| 8 মে 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-১৪) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

 রাণীয়ার ভ্লগ

ইতিমধ্যে কুশলের আইডিয়ায় রাণীয়ার ফুড ব্লগ, পডকাস্ট আর টিভি চ্যানেলের ভিডিও শ্যুটের পাশাপাশি নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে ভ্লগও চলছে । পডকাস্ট হল রেডিওর মত। কানে শুনতে হয়। ভ্লগে থাকে কথা আর ছবির ভিডিও। রাণীয়া তার ভ্লগের নাম দিয়েছে পেন্ডুলাম। ব্লগে থাকে নানান কথা লেখা। ব্লগের নাম “রাণীয়ার রান্নাঘর”। বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে হবে যে। মিঠি কে দেখাতে হবে। প্রমাণ করতেই হবে। শুধু শাশুড়ি মা নয় রাণীয়ার নিজের দিদির প্রতি এক প্রচ্ছন্ন অভিমানের জায়গা। কেউ যেন নেপথ্যে কেবলই উসকে দেয় রানিয়া কে… কাম অন! ফাইট রাণীয়া ফাইট… জিততে তোমাকে হবেই।
ঘড়ির অনুষঙ্গে পেন্ডুলাম নাম দিয়েছে সে। কারণ সে তার ভ্লগের মধ্যে দিয়ে একটা সময় কে ধরতে চায়। কাল বয়ে চলে স্রোতের মত। আর এই স্রোতের মধ্যে মুহূর্তেরা ছোট্ট ছোট্ট ঢেউয়ের রেখা টেনে চলে যায়। ঘড়ির পেন্ডুলামের দোলায় কাল বা সময়ের গায়ের এই ছোটো ছোটো আঁচড়গুলি মুহূর্ত হয়ে থেকে যায়। সময় কে ধরে বা বেঁধে রাখা যায়না কিন্তু স্মৃতির পরতে মুহূর্ত গুলিকে ধরে রাখে মানুষ।
রাণীয়া হতে চেয়েছে বেঙ্গলি ফুড ইভেঞ্জালিস্ট। বাংলার হারানো সব রান্নাবান্না হল বাংলার অন্যতম সংস্কৃতি। পৃথিবীর বাঙালিরা জানুক। আজকাল সবাই বাংলায় ভালো করে কথাও বলতে পারেনা।
পেন্ডুলাম ভ্লগ খুলতেই সেখানে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা হইহই করে বাড়তে থাকলো। ভ্লগ এর অর্থ হল ভিডিও ব্লগ। মানে ছবি আর লেখা দুইই থাকবে সেখানে। পডকাস্টে থাকে শুধুই অডিও। কেউ রাণীয়ার মুখ দেখতে পেত না । শুধু তার কথা শুনেই তৃপ্ত হত। ভ্লগে রাণীয়ার ছবি আর সেই সঙ্গে ওর মুখেই রান্নাবান্না আর বেড়ানোর গল্প শুনতে পেয়ে পেন্ডুলামের সাবস্ক্রাইবাররা যেন আহ্লাদে আটখানি। দেশ বিদেশের হাজার হাজার বাঙালী ওর ফ্যান হতে থাকলো। সেই যে কথায় বলে না? ব্লাড ইজ থিকার দ্যান ওয়াটার। সব বাঙালীরাই বুঝি মাতৃভাষার কদরটা বিদেশে গিয়ে বুঝতে পারে। টের পায় হাড়ে হাড়ে।
এরই মধ্যে মিঠি অবশ্য আড়ালে তাদের মা অনসূয়াকে বোনের ছবি দেখে মন্তব্য করতেও ছাড়েনি।
মা দেখেছো? তোমার ছোটো মেয়ে কেমন ক্লিভেজ দেখানো কুর্তি পরে ভিডিও শুট করে এখন? তুমি আমাকে পান থেকে চুন খস অলে বলো আর ছোটো মেয়েরবেলায় কোনো সাড়া করোনা। কারণ সে যে এনআরআই।
অনসূয়া বলেছিলেন, ধুর পাগলি! যেখানে যেমন সেখানে তেমন। তোর সেবার ইন্সটাগ্রামের ছবিটা আমার ভালো লাগেনি তাই বলেছিলাম।
রাণীয়া বলেছিল, দেখো মা, এখানে যেমন জামা পাওয়া যায় তেমনি পরে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম।
তোমার বড় মেয়েকে বলে দিও, আমার অন্য কোনও ইন্টেনশন ছিলনা এর পেছনে।
মিঠি আবার মায়ের মুখে সেসব শুনে জানিয়েছিল, এমন ড্রেস না পরলে ভিডিও তো কেউ দেখবেই না মা…শৈবাল বলেছিল আমাকে। টি আর পি বাড়াতে হবে না? ফ্যান ফলোয়ার কমে যাবে যে।
মা, তোমার বড় মেয়ে যেন সবজান্তা। রাণীয়ার চোখে জল এসে যায় মিঠির এমন সব কথা শুনলে। খুব মনখারাপ হয়ে যায় রাণীয়ার। ছোটো থেকেই মিঠির যেন বোনের সঙ্গে একটু হলেও ইগো প্রবলেম। মা লক্ষ্য করেন আজকাল। এমনটি তো চান নি তিনি কখনও। তবে কী আমেরিকা গিয়ে রাণীয়ার এত চটপট উন্নতির শিখরে পৌঁছে যাওয়াটা ঠিক মেনে নিতে পারছে না মিঠি? কিন্তু তাই বলে রাণীয়া দমে যাবার পাত্রী নয়। এগোতে হবেই তাকে।

তার দিদি মিঠি যে মা’কে সে একটু আধটু মন্ত্রণাও যে দিচ্ছে না তা নয়। মা মিঠির এসব কথাবার্তায় মোটেও আমল দেন না। মিঠি কে বেশ রাগতস্বরেই বলেন, কী সব বলছিস তুই! রাণীয়াকে সেসব জানান না তিনি। তবে ক্লিভেজ দেখে একটু অস্বস্তি হয়েছিল তাঁর। তাই… বুদ্ধিমান অনসূয়ার দুই মেয়েকে নিয়েই এক নৌকায় পা রেখে চলতে শিখতে হয় প্রতিনিয়ত। তিনি যে ওদের মা। মা’কে অনেক কিছু শিখতে হয়। তাঁর অবস্থা শ্যাম রাখি না কুল রাখি? দুই মেয়েই তাঁর প্রাণ। তাঁর এক ভুবন আকাশ। কিন্তু আজকাল তিনি প্রমাদ গোনেন। আলাদা জায়গায় থাকার সুবাদে, বিয়ের পরেই কী তবে এভাবে ধীরেধীরে বদলে যাচ্ছে দুই বোনের কেমিস্ট্রি? কখনও কখনও নিজের মানুষটির কাছে গিয়ে বলতে যান এসব টানাপোড়েনের গল্প। তপন বাবু হেসে উড়িয়ে দেন। মেয়েলি কথা, ছেঁদো গল্প এইসব বলে। কী যে বল অনু তুমি! আমার রাণীয়া আর মিঠি একই বৃন্তে দুটি ঘর আলো করা ফুল। মিঠি আমার রূপোলী গোলাপ। রাণীয়া আমার সোনালী গোলাপ। ঈশ্বর মাঝেমাঝে কখনও কখনও ভুল করে একই গাছে দুরঙের ফুল বানান গো। এসব তোমার মনের ভুল। বলে উড়িয়ে দেন আপাত কাঠখোট্টা মেটালারজিকাল এঞ্জিনিয়র ভদ্রলোক।


আরো পড়ুন: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-১৩) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


না গো। এসব তুমি বুঝবে না। আমি ওদের মা। মেয়েদের মনের কথা ঠিক বুঝতে পারি। আমার রাণীয়া এমন নয় । কোনোদিনও সে মিঠির নামে আমাকে কিছু অভিযোগ জানায় না। বরং সে যে তার দিদিকে প্রতি মুহূর্তে মিস করে তা বোঝা যায় ওঁর কথায়। অথচ মিঠির সবসময়ই আজকাল তার বোন কে নিয়ে যেন একটু বেশীই চিন্তাভাবনা। লক্ষ্য করেছি আমি। তার বোনের এত পপুল্যারিটি কী সে তবে মেনে নিতে পারছে না? সে হয়ত ব্যাঙ্গালোরে প্রচুর রোজগার করছে কিন্তু রাণীয়ার জনপ্রিয়তার এক আনা তার হয়নি । আমি যে দুজনকেই একই গর্ভে ধারণ করেছি । আমি না বুঝলে আর কে বুঝবে সে কথা? বত্রিশ নাড়ী ছেঁড়া আদরের ধন। সাধে কী বলে?

রাণীয়া রীতিমত আপ্লুত হল যেদিন আচমকা অপ্রত্যাশিত ইমেইল এসেছিল ইউটিউবের কাছ থেকে। ১০০০০ সাবস্ক্রাইবার ক্রস করছে রাণীয়ার ইউটিউব ভ্লগ “পেন্ডুলাম”। মনিটাইজড হয়েছে এদ্দিনে।
তার অ্যাকাউন্ট ডিটেইলস চেয়েছে। রেভিনিউ পাঠাবে তারা স্বেচ্ছায়। এহেন ইউটিউবারের নাকি রোজগার হবে ভ্লগ থেকে। আনন্দে মা আর দিদি কে ফোন করেই ফেলেছিল বেচারা রাণীয়া সেদিন। খুশিতে ডগমগ হয়ে। এভাবেও হয়? দিদা বলতেন জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা। সত্যিই তো। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে সে যেখানে ছাই দেখেছে তা যত্নে দু হাতে ভরে নিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে সুদূর দিগন্তে। সবটাই ঘরে বসে। আপন মনে মেলে দিয়েছে পাখা। এবং ফলও পেয়েছে হাতেনাতে।

রাণীয়া এখন মহাখুশি। এবার টুকটাক রোজগারপাতিও হতে শুরু করেছে যে তার। রাণীয়ার মত অনামার ভ্লগে বিজ্ঞাপন? মাঝেমধ্যে তাজ্জব বনে যায় সে। হোটেল থেকে রেস্তোরাঁ, শাড়ি থেকে গয়না, রান্নার সরঞ্জাম থেকে সংসারের টুকিটাকি। মানে মেয়েদের পছন্দের সব জিনিষ সেখানে দেখানো হয় । রান্নাবান্না এ যুগেও কী তবে মেয়েদের একবগগা বিষয়? সবাই খুশিতে বিজ্ঞাপন দেয় এখন পরিচিত ডিজিটাল মাধ্যমে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে সদস্য সংখ্যা। কমেন্ট আর লাইকের বন্যায় বানভাসি হয় তার ইউটিউব ভ্লগ চ্যানেল। মনের আনন্দে রোজ নির্দিষ্ট সময়ে সে একটু পড়াশুনো করে বাংলার হারানো রান্না নিয়ে অনর্গল বকবক করে। শুধু রান্না নয়। রেসিপি নয়। সেই বিশেষ রান্নার সঙ্গে জড়িত মজার গল্প, দুঃখের গল্প, বেড়ানোর গল্প বলে সে গল্পের ছলে। কোনোদিন দু লাইন গানও গেয়ে ওঠে রান্নার গল্প বলার ফাঁকে। কুশল বলেছে একই ভিডিও ইংরেজীতেও বলতে। কারণ জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠতে গেলে দুটি ভাষাতেই বলতে হবে তাকে। তাই কোনোদিন ইলিশ মাছের পাতুড়ি নিয়ে ইংরেজীতে বলতে গিয়ে দু’কলি লোক গান গেয়ে ওঠে তো কোনোদিন চিংড়িমাছের বাটিচ্চচড়ি নিয়ে বলতে গিয়ে রবিঠাকুরের সহজপাঠের চিংড়ি নিয়ে ছড়া বলে ওঠে।

এভাবেই একদিন শিউলিপাতার সুক্তো তো আরেকদিন পটলের দোলমায় রাণীয়ার রান্নাঘরে ভিডিও রেকর্ডিং শুরু হয়ে যায়। কুশল অফিস চলে গেলেই কাজ শুরু হয়। ভ্লগ, পডকাস্টের টেকনিকাল খুঁটিনাটি দেখে কুশল। তার ছুটির দিনে।

এদিকে স্বেচ্ছায় একদিন রাণীয়ার নিজের চ্যানেলটির লোগো বানিয়ে দিয়েছে মিঠি। তাই দেখে শুনে অনসূয়া নিজের মনকে বুঝিয়েছেন, দুই মেয়ের মধ্যে কোনও ইগোর লড়াই নেই। ওরা ভালোই আছে। তিনিই ভুল ভেবেছেন। ঈশ্বর তাই যেন হয়। ওরা মিলেমিশে থাক। তাঁদের অবর্তমানে এওর সমব্যাথী হবে।
সেদিন মিঠির বোনের জন্য সযত্নে ভ্লগের লোগো বানানো দেখে রাণীয়া তো বলেই ফেলেছে মা’কে। এবার যা দেখতে পাচ্ছি তা হল তোমার বড় মেয়ে না চাকরী বাকরি ছেড়ে দিয়ে আমার সঙ্গে ভ্লগে মেতে ওঠে। বুঝলে মা?
মা বলেছিল, ভালোই তো। দুজনকে একসঙ্গে দেখতে পাবো রোজ। তার জন্য তো তোর দিদিকে আর ইউএসএ ছুটতে হবে না। ভিডিও তুলে তোকে পাঠিয়ে দিলেই তো হল।
মায়ের মনে ভয় হয়। আদরের ছোটো মেয়েটা বিদেশ চলে যাওয়ায় তিনি খুব একা হয়ে গেছেন। ভাগ্যিস বড় মেয়ে জামাই দেশে আছে। ইচ্ছে হলেই ছুটে আসতে পারে মা, বাবার কাছে অথবা তাঁরা চলে যান মেয়ে জামাইয়ের কাছে বছরে দু এক বার। আসলে ছোটো মেয়েটা যে ছোটো থেকেই মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরত।
– ও মা, রান্নাঘরে তুমি কী বানাচ্ছো? এটায় কী মশলা দিলে? ওটা কী তেল এ রাঁধলে? অথবা আজ আলুগুলো এমন কাটলে কেন? লাউয়ের খোসাগুলো তুলে রাখলে কেন? এমন সব প্রশ্নবাণে মেয়ে জর্জরিত করত ।
রানীয়ার মা’ও খুশি মনে উত্তর দিতেন মেয়েকে। বড় মেয়ের এসবে কোনোদিন ইন্টারেস্ট নেই তাই ছোটোটা প্রশ্ন করলেই তাকে যেমন করে হোক ভালোমত একটা উত্তর খাড়া করে দিতেন ঠিক।
কোনোদিন ছোটোমেয়েটাকেই বলতেন, যা দিকিনি ছুটে। বাগান থেকে ক’ টা কচি দেখে শিউলি পাতা তুলে নিয়ে আয় দেখি।
– কী করবে মা তুমি?
-দেখ না কী করি!
রাণীয়া জানে মায়ের কাছে রান্নাবাটি হল বাঁ হাতের খেল।
শিউলি পাতা ছিঁড়ে এনেই সে দেখে মা এক মনে বেসন ফেটাচ্ছে।
– কী হবে মা এটা দিয়ে?
শিউলি পাতা ধুয়ে মুছে মা যখন বেসন, চালের গুঁড়োর মিশ্রণে পোস্ত দানা আর কালোজিরে ছড়ায় তখনি মায়ের মেয়ে বুঝতে পারে রহস্য।
– মা তুমি ফ্রিটার বানাবে? শিউলি পাতা দিয়ে? তেতো হবেনা?
গোটা গোটা পাতা বেসনের গোলায় পড়ে ডুবো তেলে পাতার আলপনার আকার নেয় দেখে মেয়ে বলে,
– ঠিক ধরেছি আমি। ইটস জাস্ট লাইক বেগুনি।
অমনি মা বলেছিলেন সেবার,
– এটার নাম শিউলিপাতার কাটলেট। বুঝলি?
– কাটলেট? সে তো বিদেশী নাম।
– ওই তো কাট অ্যান্ড লেটস ফ্রাই। সেটাই তো ইউনিকনেস অফ মাই রেসিপি। শিউলিপাতার বড়া তো সবাই বলে আমি নাম দিলাম কাটলেট। বুঝলি?
মায়ের এসব কথা মনে পড়লেই চোখে জল আসে। গরম ফুরফুরে ভাতের মধ্যে একফোঁটা ঘি ফেলে শিউলিপাতার কুড়কুড়ে কাটলেট মেখে রাণীয়ার মুখে পুরে দিতেই মেয়ের মুখের সেদিনের সেই “উঊঊম” তাঁর কানে আজও বাজে। বেচারা! সেদেশে শিউলি পাতা পায়না। পলতা পায়না। বক ফুল, কুমড়োফুল, সজনেফুল কিছুই মেলেনা । বছরে এক আধবার এসব না খেলে শরীর ঠিক থাকবে?

আজ কয়েকবছর হাপিত্যেশ করে বসে থাকেন তিনি। মেয়ে আর আসেনা। সবাই ব্যস্ত তাদের কেরিয়ার নিয়ে। দেশে আসতে বললেই রাণীয়া আর কুশল বলে, তোমরা এসে থেকে যাও তো কয়েকটা মাস। কুশল এখন গেলেই নাকি ভিসার চক্করে আটকে গিয়ে আর ফিরতে পারবে না এদেশে। এসব নিয়ে মা দোলাচলে। মেয়ে টানাপোড়েনে। কিন্তু কিছুই করার নেই। যেখানেই থাকুক ওরা ভালো থাক, সেটাই একমাত্র কাম্য অনসূয়ার।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত