| 6 মে 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: রাণীয়ার রান্নাঘর (শেষ পর্ব) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 31 মিনিট

 X+1 সিন্ড্রোম   

এদিকে অতিমারীর করালগ্রাসে অনলাইন কাজ চলতে থাকে বাংলার খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে ফুড ইভেঞ্জালিস্ট রাণীয়ার কাজ এগোয় খুব দ্রুতগতিতে । মানে সুপারফাস্ট ট্রেনের মত। সারা বিশ্ব তথা দেশের ঘরবন্দী মানুষজন সারা দুনিয়ায় বেশী হজম করছে ডিজিটালের মাধ্যমের অডিও, ভিডিও। চ্যানেলের আদেশে কাস্টমাইজ করে সাজাতে হয় তাকে প্রতিটি এপিসোড। চ্যানেলের টি আর পি কিসে বাড়ে খেয়াল রাখতে হয়। হঠাত কর্মকর্তারা বললেন বাংলার হারানো সব রান্নায় রাণীয়ার সঙ্গে একজন নিউট্রিশানিস্ট থাকবেন। প্রতিটি এপিসোডে রাণীয়ার সেই বিশেষ পদটির খাদ্যগুণ, পুষ্টি ইত্যাদি নিয়ে তিনি আলোকপাত করবেন। 

পুষ্টি বিশারদের কথায় প্রথমেই রাণীয়ার মনে পড়ে যায় জামশেদপুরের বন্ধু নেহার কথা। বাঙালি মেয়েটা ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশনে পিএইচডি করে কলকাতার এক সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতালে অ্যাটাচড। কলকাতার টিভি চ্যানেলের সব কুকারি শোতেই নেহা এখন পরিচিত মুখ । সঙ্গে সঙ্গে নেহা কে ফোন রাণীয়ার। যোগাযোগ ছিলই হোয়াটস্যাপে সুতরাং গৌরচন্দ্রিকার প্রয়োজন হয়না। 

“শোন্ , আমি তোকে পাঠাবো টেক্সট। সেটার ওপর তুই বলবি। অডিও ফাইল। সঙ্গে তোর ছবি, ডেজিগনেশন।” আগে একাধবার নেহা ইনপুট দিয়েছে খাদ্যের গুণাগুণ নিয়ে। এবারে প্রোফেশানালি আর সিরিয়াসলি লেগে পড়ল বন্ধুর সঙ্গে। 

এভাবেই এগুতে থাকে রাণীয়ার ফুড ইভেঞ্জালিস্টের কাজ। ইন্ডিয়ায় ঋতুপরিবর্তনের কালে পলতার বড়া থেকে শিউলিপাতা, নিমবেগুণ থেকে সজনেফুলের চচ্চড়ি দৌড়তে থাকে হইহই করে। নেহাও নিজের ছোট্ট বাচ্চা, সংসার আর হসপিটাল সামলে রাতে বসে বইপত্র ঘাটাঘাটি করে। কাঁচাআমের অম্বল থেকে তিলবাটার বড়া অথবা সজনে ডাঁটার গুণাগুণ থেকে কলমি শাকের মাহাত্ম্য আবিষ্কার করতে বসে। মেয়েরা কেন চল্লিশ পেরুলে রোজ ড্রাই রোস্টেড তিল খাবে অথবা রোজ খালিপেটে কেন রসুন কামড়াবে এসব নিয়ে বলে। ক্যালসিয়াম বড়ি খাওয়ার থেকে রোজ ড্রাই রোস্ট করা তিল নাকি বেশী উপকারী অথবা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রসুনে নাকি যৌবন ধরে রাখা যায় অনেকদিন অবধি। আবার ভিটামিন সি ট্যাবলেট না খেয়ে কাঁচা আম কিম্বা আমলকী যতদিন মেলে ততদিন রোজ খেলে সর্দিকাশির ঝামেলা থাকবে না কিম্বা আয়রন সাপ্লিমেন্টের থেকে কাঁচকলা, থোড় বা মোচা, ডুমুর এসব খেলে অ্যানিমিয়া বশে থাকে এমন সব টিপস দিতে থাকে চ্যানেলের জন্য। নেহার কাছেও কতকিছু শিখে ফেলে রাণীয়া। নেহা বলে তাকে…

ডায়বেটিক ডায়েট মাথায় রাখিস। তেমন সব রেসিপি নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের।  ডায়বেটিক রিভার্সাল নিয়ে কাজ করতে হবে । ডায়বেটিস ধরা পড়লে আজকাল ডাক্তারা নাকি চট করে ওষুধ দিচ্ছেন না। লাইফস্টাইল মডিফিকেশন আর ফুড হ্যাবিটের ওপর জোর দিচ্ছেন। 

গুড আইডিয়া দিলি। রাণীয়া বলে। এইজন্য শিক্ষিত বন্ধু বড় প্রয়োজন তার। 

আর শোন্, ক্যান্সার এখন হট টপিক । ক্যান্সার এখন ঘরে ঘরে। অ্যাওয়ারনেসের জন্য প্লাস্টিক কন্টেইনারে ফুড আইটেম রাখা আর সেইসঙ্গে রোজ খাবারে কারিপাতা রাখার কথা মানুষ কে জানাতে হবে আমাদের। নেহা বলে। 

রাণীয়া বলে কিন্তু কারিপাতা বাঙালি রান্নায় তো ছিলনা কস্মিনকালে। 

নেহা বলে ইনোভেটিভ আইডিয়া আনতে হবে । নতুনত্ব হবে। 

রাণীয়ারা জামশেদপুরে থাকতে কারিপাতার ব্যাপক ব্যাবহার শিখেছিল কিন্তু কলকাতার বাঙালি ইডলি দোসার সঙ্গত ছাড়া কিম্বা দক্ষিণী রান্না ছাড়া কারিপাতার ব্যাবহার জানেই না। 

মা’কে অমনি ফোন। 

মা জানায়, হ্যাঁ। মনে নেই তোর? সেই আমি যে কারিপাতার পকোড়া বানাতাম? 

মানে ইন্সটেড অফ ধনে পাতা? 

হ্যাঁ। বাকীটা এক। কিম্বা আরও দুটো আছে মুসুর ডালে কারিপাতা ফোড়ন আর কারিপাতা দিয়ে নিরামিষ সাদা আলুর দম?  মা জানায় সঙ্গে সঙ্গে। 

রাণীয়া উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে আমার মা সিম্পলি রকস্! আমার মা সব জানে। আলুর দম মানে যেটা তুমি চীনেবাদাম গুঁড়ো আর নারকোল দিয়ে করতে? 

মা আজকালকার ছেলেপুলেদের টোনেই বলেন, ইয়েস! 

প্যান্ডেমিকের যুগে সারা বিশ্বের বাঙালিও নড়েচড়ে বসেছে। কেমন খাবার খেলে বডি ইমিউনিটি বাড়বে, রোজকার খাবারের মধ্যে দিয়ে নিউট্রিশন কোশেন্ট ঠিকঠাক থাকবে এসব নিয়েও সেই ডিজিটাল চ্যানেলের ভাবনাচিন্তা করতে হয়। রাণীয়ার বাংলার রান্না নিয়ে ভিডিওর শেষে থাকে নেহার ছোট্ট বাইট। “শরীরের দেখভাল” নিয়ে দু’ মিনিটের এপিসোড । নেহার আগমনে রাণীয়ার এই প্রোগ্রাম দিন দিন হিট হতে থাকে। বাড়তেই থাকে সাবস্ক্রাইবার। একটা ভিডিওর প্রচুর শেয়ার হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় । রাণীয়া এখন ডিজিটাল মিডিয়ার সেলেব। ফুড কালচার নিয়ে যার নিত্য কর্মকাণ্ড চলতেই থাকে আমেরিকার ডালাস শহরের ক্লিফব্রুক কন্ডোমিনিয়ামে। সারা সপ্তাহের ভিডিও জমা করেই উইকেন্ডে কুশল কে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দুজনে। অবশ্যই কোভিডের সময়ে ফাঁকা জায়গায়। পাণ্ডববর্জিত জঙ্গলে কিম্বা জলাশয়ের ধারে।  

রাণীয়া ফিরছিল কুশলের সঙ্গে। নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি সব ঘুরে বেড়িয়ে। 

প্লেনের একফালি বিকিনি জানলায় চোখ রেখে রাতে ফিরতে ফিরতে গাইছিল আবারো তার সেই প্রিয় গান। একলার ঘরে ফেরার গান ।  এঘর ওদের স্থায়ী আস্তানা নয়। ঘরবাড়ি সব তো আছে দেশে। মন কেঁদে ওঠে সেই দেশটার জন্যে। তাই ঘরে ফেরা মানে ডালাস ফেরা। স্বদেশে ফেরা এখন দূর অস্ত। গান গাইতে গেলেই গলার কাছে উঠে আসে দলা পাকানো শ্লেষ্মা।  

“আমায় বোলো না, গাহিতে বোলো না…” 

রবিপুজো বোধ হয় সেদিনই, তাই ঠাকুর তোমাকেই মনে পড়ছে কেবল্। আমার সকল জ্বালা জুড়োনোর তুমি, “আমার ব্যথা যখন আনে আমায় তোমার দ্বারে…” 

ঠিক তখুনি তুমি সেই জ্বালা জুড়িয়ে দাও ঠাকুর আর তাই তো ঘরে ফেরার গান গাই। রাণীয়া মুঠোফোনের ক্যালেন্ডারে দেখে নেয় । ঠিক ধরেছে। সেদিনই রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন হচ্ছে তার দেশের কোণায় কোণায় । মে মাসের শুরুতেই তো। 

ঘোর দুর্যোগ সেদিন। আকাশের মুখ ভার। বৃষ্টি, বৃষ্টি, বৃষ্টি। নিউইয়র্ক কে বিদায় দিতে ভেতর ভেতর কান্নায় চোখ বুজে এল। কুশল, আমরা সত্যি সত্যি বাড়ি যাব কবে? একবার চলো ঘুরে আসি এবার। 

কুশল কথা ঘোরায়। 

আবারও মিস করব বাংলাদেশী দোকানের পিতজা। কী বল? 

কথা নেই রাণীয়ার মুখে। মন খুব খারাপ তার। 

খিদে পেয়েছে তোর? কুশল জিগেস করে। 

রাণীয়া বলে, এই তো খেলাম। 

এয়ারপোর্টে কফি, ক্রোস্যান্ট আর মাফিনে পেট ভরিয়েছে ওরা।

সেদিন আকাশও টের পেয়েছে বুঝি রাণীয়ার মনখারাপের। 

বিমানে এক সহযাত্রী অশীতিপর আমেরিকান মহিলা। হুইল চেয়ারে গগনপরী তাঁকে ওর পাশে বসিয়ে দিয়ে গেল। বহুদিন পর মেয়ের সংসারে যাচ্ছেন তিনি। নাতি-নাতনী-মেয়ে-জামাই কে দেখবেন বলে খুশীতে ডগমগ। কথার ভটচায্যি! রাণীয়ার ডিপ্রেশনের খেঁই হারায়। 

ওর হাতের আংটিগুলি বেশ! ওর সালোয়ারের প্রিন্টটি সুন্দর। এসব করতে করতে রাণীয়ার  মনখারাপ ভুলিয়ে দিলেন তিনি। 

রাণীয়ার মন তখন লিখে চলেছিল নিম্নচাপের ডায়েরী।মুঠোফোনের নোটপ্যাডে।  

সবাই বাড়ি যায়। শুধু ওরাই যেতে পারে না। মা, বাবাও আসতে পারেনা এদেশে। 

আবার সেই রাস্তা পেরিয়ে পাড়ার গ্রসারী স্টোরে গিয়ে টুকটাক কেনাকাটি করতে হবে তাকে । কফির পেপার কাপ হাতে অথবা পিত্জার বাক্স হাতে, আইসক্রীমের শঙ্কু হাতে লাস্যময়ী ছাত্রী অথবা গম্ভীর দেশী তনয়ার পথ চলা দেখবে সে। দেঁতো হাসি বিনিময় করবে তাদের সঙ্গে। মিশে যাবে শপিং মলের ভীড়ে। 

কচি মেপল পাতায় পড়ন্ত রোদ, তবুও নরম হবে সেখানে। পাতার রং ফ্লোরেসেন্ট ভর ভরন্ত সারি সারি ওক গাছ। ফুটপাথের ধারে লাইলাক ফুটতে শুরু করবে । কিছু বসন্তের লিলিও ফুটবে এলোমেলো, খামখেয়ালীপনায়। চেরী ব্লসম যাবে অস্তাচলে। গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত হালকা গোলাপী প্রজাপতির মত শয্যা নেবে তারা। রকমারী পাখীর ডাক কানে আসবে নিরিবিলিতে। হাওয়ায় শেষ শীতের সূক্ষ্ম ধার তখন । ভাবতে ভাবতে তার চিন্তার সুতোর পরত ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার হয়ে যায়। প্রতি মূহুর্তে এ দেশ কে নিজের দেশের সঙ্গে তুলনা করে ফেলে সে । কতদিন বাড়ি ফেরেনি ওরা! 

হঠাত মনে পড়ে যায় দেশের আত্মীয়দের কথা। ওদের দুজনের বাবা, মা, ঠাকুমা, দিদিমা সবাই বেঁচে এখনও। এই মানুষগুলোর আবার কখনো রোজ রোজ সুগারের ওষুধ খেতে খেতে হাইপো গ্লাইসিমিক শক হয়ে যায় । কিছুদিন আগেই খবর পেয়েছে রাণীয়া। তার মাসীর হয়েছিল। নিঃসাড়ে চিনির কৌটো হাতড়ে মুখ ভর্তি চিনি খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে চুপিচুপি রক্ষে পেলেন সে যাত্রায়। তাঁর ছেলেমেয়েরাও সবাই আজ চাকরীসূত্রে ইউরোপে। সেদিন কিছু পরে মাসী নিজের চেষ্টায় স্বাভাবিক হয়েছিলেন। রাণীয়ার ঠাকুমাই তো প্রায়দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার বাঁ পা’ টা ফুলে গেছে। বাড়ির লোকে ভাবে আর বেশী দিন নেই তিনি। এই বুঝি লেফট ভেন্ট্রিকুলার ফেলিওর হবে। আগেভাগেই ডাক্তার বলে রেখেছেন। ঠাকুমা ভাবেন বাঁচা গেল বাবা। মরে যাব শিগগিরিই। কিন্তু সেদিনটা আর আসেনা। 

ওরা বারবার এক কথা বলে যায় অনর্গল । স্মৃতির চোরাকুঠরির নুড়িপাথর গুলো নিয়ে খেলতে চায় ওদের মন। কিন্তু শুনতে চায়না কেউ ওদের কথা।একটু আধটু স্মৃতিও বঞ্চনা করছে আজকাল। কাজের লোকেরা ওদের কথায় বিরক্তি প্রকাশ করে। অনসূয়া বলছিলেন। তবে ভিডিও কলে আদরের নাতনি কে ঠিক চিনতে পারেন।  ঠাকুমার সেই এক কথা, কবে আবার আসবি তোরা? এবার এলে আর হয়ত আমার সঙ্গে দেখা হবে না তোদের। দিদিমাও ঠিক একই সুরে কথা বলেন। সেই দিদিমা, যার রান্নার হাত এত ভালো ছিল। সবাই যার রান্নায় প্রশংসায় পঞ্চমুখ হত। এখনও দিদার স্মৃতিটা ভাগ্যিস ঠিকঠাক আছে । রাণীয়ার অনেক কাজে লাগে দিদা কে। অনসূয়ার মতোই অনেক তথ্য দিয়ে উপকার করেন তিনি । 

এইভাবেই এই মানুষগুলো বেঁচে থাকে দিনের পর দিন দেশের অলিগলিতে, উঁচু ফ্ল্যাটের একচিলতে ব্যালকনির আরামকেদারাতে, বিশাল বাড়ির বারান্দায় রোদের ওম নিতে নিতে, কুঁচকে যাওয়া চামড়ার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকেন। বস্তাপচা টেলিভিশন সিরিয়ালও অমৃতসমান তাঁদের কাছে। কেউ স্মৃতির ঘাটতি নিয়ে, কেউ অধরা রাতঘুম নিয়ে কিম্বা কেউ পঙ্গু জীবনখানা নিয়ে দিনের পর দিন পড়েই থাকেন। কিন্তু আশীর্বাদ আর আদরের ঝোলাঝুলি ঝেড়ে সবসময় এখনো মাথায় হাত রাখেন ওরা তাই রক্ষে। ছবিতেই চিবুক ছুঁয়ে ফেলেন অভ্যাসবশত। 

রাণীয়া আর কুশলের মত বিদেশে শুধু পড়ে রইল কত সিনিয়ার সিটিজেনদের উত্তরসূরিরা। আর সেই জেরিয়াট্রিক মানুষগুলো বড় একা হয়ে গেল দিন দিন।পড়ে রইল দেশের সব মহানগরীতে।  রাণীয়া এঁদের ভোলে কী করে? এদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছে যে সে। রান্নাবান্নার তাকবাক থেকে ঘর গেরস্থালির টুকটাক। ওদের পুরনো কথাবার্তার আলপচারিতার মধ্যে দিয়েই তার গ্রুমিং। বয়সের ভারে কুব্জ ও স্মৃতির টানাপোড়েনে ন্যুব্জ এই মানুষগুলোর জন্যে সে মনে মনে বড় ব্যথা পায়। এদের কত দাপট ছিল একসময়! এরা কত সুন্দর করে শাড়ি-গয়না পরতেন্! কিম্বা কেউ নিজে গাড়ি চালিয়ে অফিস যেতেন অথবা পার্টিতে গিয়ে এক আধ পেগ ভদকা বা জিনও খেতেন ! বাড়িতে পার্টি থ্রো করতেন এরাও। টেবিল সাজিয়ে লোকজন কে অভ্যর্থনাতেও খামতি থাকত না। ক্লাবেও যেতেন স্মার্টলি। 

কিন্তু এখন? বিধাতা কানে শুনতে পাননা এদের ডাক। 

দিদা প্লিজ অমন বোলোনা। এবার গেলে দেখা ঠিক হবেই আমাদের। রাণীয়া বলেই ভাবে, সত্যিই কী দেখা হবে আর? 

উচ্চশিক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে ছেলেপুলেরা সব বিদেশের মোহে এখন। কিন্তু হায়রে পোড়া দেশ! কি রইলো তার? এত লোক! একটু হয়ত হল শিল্প, আধটু হয়ত হল উন্নয়ন। আবার পিছিয়ে পড়ল কিছুদিন। মেধাবী ছাত্রগুলো পাড়ি দিল অন্যরাজ্যে, বিদেশে। পড়ে রইল শুধু জং ধরা, তামাটে হয়ে যাওয়া রং চটা, চামড়া কুঁচকে যাওয়া সেই বুড়িবুড়িগুলো। তাই তো রাণীয়ার দেশ আজ জেরিয়াট্রিক এক বৃদ্ধাবাস! 

কেই বা শুনবে সেই ঘুণ ধরা শরীরের হাজারো একটা সমস্যার কথা ।  

সময়ের খেয়া বয়ে এদের পার করে দেয় জীবনের শেষপ্রান্তে। ধুঁকতে থাকে মানুষগুলো। স্মৃতি হাতড়ে মরে  তখনো। ” কি ক্ষমতা ছিল আমার জানিস?  কত বড় চাকরী করেছি আমি! দিদা তো বলেন এখনও। “জানিস? একা হাতে চল্লিশজনের রান্না করেছি একসময়!”

রাণীয়ার বাবা বলে “সাঁতরে ক্লাবের স্যুইমিং পুল বারেবারে এপার-ওপার করে মেডেল পেয়েছিলাম”.. ইত্যাদি ইত্যাদি। সে তো এখন ইতিহাস রাণীয়া ভাবে। 

রাণীয়ার খুব মনে পড়ে তার প্রিয় শহর জামশেদপুরে কাটানো ছোটবেলার কথা। অনাবিল শান্তি ছিল জামশেদপুরের পথহাঁটায়। না, না কলকাতার সঙ্গে তুলনা কেন করবে সে ? তবে এদেশে এসে মনে হয়েছে বটে, গডস ওন কান্ট্রি। তাই কী কেউ একবার এদেশে আসার সুযোগ পেলে আর দেশে ফিরতে চায়না? ভাবতে ভয় করে রাণীয়ার।কিন্তু আমরা ফিরবই। যেমন করেই হোক।   আমরা সব্বার থেকে আলাদা হব। মনে মনে বলে ওঠে সে। কুশল কে বলে, অনেক তো হল, এবার নিজের দেশকে কিছু দেবেনা? সেই যে বিয়ের পরে বলতে তুমি? কুশল চুপ করে থাকে। সে উত্তর তার জানা নেই। 

এ দেশ তো নতুন দেশ । আমার পুরনো দেশের কত নদী, কত পাহাড়, ভীষণ সুন্দর সব ঐতিহাসিক স্থাপত্য তার নিজস্ব সম্পদ।  তার নিলয় অলিন্দে কত কাহিনীর টানাপোড়েন। আমাদের কথা ছিল নিজের দেশে কতকিছু দেখা হয়নি এখনো। আমরা দেশে ফিরব না কুশল? 

কুশল বলে, জানিস তো সব। আরেকটা কথা… গ্রাস লুকস গ্রিনার। ফিরে গিয়ে আঙুল কামড়াবি না তো? 

আগে তো ফিরি তারপর… বলেই রাণীয়া মন কে বোঝায়। হয়ত ঠিক ফিরবে তারা একদিন। 

ফিরতে পারেনা বলেই তো সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে বাংলাদেশী দোকানের দিকে কেবলই ছুটে যায় রাণীয়া ।

মাচার পটলের জন্য দুঃখ হয় তার। লাউশাকের জন্য প্রাণ কেঁদে ওঠে। কী অপূর্ব একটা সাদা ঝোল বানাতো ওর দিদা। শৈবাল ফুচকার প্যাকেট, সিঙ্গারা নিয়ে আসে গুজরাটি দোকান থেকে। বৌয়ের মনখারাপ সারাই করতে। তর্ক শুরু হয়ে যায় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। ননবেঙ্গলিদের সামোসা আর বাঙালিদের সিঙ্গারা নিয়ে। 

মাইক্রোওয়েভ আভেনে গরম বসিয়েই আগজ্বলন্ত সেই সিঙ্গারা মুখে পুরে কুশল গাইতে শুরু করে ছোটবেলায় পড়া নার্সারি রাইমস।একবার মঞ্চের ওপর ছোটো ছোটো বাচ্চাদের সিঙ্গারা সাজিয়ে গান গাওয়ানো হয়েছিল তার ইশকুলে।  

সিঙ্গারা রে সিঙ্গারা তোর যে দেখি শিং খাড়া 

গা টা বেজায় খসখসে হাঁটু মুড়ে ওঠ বসে 

ফাটিয়ে দিলে তোর ভুঁড়ি নোলায় লাগে সুড়সুড়ি 

পেটের ভেতর এককাঁড়ি, আলু আর খোসা তরকারি! 

রাণীয়া সিঙ্গারা ভেঙে পুরের রঙ কালো দেখেই বলে। এটা আমাদের সিঙ্গারা নয় বুঝলি? চাড্ডি ধনে, জিরে, আমচুর আর গোলমরিচের গুঁড়ো দেওয়া, চটকানো আলুর কালো কালো পুর। চাড্ডিদের সামোসা। বাঙালি সিঙ্গারায় আলু ছোট্ট ছোট্ট কাটে, খোসা সমেত আর একটু মিষ্টি দেয়। ঘি, গরমমশলা দেয়। আমার মা বানাতো প্রতিবছর শীতকালে ফুলকপি আর কড়াইশুঁটি উঠলেই। চীনেবাদামও দিত। আমাদের সিঙ্গারার পুরে হলুদ দেওয়া থাকে।  

কিন্তু তোর সামোসায় সমস্যা টা কোথায় বলবি? এমন চটজলদি স্ন্যাক্স পাচ্ছিস, খেয়ে ফেল। কুশল বলে  

রাণীয়া বলে, শোন, বাঙালিদের সিঙ্গারা আর অবাঙালিদের সামোসায় বিস্তর ফারাক।  

সে যাই হোক সামোসা বা সিঙ্গারা ভালোবাসেনা এমন লোক বিরল। আর তুই এটাও জেনে রাখ। এই সিঙ্গারা আসলে কোনও বাঙালি ‘খাবার’ নয়! 

মুখে আধখানা সামোসা পুরে ন্যাপকিনে হাত মুছেই ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে রাণীয়া। তারপর বিস্তর গবেষণা করে তার মুখে কুলুপ। মন দিয়ে তার সিঙ্গারা খাওয়া দেখে কুশল বলে, কী রে কী দেখলি আর অ্যান্ড ডি করে? 

রাণীয়া বলে, হ্যাঁ রে। আমি জানতাম না। গবেষকদের মতে, ফার্সি শব্দ ‘সংবোসাগ’ থেকে এই সিঙ্গারা শব্দের আমদানি। তারা মনে করেন, এই ‘সংবোসাগ’ গজনবী সাম্রাজ্যে সম্রাটের দরবারে পরিবেশিত এক নোনতা মুচমুচে স্ন্যাক্স। এর মধ্যে কিমা, ড্রাই ফ্রুটসের পুর থাকত। আমরা আলু ভরে ‘সংবোসাগ’ এর সস্তা একটি অপভ্রংশ বানিয়েছি। 

তাহলেই বোঝ। 

রাণীয়ার আর অ্যান্ড ডি তখনও অব্যাহত। 

পারস্যের কবি ইসহাক আল-মাওসিলির নবম শতাব্দীর একটি কবিতায় সমোসার প্রশংসা স্তুতি পাওয়া যায়। 

ষোড়শ শতাব্দীর মুঘল আমলে লেখা ‘আইন-ই-আকবরি’তে ‘কুতাব’ নামে একটি  পদ রান্নার উপায়ের কথা লেখা আছে। সেখানে বলা হয়েছে, হিন্দুস্তানের লোক এই খাবারটিকে ‘সাম্বুসা’ বলে এবং দিল্লীর মোঘল সম্রাটদের দরবারে যে সিঙ্গারা সার্ভড হত তা ঘিয়ে ভাজা হত অর তার মধ্যে মশলা মাখানো মাংস আর পেঁয়াজের পুর থাকত। 

বিখ্যাত ইরানি ইতিহাসবিদ আবুল ফজল বায়হাকির দাবি, সিঙ্গারার আদি জন্মস্থান ইরান। আবুল ফজল বায়হাকির ‘তারিখ-এ-বেহাগি’ বইয়েও ‘সাম্বোসা’র কথা। এই সাম্বোসা নাকি আমাদের দেশে প্রথম আসে ত্রয়োদশ কি চতুর্দশ শতাব্দীতে, ইরানি ব্যবসাদারদের হাত ধরে। সারাদিন পথ চলে সন্ধেবেলায় সেই ব্যাবসায়ীরা রাত কাটানোর জন্য কোনও সরাইখানায় থামত। সেই রাতের বেলাতেই, মাংসের পুর দেওয়া, কড়া করে ভাজা সিঙাড়া সাবধানে মুড়ে নিয়ে, ঘোড়ার পিঠে ঝুলিয়ে রাখত। পরের দিন তাদের পথের দ্বিপ্রাহরিক ভোজনটা হয়ে যেত এই বাসি সিঙাড়া দিয়ে।

এই দ্যাখ কুশল। ইবন বতুতার বর্ণনায় মহাম্মদ বিন তুঘলকের দরবারে একটি খাবারের বর্ণনায় রয়েছে  সামুশক বা সাম্বুসাক নামে এক মুখরোচক ছোট pie এর কথা। 

এবার কুশল এগিয়ে যায় কিচেনের দেওয়ালে ঝোলানো হোয়াইট বোর্ডের দিকে। মার্কার হাতে লিখেই ফেলে সে 

QED… 

সংবোসাগ > সাম্বুসাক > সাম্বোসা > সামোসা / সিঙ্গারা। 

রাণীয়া হাততালি দিয়ে বলে, আরও দেখ। 

আমির খসরুর রচনাতেও এর উল্লেখ। কিন্তু সিঙ্গারা উইথ নো আলু?  

কুশল বলে আলু দেবে কী করে তখন? আলু তো আসেনি আমাদের দেশে। 

সিক্সটিন্থ সেঞ্চুরিতে পর্তুগিজরা ভারতের মাটিতে পা রাখার পর ‘আলু’ যেই এল তখনই বুঝি সিঙ্গারার পুরেও আলু প্রবেশ করে। হামলোগ হামেশাই সস্তা কো পিছে… বুঝলি না? 

আমেরিকার মাটিতে সেই প্রথম গুজরাটি দোকানের সিঙ্গারা খেয়ে সে যাত্রায় নিজের পডকাস্টের আরও একটি এপিসোড রেডি করে ফেলেছিল রাণীয়া। সামোসা ভার্সেস সিঙ্গারা নিয়ে। সেটাই নেট লাভ হল তার। 

কুশল তবু তার লেগপুল করতে ছাড়েনা। বলে, কালো পুর ভরা অবাঙালী সামোসা খেয়ে লাভ হল বল। আমাদের ঐতিহাসিক ঝগড়ারও মাহাত্ম্য আছে, কী বল? 

আজকাল এইসব টক ঝাল স্ন্যাক্স খুব ভালো লাগছে রাণীয়ার মুখে। কুশল ভাবে, সুদিন এলো বুঝি। শাশুড়ি মা কে খবর টা দিতে হবে। খুশি হবেন তিনি। সেই পথ চেয়ে বসে আছেন সবাই। দিন কয়েক রাণীয়ার মর্নিং সিকনেস লক্ষ্য করছে সে। তারপর টক, ঝাল। 

রাণীয়া কী তবে মা হবে এবার? 

এক একদিন খুব ভোরবেলা উঠে পড়ে রাণীয়া। কিচেন ব্লাইন্ডস সরিয়ে দেখে তখনো রোদ ঝলমলে হয়নি রিচার্ডসনের আশপাশ। দূর থেকে ভেসে আসে কী কোন গীর্জার ঘন্টার শব্দ? খুব কাছেপিঠে কোনও চার্চ নেই । তবে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছুদূরে। ডালাসের বড় ফাঁকা জায়গা এটা। মনে পড়ে যায় ঘুম ভেঙে গেলে ভোরবেলায় তার দেশের মন্দিরের মঙ্গলারতি কিম্বা মসজিদের আজানের কথা। বিদেশের ধারালো হাওয়ার সঙ্গে মিশে যায় যেন পরিচিত কানের শাঁখ, ঘন্টার ধ্বনি। কুশল ঘুম থেকে উঠবে আরও পরে। কফিমেকারে সুগন্ধি ভোরের কফির উদ্বায়ী গন্ধে রোজ ঘুম ভাঙে তার। কোনদিন আইরিশ হেজেলনাটের গন্ধে। কোনদিন আবার ক্রিম ক্যারামেলের গন্ধে। ততক্ষণ রাণীয়া দুচোখে মেখে নেয় তার একলার ভোরের আলো । 

সন্ধে হলে পশ্চিমের বারান্দায় গিয়ে কফির কাপ হাতে বসে রাণীয়া। নাহ! খালি পেটে ক্যাফিন ঠিক নয় এখন। বিস্কিটে কামড় দিতেই গা গুলিয়ে ওঠে। জল বমি করে এসে শান্তি।  

তখনও সে কুশলের অপেক্ষায়। দূরে ট্রিনিটি নদীর কথা মনে পড়ে। কুশল আর সে গেছিল একদিন নদী দর্শনে। হেঁটেছিল অনেকটা নদীপথ ধরে। সেদেশেও নদীর জল কালো হয় সূর্য ডোবার পালায়।সেখানে বড় রাত হয়ে যায় সূর্যের ঘর গুছিয়ে পাটে যেতে। সেই নদী একফালি সংকীর্ণ নালার মত। রাণীয়ার দেশের নদীর ধারে কাছে তা আসেনা। কিন্তু তার আশপাশ, নদীর তীর এত সুন্দর! যেন চিত্রপট। এত পরিচ্ছন্নতা দেখে তখনি মায়া হয়েছিল  তার নিজের দেশের নদীর ঘাটগুলোর কথা ভেবে। সত্যিই 

পশ্চিমে নিঝুম সন্ধে নামে অনেক দেরী করে । দূরে ঝলমলে ডাউনটাউনে শহরের ঝকমকে আকাশরেখা। সুউচ্চ ডালাস ডোমের আলো ঝিকমিক করে ওঠে।  কত ব্যস্ততা সেখানে। কত বিকিকিনি। উইকেন্ডে নাইট ক্লাব, বার, স্পোর্টস পাব, রেস্তোরাঁ…এখানকার  মানুষেরা জীবনের প্রতিটি পল অনুপল চেটেপুটে উপভোগ করতে জানে। তাদের রঙিন জীবনে আরও রঙ ঢালতে থাকে কেবলই। সেই রঙ খেলা অফুরান। নিজের দেশের লোকগুলোর কথা ভেবে কষ্ট হয় রাণীয়ার। বড় তাড়াতাড়ি তাঁদের জীবনের শখ আহ্লাদ, আমোদ প্রমোদ যেন ফুরিয়ে তারা সবাই বুড়িয়ে যায়। কেন এমন হয়? কারণ টা কিছুটা ভৌগোলিক, কিছুটা মানসিক আর বাকীটা তাদের পূর্বসূরিদের লেগাসি। ভাবে রাণীয়া। 

একেক দিন ভোরে উঠে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খেতে আর ইচ্ছে করে না। বেশ কিছুদিন যাবত এমন এক হাল হয়েছে রাণীয়ার শরীরের। কুশল বলে, চল্, আজ নাহয় বাইরে গিয়েই ব্রেকফাস্ট সেরে নেব আমরা। মন যেদিন যেমন চায়। ভোরে উঠে কফির গন্ধেও আবার গা গুলিয়ে ওঠে রাণীয়ার। কুশল চেঞ্জ করে কফির ব্র্যান্ড। অথচ বাইরে গিয়ে সেই একই কফিতে চুমুক দিতে বেশ অন্যরকম লাগে যেন। মা বলেছে তাকে। এমনি হবে এখন। এর নাম মর্নিং নসিয়া। এমন গা গুলোনো জন্ম জন্ম ধরে আসুক, মা সেদিন হেসে গড়িয়ে পড়ে বলেছিল ভিডিও কলে।  

ওদের অ্যাপার্টমেন্ট  কমপ্লেক্স ক্লিফব্রুক কন্ডোমিনিয়ামের কাছেই হাঁটাপথের ম্যাকডোনাল্ডস সারাদিন ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার অবধি ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকে। একদিন আকালেই ঢুকে পড়ে ওরা টুক করে। 

একটা বড় কালো কফির মাগ, এগ ম্যাক মাফিন, চিকেন নাগেটস আর হ্যাশব্রাউন আলুর টিকিয়াতে কামড় দিতে দিতে রাণীয়া দেখতে পায় সামনেই আরেক সিটে উপবিষ্টা এক হোমলেস বৃদ্ধা। বয়স প্রচুর হয়েছে। নব্বই বা তার বেশীও হতে পারে। মন দিয়ে তিনি খুঁটে খুঁটে খাচ্ছেন সারাদিনের মত মহার্ঘ্য বার্গারটি। পিঠের ঝোলায় কাপড়চোপড়, মাটিতে রাখা ঢাউস পুঁটুলি, পলিথিনের জলের বোতল, স্লিপিং ব্যাগ। কেউ নেই তার এ বিশ্বে? অবাক হ‌য় রাণীয়া । খাটবার ক্ষমতা নেই। চাকরী পাবার এবিলিটি নেই। তাই বলে তার এ দেশ তাকে কাঁচকলা দেখিয়েছে? রাণীয়া ভাবে তার দেশেও এমন কত আছে।  মহিলাকে দেখিয়ে কুশল কে সে বলে, 

দেখ, আমাদের দেশে সংসার আছে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আছে। করোনাও খায়না এদের। এত ইমিউনিটি  রাস্তায় বসে থেকে। রেস্তোরাঁর চোঁয়া, পোড়া, কাঁচা, বাসি খাবার হজম করে। দিনের পর দিন। 

কুশল তার বার্গারে মাস্টারড আর কেচাপ দিতে দিতে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইসের  দিকে হাত বাড়ায় আর  বলে আবার বৃদ্ধাশ্রমও আছে। 

রাণীয়া বলে, 

এই বুড়ির কী তবে বৃদ্ধাশ্রমে থাকার মত পয়সাকড়িও নেই? রূপ তো এখনও অপর্যাপ্ত, মানে যাকে বলে ছপ্পড় ফুঁড়ে দিয়েছেন বিধাতা পুরুষ। তা ভাঙিয়ে হয়ত কিছু পয়সাকড়িও হয়েছিল একসময়। ঠসক দেখলেই বোঝা যায়। 

কুশল বলে এদেশের রীতি অনুযায়ী পোষাক, গয়না আর সোশ্যাল স্টেট্যাস মেটাতে মেটাতেই সব ফুরিয়েছে বুড়ি। তাই বুঝি আজ সে কপর্দক শূন্য। 

রাণীয়া বলে জমানো কিছু নেই? আই মিন ব্যাঙ্ক ব্যালান্স?  

কুশল বলে, এখানকার থিয়োরি হল চার্বাকের মত। বুঝলি? সব ধার করে। আজ তো খাই তারপর দেখা যাবে। হয়ত বা ছিল কিছু সেভিংস তাও ফুরিয়েছে। নবাবী করে। হয়ত সে ছিল বহুভর্তৃকা। কিম্বা সিঙ্গলমাদার। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হয়ত আত্মীয় বন্ধুরা। যে যার নিজের ধান্ধায়। বুড়ি আজ একা হয়ে গেছে। কেউ নেই তার। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে সব বেচেবুচে দিয়ে পথই তার আশ্রয়। 

বার্গারে কামড় দিতে দিতে রাণীয়া বলে কিন্তু কেউ দেখেনা? তারা কোথায় গেল? এত প্রাচুর্যে ভরা দেশে, এত সুযোগ!  কিন্তু তবুও আজ সে ডেস্টিট্যুটের দলে নাম লিখিয়েছে?

কুশল ভুলিয়ে রাখে রাণীয়া কে। তবু যদি সেই ফাঁকে একটু খেয়ে নেয় তার বৌ’ টা গল্পের ছলে। 

রাণীয়া বলে বেশ টেস্টি লাগছে আজ বার্গার টা। বুঝলি? 

– এখানে ঢোকার মুখে দেখলি না? কাচের দরজার পাশে? ওখানেই এককোণে পড়ে থাকে হয়ত। এখানে ফুটপাথ অথবা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের প্রবেশদ্বারের পাশে একটুকু রাত্রিবাসের জায়গা অনেক হোমলেসদের । সেটুকুনিও অনির্দ্দিষ্ট। আজ এখানে তো কাল সেখানে। যতক্ষণ না তার আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসছে চিরকালের মত। 

রাণীয়া দেখতে পায় নবতিপর বুড়ির মাথার গোলাপি টুপির মধ্যে থেকে উঁকি দেওয়া সোনালী চুলের লকস। বহুদিনের অযত্নে রুক্ষ থেকে তা রুক্ষতর। টুপির মধ্যে মাথার চুল হয়ত এদ্দিনে হয়ত কাকের বাসায় পরিণত। চাপা দেওয়া তাই। গঙ্গার ধারের জটিবুড়িদের মত। ঠাম্মা দেখিয়েছিল ছেলেবেলায় রাণীয়া কে। তবে তার দেশে সবাই খুল্লামখুল্লা। লজ্জা পায়না কেউ দারিদ্র্য দেখাতে। বা হাত পেতে ভিক্ষে চাইতে। 

আর এদেশে সব চাপাচুপি দিয়ে রাখে টুপির আড়ালে। টুপির লেস আর পালক অযত্নে মলিন। পায়ের সস্তার স্নিকার্সটিও বেশ নোংরা। দুহাতে তবুও সস্তার টকটকে লাল নখরঞ্জনী, কোঁচকানো চামড়ার মধ্যে দিয়ে যেন খিঁচিয়ে বেরিয়ে আসে। টকটকে লাল রঙা ঠোঁটের লিপস্টিকেও সেই একই কারুণ্য । মুখের অজস্র বলিরেখার মধ্যে দিয়ে ঠোঁট ফাঁক হয়ে বেরিয়ে পড়ে বহুদিনের অযত্নের হলদে ছোপ ধরা দাঁত ।  অনিচ্ছের হাসিও উঁকি দেয় মেমসাহেবের চোখে চোখ পড়তেই। সৌজন্যবোধে খামতি নেই এদেশের মানুষের। রঙ বটে বুড়ির! কথায় বলে সর্ব দোষ হরে গোরা। মোটেও নয়। আমাদের দেশের কালো কালো বুড়িরাও এত নোংরা হয়না রাণীয়া ভাবে। 

মন ভারী হয়ে যায় তার। মনে পড়ে যায় দেশের বুড়োবুড়িদের কথা। দিদা, ঠাম্মার কথা। 

মনে মনে রাণীয়া বলে ওঠে।  

আমার দেশেও এমন কত বুড়ি আছে! চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়! দীর্ঘশ্বাস ফেলে  উঠে পড়ে সে। 

ব্রেকফাস্টের পরে কুশল অফিসে চলে যায়। সে নিশ্চিন্ত সেদিনের মত রাণীয়ার অ্যাপেটাইট নিয়ে। 

রাণীয়া তার একলা মহলে ফিরে আসে।  সেদিনের সেই বুড়ির ভাবনা মাথায় নিয়ে। 

কুশলের মত তার দেশের টেকনোক্র্যাট তরুণ তরুণীদের কত কত নামীদামী কিম্বা অনামা কোম্পানি ভাসিয়ে নিয়ে এদেশে চলে আসে। লোকে বলে ব্রেন ড্রেন। কিন্তু মদ্যা কথা হল যেসব ব্রেন আমাদের দেশের ড্রেনে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছিল তাদেরই নিয়ে আসে কোম্পানিরা। তবে ভাগ্যেও থাকা চাই। ঠিকমত যোগাযোগও হওয়া চাই। তাতেই  ওদের দেশের লাভ। আমাদের সর্বনাশ, ওদের পোষমাস। এন আর আই তকমা জোটে তাদের কপালে। প্রতিবছরেই তারা ভাবে আরেকটা বছর কিম্বা আর ক’টা দিন। 

আরেকটু জমিয়ে নি। আরেকটু থেকে যাই। এখনো তো মা বাবা তেমন পোড়োটে হয়নি। স্বাস্থ্য ভাঙলে দেখা যাবেখন। কত সুখ এখানে। কী সুন্দর ওয়েদার! কী  মুখরোচক সব বৈচিত্র্যময় ফাস্টফুডের হাতছানি। প্রতি উইকেন্ড থইথই গেট্টুগেদারে, পার্টিতে, কাছেপিঠে পিকনিক স্পটে। নিজের জীবনটা কে তো ভোগ করে নাও বস্‌! এ জনম চলে গেলে, ও ভোলামন তুমি আর তো পাবে না। সেই যে বোলপুরের বাউলের সেই চেনা সুরটা? মাথায় ঘুরপাক খায় তার।

তবে এখন দূরে থাকাটা আরও সহজ হয়েছে। হোয়াটস্যাপ-ফেসবুকের যুগে প্রতি মিনিটে তো বাড়ির লোকের সঙ্গে কথার ছড়াছড়ি। সব আপডেটস। চিন্তা কিসের? কিছু জমিয়ে নিতে দাও। এই তো সুযোগ! একবার এসে পড়েছি নিজের পচা দেশটা ছেড়ে। আর কেউ যাবার কথা ভাবে? 

তুই যে বলতিস একদিন, ইন্ডিয়া শাইনিং। জিডিপি রাইজিং। আর এখন সে দেশ পচা হয়ে গেল? 

থার্ড ওয়ার্ল্ড দেশের ফোরথ গ্রেডেড অধিবাসী হয়ে থেকে কি লাভ? তার চেয়ে এদেশের ফিফথ গ্রেডেড অভিবাসী হওয়াও ঢের সম্মানের। কুশল পাল্টা জবাব দেয়।  

অতএব চালাও পানসি। ভুল করল কী তবে তারাও? মেয়েরা যতই আধুনিকা হোক, পেট্রিয়ারকি নিয়ে সমালোচনা করুক, এখনো তারা ছেলেদেরই কথা শোনে। অন্ততঃ রাণীয়ার অবস্থা সেই মুহূর্তে তেমনি। যে আসছে তার কথা ভেবে শান্ত হয় সে। 

ওদিকে দুজনের বাবা মায়েরই  র‍্যাপিড এজিং প্রসেস শুরু হয়ে গেল যে। কিছুটা মেন্টালও বটে। 

কিন্তু ওরাও যে নিরূপায় । 

পাকা চাকরী, পার্মানেন্ট থেকে যাওয়া, সংসার পাতা, আরো আরো খরচ, অফুরান চাহিদা, লাম্পসাম পে প্যাকেট আর তারপরেই  সুদৃশ্য বাড়ি,সবুজ লন, ছোট্ট ওয়াটার ফাউন্টেইনের পরীর করুণ মুখশ্রী, ব্যালকনিতে বার্ডফিডে কত কত পাখির নিত্য গতায়ত থেকে জাপানিস গার্ডেন, ফুলে ফুলে ঢলে পড়া ক্রিপার। বার্ডস বাথে কত পাখিদের হইচই করে জল খেতে আসা, একফালি বাগানের জলে লাল নীল মাছ… বারেবারে বদলে বদলে নতুন মডেলের গাড়ী? এদেশে একেবারে জীবনের সব সাধ পুরিয়ে নেওয়া। আশ মিটিয়ে ভোগ করে যাওয়া শুধুই। আর তারপর লাস্ট বাট নট লিস্ট হল এদেশের ওয়েদারের প্রেমে পড়ে যাওয়া…সব মিলিয়ে জীবন যেন কানায় কানায়। তারপর তো গ্রিনকার্ড, প্রোফেসরি করলে পাক্কা টেনিওরশিপ অথবা চাকরী করলে উঁচুপোষ্ট কিম্বা নিজের ব্যবসা…এখানে সব কিছু অতি সহজে হয় বন্ধু। প্রোলোভন আর প্রোলোভন। হাতছানি আর হাতছানি। এ যেন নিশির ডাকের মত। কোথায় যে নিয়ে যায় তাদের! দেশে বসে কেউ তা কল্পনাও করতে পারেনা। মা অবিশ্যি এর মাঝে একদিন মেয়েকে সতর্ক করেছিলেন এই বলে… আমেরিকার জব সিকিউরিটি? তোর বাবা যে বলে গেল চিরকাল? ওদের হায়ার অ্যান্ড ফায়ার পলিসি? 

রাণীয়া বলেছিল, সেইজন্যই তো কুশল বলে ব্যাঙ্ক ব্যাল্যান্স বাড়িয়ে নেওয়ার কথা। এখানে না এলে বুঝবে না মা, কিসের এত মধু!  

ওদিকে মা বাবারা বসে বসে একলাটি ভাবতেই থাকে। রাণীয়াও কুশলের মতোই সেই সম্মোহনী জাদুতে ভুলেছে। 

অনসূয়াই আজকাল এমন বলেন রাণীয়া কে। কিছুটা অভিমানে আর কিছুটা নিরাপত্তাহীনতায়। কিছুটা স্বার্থপর হয়ে যান যেন তিনি। 

আমাদের নিয়ে ভাবিস না আর। আমরা একসময় আরও বুড়ো হব। পরিত্যক্ত জঞ্জালের মত অথবা নালীর মুখে জড়ো হওয়া দশ মাইক্রন পলিথিনের নোংরা ক্যারিব্যাগের মত। বুড়ো মানুষদের কেউ চায়না রে । মায়ের কথায় তীব্র খোঁচা টের পায় রাণীয়া। 

– এত দূরে আছি আমরা। এমন করে বোলোনা মা। খুব কষ্ট হয় আমার। 

রাণীয়া জিগেস করে, মা, বাবা এখনও বাজারে যায়? গুছিয়ে সুক্তোর বাজার, ছ্যাঁচড়ার বাজার করে আনে? 

মা বলে, হ্যাঁ রে এখনও তো পারছে। তাই বারণ করিনা। তবে আগের চেয়ে বেসামাল। টলোমলো পায়ে। দু দিন পড়ে গেছিল। তোকে তো বললাম সেবার। সব রিপোর্ট নর্মাল অথচ। 

রাণীয়া বলল, বাজারে আর পাঠিওনা। আমাদের বাজারগুলোর যা অবস্থা! সব ফোনে অর্ডার করে আনিয়ে নাও। 

মা, বাবা এখনও পোষ্ট অফিসেও লাইন দেয়? এম আই এস কাউন্টারে লাইন দিয়ে সুদ তোলে এখনো ? 

মা বলে, না রে। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার কৃপায় টাকা ঢুকে যায় এখন অটোমেটিক্যালি। মাঝেমধ্যে এটিএমে গিয়ে তুলে নিলেই হল। আসলে আজকাল কখনো টাল খেয়ে যায় তোর বাবার মাথাটা । 

একবার মনে করে সোডিয়াম-পটাসিয়াম ব্যালেন্সটা চেক করে নিও মা। রাণীয়া বলে মা’কে।   

মা বলে, ও সব নরম্যাল। সব রুটিন টেস্ট হয়েছে। 

রাণীয়া বলেছিল, তাহলে তো ভালোই। 

অনসূয়া বলেছিলেন, 

বাজারে নাহয় পাঠাবো না আর। তবে সেটা অন্য কারণে। একটা কথা তোকে বলে আর ঝামেলা বাড়াতে চাইনি রে। 

রাণীয়া বলে, কী কথা? 

তোর বাবার পারকিনসন্স স্টার্ট করেছে। খুব আর্লি স্টেজ। ডক্টর বললেন। 

সে কী? রাণীয়ার মাথায় সেই মুহূর্তে বজ্রপাত হল যেন। আমায় লুকিয়েছ কেন? 

অনসূয়া বললেন, কী আর হবে তোদের টেনশন বাড়িয়ে? একেই তোর এখন এই অবস্থা। আসতেও পারবি না। চালিয়ে তো নিচ্ছি আমরা এখনও। তবে জানিনা আলটিমেটলি কী হবে। 

দিদি কে বলেছো? 

অনসূয়া বলেন, তোকে যা বলিনি, তোর দিদি কে কী করে বলব? একথা ভাবলি কী করে তুই? তবে আমি একা আর কোনদিক দেখব? তোর বাবার চোখের ছানিটাও পেকে যাচ্ছে। খবরের কাগজের নেশা তো জানিস। এখনও বাইফোকাল চশমাটাকে এদিক ওদিক সামলিয়ে পড়ছে অবিশ্যি। আমারও আজকাল টিভি দেখতে অসুবিধে হচ্ছে। জানিস আজকাল কানেও কম শুনছে তোর বাবা । সেবার ওইজন্যই  রাস্তায় সাইকেল রিকশো ধাক্কা মেরেছিল। হর্ণ শুনতে পায়না। 

ও মা সে কী? সেটাও বলোনি তো! 

কত আর বলব? টেনশন করিস নি একদম। তুই ভালো থাকলে তবেই সুস্থ থাকবে তোর পেটের বাচ্ছা। তোরা এত ব্যস্ত থাকিস। সবসময় বলব ভেবেও ভুলে যাই আজকাল। আমার হয়েছে এই এক দোষ, ডিমেনশিয়া স্টার্ট করেছে হয়ত। স্মৃতিটুকুনিও তলানিতে গিয়ে ঠেকার আগে তোর কাজের কথাগুলো যেন ভুলে না যাই। পুরনো কথা সব মনে আছে, আজকাল নতুন কথা ভুলে যাই রে । 

রোজ ওয়ালনাট আর আমন্ড খেও তোমরা। রাণীয়া বলে। ইম্প্রুভ করবে মেমারি। আর নেহা বলেছে এক টুকরো টারমারিক মানে কাঁচা হলুদ কিন্তু মেমারি বুস্টার মা। 

ধুস! কী যে বলিস! পচা ছানায় কী আর সন্দেশ হয়? জিভের স্বাদটা আছে এখনও। তাই রান্নাবান্না করে খাচ্ছি সেটাই সামান্য মুড লিফটার । তবে দাঁতগুলোর জন্যে নরম খেলেই হয় ভালো । ভাবছিলাম রুট ক্যানাল করে নিলে কেমন হয়? 

এভাবেই দুপক্ষের ডায়ালগে বানভাসি হয় কখনও হোয়াটস্যাপ চ্যাটে তো কখনও ভিডিও কলে। সেদিনকার মত ঝড় থেমে গেলেও আবারও দিন কয়েক পরেই এপাশ থেকে মায়ের অভিযোগ, অনুযোগ আর ওদিক থেকে মেয়ের অনুরোধ, উপরোধ উড়তেই থাকে চ্যাটবক্সে। 

তবে মায়ের তো মন। শান্তি পায়না কিছুতেই। 

একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে মা বলেই ফেলেন… 

কী রে তবে ওদেশ ছেড়ে পালাচ্ছিস না তো এবছরেও? আর আসবিই বা কী করে আর? ডেলিভারি হলেই তো সেদেশে আরো কড়াকড়ি। বাচ্ছার নাকি বিস্তর রোগ হয়ে যাবে ইন্ডিয়া গেলে। তোদের হয়ত আর আসাই হবে না এখানে। আমি জানতাম এমনটিই সবার হয়। ভেবেছিলাম তোদের ক্ষেত্রে হয়ত বদলাতেও পারে। সেই গড্ডলিকার স্রোতে ভেসে গেলি তোরাও। 

আহ! তুমি থামবে মা? আরে ঠিক যাব ক’বছর পর। বলেছি তো। আরও একটু থিতু হই। গুছিয়ে নিই। এখনই তো কাজের বয়স বল? ক’টাদিন একটু সামলে নাও তোমরা। বাবা কে ভালো নিউরোলজিস্ট দেখালে? দিদিও তো একবার আসতে পারতো। সে তো দেশেই থাকে। 

মিঠির প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান অনসূয়া। 

এর কিছুদিন পরেই তিনি বলেন, 

পারকিনসন্সের ওষুধ স্টার্ট হয়েছে তোর বাবার। কিন্তু হাঁটাহাঁটি তে বেশ প্রবলেম। নিজে নিজে খেতেও অসুবিধে। চায়ের কাপ নিয়ে খেতে গেলে আজকাল চা পড়ে যাচ্ছে। হাতে করেও ভাত খেতে পারছে না আর। চামচে তুলে দিতে হয় মুখে। ট্রেমর হবেই এই রোগে। জানিস তো। 

রাণীয়ার মন মানতে চায়না। বাবা কে কত কর্মঠ দেখতে অভ্যস্ত সে। ইদানীং বাবার কথাতেও যেন সামান্য হলেও জড়তা। এ রোগের এমনি নিয়ম। সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম অকেজো হয়ে যায়। ইচ্ছেশক্তি, বোধশক্তি থাকলেও মোটর নার্ভগুলো কাজ করেনা।  

রাণীয়ার বাবার চিন্তায় ওদের মা’ ও যেন আরো এগিয়ে চলেন তাড়াতাড়ি  বার্ধক্যের দিকে। দুজনেরই এজিং প্রসেস শুরু হয়ে যায় চুপিসাড়ে। এখন ওরা কলকাতায় থাকেন, তপনবাবুদের পুরনো বাড়িতেই। জেরিয়াট্রিক শহরের এক কোণে পড়ে থাকেন বাকীসব বৃদ্ধদের মতোই । জামশেদপুরের সেই শখের বাগান বাড়ি এখন তালাবন্ধ। মেয়ে জামাইরা পরে যা করবে তাই হবে। যদ্দিন সামর্থ্য ছিল সেখানে তদ্দিন ক্লাব, স্থানীয় পাঠচক্র, মহিলা সমিতি, হরিনাম গান কিম্বা কালীমন্দিরে সান্ধ্য আরতি দেখতে শুনতে যাওয়া ছিল । তারপর? রোগভোগ, ইনসিকিউরিটি? রাতবিরেতে কিছু হলে? ডাক্তার দেখানো কলকাতায়। তাই সেখানকার পার্ট চুকিয়ে আপাতত কলকাতার বাড়িতেই এসে উঠেছেন ওরা। 

অনসূয়া বলে ওঠেন 

“না, না আমাদের জন্য তোকে দেশে ফিরতে বলছি না। আমরা ঠিক চালিয়ে নেব, মিঠিকেও বলে দিয়েছি সেকথা। আগে কেরিয়ার। পরে দায়িত্ত্ব, কর্তব্য সবকিছু ”  

ফোনের ওপ্রান্ত থেকে চরম চাপানউতোর। এবার রেগে যায় মেয়ে। 

” মা, প্লিজ আমাদের একটু  বোঝার চেষ্টা করো তোমরা। দিদিও তো আসতে পারে একবার । ইমোশানাল ব্ল্যাকমেলিং কোরোনা।” 

ফোন কেটে যায়। বাবার লোলচর্ম, মায়ের বলিরেখা। বাবার চোখের ছানি পাকতে থাকে। সেই সঙ্গে হার্ড অফ হিয়ারিং। বাবার চিন্তায় মায়ের রাতের ঘুম চলে গেছে। দিনের পর দিন ইনসমনিয়া আর বয়সের কারণে অস্টিওপোরেসিস। সেখানে প্রবলেম যেন বেড়েই চলে। 

– আর দাঁতের রুট ক্যানাল? সেটার কিছু খবরাখবর করলে? রাণীয়া ব্যস্ত হয় ফোনের ওপ্রান্তে। 

আমাদের সর্বাঙ্গে ঘা, ওষুধ দিবি কোথা? ছাড় দিকিনি আমাদের কথা। তোদের কথা বল। তোর শরীরের খেয়াল রাখছিস তো? একবারে না পারলে বারে বারে অল্প করে খাবি। গ্যাস অম্বল হয়নি তো আর? এখন একটু রান্নাবান্না কম করে করবি।  আর রোজ একটু করে হাঁটবি কিন্তু বুঝলি ? সারাদিন ঘরে বসে কাজ তোর। অনসূয়া মেয়েকে শান্ত করেন।  তবে ওদেশে সিজারিয়ান সেকশন অত হয়না। মা, বাচ্ছা সুস্থ থাকলে ওদেশে নরম্যাল ডেলিভারির ওপরই জোর দেন ডাক্তারবাবুরা। কমপ্লিকেশন থাকলেই সিজাড়িয়ান সেকশনের কথা ভাবেন তারা। এখানে আজকাল বস্তিবাসিদেরও সিজার হচ্ছে ঘরে ঘরে। 


আরো পড়ুন: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-১৯) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


এবার ওদিক থেকে রাণীয়ার চোখরাঙানি।  কতবার তো বলেছি তোমাদের। এখানে চলে এসো। আরামে থাকতে পারবে। সময় থাকতে এলেনা কিছুতেই তোমরা। এবার বোঝো ঠ্যালা। তাহলে দিদির কাছে ব্যাঙ্গালোরেও তো চলে যেতে পারতে মা। আমি  একটু  শান্তি পেতাম। 

না রে! তোদের দিদা কী বলত? পরভাতী হোয়ো তবু পরঘরী হোয়ো না। মা বলেন। 

রাণীয়া রেগে গিয়ে বলে, জামাইবাড়ি থাকবে না তোমরা? তোমাদের এত ইগো? 

অনসূয়া বললেন, জানিস তো সব। আমাদের পাসপোর্ট তো হয়েই ছিল।  ভিসাও পাওয়া যেত। কোভিড না হলে। তারপর কোভিড নাহয় কমল কিন্তু  তার মধ্যেই তোর বাবার এমন অসুখ  ধরা পড়ল। ডাক্তারবাবু এই পেশেন্ট কে নিয়ে বিদেশ যাত্রায় সম্মতি দিচ্ছেন না কিছুতেই। ওখানে চিকিৎসা মানে সে তো রাজার অসুখ। তোরা শেষ হয়ে যাবি। মেডিক্যাল ইন্সিওরেন্স নেই একে। 

রাণীয়া আঙুল কামড়ায়। কেন যে জোর করে তোমাদের তখন নিয়ে এলাম না? এত রোজগার পাতি হয়ত হল এ ক’বছরে কিন্তু… 

এদিকে নিশ্চুপ বাবা মা। তাঁরা অসহায় তবু বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। তখন ছিল নিজের পরিচত জোন অফ কমফর্ট । নিজের ভিটে ছেড়ে কোথাও যেতে মন চাইছিলনা এই বয়েসে । 

তবুও বলে ওঠেন নরম সুরে। এতদিন ধরে শুধুই ভেবে গেছি রে। ভাবছিলাম তোরা যদি চলে আসিস। সেবার যে বলেছিলি, দুটো পয়সা করেই দেশে ফিরবি? ভরিয়ে দিবি আমাদের। মা-বাবাকে নিয়ে জমিয়ে পাতবি সংসার। ভারতীয় সংসার। নাতিপুতির মুখ দেখাবি। কিন্তু তোরাও আর পাঁচজনের মতোই আটকে গেলি ঐতিহাসিক X+1 সিনড্রোমে?  

সেটা আবার কী গো? রাণীয়া বলে তার মা’কে।

মা, বলে কেন এ তো আমরা ১৯৭০ সালেই শুনেছিলাম। ক’ দিন আগে দেখলাম  ফেসবুকেও লিখেছে একজন । সেই লেখা ভাইরাল হয়েছে তো ফেসবুকে। হোয়াটস্যাপেও হাত ঘুরছে। ও তোরা তো এখন আবার ফেসবুক করিস না। সে তো বুড়োদের টাইমপাসের জায়গা।তোদের তো সব ইন্সটায়। বাই দ্যা ওয়ে, তোর শ্বশুর শাশুড়িরও তো বয়েস হল অনেক। ভেবেছিলাম তাদের বাধ্য ছেলে কুশলও তাদের জন্য হয়ত একদিন ঠিক ফিরে আসবে। 

লিসন মা লিসন। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড মা। ওরা কোনোদিনও ছেলে কে ফিরতে বলেন নি। ওরা ওখানেই স্বাধীনভাবে থাকতেই চেয়েছিলেন। আমরা চলে এসে ওরা বেঁচে গেছে। আমায় তো কুশলের মা কখনও সহ্য করতে পারেন নি, জানোই তো সব। মনে নেই আমার বিয়ের পরে উনি একদিন কী বলেছিলেন? ছেলের বিয়ে দিলেই সে পর হয়ে যায়? বাড়িতে বাইরের মেয়ে ঢুকলেই তোমার সব স্বাধীনতা শেষ? তুমি ভুলে গেলে মা? দূরে আছি ভালো আছি আমরা। ওনারাও নিজেদের মত আছেন। শুনলাম কুশলের এক জেঠতুতো দাদা আর তার বৌ কে বাড়ির ওপরতলায় থাকতে দিয়েছেন। সেই দাদার রোজগারপাতিও তেমন নেই। অতএব বাড়ির লোভেই বল বা কুশলের বাবার মোটা পেনশনের লোভেই বল… সেই দাদা বৌদিই এখন দেখেন ওদের। আমরা নিশ্চিন্ত। ওরা বুঝে গেছেন হয়ত আমরা আর জীবনেও ফিরবও না দেশে। অথচ এই উনিই আমায় দেখেশুনে নিয়ে এসেছিলেন একদিন ওনারই বাড়িতে। দুবছর ধরে… বাজিয়ে নিয়ে, পরখ করে, গোরু কেনার মত। কুশলের সঙ্গে ততক্ষণে ইমেইল আর ফোনে আমার কোর্টশিপ এতটাই তুঙ্গে উঠল যে ওর মায়ের ব্যাপারস্যাপার গুলো কে আমি আর পাত্তাও দিলাম না। 

ফোনের ওপ্রান্তে মেয়ের এসব গুরুগম্ভীর পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটা দেখে অনসূয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তবে আমার কুশল আমার ছেলে। তাই আমার শান্তি। শাশুড়ি বৌমার অমন কিসস্যা ঘরে ঘরে। 

মদ্দা কথা তোরাও ফেঁসে গেলি অনুপম, কৌশিক, বাবু, টুব্লু, মন্টি সকলের মত । ওদেশে গেলে সবার মাথাটাই এক্কেবারে গুলিয়ে যায় । প্রোলোভনে পড়ে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয় সবাই। তোদের আর কী দোষ? কত চাকরী, কত বাকরী, কত নিয়মানুবর্তিতা…এই করতে করতে আরেকটা বছর প্লিজ..যাব তো বলছি, কথা দিয়ে কথা রাখে না কেউ আর কেনই বা ফিরবে? স্ফটিকের মত স্বচ্ছ, সুসংবদ্ধ সেদেশের অর্গানাইজেশন। 

রাণীয়া বলে তা যা বলেছ মা। সব মিলিয়ে এদেশের এন্ট্রপি কমছেই। তাই সকলেই সদাহাস্য। এখানে মেজাজ গরম হয় না কখনো। 

মা বলে, তবুও তো দেখি কাগজে। খুনখারাপি দিনদুপুরে। ঠান্ডামাথায় গুলি চালানো, বন্ধুর বুকে ছুরি চালানো হয়। 

রাণীয়া বলে, সে কেমিষ্ট্রি অবিশ্যি আলাদা মা । সাদায়কালোয়, বাদামী চামড়ায় বহু যুগের ওপার হতে উঠে আসে সে কিসসা। সে বাদ দাও। আর আমাদের দেশে দেখ, অহোরাত্র অশান্তি, ঝুটঝামেলা, মাথা গরম, লুটপাট, ন্যাস্টি ওয়ার্ক কালচার, জঘন্য ওয়েদার…মিটিং, মিছিল… মোষ্ট ডিসঅর্গানাইজ্ড আমরা। মেজাজ তাই সবসময়ই সপ্তমে। 

– ভালো অ্যানালিসিস তোর। ঐ যে যত কেওস, অরাজকাতা, ততই ডিসঅর্ডার আর বিশৃঙ্খলতা আর সেই সঙ্গে  একই হারে এন্ট্রপি বাড়তেই থাকা। সেকেন্ড ল অফ থার্মোডায়নামিক্সে সেই কবে পড়েছিলাম আমরা।  তুইও তো পড়েছিলি ফিজিক্সে। তা এত তাত্ত্বিক আলোচনা কার সঙ্গে? কুশল এসে পড়েছে এরই মধ্যে অফিস থেকে। 

– তবে আমার মনে হয় কী জানেন মা ? নদীর ওপারেও যেমন সব সুখ নেই, এপারেও  তাই।  এখানে অনেক কিছুই খারাপ। মা, বিলিভ মি । আমরা খুব মিস করি আপনাদের। দেশে যেতে হয়ত পারছিনা এখনই কিন্তু মন পড়ে থাকে সবসময়। 

মায়ের সঙ্গে রুটিন ভিডিও কল সেরে নিয়ে রাণীয়া আবার এগোয় তার বিলাস বহুল বিদেশী রান্নাঘরের দিকে। অ্যাপার্টমেন্টের এই স্থানটি তার সবচাইতে কোজি কর্নার। সেখানে সে একাত্ম হয়ে পড়ে আলু-ফুলকপি, পেঁয়াজ-আদা-রসুনের সঙ্গে। ফ্রোজেন মটরশুঁটি, সসেজ, কোল্ড কার্ট । বরফের স্তূপে দিনের পর দিন সমাধিস্থ সব নিষ্প্রাণ প্যাকেটগুলোর কাছে যায় । তবুও এরা সবাই ওর বড় আপনার, বড় কাছের যেন। সেদিন রাণীয়া কী রাঁধবে সেসব ভাবনা তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নেয় আবারও। কুশল এসে যাবে। খিদে পেয়ে যাবে তার । সেই কোন সকালে হেভি ব্রাঞ্চ সেরে অফিসে চলে গেছে। কোভিড একটু কমতেই মাঝেমাঝে তাকে অফিসে মুখ দেখাতে হয় এখন।  

তার মধ্যেই বাংলার আরেকটি হারানো রান্না নিয়ে সব জেনেছে গতকাল অনসূয়ার কাছে। মা আবার আজকাল নাকি সব ভুলে যাচ্ছে বলছে। তার আগে সব জেনে নিতেই হবে তাকে। ক্রমশই সে নিজের বৃত্তে, কাজের চৌহদ্দিতে প্রবেশ করে একটু একটু করে। তার চাইতেও বড় কথা হল অনসূয়া এ সময় অরুচির মুখে মেয়েকে ঝাল ঝাল, গামাখা মাখা বড়ি বেগুণের চচ্চড়ি খেতে বলেছেন। দুটো ভাত খাবে তবে মেয়েটা। তাইতেই রাণীয়ার মনে পড়ে গেল কতকিছু। 

প্রতিবছর অঘ্রাণে অনসূয়া পরম নিষ্ঠার সঙ্গে বড়িহাত করত। দেশে এইসময় নতুন গোটা বিউলির ডাল ওঠে। মা কেমন সুন্দর করে বড়ি দিত। রাণীয়া তাদের ফ্ল্যাটের চারতলার ছাদে উঠে কুলোয় পাতা সাদা কাপড়ের ওপর দেওয়া টোপা টোপা বড়িগুলো রোদে রেখে আসতো  প্রতিবার শীতে। দুটো বড় বড়িকে আবার ধান দুব্বো মাথায় দিয়ে, সিঁদুর পরিয়ে দিয়ে মা বলত শাঁখ বাজাতে। বড়ির নাকি বিয়ে দেওয়া বলে একে। খুব আনন্দ হত আর হাসি পেত রাণীয়ার এসব স্ত্রী আচার দেখলে। সেখানে সেই মুহূর্তে মা আর কোথায় এয়োস্ত্রী পাবে? তাই নিজের মেয়ের হাতেই পান সুপুরি ছুঁইয়ে কপালে সিঁদুরের ফোঁটা এঁকে দিয়ে কুলো ভর্তি বড়ি মেয়ের হাতে ধরিয়ে প্রতিবছর নিয়ম করে মা বলত “যাহ! ছুটে ছাদে গিয়ে রেখে আয় তো”  

কতরকমের বড়ি দিত মা। ধুস! এতসব ভাবতে গিয়ে রান্না, কাজ মাথায় ওঠে রাণীয়ার। 

বড়ি নিয়ে এত কথা ভাবছে সে আজ ঝালঝাল বড়ি বেগুণ চচ্চড়ি রাঁধবে বলে। সেইসঙ্গে রথ দেখা আর কলা বেচাও হবে। বাংলার রান্না নিয়ে চ্যানেলের জন্য তার নিয়মিত সব বকবক। সে খেয়েছে দিদার হাতের অনবদ্য একটা রেসিপি। এই বড়িবেগুণ চচ্চড়ি। সজনে ডাঁটার সময় আবার তার মধ্যে ক’টা ডাঁটাও ফেলে দিতেন দিদা। সুন্দর গন্ধ হবে বলে। ওপর থেকে অনেকগুলো কাঁচালঙ্কা আর কাঁচা সর্ষের তেল। কিচেন কাবার্ড হাতড়ে রাণীয়া খুঁজে পায় না কিন্তু ফ্রিজের মধ্যে আটবছর আগে আনা মায়ের হাতের ধবধবে সাদা হিংয়ের বড়ির কৌটো খুঁজে পেয়ে আহ্লাদে আটখানি হয় । পড়ে আছে এখনও কয়েকটা। মায়ের হাতের স্পর্শ। এদেশে প্রথমবার এসেছিল যখন তখনকার। মায়ের গন্ধ পায় যেন সেই সুদূরে বসেও। 

প্রথমে বড়ি ক’টা মুচমুচে করে ভেজে তুলে নিয়ে পাঁচফোড়ন আর শুকনো লংকা গরম তেলে। তার কিছুপরেই আলু, বড়ি, বেগুণের মাখামাখা কেমিস্ট্রিতে আমেরিকার মড্যুলার কিচেন তখন থইথই। আজ চ্যানেলে ভিডিও দিতে হবে রাণীয়া কে। সে বাঙালির বড়ি বৃত্তান্ত নিয়ে বলবে কী না! মা এখনও বড়িহাত করে কী না কে জানে? তবে মন ভালো হয়ে যায় নিমেষেই। 

এই রান্না রাণীয়ার দিদার। 

মারণ কোভিডের বন্দীদশাতেই খবর পেয়েছিল রাণীয়া। দিদা চলে গেছে তাদের ছেড়ে। শেষ ভিডিও কলে রাণীয়া দেখেছিল দিদার প্রবল শ্বাসকষ্ট। বুকের ওঠানামা। হাপর টানছে যেন। উফ! ভাবা যায়না। অক্সিজেন মেলেনি তাঁর শেষ মুহূর্তে। কেউ যেতে পারেনি শ্মশানে দাহ করতে। পিপিই কিট পরে কর্পোরেশনের লোক এসেছিল বডি নিয়ে যেতে। কী যন্ত্রণা! এর কিছুদিনের মধ্যেই চলে গেছেন ওর ঠাম্মাও। তাঁর অবশ্য কোভিড হয়নি। বয়সজনিত কারণেই। ভগবান মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু এই কাছের মানুষদের সঙ্গে রাণীয়ার আর দেখা হল না। সেটাই যে আফশোসের। ধুস! কী হবে যে এদেশে পড়ে থেকে? কুশল বোঝায়… দেশে পড়ে থেকেই বা কী হত তোর? এই মানুষগুলো তো চলে যেতেনই  একদিন। কেউ আগে, কেউ পরে। তুই কী এঁদের মৃত্যু আটকাতে পারতিস? বি প্র্যাক্টিকাল। 

ঠিকই তো। ভাবে রাণীয়া। কিন্তু মন মানেনা যে। দিদার সঙ্গে তিনি চলে যাবার মাস তিনেক আগেই তো কত গল্প হয়েছিল। রাণীয়ার চ্যানেলের জন্যই তিনি মেটিরিয়াল দিয়েছিলেন। গল্পের মত বলে গেছিলেন। রাণীয়া রেকর্ডিং করে নিয়েছিল। দিদাও তো সে যুগের এক ফ্যাশানেবল মহিলা ছিলেন যিনি রান্না অন্ত প্রাণ। শিল্পপতি দাদুর ওঠাবসা ছিল সমাজের হোমরা চোমরাদের সঙ্গে। প্রতিভাদেবী কে সেই অর্থে তখনকার মানুষজন অনেকেই চিনতেন। সেভাবেই একদিন পুরুলিয়ায় গিয়ে দিদা-দাদুর আলাপ হয়েছিল চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর সঙ্গে। এই বাসন্তী দেবী আবার তুখোড় রাঁধিয়ে ছিলেন। তাই দিদার সঙ্গে ভাব জমতে সময় লাগেনি একটুও । 

সেটা ১৯৫০ সালের কথা। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন বেঁচে নেই তখন। পুরুলিয়ায় বেড়াতে গিয়ে তাঁদের বাগানবাড়িতে গেছিলেন রাণীয়ার দাদু-দিদা। কোলকাতা থেকে হাওয়াবদলের জন্য বাড়ির কাছেই পুরুলিয়া যাত্রায় এক অনাবিল আনন্দ ছিল। তায় আবার শীতকালে পুরুলিয়ার জলবায়ু খুব আরামদায়ক। 

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পত্নী শ্রীমতি বাসন্তী দেবী ঘটনাচক্রে তখন পুরুলিয়ায়। দিদার কাছে জানতে চেয়েছিল রাণীয়া সেদিন। 

– তাঁর নামেই কী আমার শ্বশুরবাড়ির পাড়ায় গড়িয়াহাটের বাসন্তী দেবী কলেজ?

দিদা বলেছিলেন হ্যাঁ রে। জানতিস না তুই? 

রাণীয়া বলেছিল, বা রে! আমি কী কলকাতার মেয়ে? শ্বশুরবাড়িতে আর কদিনই বা থেকেছি? 

– তা সেই বাসন্তীদেবী পুরুলিয়ায় থাকাকালীন প্রায়ই নিজের হাতে কিছু না কিছু মামুলি অথচ সুস্বাদু রান্না পাঠাতেন আমাদের। দিদা জানিয়েছিল সেদিন। উনি রন্ধনশিল্পে পটিয়সী ছিলেন। ওনার হাতে আলুপোস্ত আমি এ জন্মে খেলুম না আর কোথাও।  আর নারকোল, পোস্তবাটা, চীনেবাদাম কুচি দিয়ে আলুরদম… এসব রান্না এখনো মুখে লেগে আছে। 

উনি শখে রান্না করতেন। যদিও তাঁদের বাড়িতে খানসামা ও বাবুর্চি ছিল। তবুও সব জোগাড় করে দিলে বিশেষ দিনে বিশেষ রান্না যেমন ফিশফ্রাই, ফিশমোল্ড, মাছের ক্রোকে, মুরগীর পেটে পোলাওভাত, মুরগির রোষ্ট… এসব রান্না ওনার কাছেই শিখে নিয়েছিলেন দিদা। দিদারও যে ভয়ানক রান্নার শখ ছিল ঠিক রাণীয়ার মতই। 

একদিন এই বাসন্তী দেবী মোষের ঘনদুধের পুরু সর পাটে পাটে ভাঁজ করে মোটা দানার চিনি ও কাজু-কিশমিশ ছড়িয়ে খেতে দিয়েছিলেন দিদা আর দাদু কে।  

এই ফিশমোল্ড হল বাংলার এক হারানো সাহেবি রান্না। বাসন্তীদেবীর দেখাদেখি দিদা তখনকার হগ মার্কেট থেকে কিনে এনেছিল ক্রাউন অ্যালুমিনিয়ামের মোল্ড। মামাবাড়িতে মাটির উনুনের নীচে একটি চেম্বার করিয়েছিল দিদা। রান্নাবান্নার পরে মরা আঁচে সেই প্রকোষ্ঠে রাতের জন্য দুধ-ডিমের ক্যারামেল পুডিং বসাতো  সেখানে। নিভু আঁচে ঠিক অনেকক্ষণ ধরে পুডিং বেকিং সুষ্ঠুভাবে হত। তারপর থেকে ফিশমোল্ড হত সেই চেম্বারে। বাসন্তী দেবীর নিজস্ব রেসিপি। 

দিদার সেই ঐতিহাসিক পুডিং প্যান এখন রাণীয়ার মা অনসূয়ার কাছে। এবার দেশে গেলে সেটি মনে করে নিয়ে আসতেই হবে। দিদা জানিয়েছিল সেদিন রাণীয়া কে। নুন, ভিনিগার আর সামান্য হলুদ দিয়ে সেদ্ধ করা রুই বা কাতলার পেটি থেকে কাঁটা বেছে নিয়ে কড়াইতে সামান্য মাখন বা ঘি দিয়ে রসুন কুচি, পেঁয়াজকুচি, সামান্য আদাবাটা, টোম্যাটো কুচি, ধনেপাতা আর কাঁচালংকা কুচি দিয়ে সেই কাঁটা বাছা মাছ নেড়ে নিয়ে সামান্য চিনি, লেবুর রস, গরম মশলা ছড়িয়ে দিতে হবে। এবার একটি আলুসেদ্ধ চটকে নিয়ে দিতে হবে মিশ্রণে। এই মিশ্রণ ঠাণ্ডা হলে এর মধ্যে একটি ডিম ভেঙে দিয়ে বেশ করে ঘেঁটে দিয়ে মাখন লাগানো মোল্ডে মিশ্রণটি ঢেলে দিয়ে আভেনে আধঘণ্টা রাখলেই তৈরী হবে ফিশ মোল্ড। এর মধ্যে গ্রেট করা গাজর, মটরশুঁটি সেদ্ধও দেওয়া যেতে পারে। আভেন না থাকলে প্রেশার কুকারেও জলের ওপর বসিয়ে করা যেতে পারে এই ফিস পুডিং। দিদা জানিয়েছিল আদরের ছোটো নাতনী কে। সেটাই দিদার সঙ্গে রাণীয়ার শেষ এপিসোড রান্নার গল্প নিয়ে। প্রিয়জনের সঙ্গে এসব খুচরো স্মৃতি দুঃখ উসকে দেয়। কুরে কুরে খায় সেসব মুহূর্তগুলো। তবুও কাজে ডুব দিতে হয়। নিজের ভালো থাকার জন্য।   

রাণীয়া আবার ফেরে কাজে। এই একটা জিনিষই তাকে সবকিছু থেকে মুক্তি দেয়। 

গতকালই সে একটা ই-বুক ডাউনলোড করেছে ফোনে। খুঁজছিল অনেকদিন ধরে। পূর্ণিমা ঠাকুরের লেখা ঠাকুরবাড়ির রান্না। লেখিকা তাঁর ন’মা মানে ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর রান্নার খাতা দেখে দেখে সব লিখেছিলেন হাতে করে। তারপর সেটি এখন এক ঐতিহাসিক বই। যারা রান্নাবান্না নিয়ে কাজ করে, রান্না করতে ভালোবাসে তাদের জন্য। প্রিজাভ করার মত বই একটা। 

সেই মুহূর্তে কুশলের মা আর মিঠি কে দেখাতে ইচ্ছে করে রাণীয়ার। সেই যুগে এমন শখ ছিল মেয়েদের! প্রমথনাথ চৌধুরীর স্ত্রী রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী নিজে রাঁধতে ভালোবাসতেন না। জীবনে রান্নাঘর মাড়ান নি। অথচ যেখানেই নিমন্ত্রণে যেতেন, যা কিছু খেতেন কিম্বা বাড়িতে যা রান্নাবান্না হত সব সুন্দর করে গুছিয়ে লিখে রাখার অভ্যেস ছিল তাঁর । লম্বা মুদির দোকানের খাতার মত দেখতে হাতে লেখা একটা লালচে হয়ে যাওয়া পাতা ভর্তি রেসিপির খাতা ভাগ্যিস তিনি দান করে গেছিলেন সুপাত্রে। সত্যিই  সুযোগ্যা পূর্ণিমা নামের এই মহিলা। ভাবতে থাকে রাণীয়া। হারিয়ে গিয়েও হারায় নি তাই এইসব হারানো রান্না। তিনিও রাণীয়ার মতোই সেযুগের একজন ফুড ইভেঞ্জালিস্ট ছিলেন বৈকি। সে যুগে এমন গালভরা নাম দিত না কেউ। সোশ্যালমিডিয়াও ছিলনা। কেউ খোঁজ রাখত না এসব কাজের। তাঁরা মারা যাবার পরে এসব কাজের কদর হয়েছে। এসব বই এখনও বেস্ট সেলার। 

তক্ষুনি ইচ্ছে করে রাণীয়ার । তার দিদি মিঠি কে ঘাড় ধরে পড়ে শোনাতে। দেখ দেখ। সে যুগে কেমন কবিতায় বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন পূর্ণিমা ঠাকুর। 

“শোভন হাতের সন্দেশ পান্তোয়া/ মাছমাংসের পোলাও ইত্যাদিও / যবে দেখা দেয় সেবা মাধুর্যে-ছোঁয়া / তখন সে হয় কী অনির্বচনীয়” 

বলতে ইচ্ছে করে তার। বুঝলি দিদি? তোর শাশুড়িকেও জানাস। নতুন বৌ কী কী রান্না জানে এমন সব কঠিন প্রশ্নের সম্মুখে পড়ে দিনের পর দিন ইন্দিরা দেবীকেও তোর মত খুব অস্বস্তি তে পড়তে হত  কিন্তু তাই বলে কেউ তাঁকে ছোটো করেনি।  ঠাকুরবাড়িতে বরং নিজের সেই কুণ্ঠা ঢাকতে তিনিও লিখে রেখেছিলেন সব রান্নার রেসিপি। 

কিন্তু বেশ কিছুদিন যাবত মিঠির সঙ্গে রাণীয়ার ওঠাবসা আগের মত নেই। তাল কেটে গেছে। তাই কথা বাড়াতে মন যে চায়না এক্কেবারেই। 

মেয়েরা কী শুধুই বাড়ি বসে বসে রাঁধে আর খায়? না কী যে রাঁধতে পারে সে অন্যকিছু পারে না বলেই রেঁধে চলে? প্রজ্ঞাসুন্দরী, পূর্ণিমা দেবীরা দেখিয়ে দেন নি? কেতাদুরস্ত রান্না রেঁধে? অভিজাত স্টাইলে সেসব রান্নার অভিনব নাম দিয়ে,  পরিবেশন করে, সবাই কে তাক লাগিয়ে আর ফাইনালি রান্নার বই লিখে অমর হন নি তাঁরা? এই মেয়েরা সে যুগের তো বিখ্যাত হাইসোশ্যাইটির মহিলা । 

সেই  প্রসঙ্গে মা বলেছিল, আবার দেখ, আশাপূর্ণা দেবী কী শুধুই লিখে গেছিলেন? ঘর সংসারে তাঁর একটুও মন ছিল না। নাকি শিকেয় তুলে রেখেছিলেন স্বামী, সন্তান, সংসারের রোজনামচা? অথবা প্রভাবতী দেবী সরস্বতী? সে যুগের প্রথম গোয়েন্দা লেখক তিনিও কী একটু লিখতে পারতেন বলে জীবনের বাকী সব বিসর্জন দিয়েছিলেন? 

সেদিন অবাক হয়েছিল রাণীয়া মায়ের মুখে এসব শুনে।  নিজের একলা হেঁশেলঘরে দাঁড়িয়েই দিদির উদ্দেশ্যে এসব আখরগুলো ছুঁড়ে দিয়ে শান্ত হয়েছিল । অভিমানে, রাগে, ক্ষোভের দু-চারটে সেই ফুলকি গিয়ে আছড়ে পড়েছিল অনসূয়ার ফোনেও। 

মা বলে উঠেছিলেন, সেই কবে লিখে গেছিলেন আমাদের রাজশেখর বসু। সে যুগের সাক্ষর বাঙালি মেয়ে তাঁর গল্পের নায়িকা। সেই স্মার্ট নায়িকা তো পার্টি তে ভাইসরয়ের বলডান্সে যেমন গলা জড়িয়ে ধরে নাচতে পারত তেমনি অক্লেশে ঘোমটা টেনে দুশো লোকের রান্নাও করে দিতে পারত। 

আজকাল রাণীয়ার মাঝেমধ্যেই কাজ করতে করতে মাথাটা গরম হয়ে যায়। মিঠি কে আগ বাড়িয়ে আর সে নিজের কাজের কথা জানায় না। মনে খুব কষ্ট হয় । তবুও এই দূরত্ব বজায় রাখতেই হয়। নয়ত মানসিক শান্তি পায় না সে। সেই যে চ্যানেলের একটা ভিডিও কিছুদিন আগেই ভাইরাল হবার পরে মিঠির এহেন উদাসীনতা রাণীয়া কে আঘাত করেছিল প্রচণ্ড। এক পার্টি তে গিয়ে ব্যাঙ্গালোরের বাঙালি সোশ্যাইটির স্মার্ট লেডিজদের মুখে নিজের সহোদরার সুনাম, সুখ্যাতি শুনে মিঠি বুঝি সেদিন জ্বলে গেছিল। তারপর থেকেই দুই বোন যে যার মত। তবু তো সে মিস্টার শেফ এ এখনও মঞ্চ শেয়ার করেনি কোনও তুখোড় রাঁধুনির সঙ্গে। ডাক এসেছিল কিছুদিন আগেই। কিন্তু একে কোভিড তায় আবার নিজের শারীরিক কারণে এখন গাড়ী করে দূরে কোথাও যাওয়ায় রাশ টেনে দিয়েছে কুশল। ডাক্তারের বারণ। লেট প্রেগন্যান্সি তে অনেক কিছু ঝামেলা। 

কিন্তু রাণীয়া কিছুতেই আর বুঝে পায়না তার এতে দোষ কোথায়? ব্যাঙ্গালোরের কেউ হয়ত বিশেষ কোনও রান্না খুঁজতে গিয়ে পেয়ে গেছিল রাণীয়ার ফুড ভ্লগ আর ছড়িয়ে দিয়েছিল তার পরিচিত মহলে। এটাই তো সোশ্যাল মিডিয়ার কেরামতি। রাণীয়া তো ঠিক এভাবেই বাঁচতে চেয়েছিল। পরিচিত হতে চেয়েছিল। তার একলা মহলে বসে বসেই লাইম লাইটে আসতে চেয়েছিল। তার ইউএসপি যে অফবিট। সবার থেকে আলাদা। মুড়িঘণ্ট বা মাছের মাথা দিয়ে ডাল কিম্বা ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে ছ্যাঁচড়া সেখানে ইম্পরট্যান্ট নয়। ঘটিদের চচ্চড়ি আর বাঙালদের লাবড়া নিয়েও কাটাছেঁড়া নয় । রাণীয়ার বিশেষত্ব হল সেই রান্নার জন্ম, তার ইতিহাস, ভূগোল আর সর্বোপরি তার নিজস্ব স্বকীয়তা। প্রেজেন্টেশনের অভিনব কায়দা। সেটাতেই মোহিত হয়েছে মানুষ। তার সাবস্ক্রাইবাররা। রাণীয়া মনে মনে বলে, কোভিড পেয়িং ডিভিডেন্ড। সুদূর বিদেশে ঘরবন্দী থেকে অনেক কাজ করে ফেলেছে সে। অবিশ্যি কোভিড আসার আরও আগে থেকেই সে পডকাস্ট করেছে নিয়মিত। সেটা ছিল স্টেপিং স্টোন। 

  

তার মাঝেই সুখবর হল এদ্দিনে রাণীয়া মা হতে চলেছে। এখন কিছুদিন সব কাজ তোলা থাকবে রাণীয়ার। বাড়ি বসে যতটুকুনই হয় কোনও স্ট্রেইন না করে। এতদিন বাদে রাণীয়া মা হবে। অনসূয়া খুব খুশি হলেও চিন্তার শেষ নেই তার মেয়ের জন্য। তাঁরা এখন আর যাবেনই বা কী করে সেদেশে? মেয়েটা একাহাতে সব পারবে? এই নিয়ে আবারও বুঝি মিঠির হিংসে, বোনের সঙ্গে দূরত্ব আরও বাড়তেই পারে। মিঠি তার চেয়ে অনেক বড় কিন্তু সে এখনও মা হল না। সে তো মিঠির নিজের দোষেই । সে চায়নি সন্তান। মিঠি স্বার্থপর। শুধু নিজের নিয়ে থাকতে জানে। নিজের সুখেই সুখী। বেচারা শৈবাল। সেও তো একটা বাচ্ছার বাবা হতে চেয়েছিল। মিঠি সব দায় দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে। তার দিদি এমন কিন্তু তাই বলে কী রাণীয়া মা হবেনা? সে তো সবকিছু নিয়েই বাঁচতে চায়। খুব দোলাচলে মায়ের মন। 

তুই কী করে একা একা সব সামাল দিবি? অনসূয়া চিন্তায় পড়েন। 

– সব পারবো মা। আমি তো তোমার দশভুজা দুর্গা । রবিঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতাটা মনে নেই মা? আবৃত্তি করিয়েছিলে আমায় দিয়ে তুমি । কলেজের সোশ্যালে।

” আমি কেবল জানি,

রাঁধার পরে খাওয়া, আবার খাওয়ার পরে রাঁধা”   

– মা, তোমার বড় মেয়ে আর আঘাত দেবে না তো আমাকে? এত পড়াশুনো তোর সব বৃথা বা একটা চাকরী করলি না তুই… এই বলে? আমার শাশুড়ি আর আমায় খোঁটা দেবে না তো এই বলে? যে রান্না আর এমন কী? সে তো মুখ্যু হালুইকর বামুনদের কাজ। মা, আমি আজ রান্নাকে একটা শিল্পের স্টেট্যাস দিয়েছি কী না? তুমি বল মা একটিবার। তুমি পারবে না মা? তোমার বড় মেয়ে কে আর আমার শাশুড়ি মা কে একটু বুঝিয়ে বলতে সে কথা? 

” আমি কেবল জানি,

রাঁধার পরে খাওয়া, আবার খাওয়ার পরে রাঁধা”   

– তাই না মা?

সেদিন ছাইপাঁশ মনোলগের ফাঁকেফাঁকে কিছুক্ষণ থেকে থেকেই রবিঠাকুরের এই দুটো লাইন বলে ওঠে রাণীয়া। 

দুচোখে জল টলটল করে তার। ভিডিও কলে মা ‘কে দেখাতে ইচ্ছে করে । উপচে পড়ে সেই জলের কণা, হীরের কুচি। ধীরে ধীরে তার গাল বেয়ে নামে। একটা, দুটো, তিনটে…আজ অনেক দিন বাদে কাঁদলো রাণীয়া। 

নাহ! নিজের দুঃখ নিজের কাছেই থাক। মায়ের এখন হাজারো একটা যন্ত্রণা হয়েছে। এইসময় ডাক্তার মন ভালো রাখতে বলেছে তাকে। কুশল সব সময়ই খেয়াল রাখছে। তার বউয়ের মনে যেন ঘুণাক্ষরে কোনও নিম্নচাপ ঘনিয়ে না আসে। 

“বাইশ বছর এক-চাকাতেই বাঁধা।

মনে হচ্ছে সেই চাকাটা — ঐ যে থামল যেন ” 

বাইশ না। থুড়ি বিয়ের মাত্র আট বছর হয়ে ন’য়ে পড়তেই সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে ওরা।  এখন হাইটাইম। নিজের কেরিয়ার হয়েছে। কুশলেরও ব্যাঙ্ক ব্যাল্যান্স বেড়েছে এ ক’ বছরে।  আমেরিকায় বাচ্ছা হওয়া তো মুখের কথা নয়। এক ধাপে সংসার খরচ লাফিয়ে অনেকটাই বেড়ে যাওয়া। তবে রাণীয়ারা থামে না। থামতে শেখেনি। 

“সে যে কখন আসত যেত জানতে পেতেম না যে।

হয়তো মনের মাঝে

সংগোপনে দিত নাড়া”  

হ্যাঁ, আর এমন সংগোপনে কেউ নাড়া দেয়না মেয়েটা কে। সে বোধহয় মিঠি কে একটু বেশীই আপনার ভাবত। মিঠির দিক থেকে সেই রেসিপ্রোকেশনের এক আনাও সে দেখেনি তার বিয়ের পর। তবে কী কুশলের সঙ্গে রাণীয়ার বিয়েটাই? না কি রাণীয়ার নিজস্ব একটা কেরিয়ার গড়া, বাড়ি বসে অবলীলায় রোজগারপাতি আর সবচাইতে বড় কথা হল পরিচিতি। সেটাই কী তবে মিঠির কাছে ঈর্ষার? 

নয়ত অনসূয়া কেন সেদিন রাণীয়া কে হঠাতই বলে বসলেন, “আগ বাড়িয়ে আবার মিঠি কে যেন বলে বোসো না তোমার এই সুখবরটা, বুঝেছ? তোমার তো পেটে মোটেও কথা থাকেনা। দিদি কে কোনও কথা না বললে তো আবার পেট গুলায়” 

রাণীয়া চুপ করে থাকে। বোঝে মা’ ও কী তবে টের পেয়েছে দুই মেয়ের এই টানাপোড়েন? 

– হ্যাঁ রে মিঠি তোকে আর মেসেজও করে না একটা? 

– নাহ! 

– ঘুণাক্ষরেও যেন সে জানতে না পারে যে তুই কনসিভ করেছিস। আমার শাশুড়ি বলতেন, যাদের বাচ্চাকাচ্চা হয়না তারা এমনিতেই একটু হিংসুটে স্বভাবের হয়। আগে ভালোয় ভালোয় তোর সব মিটুক বাবা । একেই তোরা সেদেশে একদম একা তায় আবার এই করোনার পরবর্তী পরিস্থিতি। আবার কখন কী হয়! আমি কাউকে কিছুই আগেভাগে জানাই নি। অনসূয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। 

প্রাণের দিদি মিঠির সঙ্গে রাণীয়ার মনের আদান প্রদান আজ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।  সবকিছু আজ যেন সে হারাতে বসেছে মেয়েটা। রাণীয়া এই একটা ব্যাপারে নিঃস্ব আজ। মায়ের পেটের একমাত্র দিদি তার। একদিন সব ছিল দুই বোনের। জীবনের সঞ্চিত সামান্য নুড়িপাথর, খড়কুটো থেকে হীরেপান্না। সব ছিল দুই বোনের। সব ভাবনাগুলো দুজনের একই সুরে গাইত। একসঙ্গে ওঠাবসা, বেড়ানো, খাওয়াদাওয়া, ফুর্তিফার্তা, ভালোবাসা, মনের কথা, খুনসুটি।  প্রথম দিকে বিদেশে গিয়ে দিদির জন্য  মনকেমন করলেই পুরনো ছবি বের করে হাউহাউ করে কাঁদত তার একলা মহলে বসে । আজ আর সেই কান্না আসেনা। সব শুকিয়ে গেছে। গলার কাছে দলা পাকানো শ্লেষ্মা হয়ে মাঝেমাঝে বেরুতে চাইলেও গিলে নেয় সে। নিজের দুঃখ নিজের কাছেই রেখে দেয়। অন্তঃসলিলা ফল্গুনদীর মত বয়ে চলে সব কান্নাগুলো কে আঁকড়ে ধরে। সেই মিঠি যখন জামশেদপুরের বাড়ি ছেড়ে প্রথমবার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হস্টেল গেল সেবার একলা ঘরে বসে রাণীয়ার চোখে জল দেখলেই মা বলত, আবার কী হল? রাণীয়া লজ্জা পেয়ে বলত, কিছু না তো মা। চোখ দিয়ে জল পড়ে এমনিই। চোখটা দেখাতে হবে বোধহয়। 

“হয়তো পরান রইত চেয়ে যেন রে কার পায়ের শব্দ শুনে,

বিহ্বল ফাল্গুনে।

তুমি আসতে আপিস থেকে, যেতে সন্ধ্যাবেলায়

পাড়ায় কোথা শতরঞ্জ খেলায়।

থাক্‌ সে-কথা।” 

সত্যিই তোলা থাক এসব কথা আজ । দিদির হস্টেল থেকে ফেরার দিনে তার আনন্দ দেখে কে? মায়ের রান্নাঘরেই কতকিছু মন থেকে বানিয়ে ফেলত সে একমাত্র দিদির জন্য। সারপ্রাইজ দেবে দিদি কে। দেখ, আমি কেমন রান্না শিখেছি।  রাণীয়া এখন আর সেসব স্মৃতির জাবর কাটতে চায়না। 

সব বলে গেছেন রবিঠাকুর। সব মানুষের মনের কথা, ব্যথা, মনের ঝড়, তোলপাড়, আনন্দের কথা সব জানতেন এই সর্বজ্ঞ মানুষ। 

আবারও দৃপ্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করে ওঠে রাণীয়া, তার একলা মহলে।  

… 

” জানলা দিয়ে চেয়ে আকাশ পানে / আনন্দে আজ ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছে প্রাণে 

আমি নারী, আমি মহীয়সী / আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎস্না-বীণায় নিদ্রাবিহীন শশী।” 

কে জানে? মা বলত না? ঈশ্বর যা করেন, ভালো র জন্যই করেন। আজ মিঠি তার জীবন থেকে দূরে সরে না গেলে হয়ত জীবনের এতবড় একটা সিদ্ধান্ত সে নিতে পারতোই না। আজ সে খুব আনন্দিত মা হবে বলে। যদিও লেট প্রেগ্ন্যান্সি। ডাক্তার একটু সাবধানে থাকতে বলেছে। তবুও আনন্দ তো হওয়ারই সময়। 

তবে আমেরিকা থেকে নিজের দেশে ফেরা? সেটা আপাতত অধরাই থেকে গেল রাণীয়ার জীবনে। সেই বিখ্যাত এক্স প্লাস ওয়ান সিনড্রোমের চক্করে। কাদের জন্যই বা ফিরবে তারা? যার জন্য এতদিন মন কাঁদত সেই মিঠিই তো বদলে গেছে। যার জন্য জন্মদিনের কেক, মোমবাতি, পায়েসের ছবি তুলত সে, যার জন্য সিনেমা দেখেই রাতবিরেতে  আলোচনায় বসত, যার সঙ্গে মাঝরাত অবধি নেটফ্লিক্সে স্ক্রিন শেয়ার করে পছন্দের মুভি দেখা ছিল, যার সঙ্গে রেস্তোরাঁর খাবারের টেস্ট নিয়ে তর্কের তুফান উঠত? “আমরা” গ্রুপে ওরা বেড়ানোর প্ল্যান করত যে! গ্রুপটা এখন বেশ কিছুদিন মিইয়ে গেছে কেমন। কেউ সেখানে বেশী কথা বলেনা আর। সেই দিদি এখন ধীরে ধীরে সরে এসেছে রাণীয়ার জীবনের ক্লোজ সার্কল থেকে। মা, বাবা, মিঠি, শৈবাল দা, রাণীয়া আর কুশলের নিজস্ব বৃত্ত মানে হোয়াটস্যাপের গ্রুপের অনেক শখে নাম দিয়েছিল রাণীয়া Umbra বা পূর্ণচ্ছায়া । মানে “আমরা” র সঙ্গে কায়দা করে pun করেছিল  ফিজিক্সের ভাষায়। ওদের ইনার সার্কল। এখন সেই বৃত্তে আংশিক ছায়া পড়েছে। অর্থাৎ Umbra  এখন Penumbra । এক চিলতে আলো সেখানে ঢুকে পড়েছে টুক করে একটা ফাঁক দিয়ে। সেই আলোয় জ্বলজ্বল করছে রাণীয়া। মিঠি আজ অনেকটাই দূরে সরে গেছে। সবার থেকে। গ্রুপ সম্ভবত মিউট করে রেখেছে সে। রাণীয়ার কোনও আপডেট সে আর পেতে চায়না বলেই হয়ত। আর শৈবাল দা? সে তো এমন হয়ে যাবে ভাবেনি কেউ। অনসূয়া জানেন সে কারণ। ছেলেরা সংসারে অশান্তির ভয়ে অনেকসময়ই  এমনি করে গা ঢাকা দেয়। নয়ত চাপ বাড়ে। মিঠি কে সেও খুব ভালো চেনে কী না।   

রাণীয়া ছিঁড়ে খুঁড়ে শেষ হয়ে যায় নিজের সঙ্গে নিজেই । কেন এমন নিষ্ঠুর হল ঈশ্বর? কেন দুই বোনের সম্পর্কে এমন ঘুণ ধরিয়ে দিলেন তিনি? তক্ষুনি তার বিবেক নেপথ্যে বলে ওঠে, এমনি তো হয়। তাদের বাবার এত সাঁতার কেটে, শরীর চর্চা করে কী হল?বাবার শরীরও তো দিন দিন খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। 

সবসময় কী সবকিছু নিজের ইচ্ছেয় চলে? মায়ের পেটের দুই বোনের মধ্যে এত ঈর্ষা, অন্তর্দ্বন্দ? এমন করেই তো সব সম্পর্কের তারগুলো ছিঁড়ে যায়। কত বিয়ে ভেঙে যায়। সম্পর্ক বাসি হয়ে গেলে উৎকট গন্ধ ছাড়ে তা থেকে। টেঁকা দায় তখন। তাই নিজেকে গুটিয়ে নিতেই হয়। একজন সরে আসে পরশ্রীকাতরতার দায়ভার বইতে না পেরে। অন্যজন মুক্তি পায়। আরও আরও কাজের দায়ভার নিয়ে। যেন বেঁচে যায়। 

দুটো মনের যে তরঙ্গগুলো এতদিন একই সঙ্গে ওঠানামা করত, ঠিক একই সময় একই সুরে যে গেয়ে উঠত? সেগুলোয় হঠাত করেই তাল কেটে যায়। একজন যখন ইনফ্রা রেডে ভাইব্রেট করে অন্যজন তখন হয়ত ইউভি তে। 

রাণীয়ার মুখে একটু একটু করে আলো ফেলা দেখে অনসূয়া আহ্লাদে আটখানি হয়েছেন যেমন তেমনি মিঠির কর্পোরেট কেরিয়ারে নাম যশ? তাতেও তো সমান খুশি তিনি। এদিকে মেয়েদের শাশুড়ির সঙ্গে শুরু হয়েছে চরম ইগোক্ল্যাশ। তখনি মনে হয় অনসূয়ার। শাশুড়ি কে দোষ দিয়েই বা লাভ কী? রাণীয়ার মায়ের পেটের একমাত্র দিদি? মিঠিও তো জীবনে কোনোদিনও ছেড়ে কথা বলেনি তার মায়ের পেটের একমাত্র বোন রাণীয়া কে। অতএব অনসূয়া আজ কাউকেও দোষ দেন না। দোষ দেন নিজের কপাল কে। নয়ত তাদের দুই মেয়ে, জামাই মিলে একসঙ্গে এতগুলো মানুষের হোয়াটস্যাপ গ্রুপ আজ নিশুতি রাতেও আর জেগে ওঠেনা? আগের মত।  মিঠির মুখে কুলুপ। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এভাবেই তার নিষ্ক্রিয়তায় রক্তাক্ত অনসূয়ার মনের ভেতরটা। সেইসঙ্গে রাণীয়াও ভেঙ্গেচুরে শেষ হয়ে যায়।  

কর্পোরেট দুনিয়ার শিখরে উঠে কোম্পানির রাণী হয়েছে মিঠি?  না কী  ফুড ইভেঞ্জালিস্ট হয়ে ডিজিটাল মিডিয়ার সেলিব্রিটি রাণীয়া আজ বিশ্বের কুইন অফ হার্টস হয়েছে? কত ফ্যান ফলোয়ার তার! তবে? দুই মেয়েই তো তাঁর জিতেছে। কেউ তো হারেনি। তবুও তাদের মধ্যে আজ কত দূরত্ব! অনসূয়া ভেবেই চলেন সাতপাঁচ। 

রাণীয়া ছলছল চোখে এগিয়ে যায় কুশল আর তার শখের মিনিবারের দিকে। সে রাতে সম্পূর্ণ একলা রাণীয়া । নিজেকে সেদিন যেন আরও একা লাগে তার একলা মহলে। কুশল আজ অনেক রাতে ফিরবে। তার অফিসের কাজের খুব চাপ চলছে । জানিয়ে দিয়েছে আগেভাগেই। 

তাদের দুজনের শৌখিন কাচের মিনিবারের ওপরের দেওয়ালে ঝুলছে শান্তিনিকেতনি বাটিকের মোটিফে সরস্বতীর একঘর আলো করা উজ্জ্বল ছবি। সাপ্তাহিক সিঙ্গল মল্টের মৌতাতে মেতে ওঠা তাদের বাড়ির এই সুখী গৃহকোণটির নাম কুশল দিয়েছে সরস্বতী বার। রাণীয়া কাচের দরজা খুলেই র’ ইথাইলের গন্ধ নেয় সুদৃশ্য বোতল খুলে। তারপরেই  সোজা মুখে চালান করে দেয় কিছুটা। পরক্ষ্ণেই মনে পড়ে যায় ডাক্তার বারণ করেছে। প্রেগ্ন্যান্সি তে মদ্যপান এক্কেবারে মানা। নিজের কান মলে। ভুল হয়েছে। আর খাবেনা কোনোদিনও। এলিয়ে দেয় শরীরটা। মাথায় আসছিল কয়েকটা লাইন দিন কয়েক ধরে। আগে সে কবিতা লিখত মাঝেমধ্যে দু-চার লাইন। এখন ক্ষত বিক্ষত মনের ভার লাঘব করতে প্রায়ই মাথায় আসছে। সেগুলোকে লালন করছে সে। রীতিমত প্রশ্রয়ও দিচ্ছে। সাদা কাগজে লেখে আর কাটতেই থাকে মেয়েটা। কিছুতেই আর কবিতা হয় না সেগুলো। বিয়ের আগে মিঠি তার বোনের এই কবিতায় পাওয়াকেও একদিন  ঢং বলে বিদ্রূপ করেছিল। সেইসঙ্গে বোকাবোকা, ন্যাকান্যাকাও বলেছিল। দিব্য মনে পড়ে রাণীয়ার। তাই বুঝি কবিতা লেখাই ছেড়ে দিয়েছিল সে। অথবা কবিতা তাকে ছেড়ে চলে গেছিল জন্মের মত। জানেনা সে। সে সব হিসেবনিকেশ করতেও মন চায়না।  কিন্তু আজ সে চাইছে দীর্ঘদিন পর কবিতা লিখতে। তাকে লিখতে হবেই আজ । হালকা হবে বলেই হয়ত। অবশেষে কাটাকুটি খেলতে খেলতে সে একসময় ঠিক লিখেই ফেলে বেশ ক’টা লাইন। লিখেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে রাণীয়া। 

  

এক যে ছিল একলা মেয়ের একলা হেঁশেলঘর

একজনা সে বড্ড আপন, একদিন হল পর।

এক যে ছিল একলা মেয়ের একলা দুপুরবেলা

একজনা তার একটা দিদি, ছিল পুতুলবেলা।

একলা মেয়ের একলা মহল, দুচোখ জুড়ে কান্না

একলা মেয়ের গল্পবলা, ভুলে থাকার রান্না। 

এক যে ছিল মায়ের সাথে, একটা চাঁদের হাট

একটা, দুটো, অনেক রান্না, মায়ের রাজ্যপাট।

একলা ঘরে, একটা দিদি, একটা বোনের গপ্পো

এক, দুই, তিন সব কথারাও হারিয়ে হল অল্প। 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত