| 26 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: একাকিনী (পর্ব-১৫) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
  পুত্রেষ্টি যজ্ঞের আগে অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে হয়, যেখানে একটি ঘোড়া ছেড়ে দেওয়া হয়। যে রাজ্যে রাজা ঘোড়াকে আটকান, সেই রাজার সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করলে তবেই সেই ঘোড়া আবার এগোতে পারে। এই ভাবে অপরাজিত থেকে সেই ঘোড়া ফিরলে তার মাংস আহুতি দিয়ে অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু দ্রুপদের এত সময় নেই। তিনি যাজ ও উপযাজ দুই ভাইকে অনুরোধ করলেন সরাসরি পুত্রেষ্টি যজ্ঞ আরম্ভ করার জন্য। 
পাঞ্চাল রাজ্য জুড়ে শুরু হল মহা ধুমধাম। রাজা পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করবেন। যজ্ঞ মানেই প্রচুর দান। বিরাট আড়ম্বর। প্রচুর খাওয়া-দাওয়া। রাজ্যের লোকজন চতুর্দিক থেকে ভিড় জমাল রাজধানীতে। বিরাট একটি প্রান্তরে যজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছে। মাটি খুঁড়ে হোমের স্থান করা হয়েছে এক ধারে। তার দুই দিকে সহপুরোহিতদের আসন, মাঝে প্রধান পুরোহিত যাজের আসন। উল্টোদিকে দ্রুপদ ও তাঁর মহিষীর আসন।  যার পেছন দিকটা থেকে শুরু হচ্ছে জঙ্গলের সীমানা। যেদিক থেকে যজ্ঞের লেলিহান অগ্নিশিখা আর ধোঁয়ার আড়ালে আসবে দুই ভাইবোন। ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদী। দুজনকে সমস্ত কথা বোঝানো হয়েছে। দুজনেই উত্তেজিত। সাগ্রহে রাজি হয়েছে তারা নতুন জীবনে যেতে। সামান্য একটু মনখারাপ হলেও আনন্দ আর উত্তেজনাই বেশি। দ্রুপদ যখন যজ্ঞের সমস্ত উপকরণ যোগাড় করাচ্ছেন, যজ্ঞস্থল তৈরি করাচ্ছেন, ততদিন  যাজ ওদের নাগরিক আদবকায়দা, ভাষা সম্পর্কে পরিচয় করাচ্ছেন। ইরা পুরো সময়টাই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকছে। কারণ সে জানে, এই জীবনে আর দেখা হবে না দু পক্ষের। রাজনীতির আবর্তে কোথায় তলিয়ে যাবে ওর দুই সন্তান।
প্রায় ছ’মাস লাগল যজ্ঞের সব ব্যবস্থা করতে। একটু একটু করে ব্যবস্থা এগোচ্ছে, দ্রুপদ ভেতরে ভেতরে ততই উত্তেজিত হচ্ছেন। সব ঠিক থাকবে তো? যা ভাবছেন, সেই অনুযায়ী কাজ হবে তো? ধৃষ্টদ্যুম্ন আর কৃষ্ণা পাঞ্চালী! কাছে পাওয়ার আগে থেকেই দুজনের প্রতি অমোঘ টান অনুভব করছেন তিনি। 

আরো পড়ুন: একাকিনী (পর্ব-১৪) । রোহিণী ধর্মপাল


অবশেষে, সেই সময় এসে গেল। সাতটি সূর্যোদয় ধরে জ্বলল যজ্ঞের আগুন। শেষ দিনে আগুনের শিখা যেন স্পর্শ করল সূর্যকে। মাঝে মাঝেই যাজ ধুনো গুগগুল মুঠো করে ফেলছিলেন আগুনে। চারিদিক ধোঁয়ায় ভরে উঠছিল। এমন সময় যাজ ডাকলেন মহিষীকে, “হে রাণী পৃষতী(দ্রুপদের বাবা ছিলেন পৃষত), আপনি এবার আসুন। আপনার দুটি সন্তান উপস্থিত হয়েছে”।
দ্রুপদ যতোই বুঝিয়ে থাকুন, তাঁর রাণীর সময় লাগছিল পুরো বিষয়টি মানতে। বনেচর দুই ছেলে মেয়েকে মেনে নিতে হবে সন্তানরূপে? এতোই কী সহজ? তবে, প্রতিশোধ নিতে গেলে মেনে নিতেই হবে, তাও বুঝতে পারছিলেন। তবু, যাজ যখন ডাকলেন, তিনি ধড়ফড়িয়ে উঠলেন। বলে ফেললেন, “অবলিপ্তং মুখং ব্রহ্মন্!দিব্যান্ গন্ধান্ বিভর্মি চ। তিষ্ঠ যাজ! আমি এখনও মুখটুখ ধুইনি। স্নান করিনি বলে গায়ে তেলের গন্ধ এখনও রয়ে গেছে। আপনি একটু অপেক্ষা করুন যাজ”!
যাজের পক্ষে তো অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। ইরা বনের দিকে ছেলেমেয়েকে নিয়ে বসে আছে। আগুন আর ধোঁয়া কমে গেলে পুরো পরিকল্পনাই ব্যর্থ হয়ে যাবে।  সুতরাং যাজ বললেন, “আপনি আসুন বা না আসুন আমি আগুনে এই হবি দিচ্ছি। যা ফল হওয়ার হোক”।
হবি নিক্ষিপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চড়বড় চড়বড় করে আওয়াজ হতে থাকল। ধোঁয়া আর আগুন যেন আরও উৎসাহ পেয়ে চতুর্গুণ আকার ধারণ করল। সেই ধোঁয়ার আড়াল থেকে প্রথমে বেরিয়ে এল আগুনের মতো উজ্জ্বল, বর্ম পরা, তলোয়ার কটিতে, হাতে তীর ধনুক অপূর্ব সুন্দর এক কুমার। আড়াল থেকে কোনও এক স্ত্রীকন্ঠ ঘোষণা করল, “এই কুমার, ধৃষ্টদ্যুম্ন, দ্রোণকে বধ করবে”। আনন্দে কোলাহল করে উঠল সবাই। তারপরেই সেই শিখার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল আশ্চর্য এক মেয়ে। কালো আলো যেন। বিদ্যুতের শিখার মতো। অদ্ভুত আবেদনময়ী, লাবণ্য আর তেজের মিশেল, তীরের মতো ঋজু আবার যেন বীণার মতো ঝঙ্কৃত তার সারা শরীর! তাকে দেখে থমকে গেল সবাই। এ কে? মেয়ে না দেবী? আবার সেই স্ত্রীকন্ঠ শোনা গেল, হে পাঞ্চালবাসী,  “এই কুমারী, কৃষ্ণা, কুরুবংশের মনে ভয় তৈরি করবে”। জনগণ যেন উন্মাদ হয়ে উঠল। সিংহের মতো গর্জন করতে লাগল। যেন যুদ্ধ জয় হয়েই গেছে!!
 ইরা ঘোষণা দুটি করে যজ্ঞস্থলের দিকে একবার তাকিয়ে বনের ভেতর ঢুকে গেল। তার ছেলে এখন রাজপুত্র। আর মেয়ে! ইরা জানে তার মেয়ে একাই শতসহস্র। ওই রূপ আর তেজের আগুনে পুড়বে সবাই! সমস্ত ক্ষত্রিয়কুল! ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়ের এই লড়াইয়ে আসলে জয়ী হবে সে। বনে থাকা আদিবাসী এক সাধারণ মা। কেউ জানবেই না, আসলে এক শূদ্রের রক্ত কোনও একদিন হয়ত দেশের মাথায় বসবে। যদি অবশ্য দ্রুপদের পরিকল্পনা সার্থক হয় শেষ পর্যন্ত।
যজ্ঞস্থলে উপস্থিত সকলের তীব্র চিৎকার আর আস্ফালন শুনে দ্রুপদমহিষী তাকিয়ে দেখলেন আগুনের দিকে। দেখলেন অসাধারণ কান্তিমান এক কুমার ও কুমারীকে। কী অসম্ভব বলিষ্ঠ আর দৃপ্ত চেহারা। যেন পৃথিবী জয় করার জন্য এসেছে! রাজা তো বলেছিলেন বনেচর দুই জন! ব্রাহ্মণের ঔরসে শূদ্রা রমণীর গর্ভে জাত! তিনি কেমন করে তা মেনে নিতেন! কিন্তু আজ ছেলেমেয়ে দুটিকে দেখে মনে হচ্ছে দ্রুপদ কিছু ভুল করেন নি। তিনি এগিয়ে গেলেন যাজের দিকে। বললেন, “ন বৈ মদন্যাং জননীং জানীয়াতামিমাবিতি, এরা যেন আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে মা বলে না ডাকে”। যাজ তো তাইই চান। দ্রুপদের ইচ্ছা যে এমনটাই ছিল, তা তিনি জানতেন। তাই স্মিত হেসে বললেন, “তথা অস্তু। তাই হোক”।
চর তো সব রাজাদেরই থাকে। রাজ্যের সব প্রধান মানুষদেরও। সেই চর মারফত দ্রোণ যখন এই খবরটি পেলেন, তিনি ভাবলেন, আমাকে বধের উদ্দেশ্য নিয়ে জন্মালেও এই কুমারকে আমি অস্ত্রশিক্ষা দেব। তাহলে ভবিষ্যতে যাই হোক না কেন, আমাকে সকলেই উদার আর মহানরূপেই চিনবে। এই কথা ভেবে দ্রোণ নিজে উদ্যোগ নিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্নকে তাঁর কাছে অস্ত্রশিক্ষার প্রস্তাব করলেন, আত্মকীর্ত্যনুরক্ষাৎ, নিজের যশ অক্ষুণ্ণ রাখতে। 
ইতিমধ্যে ধীরে ধীরে হস্তিনাপুরের অন্দরে ষড়যন্ত্রের কালো আঁধার ঘনিয়ে আসছে। পাণ্ডবদের মারার জন্য দুর্যোধন বারাণাবতে জতুগৃহ তৈরি করিয়েছেন পুরোচন নামে বিশ্বস্ত এক ভৃত্যকে দিয়ে। যে জতুগৃহে আগুন লাগালে মুহূর্তেই পুরো বাড়ি জ্বলে উঠবে। মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে কুন্তীসহ পাঁচ ভাইকে পাঠিয়েছেন সেখানে। ভুলের মধ্যে বিদুরকে তিনি এই পুরো পরিকল্পনায় বিপদ বলে মনে করেন নি। কিন্তু বিদুর দুর্যোধনের মিষ্টি কথায় আরও বেশি করে শঙ্কিত হয়ে সব খবর নিয়েছেন এবং কিভাবে সুড়ঙ্গ কেটে যুধিষ্ঠিররা পালাবেন, সেই সঙ্কেত দিয়ে দিয়েছেন। 
বিদুরের পরামর্শ অনুযায়ী জতুগৃহে নিজেরাই আগুন লাগিয়ে আগে থেকে কেটে রাখা সুড়ঙ্গে ঢুকে এগোতে লাগলেন কুন্তী ও তাঁর পাঁচ ছেলে। দাউদাউ আগুনে পুড়তে লাগল জতুগৃহ। পুড়তে লাগল নেশায় বেঁহুশ পুরোচন। আর পেট পুরে খেয়ে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়া এক আদিবাসী পরিবার। মা আর তার পাঁচ ছেলে। পুড়ে কাঠ হয়ে যাওয়ার পর বর্ণ, আকৃতি তো আর বোঝার উপায় থাকেনা। হাড় সবারই একরঙা। তাই ওই ছটি মৃতদেহ পেলে তা পাণ্ডবদের আর কুন্তীর বলে ধরে আনন্দের আর নিশ্চিন্তে থাকবে শত্রু।
বিদুরের পরামর্শে চরম বিপদ থেকে নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে পালাচ্ছেন পাণ্ডবরা। পেছনে পড়ে থাকা আদিবাসীদের নিয়ে এতটুকু চিন্তাই নেই। কয়েকটা নীচ জাতির লোক পুড়ে মরে তাঁদের উপকার করে ধন্য হল যেন। তখনও তাঁরা জানেন না, যে পথে মশাল জ্বেলে তাঁরা এগোচ্ছেন, তা তাঁদের নিয়ে যাবে প্রথমে এক বনেচর রাক্ষসী হিড়িম্বার কাছে। যার গর্ভে জন্ম নেবে পাণ্ডুর প্রথম দৌহিত্র। এবং তার পরে পাঞ্চাল রাজ্যে। যেখানে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করে আছেন দ্রুপদ। আর তাঁর দত্তক কন্যা, শূদ্রার গর্ভে জাতা কৃষ্ণা দ্রৌপদী!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত