| 26 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প পুনঃপাঠ সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

ইরাবতী পুনর্পাঠ: একটি প্রতিশোধের কাহিনী । গৌরকিশোর ঘোষ

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষের জন্ম শতবর্ষে ইরাবতী পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।


সেলুনটাতে ভিড় দেখে মাজাজ বেজায় খিঁচড়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় ঠিক কী! চলে যাবার উপায় নেই, এই আধটি ঘণ্টাই যা ফুসরত। তারপরই তো জুড়ে যেতে হবে ভবের গাছে।
মেঘলা আকাশ। বেশ খানিটা বৃষ্টি ঝরে এখন একটু ধরেছে। গলিটা প্যাঁচ প্যাঁচ করছে কাদায়। চটিটার কাদাভেজা শুকতলায় পা লাগছে আর সিরসির করে উঠছে সর্ব শরীর। বিরক্তির হাত এড়াতে মোক্ষম দাওয়াই হচ্ছে চুরুট। চুরুট কিনতে মোড়ের সিগারেটের দোকানে গেলাম। চুরুটটি ধরিয়ে দুটো টান দিতেই মেজাজটা বশে এসে গেল। বেশ ভাল ঠেকতে লাগল মেঘলা দিনের ঠাণ্ডা-বাতাস-গায়ে-লাগা আবহাওয়া। চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলাম শ্রাবণের আকাশে মেঘের ঘন সমারোহটি।
কখন যেন আনমনা হয়ে গিয়েছিলান। হঠাৎ চমকে গেলাম আচমকা সম্বোধনে।
আরে, বাবুমশাই যে!
চেয়ে দেখি শশী আচার্যি। ঠিক অবিকল আগের চেহারাই বজায় আছে। তেমনি রোগা পাকাটে। কপালে ত্রিবলী রেখা। গর্তে-ঢোকা চোখ। হাতে একটা মস্ত আতস কাঁচ আর গোটা পাঁচেক পুরনো পঞ্জিকা।
কী বাবুমশাই, চিনতে পারছেন না?’
একটু ম্লান হেসে বলল।
বিলক্ষণ, তোমাকে চিনব না, বল কী হে?’
অন্তরঙ্গ সুর এনে আমি বলি, বলতে কী ওকে দেখে আমি খুশি হই খানিকটা।
জিজ্ঞেস করি, ব্যবসাটা চলছে কী রকম?’
শশী একগাল হেসে বলে, আজকাল একটু ভালই চলছে। আপনাদের আশীর্বাদ। পাড়াটা আবার জমে উঠেছে কিনা। যজমান অনেক বেড়ে গিয়েছে। মাগীদের পুজো-আর্চাও বেড়েছে কিছুটা।
বলেই গলির দিকে একটু নজর দেয়। প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটটার ভেতর যতদূর দৃষ্টি চলে হাতরে নিই।
শশী আচার্চা বেশ্যাদের পুরুত। শশী-পুরুতের পসার শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের মুখ থেকে আমহার্স্ট স্ট্রিট পর্যন্ত একচ্ছত্র। বেশ্যাদের পরলোকের পথে যাত্রা জমাবার ওই একমাত্র কোচওয়ান। এছাড়া হাত দেখা এবং মেয়েদের দালালি করাও ওর পেশা। এক বড়লোক বন্ধু জৈব কামনা নিবৃত্তির বাসনায় একদিন এ গলিতে পা দিয়েছিলেন। সঙ্গে আমিও ছিলাম। সেদিন ও-ই ছিল আমাদের পথ-প্রদর্শক। এ বিষয়ে ওর জুড়ি এ তল্লাটে পাওয়া ভার। অন্তত অভিজ্ঞ পথিকদের ধারণা যে মিথ্যে নয়, নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই তা বলতে পারি। আমাকে সেদিন শশী এমন মেয়েমানুষ একটা জুটিয়ে দিয়েছিল যে আমার সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পাকা দুবছর সময় লেগেছিল। সত্যি বলতে সৈরভীর আকর্ষণ এখনও যেন নাড়া দেয়।
চলো শশী, চায়ের দোকানে বসি।
আমি ওকে ডাক দিই।
হেঁ-হেঁ, বাবুমশাই চিরদিনই আমার উপর সদয়।
শশী বিগলিত হয়ে হাসতে থাকে।
চায়ের টেবিলে বসে চুমুক দিই। বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার।
এমন দিনে চা বড় পানসে লাগে। একটু খাঁটি হলে ভাল হত। কী বলেন বাবুমশাই! চায়ে সব সময় কেমন যেন শানায় না।
শশী সমর্থনের আশায় আমার দিকে তাকায়। আমি উৎফুল্ল হয়ে উঠি। এই জন্যই শশীকে আমার এতো ভাল লাগে। ঠিক মেজাজ বুঝে দাওয়াই বাতলাতে ওর জুড়ি দেখিনি।
খাসা বলেছ শশী। আজ যা একখানা দিন। একটু চাঙ্গা হতে পারলে বেশ হত।
আমার সমর্থনে শশীর উৎসাহ বেড়ে যায়।
সে বলে ওঠে,  তবে চলেন না বাবুমশাই, ঘনা সা-র ওখেনে। আঃ, অমন জমাটি জায়গা আর দুটি আর নেই।
শুনে ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে ওঠে। কিন্তু পকেটের কথা স্মরণ হতেই তা আবার তক্ষুণি মিইয়ে যায়।
বলি,  আজ থাক শশী। মাসের শেষ কিনা।
শশী বলে অঠে, তাতে কী হয়েছে, ও-মাসে দেবেন। এ শর্মা থাকলে এ পাড়ার সবই ধারে পাওয়া যায়। আপনাদের আশীর্বাদে এ পাড়ায় শশী পুরুতের একটা ক্রেডিট আছে।
ইংরেজি ক্রেডিট শব্দটির অপভ্রংশের উপর অনাবশ্যক জোর দিয়ে বলে ওঠে। এর উপর আররকথা চলে না। চায়ের দাম চুকিয়ে দিয়ে দুজনে চলতে শুরু করি ঘনা সা-র দোকানমুখো।
রাস্তায় যেতে যেতে শশী বলে, কোই, আর তো আসেন না সৈরভীর ওখেনে।
না, একে কাজকর্মের চাপ, তার ওপর পয়সাকড়ির টানাটানি, বুঝতেই পার।
তা বটে।
শশী মাথাটা ঝাঁকিয়ে সমর্থন করে। তারপর খানিকটা চুপচাপ চলার পর হঠাৎ ওঠে, তা গেলেই পারেন দু-একদিন। মাগীটার কেমন যেন একটা টান পড়ে গিয়েছিল আপনার ওপর।
হঠাৎ বলে ফেলি,  আচ্ছা, যাব একদিন।
হ্যাঁ, যাবেন। বলেই শশী চুপ মেরে যায়।
ঘনা সা আমাদের দুজনকে দেখেই উঠে আসে।
আসুন আসুন, এস হে পুরুত।
দোকানের ভেতর ঢুকে যাই। ভেতরটা ঝাপ্সা অন্ধকার, জায়গাও কম। তবু এলকোহলের গন্ধে মেজাজটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। অনেক দিন পরে দোকানটাতে আবার ঢুকলাম।
সা মশাই, খুব খাঁটি এনো কিন্তু, ঠকিও না বামুনের ছেলেকে এই বিষ্যুতবারের দিনে। “
 তোমাকে যে মদে ঠকাবে সে তো মায়ের গভভে হে পুরুত মশাই।”
সা ওধার থেকে বলে ওঠে।
একটা মাতাল জড়িত কণ্ঠে যোগান দেয়, “হ্যাঁ হ্যাঁ বাও, শশী এক্সপার্ট লোক। বোতলের ওজন দেখে আসল কি নকল বুঝতে পারে। ওখানে চালাকি না ব্রাদাররর।”
শশী আত্মপ্রসাদের হাসি হাসে।
বলে, “ হেঁ-হেঁ, আপনাদের আশীর্বাদে বারো বছর বয়েস থেকে নেশা করতে লেগেছি।”
ক্রমে ক্রমে একথা সেকথার পর নেশা জমতে থাকে। গলা দিয়ে মদ যত চুঁইয়ে পড়ে পেট তত আলগা হয়ে ওঠে আমার। শশীর কিন্তু কোনও পরিবর্তন নেই।
সে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে, “বিয়ে করেছেন?” 
নাঃ,” জবাব দিই।
কেন বাবুমশাই বিয়ে করেননি?”
পয়সা কোথায়? খাওয়াব কী?”
তা যা বলেছেন। এ তো ভাড়া করা মেয়েলোক নয় যে পয়সা থাকল গেলাম। নচেৎ কেটে পড়লাম। তোমার পয়সা থাক বা না থাক তোমার মাগকে বাওয়া খ্যাঁটন জুটিয়ে যেতেই হবে। কী বলেন?”
আমার কথা শেষ না হতেই ওপাশের মাতালটি কথা লুফে নিয়ে বলতে শুরু করেছে। সমর্থনের আশায় আমাকে প্রশ্নটা করেই আবার ঢলে পড়ল। বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “ বিয়ে অত সোজা কাজ নয়।”
শশী যেন সে কথায় কান দিল না।
বলল, “তবু পরিবার হল একটা আলাদা জিনিস। তার কাছে যা পাওয়া যায় ভাড়া-করা মাগের কাছে কি তা মেলে?”
তারপর হঠাৎ চুপ করে গেল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলে উঠল, আর বয়েস হয়ে পড়েছে, এখন আর নতুন করে আরম্ভ করার উপায় নেই।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গ্লাসে চুমুক দিতে থাকে। বাইরের বিষণ্ণ আবহাওয়া ওর মুখে-চোখে-নাকে ভর করেছে। বেশ্যার দালালও ভাবুক হয়ে উঠেছে। মদের কী আশ্চর্য মহিমা! শশীর রূপান্তর হচ্ছে।
তা হলে একটা আশ্চর্য খবর বলি আপনাকে।” শশী নড়েচড়ে ঠিক হয়ে বসে, তারপর সা-কে হুকুম করে, “সা মশাই, আধ গেলাস বিলিতি দাও।”
সা মদ দিয়ে যায়। শশী একটু একটু করে সেটা ঝিম মেরে বসে থাকে। 
তারপর বলে, জানেন বাবু মশাই, সৈরভী হচ্ছে আমার পরিবার।”
আমি চমকে উঠি, “পরিবার!”
আজ্ঞে হ্যাঁ, “শশী ম্লান হেসে বলে,”তবে বিয়ে করা নয়। ওকে নিয়ে আমি ভেগে আসি কলকাতায়। সে আজ পনেরো বছর হল, আরও মজা কী জানেন, বয়সে ও আমার মেয়ের মতোই ধরতে গেলে। কিন্তু কী বিধিলিপি দেখুন, আমারই সাথে ও সব ছাড়ল। শুধু তাই নয়, আমরা পাঁচ বচ্ছর ঘর করেছি স্বোয়ামি ইস্তিরির মতো। তারপর খালি পেটে আর পিরিত কতদিন চলে বলুন? একদিন ট্যাঁকে টান পড়ল। তারপর কোমে কোমে‘, বুঝলেন না। ও সা মশাই, আনো হে আর আধ গেলাস।
সা মদ ঢেলে দিতেই শশী এবারে এক ঢোঁকেই তা শেষ করে দিল। মুখটা হাতের চেটো দিয়ে মুছে আবার শুরু করল।
হঠাৎ একটু হেসে নিয়ে বলল লাগল, “ অথচ মজা কী জানেন, ও কিন্তু কিছুতেই এ পথে আসতে চায়নি। কত কসরত কত মেহনত কিন্তু কিছুতেই লাগাম পরতে চায় না। তবে আমিও শশী আচার্যি। স্বনামখ্যাত রঘু আচার্যির বংশে জন্ম। রঘু আচার্যি ছিলেন বাগদমলার সাত আনির দেওয়ান। যার বুদ্ধিবলে বৃটিশকে পর্যন্ত ঘোল খেতে হয়েছিল।”
শশী তার স্বনামখ্যাত ঐতিহাসিক পূর্বপুরুষকে দু হাত তুলে প্রণাম করল।
তারপর শুরু করল, সেই মহাপুরুষের সন্তান আমি। বাবা বলতেন, তাঁর চেহারার সাথেও নাকি আমার চেহারার খুব মিল। আমার সাথে টেক্কা দেবে একটা মেয়েমানুষ। ওল যত বড়ই হোক তবু মাটির নিচেই থাকে, বুঝলেন। একদিন কৌশল করে দিলাম মদ খাইয়ে বেশ করে। নেশাটা জমে উঠতেই ওর ঘরে একজনকে ঢুকিয়ে দিলাম শিকল তুলে। খদ্দেরও ঠিক ছিল। আপনি তো ওর চেহারা দেখেছেন। বয়সকালে আরও খাস্তা ছিল। মুনির মন টলে যেত। অনেক বড় বড় লোক আমার হাতে টাকা গুঁজে দিয়েছে কতবার। কিন্তু বাগে আনতে পারিনি। আমি আশ্চর্য হই বাবুমশাই এই ভেবে যে, ও-মেয়ের মন আমায় দেখে মজল কী করে? যা হোক, সে রাত তো রঙে রঙে কাটল। ভোর রাতের দিকে দুমদাম হইচই চিৎকারে বাড়ির লোক জড় হয়ে গেল। ভেতর থেকে মারামারির শব্দ পেয়ে শিকল খুলে দিলাম। আলুথালু বেশে সৈরভি প্রায় ন্যাংটো হয়েই ঘর থেকে বেরোল। দেখি ওর বাঁ গাল দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে গলগল করে। কামড়ের দাগ স্পষ্ট হয়ে রয়েছে। ওই যে কালো দাগটা দেখেন, সেইটে। আমাকে দেখেই যেন ওর চোখ দিয়ে আগুন ছুটতে লাগল। ক্ষ্যামতা থাকলে ভস্মই করে দিত বোধ হয়। ভুতে-পাওয়া মেয়ের মতো দাঁত কিড়মিড় করে বলল, হারামজাদা, তুই আমাকে নষ্ট করলি! শেষ পর্যন্ত নষ্ট করলি বিশ্বাসঘাতক! যদি দিন পাই আমি এর সুদে আসলে আদায় করব। বলেই ছুটে পাশের একটা ঘরে ঘরে ঢুকে গেল। ঘরের ভেতর গোঙানি শুনে দেখি সেই হারামজাদা যন্তন্নায় ঘেংড়ি পিটছে। সৈরভী বোতল মেরে ওর মাথা ফাঁক করে দিয়েছে।
একটু থামল শশী।
সা-কে হুকুম করল, 
বেশ, দাও হে, একটু কড়া রকমের দাও। দিশিই না হয় দাও। পুরো বোতলই দাও। আজ একটু দমকা খরচা করে দিই। যা হয় হবে।
একটুও গলা কাঁপছে না শশীর। একটুও বেচাল হয়নি সে। সা বোতল নিয়ে এল এবার। আমার দিকে চেয়ে চেয়ে বলল, বাবু আপনাকে?
আমার হয়ে গিয়েছিল।
মাথা নেড়ে বললাম, 
নাঃ, আর না।
শশী বোতল থেকে একটু ঢেলে নিয়ে খেল।
সেদিন সৈরভীর কাণ্ড দেখে আমার হাসি এল। আমার সাথে বেরিয়ে এলি তাতে জাত গেল না। আর অন্য লোক ঢুকতেই তোর জাত ছুট হল! কত রকম লোক যে দেখলাম ভুবনে তার ঠিক নেই। সাতান্নটা মেয়ের সাবিত্তি ভেঙে দিয়েছি বাবুমশাই। নতুন নতুন অনেক শর্মাই নানা রকম বলে থেকে। কাঁদে শাপমন্য দেয়। আমি হাসি। বেশ্যার শাপে বামুন হবে খোঁড়া? হুঁ! কত দেখলাম পোথোম পোথোম ফোঁস ফোঁস। দুদিন বাদে সেই জলবত্তরলং। আপনি নিজ চোখেই তো দেখেছেন সৈরভীর পরেকার ব্যাভার। মেয়ে-লোকেরা যেন রবাটের ফিতে। যে মাপে লাগাও তাতেই লেগে যায়। আবার বলে কিনা পোতিশোধ নোব। হুঁ, কতদিন খদ্দের না জুটলে আমাকেই দালালি করতে ডেকেছে পরে।
আরও হয়ত কিছু বলত শশী। বাধা পড়ল একটা মোটা মেয়েলোকের চিৎকারে।
অ পুরুত, তুমি এখেনে মুখপোড়া, উদিকে আমি তিভোবন খুঁজে খুঁজে হয়রান।
শশী একটু হেসে বলল, বর্ষার দিন একটু চানকে দিচ্ছি। তা তোমার দরকারটা কী? পারিশ্চিত্তির করাবে নাকি?
আ মরণ, আমি পারিচিত্তির করাব কোন দুঃখে। পারিচিত্তির করাবে মটরী। যাও একটু শিগগির করে, ও না খেয়ে বসে আছে তোমার পিত্যেশে।
খর খর করে উঠল মাগীটা।
কেন, মটরের কী হল আবার?
কী আবার হবে গো? ওর সেই সেই মোছনমান বাবুটা এইছিল না কাল রাতে, তাই। ওর আবার যা ছুঁচিবাই। খদ্দেরেরও জাত দেখে। মরণ! কথায় বলে না খদ্দের না নক্কি।
গড়গড় করে আরও হয়ত বলত কিছু, শশী উঠ পড়াতে থেমে গেল।
শশী ম্লান হেসে বলল,
আচ্ছা, যাই তবে, কাজটা সেরেই আসি। ও সা-মশাই, দামটা আমি দোব।
আমিও উঠে পড়লাম।
নামতে নামতে শশী ফিসফিস করে বলল, 
সৈরভীর দিনকাল বড় মন্দা যাচ্ছে। খিটখিটে হয়ে পড়েছে। যাবেন একদিন। খুশি হবে। আপনার ওপর ওর একটু মায়া পড়েছিল। আচ্ছা, যাই।
ম্লান হেসে শশী চলে গেল।
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। এর মধ্যে আর শশীর পাত্তা করতে পারিনি। এক দিন দুপুরবেলা। প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট দিয়ে আসছি, সৈরভীর বাড়িটার কাছে এসেই কী মনে হল ঢুকে পড়লাম। ভেতরে ঢুকেই বুঝলাম, সে বাড়ি আর নেই। এদিকে ওদিক চাইতেই একটা ঘরের ভেতর থেকে গামছা পরে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন,  কারে চাই? কথায় পুর্ববঙ্গীয় টান।
বললাম, বিশেষ কাউকে নয়, আমার এক বন্ধু থাকত, তাই—“
কথাটা কেড়ে নিয়েই বললেন,  বন্ধু, কে বন্ধু?
থমথম খেয়ে বললাম, তার নাম শশী।
ভদ্রলোক চিন্তা করে বললেন, হে নামে কেউরে চিনি না।
তাহলে বোধ হয় উঠে গেছে। আপনারা কতদিন হল এখানে এসেছেন?
আমি জিজ্ঞাসা করি।
তা মাস পাঁচ ছয় অইবে। ভদ্রলোক  জবাব দেন।
তা এখানে থাকেন, উৎপাত করে না কেউ। মানে পাড়াটা তো তেমন সুবিধের নয়।
আমাকে থামিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক বলেন,  হে তো জানি। যাই কোনখানডায়! কইলকাতায় কি বাড়ি মেলে? তবে একডা কম্ম করিয়া রাখছি। বাইরে একদা বিজ্ঞাপন ঝোলাইয়া দিছিইহা ভদ্রলুকের বাড়ি।
আমি পথে নেমে পড়ি। বেরিয়ে যাবার সময় সত্যিই একটা সাইনবোর্ড নজরে পড়েসাবধান, কেহ ঢুকিবেন না। ইহা ভদ্রলোকের বাড়ি। এটা যেন জীবন্ত কার্টুন বলে আমার মনে হয়।

দিন দশ-বারো পরে সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরছিলাম। শর্টকাট করবার জন্য হাড়কাটা গলির মধ্যে দিয়ে চলতে শুরু করলাম। হঠাৎ একটা বাড়ি থেকে শশীকে বেরোতে দেখে ডাক দিলাম।
শশী যে!
আমাকে দেখেই শশী হেসে ফেলল।
বলল, 
সৈরভী এখন এই বাড়িতেই থাকে। দেখা করবেন নাকি? তবে দাঁড়ান খবর দিই।
বলে, আমাকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই শশী ভেতরে ঢুকে গেল। অগত্যা দাঁড়িয়ে রইলাম।
খানিক পরে ফিরে এসে বলল, দাঁড়ান একটু, ও ডাকলে পরে ভেতরে যাবেন। যা মেজাজ হচ্ছে ওর দিন দিন। বয়েস বাড়বার সাথে সাথে ছ্যাবলাও হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গদোষ বুঝলেন না, ভদ্দরলোকেরা তো আর আসে না এখন। ছোটলোকদের সহবাস করে আর কত ভাল হবে বলুন? দেখলেই বুঝবেন সে জলুস আর নেই। কী একখানা বাঁধুনি ছিল মশাই! যেন টাইট বাঁধাকপি একখান।
দরজার ফাঁকের দিকে চেয়ে আচমকা থেমে গেল শশী।
ফিসফিস করে বলল, 
দেখুন দেখুন।
একটা অপরূপ কচিমুখ দরজা দিয়ে উঁকি মেরে শশীকে ইশারায় ডাকল। শশী তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে পরামর্শ করতে লাগল। কিসের ছোঁয়া লেগে শশীর কদাকার মুখটাও যেন সুন্দর হয়ে উঠল।
খানিক পরে শশী আমাকে ডাকল। ওর পেছনে পেছনে বাড়ির ভিতর গিয়ে ঢুকলাম।
উঠোনটা ভয়ানক নোংরা। গাদা করা উনুনের ছাই, পচা আনাজের খোসা, মাছের আঁশ, নাড়ি ভুঁড়ি, জল ভরা-ভরা ডিমের খোলা
সব মিলে একটা শ্বাসরোধী বোটকা নিরেট দুর্গগন্ধ। অন্য কোনোদিকে বেরোবার পথা না পেয়ে ওত পেতে আছে, অনখা লোক পেলেই তার নাকে ঢুকে পরে। তাড়াতাড়ি একটা ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। আমাকে দেখে সৈরভী এগিয়ে এল। তিন বছর পরে সঈরভিকে দেখলাম। অনেক রোগা হয়ে গেছে। মাথার সামনের দিক থেকে কিছুটা চুল উঠে কপাল চওড়া হয়েছে। তবুও সেই সন্ধ্যার ম্লান আলোয় বিষাদময়ী সৈরভীর রূপটা কেন জানি আমার ভালই লাগল। যৌন কামনা জাগল না, নিছক একটা আনন্দ দিল।
হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, 
কেমন আছো সৌরভ?
ওকে নিয়ে উন্মত্ত হয়েছিলাম যখন, তখন ওকে আদর করে এই নামে ডাকতাম। সৈরভীর মুখটা দেখতে দেখতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
সুন্দর করে হেসে বলল, তা হলে তুমি ভোলনি বাবু!
ওর স্বর দিয়ে খুশি উপচে পড়তে লাগল। ঘরখানা ঝাড়া পোছা করা। ঘরে আর কোনও আসবাব নেই। একটা ট্রাঙ্ক আর তক্তপোশ। বিছানার উপর পরিস্কার এমব্রয়ডারি-করা কাচানো চাদর পাতা।
জিজ্ঞাসা করলাম, 
দিনকাল কেমন চলছে?
যেমন দেখছ।
নিস্পৃহ স্বরে যেন জবাবটা দিল।
বললাম, 
দেখে শুনে তো মনে হচ্ছে ভালই।
তাহলে ভালই।
কেমন যেন ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ওর জবাবটা। এদিক-ওদিক চাইতেই ওর শাড়িটার দিকে নজর পরে গেল।
আপনা থেকেই বলে উঠলাম, 
আরে সেই জারফরানি রঙ! ঠিক বেছে আজ পরেছ তো! দেখি দেখি! আরে, খয়েরি টিপটাও যে আছে। তবে তো তুমিও ভোলোনি!
তুমি আমার ভালবাসার লোক। আমি ভুলি কী করে? আমাদের যে মুখস্থ করে রাখতে হয় এসব। আর তাই কী ছাই একরকম, হাজার লোকের হাজার লোকের শখ, হাজার রকম বায়না, পান থেকে চুন খসবার উপায় নেই। সব মনে রাখতে হয়, টুকিটাকিটা পর্যন্ত। হি-হি-হি-হি।
কেমন যেন অস্বাভাবিক হাসি হাসতে লাগল। পাকা বেশ্যাদের গলায় কেমন একটা খনখনে ধাতব আওয়াজ হয়। সত্যি সৈরভী ছ্যাবলাই হয়ে গেছে বটে। মনে বড় কষ্ট হতে লাগল।
খানিক পরে শশী ঘরে ঢুকল। হাতে খাবারের পেলেট। পিছনে চায়ের কাপ হাতে করে ঢুকল সেই সুশ্রী মেয়েটি। ছিপছিপে গড়ন, শ্যামবর্ণ, পাতলা ঠোঁট, ভাসা-ভাসা ডাগর দুটি চোখ, ভীরু, সন্ত্রস্ত ভাব, বক্ষ দুটি এখনও পরিপুষ্ট হয়নি। মেয়েটিকে দেখে আমার যেন মায়া পড়ে গেল। সৈরভীকে জিজ্ঞাসা করতে সে জবাব দিল, ওটি তার পালিতা মেয়ে।
বললাম,
বেশ মেয়েটি, কী নাম ওর?
বলেই সৈরভীর দিকে চাইলাম, দেখি ওর চোখ দুটো যেন জ্বলছে।
শশী তাড়াতাড়ি বলে উঠল, বল মা, নাম বল।
সৈরভী হঠাৎ যেন খেপে গেল। দাঁত কিড়মিড় করে কড়া স্বরে ওকে আদেশ করল, যা, হারামজাদি, নচ্ছার, ও ঘরে যা।
মেয়েটি ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে চলে গেল। শশীও বেরিয়ে গেল।
সৈরভীকে মনে হল যেন রোঁয়া-ওঠা খেঁকি কুকুর। এক মুহূর্তে মনটা খিঁচড়ে গেল।
বললাম, তুমি তো খুব নিষ্ঠুর।
সৈরভীর মুখ ব্যঙ্গের হাসিতে ভরে গেল।
ওর সেই কালশিটে-পড়া গালটায় একটা টোল খেল।
তারপর খন খন করে বলল, ওরে আমার পিরিতের গোঁসাই রে! ছুঁড়ি দেখলেই মন ছুঁক ছুঁক করে, না?
সৈরভী তো এরকম ছিল না। এত নীচ হয়ে গেল কী করে? জবাব না দিয়ে বিছানার চাদরটার দিকে চেয়ে রিলাম। হঠাৎ নজরে পড়ল এক কোণে লেখা আছে : পারুল।
যে অস্বস্তির মধ্যে আচমকা পড়েছি, তার থেকে রেহাই পাবার জন্য সৈরভীকে জিজ্ঞাসা করলাম, 
পারুল কে?
সৈরভী চমকে উঠে বলল,  তা দিয়ে তোমার দরকার কী?
বারে বারেই সৈরভী আজকে বড় আঘাত দিচ্ছে। কেন? দুত্তোর বলে উঠে পড়লাম।
বললাম, 
উঠি তা হলে। সৈরভী আবার চমকে উঠল।
সে কী, এর মধ্যে?
সঙ্গে সঙ্গে গলা ধরে এল।
রাগ করলে? মেজাজটা বড় খারাপ, কিছু মনে কোরো না মাইরি। কতদিন পরে এলে, তোমাকে আদর করব, না গালই দিলাম শুধু শুধু।
বলেই ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল।
বলল, 
পারুল হচ্ছে পাশের বাড়ির একটা মেয়ে, আমার ছিক্ষেত্তর। এই বিছানার চাদরটা ওর কাছ থেকে ধার এনেছি। এই শাড়িটাও ওর। এ সব কিছুই আমার না। আমার আর কিছু নেই। সব ধার করা। শুধু তোমার জন্য পরেছি এগুলো। জানি তুমি এ-সব ভালবাস, তাই তোমার মন রাখতেই এগুলো ধার করে এনেছি। এই দেখ আমার আসল চেহারা।
সৈরভী আবার খেপে উঠল। ভাঙা ট্রাঙ্ক খুলে আধময়লা হলদে শাড়ি, ছেঁড়ে ব্লাউজ বের করে মেঝেতে ফেলতে লাগল। এক টান মেরে বিছানার চাদরটা ছুঁড়ে ফেলল। ময়লা তেলচিটে গন্ধওলা একটা বিছানা বেরিয়ে পড়ল। কাঁথাটা ছেড়া, আড়হীন বালিশ। ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল সৈরিভী। হঠাৎ এক ধাক্কায় সৈরভী আমাকে অন্য এক জগতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। চোখের সামনে দেখলাম এক সাদা হাড়ের কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে। কাঁদছে। ওর উপর বিরক্ত হওয়াও নিষ্ঠুরতা। পিঠে হাত বুলিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। আমার বুকের উপর মাথা গুঁজে ও কাঁদতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে একটা বিজবিজে অনুভূতিও আমাকে জড়িয়ে ধরল।
খানিক পরে ও একটু শান্ত হতেই আমি বললাম, 
এবার আসি সৌরভ।
একটু ম্লান হেসে বলল, আবার আসবে তো? শুনলাম তুমি নাকি পয়সার জন্য আস না। পয়সাকড়ির জন্য কিছু আটকাবে না। শুধু হাতে আসতে যদি লজা করে, পয়সা দিয়েই এসো না হয়। সে আগেকার দিন আর নেই। এখন আমার দরকার খুব কম।
একটু বিচিত্র ভাবে হাসল ও ক্রোধ, বঞ্চনা, বিদ্রুপ সব মিশে ওর মুখখানা একটা বিচিত্র আকার ধারণ করল।
বিড় বিড় করে সে বলতে লাগল,  আমি এখন খুব সস্তা হয়ে গিয়েছি বাবু। আমার মাথা খাও, মরা মুখ দেখ যদি না আসো। তোমরা মাঝে মাঝে এলে, তোমাদের মতো লোক আমার বাবু ছিলে, সেটা অন্য মাগীদের দেখাতে পারি। আর তাতে আমি এই নরকযন্ত্রণা, এই অভাব সব ভুলে থাকতে পারি।
আন্তরিক ভাবেই বললাম, আসব, ঠিক আসব।
তাড়াতাড়ি দরজার দিকে পা বাড়ালাম।
দরজার কাছে আসতেই সে মেয়েটি আমার পায়ের উপর ঢিপ করে এক প্রণাম করে এক নিশ্বাসে বলে উঠল,
 আমার নাম পুষ্প। বলেই একছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি, এমন সময় শশী আমার পেছনে এসে ফিস ফিস করে বলল, ও ওর মাকে ভয় করে কিনা, তাই পালিয়ে গেল। এমন সুন্দর মেয়েটাকে হারামজাদী মাগী দু চক্ষে দেখতে পারে না। কী রকম মা একবার বলুন তো!
জিজ্ঞাসা করলাম, মেয়েটা আসলে কার?
শশী বলল, আমাদেরই। পালা-টালা নয়, রীতিমত গভভের সন্তান। বলে কী, পুষেছি! হারামজাদীর ছেনালী দেখলে গা জ্বলে। কলকাতায় আসবার দেড় বছর পর ও হয়। হাসপাতালের খাতায় লেখা আছে সব। মাগীটা ওকে দেখতেই পারে না মোটে।
সেদিন চলে এলাম খুব বিস্মিত হয়েই।
তারপর দু মাস কেটে গেছে। নানান কাজে জড়িয়ে পড়ে সৈরভীর কথা আর মনে রাখতে পারিনি। যাওয়াও হয়নি অনেক দিন। নতুন একটা দৈনিক কাগজ বার হচ্ছে, তার খুব খাটুনি পড়েছে অত্যাধিক। একদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে এসে অকাতরে ঘুম দিচ্ছি। অনেক রাত্রে কাদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল। দরজার উপর দড়াম দড়াম আওয়াজ। যেন ভেঙ্গে পড়বে দরজাটা।
সাড়া দিলাম, 
কে?
শুনতে পেলাম পাশের ঘরের মিস্ত্রি মশাইয়ের উত্তেজিত স্বর, ও মশাই, শিগগিরি দরজাটা খুলুন।
ওর গলায় একরাশ উৎকণ্ঠা।
তাড়াতাড়ি দরজা খুলতেই মিস্ত্রি চাপা স্বরে বলল, 
পুলিশ আপনাকে খুঁজতে এসেছে।।
বুকটা ছ্যাত করে উঠল।
কনেস্টেবলটি আমাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনার নাম গোবিন্দচন্দ্র বসাক?
ঢোঁক গিলে বললাম, হ্যাঁ, ব্যাপার কী?
আপনাকে একবার মুচিপাড়া থানায় আসতে হবে।
কেন, কী ব্যাপার?
জানি না, থানায় জানবেন।
একরাশ ভাবনা, চিন্তা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে থানায় গেলাম।
ও.সি. আমাকে দেখেই বলল,
আরে গবু, তুই?
নিতুকে দেখে প্রাণে জল এল। নিতু আমার সহপাঠি ছিল।
ওকে তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করলাম,  কী রে, ব্যাপার কী?
আমার ভয় দেখে নিতু হেসে বলল,  বোস বো।স, ভয় নেই কিছু, ধীরে ধীরে সব বলছি।
আমি একটু সুস্থির হয়ে বসলাম। ও চা আনাল।
চায়ে দু
 জনে দু-এক চুমুক দেবার পর নিতু আমাকে জিজ্ঞাসা করল, তুই শশী আচার্যকে চিনিস?
আমি বললাম, হ্যাঁ, কী করেছে শশী?
নিতু বলল,  খুন করেছে।
বিস্ময়ে প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। খুন করেছে! শশী খুন করেছে! অমন শান্ত অমায়িক নির্বিরোধ লোক খুন করবে কী?
কাকে খুন করেছে?
নিতু বলল, কাকে নয়, কাকে কাকে বল। একটা নয় দুটো খুন। সৈরভী নামে এক বেশ্যা আর ব্রজেন আচার্য নামে এক ছোকরাকে। সন্ধ্যেবেলায় খবর পেয়েই আমরা ঘটনাস্থলে যাই এবং সেখানেই রক্তমাখা অবস্থায় ওকে গ্রেপ্তার করি। কিন্তু হাজতে এসে ও চুপ হয়ে থাকে। কিছুতেই জবানবন্দি দেবে না। শেষে অনেক কচলাকচলির পর তোর ঠিকানা দিয়ে বললে, তোকে যদি ওর সঙ্গে গোপনে কথা বলতে দিই তবে ও জবানবন্দি দেবে। অগত্যা তোকে আনাতে হল। দেখ তো, তোকে কী বলে! দেওধর সিং!
ওর ডাকে একটা কনেস্টেবল এল।
বাবুকে আসামীর কাছে নিয়ে যাও।
শশী আমাকে দেখেই একগাল ওর স্বভাবসিদ্ধ ম্লান হাসি হাসল।
ভাবলাম, কী গেরো! শেষে এক খুনের মামলায় ফেঁসে গেলাম? আর লোক পেল না শশী। শেষে আমাকে ধরে টান। রাগে পিত্তি জ্বলে উঠল। আমার।
বাবু মশাইকে তা হলে ওরা আনল শেষ পর্যন্ত। কী ঘুমুচ্ছিলেন?
ওর প্রশ্নের জবাব ঘাড় নেড়েই দিই, কথা বলি না। অবাক হয়ে যাই ওকে দেখে। এত বড় একটা বিপর্যয় ঘটে গেল ওর উপর দিয়ে অথচ কোথাও একটু পরিবর্তন নেই। না কথাবার্তায় না আচার-ব্যবহারে। সব কিছু কেমন যেন রহস্যময় মনে হতে থাকে। নিস্তব্ধ রাত্রি, শিক দেওয়া অবরোধের ভেতর শশী পরম নির্বিকারভাবে কথা বলে চলেছে।
শেষ পর্যন্ত মেরেই ফেললাম মাগীটাকে। বলে যেন নিজের মনেই বলে উঠল, ঠিক করেছি।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ব্রজেন আচার্য কে?
ও ব্যাটা ডাহা শয়তান, আমার ভাইপো। রঘু আচার্যির বংশের সেশ সন্তান। ওকেও দিয়েছি সাবাড়ে। ব্যাটা আমার উপরও টেক্কা মারতে চেয়েছিল।
বলে শশী অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল।
তারপর অকস্মাৎ উত্তেজিত ভাবে শুরু করল, 
কেন খুন করেছি জানেন? মাগী পুষ্পকেও নিজের পথে নামাতে যাচ্ছিল। বোজেনকে এনেছিল, ওর সঙ্গে পুষ্পর আজ বিয়ে দিয়ে সাবিত্তি ভাঙবে বলে। মনে মনে আঁচ করেছিলাম বহুদিন। কত বুঝিয়েছি, নিজে তো ডুবলি সারাজীবন। আবার মেয়েটাকে নরকে ডুবোবার চেষ্টা কেন? কিন্তু চোরা না শোনে ধম্মের কাহিনী। ওর কী জিদ চাপল, মেয়েকে দিয়ে ব্যবসা করাবেই। আরে আমি বাপ হয়ে যেটা বুঝি, তুই মা, তোর প্রাণে সেটা ধরে না। ও যখন হয়, তখন তো আমরা স্বয়ামী আর ইস্তিরি হিসাবেই ছিলাম। তবে? বুঝলেন না, এ ওর সেই পোতিশোধ নেওয়া ছাড়া কিছুই না। ওকে বেবুশ্যি বানিয়েছিলাম, সেই রাগ। তারই শোধ নেওয়া আর কি? কিন্তু আমার মতো পাপীরও মন গলে গেল মশাই, মেয়েটার মুখ চেয়ে। হাজার হোক বাপ তো বটি, ওর ধম্ম রক্ষে আমাকেই তো করতে হবে। ওর ধম্ম বাঁচিয়ে দিলাম শেষ পর্যন্ত। মেরেই ফেলতে হল খানকি বজ্জাতটাকে। কী আর করা যায়।
শশী অম্লানবদনে বলে যেতে লাগল। এই জন্ম-পাষণ লোকটার মুনষ্যত্ব আছে? কোমল হৃদয়বৃত্তি আছে? অবাক হয়ে গেলাম মানুষের সীমাহীন রূপ দেখে।
শশী বলতে লাগল, 
ক-দিন ছিলাম না এখানে। এক জমিদারের বাগান বাড়িতে কিছু মাল যোগান দিতে বরানগরে গিয়েছিলাম। আজ ফিরে দেখি, ভাগ্যিস ফিরেছিলাম, হুলুস্থুলু ব্যাপার। রামবাগান থেকে আমার ভাইপোকে এনেছে পুরুতগিরি করবার জন্য। শুনলাম ওকেই নাকি উচ্ছুগগু করবে মেয়েটাকে। পুষ্পকে ভয় দেখিয়ে নিমরাজি করিয়েছে। সেই তো মেয়েটাকে সরিয়ে ফেললাম। তারপর কত বোঝালাম হারামজাদি নচ্ছারটাকে! কিন্তু মাগীটা কাঠবেবুশ্যি বনে গিয়েছিল মশাই। ধম্মাধম্ম লোপ পেয়ে গিয়েছিল। তাই এ সব কথা কানেই তুলল না, শুধু এক কথাই বার বার বলতে লাগল,সেদিনের কথা মনে নেই? সেই এক কথা। পোতিশোধ নেবে। আমিও মশাই ভেবেই রেখেছিলাম, শুধু কথায় চিড়ে না ভিজলে কী করব, তাই মেরেই ফেললাম শেষ পর্যন্ত।
একখানি বলে চুপ মরে থাকল খানিকক্ষণ। আমার মুখের উপর স্থির দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুখখানা নিবদ্ধ করে রাখল। তারপর আমার দুখানা হাত টেনে নিয়ে চুপ করে ধরে রইল।
কিন্তু আপনাকে একটা ভার নিতেই হবে বাবুমশাই। আর তো কোনও শালাকে বিশ্বাস নেই। কেন জানিনে, আপনাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। সেই জন্যই আপনাকে ডাকা। ওকে যেন আমাদের পাপের বোঝা আর টানতে না হয় সেটা দেখবেন।
বলে ম্লান হাসল।
আপনার উপর সৈরভীরও খুব বিশ্বাস ছিল। শুনুন, বলেই ফিস ফিস করে একটা ঠিকানা বলল। ওখান থেকে সকাল হলেই নিয়ে আসবেন। তারপর চন্দননগরে আমার এক পিসি থাকে তার বাড়িতে রেখে আসবেন। পিসির ছেলেপুলে কেউ নেই। পুষ্পকে সে পুষ্যি নেবে। ওকে দয়া করে সেখানে পৌঁছে দেবেন বাবু। পুষ্পর উপর অনেকের নজর আছে বাবু। কতজন আমার হাতে টাকা গুঁজে দিয়েছে ওকে পাবার জন্য। ওকে তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। দেবেন তো। কথা দিন।
অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে লাগলাম। তারপর বললাম, শশী, তোমার পুষ্পকে আমি পৌঁছে দেব ঠিক মতো।
আঁ বাঁচালেন। আপনি দেবেন আমি জানতাম। আমার মনে হয়েছিল।
শশীর মুখে হাসি ফুটল।
বলল, 
এবার আমাকে দারোগাবাবুর কাছে নিয়ে চলো।
ওর মুখে চোখে ফুটে উঠল পরিতৃপ্তির একটি হাসি। চোখ দিয়ে ঝর ঝর জলও পড়তে লাগল।
বিড়বিড় করে বলতে লাগল,
 অনেক অন্যায় জীবনে করেছি, কিন্তু যখন কোনও পাপ করিনি, বাবুমশাই, সেই দিনে পুষ্প আমাদের ঘরে এসেছে। ওর তো ভাল হবার অধিকার আছে।
তারপর হঠাৎ প্রশান্ত নির্বিকার মুখটা তুলে বলল,  বিড়ি থাকে তো একটা দিন বাবুমশাই। অনেকক্ষণ নেশা করিনি।”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত