছে তারা নিজেরাই। এতে তো দোষের কিছু নেই !

যখন থেকে স্ট্যাচুটাকে তার বড় লনে এনে রাখা হয়েছে, তখন থেকেই তার শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ শুরু হয়েছে। সারাদিন অনেক লোকের মাঝে সে অবশ্যি উদাসীনতা দেখায়, অন্য হাজার কাজের ব্যস্ততায় নিজেকে মগ্ন থাকার ভাণ করে। কিন্তু এই রাত্তিরে, সে যখন বিশাল মূর্তিটার সামনে এসে দাঁড়াল, কিছুতেই সারাদিনের অভিনয়কে আর ধরে রাখতে পারে না। এখন অনেক রাত। সে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। প্রথমে আড়াল থেকে দূরের স্ট্যাচুটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল মুগ্ধ চোখে, অনেকক্ষণ। তারপর ঠিক মনে করতে পারছে না মূর্তিটা কখন যেন তাকে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তাকে, তার নিচে। খেয়াল হল, সে দাঁড়িয়ে আছে আর বিষ্ময়াবিষ্ট ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে। দু’হাত উঁচু করে মূর্তিটাকে একবার ছোঁয়ার চেষ্টা করল সে। মূর্তির হাঁটু অব্দি হাত পৌঁছতে বেশ কসরত করতে হল তাকে। ছুঁয়েই মনে হল, কী ঠান্ডা, কী সুন্দর, কত নিরেট আর ভারি মার্বেল !  অন্যমনস্ক হয়ে অনেকক্ষণ ধরে মূর্তির হাঁটুতে সে হাত বুলিয়েই চলল। দামি সেই পাথরের ওজন ও ঘনত্ব পরখ করার জন্যে মূর্তিটা একটু নড়ানোরও চেষ্টা করল । কিন্তু বিন্দুমাত্র নড়ার লক্ষণই দেখা গেল না। আরও একটু জোর লাগাল। অবস্থা একইরকম দেখে এবার সে দু’হাত দিয়ে নড়াবার চেষ্টা করল। আনমনে এমন চেষ্টার বিফলতায় তার ভেতরে কেমন যেন একটা জেদ চেপে বসল। সত্যি সত্যিই সেই জেদ কখন হিংস্র হয়ে উঠেছে, সে বুঝতে পারল না। পাগলের মত দু’হাত দিয়ে মূর্তিটাকে ক্রমাগত আগে-পিছে ঠেলতে লাগল। শেষে মনে হল, স্ট্যাচুটা যেন সামান্য নড়ে উঠল।


পরের দিন সকালে ক্রেন এল। ক্রেনের সাহায্যে উল্টে-পড়া বিশাল স্ট্যাচুর নিচ থেকে বের করা হল চাপাপড়া তার শরীর।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত