| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
উপন্যাস পুনঃপাঠ সাহিত্য

পুনঃপাঠ উপন্যাস: শাম্ব । কালকূট

আনুমানিক পঠনকাল: 110 মিনিট

শ্ৰীযুক্ত শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ মহাশয়
শ্রীচরণেষু

সংস্কৃত মহাসিন্ধুর অকূলে বসে এই
সামান্য বিন্দুকে সাহিত্যে উপস্থিত
করা আমার পক্ষে অতি দুঃসাহসের কাজ
হয়েছে। আপনার মত সংস্কৃত সিন্ধু
বিশারদ থাকতে এই কাজ আমার
মনকে প্রতি মুহুর্তে সঙ্কুচিত করছে।
তথাপি আমার এই সামান্য রচনা
আপনার পাদস্পর্শে ধন্য হোক— এই
প্রার্থনা।

.

ধ্যান জ্ঞান প্রেমশাম্ব-কাহিনী—বিশেষত তাঁর পিতার দ্বারা অভিশপ্ত হওয়া, শাপমোচন ও মুক্তি, বহুবিধ ঘটনা তত্ত্ব তথ্যের জালে আবৃত। আমি তার অনেক বিষয়ই বাহুল্যবোধে ত্যাগ করেছি। কেবল তাঁর প্রতি পিতার অভিশাপের কারণ এবং শাপমোচন বিষয়কেই আমি যথাসম্ভব সহজভাবে বলতে চেয়েছি। কৃষ্ণ যেমন আমার কাছে ইতিহাস-প্রসিদ্ধ মহামানব, তেমনি শাম্বকেও আমি প্রাচীনতম কালের একজন আশ্চর্য প্রতিভাশালী, ত্যাগী, “বিশ্বাসী” উজ্জলতম ব্যক্তিরূপে দেখেছি।

ইতিহাসে অনেক সময়েই, পরবর্তীকালে অনেক ঘটনা স্থূলহস্তাবলেপে প্রক্ষিপ্তভাবে প্রবেশ করে। যেমন শাম্বর সৌর উপাসনার মধ্যে অনেকে “তন্ত্র”-এর সন্ধান পেয়েছেন বা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। আমি তা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করিনি। মুল-প্রসব বা পর্ব এবং যদুবংশের ধ্বংসের সঙ্গে তার যোগাযোগ কতখানি যুক্তিযুক্ত, আমি সে-বিষয়ও এই কাহিনীতে উপস্থিত করা প্রয়োজন বোধ করিনি।

আমি একটি ব্যক্তির কথাই বলতে চেয়েছি, যিনি অতি দুঃসময়েও বিশ্বাস হারান না, যিনি দৈহিক ও মানসিক কষ্টের ভিতর দিয়েও, নিরন্তর উত্তীর্ণ হবার চেষ্টা করেন। শাম্ব আমার কাছে এক “সংগ্রামী” ব্যক্তি, “বিশ্বাস” এখানে আমার বক্তব্য বিষয়, এবং এক বিপন্ন ব্যক্তির উত্তরণকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখাতে চেয়েছি, দেখতে চেয়েছি কালের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।

কালকূট ॥ ১লা বৈশাখ ॥ ১৩৮৫


.

মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, কথাটা আজ অন্য একটা কথার খেই ধরিয়ে দিল। ধরিয়ে দেওয়া খেই কথাটা অবিশ্যি বিপরীত। না-তে আছে হ্যাঁ। ভ্রমিতে চাহি আমি সুন্দর ভুবনে। অনেকবার শোনা, আর অনেকবার বলা সেই কলিটাই তাই ফিরে আসে বারে বারে, মন চলো যাই ভ্রমণে। কিন্তু কোন ভুবনে?

এরকম একটা ধন্দ কখনও কখনও আমাকে পেয়ে বসে। তবে সচরাচর না। ভুবনের কথা এল যে! না, লোটা কম্বল নিয়ে, আর কপনি এঁটে— যাকে বলে ‘আপনি আর কপনি’ সেইরকম, সংসারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে, ‘ব্যোম ভোলানাথ!’ হেঁকে আমি কদাপি দৌড় মারিনি। কেননা, ওটা আমার কাছে দৌড় মারার মতোই। বুলি হল, আপনি বাঁচলে বাপের নাম!

না, পিতা পিতৃপুরুষের নাম, আমি আমার বাঁচার থেকে ছোট করে ভাবি না। ভাবিওনি। ক্ষয় লয় মৃত্যু, অনিবার্য বলে তাকে জেনেছি। এই জানাটা যে কেবল নিজের এই জীবনকালের মধ্যে, তা যেমন সত্যি, তার থেকেও গভীরতর সত্যের কথাটা না বলে থাকতে পারছি না। ক্ষয় লয় মৃত্যুর সে-এক মহিমময় বর্ণনা, বিষ্ণুপুরাণের ধরণীগীতায় উক্তি করেছেন পরাশর। বলছেন:

তপ্তং তপো যৈঃ পুরুষপ্রবীরৈ-
রুদ্বাহুভির্ব্বর্ষগণাননেকান্‌।
ইষ্টাচ যজ্ঞা বলিনোহতিবীর্য্যাঃ
কৃতাস্তু কালেন কথাবশেষাঃ॥

আহ্‌, ওহে জীবন, তুমি আবার আমাকে দিয়ে পুরাণের শ্লোক আউড়িয়ে নিচ্ছ কেন। এ ভাষা আমার অর্জিত না। চলো যাই পণ্ডিতের পদতলে, যিনি ভাষার সিংহদ্বার ভেঙে, গম্য স্রোতে ভাসিয়েছেন পরাশরের সেই মহিমময় বেদনাভিভূত বাণী, বাংলা কথায় ধরণীগীতার সেই সব উক্তি:

‘যে-পুরুষপ্রধানগণ ঊর্ধ্ববাহু হয়ে অনেক বর্ষ যাবৎ তপ আচরণ করেছিলেন, অতি বীর্যশালী যে বলবান ব্যক্তিগণ যজ্ঞানুষ্ঠান করেছিলেন, কাল তাঁদের সকলকেই কথাবশেষ করেছেন। যে-পৃথু অব্যাহত পরাক্রমে সমস্ত লোকে বিরাজ করতেন, যাঁর চক্র শত্রুদের বিদারিত করত, তিনি কালবাতাহত হয়ে, অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত শিমুল তুলার মতো বিনষ্ট হয়েছেন। যে-কার্তবীর্য সমস্ত দ্বীপ আক্রমণ করে, শত্রুমণ্ডল বিনাশ করে রাজ্য ভোগ করেছিলেন, এখন কথাপ্রসঙ্গে তাঁর নাম উত্থাপিত হলে, সন্দেহ হয়, তিনি বাস্তবিক ছিলেন কি না। ধিক! দশানন অবিক্ষিত রাঘব প্রভৃতি দিঙ্‌মুখ উদ্ভাসিতকারী রাজগণের ঐশ্বর্যও কি কালের ভ্রূভঙ্গপাতে ক্ষণমাত্রেই ভস্মসাৎ হয়নি! মান্ধাতা নামে যে-ভূমণ্ডলের চক্রবর্তীরাজ কথাশরীর প্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁর কাহিনী শুনে, কে এমন সাধু ব্যক্তি আছেন, যে মন্দচেতা হয়ে নিজের প্রতি মমত্ব করবেন। ভগীরথাদি নৃপতি, সগর, ককুৎস্থ, দশানন, রাঘব, লক্ষ্মণ, যুধিষ্ঠির ইত্যাদি সকলেই ছিলেন, এ-কথা সত্য। মিথ্যা না। কিন্তু এখন তাঁরা যে কোথায়, (হায়!) আমরা জানি না।’ … জানি না, কিন্তু ছিলেন— এই সত্যের বিনাশ নেই। পরাশরের লোটা কম্বল কপনি ছিল কি না, এতে আমারও বেজায় ধন্দ। কারণ, জানি না। তথাপি দেখছি, সেই প্রাচীন পুরুষপ্রধানদের তিনি ভুলতে পারছেন না। আপনি বাঁচো, বাপের নাম ভোলো, আর আপনি কপনি করে দৌড় মারো, আর ধুনি জ্বালিয়ে বেল-কাঠ বেহ্মচারীর মতো গায়ে মাখো ছাই, তিনি যে তা ছিলেন না, তার প্রমাণ তাঁরই উক্তি। যাঁদের অস্তিত্বের নশ্বরতা বিষয়ে তিনি উক্তি করেন, তাঁদের স্মরণের, তাঁরা ছিলেন, এ দায় থেকে মুক্তি পান না।

মুক্ত আমিও না। যদিও জানি, আমার বাঁচার থেকে পিতৃপুরুষগণকে ছোট করে ভাবতে পারি না, কিন্তু অবিমিশ্র সুখ কেউ রেখে যাননি এই বংশধরটির জন্য। সংসারকে নিরঙ্কুশ দুঃখের আগার ভাবি না। আর সুখ? প্রয়াগের সেই ঘর-ছাড়া পাগলাবাবার কথা মনে পড়ে যায়। যে-কথা এমন স্পষ্ট করে কোনও গীতায় উচ্চারিত হয়নি। তার আগে একটা কথা কবুল না করলে, নিজেকে যেন কেমন ছলনাকারী লাগছে। সংসারের বাইরের পথে যাঁরাই কপনি এঁটে বেরিয়েছেন, মাথায় জটা উঁচিয়ে, গায়ে ছাই মেখে খ্যাপা হয়ে ফিরছেন, তাঁদের সবাইকে আমি কখনও দৌড় মারার রঙিলা ব্রহ্মচারী বলিনি। তা হলে আমার জীবনে অনেক দর্শন, অনেক বচনবাচন দেখা আর শোনা হত না।

প্রয়াগের সেই জটা খোলা, উদলা গা, হাসকুটে মানুষটি আমাকে শুনিয়েছিলেন, ‘সুখ দুঃখটা কেমন জানিস? প্রয়াগে তীর্থ করলে, আর পকেট ভরে পুণ্যি নিয়ে গেলেই সব শেষ না। সুখদুঃখের মাপ জ্ঞানটা থাকা দরকার। পৃথিবীটাকে দেখে নিয়েছিস। আহ্, সেই দেখার কথা হচ্ছে না, ঘরে বসে ভূগোল ম্যাপ নিয়ে নাড়াচাড়া করেছ তো। তার তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল। কেমন কি না। ওটাই হল সুখ দুঃখের ভাগ। তিন ভাগ জলের মতো দুঃখ, স্থলের এক ভাগ সুখ।’

কত কাল আগের কথা? তেইশ-চব্বিশ বছর তো হল প্রায়। তখন পশ্চিমের ‘মিথ অফ সিসিফাস’ জানা ছিল না। কথাটা এমন করে মরমে বিঁধেছিল, জীবনের কত জায়গায়, কত ভাবে যে কথাটা বলেছি, নিজেরই কোনও হিসাব নেই। কথাটা এই কারণে মরমে বেঁধেনি, জীবনটা একান্তই দুঃখের অকূল সমুদ্র। বড় অসহায় বোধ করেছিলাম। জীবনকে দেখার সেই দৃষ্টিভঙ্গি, নিদারুণ মনে হয়েছিল। তখনও সুখ বিষয়ে মনের মাত্রাজ্ঞানে আকাঙ্ক্ষার ভাগটা ছিল অনেক বড়। কথাটা শুনে মনে হয়েছিল, জীবন হল দুঃখের দ্বারা বেষ্টিত। তাকে পাশ কাটিয়ে যাই, এমন কোনও পথ ছিল না। ব্রহ্মাণ্ডের অনিবার্যতার প্রমাণটা একটা প্রতীক। তিন ভাগ জলের ধারা প্রবাহিত স্থলের অভ্যন্তরে নানা নদ ও নদী। তার ওপরে, পন্থ বড় বন্ধুর হে, পন্থ বড় বন্ধুর। তিন ভাগ জল ছিল এক গভীর অর্থবহ সংবাদ। দুঃখ জীবনের সমগ্রতায় অনতিক্ৰমণীয়। সুখ থাকে দুঃখের কুণ্ডলীতে। নাম তার ঝলকিত দ্যুতি। সামান্য জীবনকালের কয়েকটি স্বপ্নময় মুহূর্ত মাত্র।

পরবর্তীকালে পশ্চিমের ‘মিথ অফ সিসিফাস’ পড়ে, তিন ভাগ জলের প্রতীকটাকে সমার্থক মনে হয়েছিল। আরও পরে বুঝেছিলাম, দুটো ধারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। দুটো বিশ্বাস আলাদা, অভিজ্ঞতা ভিন্নতর। অভিশাপ আর বিশ্বের নিয়মের অনিবার্যতায় বেবাক ফারাক।

প্রয়াগের সাধু আমাকে শুনিয়েছিলেন, বিশ্ব নিয়মের একটি অনিবার্যতার কথা! পৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল। জীবনের তিন ভাগ দুঃখ, এক ভাগ সুখ। এর নাম মন্ত্র তন্ত্র না। দার্শনিকতা? কেউ দাবি করেনি। ভারতের ঘাটে মাঠে গাছতলায়, এক শ্রেণীর সর্বত্যাগীর (সর্বহারা বলা যায় কি?) মুখে মুখে জন্ম নেয়। এখন বোঝো হে কথা, যে জানো সন্ধান। কারওর মাথার দিব্যি নেই।

কিন্তু তথাপি মনে একটা খটকা, প্রাণে লাগে একটা ধন্দের দোলা। এই যে কেবল ভারত ভারত করি, কেবল কি ভারতের মাঠে ঘাটে গাছতলাতেই এমন কথার জন্ম হয়। জগতের আর কোথাও না? ঘাড় ঝাঁকাতে পারি না। শিরে টান ধরে। প্রয়াগের গাছতলা কি প্রাগে নেই? প্রাগের ঘাট সাইবেরিয়ায়? সাইবেরিয়ার মাঠ সাংহাইয়ে? কাসপিয়ানের কূলে কিংবা অতলান্তিকের বেলাভূমে?

সত্যি মিথ্যা জানি না। অবুঝ মন বলে, আছে। বোঝদার বললে কেউ ‘অংখারি’ ভাবে, তাই। তবে নিতান্ত অবুঝ মনের কথা না। সেই মহান মেষপালক, গায়ে ছেঁড়া আলখাল্লা, আর এক মুখ দাড়ি নিয়ে মাঠে ঘাটেই তাঁর কথার জন্ম দিয়েছিলেন।

খেই হারালাম নাকি? না। কথা হচ্ছিল, ‘মরিতে চাহি না…।’ বলতে চাইছিলাম, না-তে আছে হ্যাঁ, অন্য কথায়। ভ্রমিতে চাহি আমি সুন্দর ভুবনে: কিন্তু কোন ভুবনে? ভুবনের কথাটা এল, আমার ধন্দটাও, অতএব। সেই কারণেই লোটা কম্বল কপনির প্রসঙ্গ। কথাটা অনেকবার অনেকভাবে বলেছি, ভ্রমণে যাব। কিন্তু সংসারটাকে ছাড়িয়ে যাবার কথা কখনও মনে হয়নি। তিন ভাগ জলের সত্যকে জেনেছি বটে, উপলব্ধি অন্য কথা। সেই জানা থেকেই, আমার এক কথা, আমি লোটা কম্বলধারী না। পরিব্রাজক যাঁদের বলে, প্রব্রজ্যা যাঁদের পরিভ্রমণ, আমার মন চলো যাই ভ্রমণের সঙ্গে তার মিল নেই কোথাও। বৈরাগ্য যে কখনও অন্তরকে গ্রাস করে না, সে-কথা বলা কঠিন। বৈরাগী হতে গেলেই, সংসারের ধিক্কারটা বড় কঠিন হয়ে বাজে।

তাই কি? আসলে বৈরাগী যে হতেই চাইনি কখনও। সন্ন্যাস আমার জন্য না। লোটা কম্বল নিয়ে যদি দৌড় দিতে পারতাম, তবে আমার থেকে কার বিবেক আর বেশি সাফ সুরত থাকত? মনের কথাটা তো গোড়াতেই বলেছি। ভ্রমিতে চাহি আমি সুন্দর ভুবনে। কথাটা আরশিতে ফেলে দেখতে গিয়ে তাজ্জব। দেখি, লেখা রয়েছে, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।’ এই চাওয়া আর না চাওয়ার মধ্যে, যদি আনন্দের ধ্বনি বেজে থাকে, বাজুক না কেন। আরও কি বাজে কোনও আর্তস্বর? অথবা এরই মধ্যে জীবনের অলঙ্ঘিত বিধি, সম্যক জ্ঞানের ধারায় নিয়ে চলে?

না না না, এ বড় পয়জার হে৷ মনের নানা ব্যাজ। উসব থাকুক গা মনের রাংচিতের বেড়ায় ঢাকা। আমার এক কথা, ভ্রমি অনুরাগে। আমার হল অনুরাগের ভ্রমণ। কিন্তু ওই ভুবনে এবার আমার ঠেক লেগেছে। মন নিয়ে কথা। ঠেক ধন্দ যে কত, আজতক বলে বলে তার ইতি করতে পারলাম না।

একটা মজার কথা বলি। ছেলেবেলার কৃষ্ণযাত্রার কথা, মন তখনও কুসুমকলি। বিরহিণী রাধার কাছ থেকে কৃষ্ণ বিদায় নেবেন। কিন্তু বিদায় নেবার ইচ্ছা নেই। মানভঞ্জনটা হয়েছে। রাধার দুই সখী দু’পাশে। কৃষ্ণ বললেন, ‘এবার তা হলে যাই।’ বলে পা বাড়ালেন।

সখী বললেন, ‘যাই নয়, আসি।’

কৃষ্ণ ফিরে এসে দাঁড়ালেন। রাধা এবং সখীরা অবাক! কী হল? কৃষ্ণ বললেন, ‘বললে যে যাই না আসি। তাই এলাম।’

সখী হেসে বললেন, ‘যাই বলতে নেই, যাবার বেলায় আসি বলতে হয়।’

কৃষ্ণ বললেন, ‘তাই বুঝি? এবার তা হলে আসি।’ যাবার জন্য পা বাড়ালেন।

সখী বললেন, ‘এসো।’

কৃষ্ণ আবার ফিরে এলেন। রাধা এবং সখীরা আবার অবাক! কৃষ্ণ বললেন, ‘এসো বললে, তাই এলাম।’

রাধার অনুরাগ আর বিরহ কাতরতা যুগপৎ বাড়ে। সখীরা হাসেন। কৃষ্ণযাত্রার কেষ্টঠাকুরটি বরাবরই চতুর রসিকলাল। আমাদের ক্ষেত্রে বিটলেমি। বুঝতে পারছি না, আমাকে সেই বিটলেমিতে পেল কি না। ভুবনের ঠেক লাগল এই কারণে, ভ্রমণে যাব কোন ভুবনে। হিসাবে দেখেছি, ভুবন তিনটি। ত্রিভুবন যাকে বলে।

অনুরাগের ভ্রমণের একটা বৈশিষ্ট্য, ডানায় কাঁপন লেগে যায়। নিষ্পত্র গাছপালা আর বরফের দেশ ছেড়ে পাখিরা যেমন পাখা ঝাপটিয়ে উড়ে যায় চিরবসন্তের দেশে। তা বলে কি আমার ভ্রমণ কাসপিয়ানের কূল থেকে কুরু পাঞ্চালে? ইস! টিকিটবাবুরা হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে নেই? মনের পাখায় কাঁপন যতই লাগুক, আকাশযান জলযান স্থলযান, ব্যতিরেকে উড়ব কীসে? আর সেইসব যানবাহী হলে ফুঁকো ট্যাঁকে মনের পাখনায় মরণ ধরে। সবাইয়ের এক বুলি, ফ্যালো কড়ি মাখো তেল, তুমি যে আমার বড় আপন গো!

না, অমন দূর দূরান্তের ভ্রমণ আমার কপালে নেই। আমার হল, দশজনকে নিয়ে ঘর করতে, হঠাৎ গুনগুনিয়ে ওঠা “মন চলো যাই ভ্রমণে/ কৃষ্ণ অনুরাগীর বাগানে।” কৃষ্ণ হেথায় প্রতীক, এক অরূপ রূপের ঠাঁই। তার কোনও ব্যাখ্যা নেই, নগর পুরী জনপদের কোনও ঠিক ঠিকানা নেই। ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে ঘরের হাতায় মাঠ থেকেই মোটর বাসে চেপে বসে, ঘরেরই আর এক পিঠে গিয়ে নামো। কোনও এক গাঁয়ের পথে, নয় তো কোনও এক খোয়াইয়ের ঢালুতে। কুন্তী নামেও তো এক নদী আছে, অথবা ক্ষীণধারা সরস্বতীর কূলে বাঁশঝাড়ের ছায়ায় ভ্রমণে চলে যাও। নানুরের পুকুর ধারে, নয়তো ছাতনার ঝোপ ঝাড়ের জঙ্গলে। সোনামুখীতে না গিয়ে, পাঁচমুড়ার গাঁয়ে গিয়ে বসো। থেলো হুঁকোয় ভুড়ুক ভুড়ুক করে, পোড়ামাটির শিল্পী কারিগরদের উঠোনে বসলে কেউ তোমাকে ঠ্যাঙা নিয়ে তাড়া করবে না। গুলবাজি? না। কসম? কসম! এমন অনেক জায়গার নাম করতে পারি। সবই মনে হবে কৃষ্ণ অনুরাগীর বাগান।

যে যায় এমন ভ্রমণে।

কৃষ্ণ থাকেন তার সনে।

আবার কৃষ্ণ? আবার কেন, বারে বারে। বললাম না, ওই নাম হল প্রতীক। পাবার আশায় সেখানে কেউ যায় না। নিজেকে একটু ধোয়া মোছা সাফসুরত করতে যাওয়া। এত কথা কীসের। বলছি, প্রাণের লক্ষ কক্ষে বায়ুর ভারী চাপ। প্রাণে বায়ু চালাচালির নামই ভ্রমণ।

‘তা যেন হল।’ তিনি বলেছিলেন, ‘ভ্রমণে তোর সঙ্গে না যেতে পারলেও মনটা হালকা হল। কিন্তু খাস কী?’

‘খাই কী?’

‘হ্যাঁ, খাস কী?’

একে বলে জিজ্ঞাসা! প্রাণের লক্ষ কক্ষে বায়ু চালাচালি তো করছ বাপু, মহাপ্রাণীটির ব্যবস্থা কী? দাঁতকপাটি? যে তাঁর বচন শোনেনি, সে বুঝবে না, জিজ্ঞাসায় ঝাঁজ কেমন। তারপরেই আবার পালটা জিজ্ঞাসা, ‘গেরস্তের বাড়িতে পাত পাতিস?’

‘আজ্ঞে সে কখনও সখনও। সব জায়গায় সব গেরস্ত তো সমান না। আশেপাশের দোকান থেকে চিড়ে মুড়ি মুড়কি কেনা যায়। ময়রার দোকান থাকলে তো কথা নেই। দই মণ্ডা মেঠাইও কিছু মেলে।’

‘তুই একটা আস্ত গাধা।’

‘আজ্ঞে?’

‘হ্যাঁ, বইলছি, তুই একটা কুড়ের বাদশা। ওতে না আছে মজা, না ভরে পেট। খেটে খেতে পারিস না?’

সেটা কী রকম? জিজ্ঞাসা করিনি, চোখে জিজ্ঞাসা নিয়েই তাকিয়েছিলাম।

‘রেঁধে খেতে পারিস না?’

‘রেঁধে?’

‘হ্যাঁ রে বাঁদর, রেঁধে। তোর বয়সে আমি ওরকম অনেক, ঘর করতে উঠবন্দি প্রজার মত বেরিয়ে পড়তাম। সেইজন্যই তোর বেরিয়ে পড়ার খবরে আমি খুশি। কিন্তু আমি তোর মতন ওরকম চিড়ে মুড়ি মণ্ডা মেঠাইতে ছিলুম না, বুঝলি?’

‘কীসে থাকতেন?’

‘ক্যানে, দোকানে চাল ডাল মেলে না? নুন লঙ্কা তেল? হাঁড়ি মালসা, গেরস্তের বাগানে কলাপাতা?’

‘তা তো মেলে।’

‘মেলে মানে? মিলবেই। তোকে তো আর কেউ শিল নোড়ায় বাটনা বাটতে বলেনি। বলেছে কি? ত? যা, সব কিনে কেটে জোগাড়জাত করে, গাঁয়ের বাইরে গাছতলায় যেয়ে বস। গাছের শুকনো পাতা ডাল কুড়িয়ে আন। কিছু না পাস মাটির ঢ্যালা বসিয়েই উনোন সাজা। জল নিয়ে টিপটিপিনি আছে নাকি?’

‘আজ্ঞে?’

‘বইলছি পেট রুগিদের মতন, এ-জল খাব না, সে-জল খাব, ওসব হ্যাপা নাই ত?’

‘না।’

‘ওইটেই বাঁচোয়া। তবে যা, কাছেপিঠে যেখানে পুকুর টিউবকল যা পাবি, হাঁড়িতে করে জল নিয়ে আয়। চালে ডালে বসিয়ে দে। মালসায় তেলের ছিটা দিয়ে, লঙ্কা ভেজে নে, হাঁড়িতে ঢেলে দে। গাছের ডাল দিয়ে হাঁড়িতে নাড়। ঠিক মতন ফুট খেয়েছে? তা হলে এবার গরম গরম কলাপাতায় ঢাল, আর খা। কেমন লাইগছে?’

‘আজ্ঞে জিভে জল এসে যাচ্ছে।’

‘তব্যা? তা না চিড়া মুড়ি মেঠাই মণ্ডা। এখন তোর আশেপাশে কারা আছে বল। দিকিনি?’

‘আজ্ঞে, কই? কেউ নেই তো।’

‘গাধা! নিদেনপক্ষে চার-পাঁচটা গায়ের অনাহারী কুকুর তোকে ঘিরে বসে নেই? কাক শালিকের কথা বাদই দিলাম।’

‘ইস! সত্যিই তো, মনেই ছিল না দাদা।’

‘মনে না রাখলে লিখবি কেমন করে? এবার নিজে খা, ওদের দে। তারপর কী করবি?’

‘গাছতলায় শোব?’

‘তা শুবি না আরামখোর! শোবার জন্যে তখন একটা জাজিমের কথা মনে পড়বে, তারপরে একটি দাসী।’ মনে আছে, হেসে জিভ কেটেছিলাম। কিন্তু তিনি তাঁর মনে, ‘ঢ্যালা মেরে উনোন ভেঙে হাড়ি মালসা ভেঙেচুরে, আর পেছনে তাকানো নয়, চলে যা, নিজের পথে। তোর বয়সে আমি যখন বেরিয়ে পড়তাম, এইরকম করতাম। বেরিয়ে পড়লেই, গায়ে গতরে খাটবি না, পোকা পড়বে যে! তবে ওই দিনান্তে একবার। হাত পুড়িয়ে খাবি, মুখে অমৃতের স্বাদ পাবি। চড়ুইভাতি কি কেবল দঙ্গলে হয়? জঙ্গলে একা হয় না?’

হয় না আবার? হাতে কলমে পরখ করে দেখেছি। কেবল কি অমৃতের স্বাদই পেয়েছি? আর কিছু না? আরও কিছু। একলা সেই অনুষ্ঠান, এক যজ্ঞের মতো। সেই যজ্ঞের মধ্যে নিজেকে যেন অনেকখানি চিনে নেওয়া যায়। আহা, জানি তোমরা কী ভাবছ। আর তা জেনে আমার এমনি করে বলতে ইচ্ছা করছে, ‘পাঠক! তোমাদিগের মনের অবস্থা আমি অনুমান করিতে পারিতেছি। যে-ব্যক্তির সঙ্গে আমার উক্ত প্রকার আলাপাদি হইয়াছিল, তাঁহার পরিচয় জানিবার জন্য তোমাদিগের কৌতুহল অতি তীব্র হইয়াছে।’ বচনদারের বচনেও যদি না বোঝা গিয়ে থাকে, তবে বলি, তিনি কথাশরীর প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি দিঙ্‌উদ্ভাসিত সাহিত্য রচয়িতা তারাশঙ্কর— তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। কথাশরীর প্রাপ্ত হওয়া মানে কী? পণ্ডিতমশাইয়ের কাছ থেকে যথার্থরূপে জেনে নেওয়া হয়নি। কথাশরীর প্রাপ্ত কি কেবল মৃত্যু? সম্ভবত না। যিনি এখন ইতিহাস তিনি কথাশরীর প্রাপ্ত হন। দাদা (এই নামেই তাঁকে ডাকতাম। দাদার আগে নাম ধরবার, অন্তত তাঁর ক্ষেত্রে, জিভ আড়ষ্ট হয়ে যেত। সেটা তাঁর বয়স এবং ব্যক্তিত্ব।) এখন সৃষ্টি জগতের ইতিহাস।

কিন্তু ‘আমার সাধ না মিটিল/ আশা না পুরিল।’ বড় ইচ্ছা ছিল, তাঁর সঙ্গে একবার ভ্রমণে যাই। গ্রামের বাইরে গাছতলায় চাল ডাল হাঁড়ি মালসা নুন তেল জোগাড়জাত করে গিয়ে বসি, মাটির ঢ্যালায় উনোন সাজিয়ে, হাঁড়ি চাপিয়ে দিই। আমি শুকনো কাঠ পাতায় আগুন উসকে তুলব, তিনি গাছের ডাল দিয়ে হাঁড়িতে নাড়বেন। আর তখন কি গুনগুন করবেন, ‘জীবন এত ছোট ক্যানে?’

এই দেখো, আমার প্রাণের বায়ুর ঘরে কেমন হাহাকার করে উঠেছে। ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। কারণ, সে-উপায় যে আর ছিল না। সাধ মেটাতে পারিনি। কালের স্রোত তখন তাঁকে অন্যদিকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। একলা চড়ুইভাতির দিন শেষ অভিজ্ঞতাগুলোকে হৃদয়ের জারিত রসে রূপায়ণের একনিষ্ঠ শিল্পী। কর্তব্য আর বয়সের দায় তাঁকে ঘরবন্দি করেছে।

তা-ও বা কতটা? ঘরে বন্দি হবার লোক কি তিনি ছিলেন। আর একটা ঘটনা বলে নেব নাকি? এই দেখো, অতি লোভে তাঁতি নষ্ট, কথায় বলে। আমার সেই অবস্থা। আমি খেই হারাতে বসেছি। তবু মন বলছে, খেদ রেখো না বাপু, যা বলবার ঝটপট বলে ফ্যালো।

হ্যাঁ, তাই বলি। একবার দাদার সঙ্গে গিয়েছি সাঁওতাল পরগনার শিমুলতলায়। আরও অনেকে ছিলেন। কেন, কী বৃত্তান্ত, সে-সব কথা থাক। আবহাওয়াটা দঙ্গলের চড়ুইভাতির মতোই। দুপুরবেলা খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম করে, ঠিক হল তিন মাইল দূরে তিলুয়াবাজারের হাটে যাওয়া হবে বাজার করবার জন্য। আসলে সেও এক ভ্রমণ।

হাটে একটি সাঁওতাল মেয়ে, খাঁচায় পুরে নিয়ে এসেছিল কয়েকটি পায়রা। নতুন পাখনা গজানো নধর পায়রা। সচকিত ভীরু পায়রাগুলো, খাঁচার মধ্যে হাটের ভিড় দেখে ছটফট করছিল। হঠাৎ আমার মনে হয়েছিল, অনেককাল পায়রার মাংস খাওয়া হয়নি। দাদাকে বললাম, ‘পায়রা ক’টা কেনা যাক, মাংস খাব।’

দাদা তাঁর মোটা লেন্সের চশমায়, খয়েরি উজ্জ্বল চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘পায়রার মাংস খাবি?’ তারপরে পায়রাগুলোর দিকে তাকালেন। পায়রাদের থেকে চোখ তুলে সাঁওতাল মেয়েটির দিকে। আমাকে বললেন, ‘তা হলে কিনে ফ্যাল।’

কিনে ফেলেছিলাম। দাম শুনে তো নিজেকে মনে হয়েছিল, ‘ড্যানচিবাবু’। দাদা হাত বাড়িয়ে বলেছিলেন, ‘দেখি।’

খাঁচাটা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম তাঁর দিকে। তিনি খাঁচার দরজাটি খুলতে খুলতে বলেছিলেন, ‘পায়রার মাংস খাবি?’ খা!’ বলে একটি একটি করে পায়রাকে ধরে বাইরে, আকাশের দিকে ছুড়ে দিয়েছিলেন।

আমি হাহাকার করতে গিয়ে দেখেছিলাম, সাঁওতাল পরগনার হেমন্তের আকাশে পড়ন্ত বেলার রোদে, চিত্রগ্রীবের দল কেমন রং বাহারে উড়ে গিয়েছিল। দাদা তাকিয়ে ছিলেন আমার মুখের দিকে। না, অনুশোচনার কিছুমাত্র অভিব্যক্তি ছিল না তাঁর চোখে মুখে। বরং মিটিমিটি হাসি। বলেছিলেন, ‘আরও পায়রা কিনবি নাকি? চল দেখি, হাটে নিশ্চয় আরও পায়রা এসেছে।’

বিক্ৰয়িত্রী সাঁওতাল কন্যাটি, আর তার আশেপাশে, ইস্তক আমাদের অন্যান্য সঙ্গীরাও তখন হাসতে আরম্ভ করেছে। ভ্রমণে এলাম আমি। আকাশ বিহারে গেল কবুতরেরা! কিন্তু হাসিটা তখন আমার ভিতরেও সঞ্চারিত হয়েছে। সেই হল আর এক রকমের কৃষ্ণ অনুরাগীর বাগানে ভ্রমণ!

সত্যি খেই হারালাম নাকি? কথা হচ্ছিল, ভ্রমিতে চাহি আমি সুন্দর ভুবনে। ভুবনের কথা এসে গেল, গোলমালটা সেখানে। ত্রিভুবনের কোন ভুবনে যাব? ঝোলা কাঁধে নিয়ে, রেলগাড়িতে বা মোটর বাসে চাপলেই কি ত্রিভুবনের কোনও এক ভুবনে যাওয়া যায়? এবারে আমার ঠেক লেগেছে সেইখানে। এই ত্রিভুবনের সংজ্ঞাটা একটু ভিন্ন রকমের। স্বর্গ মর্ত্য পাতাল, ভ্রমণের এই ত্রিভুবন এবার আমাকে ডাক দিয়েছে। আর এই ত্রিভুবনে যেতে হলে, ঝোলা কাঁধে নিয়ে কোনও যানবাহনে চেপে যাওয়া একেবারে অসম্ভব।

বুঝতে পারছি, স্বর্গ মর্ত্য পাতাল নামেই অনেক বাংরেজ বাবাজির মাথায় লগুড়াঘাত লাগল। অথবা কালকূটের মস্তিষ্কের সুস্থতা বিষয়ে অনেকে উদ্‌বিগ্ন হয়ে উঠছে। নয় তো হাসি পাচ্ছে। পেতে পারে। তাতেও, হাসতে গেলে কপাল ব্যথার আশঙ্কা আছে, নিবেদন করে রাখছি।

ভেবেছিলাম সরাসরি যাত্রা করব দ্বারাবতী, যে-স্থানকে লোকে জানে দ্বারকা নামে। স্থান যদি দ্বারাবতী, কাল তবে কলি-সন্ধ্যা, অর্থাৎ দ্বাপরান্তর। কিন্তু কাল এবং যুগের এই বিচারটা বোধহয় অনেকেরই হালে পানি পাবে না। আধুনিক ইতিহাসের কাল গণনার বিচারটা, আমার অনেক আগের পুরুষ থেকেই ভিন্ন পথগামী। যদি বলি পৌরাণিক মতে অষ্টাবিংশ যুগ, তবে এই নিশ্চিত ও অমোঘ কাল গণনা অনেকের কাছে ধাঁধার মতো লাগবে। কারণ দোষ কারও নয় গো মা/ আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা। সাহেবরা যে আমাদের শিখিয়ে গিয়েছেন, পুরাণ মানে মাইথলজি, ইতিহাস না। অতএব সে-কাল গণনা অনেকটা রূপকথার মতো। হ্যাঁ, মিথ্যার স্বর্গবাসেও সুখ আছে বই কী! সুখ এই, মেনে নিলে আর পরিশ্রম করতে হয় না।

কিন্তু এ তো হল তর্কের কথা। ইতিহাস প্রমাণ চায়। তাই প্রমাণ দিই। কাঁধ থেকে ঝোলাটা রেখে, এবার মন চলো যাই দ্বারাবতী। সেখানে কে আছেন? বাসুদেব। যাদবশ্রেষ্ঠ, তিনি কেবল নরপতি নন, কালান্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। কালের হিসাবটা কী? তাঁর জন্মকালের হিসাবে সময়টা এক হাজার চারশো আটান্ন খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই হিসাবটা আধুনিক ঐতিহাসিক কাল গণনা। পুরাণের অষ্টাবিংশ যুগ, কলির সন্ধ্যা। কেউ বলেছেন দ্বাপরান্তর। যিশুখ্রিস্টের মতো যদি কৃষ্ণ জন্মাব্দ বা কৃষ্ণাব্দ গণনা হত, তা হলে এই যিশু জন্মের উনিশশো সাতাত্তর সালকে বলা যেত তিন হাজার চারশো পঁয়ত্রিশ সাল।

বিশেষ কাল নির্দেশে আরও কিছু অতীতে যাব নাকি? কিন্তু পণ্ডিত মশাইদের ভ্রূকুটি আর তর্ককে যে বড় ভয় লাগে! এই সেদিনই তো রাম-রামায়ণ নিয়ে তর্ক বিতর্কের ধুন্ধুমার লেগে গিয়েছিল। ধুন্ধুমার! কথাটা কত সহজেই না আমরা কাজে লাগিয়ে ফেলেছি। আসলে ধুন্ধু নামক দৈত্যের যিনি নিধনকারী, তাঁরই নাম ধুন্ধুমার। ধ্বনির গুণ বটে। বিশেষণকে লাগিয়ে দিলাম ক্রিয়াবাচক শব্দে। তবে আমার প্রণাম সদ্য স্বর্গত আচার্য সুনীতিকুমারকে। প্রণাম রমেশচন্দ্র ঐতিহাসিক মহাজনকে এবং আরও সকলকে। কিন্তু আমি তর্কে নেই। বিদগ্ধজনের রচনার পথ ধরে আমার এবারের যাত্রা।

দেখছি, শ্রীরাম ছিলেন দুই হাজার একশো চব্বিশ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তা হলে রামাব্দ ধরতে হয় চার হাজার একশো এক সাল। আর রামের থেকে কৃষ্ণ ছিলেন ছ’শো ছেষট্টি বছরের ছোট। কিন্তু কী লাভ আমার এই গণনায়? আমি অযোধ্যায় যাব না। আমার যাত্রা দ্বারাবতীর পথে।

এই যাত্রার আগে, আমাকে আর একবার সেই বাউলের গানে ফিরে যেতে হবে। গানে দেখছি, কৃষ্ণ অনুরাগীর বাগানে, ‘বাগানে পাঁচজনা মালী/ যে যাঁর ঠাঁইয়ে বস্যে আছেন/ পাঁচ মাথার মোড় আগুলি।’..এখন এই বুঝহ রসিকজন, এই পাঁচজনা মালী কারা, পাঁচ মাথার মোড় আগলিয়ে বসে আছেন? কথায় ধন্দ আছে বটে, কিন্তু দ্বন্দ্ব নাই, এঁয়ারা হলেন বাউলের প্রতীক পঞ্চেন্দ্রিয়। দেহতত্ত্বে এমন প্রতীক বিস্তর। আমার এক কলসিতে নয়টি ছিদরি/ কেমনে জল ধরি ভরা কলসির ভিতরি।… এও বোধহয় সেই নবম দলের নয়টি নাড়ির প্রতীক। এমন প্রতীক কথায় কথায়। ষোলো ঘর থেকে চৌষট্টি ঘরও মেলে। আবার ত্রিবেণীতে ডুব দিয়ে, মীন ধরবার জালও বাঁধে।

আসলে, এ-সব হল, মূলে যাবার প্রস্তুতি। সিদ্ধির প্রমাণ-পথের দ্বারের যথাযথ খোলা বন্ধ। বলব নাকি, সাধনার মুখবন্ধ? তা হলে আমার গীত গাইবার সুবিধা হয়। ইতিহাস-প্রসিদ্ধ দ্বারাবতী যাবার আগে, পুরাণ যে ইতিহাস, তার যুক্তির ধন্দ কিঞ্চিৎ কাটানো দরকার। কাটান করবার আমি কেউ না, স্বয়ং পুরাণকাররাই তার কাটানদার। পুরাতনস্য কল্পস্য পুরাণানি বিদুৰ্বধাঃ। জ্ঞানী ব্যক্তিগণ পুরাণকে প্রাচীনকালের বিবরণ জ্ঞানেই অবগত আছেন।

জ্ঞানীর সঙ্গে আমার মতো অর্বাচীনের ফারাক হল, আমি সংশয়ী। আমার যুক্তি চাই। প্রমাণটা চাই আগে নিজের। খুঁজতে গিয়ে দেখছি, খ্রিস্টজন্মকালকে যাঁরা কালবিন্দু হিসাবে ধরেছেন, কৃষ্ণজন্মকালকে তারা খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভাবতে আপত্তি করছেন। এ আপত্তিটা কুসংস্কার, কারণ পুরাণকার দেখছি যুগমানের দ্বারা কাল নির্ণয় করেছেন। ফলে তাঁদের বি-সি এ-ডি নেই। একজন বলেন এক হাজার ছেষট্টি খ্রিস্টাব্দে রাজা উইলিয়ম ছিলেন। আর একজন বললেন কৃষ্ণ অষ্টাবিংশ যুগে ছিলেন।

সৃষ্টি, প্রলয়, বংশ, মন্বন্তর, বংশানুচরিত পুরাণের কাছে এই পাঁচ বিষয় ইতিহাসের মূল উপাদান। তার বিশ্বাস, যে দেশ প্রথম সৃষ্ট হল, তখন থেকেই তার হিস্টরি (পুরাণ) বা ইতিবৃত্ত লেখা হওয়া উচিত। ইংল্যান্ডের ইতিবৃত্ত কেউ কেউ নিওলিথিক ও পোলিওলিথিক অধিবাসীদের দিয়ে শুরু করেছেন। তারও আদিমকালের অতীতে যেতে হলে, ভূতত্ত্বের কথা আসে। ওয়েলস তাঁর ইতিবৃত্ত সেখান থেকেই শুরু করেছিলেন। অনেকটা পুরাণের মতোই। কিন্তু হিসাবের কালবিন্দু যিশু জন্মকাল। পুরাণের কি কোনও কালবিন্দু নেই? নেই। তার আদিবিন্দু আছে, তাকে বলা হয়েছে মানবকল্পের আদিবিন্দু। স্বয়ম্ভূর মনুকাল, পাঁচ হাজার ন’শো আটান্ন খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই আদিবিন্দুর অতীতে আর-কিছু নেই। থাকলেও তা ইতিবৃত্তে আসেনি।

মুশকিল! বলে তো যাচ্ছি ইতিবৃত্ত। বিষয়টা কী? পণ্ডিত বলছেন, ইতিবৃত্ত শব্দের অভিধা ইতিহাস শব্দের অনুরূপ হওয়ায়, তা হিস্টরি অর্থে অচল। হিস্টরির সংস্কৃত অর্থ ইতিবৃত্ত। ইতিহাস শব্দের অর্থ, সংস্কৃতে আর বাংলায় ভিন্ন। পুরাণের বিচারে ভুলের সম্ভাবনায় ভরা। ইত অর্থে যা গত হয়েছে, বৃত্ত অর্থে বর্ণনা। ইতিবৃত্ত, এই পারিভাষিক প্রয়োগে ভুলের সম্ভাবনা নেই।

দ্বারাবতী ভ্রমণে যাবার দেখছি বিস্তর ঝকমারি। পথঘাটের নিশানা পাওয়া ভারী দুষ্কর। পথ চিনে যাওয়ার হাজার হাজার বছরের কাঁটা। কাঁটা না, কালের স্তর। অথচ ঠিক ঠিক পথে যাচ্ছি কি না, সে-সংশয়ে হোঁচট খাচ্ছি বারে বারে। কিন্তু সংশয় না ঘূচিয়ে উপায় নেই। দিঙ্‌নির্ণয়ের সঙ্গে সঙ্গে অতএব পথ বন্ধন করো। যার নাম যুক্তিতে হদিশ।

আমি নৈয়ায়িক না, ন্যায়শাস্ত্রের কূট চালেও নেই। পুরাণের ইতিবৃত্তের পথই আমাকে খুঁজে নিয়ে যেতে হবে। পুরাণকারের কথা আগেই বলেছি, তাঁদের ইতিবৃত্তের লক্ষণ বা উপাদান সর্গ, প্রতিসর্গ, বংশ, মন্বন্তর, বংশানুচরিত। সৰ্গ বোঝায় বিশ্বের সৃষ্টি, প্রতিসর্গ প্রলয়। রাজা ঋষি প্রধান ব্যক্তিগণ দেবতা দৈত্যগণের বংশের উৎপত্তি স্থিতি বিলোপ আর বংশানুক্রম। বংশ শব্দের অর্থ ইংরেজিতে কি ডাইনাস্টি? হ্যাঁ একেবারে সম্যক বংশ বর্ণনা। মন্বন্তর এখানে ‘দুটো ভাত দাও মা’ দুর্ভিক্ষের অর্থে না। মন্বন্তর মনুকাল। কাল গণনার জন্যই যুগকাল আর মনুকাল পুরাণকারেরা ধরে নিয়েছেন।

এই ইতিবৃত্তকারগণ কারা? দেখছি, পুরাকালে প্রত্যেক রাজার নিজের ইতিবৃত্তকার থাকতেন। এঁদের বলা হত মাগধ। এঁদের কাছ থেকে বিভিন্ন রাজবংশের বিবরণ সংগ্রহ করতেন সূতগণ। এই সূতেরাই হলেন খাঁটি লোক, কোনও বিশেষ বংশের পোঁ ধরা ছিলেন না। মিথ্যাকে কাট-ছাঁট করতে জানতেন। তাঁদের বিবরণ পুরাণের মূল ভিত্তি। তাঁরা এক একজন ছিলেন স্যার যদুনাথ সরকার। সূত ঋষিগণকে বলছেন, আপনাদের দ্বারা পুরাণ কথনে প্রণোদিত হয়ে আমি নিজেকে পবিত্র আর অনুগৃহীত বোধ করছি। আমার স্বধর্ম, দেবতা আর ঋষিগণের, অমিততেজসম্পন্ন রাজাদের, খ্যাতনামা মহাত্মাদের বংশবৃত্তান্ত জানা এবং ধারণ করে রাখা। কিন্তু বেদে আমার কোনও অধিকার নেই। অথচ পুরাণ বেদসস্মিতম্‌।

বেদের আগে পুরাণ। আমি আদি পুরাণে যা শুনেছি, মহাত্মা ঋষিগণ যা বলেছেন, পরাশরপুত্র গুরু দ্বৈপায়ন অতি কষ্টে যা নির্ণয় করে গিয়েছেন, ঠিক যেমনটি শুনেছি, তেমনটি আপনাদের শোনাই। আমাকে (আমাদের) বলা হয়েছে, অতিশয় বিশ্বাসভাজন বিদ্বান লোমহর্ষণ সূত। আমি যে-কথা যেমনভাবে শুনেছি ঠিক সেইভাবেই বলি। আমার স্বধর্মের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য সত্যব্রতপরায়ণতা, বিশ্বস্ততা। আমি নির্ভীক, ক্ষমতাবানদের ভয় করি না। রাজনৈতিক কারণে, কোনও নেতা রাজা বা বংশের কাছ থেকে ঘুষ খাই না।

আমি সাধারণের উপযোগী আর লোকহিতার্থে, ভাষাকে যথাসম্ভব সরল করি।

আহা, বুঝেছি হে! পুরাণের অতিরঞ্জন আর অত্যুক্তির কথা বলবে তো? ভ্রূকুটি সন্দেহ দেখেই তা বুঝতে পেরেছি। দেখো, পক্ষপাতবশে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ‘ইতিহাস’ লেখকগণ যে-সব অতিরঞ্জন কথা বলেন, এঁদের বলার গুণে মিথ্যা সহজে ধরা পড়ে না। আমাদের অতিরঞ্জন একেবারে জ্বলজ্বল করে, ধরিয়ে দিতে হয় না। সেইজন্যই এত সন্দেহ। কিন্তু আমাদের বৈশিষ্ট্যগুলো মানবে তো? আমাকে তুমি চসার সাহেব বলে ধরে নিলে সব গোলে হরিবোল হয়ে যাবে। ধরো, আমি বললাম, রাম পনেরো বছর বয়সে সীতাকে বিয়ে করলেন, সাতাশ বছর বয়সে বনে গেলেন, বিয়াল্লিশ বছর বয়সে অযোধ্যায় ফিরে রাজ্যে অভিষিক্ত হলেন। তারপর? তারপরেই বললাম, রাম একাদশ সহস্র বৎসর রাজত্ব করে স্বর্গারোহণ করলেন।

তোমার যত সন্দেহ আর অবিশ্বাস, এই শেষের কথায়, কেমন নাকি? বিয়াল্লিশ বছর পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। তারপরেই একেবারে এগারো হাজার বছর! কেন, তোমরা কি কীর্তিমানকে আশীর্বাদ বা গৌরব করে বলো না, ‘হাজার বছর পরমায়ু হোক!’ পশ্চিমের লঙ্‌লিভ-কে তোমরা তোমাদের প্রিয়জন অমুক গান্ধী আর তমুক বসুকে, খুশির উত্তেজনায় বলো, যুগ যুগ জিও। ভালই জানো হাজার বছরের পরমায়ু নিয়ে কেউ জন্মায় না, যুগ যুগ জিইয়েও কারওকে রাখা যায় না। তবু তো বলা। তার বলাটা শিখিয়েছি আমরাই। মহত্ত্ব বীরত্ব সুকৃতি অতুলনীয় কীর্তির গৌরব করতে হলে, আমরা এমনই অতিশয়োক্তি করি। তা হলে রামের মতো একজন রাজার এগারো বছরের রাজত্বের আশ্চর্য ঘটনাবহুল কীর্তিকে এগারো হাজার বলতে দোষ কী?

‘পুরাণের অতিরঞ্জনের এটি একটি চাবিকাঠি বলে জানবে। এই ‘হাজার’ হল উপলক্ষণ প্রয়োগ। যেমন আরও দু’-একজনের কথা বলি। কার্তবীর্যার্জুন পঁচাশি হাজার বছর বেঁচে ছিলেন। অলর্ক ছেষট্টি হাজার বছর রাজত্ব করেছিলেন। হাজারের উপলক্ষণ সরিয়ে দেখবে, কার্তবীর্যার্জুন পঁচাশি বছর বেঁচে ছিলেন। অলর্ক ছেষট্টি বছর রাজত্ব করেছিলেন। এও কীর্তিরই গৌরব। যে-দেশে, যাদের যেমন। পৃথিবীর আর কোনও দেশে তুমি এমন আশীর্বাদ শুনেছ, হাজার বছর বাঁচো। শত পুত্রের জননী হও।

‘আর একটা কথা তোমাদের শোনাই। ‘দিবি আরোহণ’ বলে একটা কথা আছে। এসব শুনলে, তোমার কুসংস্কার ঘুচবে, সত্যকে জানতে পারবে, পুরাণকে বিস্মিত শ্রদ্ধায় প্রণাম জানাতে শিখবে। এর নাম জ্ঞান। দিবি আরোহণ, মানুষেরই দেবত্বলাভের কথা। উত্তম মানুষ প্রতিলোম ক্রিয়ায় দেবতা হন। প্রতিলোম ক্রিয়ার আশ্চর্য সূত্র হল, উত্তম মানুষ প্রথমে মানুষ রূপেই পূজিত হন, তারপরে তিনি দেবতা হন, তারপরে তাঁকে জ্যোতিস্ক রূপে কল্পনা করা হয়।

‘যেমন ইন্দ্ৰ একাধিক এবং সকল ইন্দ্ৰই প্রথমে মানুষ ছিলেন, পরে দেবতা তারপরে সূর্য। দিবি আরোহণের এই সূত্র না মানলে ঋক্‌বেদের ইন্দ্র বিষয়ক সমস্ত সূক্তগুলোর সরল অর্থ পাওয়া যাবে না। মানুষ দেবতা আর সূর্য এই তিনরকমেই ইন্দ্রের কীর্তিকলাপ ঋক্‌বেদে বর্ণিত হয়েছে। কৃষ্ণ মানুষ, কৃষ্ণ নারায়ণ, কৃষ্ণ সূর্য। ধ্রুব মানুষ, ধ্রুবই আবার জ্যোতিষ্ক। সূক্তগুলোকে যিনি জ্ঞান আর বুদ্ধির দ্বারা সূক্ষ্মভাবে পাঠ করেন, তিনিই দেবতার মনুষ্যত্ব নির্ণয় করতে সক্ষম।

‘তোমার যাত্রা দ্বারাবতী। তোমাকে আমি কয়েক হাজার শ্লোক শোনাব না। দেবতা কারা, স্বর্গ কোথায়, এই পথ বন্ধন করে নিতে পারলে তোমার যাত্রা যথার্থ হবে। আগে দেবতার পরিচয় হোক। আমি প্রাকৃতিক শক্তির অভিমানিনী দেবতার কথা বলেছি। এখন যে-দেবতার কথা বলছি, তাঁরাই দেব দৈত্য ইত্যাদি নামে পরিচিত। তোমরা এখন সকল জাতিকেই মানুষ বলো। আমি মানুবংশীয়দের প্রতি একমাত্র মানুষ শব্দ প্রয়োগ করেছি। আন্যান্য জাতি হলেন, দেবতা অসুর গন্ধর্ব সর্প নাগ সিদ্ধ যক্ষ রক্ষ ইত্যাদি। অসুরেরা ছিলেন দেবতাদের জ্ঞাতি ও বন্ধু। ‘সিসৃক্ষোৰ্জঘানাৎ পূর্বমসূরা জাজ্ঞিরে ততঃ, ততঃ পুরা।’ স্বয়ম্ভূব মনুর আদিবিন্দু থেকে আমরা ব্রহ্মাকেই সৃষ্টিকর্তা বলে জেনেছি। তিনি প্রথমে অসুরদের সৃষ্টি করেছিলেন, শ্লোকটা তাই শোনালাম। তারপরে দেবতা, পরে পরে পিতৃগণ, মানুষ, যক্ষ রক্ষ সর্প গন্ধর্ব। ঋক্‌বেদে কোনও কোনও জায়গায় ইন্দ্রকে অসুর বলা হয়েছে। অনেকটা, তোমরা যখন কারওকে বলো, লোকটা অসুর সেইরকম ভাবে। অসুরেরা ছিলেন অতি শক্তিশালী জাতি। দেবতাদের কোনও কোনও জ্ঞাতিবর্গ পরবর্তীকালে নিজেদের অসুর বলেই পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। কিন্তু দেবতাদের দায়াদ বন্ধু বললেও অসুরদের সঙ্গে দেবতাদের ইন্দ্ৰত্ব নিয়ে বিবাদ বিসংবাদ প্রায়ই লেগে থাকত।

‘আমি কী বলি জানো? পুরাণের সাহায্য ছাড়া বেদের অর্থ কখনও সুগম হয় না। আমি সূত, আমি যদ্দৃষ্টং বর্ণনা করি, যথাশ্রুতি বলি, ঋষি লেখেন। আমি বলি, যে পুরাণ জানে না, বেদ তার কাছে প্রহৃত হবার আশঙ্কা করেন।

‘আমি তোমাকে একজন ইন্দ্রের কাহিনী বলব। বিভিন্ন ইন্দ্রের কীর্তি এঁর ওঁর ঘাড়ে চেপে অনেক সময়েই গোল বাধিয়েছে। আমি যাঁর কথা বলছি এঁকে বলা হত, বৃএহন্তা বজ্রধারী, পুরন্দর ইন্দ্র। বিরাট যোদ্ধা ছিলেন। পুরন্দর অর্থে যিনি পুরী ধ্বংসকারী। অসুরদের অনেক নগর ইনি ধ্বংস করেছিলেন।

‘ঝটিতি তোমাকে একটা কথা বলে রাখি। তোমাদের কালে কোনও কোনও পণ্ডিত মহেন-জ-দরো সভ্যতাকে প্রাক আর্য দ্রাবিড় সভ্যতা বলে দাবি করেছেন। না জেনে করেছেন, আসলে ভিত্তিহীন অনুমান এবং আন্দাজ। অনুমানে প্রমাণসিদ্ধি হয় না। মহেন-জ-দরো আবিষ্কার পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভাল। তখন স্বর্গ এবং ইন্দ্রদের ইতিবৃত্ত আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। আরও বলে রাখি, দেবতারা মানুষ ছিলেন। কথাটা আগেও বলেছি। পুরন্দর ইন্দ্রও একজন বীর মানব। জাতিতে দেবতা।

তোমাদের একজন সুবিখ্যাত পণ্ডিত, ঋকবেদসংহিতার অনুবাদক রমেশচন্দ্র দও, মানুষ ইন্দ্রের দেবত্ব বিষয়ে অনেকগুলো ঋকের অনুবাদ করেছেন। আমি কয়েকটি তোমার সামনে তুলে ধরছি:

‘হে অশ্বযুক্ত ইন্দ্র, ত্বরান্বিত হয়ে স্তোত্র গ্রহণ করতে এসো। এই সোম অভিষবযুক্ত যজ্ঞে আমাদের অন্ন ধারণ করো।’

‘হে সোমপায়ী ইন্দ্র, আমাদের অভিষবের নিকট এসো, সোম পান করো। তুমি ধনবান, তুমি হৃষ্ট হতে গাভী দান করো।’

‘হে শতক্রতু, এই সোম পান করে তুমি বৃত্র প্রভৃতি শত্রুদের বিনাশ করেছিলে। যুদ্ধে (তোমার ভক্ত) যোদ্ধাদের রক্ষা করেছিলে।’

‘হে ইন্দ্র, দৃঢ় স্থাপনে ভেদকারী এবং বহনশীল খরুৎদের সঙ্গে তুমি গুহায় লুকিয়ে রাখা গাভী সমুদয় খুঁজে উদ্ধার করেছিলে।’

‘যুবা মেধাবী প্রভূতবলসম্পন্ন সকল কর্মের ধর্তা বজ্রযুক্ত বহুস্তুতিভাজন ইন্দ্র (অসুরদের) নগরবিদারকরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।’

‘বজ্রধারী ইন্দ্র প্রথমে যে পরাক্রমের কাজ করেছিলেন, তাঁর সেই সব কাজের বর্ণনা করি। তিনি অহিকে (মেঘকে) হনন করেছিলেন, পরে বৃষ্টিবর্ষণ করেছিলেন, বহনশীল পার্বতীয় নদীসমূহের (পথ) ভেদ করে দিয়েছিলেন।’

‘সব সূক্তগুলো শোনাতে গেলে অনেক সময় লেগে যাবে। দ্বারাবতী যাত্রার জন্য তুমি অতি ব্যস্ত হয়েছ। এবার আমি আর কয়েকটি সূক্ত শোনাব, তারপরে ব্যাখ্যা করব এসব সূক্তের অর্থাগুলো। এবার শোনো, ইন্দ্রও নিজের বজ্র নিজে হেনে, কেমন ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।’

‘হে ইন্দ্র, অহিকে হনন করার সময় যখন তোমার হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার হয়েছিল, তখন তুমি অহির কোন হন্তার জন্য অপেক্ষা করছিলে, যে ভয় পেয়ে শ্যেন পাখির মতো নবনবতি নদী ও জল পার হয়ে গিয়েছিল।’

‘তুমি শুষ্ণ (অসুরের) সঙ্গে যুদ্ধে কুৎস ঋষিকে রক্ষা করেছিলে, তুমি অতিথিবৎসল (দিবাদাসের রক্ষার্থে) শম্বর (নামক অসুরকে) হনন করেছিলে। তুমি মহান অর্বুদ (নামক অসুরকে) পদদ্বারা আক্রমণ করেছিলে, অতএব তুমি দস্যুহত্যার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছ।’

‘ত্বষ্টা তোমার যোগ্য বল বৃদ্ধি করেছেন, এবং তার পরাভবকারী বল দ্বারা বজ্র তীক্ষ্ণ করেছেন।’

‘ইন্দ্র পৃথিবীর ওপরে স্থাপিত মধুর উদকপূর্ণ যে-চারটি নদী জলপূর্ণ করেছেন, তা সেই দর্শনীয় ইন্দ্রের অতিশয় পূজ্য ও সুন্দর কর্ম।’

‘তিনি বৃত্রকে বধ করে তন্নিরুদ্ধ বারি নির্গত করেছিলেন।’

‘তিনি সুদর্শন, সুন্দর নাসিকাযুক্ত ও হরি নামক অশ্বযুক্ত, তিনি আমাদের সম্পদের জন্য দৃঢ়বদ্ধ হাতে লৌহময় বজ্র স্থাপন করলেন।’

‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী ইন্দ্র দধীচির (মূলে ঋষি নামের উল্লেখ নেই) অস্থি দ্বারা বৃত্রগণকে নবগুণ নবতিবার বধ করেছিলেন।’

‘নদীসমূহ যার নিয়মানুসারে বহে যায়।’

‘যিনি মহতি সেনার নায়ক তিনিই ইন্দ্র।’

‘তিনি বজ্রের দ্বারা নদীর নির্গমদ্বার সকল খুলে দিয়েছিলেন।’

‘ইন্দ্র নিজ মহিমায় সিন্ধুকে উত্তরবাহিনী করেছেন।’

‘তুমি বদ্ধ সিন্ধুগণকে উন্মুক্ত করেছ।’

‘আমি সূত, পুরাণকারের একমাত্র বাহন। আমি বলি, এই যে আশ্চর্য বলবীর্যশালী পুরুষ, স্বাভাবিক দিবি আরোহণের ফলে, ইনিই আন্তরীক্ষ দেবতা কল্পিত হন। যেমন তাঁদের অনেকের পরে রাম বা কৃষ্ণ ভগবান হয়েছিলেন। যেমন পরে তোমরা দেখেছ, নবদ্বীপের নিমাই মিশ্র নিজ মহিমায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য হয়েছিলেন। এখন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ভগবান। আমি তো দেখি, ভাদ্রমাসে জন্মাষ্টমী উৎসবের তুলনায় গান্ধী রবীন্দ্রনাথ সুভাষ বসুর জন্মদিনের উৎসব আয়োজন পূজা কিছুমাত্র কম নয়।

‘এখন এই পুরন্দর ইন্দ্রের বিষয় বুঝতে পারলে? তাকে বিশেষভাবে বৃত্রহন্ত বলা হয়। এই বৃত্রকে বলা হয়, হিরণ্যকশিপুর কন্যা রমা ও মহর্ষি ত্বষ্টার ছেলে। আমি জানি, ত্বষ্টা নামে একাধিক গুণী ব্যক্তি ছিলেন। যদিও ঋক্‌বেদে বলা হয়েছে, ত্বষ্টাপুত্র বৃত্রকে ইন্দ্র নিহত করেছিলেন। কিন্তু তার আগে বৃত্র তদানীন্তন ইন্দ্রকে আঠারোবার পরাজিত করেছিলেন। স্বর্গের সম্রাটদের ‘ইন্দ্র’ বলা হয়, অতএব তাঁর কাছে এই পরাজয় ছিল অত্যন্ত অসম্মানজনক ও হৃদয়বিদারক

‘আমার মনে হয়, পুরন্দর ইন্দ্রের বিশেষ কীর্তিসমূহ শোনাবার আগে তোমাকে স্বর্গের অবস্থানটা জানানো দরকার। আমি সূত, স্বর্গের ঠিকানা আমার জানা আছে। ভারতের উত্তরে হিমালয়। হিমালয়ের উত্তরে হেমকূট, তার দক্ষিণে কিম্পূরুষবর্ষ। হেমকুটের উত্তরে হরিবর্ষ। হরিবর্ষের উত্তর সীমা নিষধ পর্বত। নিষধের উত্তরে “ইলাবৃতবর্ষ”। ইলাবৃতের উত্তরসীমা নীলাচল।

‘এই ইলাবৃতবর্ষ, তোমাদের এখনকার মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত। আধুনিক পামির পূর্বতুর্কিস্থান ইলাবৃতবর্ষের অন্তর্গত। এই ইলাবৃতবর্ষেরই অপর নাম “স্বর্গ”। তোমাদের কে একজন কবি যেন লিখেছেন, “কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহু দুর/ মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেই সুরাসুর।” আসলে এই কবিও স্বর্গ নরকের একটা কল্পনা করেছিলেন, কিন্তু ভৌম স্বর্গের ভৌগোলিক অবস্থান জানতেন না।

‘পুরাকালে এই ইলাবৃতবর্ষ অতি সমৃদ্ধ স্থান ছিল। পরে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে, নদনদী শুকিয়ে থাকার সভ্যতা লুপ্ত হয়। আরও একটা কারণ, আমি অনেকবার বলেছি, তেত্রিশ কোটি দেবতা। তার মানেই, স্বর্গ অত্যন্ত জনাকীর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। অতএব ভারতবর্ষে আগমন।

‘আমি জানি যেখানে বলি যজ্ঞ করেছিলেন, সেই সুবিস্তৃত প্রদেশের নাম ইলাবৃতবর্ষ। এই স্থান দেবগণের জন্মস্থান। তাঁদের বিবাহ, যজ্ঞ, জাতকর্ম, কন্যাদান প্রভৃতি যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ এই প্রদেশেই অনুষ্ঠিত হয়। দেবগণ আধুনিক তুর্কিস্থান থেকে কাশ্মীরের পথে পাঞ্জাব, পাঞ্জাব থেকে বিন্ধ্যাচলের উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত অধিকার করেন। তারপরে বিন্ধ্যের দক্ষিণেও অগ্রসর হন। বলতে গেলে, আস্তে আস্তে তাঁরা সারা ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে পড়েছিলেন। আমি এইভাবে ভাগ করি, ইলাবৃতবর্ষ কাশ্মীর বিন্ধ্যোত্তর ভারত এবং দক্ষিণাপথ পর্যায়ক্রমে স্বর্গ, অন্তরীক্ষ, মর্ত, পাতাল নামে পরিচিত। ভারতীয়দের পূর্বপুরুষেরা প্রথমে কাশ্মীর বা অন্তরীক্ষে এসে বাস করেন তাই তার অপর নাম পিতৃলোক।

‘দেবগণ যখন প্রথমে ভারতে এলেন, তখন তাঁরা ইন্দ্রের অধীন ছিলেন। ভারতে তখন কেউ রাজা ছিলেন না। দেবগণ ভারতে এসে মানব জাতি হলেন, কারণ ইন্দ্রের প্রতিভূর নাম হল মনু বা প্রজাপতি। পরে ভারতে রাজা হয়ে, বেণরাজা প্রথম ইন্দ্রের বশ্যতা অস্বীকার করেন। ইলাবৃতবর্ষই যেহেতু আদি বাসস্থান, অতএব পবিত্র তীর্থভূমি বিবেচিত। যুধিষ্ঠিরের সময়েও স্বর্গে তীর্থযাত্রার প্রচলন ছিল। স্বর্গের পথ ক্রমেই দুর্গম হয়ে পড়ে। আর দিবি আরোহণের ফলে, স্বর্গ মৃত পুণ্যাত্মাদের বাসস্থান কল্পিত হয়েছে, দেবযান পরিণত হয়েছে নক্ষত্রবীথিতে। এখন স্বর্গপ্রাপ্তি মৃত্যুর নামান্তর। আমি মৎস্যপুরাণে একজন ইন্দ্রকে “হীনচেতা” বলেছি, কারণ সে সামরিক কারণে, যখন থেকে বজ্র দ্বারা স্বর্গপথ রোধ করে, তখন থেকে লোক সকলের স্বর্গমার্গ নিবারিত হয়। তার মানে পাহাড় ধসিয়ে পথরোধ করা হয়। এই পথ ছিল মধ্য এশিয়া আর ভারতে যাতায়াতের বণিকপথ। কিন্তু স্বর্গ দর্শনের আকাঙক্ষা অমর, অতএব দেবযান পথ বন্ধ হয়ে গেলেও বদরিনারায়ণ আর মানস সরোবরের পথে অনেকে স্বর্গে যেত। যুধিষ্ঠিরকে এই পথেই যেতে হয়েছিল। এই সেই কৈলাসপতি রুদ্র— অর্থাৎ শিবের রাজত্ব। তিব্বতে চিরকালই ভূত প্রেতের নাচ প্রসিদ্ধ। এরা শিবের অনুচর। ইন্দ্রের অনেক পরে শিবও ঋষিদের যজ্ঞভাগী হন।

‘মনে রেখো স্বর্গেরও উত্তর কুরুতে ছিল ব্রহ্মলোক আর বিষ্ণুলোক। আর ভারতীয়দের মতোই, স্বর্গের দেবতাদের আকাঙক্ষণীয় তীর্থ ছিল ব্রহ্ম ও বিষ্ণুলোক। দেবতারা নিজেদের সেই লোকেরই অধীন মনে করতেন। এখন তুমি এই দুই লোকের সন্ধানে কাসপিয়ান সাগরের কূলে কিংবা সাইবেরিয়ায় যেতে পারো, সন্ধান মিললেও মিলতে পারে। স্বর্গের নেতা অধিপতি ইন্দ্রগণ বিপদে পড়লে বিষ্ণুর পরামর্শ নিতেন। একাধিক ইন্দ্রের মতো, বিষ্ণু বরুণ মিত্রও একাধিক।

‘ভারতের বিন্ধ্যাচলের উত্তর ভাগের নাম পৃথিবী বা মর্ত। পৃথু রাজার রাজ্যই পৃথিবী। বিন্ধ্যাচলের দক্ষিণভাগ পাতাল। পাতালকে আমি ভূবিবর বলেছি, দক্ষিণদেশও বলেছি। পাতালেরও সাত ভাগ আছে। আমি পাতালের সাত ভাগে দেখেছি বহু সুন্দর নদ নদী উপবন আর নগর। নারদ বলেছেন, পাতাল স্বর্গাপেক্ষাও মনোরম।

‘দ্বারাবতীর কোন উপাখ্যান তুমি বলবে, জানি না, কিন্তু পাতালের বর্ণনা শুনে রাখো। অতল— ময়পুত্র মহামায়ার রাজত্ব। বিতল— হাটকেশ্বর হর। সুতল— বৈরোচন বলি। তলাতল— ময় ত্রিপুরাধিপতি। মহাতল— সর্পজাতি! রসাতল— দানবজাতি। পাতাল— নাগজাতি। অঙ্গ-বঙ্গ কলিঙ্গ— সুতল। আমি পাতালের অধস্তন প্রদেশে সংকর্ষাগ্নি দেখেছি। যবদ্বীপের আগ্নেয়গিরির কথা মনে রেখো। একটা হিসাব দিয়ে রাখি, বলির রাজ্যকাল, তিন হাজার চারশো সাতান্ন খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কপিল পাতালবাসী ছিলেন।

‘পুরাণের ইতিবৃত্ত প্রমাণের একটি আশ্চর্য ঘটনা এখানে শোনাই। সগরের বংশধর ছেলে অসমঞ্জ এবং আরও যাট হাজার ছেলে পাতালে কপিল শাপে বিনষ্ট হয়, এ আমারই কথা। ষাট হাজার অশ্ববাহিনীকে আমি যজ্ঞীয় অশ্ব বলি। সগর অশ্বচোরের সন্ধানে যাদের পাঠালেন, তারা ঘোড়ার খুরের চিহ্ন দেখে দেখে, কপিলের কাছে উপস্থিত হয়ে, তাকেই চোর ভেবে ধরতে গিয়ে কপিলের অগ্নিপিঙ্গল বর্ণের দিকে তাকিয়েই অভিশপ্ত হয়ে মারা গেল। তখন সগর পৌত্র অংশুমানকে অশ্বের সন্ধানে পাঠালেন। অংশুমান সাবধানী, তিনি কপিলকে খুশি করে যজ্ঞীয় অশ্বসকল নিয়ে পিতামহকে ফিরিয়ে দিলেন। অংশুমানের ছেলের নাম দিলীপ। দিলীপের ছেলের নাম ভগীরথ।

‘জানো তো ভগীরথ গঙ্গা আনয়ন করেছিলেন। আসলে, তোমাদের ভঙ্গিতে বললে, বলতে হয়, ভগীরথ একজন ইরিগেশনের বীর ইঞ্জিনিয়ার যিনি গঙ্গাকে খাল কেটে সুদীর্ঘ পথে সাগরে মিশিয়েছিলেন। সগর বংশের এইটি একটি মহান কীর্তি। সগর খাল কাটিয়ে গঙ্গাকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করতে চেয়েছিলেন। সেই জন্য প্রথমে বংশধর পুত্র অসমঞ্জ এবং আরও যাট হাজার অশ্বারোহী পুত্রকে পাঠিয়েছিলেন। লক্ষ রেখো, অসমঞ্জ ‘বংশধর পুত্র’, বাকিরা কেবলই ‘পুত্র’। এটাই আমাদের— সূতদের বৈশিষ্ট্য। ষাট হাজার খননকারী কর্মীকেও আমরা সগর পুত্র বলে উল্লেখ করলাম, কিন্তু বংশধর পুত্র বললাম না।

‘তা হলে দেখা যাচ্ছে, অসমঞ্জ, তারপরে অংশুমান। তারও পরে অংশুমানের পৌত্র ভগীরথ আবার সেই খাল খননের কাজে লাগলেন। কিন্তু কে কপিল। কীসে এত বিস্তর লোক মারা গেল?

‘কৃষ্ণ একবার বলরাম আর প্রদ্যুম্নকে সঙ্গে করে বাণরাজ্য থেকে অনিরুদ্ধকে উদ্ধার করতে গিয়ে মাহেশ্বর জ্বরের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। বাণরাজ্য আধুনিক আসাম। মহেশ্বর জ্বর শুনলেই ব্যাধির নাম মনে আসে আর সেই ব্যাধি অতি ভয়াবহ দৈত্যের থেকেও ভয়ংকর।

‘বাঙালিরা দক্ষিণে ম্যালেরিয়ার কথা কখনও ভুলবে না। যকৃতের দোষ, চোখ হলদে আর বিভীষিকাময় জ্বর। পিঙ্গলবর্ণ কপিলের ইঙ্গিত সেখানেই। ঘোড়াগুলো চরে বেড়াচ্ছিল, ষাট হাজার খননকারী মরে পড়ে ছিল। অতএব কপিলকে সাধনা করেই সাধ্যায়ত্ত করতে হয়। অসমঞ্জ থেকে ভগীরথ তিন পর্যায়কাল ব্যবধান— আমার হিসাবে পঁচাশি বছর সময় লেগেছিল। তাই আমি গঙ্গাকে একটি নতুন নাম দিলাম ভাগীরথী। সগরের নামানুসারে, সমুদ্রকে সাগর। এই বিশাল আর পুণ্য কর্মের জন্য গঙ্গাসাগর বিন্দুকে তীর্থ বোধ করলাম, আনন্দে অবগাহন করলাম। কিন্তু কপিলের স্থান তাই দুরন্ত শীতে পৌষ সংক্রান্তির দিন ধার্য। তান্য কোনও ঋতুতে নয়, কপিল ক্ষুব্ধ হতে পারেন।

‘মনে রেখো, এই কপিল, সাংখ্যকার কপিল মুনি নন। ব্রহ্মা তাঁকে জন্মাতে দেখেছিলেন সৃষ্টির আদিতে। ইনি মানুষ নন। সৃষ্টির আদিতে যে হিরন্ময় অণ্ড জন্মেছিলেন আমরা তাঁকে তারই অধিষ্ঠাত্রী দেবতা বলেছি। এক এক অস্বাস্থ্যকর সংক্রামক রোগের স্থানে, সগর সন্তানদের মতো অনেক মৃত্যুর খবর তোমরাও জানো। মিরজুমলার দুই লক্ষেরও বেশি সৈন্য আসামে গিয়ে জ্বরে মারা গিয়েছিল।

‘আমি জানি, পুরাকালে অনেক ব্যক্তি খাল খনন পূর্তাদি কাজে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। জানি, গঙ্গাকে খনিত খাল ভাবতে তোমার বিশ্বাসে আঘাত লাগছে। কিন্তু মানুষের কীর্তিই পূণ্য, তাঁর দিবি আরোহণ সেখানেই। এই বিশাল কর্মকে প্রণাম করি, পুণ্যাবগাহন করি।

‘তোমার দ্বারাবতী যাত্রা আর সবুর সইছে না। অথচ এসব না জেনে, যাত্রাটাও ঠিক হবে না। আসলে তোমার বাইরে ত্বরা, অন্তরে তুমি তন্ময়। এবার তোমাকে পুরন্দর ইন্দ্রের কয়েকটি কথা বলি। বৃত্রের সঙ্গে ইন্দ্র যুদ্ধে বারবার পরাজিত হয়ে খুবই শান্তি বোধ করেছিলেন। বৃত্র যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলেন। তিনি ইন্দ্র আর তাঁর প্রজাবর্গকে উৎপীড়ন করার জন্য, পাহাড় ধসিয়ে চারটি নদীপথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ইন্দ্র বৃত্রকে হনন করে বজ্রাঘাতে পর্বতকে বিদীর্ণ করে রুদ্ধ নদীপথ খুলে দিয়েছিলেন। তাই তিনি পর্জন্যদেব, জলমোচনকারী। সূক্তগুলোর কথা মনে করো।

‘কিন্তু মানুষ কেমন করে বজ্রকে ধারণ করবেন? না, প্রাকৃতিক বজ্রকে কেউ ধারণ করতে পারেন না। তথাপি আমি দেখছি, বজ্র ইন্দ্রের আয়ুধ। এই বজ্র তোমাদের বন্দুকের মতোই এক অস্ত্র ছিল। এই বজ্র সুদূরপাতী। এই অস্ত্রটির জন্য ইন্দ্ৰ হতাশ হয়ে বিষ্ণুর কাছে গিয়েছিলেন। বিষ্ণু বললেন, ‘এই বৃত্র অস্থিময় বজ্রের দ্বারা নিহত হবে।’ ইন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন জীবের অস্থি দিয়ে এই বজ্র তৈরি হবে? গজ, শরভ বা অন্য কোন জন্তুর অস্থি আবশ্যক আমাকে তা বলুন।’

বিষ্ণু বললেন, ‘সুরাধিপ, সেই জীব শত হস্ত প্রমাণ, মধ্যে ক্ষীণ দুই পার্শ্বে স্থূল ছয় কোণ অর্থাৎ পলযুক্ত ভীষণাকৃতি হওয়া চাই।’ ইন্দ্র হতাশ হয়ে বললেন, ‘আমার পরিচিত ত্রৈলোক্য মধ্যে এমন কোনও প্রাণীই যে দেখি না।’

‘আমি তোমাকে এখন আর রূপকের কথা বলব না। সরাসরি বলব। বিষ্ণু বললেন, ‘সরস্বতী তীরে যে বিশাল দধীচি আছেন তিনি এর দ্বিগুণ। ইন্দ্র সরস্বতী তীরে গিয়ে দধীচির দেখা পেলেন। আমি অবিশ্যি এখানে দধীচিকে বিপ্র বলেছি, এটাই আমার বৈশিষ্ট্য। ইন্দ্র গিয়ে তাকে বললেন, ‘হে বিপ্র, আপনি ভিন্ন এত বিশাল প্রাণী আর দেখি না।’ অতএব ইন্দ্র দধীচির অস্থি গ্রহণ করলেন। তাঁর করোটি অশ্বমস্তকের ন্যায় দেখতে ছিল। অস্থির অন্য অংশ না মস্তকটি চাই, আর তার জন্য ইন্দ্রকে, পাহাড়ে লুকানো শরণাবতে সরোবরে তা খুঁজে পেতে হয়েছিল।

‘তোমার চোখের সামনে কি প্রাচীন প্রাণী ডাইনোসোরাসের ঘোটক জাতীয় করোটি ভেসে উঠছে? উঠলেও আমি কোনও মন্তব্য করব না। কিন্তু অস্থি পেলেই তো হবে না। বারুদ চাই, নির্মাণ করা চাই সেই ভয়ংকর আয়ুধ। তখন ইন্দ্র গেলেন আর একজন ত্বষ্টা নামক জ্ঞানীর কাছে। ইনি বৃত্রের পিতা ত্বষ্টা নন। এই ত্বষ্টার বারুদ বিষয়ে জ্ঞান ছিল। আর বারুদ তৈরি করতে জানতেন, ইলাবৃতবর্ষের সংলগ্ন ভদ্রাশ্ববর্ষে, তোমরা এখন যাকে চিন বলো, সেই দেশের বিশিষ্ট গুণধরগণ।

‘তোমাদের আধুনিক ভূবিজ্ঞানীরা, পূর্বতুর্কিস্থান আর তার নিকটবর্তী প্রদেশসমূহে, প্রাগৈতিহাসিক জীবের কঙ্কাল, কিছুকাল আগেও আবিষ্কার করেছেন। প্রাগৈতিহাসিক কাল বলতে, আমি সর্বদাই স্বয়ম্ভূ মনুকালের পূর্বের কথা বলি। বিলিতি বি-সি এ-ডি ইত্যাদির কথা বলি না। যে-প্রাণীর দ্বারা দেব ও মানবজাতির ইষ্ট হয়, আমরা সেই প্রাণীকেও ঋষিতুল্য জ্ঞান করি। আধুনিককালের ইতিহাস লেখকগণের সঙ্গে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির মূলত তফাত এইখানে।

‘যাই হোক, বজ্ৰায়ুধ সৃষ্টিকারী ত্বষ্টা ভদ্রাশ্ববর্ষ থেকেই বারুদ তৈরি করতে শিখেছিলেন। তিনি দধীচির অশ্ব করোটির ন্যায় সুবিশাল মস্তক দিয়ে যে বজ্ৰাস্ত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন, তা ছিল দীর্ঘ নালিক অস্থির সঙ্গে যুক্ত। বারুদ ধাতুখণ্ড প্রস্তুরাদি ঠাসা সেই বিশাল অস্ত্রের বর্ণনায় বেদ বলেছেন, বজ্রটি প্রকাণ্ড, শতপর্ব, চারপলযুক্ত।

‘তোমার নিশ্চয়ই খুব কৌতুহল হচ্ছে, বৃত্র কোন কোন নদীপথ, কোথায় অবরোধ করে, ইন্দ্রকে এবং তেত্রিশ কোটি দেবতাগণকে কষ্ট দিচ্ছিল? স্বাভাবিক। আমি সে-কথাও বলেছি। মানস সরোবরের কাছে বৃত্র দুটি নদীপথ অবরুদ্ধ করেছিল। বিপাশা আর শুতুদ্রী। আমি নদীদ্বয়ের মুখ দিয়েই বলিয়েছি, ‘নদীগণের পরিবেষ্টক বৃত্রকে হনন করে বজ্রবাহু ইন্দ্র আমাদের খনন করেছেন। জগৎপ্রেরক, সুহস্ত, দ্যুতিমান ইন্দ্র আমাদের প্রেরণ করেছেন, তাঁর আজ্ঞায় আমরা প্রভূত হয়ে গমন করছি।’ এই নদী দুটির তোমরা আধুনিক নাম দিয়েছ, বিয়াস আর সটলেজ।

‘অবিশ্যি পরবর্তীকালে অর্বাচীন সূতগণের দ্বারা এই দুটি নদীই চারটি হয়েছে, তারপরে সাতটি। এ-সবই গৌরবে বহুবচন। অর্বাচীনেরা চিরকালই ছিল, এখনও আছে, আর জ্ঞানী তার ভিতর থেকেই সত্যকে অনুসন্ধান করে আত্মসাৎ করেন।

‘এইবার সেই সূক্ত মনে করো, যখন বজ্ৰবাহু সেই বজ্র বৃত্রের প্রতি নিক্ষেপ করলেন, তার শব্দ এমনই বিশ্বপ্রকম্পিত, অগ্নি ও ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছিল, পর্বত ধসিয়ে দিয়েছিল, অবরুদ্ধ নদীদ্বয় আকাশের মতো উঁচু হয়ে প্রবাহিত হয়েছিল, স্বয়ং ইন্দ্র ভয়ে বহুদূর পালিয়ে গিয়েছিলেন। আমরাও ভেবেছিলাম, স্বর্গ লয় পেতে বসেছে। কিন্তু নদী দুটির প্রবল বহমানত, বৃত্রের অনুচরগণসহ মৃত্যুর সকলই যখন প্রত্যক্ষ হল, সবাই গিয়ে ইন্দ্রকে খবর দিলেন। এই জন্যই ইন্দ্রকে আমরা বলি, জলমোচনকারী। এই কারণেই তাঁর দিবি আরোহণের পরে তিনি জলবর্ষণকারী, অন্তরীক্ষ দেব হয়েছেন। বৈদিক দেবতাই হলেন শত্রুবিমর্দক পরাক্রান্ত যোদ্ধা।

‘আমরা সকলেই সেই স্বর্গের অধিবাসী, কোনওকালেই সেখানকার দেবদেবীদের, সেই সুন্দর স্থানের কথা ভুলতে পারি না। তোমাদের এখন যেমন বিশিষ্ট ব্যক্তির সংবর্ধনা সভা হয়, আমরাও সেইরকম সভা উৎসব করতাম। আমরা তাকে বলতাম যজ্ঞ। সেই যজ্ঞে ইন্দ্রকে আহ্বান করা হত। তাকেই প্রথম পাদ্যঅর্ঘ্য সোম ও অন্ন নিবেদন করা হত, এবং সকলেই সেই যজ্ঞে শামিল হয়ে, তাঁর স্তুতি করতাম। এক সময়ে গৃৎসমদ বলছেন, ‘লোকে এখন ইন্দ্রকে অবিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে।’ অতএব জনগণের বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য তিনি বলছেন, ‘যিনি মহতী সেনার নায়ক তিনিই ইন্দ্র। যিনি অহিকে (বৃত্রকে) বিনাশ করে সপ্তসংখ্যক (দুই) নদী প্রবাহিত করেছিলেন, যিনি গো উদ্ধার করেছিলেন, যিনি শত্রু বিনাশ করেন, যিনি বিশ্ব নির্মাণ করেছেন, তিনিই ইন্দ্র।’ এ কথাগুলো থেকে বুঝতে পারবে, ইন্দ্রগণ লুপ্ত হবার পরে তাঁদের নরত্ব কী করে আস্তে আস্তে অদৃশ্য দেবত্বে পরিণত হয়েছে। অতএব আমরা এখনও যজ্ঞভূমিতে তাঁকেই আহ্বান করি, তাঁর উদ্দেশেই সোম ও অর্ঘ্য নিবেদন করি।

‘জানি, তোমার দ্বারাবতী যাত্রার ভূমিকা কিঞ্চিৎ দীর্ঘ হল। কিন্তু তোমার যাত্রা দীর্ঘতর, তুলনায় এ-ভুমিকাকে দীর্ঘ বলা যাবে না। পুরাণের ইতিবৃত্তীয় সংকেত ও ইঙ্গিতগুলো পেলে, মানুষ ও তার দিবি আরোহণের ফলে দেবত্বের সংবাদ পেলে।

‘তোমার যাত্রার আগে, আর একটু সহজ কথা বলি। পৃথিবীতে সব দেশের, সব জাতির নিজেদের কতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে। আন্তর্জাতিকতা সেখানেই মহিমময় যখন সকলের সব বৈশিষ্ট্যগুলো পরস্পরের যোগসূত্রে বিশাল ও বর্ণাঢ্য হয়ে ওঠে। প্রাচীন ভারতীয়দেরও নানন বৈশিষ্ট্য ছিল, এখনও আছে। আমি একজন সূত হিসাবে দেখলাম, ভারতীয়রা যা প্রাণ ধরে রক্ষা করে, তার সঙ্গে ধর্মের একটা সম্পর্ক থাকে। পুরাণ তাদেরই জাতীয় ইতিবৃত্ত, কিন্তু আমি যদি কেবলমাত্র ‘ইতিবৃত্ত’ বলি, তা হলে তারা তা রক্ষা করবে না। অতএব আমি বললাম, পুরাণ ধর্মপুস্তক। এই পুস্তক প্রতিদিন পাঠ করা, লিখে দান করা, পাঠ করে অপরকে শোনানোর মতো পুণ্য আর কিছু নেই। সেইজন্যই পুরাণ এখনও বর্তমান আছে।

‘কিন্তু কালের প্রবাহকে আমি অস্বীকার করতে পারি না। গৃৎসমদ ঋষি কতকাল আগেই বলেছিলেন, ‘লোকে এখন ইন্দ্রকে অবিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে।’ ভারতীয়রাও সেইরকম বহু বহিরাগতদের শাসনে, শিক্ষায়, প্রলোভনে আপন জাতীয় ইতিবৃত্তকে ভুলতে বসেছে। হাম্পটিডাম্পটির ড্যাডরা তো পুরাণকে জানেই না, বিশ্বাসও করে না। তোমার এই দ্বারাবতী যাত্রার উদ্যমে আমি হৃষ্ট, কারণ তুমি জাতীয় ইতিবৃত্তেরই একটি অধ্যায় তুলে ধরতে যাচ্ছ। প্রকৃত ইতিবৃত্ত, নর ও দেবের ইঙ্গিত, তোমার দরকার ছিল। এখন তোমার দৃষ্টি স্বচ্ছ ও সহজগম্য হবে। আমার মনে হয়, পরেও আমাকে তোমার দরকার হবে। ডেকো, আসব। তোমার যাত্রা শুভ হোক।’

 

এবার মন চলো যাই ভ্রমণে, বাসুদেবের অঙ্গনে। ঠিকানা কী? দ্বারকানগরী। ইতিবৃত্তে বাসুদেব একজন থাকারই কথা। যিনি যেখানেই গমন করতেন, গমনের আগে তাঁর রীতি ছিল, শঙ্খ নিনাদের দ্বারা জ্ঞাতি বান্ধব আর নগরবাসীদের জানানো। যদুবংশের কয়েক শরিকের মধ্যে যিনি বৃষ্ণি গোষ্ঠীর নেতা বার্ষ্ণেয় সেই বাসুদেব তাঁর যাত্রার ঘোষণা এভাবেই করতেন। তার আগেই তাঁর রথের যিনি সারথি, তিনি দুর্মদ অরি নিধনকারী কৃষ্ণের আয়ুধাগার থেকে, রথে তুলে রাখতেন তাঁর ব্যবহারের বিশেষ অস্ত্র গদা শার্ঙ্গ এবং চক্র।

বংশপরম্পরার তালিকা, সে ভারী জটিল জালের বিষয়। তবু একটা ধরতাই থাকা ভাল। যে-পথে ভ্রমণ করছি, এ-যাত্রায় এ-সবের কিছু কিঞ্চিৎ দরকার। যদুকে পেলে, যদুবংশের একটা হিল্লে হয়। মন খোলসা করে, ব্যক্তিকে নির্ণয় করা যায়। অতএব এবারে খোঁজ করি, যদু কে? যাত্রা পথের ধুলা উড়িয়ে দেখছি, যযাতি শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর গর্ভে যদু আর তুর্বসুর জন্ম দিয়েছিলেন। শর্মিষ্ঠার গর্ভে দ্রস্থ্য; অনু আর পুরুকে। এঁদের নিয়ে আপাতত আমার দরকার নেই। দেখছি, ইতিবৃত্তের ধূলার নীচে লেখা রয়েছে, যযাতির জ্যেষ্ঠ পুত্র যদু। তারপরের জটিল। বংশমালা দেখে আমার মাথা ভিরমি যাচ্ছে। যাত্রার আগে যদুকে নিয়েই দু’-এক কথায় বংশপরিচয় সাঙ্গ করি।

দেখছি, এই যদুরই বংশধরেরা কালে কালে সাত্বত, বৃষ্ণি যাঁদের বলে, অন্ধক, ভোজ নানা শাখায় ছড়িয়ে গিয়েছিলেন। একে বোধহয় শরিকানার ভাগাভাগিও বলা যায়। এঁরা নিজেদের মধ্যে বিস্তর ঝগড়া বিবাদ করেছেন। সে-কথা আপাতত যাক। বরং তার চেয়ে বলা ভাল বিভিন্ন শাখার এই যদুবংশ দীর্ঘকাল নিজেদের মধ্যে সম্ভাব বজায় রেখে চলতে পেরেছিলেন। নিশ্চয়ই আমাদের কালের প্রবাদ কাহিনীর সেইরকম জ্ঞানী বৃদ্ধরা যদুবংশে ছিলেন যাঁরা উপদেশ দিয়েছিলেন, এক গাছি কঞ্চিকে অনায়াসে একজন ভাঙতে পারে; একগুচ্ছ কঞ্চিকে পারে না। অতএব ওহে যদুগণ এককাট্টা হয়ে থাকো। এ ক্ষেত্রে বয়সে বৃদ্ধ না হয়েও যদুবংশের রাজসিংহাসনে আরোহণ না করেও যিনি সমগ্র গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ সংহত করে রাখতে পেরেছিলেন, তৎকালের লোকেরা তাঁকে বিশেষণ দিয়েছিলেন বৃষ্ণিসিংহ। যিনি আমাদের কাছে শ্রীকৃষ্ণ নামে পরিচিত।

নাম তাঁর বহুতর। ছেলেবেলায় আসন্ন ভোরের বিছানায় শুয়ে মায়ের মুখেই তাঁর শতাধিক নাম উচ্চারিত হতে শুনেছি। ইনি অগাধ কীর্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন। পুরনো ঐতিহ্যের কথা কে ভোলে? আমরা ভুলি না। আমি ভুলি না। ইলাবৃতবর্ষে দেবতা জাতির যে-সব কীর্তিশালী ব্যক্তিরা বীর যোদ্ধা মেধাবী শ্রেষ্ঠ ছিলেন তাঁদের যেমন দিবি আরোহণ ঘটত, রূপান্তরিত হতেন ভগবানে, কৃষ্ণেরও সেই দিবি আরোহণ ঘটেছিল। তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।

কিন্তু তাঁর এই অগাধ কীর্তির একটা পশ্চদপট ছিল। সাত্বতদের— অর্থাৎ বৃষ্ণিকুল সম্পর্কে ইতিবৃত্ত দেখছি অতি মুখর। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন কীর্তন করছেন, সাত্বতগণকে কেউ পরাজিত করতে সমর্থ না। বৃষ্ণি বংশীয়রা যুদ্ধে লব্ধলক্ষ্য হয়ে অসাধারণ যুদ্ধকৌশল প্রদর্শন করেন।… এঁদের তুল্য বলবান ব্যক্তি দৃষ্টিগোচর হয় না। এঁরা জ্ঞাতিদের অবজ্ঞা করেন না, বৃদ্ধগণের আজ্ঞা পালন করেন।… সত্যবাদী, ব্রহ্মচর্যানুষ্ঠানরত মহাত্মা, প্রচুর বিত্তশালী হয়েও অহংকার করেন না।… বিপদের সময়ে সমর্থ ব্যক্তিদেরও উদ্ধার করে থাকেন। এঁরা দেবপরায়ণ, দাতা… এইসব গুণের জন্যই তাঁদের সঙ্গে কেউ যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেন না।’

কীর্তিমানদের গুণের কথা এখানেই ইতি করা যেত। আর একটু যোগ করলে, একটি বিশেষ সংবাদের সঙ্গে আশ্চর্য একটি চিত্রও ভেসে ওঠে চোখের সামনে। শূরসেনদের মথুরাবাসী বলা হয়। জ্ঞানী বৃদ্ধরা বলেছেন, ‘এঁরা দীর্ঘদেহী, ক্ষিপ্রকারী আর নৌচালনাপটু। এঁদের সর্বদা যুদ্ধের অগ্রভাগে স্থাপন করবে।’…

আমার চমকটা লাগল ‘নৌচালনাপটু’ শব্দটিতে। নৌচালনা? তা হলে মহেন-জ-দরো-র “অনার্য-কীর্তি” যুক্তিগুলো টেকে কেমন করে? না, আমি এ-সব পণ্ডিতি তর্কে নেই। ওতে বিস্তর ফাঁদ পাতা। কে কোথা দিয়ে ঠেলে ঢুকিয়ে দেবেন, কে জানে। আন্‌ কথায় কী কাজ? কাজের কাজ করো। তবে তোমাদিগের নিকট যাচ্ঞা করি, এই নৌচালনাপটু সংবাদটির কথা মনে রেখো। দ্বারাবতী গমনের সময় সংবাদটির গুরুত্ব বোঝা যাবে।

কিন্তু যে-কথা বলতে গিয়ে এত কথার উৎপত্তি, সে-এক ঝকমারি। কারণ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের অনুমতি দিতে গিয়ে কৃষ্ণের মুখ থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে, বঙ্গ পুণ্ড্র কিরাতদেশের অধিপতি, জরাসন্ধের অনুগত, তার নাম আর আমার নাম এক। কিন্তু সে নিজেকে কেবল বাসুদেব বলেই ক্ষান্ত নেই। যে বিশেষণের দ্বারা তোমরা আমাকে ভূষিত করেছ, সে নিজেকে সেই পুরুষোত্তম বিশেষণে ভূষিত করে থাকে। এমনকী মোহবশত সে আমার চিহ্নসমূহও সর্বদা ধারণ করে থাকে। আসলে ভূমণ্ডলে তার প্রকৃত পরিচয়, মহাবলপরাক্রান্ত পৌণ্ড্রক।

এই বিষয়টিকেই আমি ঝকমারি বলছিলাম। ঘটনাটা ইতিবৃত্তীয় সত্য। এখন দেখছি, কীর্তিমানদের অনুকরণ করার ইচ্ছা আর অভ্যাসটা নিতান্ত একালের না। রুপোলি পরদার অমুক কুমারকে আপাদমস্তক নকল করার মতো স্পৃহা হাজার হাজার বছর আগেও ছিল। রকমফেরটা অবিশ্যিই মানতে হবে। আমাদের কালে, রুপোলি পরদার নায়ক নকলবাজরা নিজেদের সাচ্চা বলে চালাবার চেষ্টা করে না। পৌণ্ড্রক বাসুদেবের সেই রোগটি ছিল, কারণ সে কৃষ্ণের বীরত্ব বুদ্ধি আর কৌশলকে ঈর্ষা করত। অতএব শঙ্খ গদা চক্র তারও থাকতে হবে। কৃষ্ণের মতো মণিকুণ্ডল তারও চাই। উপরন্তু প্রচার করা চাই, সে নিজেই পুরুষোত্তম বাসুদেব।

ঈর্ষা নামক ইন্দ্রিয়টি একবার মস্তিষ্কে বিঁধে গেলে, তখন রক্তক্ষরণের পালা শুরু হয়। পৌণ্ড্রক বাসুদেবের সেই অবস্থা হয়েছিল। কারণ সে ছিল প্রাগজ্যোতিষপুরের অসুররাজ নরকের বন্ধু। কৃষ্ণের অপরাধ, তিনি সেই দর্পী প্রাগজ্যোতিষপুরের অধিপতি নরককে হত্যা করেছিলেন। নরকের লালসালয় থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন ষোলো হাজার রমণীকে। পুরাণকাররা হিসাবটাকে কেউ কেউ ষোলো হাজার একশো বলেছেন। প্রাচীন ইতিবৃত্তে প্রক্ষিপ্ত কিছু থাকাটা আশ্চর্যের না, ইতিপূর্বেই স্বয়ং সূত আমাকে এ-কথা শুনিয়েছেন। তবে ষোলো হাজারের সঙ্গে একশো জোড়া আর না জোড়াটা, যাহা বাহান্ন তাহা তেপান্নর মতোই মনে হয়। তেমন একটা ইতর বিশেষ নেই। কিন্তু নরকের ভোগগুহা থেকে মুক্ত ষোলো হাজার রমণীকে সহসা ব্রজরমণীদের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলাটা ঠিক হবে না। ওখানে হিসাবের একটু খটোমটো আছে। বৃষ্ণিসিংহ বাসুদেবের সঙ্গে গোপরমণী রাধার কথায় আমি আদৌ নেই। সেই তো আমার কথা, ‘কথা কইতে জানলে হয়, কথা ষোলো ধারায় বয়।’ কৃষ্ণ বলে কথা! বহু ধারায় তাঁর যাতায়াত।

একটা কথা এ সময়েই কবুল করে রাখি। দ্বারাবতী আমার যাত্রা বটে। বাসুদেবেরই সান্নিধ্যে। কিন্তু যে-উদ্দেশ্যে আমার যাত্রা, সেই উদ্দেশ্যের তিনি একটি পার্শ্বচরিত্র মাত্র। কিন্তু তিনিই দ্বারকানগরীর প্রতিষ্ঠাতা স্রষ্টা, তাঁর জীবিতকালের মধ্যে তিনিই প্রধান পুরুষ, সেইজন্য তাঁকে ছেড়ে আমার উদ্দেশ্যকেই প্রতিষ্ঠা করতে পারি না যে। অতএব বাসুদেবায়ঃ শরণং। রাধা অন্য ধারায় আছেন, আমি অন্য ধারায়।

আমি যে-ধারায় চলেছি, সেখানে বাসুদেব শ্রী ও কীর্তিসম্পন্ন অতিমাত্র শত্রু সংহারক, বন্ধুদের ইষ্টাকাঙ্ক্ষী, ঐক্যবদ্ধকারী সংগঠক। পৌণ্ড্রক বাসুদেবের কথা। শেষ করি। নরককে কৃষ্ণ হত্যা করেছিলেন বলে পৌণ্ড্রক খেপে উঠেছিল। বলতে গেলে, তখন থেকেই যদুবংশের যশস্বী বার্ষ্ণেয়কে নিয়ে তার মোহের সঞ্চার, নামের অনুকরণ, আয়ুধ আর চিহ্নসমূহ ধারণের পাগলামি। অথচ রাজাকে যে-সম্মান দেওয়ার রীতি ছিল, সব ক্ষেত্রেই তা তার প্রাপ্য ছিল। আর সেগুলোকে সে কাজে লাগাত একমাত্র বাসুদেবের বিরুদ্ধাচরণে। কৃষ্ণ দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় পাঞ্চালে আসছেন। পৌণ্ড্রকও গেল। ধুলা উড়িয়ে পরতে পরতে লেখা দেখছি, উদ্দেশ্য একমাত্র, কোনওরকমে একটা গোলমাল লাগাতে পারলে কৃষ্ণের সঙ্গে লেগে যাওয়া। কিন্তু দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে দরিদ্র ব্রাহ্মণবেশী তৃতীয় পাণ্ডব, সব ভেস্তে দিয়েছিলেন। মাঝখান থেকে লাভ, হায়! সেই কৃষ্ণের। জীবনে যাঁদের কখনও চোখে দেখেননি, অথচ কানাঘুষা শুনছিলেন, পাণ্ডবেরা জতুগৃহে দগ্ধ হয়ে মারা যাননি, আর মনেপ্রাণে প্রার্থনা করছিলেন, যেন কোনওরকমে তাঁদের দেখা পান, সেই বৈপ্লবিক মুহূর্তটি এসে গেল দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভাতেই। পৌণ্ড্রকের জানা উচিত ছিল ‘গোলেমালে গোলেমালে পিরিত কোরো না।’ অর্থাৎ কার্যসিদ্ধি করতে যেয়ো না। কৃষ্ণ গোলমাল থেকে দূরে ছিলেন, আর তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিই তাঁর অভীষ্ট সিদ্ধিলাভ করিয়ে দিল।

কিন্তু সে-কথার জালবিস্তার আপাতত না। পৌণ্ড্রক জরাসন্ধের অনুগত হওয়া সত্ত্বেও যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল, উপস্থিত হয়েছিল। ইতিবৃত্তকার ঘটনা লেখেন, সূত বলেন, তুমি তোমার ধারণা মতো ইঙ্গিত ও সংকেতগুলো চিনে নাও। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের প্রধান অন্তরায় কে ছিলেন? জরাসন্ধ। আর এই জরাসন্ধের প্রবল পরাক্রমের ভয়েই তো স্বয়ং কৃষ্ণের মথুরা ছেড়ে পশ্চিম সমুদ্রোপকূলে আশ্রয়ের সন্ধান। অতএব জরাসন্ধের মতো যারা কৃষ্ণ বিদ্বেষী ছিলেন তাঁরাও যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে আসতে পারেন একটি মাত্র উদ্দেশ্যেই। কৃষ্ণ বিরোধী প্রচার, কৃষ্ণের নিন্দা, কৃষ্ণকে অবজ্ঞা দেখানো এবং সুযোগ পেলে কৃষ্ণ নিধনেও আপত্তির কোনও কারণ ছিল না।

রাজসূয় যজ্ঞে যাঁরা এসেছিলেন, জরাসন্ধ হত্যাকাহিনী তাঁদের অজানা ছিল না। জরাসন্ধ জীবিত থাকতে, যুধিষ্ঠিরের পক্ষে রাজসূয় যজ্ঞ করা কি সম্ভব ছিল? কৃষ্ণের অভিমত, কখনওই না। আগে জরাসন্ধ বধ, তারপরে রাজসূয় যজ্ঞ।

কেন কৃষ্ণ এ-পরামর্শ যুধিষ্ঠিরকে দিয়েছিলেন? সূত বলেন, ঋষি লেখেন, তুমি ইঙ্গিত আর সংকেতগুলো চিনে নাও। কেবল শ্রবণ আর পাঠে পুণ্য নেই, পুণ্য অনুভবে। পুণ্য-ভাবনা, আমার কাছে জীবন-জিজ্ঞাসা। মহাবল জরাসন্ধ কৃষ্ণবধে কৃতসংকল্প ছিলেন। এইরূপ প্রচার ছিল, তিনি ছিয়াশিজন রাজাকে কারাগারে বন্দি করেছেন। একশো পূরণের জন্য আর চৌদ্দজন বাকি। যদুবংশে কৃষ্ণ কখনওই রাজসিংহাসনের অধিকারী ছিলেন না। যদুর বংশপরম্পরায় ভোজক শাখার উগ্রসেনই রাজা হয়েছিলেন। তাঁর ছেলে কংস, তাঁকে বন্দি করে রাজা হয়েছিলেন, আর জরাসন্ধের দুই মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন।

না, বরং বলা যায় জরাসন্ধই যদুবংশকে আপন শক্তির সীমায় রাখার জন্য, কংসের সঙ্গে অস্তি আর প্রাপ্তি নামে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর বুদ্ধিটা কাজে লেগেছিল। জরাসন্ধের মতো মহাবল শ্বশুর পেয়ে কংসের মাথা বিগড়ে গিয়েছিল। তিনি পিতা উগ্রসেনকে সিংহাসনচ্যুত করে কারারুদ্ধ করেছিলেন। আর যদুবংশের রথী মহারথীদেরও পীড়ন করে পায়ের তলায় রেখেছিলেন।

উগ্রসেনের ভাই দেবকের মেয়ে দেবকীর সঙ্গে বসুদেবের বিয়ে হয়েছিল। বসুদেবের ছেলে, বাসুদেব। তাঁর কংসবধের ঘটনায় আমি যাব না। যদিও যাব না যাব না করে দ্বারাবতীর পথের অলিগলি ঘাঁটতে বিস্তর ধুলাবৃত কাহিনী এসে পড়ছে। বলতে চেয়েছিলাম, জরাসন্ধের বাকি চৌদ্দজন শত্রুর মধ্যে, একজন অন্তত রাজা ছিলেন না। তিনি ছিলেন মুকুটবিহীন সাম্রাজ্যের অধিপতি বৃষ্ণি সিংহ। জরাসন্ধ জামাই হত্যার প্রতিশোধ নেবেন, অতি দুরন্ত শক্তিশালী, দুর্ধষ বুদ্ধিমান কৃষ্ণকে বাঁচিয়ে রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না।

কৃষ্ণ তা জানতেন, অতএব যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ করার ইচ্ছাকে সমর্থন করেছিলেন। কেবল সমর্থনই করেছিলেন? পাণ্ডবদের ক্রমে বলীয়ান হয়ে ওঠার মূলে তার অবদান অনেকখানি। অর্জুন যে-মুহূর্তে পাঞ্চালীকে লাভ করে, ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে কামারশালায় গিয়ে উঠেছিলেন, কৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ বলরামকে সঙ্গে করে সেখানে গিয়েছিলেন। প্রথমেই পরিচয় কুন্তীকে— তুমি আমার পিসিমা। যুধিষ্ঠির ভীম অর্জুন আমার পিসতুতো ভাই।

যদুবংশের জ্ঞানী ও বীর, বন্ধু ও কর্মী বাসুদেবের আত্মীয়তাও কম নয়। সেই থেকে শুরু। ক্রমবর্ধমান বলশালী বিত্ত ও ক্ষমতাশালী পাণ্ডবদের অন্তরের ভাষা তিনি পড়তে পেরেছিলেন। সেই কারণেই তিনি মহান। ইতিবৃত্তের প্রতিটি পঙ্‌ক্তিতে আমি দেখছি, লিখিত ভাষার গভীরে প্রচ্ছন্ন রয়েছে বাসুদেবের মহিমময় ভবিষ্যকীর্তির ইঙ্গিত। মুখ ফুটে না বললেও, যুধিষ্ঠিরের অন্তরে রাজসূয় যজ্ঞের বাসনা তিনিই জাগিয়েছিলেন। অতএব অনুমতি প্রার্থনামাত্রই, যজ্ঞের সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগে জরাসন্ধ বধ নিশ্চিত হতে হবে।

দুর্মদ শক্রুনিধনকারী কৃষ্ণ কি আগে থেকেই ভেবে রাখেননি, জরাসন্ধকে মহাসমরের সুবিশাল প্রাঙ্গণে ডেকে নিয়ে এসে নিধন করা, সসাগরা ধরণীর সকলের পক্ষেই অসম্ভব ছিল? ভেবেছিলেন। ইতিবৃত্তের লেখায় তা প্রচ্ছন্নরূপে রয়েছে। কিন্তু জরাসন্ধ বধ কাহিনীতে কী দরকার?

দরকার একটি সংশয়িত জিজ্ঞাসার জন্য। মহাসমরের বদলে, কৃষ্ণ জরাসন্ধকে, ভীমের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য করেছিলেন? না কি তিনি, ভীম এবং অর্জুনসহ নিতান্ত স্নাতকের বেশে, মগধ রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেছিলেন? এবং তারপরে গুপ্তহত্যা?

না, প্রাচীন ইতিবৃত্তকে আমি এতটা অপরিচ্ছন্ন বিক্ষিপ্ত ভাবতে পারি না। সংশয়টা এই কারণে জাগে, যে-ধুরন্ধর মহাবল জরাসন্ধের ভয়ে স্বয়ং কৃষ্ণকে সকল যদুবংশের প্রধানগণকে নিয়ে মথুরা থেকে সুদূর পশ্চিমের দ্বীপান্তরে চলে যেতে হয়েছিল, তাঁকে হাতের কাছে পেয়েও জরাসন্ধ ছেড়ে দিলেন কেমন করে? স্পষ্টতই তিনি জরাসন্ধের রাজপুরে প্রবেশের জন্য ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি ভীম অর্জুনকে নিয়ে স্নাতকের ছদ্মবেশে জরাসন্ধপুরীতে প্রবেশ করেছিলেন। কাছে গিয়ে পরিচয় দিয়ে, তিনজনের যে-কোনও একজনের সঙ্গে জরাসন্ধকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেছিলেন।

দেখছি, দ্বন্দ্বযুদ্ধের রীতিটা প্রাচীন ভারতেও ছিল। সাহেবরাই কেবল দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতেন না। কৃষ্ণের সকল মহানুভবতাকে মেনে নিয়েও এই মুহূর্তে জরাসন্ধকে আমার সত্যবদ্ধ রাজা বলে মনে হচ্ছে। তিনি দ্বন্দ্বযুদ্ধে স্বীকৃত হয়েছিলেন। বীরের যা ধর্ম। ভীমকেই তিনি প্রথমে বেছে নিয়েছিলেন। অবিশ্যি ভীমই প্রথম এবং শেষ। জরাসন্ধ অর্জুন আর কৃষ্ণের সঙ্গে লড়বার অবকাশ পাননি, নিহত হয়েছিলেন ভীমের হাতেই। কৃষ্ণ কি এ-কথাও জানতেন, জরাসন্ধ ভীমকেই প্রথমে বেছে নেবেন?

তবে হে বাসুদেব, তোমার তুলনা তুমিই! অন্যথায় যে-কোনও ছদ্মবেশেই হোক কোন সাহসে তুমি জরাসন্ধপুরীতে প্রবেশ করেছিলে? যাঁর ভয়ে তুমি সুদূর পশ্চিমে চলে গিয়েছিলে? সবই দেখছি, দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভা, পাণ্ডবগণের পরিচয় লাভ, তোমার দূরদৃষ্টি, তোমার মাহাত্ম্যকেই বৃদ্ধি করেছিল। শত্রুকে তো নিধন করাই শ্রেয়ঃ!

দ্বারাবতীর পথ ক্রমে দুর্গম হয়ে উঠছে। পৌণ্ড্রক বাসুদেবের আখ্যানটুকু শেষ করি। সে জানত কৃষ্ণবিদ্বেষী রাজা মহারাজা বলবান ব্যক্তিরাও যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে যাবেন। শৃঙ্গ দিয়ে তৈরি ধনুক, যার নাম শার্ঙ্গ সেই শার্ঙ্গপাণি, গদা-চক্রধারী কৃষ্ণই নিশ্চয় যজ্ঞস্থল রক্ষা করবেন। যুধিষ্ঠির পূজা ও পাদ্যঅর্ঘ্যও নিশ্চয় কৃষ্ণকে দেবেন। তখন একটা গোলমালের সম্ভাবনা নিশ্চিত!

আবার সেই গোলেমালে গোলেমালে…। ঘটেছিল সেইরকমই। যুধিষ্ঠিরের জিজ্ঞাসার জবাবে ভীষ্ম বলেছিলেন, পূজা পাবার ক্ষেত্রে কৃষ্ণই শ্রেষ্ঠ। তিনি নিখিল বেদ বেদাঙ্গ পারদর্শী, নিরহংকারী, জ্যোতিষ্ক মধ্যে উজ্জ্বলতম।… অনেকের সঙ্গে সব থেকে বেশি বাদ সাধলেন চেদিরাজ শিশুপাল। তাঁর মতো মহীপতি থাকতে, কৃষ্ণ কেন পূজা পাবেন? তিনি কৃষ্ণের নামে অতিমাত্রায় কুৎসা গীত করলেন, বাসুদেবকে নীচাশয় থেকে শুরু করে, কোনওরকম খারাপ কথা বলতেই বাদ রাখলেন না। যজ্ঞস্থলে গোলমাল লেগে যাবার দাখিল।

কিন্তু যজ্ঞস্থলে কি হত্যার প্রচলন ছিল? ছিল। অন্যথায় কৃষ্ণ তাঁর আয়ুধসকল নিয়ে যজ্ঞস্থলে যেতেন না। শিশুপাল যখন যজ্ঞে এবং কৃষ্ণপূজায় বাধা দিয়ে সব ভেস্তে দেবার তাল করলেন, তখন কৃষ্ণ রুখে রেগে ওঠেননি। বরং উপস্থিত সকলের সামনে শিশুপালের পূর্ব অপরাধের কাহিনীগুলো বলেছিলেন। তার মধ্যে সব থেকে বড় অপরাধ যাদবগণের অশেষ অনিষ্টসাধন। বিচিত্র এই, শিশুপালও ছিলেন সম্পর্কে কৃষ্ণের পিসতুতো ভাই। কৃষ্ণ যখন প্রাগজ্যোতিষপুরে নরককে হনন করতে গিয়েছিলেন শিশুপাল সেই অবকাশে দ্বারকা আক্রমণ করেছিলেন। দ্বারকাপুরী পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।

শিশুপালের অপরাধ বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। মৃত্যু তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে এসেছিল। তিনি অন্যান্য মহীপালদের প্ররোচনায় নিজের ক্ষমতার প্রতি অতি বিশ্বাসে, রাগে অহংকারে এতই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, প্রকৃত সংগ্রামের ক্ষমতা তিনি হারিয়েছিলেন। কৃষ্ণ অবিশ্যি বলেছিলেন, শিশুপালের মা তাঁকে তাঁর পুত্রের শত অপরাধ ক্ষমা করতে বলেছিলেন। যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞস্থলে সেই শত অপরাধ অতিক্রান্ত হয়েছিল, অতএব কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে তীক্ষ্ণ চক্র দ্বারা শিশুপালের মস্তকটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

কথা হচ্ছিল মেকি বাসুদেবকে নিয়ে। পৌণ্ড্রক বাসুদেব, কৃষ্ণবিদ্বেষী। নামের ফের নিয়েই বিষয়টার সূত্রপাত হয়েছিল। শিশুপাল হত্যা দেখেই সে বুঝে নিয়েছিল, গোলেমালে গোলমাল। কৃষ্ণের ক্ষতি করা গেল না। কিন্তু সে নিজেকে বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে চায়, পুরুষোত্তম বাসুদেব বলে। কৃষ্ণের চিহ্ন এবং আয়ুধ সেও ধারণ করে বেড়াত।

কৃষ্ণ এ ব্যাপারে রুপোলি পরদার কুমারদের মতোই নির্বিকার ছিলেন। কাকেরা ময়ূরপুচ্ছ ধারণ করলে কী করা যায়? কিছু করা যায়? পৌণ্ড্রক বাসুদেব নিষাদরাজ একলব্যকে এবং আরও কিছু কৃষ্ণবিদ্বেষীকে নিয়ে দ্বারকার আশেপাশে তক্‌কে তক্‌কে রইল, কৃষ্ণের অনুপস্থিতিতে দ্বারাবতী ধ্বংস করবে। এই নকল বাসুদেব দেখছি সব বিষয়েই নকল করতে চায়। কৃষ্ণ যখন নরককে হত্যা করতে গিয়েছিলেন, শিশুপাল সেই অবসরে দ্বারকা পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। নকল বাসুদেবও তাই করেছিল। কৃষ্ণের অনুপস্থিতিতে সে গভীর রাত্রে দ্বারকা আক্রমণ করেছিল। দ্বারকার যাদবেরা সারা রাত্রি লড়াই করেছিলেন। যুদ্ধটা খুব ছোটখাটো হয়নি। কিন্তু কৃষ্ণ এসে পড়েছিলেন রাত পোহাতেই। নকল বাসুদেব এবার আর রেহাই পেল না। সে কৃষ্ণের হাতেই নিহত হয়েছিল। একলব্য পালিয়ে বেঁচেছিল, অবিশ্যি পরে একলব্যও কৃষ্ণের হাতেই নিহত হয়েছিল।

কিন্তু নামের ফেরে মানুষ ফেরে, এও কোথা দেখি নাই। নকল বাসুদেব থাক। এখন আসল বাসুদেবের দ্বারাবতী যাত্রা ত্বরা করো হে। যাত্রা ত্বরা করো। ঠিকানা খোঁজো। ধুলা উড়িয়ে চলো।

চলব, কিন্তু পথ বড় গহন। এ যাত্রা কাঁধে ঝোলা চাপিয়ে ঠেলাঠেলি করে রেল গাড়িতে যাওয়া না। যদিও এ যাত্রায়ও দেখছি বাঁশি বাজে, নিশান ওড়ে, তবে সেটা এই আমলের ভেক পাতলুন পরা গার্ড সাহেবের নিশান বাঁশি কিছু না। এ বাঁশি প্রাণের কোথায় যেন বাজে, সুরে ডাক দিয়ে ঘরের বাহির করে নিয়ে যায়। নিশানাটা চোখের সামনে চিত্রের মতো ভাসে। রৈবতক পর্বতের কৃষ্ণনীল মহীরূহের মাথা ছাড়িয়ে যেন সেই নিশান পতপত করে ওড়ে।

না, রেলগাড়ির ঝুকঝুক শব্দে কিংবা মোটর গাড়িতে এমনকী হাওয়াই জাহাজেও আমার গন্তব্য দ্বারাবতী যাওয়া যাবে না। আমাকে পথ পরিক্রমা করতে হবে স্বয়ম্ভূব মনু কাল থেকে রচিত ইতিবৃত্তের বর্ণনা থেকে। কারণ আগেই সূতের মুখে শুনে এসেছি স্বয়ম্ভূব মনুকালই আদি কালবিন্দু গণ্য করা হয়েছে। বিলেতের ঐতিহাসিকরা যেমন যিশু জন্মের তারিখকে আদি কালবিন্দু ধরে বি সি আর এ ডি-র হিসাব কষেছেন।

আমাদের প্রাচীন ইতিবৃত্তের ব্যাখ্যাকার পণ্ডিতগণ স্বয়ম্ভূব মনুকাল থেকে অনায়াসেই যিশুর জন্মসালকে হিসাবে আনতে পেরেছেন। সন্দেহ আর তর্ক? শ্রম করে করে এসো গিয়ে। দ্বন্দ্বে আহ্বান করতে এলে ক্ষমতা থাকার দরকার। কোনও কোনও সাহেবিয়ানার হিসাব যথার্থ, বাকিরা সব ধুলায় যাবে তা হয় না।

কৃষ্ণের জন্মকাল আমাদের সুবিধাজনক প্রচলিত মানের হিসাবে এক হাজার চারশো আটান্ন খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকাল এক হাজার চারশো ষোলো খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই হিসাবে দেখছি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় কৃষ্ণের বয়স বিয়াল্লিশ বৎসর। আদি কালবিন্দু থেকে একে একটি যুগকাল বলা হয়েছে। যুগকাল মানেই, এক একটি যুগের সংক্রান্তি। যাওয়া আর আসার মধ্যবর্তী সময়।

এইখানটিতে এসে আমার মনে একটা খটকা লাগছে। আমি যে-সূতগণের ইতিবৃত্তকে অনুসরণ করছি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, শ্রীমদ্‌ হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য মহাশয় আমার অপেক্ষা অনেকগুণ অধিক তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন, ইতিহাসের বিচারক। তাঁর সূক্ষ্ম বিচারের দ্বারা তিনি সিদ্ধান্ত করেছেন, এই উনিশশো আটাত্তর খ্রিস্টাব্দ থেকে ধরলে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়েছিল ৫০৭৮ বছর আগে। এ ক্ষেত্রে মনে করি, সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয়, সূতগণের ইতিবৃত্তীয় সংকেতকে আমার থেকে অনেক বেশি সম্যক অনুমান করেছিলেন। তাঁর মতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকালে যুধিষ্ঠিরের বয়স ৭২, ভীম ৭১, অর্জুন ৭০, নকুল সহদেব ৬৯। কৃষ্ণকে যদি অর্জুনের সময়বয়সি ভাবা যায়, বা অন্য মতে এক বছরের কনিষ্ঠ, তা হলে সেই সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল সত্তর অথবা ঊনসত্তর।

ইতিবৃত্ত রচনা আমার লক্ষ্য না। কিন্তু ইতিবৃত্তীয় লক্ষণগুলো আবশ্যক। অতএব উভয় মতই বলে রাখলাম। পাঠকদের বিশ্লেষণী ক্ষমতাকে আমি শ্রদ্ধা করি।

কৃষ্ণের জন্মকালে পুরাণকাররা দেখছেন দ্বাপরের অংশে ক্ষয় ধরেছে। এই সময়টিকে বলা হয়েছে কলির সন্ধ্যাকাল। তবে তখনও সন্ধ্যাসন্ধ্যাংশমধ্যবর্তী কলিযুগ পড়েনি। কৃষ্ণের জীবিতকালের মধ্যেই কলিযুগ এসেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু যদুগণের কীর্তিবর্ধনকারী বাসুদেবের জীবিতকাল পর্যন্ত কলির প্রাদুর্ভাব স্পষ্টত ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। এ-কথায় কি একটু বেশি গৌরব প্রকাশিত হয়নি? সূতেরা এবং ঋষিরা মানুষ ছিলেন। ইতিবৃত্তের ক্ষেত্রে তাঁরা যতটা সম্ভব নিরপেক্ষ থাকবারই চেষ্টা করছেন। সেইজন্যই ইতিবৃত্তের বর্ণনার গভীরে প্রচ্ছন্ন সংকেত আর ইঙ্গিতগুলোর কথা আমি বারে বারে বলেছি।

কৃষ্ণ যে কলির যাবতীয় লক্ষণগুলোকে প্রকটিত হতে দেখেছিলেন, ইতিবৃত্তে নানাভাবে তা প্রকাশ পেয়েছে। বেদব্যাস কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অনেক আগেই তাঁর মা সত্যবতীকে ঘোষণা করেছিলেন, ‘যুগক্ষয়ের সমস্ত লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, অমঙ্গলের ছায়া সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ঘোর দুর্দিন আসন্ন। যে-সব পশুপক্ষীরা দিনের আলোয় নিজেদের স্বর ও আকৃতি গোপন রাখত তার ব্যতিক্রম ঘটছে। লোকক্ষয় অনিবার্য। মানুষের, বিশেষত সদ্‌বংশীয় রাজপুরুষদের চরিত্র নষ্ট হতে বসেছে। জ্ঞাতিগণ পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। এ-সবই ধ্বংসের লক্ষণ।’

একদিকে যখন বৃষ্ণিসিংহের অশেষ গুণকীর্তন হচ্ছে, তখনই যুগক্ষয়ের কথাও বলা হচ্ছে। কিন্তু আপাতত আমি ইতিবৃত্তের সে-পথে যাত্রা করতে চাই না। যদি মনে করি দ্বাপরের অংশক্ষয়ের কালে, কৃষ্ণই দ্বাপরের শেষ পুরুষ, তবে তাঁর আলোর বৃত্তেই যাত্রা করি। সেই আলোর বৃত্তের ঠিকানা দ্বারাবতী।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় যদি কৃষ্ণের বয়স বিয়াল্লিশ হয়, তাঁর বয়সের হিসাবে বয়সটাকে যুবকাল বলা যায়। তা হলে মথুরা থেকে রাজ্যপাট গুটিয়ে নিয়ে পশ্চিম উপকূলে চলে যাওয়ার ঘটনা তার মধ্যেই ঘটেছিল। এ ক্ষেত্রে আমি কৃষ্ণের বয়স হিসাব করতে যাব না। কারণ অন্য মতের কথা আগেই বলেছি। বিয়াল্লিশ না হয়ে ঊনসত্তর হলেও আমার সার বক্তব্যের ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। আমি ইতিবৃত্তের আশ্রয় নিয়েছি মাত্র। নির্ঘাত ইতিবৃত্ত লিখতে বসিনি। একে কি ইতিবৃত্তাশ্রয়ী কাহিনী বলে? যা বলার তোমরা বলো, আমি পথ চলি। দেখছি, মথুরা থেকে কৃষ্ণ সহজে নড়েননি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বাহিনীর মিলিত সৈন্যসংখ্যা ছিল আঠারো অক্ষৌহিণী। সম্রাট জরাসন্ধের একলারই ছিল কুড়ি অক্ষৌহিণী সেনাবাহিনী। আর যদুকুলে তখন ছিল আঠারো হাজার বীরপুরুষ। কৃষ্ণসহ কিছু রথীবৃন্দ। জরাসন্ধ বেশ কয়েকবার মথুরা অবরোধ করে যাদবদের ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। কৃষ্ণের হাতে তাঁর পরাক্রমশালী যোদ্ধা হংস, ডিম্বক, এমনকী কালবনের মতো বীরও মারা পড়েছিলেন।

কিন্তু এভাবে কতকাল কাটানো যায়? প্রতি মুহূর্তে শত্রুসৈন্যের অবরোধ আর আক্রমণে, সকল যাদবেরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা গোটা যদুবংশের ক্ষয়ের আশঙ্কা করেছিলেন। অতএব, তাঁদের একটি মন্ত্রণাসভা নিশ্চয় বসেছিল, সেখানে স্থির হয় যাদবরা তাঁদের বিপুল সম্পত্তি ভাগাভাগি করে যা পারেন, সব নিয়ে পশ্চিম উপকূলে চলে যাবেন। সন্দেহ নেই, এর নেতৃত্ব নিয়েছিলেন বাসুদেব স্বয়ং।

তিনি কি আগেই পশ্চিমের সমুদ্রকূলে রৈবতক পর্বতের সেই দেশটি দেখে এসেছিলেন? নির্বাচন করেছিলেন সেই স্থান? কোথায় সে দ্বারকা? কাথিয়াবাড় উপদ্বীপের জুনাগড় রাজ্যের যে শহরকে এখন জুনাগড় বলা হয়, সেখানেই কি? গিরনারের পর্বতমালাই কি রৈবতক? রৈবতক পাহাড়ের ওপরে কুশস্থলী নামক যে সুদৃঢ় পুরী তৈরি করেছিলেন সে স্থান কি আজকের গুজরাটের দ্বারকা?

সন্দেহ আছে। এই সন্দেহটি খণ্ডনের সংকেত পুরাণেই আছে। পুরাণকারের প্রলয়ংকর ভূমিকম্প, নদীসমূহের গতি পরিবর্তন ইত্যাদি সবই প্রত্যক্ষ করেছেন। এ কূল ভাঙে, ও কূল গড়ে, এ তো আমরা একালেও কম দেখলাম না। তা প্রলয়ংকর না হতে পারে, কালে কালে, অতি ধীরে ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। এ অভিজ্ঞতা প্রাচীন ইতিবৃত্তের সঙ্গে আজকের ভৌগোলিক স্থানগুলোর প্রভেদেই আমরা পেয়েছি।

পুরাণ বা ইতিবৃত্তের মতামতগুলো তাঁদের নিজস্ব ভঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে। দধীচির কথা আমি ইতিপূর্বেই শুনেছি। জলাশয়ের বিশাল প্রাণীটি মুনি নামে আখ্যাত হয়েছিলেন। ধ্বংস বা সৃষ্টি সব কিছুর কারণকেই একটি রূপ দান করা হয়েছে। চোখের সামনে যে-রূপে দেখা গিয়েছে, সেই রূপের ওপরেই তাকে একটি বিশেষ মূর্তির পরিকল্পনায় তুলে ধরা হয়েছে। পাতালসমূহের শেষভাগে বিষ্ণুর শেষনামা তামসী মূর্তিকে অনন্ত বলা হয়েছে। এই অনন্তর শক্তি ও বীর্যের বর্ণনা দেবতারাও দিতে সমর্থ ছিলেন না।

কেমন দেখতে সেই অনন্ত? তিনি সদাঘূর্ণিত লোচন, অগ্নিযুক্ত শ্বেত পর্বতের ন্যায় শোভা পান। তিনি (যেন) মদনোন্মত্ত। পরিধানে নীলবাস (সমুদ্র?)। তাঁর এক হাতে লাঙ্গল, আর এক হাতে মুষলের কল্পনা করা হয়েছে। তাঁর মুখ সমূহ থেকে উজ্জ্বল বিষানলশিখাযুক্ত সংকর্ষণনামা রুদ্র নির্গত হয়ে ত্রিভুবন ভক্ষণ করেন। তিনি যখন সদাঘূর্ণিতলোচনে জৃম্ভা পরিত্যাগ করেন, তখন সমুদ্রসলিলে কাননসমূহের সহিত এই ভূমি কম্পিত হয়। এঁর অগ্নিময়ী সহস্র ফণা আছে।

তা হলে ইনি ভূগর্ভস্থ অগ্নি? ঋষিগণ ভূগর্ভস্থ অগ্ন্যুৎপাত দেখেই এই কল্পনা করেছিলেন। তাঁদের মতে, এই অগ্নিজাত শক্তিই পৃথিবীর উপরিভাগস্থ কঠিন স্তর ধারণ করে আছে। অভ্যন্তর অগ্নিময়। সেই আগুনের হাজার জিহ্বার সংকোচন প্রসারণেই ভূমিকম্প এবং আগ্নেয়গিরির উৎপাত ঘটে। বাসুকি নাগের কল্পনার সঙ্গে এর কোনও অমিল নেই। আগ্নেয়গিরি থেকে ভস্মরাশি ছড়িয়ে যায়, তাকেই স্তবের গৌরবে বলা হয়েছে, সুবাসিত হরিদ্রা বা কপিলবর্ণের হরিচন্দনের রেণু। এসব তুলনা। ভূকম্প আর অগ্ন্যুৎপাতের আনুষঙ্গিক বজ্রধ্বনিকে সংকর্ষণের স্বস্তিক চিহ্নের দ্বারা উপলক্ষিত হয়েছে। মাটি ফেটে চৌচির হওয়া ধ্বংসকে, লাঙল আর মুষলের ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা।

দেখছি ‘যাঁহাকে আরাধনা করিয়া পুরাণর্ষি গর্গ জ্যোতিঃতত্ত্ব আর সকল নিমিত্ততত্ত্ব অবগত হয়েছিলেন,’ সেই গর্গই ছিলেন ভূকম্পবিৎ। কিন্তু পুরাণের ব্যক্ত করার ভঙ্গি ও ভাষা এইরকম, তিনি সেই অনন্তের আরাধনা করেই, সংকর্ষণের আরাধনা করেই জ্যোতিঃতত্ত্ব আর নিমিত্ততত্ত্ব লাভ করেছিলেন।

আমাদের আধুনিক ভাষায় কী বলা যায়। বিজ্ঞানী প্রকৃতিকে জয় করলেন। পুরাণে অবতার কল্পনা একটি অনিবার্য বৈশিষ্ট্য। কৃষ্ণতা বলরামকে তেমনই একজন অবতার রূপে কল্পনা করা হয়েছে। কেন? এই প্রকৃতির সঙ্গে কি তাঁর প্রকৃতির কোনও মিল ছিল? ছিল। বলরামও সর্বদাই সদাঘূর্ণিতলোচন মদোন্মত্ত থাকতেন। লাঙল মুষলও তাঁর হাতে থাকত, হয়তো তাঁর আয়ুধ ছিল সেইরকম। তিনি যে প্রায় সময়েই মদিরাপানে লিপ্ত থাকতেন, তা তো দেখাই গিয়েছে। ক্রোধে হুংকারপ্রবণতা ছিল। তাঁর বিক্রমকে সবাই ভয় করতেন।

এখন বৃন্দাবনের ধারেই যমুনা। বর্তমান মথুরা থেকে বৃন্দাবনে যেতে মোটরযানে সময় লাগে এক ঘণ্টারও কম। কিন্তু কংস-দূত অক্রূরের সঙ্গে কৃষ্ণ আর বলরাম যে বৃন্দাবনে ও মথুরায় গিয়েছিলেন, তার ইতিবৃত্তীয় বর্ণনা অন্য এক ভৌগোলিক চিত্রের পরিচয় দেয়। বিমল প্রভাতে, অক্রূরে সঙ্গে কৃষ্ণ আর বলরাম অতি বেগবান অশ্বসমূহযুক্ত রথারোহণে যাত্রা করলেন। মধ্যাহ্নে এসে উপস্থিত হলেন যমুনার ধারে। সেখানে স্নানাদি সেরে আবার রথে উঠলেন। অক্রূর বায়ুবেগবান অশ্বগণকে অতি দ্রুত চালিয়ে, অতি সায়াহ্নে অর্থাৎ সায়াহ্ন অতীত হলে, তাঁরা মথুরায় পৌঁছুলেন।

বেগবান অশ্বযুক্ত রথ ঘণ্টায় সাত-আট মাইল যেতে পারে। এটা আমার হিসাব না, ব্যাখ্যাকারের। তা হলে বিমল প্রভাতে বেরিয়ে মধ্যাহ্নে যমুনার ধারে পৌঁছুতেই চল্লিশ মাইল ছুটতে হয়েছিল। তারপরে অতি সায়াহ্নে মথুরা মানে আরও চল্লিশ মাইল। একুনে আশি মাইল দূরত্ব! আরও একটা কথা এখানে অনিবার্য ভাবেই অনুমান করা যাচ্ছে, অশ্বযুক্ত রথসমূহ নিশ্চয়ই নৌকাযোগে পারাপার করার ব্যবস্থা ছিল। নৌচালনাপটু কথাটা আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। মনে রেখো।

তা হলে যমুনা তীরে বৃন্দাবন এল কী করে? নাকি যমুনাই বৃন্দাবনের তটে এসে ঝাঁপ দিয়েছিল? কারণ কী? ভূমিকম্প?

হ্যাঁ, ভূমিকম্প। পুরাণকারেরা তা দেখেছিলেন, আর এইভাবে তা ব্যক্ত করেছেন। একদা বলরাম বৃন্দাবনে মদিরাপানে বিহ্বল আর ঘর্মাক্ত হয়ে স্নান করতে চাইলেন। তিনি যমুনাকে ডেকে বলেন, হে যমুনে, তুমি এইখানে এসো। বলভদ্রের মাতলামিতে কান না দিয়ে যমুনা আপন মনে নিজের প্রবাহেই চললেন। তখন লাঙ্গলী বলদেব রেগে আগুন হয়ে, লাঙল দিয়ে যমুনাকে আকর্ষণ করে বললেন, রে পাপে, আসবে না? এবার যাও দেখি, কেমন যেতে পারো? যমুনা আসতে বাধ্য হলেন।

বলভদ্রের বর্ণনাটা কীরকম? তিনিও সংকর্ষণের মতো নীল বাসযুক্ত, এক কুণ্ডল, মালা, মুষল ও হলধারী। বলরামকে সংকর্ষণের অবতার রূপে কল্পনাটা পরবর্তীকালে। ভূমিকম্পটা ঘটেছিল আগেই। পুরাণকার পরবর্তীকালে বলরামের প্রকৃতি, আচরণ আর বীরত্বের সঙ্গে একটি তুলনা দিয়েছিলেন। ওটাই তাঁদের বৈশিষ্ট্য।

বিষয়টি উল্লেখ করলাম এই কারণে, জানা গেল, এ-বৃন্দাবন সে-বৃন্দাবন নয়। যমুনার গতি পরিবর্তনের সঙ্গে সেই বৃন্দাবন যমুনাগর্ভে গিয়েছিল। এ বৃন্দাবন পরবর্তীকালে মথুরার কাছে প্রতিষ্ঠিত। এ-সবেরই উদ্দেশ্য অবিশ্যি দ্বারাবতী যাত্রাপথের হদিশ করে নেওয়া। তা হলে, এই মুষল ও হলধারী প্রমত্ত বলরামকে নিয়ে আর একটি ঘটনাও বলে নিই।

কৃষ্ণের ছেলে জাম্ববতীতনয় বীর শাম্ব দুর্যোধন-কন্যা লক্ষাণাকে বলপূর্বক হরণ করেন। ফলে যুদ্ধ লেগে গিয়েছিল। কর্ণ, দুর্যোধন আরও অনেক কুরুবীরেরা শাম্বকে যুদ্ধে পর্যুদস্ত করে পরাজিত করে বন্দি করেছিলেন। যদুবংশের সন্তান শাম্ব। বলভদ্র নিজে শাম্বকে ফিরিয়ে দেবার জন্য দুর্যোধনকে অনুরোধ করেছিলেন। জবাবে, দুর্যোধন তাঁকে নানা কটু কথা শুনিয়ে অপমান করেছিলেন। তখন হলায়ুধ ক্রোধে মত্ত ও আঘূর্ণিত হয়ে পায়ের গোড়ালি দিয়ে বসুধা বিদারিত করেন। তিনি মদলোলাকুলকণ্ঠে বললেন, কুরুকুলাধীনা হস্তিনানগরীকে, কুরুগণসহ উৎপাটিত করে ভাগীরথী মধ্যে ছুড়ে ফেলে দেব। বলে মুষলায়ুধ বলরাম কর্ষণাৰ্বোমুখ লাঙ্গল হস্তিনাপুরীর প্রাকারে বিঁধিয়ে টান দিলেন।

নগরী সহসা আঘূর্ণিত হতে দেখে কৌরবগণ, ‘হে রাম, রক্ষা করো’ বলে চিৎকার জুড়ে দিলেন। তাড়াতাড়ি শাম্বকে ফিরিয়ে দিয়ে তবে নিস্তার। কেবল শাম্বকে না, তাঁর বলপূর্বক হরণ করা গিন্নি লক্ষণাসহ মুক্তি দিলেন। সেই থেকে হস্তিনা নগরীকে যাঁরাই দেখেছেন, দেখেছেন গোটা নগরীটি যেন মোচড়ানো। ইঙ্গিত একটাই, সেই ভূমিকম্প! যদুবীর বলরামকে সেই কাহিনীর সঙ্গে গ্রথিত করা।

কিন্তু আমি ভাবছি শাম্বর কথা। বন্দি অবস্থায় হঠাৎ ভূমিকম্প! বোধহয় ভাবতেই পারেননি, লক্ষ্মণাকে লুঠ করে আনতে গিয়ে, কুরুদের সঙ্গে এরকম একটা লড়াই লেগে যাবে, আর তারপরেই সেই ভূমিকম্প! তখন কি তিনিও ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছেড়েছিলেন? লক্ষ্মণা থাক, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি! না, আসলে বোধহয় শাপে বরই হয়েছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটি নগরী বেঁকেচুরে মোচড় খেয়ে গেল, লোকেরা হা রাম! করে দিকে দিকে দৌড়। চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা। এদিকে যদুবংশের বীরেরাও এসে পড়েছিলেন। অতএব শাম্বর মুক্তি পেতে আর বাধা কোথায়?

হিন্দু চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এমনও হতে পারে, কুরুরা ভেবেছিলেন শাম্বকে বন্দি করার মধ্যে কোনও অশুভ ইঙ্গিত ছিল। এইক্ষণেই একটি কথা বলবার অবকাশ এল। বলেছিলাম, যাত্রা আমার দ্বারাবতী, কিন্তু কৃষ্ণ আমার পার্শ্বচরিত্র। আমি শাম্বকে দর্শনেই বেশি ব্যাকুল। পিতা পুত্রকে একসঙ্গেই দেখতে চাই। বেশি চাই, অপরূপকান্তি এবং বীর শাম্বকেই। কৃষ্ণ ছাড়া নাম নেই, কিন্তু শাম্ব আমাকে আকর্ষণ করছেন বেশি।

ত্বরা করো হে; ত্বরায় চলো। চলব তো, অনেক প্রস্থ ধুলা উড়িয়ে পথের সন্ধান নিতে হচ্ছে। তার আগে একটা নির্ঘাত বিষয় বলা দরকার। বলভদ্র যে হস্তিনানগরীকে ভাগীরথীতে ছুড়ে ফেলার ভয় দেখিয়েছিলেন, ঘটনাটা ঘটেছিল তা-ই। যুধিষ্ঠিরের সাত পুরুষ পরে, রাজা নিচস্থর রাজ্যকালে হস্তিনাপুরী গঙ্গাগর্ভেই চলে যায়।

কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ প্রতিষ্ঠিত দ্বারকায়, দ্বারকার কুশস্থলী সুদৃঢ় পুরী? সেই রমণীয় রৈবতক পর্বত, কাননাদি ও সুমিষ্ট মনোহর জলাশয়, কোথায় ছিল সে-সব? প্রভাসতীর্থও তো কাছাকাছিই ছিল মনে হয়। পাণ্ডবগণ তীর্থ করতে বেরিয়ে যখন প্রভাসতীর্থে গিয়েছিলেন, তখন যাদবেরা তাঁদের সঙ্গে সেখানে দেখা করেছিলেন। কৃষ্ণ তো বটেই!

ইতিবৃত্তের এক স্থানে দেখছি রৈবত ককুদ্মি নামে এক রাজা কুশস্থলী পুরীর স্রষ্টা ছিলেন। পরবর্তীকালে কৃষ্ণ সেখানেই দ্বারকাপুরী স্থাপন করেছিলেন। রৈবত রাজবংশ কোনও কারণে রাজ্যচ্যুত অথবা বংশহীন হয়েছিল। বলা হয়েছে রাজ্যচ্যুত রৈবতগণ সংগীত ললিতকলা নিয়েই কালযাপন করতেন।

আমার এতে কোনও অসুবিধা নেই। আমার যাত্রা কৃষ্ণের দ্বারকায়।

আমি হালের ভারতীয় ম্যাপে, মথুরা থেকে, বর্তমান দ্বারকার একটা দূরত্বের হিসাব কষেছি। না, রেলপথ বা আধুনিক রাস্তা ধরে না। মথুরা থেকে একেবারে সোজা দক্ষিণ পশ্চিমে নেমে যাওয়া। তার মধ্যে পাহাড় পর্বত নদনদী আছে। রেখাটা টেনেছি সরল রেখায়, তার ওপর দিয়েই। হিসাবে পাচ্ছি সাড়ে ছ’শো মাইলের মতো। কিন্তু এ-দ্বারকাকে সেই দ্বারকা বলে জানি না। প্রাচীন বৃন্দাবনের মতোই সেই নগরীকে খুঁজে নিতে হবে পশ্চিম সাগরের জলের তলায়। মাউন্ট আবু বলো, আর গিরনারের পর্বত বলো, আসল রৈবতক এখন কচ্ছের কাছাকাছি কোথাও হেথা হোথা কিঞ্চিৎ মাথা তুলে থাকতে পারে। সিন্ধুদেশে অনেকবার প্রলয়ংকর ভূমিকম্প হয়েছে। পুরাণকাররা সে-কথা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। মহর্ষি উতঙ্ক বলেছিলেন, ‘সংবৎসরান্তে ধুন্ধু অত্যাচার করে।’ এই ধুন্ধু ছিলেন বলরামেরও আগে অনন্তের অবতার। উতঙ্কের আশ্রম সিন্ধুদেশেই ছিল, এবং তিনি একটি বিশাল তপ্ত বালুকারাশিপূর্ণ অগ্নিময় স্থল দেখেছিলেন আর সেখান থেকেই আগুন বালি ভস্ম পাথর ধোঁয়া নির্গত হয়ে, মহীতল আঘূর্ণিত করত। উতঙ্কের কথায়, তৎকালীন রাজা কুবলয়াশ্ব (৩৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) একুশ হাজার লোক দিয়ে, সেই ভূকম্পনপীড়িত কেন্দ্রটিকে উৎখাত করবার চেষ্টা করেছিলেন। ফলে, প্রচণ্ড ভূমিকম্পে সকলেই মারা যায়।

আধুনিক কালের আঠারোশো উনিশ খ্রিস্টাব্দে দেখছি, কচ্ছপ্রদেশের দু’হাজার বর্গমাইল সমুদ্রের গর্ভে চলে গিয়েছিল, আর প্রায় পঞ্চাশ মাইল লম্বা, দশ মাইল চওড়া ভূমি নতুন করে জেগে উঠেছিল। কচ্ছের রান বা রন বলে বিশাল এক জলাভূমি রয়েছে। রান বা রন গুজরাতি ভাষার একটি শব্দ। যার অর্থ নোনা জলময় অস্বাস্থ্যকর স্থান।

এই ভৌগোলিক পরিবর্তনটি আধুনিক হলেও, আমাকে একবার স্মরণ করতেই হল। কেননা, আমার যাত্রাটা একেবারেই অত্যাধুনিক কালে। কৃষ্ণ এবং যাদবগণের প্রতিষ্ঠিত দ্বারকাপুরীর সঠিক স্থান নির্ণয়ে এই ঘটনাটি আমার যাত্রাপথকে সুদৃঢ় করছে। কিন্তু আধুনিক কালের এই দু’হাজার বর্গমাইল সমুদ্রের গর্ভে চলে যাওয়ার অনেক আগেই নিশ্চয় প্রাচীন দ্বারকা সমুদ্রগর্ভে ডুবেছিল। সিন্ধু এবং কচ্ছ প্রদেশের এইসব অঞ্চল প্রায়ই প্রলয়ে ওঠা নামা করেছে, এটা বোঝা যায়। তবে কৃষ্ণ জীবিত থাকতে তাঁর দ্বারকা এবং রৈবতক পর্বতের ওপর সুদৃঢ় কুশস্থলীপুরী সমুদ্রগর্ভে যায়নি। গেলে পুরাণকারের লেখনীতে তা নিশ্চয়ই পাওয়া যেত।

কত বৎসর কৃষ্ণ দেহধারণ করেছিলেন? এখানে একটা ধন্দ রয়েছে। এক মতে, তিনি বেঁচে ছিলেন একশো পাঁচ বছর। আর এক মতে একশো এক বছর। চার বছরের সমস্যা। সমস্যাটা তেমন একটা বড় না। কোনটা বিক্ষিপ্ত কোনটা বিক্ষিপ্ত না, এইটি ভাববার বিষয়। যে-হিসাব থেকে কৃষ্ণের জন্মকাল, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকাল পেয়েছি, সেই হিসাব বলছে, বাসুদেব একশো পাঁচ বছর বেঁচে ছিলেন। পুরাণের এই মতটিই আমি গ্রহণ করছি।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকাল থেকে এই উনিশশো সাতাত্তরে দাঁড়াচ্ছে, তিন হাজার তিনশো তিরানব্বুই বছর। সিন্ধু দেশে কুবলয়াশ্বের ভূমিকম্পজনিত সংবৎসরের প্রলয়কাল তিন হাজার ছ’শো খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই বর্তমান বছর ধরলে পাঁচ হাজার পাঁচশো সাতাত্তর বছর। কৃষ্ণের দ্বারকার অনেক আগে। পুরাণকার বলছেন, কৃষ্ণের দেহাবসানের পরে অবশিষ্ট অক্ষম যাদবগণ, রমণীগণ, বালকগণ এবং মূল্যবান অলংকারাদিসহ সম্পত্ত্যাদি নিয়ে অর্জুন দ্বারকা ত্যাগ করেছিলেন। কৃষ্ণের দেহে যখন অস্তগামী আসন্ন ছায়াপাত ঘটেছে, তখন তিনি নারদকে এক সময়ে বলেছিলেন, জ্ঞাতিদের অর্ধেক ঐশ্বর্য দান করে, তাঁদের কটুবাক্য শুনে তাঁদেরই দাসের ন্যায় রয়েছি। যাদবদের আত্মকলহ পরস্পরের সংঘর্য তিনি দেখেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে অর্জুন ভোজকুলের কামিনীগণ ও তনয়দের মার্তিকাবতনগরে পাঠিয়েছিলেন। অন্যান্য বালক বৃদ্ধ আর স্ত্রীগণকে, সাত্যকিপুত্রসহ সরস্বতী নগরীতে পাঠিয়ে, ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যভার কৃষ্ণের প্রপৌত্র বজ্রনাভের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তার মানে, একদা কৃষ্ণের নেতৃত্বে যাদবেরা যেভাবে মথুরা ত্যাগ করে দ্বারকায় চলে গিয়েছিলেন, সেটা ছিল নিরাপদ সুদৃঢ় আশ্রয়ের সন্ধান। তারপরে সম্ভবত সত্তর-পঁচাত্তর বছরের মধ্যেই আত্মকলহে ধ্বংসপ্রাপ্ত, অবশিষ্ট যাদবেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। দ্বারকা পরিত্যক্ত হয়েছিল।

শুধুই এক পরিত্যক্ত নগরী? না, সিন্ধুদেশের ভূমিকম্পপ্রবণতাই কৃষ্ণের দ্বারকাকে গ্রাস করেছিল? তা না হলে সম্ভবত কৃষ্ণের কুশস্থলী পুরীর কোনও না কোনও নিদর্শন, কাথিয়াবাড়ে, গিরিনগরে (গিরনারে) বা জুনাগড়ে খুঁজে পাওয়া যেত। অনুমিত হয়, জরাসন্ধের পক্ষে অগম্য কিংবা আক্রমণের পক্ষে প্রায় অসম্ভব কৃষ্ণের দ্বারকা ছিল, মূল ভূমিখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সমুদ্রের কোনও রমণীয় দ্বীপে। নৌচালনাপটুত্বের কথাটা এ সময়েই বিশেষ করে মনে আসে। অশ্বসমূহযুক্ত রথসমূহ নিয়ে, যে কোনও সময়েই মূল ভূখণ্ডে পৌঁছে দেবার জন্য নৌবাহিনী তৈরি থাকত।

আঠারোশো উনিশ খ্রিস্টাব্দে কচ্ছপ্রদেশের সমুদ্রগর্ভে যাবার আগের কোনও সাক্ষীর বিবরণ আমার গোচরে নেই। তা হলে হয়তো কৃষ্ণের দ্বারকার কোনও সংবাদ পেলেও পাওয়া যেতে পারত। তবে যাদবগণ যে ভারতের কোনও কোনও অঞ্চলে এখনও যদুবংশের পরিচয়েই ছড়িয়ে আছেন, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

এখন কেবল দ্বারকাবৃত্তান্ত। নারদ মুনি দ্বারকায় চলেছেন। পশ্চিম সমুদ্রের উপকূলে, প্রভাসতীর্থেই ভ্রমণে এসেছিলেন। এত কাছে এসে, দ্বারকায় গিয়ে একবার যাদবদের সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যাওয়াটা তাঁর যথার্থ মনে হল না। না, তিনি আদৌ ঢেঁকিতে চেপে ভ্রমণ করছিলেন না। নিজের রথেই তিনি ভ্রমণ করছিলেন।

নারদ নামে কি একজন মুনিই ছিলেন? অথবা একাধিক ব্যক্তি? নারদ নামে কি কোনও বিশেষ সম্প্রদায় আছে? নারদীয়গণ যাঁদের বলা হয়, তাঁরাই হয়তো সেই সম্প্রদায়ের। তাঁদের মধ্যে যাঁরা জ্ঞানে গুণে শ্ৰেষ্ঠ ছিলেন, বিভিন্ন রাজা এবং গোষ্ঠীপতিদের দ্বারা তাঁরা পূজিত হতেন। এই মন্তব্য ইতিবৃত্তের একটি সংকেত। তবে পুরু বংশীয় কৌরবদের ও যাদবদের, উত্থান পতনের কালের মধ্যে নারদ মুনি একজনই। ইনিই সেই নারদ। ইনিই যুধিষ্ঠিরকে রাজনীতি, অর্থনীতি, ভেদনীতি, সমাজনীতি, গার্হস্থ্যনীতিসমূহ বিষয়ে উপদেশ দিয়েছিলেন। ইনিই বিধান দিয়েছিলেন কুরুবংশীয়, পাণ্ডুতনয় পাণ্ডবদের, পাঞ্চালীর সঙ্গে পাঁচ ভাই কোন প্রথায় দাম্পত্য জীবন কাটাবেন। ইনি অশেষ গুণশালী, চিন্তাশীল অভিজ্ঞ ব্যক্তি। ইনি সমগ্র বর্ষগুলো পরিভ্রমণ করেছেন। কিম্পুরুষবর্ষ, ইলাবৃতবর্ষ, মধ্যস্থল, অন্তরীক্ষ, ভদ্রাশ্ববর্ষ, কৈলাস কোনও জায়গা বাদ নেই। দেবতা, অসুর, দানব, গন্ধর্ব, যক্ষ, সর্প, মানুষ সকলের সঙ্গে মিশেছেন, জীবনযাত্রা ও ধারণপ্রণালী দেখেছেন। এই সবই তাঁকে অশেষ জ্ঞানী ও গুণী করেছিল। যে-কোনও বিষয়েই তাঁর প্রীতিভাজন রাজা ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদিগকে উপদেশ দিতে সক্ষম, কেবল যুদ্ধবিদ্যা ছাড়া। তিনি নিজে ক্ষত্রিয় নন, অস্ত্রবিদ্যাবিশারদ নন, কিন্তু শত্রুদমনের কৌশল, নগররক্ষা, গুপ্তচরাদি বিষয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, সীমান্তরক্ষা, পাত্রমিত্রে ভেদাভেদ, প্রয়োজনে ছলনা ও চাতুরি, রাজকোষে অর্থাগমের বিধি, ব্যয়ের নিয়ম, নগরের বেশ্যা ও অন্তঃপুরিকাদের সঙ্গে আচরণের সঙ্গতি অসঙ্গতি, এমনকী গৃহে ও অন্তঃপুরে পরিচারক পরিচারিকাদের সম্বন্ধে যথার্থ খবর রাখা, যাবতীয় বিষয়েই সম্যক উপদেশ দানের জ্ঞান ছিল তাঁর।

পরবর্তীকালে মগধের নন্দবংশ ধ্বংসের যিনি নেতৃত্ব করেছিলেন, সেই কৌটিল্যের মধ্যেই নারদের গুণাবলী প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে। সেই অর্থে মহর্ষি নারদও কুটিল। কুটিলতা এ ক্ষেত্রে নীচতা না। ন্যায় এবং অন্যায় বিষয়ে দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা। যার পক্ষে যা অনাচরণীয়, তার প্রতিই নারদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকে এবং সে-সব তাঁর কাছে অন্যায় প্রতীয়মান হলে, তিনি ক্ষুব্ধ হতেন।

এরকম ব্যক্তিকে কি রগচটা বলা চলে? বোধহয় না। রগচটা বলতে গোঁয়ার বোঝায়। মহর্ষি আদৌ তা নন। কিন্তু তাঁর কাছে যা অন্যায় বলে বোধ হয়, তার বিহিত না করে ছাড়েন না। এ-কথাটা সর্বজনে বিদিত ছিল বলেই, নারদ বা নারদ ঋষিদের সম্পর্কে সকলেরই মনে একটা ভয়ের ভাব ছিল। কেবল সাধারণ মানুষের না, সমস্ত রাজা এবং অমাত্যগণেরও। আর কুটিল হলেই ভেদবুদ্ধি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

মহর্ষি প্রভাসতীর্থ ভ্রমণের মধ্যেই, যাদবদের গূঢ়পুরুষদের সম্যক চিনে নিতে পারছিলেন। গুপ্তচরদের আচার আচরণ চলাফেরা ভঙ্গি দেখলেই তিনি বুঝতে পারেন। এখন অবিশ্যি যাদবদের বাইরের শত্রুর ভয় আর নেই। তথাপি রাজ্য পরিচালনায় সর্বদাই সাবধানতা অবলম্বন দরকার। যাদব গুপ্তচরদের দেখে, তিনি মনে মনে তাঁদের প্রশংসাই করলেন। খুশি হলেন, বিনা পরিচয়েই তারা সকলে অতি ব্যাকুল ব্যস্ততায় মহর্ষির পদধূলি গ্রহণ করে, নিজেদের ধন্য ঘোষণা করল। মহর্ষির পরিচয় অতি ব্যাপক, অতএব প্রভাসতীর্থে তিনি ভক্তদের কাছ থেকে সহজে নিস্তার পেলেন না।

মহর্ষি মনে মনে সুখীবোধ করলেন। সবাইকে যথাবিহিত আশীর্বাদ জানিয়ে দ্বারকায় যাত্রা করলেন। সময় মতো পৌঁছুলেন দ্বারাবতীতে। যে-নৌকারোহণে তিনি ও তাঁর শকট দ্বারাবতী পৌঁছুলেন সেই নৌচালকেরা চিৎকার করে তীরবর্তী যাদবগণকে তাঁর আগমনবার্তা জানিয়ে দিল। মহর্ষি তীরে পা দিতে না দিতেই, ভোজক, অন্ধক ও বৃষ্ণি শাখার যাদবদের গৃহে গৃহে সাড়া পড়ে গেল। কুশস্থলীপুরী আর রৈবতক পর্বতের বিভিন্ন হর্ম্যতলে, কাননে কাননে, ক্রীড়াভূমিসমূহে সর্বত্র তাঁর আগমনবার্তা পৌঁছে গেল। তাঁর আসা মানেই, নানা দেশের নানা সংবাদ জানা, বিবিধ বিষয়ে জ্ঞানলাভ করা। অন্তরে বাহিরে কোনও সংকট থাকলে তাঁর উপদেশ লাভে তার নিরসন করা। সেইজন্য তিনি সর্বত্র পূজিত নিমন্ত্রিত।

পার্বত্য নগর প্রাকারের এবং প্রবেশদ্বারের রক্ষীরা সকলেই তাঁকে আভূমি নত হয়ে অভিবাদন করল। মহর্ষি দু’হাত তুলে সবাইকে আশীর্বাদ করলেন। অন্ধক ভোজক বৃষ্ণি গোষ্ঠীর অনেকেই নানাদিক থেকে প্রণাম ও সমাদর করতে ছুটে এলেন। মহর্ষি খুশি আর আনন্দিত চিত্তে সকলের মস্তক আঘ্রাণ করে আশীর্বাদাদি জানিয়ে নানা কুশল জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে এগিয়ে চললেন।

কালের একটা হিসাব দরকার। মহর্ষির এই আগমন, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কত বছর পরে? যুদ্ধের পরেও তিনি ইতোমধ্যে কয়েকবার দ্বারাবতী ভ্রমণ করে গিয়েছেন। এই ক্ষণের কালটি ঠিক কখন? কৃষ্ণের বয়স আচরণ ইত্যাদি দিয়েই হিসাব করে বলা যায়, ভারত যুদ্ধের দশ বছরের বেশি বোধহয় না। তা হলে কৃষ্ণের বয়স এখন প্রায় বাহান্ন কিংবা সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয়ের বিচারে ঊনআশি। তবু এখনও তাঁর নীলোৎপল দেহে জরা বা বার্ধক্যের কোনও লক্ষণ নেই। তার জীবনসায়াহ্নের অস্তরাগে, এখনও সেই বিমর্ষ ম্লানতার কোনও ছায়া পড়েনি। যে-সময়ে তিনি নারদকে দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘জ্ঞাতিবর্গকে ঐশ্বর্যের অর্ধেক দান করে, সর্বদা তাঁদের কটুবাক্য শুনে তাঁদের দাসের মতো বেঁচে রয়েছি।’…

আমার বলতে ইচ্ছা করছে, জীবন এইরকম। আমাদের জীবিতকালের মধ্যেই তো বিশ্বের কত রথী মহারথীর অতি ভয়ংকর আর বিষাদজনক পরিণতি দেখলাম! তুলনা আমি কারও সঙ্গেই কারওর করব না। কারণ, আমি মনে করি, এই সব অতিমানুষ ব্যক্তিগণ সকলেই আপনিই আপনার একমাত্র তুলনা। একজনের চরিত্রের আলোকে আর একজনকে বিচার করা যায় না।

কিন্তু এখন এ-সব কথা থাক। মহর্ষিকেই অনুসরণ করি। যদুবংশে যদিও ভোজক কুলের উগ্রসেন বংশধরেরাই রাজসিংহাসনে আরোহণের অধিকারী তথাপি ন্যায়াধীশ বীর এবং কুশলী, সব বিষয়েই শ্রেষ্ঠ হলেন, বৃষ্ণিবংশাবতংসাবতার বাসুদেব। অতএব মহর্ষি কুশস্থলীপুরীতে, আগে কৃষ্ণ সমীপে যাওয়াই স্থির করলেন। অতি রমণীয় পর্বতের ওপর কুশস্থলীপুরীর যে-অংশে কৃষ্ণ বাস করেন, সেই অংশের কাছাকাছি হতেই বৃষ্ণিবংশীয় সকল বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সন্তানসন্ততিরা মহর্ষিকে অভ্যর্থনা করতে ছুটে এলেন। অবিশ্যি একটা কথা সব সময়েই মনে রাখা দরকার, মহর্ষি সচরাচর একলা কোথাও তেমন যেতেন না। তাঁর সঙ্গে সর্বদাই কিছু জ্ঞানী ঋষিগণ থাকতেন। তাঁরা মহর্ষির শিষ্য এবং জ্ঞানমুগ্ধ। মহর্ষির সঙ্গে নানাস্থানে ঘুরে বেড়ানো, একটি অতি আনন্দজনক বিষয়।

মহর্ষি কি তা বলে কখনও একলা কোথাও যেতেন না? নিশ্চয়ই যেতেন। সেরকম বিশেষ প্রয়োজন হলে তিনি ঋষিগণ সহ বিহার করতেন না। মহর্ষি কৃষ্ণ-অঙ্গনে আসামাত্র, প্রদ্যুম্ন এবং আর আর যুবক বৃষ্ণি যাদবেরা তাঁদের নানা বিলাস, আলাপন, ক্রীড়া, অন্তঃপুরে ও বাইরের কানন ছায়ায় নারীগণের সঙ্গে নানা হাসিমুখর চতুর বাক্যালাপাদি ত্যাগ করে দ্রুত মহর্ষি সমীপে এসে তাঁকে যথাযোগ্য সমাদরসহ প্রণাম করলেন। কৃষ্ণও অন্তঃপুরে সংবাদ পাওয়ামাত্র, ত্বরিত গতি উত্তাল জলস্রোতের ন্যায় নানা সম্ভাষণ করতে করতে ছুটে এলেন। তাঁকে যথাযোগ্য সমাদর ও পূজা করার জন্য নতশিরে হাত বাড়িয়ে আহ্বান করে বললেন, ‘মহর্ষি, আমার অশেষ সৌভাগ্য বিশ্ববিহারী আপনি আমাকে দয়া করে দর্শন দিয়েছেন। আসুন, উপযুক্ত আসন গ্রহণ করুন।’

মহর্ষি এবং তাঁর সঙ্গীরা বাসুদেবের এবং অন্যান্য বংশধরগণের আচরণে সত্যি খুব খুশি হলেন। কিন্তু তাঁর তীক্ষ্ণ ভ্রূকুটি চোখে একটি জিজ্ঞাসা জেগে উঠল। বাঁ দিকে, কিছু দূরেই একটি ছায়াঘন, বিবিধ বর্ণাঢ্য ফুলের কেয়ারি ও লতাপাতায় কিছুটা আচ্ছন্ন, কানন মধ্যে অপরূপ রূপবান কৃষ্ণপুত্র শাম্বকে দেখলেন, তিনি একবারের অধিক মহর্ষির দিকে ফিরে তাকাবার অবকাশ পেলেন না। কেন, এত ব্যস্ততা কীসের?

শাম্ব সত্যি আর দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাবার অবকাশ পেলেন না, কারণ তখন তাঁর কাননবিহারিণী সহচরীদের মধ্যে একজনের মদির চোখের দিকে তাকিয়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। দেহসম্ভোগ বিষয়েই আমোদজনক নানা কূট তর্ক হচ্ছিল, যে-তর্কের মধ্যেও মনে স্ফূর্তি জাগে, প্রাণ হিল্লোলিত হয়। বিশেষত কৃষ্ণপুত্রদের মধ্যে শাম্ব সর্বাপেক্ষা অধিক রূপবান পুরুষ। কাঞ্চনের অধিক উজ্জ্বল বর্ণে, তাঁর দেহে যেন, পারিপার্শ্বিক সকলেই প্রতিবিম্বিত হয়। তা সে কানন কুঞ্জ জলাশয় আকাশ পর্বত নারী যাই হোক। তাঁর অতি আয়ত চোখে সর্বদা কামনার বহ্নি অনল প্রজ্বলিত হয় না, কিন্তু তাঁর মুগ্ধ দৃষ্টিতে এমন একটি চিত্তজয়ী দুর্বার আকর্ষণ আছে, রমণীমাত্রেই তাঁর দর্শনে মিলন আকাঙক্ষায় কাতর হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে, পুরুষ হিসাবে তাঁর রূপ এমনই অসামান্য, তিনি নগরের পথে বের হলে, মাতা ও মাতৃপ্রতিম দুই চারি মহিলা ছাড়া সকল যাদবরমণীগণই, প্রচ্ছন্ন বা অপ্রচ্ছন্ন যে-কোনও অলিন্দে গবাক্ষে বা সোপানে তাঁকে একবারটি দেখবার জন্য ছুটে আসেন।

দ্বারকার রমণীকুলে শাম্ব সম্পর্কে বহুতর কৌতূহল, নানা আকাঙ্ক্ষা। সকলেই জানেন, প্রণয়োদ্দীপ্ত ভাষণে ও আলাপে তিনি তুলনাহীন। অথচ কোনও ইতর ভাষা তিনি উচ্চারণ করেন না। তাঁর রতিকলাকুশলতা বিষয়ে রমণীগণ নানা কাহিনী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে, অতি কামনায় অবশাঙ্গ ও মূৰ্ছিত হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি সকল রমণীগণের সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ে অবহিত আছেন। যথাস্থানে যথাযোগ্য সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে থাকেন। ভ্রাতৃবধুদের প্রতি প্রীতি, কনিষ্ঠ কুলরমণীগণকে স্নেহের দ্বারা সুখী করেন। পুরুষরাও সকলেই প্রীত, কারণ শাম্বর আচরণ, আলাপাদি শ্রদ্ধা প্রীতি ও বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু মানুষের মন! শাম্বর পুরুষোচিত রূপ যৌবনে অনেক যাদবগণের অবচেতনেই ঈর্যা প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে।

শাম্ব এখন যে সহচরীটির মদির চোখের দিকে অভিভূত হয়ে তাকিয়ে আছেন, সম্ভবত সে একজন গোপবালা। সর্বজনবিদিত, যাযাবর গোপরমণীরা অন্যান্যদের তুলনায় স্বাধীনচেতা। তাদের স্ব-ইচ্ছাগমন বিষয়ে সকলেই অবগত আছে। প্রণয়-সহচরীরূপে তাদের ভূমিকা অদ্বিতীয়। শাম্ব কুঞ্জ মধ্যে সেই রমণীটির দিকে কেবল অভিভূত হয়ে তাকিয়ে নেই, যেন হতবাক বিস্ময়ে, অথচ কামনাবিহ্বলতায় স্তব্ধ হয়ে আছেন। তাঁকে ঘিরে রয়েছে আরও কয়েক যুবতী, যারা পীনবক্ষ, ক্ষীণকটি, গুরুনিতম্ব এবং সুগৌরী। সকলেই অবিন্যস্ত, বস্ত্রাদি স্খলিত, সকলেই অপরূপদেহধারী শাম্বের অঙ্গ স্পর্শে ব্যাকুল হয়ে তাঁর নানা অঙ্গ নিজেদের হাতে ধারণ করে আছে। শাম্বের সঙ্গে সকলেই সুরাসব পান করেছে। এখনও করছে।

শাম্ব খালি গা। তাঁর অতি উজ্জ্বল দেহে বক্ষভাগ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। গলায় কবচযুক্ত মুক্তাহার, কানে কুণ্ডল, দুই নিবিড় আয়ত চোখ সুরাসবের গুণে রক্তিম। সকলের সঙ্গেই তিনি নানা প্রণয়সম্ভাষণে লিপ্ত ছিলেন। তার মধ্যে দেহ সম্ভোগের নানা গূঢ় রহস্য ও চাতুর্যপূর্ণ প্রশ্নোত্তরের খেলা চলছিল। বেণীবন্ধনহীন আলুলায়িতকেশ পীনোদ্ধত বুকের ওপর লুটিয়ি, যে-রমণী এখন নাসারন্ধ্র কাঁপিয়ে ঠোটের কোণে হাসি ফুটিয়ে মদির চোখে শাম্বকে দেখছে সে সহসা একটি কূট প্রশ্ন করেছে। বাসনাতড়িতা রমণী যদি উড়ন্ত মরালীর মতো চক্রাকারে উড়তে উড়তে পূর্ণ বৃত্তাকারে অবস্থান করে শাম্ব-সঙ্গলাভে অতিপ্রার্থিী হয়, তা হলে শাম্ব কীরূপ আসন গ্রহণ করবেন?

এক গন্ধর্বী সুন্দরী মাথার ওপর হাত তুলে দেহকে অর্ধচক্রাকারে রেখে ভূমিতে হাত রেখেছিল। উদ্দেশ্য শাম্বকে বৃত্তকার কৌশলি দেখাবে। প্রশ্নকর্ত্রী বাধা দিয়েছে। অন্যান সহচরীরাও বাধা দিয়েছে। রমণীর সেই বৃত্তকার দেহকে কল্পনা করুন এবং আপন আসনের কল্পনা ব্যাখ্যা করুন।

সহচরীদের সুরাসব পানে ও হাস্যে কুঞ্জ মুখরিত। তারাও যেন অতিপ্রার্থিনী হয়ে, সকলেই নিজেদের বৃত্তাকারে কল্পনা করে শাম্বসঙ্গলাভে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। শাম্ব কয়েক মুহূর্ত ভেবেই, সহসা প্রণায়াকুল হয়ে প্রশ্নকর্ত্রী সহচরীকে দু’হাতে বুকে টেনে নিলেন, চুম্বন সোহাগে স্পর্শের দ্বারা তাকে আহ্লাদিত করে বললেন, তুমি প্রকৃতই চতুরা। শুনলে মনে হয়, তোমার প্রশ্ন অতিশয় কঠিন ও কূট। আসলে সহজ। ঘুরিয়ে বলেছ।

সকল সহচরীরাই শাম্বর জবাবের প্রত্যাশায় তাঁকে সর্বাঙ্গে ঘিরে ব্যূহ রচনা করল। তাঁর পত্নী লক্ষ্মণাও সহচরীদের মধ্যেই রয়েছে। শাম্ব বললেন, রমণীর বৃত্তাকার দেহধারণ আগে নয়, পরে। বলো ঠিক বলেছি কি না?

প্রশ্নকর্ত্রী আলুলায়িতকেশিনী পীনোদ্ধত সুগৌরীবালা ভুরু কুঁচকে তাকাল। কিন্তু তার ঠোঁটের তটে নিটুট হাসি তরঙ্গে ঢেউ তুলল। চোখের কালো তারা দ্রুতসঞ্চরণশীল ভ্রমরের মতো ঝিলিক দিল। কিন্তু কোনও জবাব দিল না। শাম্বর মুখ থেকেই সে এবং সকলেই জবাব শুনতে চায়।

শাম্ব বললেন, আমি যে-রমণীকে ধারণ করি, একমাত্র সে-ই তখন সেই অবস্থায় নিজের কোমল অঙ্গে বৃত্তাকার রূপ ধারণ করতে পারে।

প্রশ্নকর্ত্রী তৎক্ষণাৎ নত হয়ে, শাম্বর জানুদেশে মাথা রাখল। অন্যান্য রমণীরা সোল্লাসে হেসে উঠল। কিন্তু এই সব প্রণয়োদ্দীপ্ত রঙ্গ খেলায়, শাম্ব এই মুহূর্তে কার কোপে পড়লেন, তা জানতে পারলেন না। দূরান্তের সমুদ্রমধ্যে পর্বতবেষ্টিত এই রমণীয় নগরে যাদবেরা এখন নিশ্চিন্তে জীবনধারণ করছেন। শত্রুর আক্রমণ বা যুদ্ধবিগ্রহের কোনও সম্ভাবনা নেই। বলতে গেলে পাঞ্চালরাজ, পাণ্ডব, যাদবরাই এখন ভূভারত শাসন করছেন। তাঁদের মধ্যে ঐক্যের কোনও অভাব নেই। পরাজিত রাজন্যবর্গ সকলেই আত্মসমর্পণ করে স্ব স্ব রাজ্যে এঁদেরই নেতৃত্বে বাস করছেন। কোথাও কোনওরকম ষড়যন্ত্র বা বিদ্রোহের সংবাদ নেই। বড়রকমের কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেনি। সারা দেশে এখনও আকাশে বাতাসে শোকের যেটুকু চিহ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে, তা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বিশাল ক্ষয় ও ক্ষতি। এখন চারদিকে শান্তি ও স্বস্তি। একা শাম্ব না, সকল যাদব সন্তানেরাই এখন নানা ক্রীড়াকৌতুকে সময় অতিবাহিত করেন।

কিন্তু প্রদ্যুন্মের মতো, শাম্বর দৃষ্টি ও চিন্তা যদি জাগ্রত হত তা হলে তিনি মহর্ষির আগমনকে কখনও ভুলে থাকতে পারতেন না। সকল যাদব শ্রেষ্ঠগণের মতোই ছুটে আসতেন। শাম্ব আচরণবিধি জানেন না, এমন না। তবু ভুলে গেলেন। প্রেম প্রণয়লীলা এমন ভুলের সৃষ্টিও করে। মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়। আর মানুষ মাত্রকেই তার মূল্য দিতে হয়।

শাস্ত্র প্রণয়-লীলা করুন। মহর্ষিকে দেখি।

মহর্ষি, কৃষ্ণ, পুত্র প্রদ্যুম্ন ইত্যাদি সকলের দ্বারা আপ্যায়িত ও পূজিত হয়ে নানা কুশল জিজ্ঞাসা ও আশীর্বাদ করলেন। কৃষ্ণ নানাস্থানের সংবাদ জিজ্ঞেস করলেন। মহর্ষি সবই তাঁকে বললেন। কিন্তু শাম্বর আচরণে তাঁর অন্তরে আগুন জ্বলছে। তাঁর প্রতিটি নিশ্বাস যেন বিষানলশিখাযুক্ত হয়ে, শাম্বকে আঘাত করতে চাইছে। সেই মুহূর্তেই তা প্রকাশ না করে নানা দেশ জনপদ আশ্রম তপোবন রাজা ও ঋষিদের বহুতর সংবাদ বললেন। কিন্তু নিজেকে তিনি অপমানিত বোধ করে ভাবতে লাগলেন, বৃষ্ণিকুলের এই রূপবান বংশধরটিকে কীভাবে শিক্ষা দেওয়া যায়।

মহর্ষি নারদ কৃষ্ণের আতিথেয়তায় যৎপরোনাস্তি সন্তোষ প্রকাশ করে অন্যান্য যদুবংশীয়দের গৃহে গমন করলেন। ভোজ এবং অন্ধকবংশীয়দের কাছে শাম্ব সম্পর্কে দু’-একটি প্রশ্নও করলেন। শাম্বর নিন্দা কেউ করেননি। কিন্তু মহর্ষির ক্ষুব্ধ চিত্ত তাতে বিন্দুমাত্র শান্ত হল না। দ্বারকাত্যাগ করার আগেই, শাম্বকে একটা কোনও শিক্ষা দিতে না পারলে, তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হচ্ছিল না। তিনি বিচক্ষণ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং তাৎক্ষণিক উপায় উদ্ভাবনে বিশেষ পটু। ভেবে দেখলেন, একমাত্র কৃষ্ণকে বিচলিত করতে পারলেই শাম্বকে যথোচিত শিক্ষা দেওয়া সম্ভব। পুত্রের বিরুদ্ধে পিতাকে কুপিত ক্রুদ্ধ করে তুলতে পারলেই এক্ষেত্রে মহর্ষির মনস্কামনা সিদ্ধ হতে পারে। সমগ্র দ্বারকায় যাদবগণের মধ্যে শাম্ব স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে প্রতিষ্ঠিত। শাম্বর বিরুদ্ধে যদুবংশকে বিবাদে প্রবৃত্ত করা সম্ভব না। বিরোধ সৃষ্টি করতে হবে পিতা পুত্রের মধ্যেই। আর তার হেতু স্বরূপ, শাম্বর অসামান্য রূপই যথেষ্ট।

মহর্ষি কি কৃষ্ণচরিত্র জানতেন না? খুব ভালই জানতেন। পাণ্ডবদের সংগঠিত করে সমগ্র দেশে শত্রুদের বিনাশসাধনে গভীর ভেদবুদ্ধির প্রয়োগ, বিশেষ করে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে আত্মীয়ক্ষয়ে বিমুখ, আচ্ছন্ন ম্রিয়মাণ অর্জুনকে শত্রুরূপী জ্ঞাতিহত্যায় উদ্‌বুদ্ধ করে তোলার অসামান্য কীর্তি এই সব কিছু সত্ত্বেও কৃষ্ণ কি পরিপূর্ণ অসূয়াহীন? অতি কীর্তিমান মহামানবও মানুষ! জীবধর্মের এইটি একটি বিশেষ লক্ষণ। তাঁরও কতকগুলো সুপ্ত বোধ থাকে, অসূয়া অহংকার সম্ভোগেচ্ছা, আপনশক্তিতে বিশ্বাসী নিশ্চিন্ত কালাতিপাত। আঘাত সেখানেই হানতে হবে।

মহর্ষি দ্বারকাত্যাগের আগে, কৃষ্ণের সঙ্গে একান্তে একবার সাক্ষাৎ করলেন। বললেন, ‘বাসুদেব, আপনার বংশে একটি গ্লানিময় পাপের ছায়া দেখে আমি বড় বিচলিত বোধ করছি।’

প্রশান্ত কৃষ্ণ উদ্‌বিগ্ন বিস্ময়ে বললেন, ‘আমার বংশে গ্লানিময় পাপের ছায়া? আমার চোখে পড়েনি?’

মহর্ষি হেসে বললেন, ‘চোখে পড়লে তো আপনি জানতেই পারতেন। ওপরে শান্ত জলরাশি, অথচ তলের গভীরে খরস্রোতের মতো সেই পাপের ধারা বহে চলেছে। তির্যগযোনিসম্ভুত অনার্যরাজের কন্যা, জাম্ববতী তনয় শাম্ব তার কারণ।’

কৃষ্ণ অধিকতর বিস্ময়ে বললেন ‘শাম্ব? তার বিষয়ে যদুবংশে কোনও মালিন্য নেই। আমার এই রূপবান সন্তানটি সকলের প্রিয়।’

মহর্ষি বিদ্রূপে কুটিল হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, শাম্ব সকলের প্রিয়, কিন্তু সে প্রিয়তম পুরুষ আপনার ষোলো হাজার রমণীর! যে-ষোলো হাজার রমণীকে উদ্ধার করে, আপনি ভর্তাস্বরূপ তাদের গ্রহণ করেছেন, যাদের প্রতি প্রেমবশত স্যমন্তক মণি আপনি ধারণ করতে পারেননি, সেই ষোলো হাজার রমণী শাম্ব সঙ্গলাভে ব্যাকুল। শাম্বই তাদের ধ্যানজ্ঞান। এ কি পাপ নয়?’

কৃষ্ণ এক মুহূর্ত দ্বিধাগ্রস্ত হলেও পরমুহূর্তেই দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ, পাপ, কিন্তু আপনার অভিযোগ সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। মহর্ষি, আপনি ত্রিভুবনখ্যাত, সীমাহীন আপনার অভিজ্ঞতা। তবু বলি, আমার পুত্র ও প্রেয়সীদের বিষয়ে এই অভিযোগ আমি বিশ্বাস করি না। শাম্বর সদাচার বিশ্বস্ততা পিতৃভক্তি প্রশ্নের অতীত। আমার ষোলো সহস্র স্ত্রী সহচরী রমণীদের বিষয়েও আমার মনে কোনও দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব নেই।’

মহর্ষি গম্ভীর হয়ে উঠলেন, তাঁর অন্তরের কোপানল বর্ধিত হল। বললেন, ‘আমি ত্রিভুবনখ্যাত, আমার অভিজ্ঞতা সীমাহীন। কিন্তু বাসুদেব, আপনার অন্তর্দৃষ্টি গভীর ও ব্যাপক, অতুলনীয়। যে-কোনও বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সকলের সাধনার বস্তু। রমণীর চরিত্র আর মন সম্পর্কে আপনি এমন দ্বিধাহীন হচ্ছেন কেমন করে?’

‘কারণ আমি সত্যাশ্রয়ী।’ কৃষ্ণ বললেন, ‘মহর্ষি, আপনি জানেন, এই ষোলো হাজার রমণী দ্বারকার যদৃচ্ছ বিচরণকারিণী। আমাদের বংশের পুত্রগণ ব্যতীত, যাদবশ্রেষ্ঠগণের অনেকেই এই রমণীদের প্রার্থনা করে থাকেন, যথোচিত সমাদরের দ্বারা সঙ্গলাভও করে থাকেন। তা কোনও দূষণীয় বিষয় না। এদের মধ্যে আপনি বাদ দেবেন, রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, গান্ধারী (ধৃতরাষ্ট্র-পত্নী নন), হৈমবতী, শৈবা, প্রস্বাসিনী, ব্ৰতিনী এই আটজনকে। এই রমণীরত্নগণ আমার মহিষী। ষোলো হাজার রমণীরত্নও স্বর্গের অপ্সরাতুল্য একান্ত আমার দ্বারাই রক্ষিত। তাদের রক্ষণাবেক্ষণের সকল দায় দায়িত্ব আমার। আমি তাদের গতিবিধি আচরণ সবই জানি।’

মহর্ষি বিমর্ষ মুখে বললেন, ‘আপনি যা বললেন, সবই আমারও জানা আছে। আপনি পুত্রগণ ব্যতীত বললেন। কিন্তু শাম্ব আপনার পুত্রই।’

কৃষ্ণ বললেন, ‘অবশ্যই। সেই জবাব তো আপনাকে আগেই দিয়েছি। শাম্ব এবং ষোলো হাজার রমণী বিষয়ে আপনার অভিযোগ আমি বিশ্বাস করি না।’

মহর্ষির মুখ শক্ত হয়ে উঠল, বললেন, ‘প্রমাণ পেলে কি আপনি বিশ্বাস করবেন?’

কৃষ্ণ হেসে বললেন, ‘প্রমাণ পেলে, তখন আর বিশ্বাস অবিশ্বাসের কী আছে? চাক্ষুষ ঘটনাই তো বিশ্বাস।’

মহর্ষি কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে বললেন, ‘তবে তাই হবে। প্রমাণের সুযোগ এলে, আবার আপনার কাছে আসব। আজ বিদায় নিচ্ছি।’

কৃষ্ণ মহর্ষিকে প্রণাম করলেন। মহর্ষি কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে, মস্তক আঘ্রাণ করে বিদায় নিলেন।

কৃষ্ণের চিত্তে কোথাও সন্দেহের কোনও ছায়া ছিল না। অবিশ্বাসও তাঁর হৃদয়কে কিছুমাত্র বিচলিত করেনি। মহর্ষি নারদের অভিযোগ তিনি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। তবু মনটা যে বিচলিত না হল, তা না। কারণ মহর্ষি সহসা কোনও কথা বলবার পাত্র নন। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপেই বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য থাকে। কেন তিনি শাম্ব এবং ষোলো সহস্র প্রিয়দর্শিনী প্রণয়শীলা রমণীগণকে কেন্দ্র করে এমন একটি অমূলক অভিযোগ করলেন? শাম্ব কি কোনও কারণে তীক্ষ্ণদৃষ্টি মেজাজি মহর্ষির বিরক্তি উৎপাদন করেছে? অথবা রমণীগণ কেউ তাঁকে দেখে কোনওরকম হাস্যপরিহাসাদি করেনি তো?

কিন্তু কৃষ্ণ কারওকেই মহর্ষির অভিযোগের বিষয়ে কিছু বললেন না। কৌতূহলবশত শাম্বকে কয়েকদিন লক্ষ করে দেখলেন। ব্যতিক্রম বা বৈশিষ্ট্য কিছুই চোখে পড়ল না। শাম্ব একজন যুদ্ধবিশারদ দৃঢ়কলেবর মহাবীর। এক্ষণে নারীসঙ্গ, প্রণয়লীলা ও নানা রঙ্গরস ক্রীড়াকৌতুকে শাম্বর আসক্তি কিঞ্চিৎ বেশি। সে তার স্ত্রী ও রমণীদের সঙ্গে যেমন ক্রীড়াকৌতুকে কাল কাটিয়ে থাকে, তার অতিরিক্ত কিছু চোখে পড়ল না।

কৃষ্ণ কি ষোলো সহস্র রমণীর অন্তরের কথা জানবার প্রয়াসে, তাদের মধ্যে উৎকর্ণ ও সজাগ দৃষ্টি নিয়ে বিচরণ করেছিলেন? করলেও, তিনি কি কিছুই অনুমান করতে পেরেছিলেন? তিনি দুরন্ত মহাবল অরিনিধনকারী বাসুদেব। নরককে বধ করে তিনি এই রমণীদের কেবল উদ্ধার করেননি, জাম্ববানের কাছ থেকে স্যমন্তক মণি উদ্ধার করেছিলেন। সত্রাজিৎ কন্যা সত্যভামাকে বিবাহ করেছিলেন। স্যমন্তক মণি যে-কোনও পুরুষের ধারণের অতি আকাঙক্ষণীয়। কিন্তু ষোলো হাজার রমণীকে নরকের পীড়ন থেকে উদ্ধার করে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেছিলেন বলেই স্যমন্তক মণি ধারণ করতে পারেননি। ইচ্ছা ছিল সত্যভামা করুন। কিন্তু তিনি কৃষ্ণের বিবাহিতা স্ত্রী। যা কৃষ্ণ পারেন না, তা তিনিও পারেন না। সেই ষোলো সহস্র রমণী কি কখনও কৃষ্ণপুত্র শাম্বের প্রতি আসক্তিবোধ করতে পারে?

কৃষ্ণের একমাত্র সিদ্ধান্ত, এমন ঘটনা কদাচ ঘটতে পারে না। সংগীতাচার্য মহর্ষি নারদের অভিযোগ তিনি কোনওরকমেই বিশ্বাস করতে পারলেন না। বিশ্বাস করলেন না, এবং তিনি স্থিরনিশ্চিত ছিলেন, মহর্ষি কখনওই তাঁর অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবেন না। অতএব জনার্দন অল্পকালের মধ্যেই মহর্ষির অভিযোগের কথা বিস্মৃত হলেন। যথাবিহিত নিত্যনৈমিত্তিক জীবনযাপনে কাল কাটাতে লাগলেন। যদিচ তাঁর এই কাল ক্রমশ বার্ধক্যের দিকে ঢলে পড়ছিল, আর সেই সঙ্গে যদুবংশের মধ্যে নানারকম বিবাদ বিরোধ দেখা দিচ্ছিল।

কৃষ্ণ নিজে বিশ্বাস করতেন, জীবনকালের মধ্যে দুইটি ভাগ সর্বাপেক্ষা শ্রেয়স্কর। বনবাসে জীবনধারণ, অথবা রাজ্য ও সমৃদ্ধিলাভে পরাক্রান্ত সৌভাগ্যশালী হওয়া। এর মধ্যবর্তী ইন্দ্রিয়ভোগে কাল যাপন মানুষকে অধঃপতিত করে। বনবাসে নিরিবিলি সামান্য ধনে জীবনযাপনে শান্তি থাকে। রাজ্য-সমৃদ্ধি ইত্যাদি লাভের মধ্যে মানুষের বলবিক্রম নানা নীতি ও কূটকৌশল যুদ্ধকর্মাদিতে ব্যাপৃত থাকা, ক্রিয়াশীল জীবনের লক্ষণ। এই দুই জীবন প্রবাহের মধ্যে, মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে। মধ্যপন্থা মানুষকে কিছুই দেয় না। অলস বিলাস ব্যসন এবং নিশ্চিন্ত জীবনযাপনের ক্ষেত্রে, ইন্দ্রিয়ভোগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। তখন আর নতুন করে বিকাশের কিছু অবলম্বন থাকে না। মানুষের বলবিক্রম বা তপশ্চর্যা সব কিছুই সৃষ্টিশীল। নব নব রূপে তা উদ্‌ভাসিত হয়।

কৃষ্ণ কি যদুবংশের মহাবল পরাক্রান্ত পুরুষদের মধ্যে সেই মধ্যপন্থা অবস্থা লক্ষ করছিলেন? যখন সকলেই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছিল, নিজেদের মধ্যে তুচ্ছ দলাদলি পরাক্রম বিষয়ে প্রতিযোগিতা ও আস্ফালন করছিলেন? গৌরব বর্ধিত হচ্ছিল না। অতএব সম্পদও বর্ধিত হচ্ছিল না। কৃষ্ণই সর্বাপেক্ষা ভাল জানতেন, ক্ষয় ও লয় অবশ্যম্ভাবী। তিনি কি তারই অশুভ ছায়া, যদুবংশে দেখতে পেয়েছিলেন?

কিন্তু সে অবশ্যম্ভাবী পরিণতি এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে।

নারদ দ্বারকা ত্যাগ করলেও শাম্বের অবহেলা তিনি ভুলতে পারেননি। কৃষ্ণের অবিশ্বাস তাঁর মর্মমূলে গাঁথা ছিল। কিন্তু কেন? তিনি কি সত্যি বিশ্বাস করতেন তাঁর অভিযোগ সত্য? অসামান্য রূপবান পুরুষ শাম্বর মনে হয়তো নিজের সম্পর্কে কিছু অহংকার থাকতে পারে। সে-অহংকার কিছু কিঞ্চিৎ প্রদ্যুম্ন বা চারুদেষ্ণ, কার মধ্যেই বা না ছিল? এবং মহর্ষির এ-অনুমানও হয়তো আদৌ মিথ্যা না, বাসুদেব একান্তরূপে অসূয়াহীন ছিলেন না। মহামানবের গৌরবও চিরকাল তাঁকে আঁকড়িয়ে থাকে না।

প্রকৃতপক্ষে শাম্ব প্রণয়লীলায় কখনওই অতি আসক্ত নন। কিন্তু তাঁর প্রণয়-সম্ভাষণ, কৌতূহলোদ্দীপক প্রেমলীলা, প্রণয়িনীগণের সঙ্গে তাঁর প্রণয়োদ্দীপক নানা ক্রীড়াকৌশল যা একান্ত অনায়াসসাধ্য নয়, বিবিধ আচার অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াদির অপেক্ষা রাখে তা যাদব রমণীগণের মধ্যে সুখকল্পনায় গুঞ্জরিত হত। সেটা তাঁর কোনও অপরাধ না। কিন্তু মহর্ষি ক্রুদ্ধ হয়ে, এত বড় একটা গুরুতর অভিযোগ তুললেন কেমন করে? তাও পিতার রমণীগণ বিষয়ে পুত্রকে অভিযুক্ত এবং সে অভিযোগ পিতাকেই! মহর্ষির কি কোনও বাস্তব ভিত্তি ছিল এই অভিযোগের?

সম্ভবত ছিল। দ্বারকায় ইতিপূর্বে তিনি অনেকবার এসেছেন। যাদবদের বিভিন্ন গৃহে গমন করেছেন। এবং এমন একটি ধারণা করবার মতো সঙ্গত কারণ তাঁর ছিল, রূপবান শাম্ব যাদবরমণীগণের অতি প্রিয় পুরুষ। তিনি কি কখনও কারওর মুখে শুনেছেন, কৃষ্ণের ষোলো সহস্র রমণীগণ শাম্বকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে অভিলাষপূর্ণ প্রণয়ালাপ করছে?

মহর্ষি নিশ্চয়ই কিছু জ্ঞাত ছিলেন। অথবা কেবলমাত্র রমণীর মন বিষয়ে, নানা দেশের অভিজ্ঞতাই তাঁকে এমন একটি দৃঢ় সিদ্ধান্ত দান করেছিল, কৃষ্ণকে সেই গুরুতর অভিযোগ করতে তিনি দ্বিধা করেননি। তিনি দেবতা, অসুর, গন্ধর্ব, যক্ষ, সর্প, মানব সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের স্ত্রীলোকগণের আচরণের নানা রীতি ও বৈপরীত্য বিষয়ে অবগত আছেন সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

মহর্ষি আবার দ্বারকায় ফিরে এলেন। দ্বারকা ত্যাগ করে গেলেও আদৌ কি তিনি দূরান্তরে কোথাও গমন করেছিলেন? মনে হয় না। সম্ভবত নিকটে থেকেই তিনি একটি বিশেষ মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন। নানা শ্রেণীর ঋষিগণের মধ্যে তাঁর কোনও সংবাদদাতা ছিলেন না, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। তিনি এ যাত্রায় দ্বারকায় এসেই আগে গেলেন রৈবতকের পর্বতের গহনে কৃষ্ণের প্রমোদকাননে। রৈবতকের সেই প্রমোদকাননে নানা বৃক্ষে বর্ণাঢ্য ফুলের সমারোহ। ভূমিসকল নানা পুষ্পপল্লবিত বীথি ও মনোহর সবুজ ঘাসে আস্তীর্ণ। প্রমোদকাননে বিশাল সুমিষ্ট স্বচ্ছ জলাশয়।

নারদ দূর থেকে দেখলেন, কৃষ্ণ তাঁর মহিষী ও ষোলোসহস্র রমণীগণসহ জলকেলিতে সুখে মগ্ন। বাসুদেবকে ঘিরে জল মধ্যে নানা রমণী নানা ক্রীড়াকৌতুকে, মরালীর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। কেউ কৃষ্ণকে স্পর্শের জন্য ব্যাকুল, কেউ জলমধ্যে বিহার আকাঙক্ষায় মীনসমূহ যেমন জলমধ্যে নিমগ্ন বৃক্ষের চারপাশে খেলা করে সেইরূপ করছিল। কেউ কেউ সুরাসব পানে অতি প্রমত্তা হয়ে নানারূপ প্রণয় কথা উচ্চারণ করছে। অন্যান্য বান্ধবীদের পৈষ্ঠী ও সুরাসবের পাত্র এগিয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যেই আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে বাসুদেবকে অনুভব করছে। স্বভাবতই প্রমোদকানন ও জলাশয়ে রমণীরা উচ্চহাস্যে প্রগল্‌ভ কথাবার্তায় প্রমত্তা। জলাশয়ও তাদের কেলি উদ্দামে অতি উচ্ছ্বাসে তরঙ্গায়িত।

কৃষ্ণ স্বয়ং অতি উদার ও প্রমত্ত বাঞ্ছায় প্রিয় রমণীগণের সহবাসে সকলের ইচ্ছাপূরণ ও আহ্লাদিত করছেন। এই অতি প্রেমোচ্ছল জলকেলিতে বৃক্ষের পাখিরা নানা স্বরে রব করছে। বিচিত্র বর্ণের পতঙ্গসমূহ কাননের শোভা বর্ধন করছে। রমণীগণের সঙ্গে মরালীরাও জলাশয়ের অন্যপ্রান্তে নিজেদের মধ্যে কেলি করছে।

নারদ দেখলেন, সুরাসব পানে অতি প্রমত্তা রমণীগণের অঙ্গের বসনভূষণ সকলই শিথিল ও স্খলিতপ্রায়। নিজেদের নগ্নতা বিষয়ে তাদের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। থাকবার কথাও না। কারণ রৈবতকের এই প্রমোদ কাননে ও জলাশয়ে একমাত্র পুরুষ কৃষ্ণ ছাড়া কারওরই উপস্থিতির কোনও উপায় নেই। কৃষ্ণের প্রমোদকানন ও জলকেলি স্থান কৃষ্ণ ছাড়া সকলের অগম্য এ-কথা দ্বারকায় সর্বজনবিদিত। কিন্তু তার অর্থ এই না, কৃষ্ণ কোনও প্রয়োজনে সেখানে কারওকে ডেকে আনতে পারবেন না। বিলাস অবকাশেও অনেক সময় কর্মজীবনের জরুরি প্রয়োজন ঘটতে পারে।

নারদ দেখলেন, এই তাঁর সেই প্রকৃষ্ট সুযোগ উপস্থিত। রমণীরা সুরাসব পানে ও যৌবন সম্ভোগেচ্ছায় অতি প্রমত্তা, হাস্যে লাস্যে কৌতুকে কেলিতে প্রমোদকানন মুখরিত। তিনি নগরের প্রাসাদে ফিরে গেলেন। প্রাসাদের কাছাকাছি কুঞ্জমধ্যে শাম্বকে তাঁর সহচরী পরিবেষ্টিত অবস্থায় খুঁজে পেলেন। রূপবান শাম্বকে রমণীর সোহাগে অধিকতর রূপবান দেখাচ্ছিল। নারদ কিছুটা দ্বিধা ও সংকোচ করে বললেন, ‘শাম্ব, তোমাকে সুখে বাধা দিতে চাই না। বাসুদেব এখনও তাঁর রৈবতকের প্রমোদকাননে রয়েছেন। সেখানে তিনি তোমাকে স্মরণ করেছেন।’

শাম্ব তৎক্ষণাৎ সংবিৎ ফিরে পেলেন। মহর্ষি বাক্য কখনও মিথ্যা হবার না। পিতা স্মরণ করেছেন শোনামাত্র তিনি দ্রুতগতি হয়ে, প্রমোদকাননে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণ এমন অসময়ে, তাঁর প্রমোদকাননে কেলিস্থলে শাম্বকে দেখে অবাক হলেন। কিন্তু তাঁর ষোলোসহস্র রমণীগণ, রূপবান শাম্বকে দেখে উল্লাসে মেতে উঠল। তাদের সকলের আরক্ত সিক্ত চোখ মুখ কামনায় উদ্‌বেল হয়ে উঠল। কামোচ্ছ্বাসে তারা সকলে নির্বাক হয়ে থাকতে পারল না। কৃষ্ণের উপস্থিতি সত্ত্বেও শাম্বের রূপ নিয়ে তারা প্রগল্‌ভ গুঞ্জনে মেতে উঠল।

নারদ বুঝলেন, এটা প্রথম ধাপ। রমণীরা এখনও তাদের যৌবনপ্রস্ফুটিত দেহ জলের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে। অবিশ্যি সকল রমণীর মধ্যে তিনজন কৃষ্ণের নিকটবর্তী হয়ে অধোবদন ছিলেন। তাঁরা জাম্ববতী, রুক্মিণী, সত্যভামা। তাঁরা অবাক ও গম্ভীর হয়ে ছিলেন। মত্ততা দূরের কথা, কোনও প্রকারের বিকার তাঁদের ছিল না। নারদ এতক্ষণ অন্তরালে ছিলেন। এবার কৃষ্ণের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন।

মহর্ষিকে দেখামাত্র তাঁকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য সকল নারী জল থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু ফল হল বিপরীত। নারদকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে গিয়ে রমণীগণ শাম্বকে তাদের প্রস্ফুটিত যৌবন দেখাতেই অত্যুৎসাহী হয়ে উঠল। তাদের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহ বিবিধ ভঙ্গিসহকারে শাম্বর সামনে এমনভাবে উচ্ছ্রিত হল যে, সকলের কামোচ্ছ্বাস অত্যন্ত প্রকটিত হল। অতিমাত্রায় সুরাসবপানে, মত্ততাপ্রসূত, তারা শাম্বর প্রতি অতিপ্রার্থিনী হয়ে তাদের উজ্জ্বল রূপলাবণ্যরাশি অনাবৃত করল।

নারদের সঙ্গে কৃষ্ণের একবার দৃষ্টিবিনিময় হল। পরমুহূর্তেই মর্মাহত বাসুদেব ক্রোধে ও গ্লানিতে জ্বলন্ত চোখে রমণীদের দিকে তাকালেন। নারদকে তাঁর আর কিছুই জিজ্ঞেস করার ছিল না। বলবারও ছিল না। মহর্ষি যা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তা তিনি অতি নির্মম ভাবেই করেছেন। এখন তিনি পরিণতি দেখবার জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলেন। কৃষ্ণ রমণীদের প্রতি কঠিন দৃষ্টিপাত করে ধিক্কার দিয়ে অভিশাপবাণী উচ্চারণ করলেন, ‘তোমরা আমার রক্ষিত হয়েও অতি নিকৃষ্ট আচরণ করেছ। অতি প্রমত্তা হয়ে তোমরা যেমন পণ্যাঙ্গনাদের ন্যায় ব্যবহার করেছ, আমার মৃত্যুর পরে, তোমরা তস্করদের দ্বারা লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত হবে।’

কৃষ্ণের অভিশাপ যাঁদের ওপর বর্ষিত হল না তাঁরা জাম্ববতী, রুক্মিণী এবং সত্যভামা। অন্য সমস্ত রমণীগণ মুহূর্তে তাদের অপরাধ অনুভব করে আর্তস্বরে বাসুদেবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল। প্রমোদকাননের জলকেলি, হাস্য মুখরিত লীলাক্ষেত্র সকলই বিষাদে ডুবে গেল। কৃষ্ণ রমণীদের বললেন, ভবিষ্যতে দালভ্য ঋষির কাছে তোমাদের সম্যক জীবনধারণের উপায় জানতে পারবে।

কৃষ্ণ অতঃপর তাকালেন বজ্রাহত বিস্মিত ভীত অধোমুখ শাম্বর দিকে। শাম্বর অসামান্য রূপের প্রতি দৃষ্টিপাত করে, তাঁর ক্রোধানল প্রজ্বলিত হল। পুত্রকে তিনি অভিসম্পাত করলেন, ‘তোমার এই রমণীমোহন রূপ নিপাত যাক। কুষ্ঠরোগের কুশ্রীতা তোমাকে গ্রাস করুক।’

শাম্বর সর্বাঙ্গ আতঙ্কে শিহরিত হল। তিনি করজোড়ে নতজানু হয়ে বাসুদেবের পায়ের কাছে ভেঙে পড়ে, কাতর স্বরে বললেন, ‘পিতা, আমি স্বইচ্ছায় কখনওই আপনার প্রমোদকাননে আসিনি। আমি আমার জন্মমুহূর্ত থেকে আপনার আজ্ঞাবাহী সেবক। পিতা, আপনি জগদ্‌বিখ্যাত বাসুদেব। হে পুরুষোত্তম জনার্দন, হে বৃষ্ণিসিংহাবতার, এই জগতীতলে, কী বা প্রকৃতি কী বা মানুষ, আপনি সকলের অন্তর্যামী। বিশ্বচরাচরের যা কিছু অমোঘ পরিবর্তনশীলতা অথবা মানুষের অন্তরের কথা কিছুই আপনার অগোচরে থাকে না। আপনাকে কোনও কারণে অসুখী দর্শনের চেয়ে আমার পক্ষে মৃত্যুও শ্রেয়ঃ। কিন্তু আপনি জানেন আমি নিষ্পাপ। আমি আপনার ঔরসজাত সন্তান, সংসারে এর তুল্য সুখ ও অহংকার আমার আর কিছুই নেই। আপনার অন্যান্য পুত্রদের ন্যায় আমার দ্বারা কখনও কোনও নীতিবিগর্হিত কাজ সম্ভব না। আপনার সন্তাপ হতে পারে, এমন কোনও কুরুচিপূর্ণ আচরণের সাহস আমার কদাপি মনে ছায়াপাতও করেনি। হে সর্বজ্ঞ পিতা, আপনি আমাকে কেন এই নিদারুণ অভিসম্পাত করলেন?’

কৃষ্ণ সেই মুহূর্তে কোনও জবাব দিতে পারলেন না। বজ্রপাতের পরমুহূর্তে যেমন স্তব্ধতা নেমে আসে, তিনি সেইরূপ মৌনতা অবলম্বন করলেন। মহর্ষি, পুত্র, রমণীগণ, প্রমোদ কানন কোনও কিছুর প্রতি কারও প্রতিই যেন তাঁর দৃষ্টি নেই। অথচ তাঁর বিশাল চক্ষুদ্বয়ের দৃষ্টি শূন্য না। তিনি যেন স্থাণুর গভীর ধ্যানমগ্নতায় ডুবে আছেন।


আরো পড়ুন: উপন্যাস: ঝুমরা । তিলোত্তমা মজুমদার


মহর্ষি মনে মনে হাসছিলেন আর মনে মনেই উচ্চারণ করছিলেন, অসূয়া অসূয়া! হে বাসুদেব, আপনার জ্ঞানই আপনাকে সর্বজ্ঞ করেছে। জ্ঞানী হয়েও রমণীর চরিত্র ও মন আপনি এই বয়সে আর একবার অনুধাবন করলেন। অতি নির্মমরূপে অনুভব করলেন রূপবান আত্মজের সামনে নিজের রমণীগণ কামনায় ব্যাকুল হয়ে উঠলে কী দুঃসহ ঈর্ষায় অন্তর বিদীর্ণ হয়। হে পুরুষোত্তম, আপনিও তখন আপন প্রিয় পুত্রকে নির্মম অভিশাপ না দিয়ে পারেন না। আপনি প্রমাণ চেয়েছিলেন, আমি প্রমাণ দিয়েছি। আমি মিথ্যা কথা বলে শাম্বকে এখানে ডেকে নিয়ে এসেছি, তা ছাড়া চাক্ষুষ প্রমাণের আর কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু শাম্ব নিরপরাধ আপনি জানেন। জেনেও এই অভিশাপ। অমোঘ এই অন্তরের বিকার, হে বাসুদেব। আমি আর ক্ষণকাল এখানে অপেক্ষা করব। শুধু সেই পরিণাম দেখে যাব, পুত্রের কাতর প্রার্থনায় আপনার অভিশাপ থেকে মুক্তিদান করেন কি না। যদি করেন তা হলে আমার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে। শাম্বকে আমি যে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম, তা ঘটবে না।

শাম্ব তখন কৃষ্ণের পদতলে পড়ে কাতর প্রার্থনা করে চলেছেন, ‘পিতা, আপনার কোনও পুত্রই কখনও আপনার অবাধ্যতা করেনি, আমিও করিনি। শৈশব থেকে আপনার ও আমাদের বংশের অন্যান্য অস্ত্রবিদদের কাছে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছি। যুদ্ধবিশারদরূপে আমার যদি কোনও খ্যাতি থেকে থাকে, তবে তা আপনারই দান। আপনার নির্দেশ ও নেতৃত্বে, জরাসন্ধের মহাবল সেনাপতিদের সঙ্গে সংগ্রাম করেছি। বলার অপেক্ষা রাখে না, আপনার অনুপস্থিতিতে এই দ্বারকানগরী যতবার শত্রুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, যদুবংশের সকল বীরদের সঙ্গে আমিও প্রাণপণ যুদ্ধ করেছি। প্রদ্যুম্ন আর আমি অতিবলশালী শাল্বর সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে দ্বারকার দূরপ্রান্তে তাড়িয়ে এসেছি। আপনার মহিমময় কীর্তি, সৌভনগরে গিয়ে সেই শাল্বকে আপনি নিজের হাতে হত্যা করেছিলেন। রাষ্ট্র সমাজ পরিবার বিষয়ে যাবতীয় শিক্ষা আপনার কাছেই পেয়েছি। রমণীদের কার প্রতি কী আচরণ করতে হয়, সেই সুনীতিজ্ঞান আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি। পৃথিবীতে আপনি সেই পুরুষ, যিনি বিশাল রমণীকুলের ভর্তা ও ত্রাতা। আমাকে ক্ষমা করুন পিতা, আমাকে অভিশাপ দেবেন না।’

কৃষ্ণের স্তব্ধ মৌনতা ভাঙল, তিনি তথাপি কয়েক মুহূর্ত তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘শাম্ব, আর তা সম্ভব না।’

শাম্বর অতি উজ্জ্বল কান্তি স্বেদসিক্ত হয়ে বারে বারে প্রকম্পিত হল। নারদ তৎক্ষণাৎ সে-স্থান পরিত্যাগ করলেন। শেষ কথা যা শোনার, তা তাঁর শোনা হয়ে গেল। তিনি প্রমোদকানন ছেড়ে, নগরীর দিকে চলে গেলেন। কৃষ্ণ একবার সেদিকে দেখলেন। বিষাদের ছায়া তাঁর মুখে। জাম্ববতী রুক্মিণী ও সত্যভামার চোখে জল। অন্যান্য রমণীগণ দ্বারকানগরীর অনন্ত বিলাস ব্যসন ও সুখের পরিবর্তে, অভিশাপ ভয়ে কাতর হয়ে তখন কেবল সেই ভয়াবহ অনাগত ভবিষ্যতের চিন্তায় মগ্ন। আর মনে মনে দালভ্য ঋষির নাম জপ করছে।

কৃষ্ণের চোখে, মুখে, বক্ষে, বর্ণের উজ্জ্বলতায় কোথাও কোনওরকম ক্রোধের অভিব্যক্তি নেই। তিনি বললেন, ‘শাম্ব, একমাত্র অভিশাপ দিয়ে যদি সকল সংকটের মুক্তি হত তা হলে আমাকে গদা আর চক্র ধারণ করে শত্রু নিধন করতে হত না। অভিশাপ কেবলমাত্র মনস্তাপ থেকে স্ফুরিত হয় না। সাধারণ মানুষ পরস্পরকে যে-রকম অভিশাপ দিয়ে থাকে, আমার অভিশাপ তদ্রূপ না। যা ঘটে যায়, যা ভবিতব্য তা-ই অভিশাপরূপে উচ্চারিত হয়। তোমার জন্মলগ্নেই এই কুৎসিত ব্যাধি তোমার ভাগ্যে লেখা হয়ে গেছে। আমি অতি ক্রোধে তা উচ্চারণ করেছি মাত্র। তোমার কোষ্ঠীর কাল অনুযায়ী, তোমার ব্যাধির প্রকটরূপ প্রকাশের সময় আসন্ন। বিম্ব ফলের ন্যায় তোমার দেহের এই রক্তাভ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গে স্ফীতি, কিছুই আর স্বাভাবিক নেই। শরীরের এই লক্ষণগুলো তোমার চোখে পড়েনি। তথাপি আমি স্বীকার করি, তোমাকে দেখে রমণীদের যৌবনোচ্ছ্বাসে ক্রুদ্ধ হয়েই তোমাকে অভিসম্পাত দিয়েছি।’

শাম্বের স্বেদসিক্ত কলেবরের কম্পন কিছু স্থির হল। তিনি তাঁর নিজ দেহের প্রতি অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিপাত করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পিতা, তাই যদি সত্য তবে বলুন আমার আরোগ্যের উপায় কী?’

কৃষ্ণ এক মুহূর্ত চিন্তা করে বললেন, ‘এখন আমি বুঝতে পারছি, মহর্ষি নারদকে তুমি রুষ্ট করেছ। তুমি তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দেখাওনি। আমার মনে হয়, তোমার ব্যাধি প্রকটিত হলে তাঁর কাছেই তোমার যাওয়া উচিত। তিনি দেবভূমি থেকে সর্বত্র ভ্রমণ করেছেন। বহু বিচিত্র স্থান ও সম্প্রদায়কে তিনি চাক্ষুষ করেছেন। একদিক থেকে তাঁর অভিজ্ঞতা আমাদের থেকে অনেক ব্যাপক। সম্ভবত তিনিও চান, তুমি তাঁরই দ্বারস্থ হবে। আমিও তোমাকে সেই উপদেশই দিচ্ছি, তুমি যথাসময়ে মহর্ষির সন্ধানেই যেয়ো।’

শাম্ব এখন অকম্পিত স্বরে ঘোষণা করলেন, ‘পিতা, যা অমোঘ এবং অনিবার্য হয়ে জীবনে নেমে আসে, তাকে আমরা ভাগ্য বলে মানি। এই অভিশাপ আমার অদৃষ্ট। এই বয়সের মধ্যেই আমি ভাগ্যের উত্থানপতন কম দেখিনি। এককালে যদুবংশকে মহাবল সম্রাট জরাসন্ধ সংখ্যাল্প করেছিলেন, ভীত ও সন্ত্রস্ত করেছিলেন। আজ কোথায় জরাসন্ধ। যদুবংশ সগৌরবে অবস্থান করছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অতি যুদ্ধার্থী কৌরবগণ প্রায় নিশ্চিহ্ন। পাণ্ডবেরাও লোকবলে ক্ষীণপ্রাপ্ত হয়েছেন। তথাপি কেউ নিশ্চেষ্ট বসে থাকেননি। আমার ভাগ্যের এই অমোঘ অনিবার্য পরিণতি জেনেও, আমিও নিশ্চেষ্ট থাকব না। প্রয়োজন হলে, মুক্তির জন্য আমি এই সসাগরা পৃথিবী, দেবলোকে, অন্তরীক্ষে সর্বত্র যাব। আমাকে আপনি বিদায় দিন।’

শাম্ব পিতার পদধূলি নিয়ে মাথায় ঠেকালেন। কৃষ্ণ শাম্বর মস্তক আঘ্রাণ করে মুখ ফিরিয়ে জাম্ববতীর দিকে তাকালেন। জাম্ববতী তখন অশ্রুজলে ভাসছিলেন। শাম্ব নিজে কাছে গিয়ে, মা জাম্ববতীকে প্রণাম করলেন। রুক্মিণী এবং সত্যভামাকেও প্রণাম করলেন। জাম্ববতী শাম্বর মস্তক আঘ্রাণ করে তাঁকে শিশুর ন্যায় বক্ষে গ্রহণ করলেন। পুত্ৰস্পর্শে মায়ের স্তনধারা যেন সন্তানের জন্য অজস্র ধারায় বিগলিত হল। তিনি আশ্রুরুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘বৎস, আশীর্বাদ করি, তুমি শাপমুক্ত হও। তোমার সেই জনচিত্তবিমোহিতকারী রূপ আবার লাভ করো।’

অভিশাপ ভয়ে ভীতা ষোলো সহস্র রমণীগণও এই দৃশ্য দেখে অশ্রুমোচন করল। যে-কারণে তারা বাসুদেবের দ্বারা অভিশপ্ত, তাদের সেই রমণীচিত্ত শাম্বদর্শনে এখনও বিমোহিত। রূপবান পুরুষের প্রতি রমণীর চির আকাঙক্ষা, এই অভিশাপের দ্বারাই চিরস্থায়ী হল। শাম্ব প্রমোদকানন থেকে বিদায় নিলেন।

শাম্ব ফিরে এলেন নগরীতে। এখন তাঁর অঙ্গ স্বেদকম্পিত না। অভিশপ্ত পুরুষ এখন আত্মমগ্ন হয়ে, মুক্তির কথা ভাবছেন। গৃহ সন্নিকটে অদূরে রমণীয় কুঞ্জমধ্যে সহচরীরা তাঁর জন্য ব্যাকুল হয়ে প্রতীক্ষা করছিলেন। তিনি সেইদিকে ভগ্নহৃদয় বিষাদ দৃষ্টিতে দেখলেন। কিন্তু সেদিকে গেলেন না। যুদ্ধবিশারদ শাম্ব, রতিবিশারদ শাম্ব, আপন বাহু তুলে নিরীক্ষণ করলেন। সত্যি, তাঁর যে-অঙ্গে চতুস্পার্শ্বস্থ সকলই প্রতিবিম্বিত হয়, তা এখন অধিকতর রক্তাভ দেখাচ্ছে। তিনি গৃহমধ্যে গমন করলেন।

গৃহমধ্যে বহু দাসদাসী বিচরণ করছে। শাম্ব কারও প্রতি দৃষ্টিপাত না করে, অন্তঃপুরে গমন করলেন। সেখানে নানা সুবর্ণের আভরণ নানা সময়ে প্রাপ্ত বিবিধ মণি, কক্ষে কক্ষান্তরে, রমণীয় শয্যা ও বিবিধ গৃহসামগ্রী নানাদেশীয় মহার্ঘ বসন, কোনও কিছুর প্রতিই দৃষ্টিপাত করলেন না। অথচ এ সকলই ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয়।

শাম্বকে অন্তঃপুরে গমন করতে দেখে রমণীগণ পাথর স্খলিত প্রস্রবণের ন্যায় সেদিকে ধাবিত হলেন। শাম্ব কপাট বন্ধ করে অতিকায় সুবর্ণদর্পণ হাতে তুলে নিলেন। নিরীক্ষণ করলেন আপন প্রতিবিম্বকে। আশ্চর্য, পিতা মিথ্যা কিছু বলেননি। লক্ষ করে দেখলেন, তাঁর নাসা, কর্ণ, ভ্রূ ইত্যাদির স্থানে স্থানে স্ফীতিলাভ করেছে। এ কি বাসুদেবের অভিশাপমাত্রই ঘটল? নাকি তাঁর কথায় এখন চোখে পড়ছে। তিনি কোষ্ঠীর ভবিতব্যের কথা উল্লেখ করেছেন। হয়তো অভিশাপের বাস্তব ভিত্তি তাই। কিন্তু শাম্ব এই ঘটনাকে পিতার অভিশাপ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছেন না।

শাম্ব সুবর্ণদর্পণ রেখে দিয়ে কপাট খুলে দিলেন। রমণীগণ মধ্যে কেবল লক্ষ্মণাকেই প্রবেশ করতে বললেন। এই সেই দুর্যোধন আত্মজা লক্ষ্মণা, যাঁকে শাম্ব হরণ করে বিবাহ করেছিলেন। লক্ষ্মণা সর্বাঙ্গসুন্দরী, সর্বালংকারশোভিতা। কিন্তু শাম্ব কর্তৃক সখী ও সহচরীদের কক্ষ প্রবেশে বাধাদানে অবাক হলেন। অবাক হল প্রণয়সঙ্গিনীরা। ম্লান মুখে তারা ফিরে গেল। লক্ষ্মণার হৃদয় শুভ আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। তিনি শঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে তোমার। তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’

শাম্ব ব্যস্ত কৌতূহলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন দেখাচ্ছে আমাকে লক্ষ্মণা?’

লক্ষ্মণা প্রশ্ন আশা করেননি। শাম্বর জিজ্ঞাসায় এক মুহূর্ত দ্বিধাগ্রস্ত হলেন, তারপর বললেন, ‘তোমার চোখ মুখ শুষ্ক। পীড়িত, বিষণ্ণ, দুঃখিত দেখাচ্ছে তোমাকে। মহর্ষি নারদ তোমাকে কোথায় ডেকে নিয়ে গেছলেন? কিছুক্ষণ আগেও তুমি সুখী ছিলে। এখন এত করুণ আর বিমর্ষ কেন?’

শাম্ব লক্ষ্মণাকে সব কথাই বললেন। লক্ষ্মণা অস্ফুট ক্রন্দনে আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘অভিশাপ! কেন? তুমি যে রমণীমোহন, এ-কথা দ্বারকায় সর্বজনবিদিত। তবে কেন অভিশাপ?’

শাম্ব বললেন, ‘লক্ষ্মণা, অভিশাপ জিজ্ঞাসার অতীত। এ অমোঘ এবং অনিবার্য। এ ভাগ্যের পরিহাস না, নির্দেশ। একে অমান্য করা চলে না। আমি এখন থেকে তোমাদের কাছ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকব। নগর প্রকারের বাইরে কিছুকাল অপেক্ষা করে মহর্ষির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর নির্দেশ নেব। তিনি যা বলবেন তাই করব।’

লক্ষ্মণা আসন্ন বিচ্ছেদব্যথায় কাতর হয়ে উঠলেন, বললেন, ‘না না, আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেব না। তুমি যেখানেই যাও আমি তোমার সঙ্গে যাব।’

শাম্ব শান্ত স্বরে বললেন, ‘লক্ষ্মণা, মহর্ষির সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই একমাত্র এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তিনি যদি নির্দেশ দেন, তা হলে তুমি আমার সঙ্গে যাবে। তবে, খুব দ্রুতই ব্যাধি আমাকে গ্রাস করবে, আমি অনুভব করছি। পূর্ণ গ্রাসের পূর্ব পর্যন্ত আমি নগরের বাইরে থাকব। তারপরে মহর্ষির সঙ্গে সাক্ষাৎ করব।’

লক্ষ্মণার কান্না হৃদয়বিদারক হল। তিনি শাম্বকে আলিঙ্গন করে তাঁর প্রতিটি অঙ্গ নিরীক্ষণ করে সন্দিগ্ধ অবিশ্বাসের স্বরে বললেন, ‘প্রিয়তম, সুবর্ণদর্পণের ন্যায় উজ্জ্বল তোমার অঙ্গে, আমি কিছুমাত্র পরিবর্তন বা ব্যতিক্রম দেখি না। এ সকল তোমার পিতার অভিশাপগ্রস্ত মনের ও চোখের বিকার। আমি এখনও তোমার বুকে আমার প্রতিবিম্বকে দেখতে পাচ্ছি। তুমি এখনও বিশ্বের সকল পুরুষের ঈর্ষণীয় সেই বলিষ্ঠ রূপবান পুরুষই আছ। পিতার অভিশাপ পুত্রের প্রতি স্নেহেরই এক বিপরীত সম্ভাষণ। ব্যাধির আশঙ্কা, গৃহত্যাগের বাসনা তুমি মন থেকে ত্যাগ করো।’

শাম্ব মনে মনে হাসলেন, করুণ আর মর্মান্তিক সেই হাসি। বললেন, ‘লক্ষ্মণা, পিতার অভিশাপ না, বৃষ্ণিসিংহাবতার পুরুষের অপমানিত মর্মাহত অন্তরের অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে আর এক পুরুষের প্রতি। এক্ষেত্রে পিতা পুত্রের সম্পর্কজনিত কপট উষ্মা বা ক্রোধের বিষয় কিছু নেই। তোমাকে তো সব ঘটনাই বললাম। বাসুদেবের মতো ব্যক্তির পৌরুষে যদি আঘাত লাগে, তবে তাঁর সংহারমূর্তি কী ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, তুমি কল্পনা করতে পারো! অন্য পুরুষের তো কোনও কথাই নেই। তা ছাড়া, তুমি আমার মনের ও চোখের যে-বিকারের কথা ভাবছ, তা সত্যি না। পিতা কখনও মিথ্যা বলতে পারেন না। আমি কখনওই নিজেকে দেখতে ভুল করিনি। বিকার বা মায়া, কিছুই আমাকে গ্রাস করেনি। পিতার ষোলো সহস্র রমণীর প্রমত্ত উৎকট কামতাড়িত আচরণ আমি নিজেই লক্ষ করেছি। বৃষ্ণিসিংহের ক্রোধবহ্নির সম্যক কারণ আমি অনুভব করেছি।’

লক্ষ্মণার আসন্ন স্বামী-বিচ্ছেদ-কাতর প্রাণ কোনও যুক্তি মানতে পারছে না। অশ্রুসজল চোখে, ব্যথায়, অভিমান স্ফুরিত স্বরে বললেন, ‘রতিকোশাস্ত্রবিদ হে দ্বারকামোহন, সেই রমণীদের কামোচ্ছ্বসিত আচরণের অপরাধই বা কী? আমি জানি তুমি কদাচ সেই রমণীদের নিজের রূপের দ্বারা কামোদ্রেক করোনি। কিন্তু সর্বজ্ঞ বৃষ্ণিসিংহ কি জানতেন না, মাতৃগণ ব্যতীত দ্বারকার সকল রমণীকুলের তুমি অতি আকাঙিক্ষত পুরুষ? এই ষোলো হাজার রমণীকে নির্বিচারে গ্রহণের জন্য তিনি নিজেকে অনাচারীজ্ঞানে অতি পুণ্যের স্যমন্তক মণি ধারণ করতে পারেননি। মুষল ও লাঙ্গলধারী দুর্দান্ত যদুবীর বলভদ্রকেও তিনি সেই স্যমন্তক মণি ধারণ করতে দেননি, কারণ বলভদ্রও সর্বদাই সুরাসবপানে প্রমত্ত থাকেন। তবে তোমাকে কেন তিনি কামোচ্ছ্বসিত রমণীদের কারণে অভিশাপ দিলেন?’

শাম্ব গম্ভীর হলেন, বললেন, ‘লক্ষ্মণা, সুলক্ষণা প্রিয়তমে, তোমাকে আগেই বলেছি মহাপুরুষের অভিসম্পাত প্রশ্নের অতীত। তা ছাড়া যদুকুলের কুমারগণ তাঁদের পিতার সমালোচনা শুনতে অভ্যস্ত না। পিতার অভিশাপ অলঙ্ঘনীয়। তিনি আমাকে মুক্তির ইঙ্গিত দিয়েছেন। এখন সেই পথেই আমার যাত্রা।’

লক্ষ্মণা ক্রন্দনোচ্ছ্বসিত স্বরে বললেন, ‘আহ্‌, হায় কী দুর্ভাগ্য আমার, যে-পুরুষের মুহূর্তের দর্শন ছাড়া থাকতে পারি না, যিনি আমাকে হরণ করার সময়ে পিতার বাধা দানের ফলে হস্তিনানগরী ভূমিকম্পে আকুঞ্চিত হয়েছিল, যাঁর কণ্ঠলগ্ন হয়ে ছাড়া দিনযাপন করিনি, তিনি পিতার দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে আজ আমাকে পরিত্যাগ করে যাচ্ছেন।’

শাম্ব লক্ষ্মণাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘লক্ষ্মণা, অভিশাপমুক্ত হয়ে আমি আবার ফিরে আসব।’

রমণীর মন এইসব সান্ত্বনা বাক্যে প্রবোধ মানে না। শাম্বর দেহলগ্ন হয়ে তিনি নানা রূপে নিজের ব্যথা প্রকাশ করতে লাগলেন, জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি নগর প্রাকারের বাইরে কেন যাবে?’

শাম্বর বিশাল বক্ষ দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠল। কিন্তু কাতরতা প্রকাশ না করে বললেন ‘লক্ষ্মণা, ব্যাধি আমাকে পূর্ণরূপে গ্রাস করবার আগেই আমি আমার প্রিয়জনদের লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যেতে চাই।’

লক্ষ্মণা এই কথা শুনে অতি শোকাকুল হলেন। কারণ তিনি এই বলীয়ান রূপবান পুরুষের অন্তরের বেদনা অনুভব করলেন। যিনি নগরের পথে বের হলে রমণীগণ ব্যাকুল হয়ে তাঁকে দেখতে ছুটে আসেন, তিনি কুৎসিত বিকলাঙ্গ দেহ নিয়ে কেমন করে সেই নগরী মধ্যে বাস করবেন? তখন লক্ষ্মণা স্বামী সান্নিধ্যে বসনভূষণ পরিত্যাগ করে, যুগপৎ কান্না ও আবেগকম্পিত স্বরে বললেন, ‘হে পরম সুন্দর মহাভুজ রমণীবিশারদ, এই দারুণ দুঃখেও আমি অতিপ্রার্থিনী হয়ে তোমাকে কামনা করছি। তোমার দুই বিশাল বাহু ও বক্ষ ও তেজ দ্বারা আমাকে মর্দিত করো।’

শাম্ব শান্ত ও অবিকৃতভাবে লক্ষণাকে আপন অঙ্গে গ্রহণ করলেন। কিন্তু মনে মনে বললেন, ‘হায় অভিশাপ! কুরুকুলের এই অবিস্মরণীয় রমণীরত্নের সঙ্গে সঙ্গম প্রমোদেও কোনও সুখানুভূতির লেশ নেই। জীবনপ্রবাহ কি আশ্চর্য স্বপ্নবৎ! যে-আত্মা অতি দুর্জ্ঞেয়, সেই আত্মানুসন্ধানেই জীবনকে আহরণ করতে হয়। আমার সমগ্র ধারণা এখন এই ধারণার বশবর্তী।…’

শাম্বর নগর প্রকারের বাইরে সকলের চোখের অন্তরালে সমুদ্রোপকূলবর্তী বালুবেলায়, বৎসরান্ত বাসের আগেই, পিতার অভিশাপ এবং ভবিতব্য সমগ্র দেহে অতি উৎকটরূপে প্রকটিত হল। তিনি দিনের আলোয় সচরাচর বালুবেলায় আত্মপ্রকাশ করতেন না। উপকূলবর্তী পর্বতের গুহান্দকরে দিনযাপন করতেন। পর্বতের বুকে, আশেপাশের বৃক্ষে ও ভগ্নপ্রস্তর মৃত্তিকায় যে সমস্ত ফলমূলাদি সংগ্রহ করতে পারতেন তা দিয়েই ক্ষুন্নিবৃত্তি করতেন। পর্বতের ক্ষীণ প্রস্রবণধারায় যে মিষ্ট জল পেতেন, তা দিয়ে তৃষ্ণা মেটাতেন।

নগররক্ষীরা যখন অশ্বচালনা করে, নগরের বাইরে টহল দিতে বেরোত, শাম্ব কখনওই তাদের সামনে যেতেন না। সূর্যাস্তের পর তিনি যখন বালুবেলায় বেরিয়ে আসতেন তখন নগর দ্বারপালদের ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেতেন। তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠত, রৈবতক পর্বত নগরীর আলোকমালা। নাগরীদের গুঞ্জন ও হাসি, নাগর পুরুষদের দেখে, চোখের ঝিলিক হানা নানা প্রকারের অঙ্গভঙ্গি। সুরাসবপানে সুখী ও প্রমত্ত রাজপুরুষগণের নাগরী পণ্যাঙ্গনাদের অতি রুচিশীল সংগীত ও নৃত্য মুখরিত অঙ্গনে গমন। প্রবাসী ইন্দ্রপ্রস্থবাসী বা পাঞ্চালের অধিবাসীরা বা অন্যান্য দেশের নাগরিকগণ, দ্বারকানগরীর নৈশ প্রমোদ ভ্রমণে বেরিয়েছেন। গৃহে গৃহে মন্দিরে মন্দিরে, মঙ্গল শঙ্খ ও ঘণ্টা বাজছে। শাম্ব শুনতে পেতেন সবই। দূরের অন্ধকার বালুবেলা থেকে দেখতে পেতেন না কিছুই। কিন্তু সবই তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠত।

শাম্বর নিজের গৃহাঙ্গনে ও অন্তঃপুরের কী অবস্থা? তিনি নির্বিকার থাকবার চেষ্টা করলেও সমুদ্রের জোয়ার ভাঁটার মতোই সে-সব বিষয় তাঁর অন্তর মধ্যে তরঙ্গায়িত হত। তাঁর গৃহাঙ্গনে ও অন্তঃপুরে আলো জ্বলছে তো? রমণীর প্রতি রাত্রের মতোই সুখে বিচরণ করছে তো? লক্ষণা অন্ধকারে মুখ ঢেকে বসে নেই তো? মাতৃগণ মনোকষ্টে নেই তো? পিতা বিচলিত ও বিমর্ষ হয়ে নেই তো? ভ্রাতা ও বন্ধুগণ তাঁর অদর্শনে ভগ্নমনোরথ হয়ে নেই তো?

এইভাবে বৎসর পূর্তির পূর্বেই শাম্বর দেহ কুষ্ঠরোগের গ্রাসে অতি কুৎসিত ও বিকলাঙ্গ রূপ ধারণ করল। পিতার নির্দেশ তাঁর মনে পড়ল। মহর্ষি নারদের কাছে তাঁকে যেতে হবে। তাঁর কাছে যাবার সময় হয়েছে। তিনিই ব্যাধি মুক্তির উপায় বলে দেবেন। কিন্তু তিনি এখন কোথায়? শাম্ব তাঁকে কোথায় পাবেন? মহর্ষি সর্বব্যাপী। ঋষিগণসহ নানা বর্ষগুলোতে পরিভ্রমণ করে বেড়ান। অথচ তাঁকে না পেলে চলবে না। তাঁর প্রতি অসঙ্গত আচরণের মূলেই নিহিত রয়েছে এই অভিশাপের কারণ। সেইজন্য হয়তো পিতা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুক্তির উপায় জানতে বলেছেন।

শাম্বর সহসা মনে হল, পিতার কাছে যাওয়া উচিত। একমাত্র তিনিই হয়তো বলতে পারেন মহর্ষি এখন কোথায় অবস্থান করছেন। রাত্রে তিনি এই কথা ভাবলেন এবং পরের দিন প্রভাতেই নগর দ্বার উন্মুক্ত হবার পরে নগরের উদ্দেশে গমন করলেন। না, এখন আর শাম্বকে দেখে কেউ যদুবংশের সেই রূপবান যুদ্ধবিশারদ পুরুষকে চিনতে পারবে না। নগর ও দ্বাররক্ষীরা সহজেই অনুমান করে নেবে, তিনিও একজন ব্যাধিগ্রস্ত অসহায় ভিক্ষার্থী। ভিক্ষা শেষে যথাসময়ে নগরের বাইরে নিজের আশ্রয়ে চলে যাবেন।

শাম্ব ভুল ভাবেননি। দ্বাররক্ষীরা তাঁর দিকে কৃপাদৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেদের বিশাল গুল্ফে মোচড় দিল। কেউ তাঁকে বাধা দিল না। নানা কার্যব্যপদেশে, নগরের অধিবাসীর পথে ভিড় করে, নানা কথায় মুখরিত করে চলেছেন। কেউ শাম্বর কুষ্ঠ কুৎসিত চেহারার দিকে ফিরেও তাকালেন না। বরং কেউ কেউ যুগপৎ ঘৃণা ও কৃপাবশে, তাঁর প্রতি দূর থেকে মুদ্রাদি নিক্ষেপ করলেন এবং শাম্বকে তা সাগ্রহে সংগ্রহ না করতে দেখে তাঁর মস্তিষ্কের সুস্থতা বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন।

শাম্ব দ্রুত গতিতে পথ অতিক্রম করে রৈবতকে কুশস্থলীতে গমন করলেন। বিভিন্ন স্থানে চারুদেষ্ণ, প্রদ্যুম্ন, সাত্যকি ইতাদি ইত্যাদি যাদবশ্রেষ্ঠগণকে দেখতে পেলেন। তাঁরা কেউ তাঁকে চিনতে পারলেন না, তাঁর প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টিপাতও করলেন না। সৌভাগ্যবশত তিনি সেই অনায়াসেই বাসুদেবের সাক্ষাৎ পেলেন, এবং অধিকতর সৌভাগ্যের বিষয়, তিনি দৃষ্টিপাতমাত্র পুত্রকে চিনতে পারলেন। তাঁর অভিশাপের জাজ্বল্যমান প্রমাণ স্বরূপ কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত মূর্তি দেখে কৃষ্ণ মুহূর্ত মধ্যে অত্যন্ত বিচলিত ও বিষণ্ণ হলেন। সেই মুহূর্তে গান্ধারীর অভিশাপের কথা তাঁর মনে পড়ল। গান্ধারী শোকে ও মনস্তাপে অতীত বিস্মৃত হয়েছিলেন। যুদ্ধের পূর্বে তাঁর পুত্রের আস্ফালন, যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলা, কৃষ্ণের বহু অনুরোধ, যুদ্ধজনিত জ্ঞাতি ও লোকক্ষয় বিষয়ে কৃষ্ণের সাবধানবাণী, শান্তি ও সম্প্রীতি বিষয়ে কৃষ্ণের দৌত্য সে-সবই তখন শোকাকুলা গান্ধারী বিস্মৃত হয়ে কৃষ্ণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। কৃষ্ণ জানতেন, কালের অমোঘ নিয়মে যা অনিবার্য গান্ধারী অভিশাপ দিতে গিয়ে সে-কথাই উচ্চারণ করেছিলেন। কৃষ্ণের প্রতি তা কখনওই অভিশাপরূপে বর্ষিত হয়নি।

কিন্তু এখন কৃষ্ণ নিজ মুখে উচ্চারিত অভিশাপেরই পরিণতি, কুষ্ঠ জর্জরিত আত্মজকে দেখে মর্মান্তিক বেদনা অনুভব করলেন। তিনি শাম্বকে নিয়ে কুশস্থলীর এক কক্ষে দ্রুত গমন করলেন। শাম্ব পিতাকে যথাবিহিত প্রণাম ও পাদ্যার্ঘ্য প্রদান করে বললেন, ‘পিতা, আপনার মনে কোনও প্রকার দুঃখ সঞ্চার করতে বা আপনাকে বিচলিত করতে আমি আসিনি। আপনার অভিশাপে আমার সর্বাঙ্গে ব্যাধি। আপনি বলেছিলেন, আরোগ্যলাভের উপায় একমাত্র মহর্ষি নারদ আমাকে বলতে পারবেন। কিন্তু তিনি এখন কোথায় আছেন, আমি জানি না। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই।’

কৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ আশ্চর্য ও চমৎকৃত হয়ে বললেন, ‘শাম্ব, এ বিচিত্র যোগাযোগ! মহর্ষি আজই দ্বারকায় এসে আমার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। তাঁকে আমি এখনই তোমার সংবাদ দিচ্ছি, তুমি অপেক্ষা করো।’

শাম্বও মনে মনে বিস্ময় ও স্বস্তি বোধ করলেন। ললেন, ‘এ আমার এক পরম সৌভাগ্য!’

কৃষ্ণ কক্ষত্যাগ করে দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হলেন এবং ক্ষণপরেই মহর্ষি নারদসহ, সেখানে আবার উপস্থিত হলেন। মহর্ষি নারদকে দেখে শাম্ব এগিয়ে এসে কষ্টের সঙ্গে নতজানু হয়ে তাঁকে প্রণাম করলেন। মহর্ষি আশীর্বাণী ও স্বস্তিবচন উচ্চারণ করে, কৃষ্ণের দিকে ফিরে বললেন, ‘আমি শাম্বর ব্যাধিমুক্তি বিষয়ে আলোচনা করব।’

কৃষ্ণ মহর্ষির ইঙ্গিত উপলব্ধি করে সে-স্থান ত্যাগ করলেন। মহর্ষি শাম্বকে বললেন, ‘বসো, আমি তোমাকে এক স্থানের কথা বলব।’

মহর্ষি অগ্রে আসন গ্রহণ করলেন। শাম্ব অদূরে উপবেশন করলেন। বললেন, ‘হে পরমপূজনীয় মহর্ষি, আমার বিষয়ে আপনার অজ্ঞাত কিছুই নেই। নিতান্ত চপলতাবশত আমি আপনার প্রতি অবহেলা প্রকাশ করেছিলাম, কিন্তু আপনি অনুমান করতে পারেন, যদুবংশের পুত্র হয়ে আমি কখনওই ইচ্ছাকৃতভাবে তা করিনি। এখন যা অনিবার্য তাই ঘটেছে। পিতার দ্বারা আমি অভিশপ্ত হয়ে কুৎসিত ব্যাধিতে আক্রান্ত। আপনি তুষ্ট হন, আমার প্রতি প্রসন্ন হন। আপনি সুরলোক, অসুরলোক, গন্ধর্বলোক অন্তরীক্ষ যাবতীয় লোকে গমনাগমন করে থাকেন। আপনার অভিজ্ঞতা সীমাহীন। আপনি আমাকে অনুগ্রহ করে উপদেশ দিন এখন আমার কী কর্তব্য? পিতা বলেছেন, আপনি আমার আরোগ্যলাভের উপায় বলে দিতে পারেন।’

মহর্ষি শাম্বর কথা শুনলেন, তারপরে সম্বোধন করলেন, ‘হে বৃষ্ণিব্যাঘ্র! তোমার প্রতি আমার পরম সন্তোষ জ্ঞাপন করছি।’

মহর্ষির মুখে ‘বৃষ্ণিব্যাঘ্র’ সম্বোধন শুনে, শাম্বর প্রাণের মধ্যে অতি ব্যথাতুর একটি আনন্দানুভূতি হল। মনে হল, এখনই তাঁর পুচ্ছহীন রক্তগর্ভ চোখ জলপূর্ণ হয়ে উঠবে। তিনি হৃদয়ের আবেগকে দমন করে মহর্ষির উদ্দেশে প্রণাম জানালেন।

মহর্ষি আবার বললেন, ‘আমি জানি, তোমাকে অতি কষ্টের মধ্য দিয়ে কাল যাপন করতে হবে। কিন্তু তার কিছুই বৃথা যাবে না। এবার মন দিয়ে শোনো। আমি একদা একবার সূর্যলোকে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছি, সূর্যদেবকে দেবতারা বেষ্টন করে আছেন। দেবতা, যক্ষ, গন্ধর্ব এবং অপ্সরাবৃন্দ তাঁর চারপাশে অবস্থান করছেন। ঋষিগণ সেখানে বেদপাঠ করছেন এবং সূর্যের স্তব করছেন, পূজিত হচ্ছেন ত্রিসন্ধ্যা দ্বারা। সেখানে সূর্যকে ঘিরে রয়েছেন আদিত্যগণ, বসুগণ, মারুতগণ, অশ্বিনীগণ। তাঁর পার্শ্বেই রয়েছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র তাঁর দুই পত্নী রজনী ও নিক্ষুভা। রয়েছেন পিঙ্গলা, যিনি সদাসর্বদা মঙ্গল অমঙ্গল বিষয়ে লিখে চলেছেন। দ্বারপাল রূপে রয়েছেন দণ্ডনায়ক, রজনা, স্তোশা, কালমাস এবং পক্ষী। কথুশৃঙ্গে রয়েছেন ভিওমন এবং নগ্নদিণ্ডি।’

শাম্ব স্তব্ধ বিস্ময়ে মহর্ষির মুখ থেকে এই বর্ণনা শুনলেন। মহর্ষি আবার বললেন, ‘ইনি একমাত্র অনাবৃত দর্শিত ঈশ্বর, যিনি সকল দেবতা ও পিতৃগণেরও ঊর্ধ্বে। ইনিই সকল শক্তির উৎস। ইনি বিশ্বের রক্ষাকর্তা ও নিয়ন্তা, ইনিই স্রষ্টা ও সময়ে ধবংসকারী। তোমার একমাত্র পূজ্য দেবতা এই সূর্য। ইনি সমস্ত অমঙ্গল ও ব্যাধিকে ধ্বংস করেন, সেইজন্য সকল দেবতাগণ তাঁকে মান্য করেন। তুমি সেই সূর্যলোকে যাও।’

শাম্ব বিনীত নম্রস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কখনও এই সূর্যলোকের কথা শুনিনি। আপনার অশেষ করুণা, আপনি আমাকে শোনালেন। কিন্তু কোথায় এই সূর্যলোকের অবস্থান, আমি তাও জানি না। আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে পথের সন্ধান দিন, আমি যে-কোনও প্রকার নিগ্রহ সহ্য করে তাঁর করুণাভিক্ষা করতে সেখানে যাব।’

মহর্ষি বললেন, ‘যথার্থ বলেছ, তুমি এখান থেকে উত্তর সমুদ্রতীরে গিয়ে, উত্তর পূর্বে গমন করো। তুমি যাবে মহানদী চন্দ্রভাগা তীরে, সেখানে মিত্রবনে সূর্যক্ষেত্র বর্তমান। সেখানে তিনি পরমাত্মারূপে অত্যুজ্জ্বল পুরুষ রূপ নিয়ে রয়েছেন। তুমি সেইখানে গমন করো।’ এই কথা বলে, মহর্ষি গাত্রোত্থান করে আবার বললেন, ‘কোনও কারণে কোনও সংকটে পড়লে, তুমি আমার সন্ধান কোরো, আমি তোমার সংকটমোচনের উপায় বলব।’

শাম্ব করজোড়ে নতজানু হয়ে আবার মহর্ষির পদধূলি গ্রহণ করলেন। মহর্ষি চলে যাবার কিছু পরেই কৃষ্ণ এলেন। মহর্ষি শাম্বকে কোনও কথা পিতাকে বলতেই নিষেধ করেননি। অতএব তিনি মহর্ষি বর্ণিত মহানদী চন্দ্রভাগা তীরে সূর্যক্ষেত্র মিত্রবনের কথা পিতাকে বললেন, এবং তখনই যাত্রা করার জন্য পিতার অনুমতি চাইলেন।

কৃষ্ণ বললেন, ‘একমাত্র মহর্ষিই এ বিষয়ে অবগত আছেন। চন্দ্রভাগা মহানদী দেবলোক থেকে অতি বেগে প্রবাহিত হচ্ছে, আমি জানি। কিন্তু সূর্যক্ষেত্র মিত্রবনের সন্ধান আমার জানা নেই।’

শাম্ব বললেন, ‘মহর্ষি আমাকে পথের নির্দেশ দিয়েছেন। যথাস্থানে পৌঁছুতে আমার কতদিন লাগবে, তা আমি জানি না। অতএব যত শীঘ্র সম্ভব, আমি যাত্রা করতে ইচ্ছুক। আপনি আমাকে বিদায় দিন।’ এই বলে তিনি নতজানু হয়ে পিতার পদযুগল স্পর্শ করে মাথায় ঠেকালেন।

পুরুষোত্তমের অন্তর বিচলিত হল। তিনি তাঁর ঔরসজাত সেই অত্যুজ্জ্বল রূপবান বংশধরের দিকে করুণ চোখে তাকালেন। দেখলেন, তাঁর নাসিকা মধ্যস্থল দুই গিরিশৃঙ্গের ন্যায় ভগ্ন। তাঁর ভ্রূযুগল কেশহীন, সমস্ত মুখমণ্ডল মলিন কালিমালিপ্ত এবং তাম্ৰাভ, কোথাও রক্তাভ শুষ্ক ঘা এবং অতি পলিত। বিশাল চক্ষুদ্বয়ের কৃষ্ণপুচ্ছ। সকল পতিত হয়েছে, ফলে চোখ অতি রক্তাভ দগদগে দেখাচ্ছে। তাঁর সমগ্র দেহের চর্ম স্ফীত, বিবর্ণ, হাত পা বিকলাঙ্গের ন্যায়। কেবলমাত্র চোখের দৃষ্টি অতি করুণ অসহায়। কৃষ্ণ বললেন, ‘এই দূর পথের যাত্রায় তুমি কী কী গ্রহণযোগ্য মনে করো।’

শাম্ব বললেন, ‘কিছুই না। আমি অভিশপ্ত, মুক্তির সন্ধান ছাড়া কিছুই আমার গ্রহণীয় না।’

কৃষ্ণ বললেন, ‘এত দূরবর্তী পথ তুমি অশ্বচালিত রথ অথবা অশ্বারোহণ ব্যতিরেকে কেমন করে যাবে? ক্ষুধা তৃষ্ণা ছাড়াও পথ চলতে আরও নানা রকমের প্রয়োজন থাকে।’

শাম্ব বিষণ্ণ হেসে বললেন, ‘এখন আর আমার সে-সবে কোনও প্রয়োজন নেই। কবচ কুণ্ডল অঙ্গুরীয়াদি সবই আমি খুলে রেখেছি। সর্বাঙ্গে জড়াবার বস্ত্র আমার আছে। এমনকী পাদুকাও আমি ত্যাগ করেছি, কারণ পাদুকা পায়ে চলতে পারি না। আমার এই বিকট মূর্তি নিয়ে এখন রথারোহণ, গ্রাম জনপদে বিস্ময় ও অবিশ্বাস উৎপাদন করবে। অশ্বারোহণে গেলে, লোকে আমাকে নানাপ্রকার ব্যঙ্গবিদ্রূপ করবে। এখন আমাকে ও-সবে খুবই বেমানান লাগবে। সপারিষদ অথবা সৈন্যসামন্তসহ আমি যেতে পারি না। আমার এ-যাত্রা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ব্যাধিগ্রস্ত হতদরিদ্র লোকেরা যেমন অন্যান্যদের সাহায্যে বা কৃপায় গ্রামজনপদে গমনাগমন করে থাকে, আমাকেও সেইভাবেই যেতে হবে। ক্ষুধা তৃষ্ণা? ভাববেন না। গাছে বা মাটিতে ফলমূলের অভাব হবে না। তৃষ্ণার জলও নদনদী জলাশয় প্রস্রবণ থেকে সংগ্রহ করতে পারব। আপনি কোনওরকম দুশ্চিন্তা করবেন না।’ শাম্ব পিতার সামনে আর উচ্চারণ করবেন না: তিনি একজন অভিশপ্ত মানুষ। পূর্ব জীবনের সঙ্গে এখন তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি আর এখন যদুবংশের রূপবান কুমার নেই। গ্রামজনপদের ভিক্ষান্নে তিনি দিন যাপন করতে পারবেন।

কৃষ্ণ নিজেও যে সে-কথা বোঝেন না, এমন নয়। তবু আত্মজর কথা শুনে, কয়েক মুহূর্ত নির্বাক হয়ে রইলেন। তারপরে বললেন, ‘তোমার গর্ভধারিণীর সঙ্গে দেখা করবে না?’

শাম্বর চোখের সামনে মাতৃমূর্তি জাম্ববতী ভেসে উঠলেন। পুত্র দর্শনে তাঁর খুশি মুখের আকস্মিক আহত আঘাতপ্রাপ্ত অভিব্যক্তি যেন শাম্ব দেখতে পেলেন। বললেন, ‘আমি আপনার কাছ থেকেই অনুমতি নিয়ে যাত্রা করছি। মাতৃগণকে আপনিই সমস্ত বৃত্তান্ত বলবেন, আমার প্রণাম জানাবেন। আপনি আমাকে যাত্রার অনুমতি দিন।’

কৃষ্ণ বললেন, ‘এসো। তোমার যাত্রা সফল হোক।’

শাম্ব আর একবার পিতার পদধূলি নিয়ে যাত্রা করলেন। লক্ষ্মণার কথা কি তাঁর মনে পড়ছে না? তাঁর নিজের অন্তঃপুর, বিলাস সামগ্রীতে সাজানো গৃহের সৌন্দর্য, রমণীরত্নাদি, যাদের সঙ্গে নানা ক্রীড়া কৌতুকে, ভোগে বিলাসে দিনগুলো কেটে যেত, সে-সব কিছুই কি তাঁর মনে পড়ছে না? কোনও মানুষের পক্ষেই সে-সব ভোলা সম্ভব না। কিন্তু অভিশাপমুক্ত না হয়ে শাম্ব আর সেখানে তাদের সামনে যাবেন না। শাম্বকে দেখলে এখন তাদের দৃষ্টি আহত, বিস্ময়ে ও ঘৃণায় কুঞ্চিত হবে। চিত্তবিকার ঘটবে। লক্ষ্মণারও কি একই অবস্থা হবে না?

শাম্ব কোনও দিকে দৃষ্টিপাত না করে দ্রুত নগরীর পথে বেরিয়ে পড়লেন। রৌদ্রকরোজ্জ্বল নগরীর পথে পথে নগরবাসীরা চলাচল করছে। যদুবংশের বালক এবং কুমারগণ অশ্বারোহণে নানাদিকে ভ্রমণ করছে। নগররক্ষীদের এই শান্তির সময়ে তেমন ব্যস্ততা নেই। নানা শ্রেণীর শ্রমজীবী ও অন্যান্যদের সঙ্গে ওরাও, পথিমধ্যে শুণ্ডিণীর ভাণ্ডারের সামনে মক্ষিকার ন্যায় জড়ো হয়েছে। সকলের দৃষ্টি যে কেবল শুণ্ডিণীর পৈষ্ঠী ও মাধ্বীপূর্ণ পাত্রের দিকে, এমন বলা যায় না। রসিকা যুবতী শুণ্ডিণীর প্রতিও অনেকের লক্ষ্য। তার অবিশ্যি কেউ পর না, সবাই আপন। সে সবাইকেই তার হাসির দ্বারা আপ্যায়ন করছে, সবাইকেই দৃষ্টির ঝলক হানছে, এবং সবাইকেই তার সুঠাম অঙ্গের নানা ভঙ্গি দ্বারা জানিয়ে দিচ্ছে, তার তৈরি সুরাপানে সকলেই কেমন উল্লাস বোধ করে থাকে।

শাম্ব নগরীর প্রাসাদসমূহের অলিন্দে ও গবাক্ষে রমণীদের কারওকে অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। যদুবংশের কুমারগণকে কেউ কেউ কৌতুকের সঙ্গে লক্ষ করছে এবং একে অপরকে অঙ্গুলিদ্বারা বিশেষ কারওকে দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে হাস্য পরিহাস করছে। শাম্বকে তারা কেউ চিনতে পারছে না। একজন কুষ্ঠরোগীর প্রতি তাকিয়ে, কেউ তার দৃষ্টিকে অকারণ বিঘ্নিত করতে চায় না।

শাম্ব অকারণ অতীতের কথা ভেবে, মনস্তাপ ভোগ করতে চান না। কারণ সে-মনস্তাপের কোনও মূল্য নেই। তিনি দ্বারকার নানা পথ দিয়ে, পূর্বদিকের প্রধান দ্বারের দিকে এগিয়ে চললেন। যদিও আগের মতো স্বাভাবিক দ্রুতগতিতে চলতে তিনি আর সক্ষম নন। তাঁর সর্বাঙ্গের বহিরঙ্গ এখন প্রায় সম্পূর্ণ অসাড়। হাত ও পায়ের গ্রন্থিসমূহে রক্তাভ ক্ষত ও স্ফীতির জন্য পদক্ষেপ সহজ নেই। সহসা দ্রুতগতি অশ্বচালিত রথ অথবা কোনও অশ্বারোহী দ্রুতবেগে ছুটে এলে, তিনি অনায়াসে পথের পাশে ছিটকে চলে যেতে পারেন না। স্বভাবতই রথারোহী ও অশ্বারূঢ় বিরক্ত হন। এই নগরীর পথও সর্বত্র মোটেই সমতল না। সমুদ্রমধ্যে পার্বত্যদ্বীপ বিশিষ্ট এই ভূমির অধিকাংশ রাজপথই চড়াই উতরাইয়ে বন্ধুর।

শাম্ব মনে মনে পুণ্যভূমি মিত্রবনের কল্পনা করতে করতে, ব্যাধির দুঃখ কষ্ট ভোলবার চেষ্টা করতে লাগলেন। প্রায় দ্বিপ্রহর অতিক্রান্ত করে তিনি নগরীর পূর্ব দ্বারে পৌঁছুলেন। এই সময়ে যদুবংশের কুল-রমণীগণ সর্বালংকার শোভিতা হয়ে সহচরীদের সঙ্গে কোনও পূজা সাঙ্গ করে ফিরছিলেন। উপবাসক্লিষ্ট হলেও পূজাশেষে তাঁদের মন প্রফুল্ল ছিল। তাঁরা দরিদ্র ও প্রার্থীদের পথে ফল ও মিষ্টান্ন বিতরণ করতে করতে যাচ্ছিলেন। শাম্বও ক্ষুধার্ত ছিলেন। তিনি হাত না পেতে পারলেন না। পূজারিণীরা তাঁকে বিমুখ করলেন না, কিন্তু তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাতে সকলেই আকুঞ্চিত মুখে শিহরিত হচ্ছিলেন। স্পর্শের আশঙ্কায় দূর থেকে মিষ্টান্ন নিক্ষেপ করছিলেন।

শাম্ব দুঃখ ও মনস্তাপ থেকে নিজেকে নির্বিকার রাখলেন। মনে মনে কেবল উচ্চারণ করলেন, “আমি অভিশপ্ত।” তিনি পূজারিণীদের আচরণে কোনও দোষ খুঁজে পেলেন না। এরকম না ঘটলেই তিনি বরং অবাক হতেন। তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ আত্মজিজ্ঞাসার দ্বারা, জবাব পাচ্ছেন, তাঁর দৃষ্টি ও মন এইসব রমণীদের তুলনায় উদার ছিল না। অতীতে সুস্থাবস্থায় কুষ্ঠরোগীর বীভৎস চেহারা দেখে, তাঁর মনেও বিকার ঘটত, দৃষ্টি আহত ঘৃণায় শিহরিত হত এবং সংস্পর্শ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতেন।

শাম্ব ফল ও মিষ্টান্ন খেয়ে, পথের ধারে জলাশয়ে সকলের কাছ থেকে দূরে জলপান করলেন। সাধারণের জন্য নির্দিষ্ট নৌকায় আরোহণ করে, মূল ভূখণ্ডে পৌঁছুলেন। অবিশ্যি সাধারণের জন্য নির্দিষ্ট নৌকোয়ও তাঁকে যাত্রীদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হল। স্বভাবতই তাঁর মতো একজন ব্যাধিগ্রস্তের কাছ থেকে খেয়া-পারানির অর্থ কেউ দাবি করেনি।

মূল ভূখণ্ডে পৌঁছুতে অপরাহ্ন হয়ে গেল। যাত্রীরা দলবদ্ধ হয়ে যে-যার পথে চলে গেল। শাম্ব সমুদ্রের তীর ধরে উত্তর দিকে চলতে লাগলেন। কোন সীমানা থেকে পূর্ব-উত্তরে গমন করতে হবে, মহর্ষি নারদ স্থির করে তা বলে দেননি। অধিক উত্তরে সিন্ধুদেশ কুবলয়াশ্ব বংশধরদের রাজত্ব। ভূমিকম্পপ্রবণ সেই দেশে ঋষি উতঙ্কের আশ্রম ছিল। শাম্ব অনুমান করলেন, সমুদ্রতীর ধরে ততোধিক উত্তরে তাঁকে যেতে হবে না।

আকাশ ক্রমে রক্তাভ হল, এবং অতি দ্রুত সেই রক্তাভায় কৃষ্ণছায়া ছড়িয়ে পড়ে, সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে লাগল। বহু দূর দিগন্ত পর্যন্ত বালুকারাশি এখনও তপ্ত। শাম্বর অশক্ত পদযুগল প্রতি পদক্ষেপেই সেই তপ্ত বালুতে ডুবে যাচ্ছে। গতি হয়ে উঠছে মন্থরতর। সমুদ্র সর্বদাই গর্জমান, বহু দূর পর্যন্ত তরঙ্গরাশি উৎক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে আসছে, আবার বেগে নেমে যাচ্ছে। সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে নামতেই সমুদ্রের বুক থেকে অতিবেগে বায়ু উত্থিত হল। সমুদ্রের গর্জনের প্রচণ্ডতার সঙ্গে বালুকারাশি উড়তে লাগল। চোখ খুলে রাখা দায় হল। সারা গায়ে অজস্র তীক্ষ্ণমুখ সুঁচের মতো বালুকা বৃষ্টি হতে লাগল। নাসারন্ধ্রের ভিতর দিয়ে, বালুকণা গলনালী ও মুখের মধ্যে ঢুকে গেল।

শাম্ব দেখলেন, পাহাড়ের মতো বালুকারাশি ও সমুদ্রতীরে তিনি একলা। এতক্ষণ যাত্রীরা যারা তাঁর কাছাকাছি চলছিল, তারা ভিন্ন পথে নিকটবর্তী কোনও গ্রামে চলে গিয়েছে। তিনি দেখলেন, এক শ্রেণীর অনতিদীর্ঘ সাপ অনায়াসেই বালুরাশি ঠেলে চলে যাচ্ছে। তিনি জানেন, এই সাপ অতি বিষাক্ত, কিন্তু সর্বদাই উদ্যত আক্রমণশীল না। শাম্ব এই প্রথম অনুভব করলেন, তিনি নিরস্ত্র। কোনও মানুষ বা শ্বাপদের দ্বারা আক্রান্ত হলে, তিনি কিছুই করতে পারবেন না। একমাত্র আশা, মানুষ তাঁকে কিছু করবে না। তাঁর কাছে এমন কিছুই নেই, যা দস্যু বা তস্করেরা লুণ্ঠন করতে পারে। কিন্তু কোনও শ্বাপদ সরীসৃপ তাঁকে শত্রুজ্ঞানে আক্রমণ করলে তিনি নিরুপায়।

বাতাস যেন হাজার বেগবান অশ্বচালিত হয়ে ছুটে আসছে, বিশাল বালুবেলায় দাপাদাপি করছে। অথচ আকাশে মেঘ নেই। সূর্যাস্তের পরেই নক্ষত্ররাজি ঝিকিমিকি করে উঠেছে। এই বাতাসের বেগ দেখলে, মনে হয় পৃথিবীও যেন অতিবেগে ঘূর্ণিত হচ্ছে। বালুকারাশির স্তুপ আশ্চর্য শব্দে ফেটে যাচ্ছে, এবং সেই ফাটলের গহ্বর দিয়ে, বাতাস সাপের মতো এঁকে বেঁকে, সোঁ সোঁ শব্দে ছুটে চলেছে। অন্ধকারে সমুদ্রের তরঙ্গে তীক্ষ্ণ ধারালো ঝকঝকে দাঁতের হাসি খলখলিয়ে বাজছে।

‘হে অভিশপ্ত, কোনও দিকে দৃকপাত কোরো না।’ শাম্ব মনে মনে উচ্চারণ করলেন, এবং চলতে লাগলেন। সমুদ্র, বায়ুর তাণ্ডব, কোনও কিছুই তাঁর অধীন না। অতএব প্রাকৃতিক দুর্যোগকে অনিবার্য জেনে, নিজের কর্ম করাই শ্রেয়। এই সময়েই, পূর্ব দিগন্তে এক ফালি তাম্রাভ চাঁদ দেখা গেল। আর শাম্ব মাছের আঁশটে গন্ধ পেলেন। গন্ধ পাওয়ামাত্র তিনি দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে সমুদ্রতীরের চারদিকে লক্ষ করলেন। এবং যা আশা করেছিলেন, তা দেখতে পেলেন। তাম্রাভ চাঁদের ম্লান আলোয়, দীর্ঘ ঋজু ঝাড়ালো কতগুলো গাছ, খানিকটা অঞ্চল জুড়ে নারকেল বীথির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। সমুদ্র থেকে কিছুটা পুবে, সেই গাছপালার মধ্যে, কতিপয় কুটিরের অবয়ব ও দু’-একটি আলোর বিন্দু দেখতে পেলেন। মাছের আঁশটে গন্ধের ইঙ্গিতে তিনি ঠিকই অনুমান করেছিলেন, কাছেপিঠেই কোথাও নিশ্চয় ধীবরপল্লি আছে। শাম্ব স্বস্তি বোধ করলেন। এই মহাসমুদ্রের ঝটিকাপ্রবাহিত বিশাল বালুবেলায় তিনি অত্যন্ত একাকী বোধ করছিলেন। তাঁর অন্তরে কোনও ভয় উৎপাদিত হয়নি। অভিশপ্ত মানুষ তার অভিশাপের বোঝা একাই বহন করে। শাপমোচনের প্রয়াসে একাই সংগ্রাম করে। তবু জগৎ সংসারে তাঁর পরিচয়, তিনি মানুষ। মানব জীবধর্মের এই নিয়ম, সংসারের বাইরে একাকী থেকেও সংসারের সীমান্তে দাঁড়িয়ে জীবনের ঘ্রাণ গ্রহণ করে।

শাম্ব ধীবরপল্লির সীমানায় গিয়ে দাঁড়ালেন। ঝড়ো বাতাসের ঝাপটায় গাছপালা যেন আভূমি নত হয়ে পড়ছে। কুটিরগুলো কাঁপছে। কিন্তু ধীবরপল্লির কেউ ভয়ে ভীত না। শিশুরা কুটিরের ভিতরে ঘুমোচ্ছে। রমণী এবং পুরুষরা এখনও ঘরকন্না, জাল সেলাই, গোটানো এবং নানা ক্রীড়া-কৌতুক করছে। ঝড়ো বাতাসকে আড়াল করে কোনও কোনও ধীবর রমণী রান্না করছে। কিন্তু শাম্ব পল্লি মধ্যে প্রবেশ করতেই, তাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটল, শান্তি বিনষ্ট হল। তাঁর সেই অতি বিকট মূর্তি দেখে, অনেকেই ভয়ে ও অস্বস্তিতে উঠে দাঁড়াল। রমণীরা কুটিরে ঘুমন্ত সন্তানদের আড়াল করার জন্য দরজায় দাঁড়াল। গৃহপালিত কুকুরেরা শাম্বকে দূর থেকে চারদিকে ঘিরে প্রচণ্ড চিৎকার জুড়ে দিল।

কুকুরের চিৎকার, ঝড়ে গাছপালার সোঁ সোঁ এবং সমুদ্রের গর্জন, সব মিলিয়ে, একটা তাণ্ডবের মাঝখানে যেন ভূতসহ নরনারী দাঁড়িয়ে রয়েছে। পিঙ্গল আবছা জ্যোৎস্নায়, গাছপালা নরনারীদের ছায়াগুলো কিম্ভূত দেখাচ্ছে। শাম্ব সহজেই অনুমান করতে পারেন, তাঁকে কীরকম দেখাচ্ছে। তিনি ঝড়ের এবং কুকুরের চিৎকার ছাপিয়ে উচ্চ স্বরে বললেন, ‘ভাই বন্ধুগণ, আমি সমুদ্র থেকে উত্থিত কোনও জলচর প্রাণী নই। আমি মানুষ, ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ। ব্যাধিই আমাকে এরকম কুরূপ কুৎসিত করেছে। তোমাদের নারী পুরুষ সবাইকেই বলছি, আমাকে ভয় পেয়ো না। আমার দ্বারা তোমাদের কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।’

শাম্ব দেখলেন, তাঁর কথায় কাজ হল। ধীবর রমণী পুরুষদের চোখ মুখের ভীতির ভাব অনেকটা অপসারিত হল। তারা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল এবং বারে বারে শাম্বর দিকে দেখল। একজন পুরুষ তাদের নিজেদের লোককে স‌ম্বোধন করে বলল, ‘আসলে আমি এই প্রাণীটিকে কোনও নরখাদক রাক্ষস ভেবেছিলাম। কিন্তু এর কথা আমাদের থেকেও ভাল। যেন কোনও উচ্চবংশজাত ব্যক্তির ন্যায় শালীনতাপূর্ণ। রাজরাজড়া বা ঋষিগণ যেভাবে কথা বলেন, এর কথাবার্তা সেইরকম।’

একজন রমণী সন্দিগ্ধ ভয়ে বলল, ‘কিন্তু নরখাদক রাক্ষসেরা অনেকরকম মায়া জানে। কে বলতে পারে এর এরকম কথা মায়া ছাড়া কিছুই না?’

শাম্ব নিজেই রমণীর কথার জবাব দিলেন, ‘তুমি যথার্থ বলেছ, কিন্তু রাক্ষসদের আচার আচরণ বিভিন্ন রূপ হয়। তারা হুংকার ছাড়ে, আবির্ভূত হয়েই তাণ্ডব করে, বাক্যবিনিময়ের কোনও চেষ্টাই করে না। দ্বারকা এখান থেকে খুব বেশি দূরে না। এ অঞ্চলে যদি কোনও রাক্ষসের বাস থাকত, তা হলে বাসুদেব অথবা যদুবংশের কোনও বীর নিশ্চয়ই তাকে হত্যা করতেন, তোমাদের জীবনকে নিরাপদ করতেন। আমি একজন নিতান্ত হতভাগ্য, দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ।’

শাম্বর কথা শুনে, সকলেই যেন অনেকখানি আশ্বস্ত এবং সহজ হল। কয়েকজন কুকুরগুলোকে হাত তুলে প্রহারের ভঙ্গিতে তাড়া করে দূরে সরিয়ে দিল। একজন বর্ষীয়ান রৌদ্রদগ্ধ তাম্রবর্ণ দীর্ঘদেহী পুরুষ জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কোথা থেকে আসছ, কোথায় যাবে?’

শাম্ব বললেন, ‘আমি এখন দ্বারকা থেকে আসছি। পূর্বোত্তরের চন্দ্রভাগা নদীর ধারে মিত্রবনে আমি যাব।’

শাম্ব জানেন, তাঁর পরিচয় দেওয়া বৃথা। তা অবিশ্বাস্য শোনাবে, তেমনি এদের কাছে তাঁর অভিশাপের বিষয় বলাও নিরর্থক। তিনি আবার বললেন, ‘আমি আজ সারা দিনই চলছি। সহসা বাতাস ওঠায়, বালুর ঝড়ে, আমি অত্যন্ত ক্লান্ত আর পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছি। যেখানে আমাকে যেতে হবে, সেই পথ আমার জানা নেই। দিক ঠিক না করে, রাত্রের অন্ধকারে আমি চলতে পারছি না। শুকনো মাছের গন্ধে টের পেলাম, এখানে নিশ্চয়ই কোনও বসতি আছে।’

শাম্বর কথাবার্তার উচ্চারণে ও ভঙ্গিতে সকলেই সহজ হয়ে গেল। তাদের অবিশ্বাস ভয় সন্দেহ দূর হল। সেই ধীবর পুরুষটি বললে, ‘কিন্তু চন্দ্রভাগা নদীই বা কোথায়, মিত্রবনই বা কোথায়?’

শাম্ব বললেন, ‘শুনেছি, সিন্ধুনদের থেকে উৎপন্ন একটি বেগবতী শাখার নাম চন্দ্রভাগা। তারই তীরে কোথাও মিত্রবন আছে। সবই আমাকে খুঁজে নিতে হবে।’ এই পর্যন্ত বলে শাম্ব প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন, ‘আমি আজ তোমাদের পল্লির উপান্তে কোথাও রাত্রিটা শুয়ে কাটিয়ে দেব। এখন এই সমুদ্রকূলের অন্ধকারে কোথাও মিষ্ট জলের সন্ধান করা আমার পক্ষে দুরূহ। আমি তোমাদের কাছে কয়েক গণ্ডূষ পানীয় জল আর কয়েক গ্রাস খাদ্যের প্রত্যাশী।’

ইতোমধ্যে ধীবর রমণী পুরুষরা শাম্বকে দেখিয়ে দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল, তিনি যেরকম কুৎসিত ও বিকলাঙ্গ দেখতে, তাঁর কথাবার্তা মোটেই সেরকম না। তাঁর কথা শুনলে, ধীমান ও শ্রীমান মনে হয়।

বর্ষীয়ান ধীবরটি বলল, ‘তুমি খাদ্য পানীয় সবই পাবে। তুমি এখন বসো। আমরা প্রথমে ভয় পেলেও, এখন আর তা নেই।’

শাম্ব নিশ্চিন্ত হয়ে একটি নারিকেল গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসলেন।

শাম্ব ক্রমাগত এইভাবে দিনের পর দিন চলতে লাগলেন। উত্তর সমুদ্রের তীর ধরে চলতে চলতে এক সময়ে তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি সিন্ধুদেশের অভ্যন্তরে গমন করছেন। একটা নদী অতিক্রম করতে গিয়ে, এক ঋষিতুল্য ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। শাম্ব তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন চন্দ্রভাগা নদীতীরে মিত্রবন কোথায়, তাঁর জানা আছে কি না।

সেই ঋষিতুল্য ব্যক্তি বস্তুতপক্ষে একজন তপস্বীই ছিলেন। তিনি শাম্বকে বলেছিলেন, ‘এই নদী অতিক্রম করা তোমার ঠিক হয়নি। আমি শুনেছি, মিত্রবণ নামে এক সূর্যক্ষেত্র পঞ্চনদীর দেশে আছে। আরও শুনেছি, অন্তরীক্ষের পাদদেশে কোথাও সেই স্থান বর্তমান। তোমার ন্যায় চর্মরোগীরা সেখানে যায় আরোগ্যলাভের জন্য। বস্তুতপক্ষে সেখানে কী আছে, কেমনভাবেই বা চর্মরোগীরা আরোগ্যলাভ করে, আমার কিছুই জানা নেই। তবে আমার মনে হয়, তোমাকে সেই পঞ্চনদীর দেশেই যেতে হবে। তুমি নদী পার না হয়ে, ফিরে যাও।’

তপস্বীর মুখে চর্মরোগের কথা শুনে, শাম্বর মনে আর কোনও সন্দেহ ছিল না, তাঁর গন্তব্য মিত্রবনের কথাই তিনি বলেছেন। শাম্ব অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হয়ে তপস্বীকে প্রণাম করেছিলেন। তপস্বী তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন, ‘তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হোক।’

শাম্ব বহু নদনদী অতিক্রম করে, অরণ্যের ভিতর দিয়ে পাহাড় ডিঙিয়ে পূর্বোত্তর বরাবর চলেছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে তিনি সহনীয় করে তুলেছিলেন। ক্রমেই অশক্ত হয়ে পড়া শরীরকে চালিত করে নিয়ে যাচ্ছেন। অরণ্যমধ্যে শ্বাপদকে ভয় করেননি। কিন্তু গ্রাম ও জনপদের সর্বত্র প্রায়ই তাকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। বয়স্ক নরনারীরা যতখানি ঘৃণা প্রদর্শন করে ততখানি বিতাড়নের দ্বারা নিগ্রহ করে না। কিন্তু গ্রাম জনপদের বালকগণ, সারমেয়কুল সর্বত্র একইরকম। বালকেরা তাঁর গতিভঙ্গির বিকৃতিকেই কেবল অনুকরণ করেনি, প্রস্তরাদি নিক্ষেপ করে তাড়া করেছে। তাদের সঙ্গে সারমেয়কুলও এক মুহূর্ত স্থির হতে দেয়নি।

শাম্ব অতি দুঃখের সময়ে কেবল মনে মনে উচ্চারণ করেছেন, ‘তুমি অভিশপ্ত। শাপমোচনেই তোমার জীবনের মোক্ষলাভ। ভাগ্য অমোঘ। তাকে মেনে নিয়েই, দুর্ভাগ্য থেকে উত্তরণের সন্ধান করতে হয়। আমার কেন এমন দুর্ভাগ্য হল, অপরের কেন হল না, এইরূপ প্রশ্ন বাতুলতামাত্র। নিজের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে অপরের তুলনা করে, আত্মাকে ক্ষুব্ধ করা এবং কষ্ট দেওয়া ছাড়া আর কিছুই লাভ হয় না। নিজের কষ্টের জন্য কারওকে দোষারোপ করাও অবিমৃশ্যকারিতা ছাড়া আর কিছু না। কেন জরা আছে, ব্যাধি আছে, মৃত্যু ঘটে, এইসব নিয়ে মানুষ বিলাপ করে, শোকাকুল হয়। অথচ এ-সবের আক্রমণ থেকে কারওরই রেহাই নেই। বলবীর্যের দ্বারা শত্রু নিধন মানুষের নিরাপত্তা ও শান্তিস্থাপন যেমন ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম, তেমনি ব্যক্তির দুর্ভাগ্যের জন্য, তাকে একাকী সংগ্রাম করতে হয়।’

শাম্ব গ্রামে জনপদে যখনই নিগৃহীত লাঞ্ছিত হয়েছেন, তখনই সহ্য করবার শক্তি সংগ্রহ করেছেন। কখনও কখনও তাঁর চোখ ফেটে জল এসেছে, কিন্তু কদাপি ক্রুদ্ধ হননি। প্রতি-আক্রমণ কিংবা উন্মত্তের ন্যায় আচরণ করেননি। সুখ এবং দুঃখকে একত্রে গ্রথিত করে, সর্বদাই নির্বিকার থেকেছেন। অতীতের কথা বা বর্তমানের কথা ভাবেননি। শুধু ভবিষ্যতের কথাই ভেবেছেন। গন্তব্যের দিকেই এগিয়ে চলেছেন, এবং মহর্ষি কথিত সেই অত্যুজ্জ্বল পুরুষের মূর্তিই কেবল কল্পনা করেছেন।

এইভাবে সাতটি ঋতু অতিক্রমের পরে, তিনি এক আসন্ন সন্ধ্যায় চন্দ্রভাগা তীরে পৌঁছুলেন। নৌকায় যারা নদী পারাপার করছিল, তারা কেউ কেউ নদীটিকে মহানদী বলেও উল্লেখ করছিল। শাম্ব দেখলেন, অতি বেগে পূর্ব-দক্ষিণগামিনী নদীটির বুকে রক্তাভ শার্ঙ্গাস্ত্রের মতো বঙ্কিম স্রোত ঝকঝক করছে এবং শৃঙ্গ দ্বারা প্রস্তুত ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত তিরের মতো এক-একটি তীক্ষ্ণ রেখা ছুটে চলে যাচ্ছে। নদীর তীর বালুকারাশি পূর্ণ না, বরং সবুজ ঘাসে শক্ত মৃত্তিকা আচ্ছাদিত। ঋজু বিশাল মহীরূহসমূহ ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে। যেন নদীকূলে এসে ক্লান্ত পথিকদের আশ্রয়দানের জন্য, আকাশবিদ্ধ বনস্পতিরাজিসমূহ দাঁড়িয়ে আছে। আসন্ন সন্ধ্যার রক্তাভা যেমন নদীর বুকে, তেমনি বনস্পতির শীর্ষে। কাছেপিঠে ঘন বসতি চোখে পড়ে না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু কুটির। নদী থেকে তীরভূমি বেশ উচ্চে। তথাপি, সম্ভবত বর্ষায় এ নদীতে বন্যা হয়, সেইজন্যই তীরে কোনও লোকালয় নেই। অথচ কর্ষিত ক্ষেত্রে ফসল ফলানো হয়েছে।

শাম্ব এই নদী দর্শনমাত্র, তাঁর অন্তরে গভীর আনন্দের সঞ্চার হল। নদীর এপারে ওপারে গমনাগমনকারী প্রতিটি পুরুষকেই তিনি, মনের সামান্যতম সন্দেহও মোচনের জন্য বারে বারে ব্যগ্র স্বরে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, ‘সিন্ধুনদ থেকে উৎপন্ন এই কি সেই চন্দ্রভাগা নদী?’

অনেকের কাছ থেকেই তিনি জবাব পেলেন না। অধিকাংশ লোকই তাঁকে এড়িয়ে গেল, যেন তাঁর প্রশ্নের অর্থ বুঝতেই পারেনি। আসলে তাদের বিরাগ ও বিতৃষ্ণা গোপন থাকছিল না। কেউ কেউ জবাব দিল, ‘কোথা থেকে উৎপন্ন, সেসব জানি না। এই নদীর নাম চন্দ্রভাগা।’

চন্দ্রভাগা! শাম্ব যেন বারে বারেই নামটি শুনতে চাইছিলেন। কিন্তু মিত্রবন কোথায়? নদীর এপারে না, ওপারে? এইটিই পঞ্চনদীর দেশ তো? সন্ধ্যার ছায়া যত ঘন হতে লাগল, খেয়া যাত্রীদের সংখ্যাও দ্রুত স্বল্প হয়ে উঠল। শাম্ব শেষ পর্যন্ত মাঝির শরণাপন্ন হলেন। স্থানীয় অধিবাসী পুরুষ ও স্বল্প সংখ্যক রমণীদের সকলেরই দেহের গঠন দীর্ঘ। আপাতদৃষ্টিতে তাদের চোখে মুখে রুক্ষতা থাকলেও নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় সকলেই বেশ রসিক ও আমুদে। অপরূপ নদীতীরে সুবিমল বাতাসে, তাদের সুখী দেখাচ্ছিল, এবং প্রায়ই প্রাণের স্ফূর্তিতে গান গেয়ে উঠছিল। তাদের গানের ভাষা অনেকটা পৈষ্ঠীপাত্রের গায়ে লেগে থাকা মক্ষিকার মতো, অশ্লীল ও ইতরতাপূর্ণ, কিন্তু নির্দোষ মনে হচ্ছিল। কারণ তারা কোনও ব্যক্তিবিশেষের নামে কিছু বলছিল না, নিজেদের কামোচ্ছ্বাসকে ব্যক্ত করছিল, এবং গান শুনে সকলেই হইহই করে হেসে উঠছিল।

শাম্বকে দেখেই মাঝির ভ্রূযুগল কুঞ্চিত হল, চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠায়, দাড়ি কুঁকড়ে উঠল। বলল, ‘ওহে, তোমাকে আমি শেষ খেয়ায় পার করব, এখন নিতে পারব না।’

শাম্ব বললেন, ‘ভাই, সেটা তোমার করুণা। আগে বা শেষে, যখনই তুমি আমাকে পার করো, পার হতে পারলেই আমি সার্থক জ্ঞান করব।’

শাম্বর বিনীত বাক্যে মাঝি যেন একটু অবাক হল। আসলে শাম্বর ভাষায় বিন্দুমাত্র অর্বাচীনতার স্পর্শ নেই। ধীমান ও জ্ঞানীর মতো তাঁর কথা শুনে, আরও কয়েকজন যাত্রী তাঁর দিকে তাকাল। কিন্তু প্রথম দর্শনেই সকলের মুখে বিমুখতা ফুটে ওঠে। শাম্ব আবার বললেন, ‘এ দেশে আমি কখনও আসিনি। এই নদীর তীরে মিত্রবন নামক স্থানে আমি যেতে চাই। আমি শুনেছি, সে-স্থানকে সূর্যক্ষেত্র বলা হয়। সে-স্থান কি নদীর পরপারে?’

মাঝি চমৎকৃত হয়ে বলল, ‘পরপারে বটে, কিন্তু এ-ঘাটে পার হয়ে তোমাকে নদীর উত্তরদিকে সারাদিনের পথ যেতে হবে। তার চেয়ে রাত্রিটা তুমি এপারেই অতিবাহিত করে, নদীর উজানে তীর ধরে চারটি অতিকায় বাঁক পাবে। ভোরে রওনা হলে, সন্ধ্যাকালের মধ্যে তুমি সেখানে পৌঁছুতে পারবে, আর সেখানেই খেয়া পার হবে।’

শাম্ব কৃতার্থ হয়ে বললো, ‘ভাই, পঞ্চনদীর দেশের মাঝি, তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’

মাঝি শাম্বর কথায় খুবই প্রসন্ন হল, এবং তার চোখে মুখে করুণার অভিব্যক্তিও ফুটল। সে বলল, ‘এপারে কোনও গ্রাম নেই, ওপারে গেলে, ঘাটের অদূরেই তুমি একটি গ্রাম পাবে। আমার মনে হয়, এপারে রাত্রে থাকা তোমার ঠিক হবে না। গভীর রাত্রে এপারে যক্ষগণ বাতাসে ভেসে বেড়ায়, নানারকম গান বাজনা করে। সে এক রকমের ইন্দ্রজালের মায়া। সেই মায়ায় তুমি ঘুমিয়ে পড়লে, হিংস্র জন্তু তোমাকে খেয়ে ফেলতে পারে। তারা মানুষের রোগ ব্যাধি মানে না। তুমি অপেক্ষা করো, শেষ খেয়ায় আমি তোমাকে ওপারে নিয়ে যাব।’

শাম্ব কৃতজ্ঞতায় কোনও কথা উচ্চারণ করতে পারলেন না। মাঝির কথায় তাঁর চোখ সজল হয়ে উঠল। নৌকা ছেড়ে যাবার পরে, শাম্ব সাবধানে নদীর জলে অবতরণ করলেন। অবগাহন স্নানে যেন তাঁর সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে গেল।

পরের দিন সন্ধ্যাবেলা নদীতীরের এক স্থানে এসে তিনি উপস্থিত হয়ে দেখলেন, ছোট ছোট টিলার গায়ে একটি কিংবা দুটি মানুষ কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকতে পারে, এমনি ধরনের মানুষের তৈরি কতগুলো গুহা। তার আশেপাশে, ঝোপঝাড়ের মুণ্ডসকল লতাগুল্মের দ্বারা শক্ত করে বেঁধে, একটি প্রবেশমুখ রেখে, এক ধরনের কুটির তৈরি করা হয়েছে, যার ভিতরে হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করা ছাড়া উপায় নেই, এবং ভিতরে নিশ্চয়ই মাথা সোজা করে বসাও যায় না। আশেপাশে কয়েক জায়গায় কাঠের আগুন জ্বলছে। তারই লেলিহান শিখার আলোয়, শাম্ব সেইসব গুহা ও কুটিরের সামনে কিছু মানুষকে নড়েচড়ে বেড়াতে দেখলেন। পুরুষ এবং রমণীর কণ্ঠস্বরও তাঁর কানে এল।

শাম্ব মনে মনে অবাক হয়ে ভাবলেন, এরা কারা? কোনও যাযাবর জাতির গোষ্ঠীভুক্ত, অথবা অরণ্যবাসী কিরাতগণ? ভাবতে ভাবতে তিনি সেইসব গুহা ও কুটিরের সামনে এগিয়ে গেলেন। কাঠের আগুনের আলোয় তাঁর মূর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠতেই কয়েকজন তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। শাম্বর বুকে যেন বিদ্যুতের ঝলক হেনে গেল। দেখলেন, তাঁর সামনে যে-ক’জন এসে দাঁড়িয়েছে, তারা সকলেই তাঁর মতো কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত। শাম্ব এবং তাদের মধ্যে দৃষ্টিবিনিময় হল। কয়েক মুহূর্ত পরেই দেখা গেল, কয়েকজন কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত রমণীও সামনে এসে দাঁড়াল। যাদের দু’-একজনের কোলে শিশু! আশ্চর্য, শিশুরা কেউ রোগগ্রস্ত না।

শাম্ব মুহূর্তেই অনুমান করতে পারলেন, এ অঞ্চলই মিত্ৰবন। যে-কথা তিনি মহর্ষি নারদের কাছে শুনেছিলেন, এরাও নিশ্চয় সেরকম ভাবেই কারও কাছ থেকে শুনে, এখানে আরোগ্যলাভের জন্য এসেছে। তিনি সন্দেহ মোচনের জন্য প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই স্থানের নাম কি মিত্রবন?’

একজন পুরুষ জবাব দিল, ‘তাই তো শুনেছি।’

শাম্বর মনে পড়ল, মহর্ষি নারদের সূর্যক্ষেত্রের সেই বিস্ময়কর বর্ণনা, যেখানে গ্রহরাজ সূর্যকে ঘিরে অষ্টাদশ দেবতা, গন্ধর্ব, যক্ষ, অপ্সরাগণ, দণ্ডনায়ক ও দিণ্ডি দণ্ডায়মান রয়েছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেই সূর্যক্ষেত্র কোথায়, যেখানে গ্রহরাজ পরমাত্মন অবস্থান করছেন?’

শাম্বর কথা শুনে, সবাই হেসে উঠল। কেউ বলল, ‘এর কথাবার্তা বেশ রাজপুরুষদের মতন চৌকস।’

কেউ বলল, ‘ঋষির মতনও বলা যায়।’

শাম্ব অবাক হয়ে শুনলেন, এদের কথাবার্তা রীতিমতো অর্বাচীন, ইতর শব্দে ভরা। এদের কী পুরুষ, কী রমণী, সকলেই এমনভাবে গ্রহরাজের কথা শুনে হাস্যপরিহাস করছে, যেন তারা ব্যাধিগ্রস্ত নয়। একজন এগিয়ে এসে বলল, ‘তোমার মত আমরাও অনেক কথা শুনে এখানে এসেছি। কিন্তু ওই যেসব গ্রহরাজ-টাজ কী সব বলছ, ওসব আমরা কিছুই দেখিনি। তবে মান্ধাতা আমলের একটা মন্দির আছে। ওটাকেই সবাই সূর্যক্ষেত্র বলে।’

শাম্বর অন্তর একরকমের অশান্তি ও অস্বস্তিতে ভরে উঠল, জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেই মন্দিরে কোন দেবতার বিগ্রহ আছে?’

সবাই আবার পরিহাস করে হেসে উঠল, এবং একজন বলল, ‘সেটা মন্দিরই কি না, আমরা জানি না। মাথার ওপরে ছাতা, আর রাজার মতন জুতো জামা পরা একটা মূর্তি আছে। ও-ই নাকি সূর্যমূর্তি। আমরা রোজ তাকে একবার করে গড় করি।’

অনেকে প্রতিধ্বনি করল ‘হ্যাঁ, আমরা চন্দ্রভাগার জলে রোজ চান করে, সেই মূর্তিকে একবার গড় করি। তার আশেপাশে আরও অনেক মূর্তি আছে, ওরাও নাকি সবাই দেবতা। এদেরও গড় করি।’

একজন পুরুষ বলল, ‘অপ্সরা মূর্তি বেশ সুন্দর, আমি রোজ তার গায়ে গা ঘষি।’

আর একজন বলল, ‘আমরা রোজ সকালে চন্দ্রভাগায় নেয়ে, মন্দিরে গড় করে ভিক্ষে করতে বেরোই। আর এ সময়ে এসে ভিক্ষার অন্ন ফুটিয়ে খাই।’

অন্য একজন বলল, ‘আমরা সংসারও করি। এইসব মেয়েছেলেরা প্রতি বছরই পোয়াতি হয়, আর বাচ্চা বিয়োয়।’

ভগ্নকেশ, বিকলাঙ্গ, বিবর্ণ, পুচ্ছহীন রক্তচক্ষু রমণীরা সবাই হেসে উঠল, এবং একজন বলল, ‘আমাদের বাচ্চাগুলো প্রথমে খুব ফুটফুটে হয়ে জন্মায়। চার-পাঁচ বছর বয়স হলেই ওরা আস্তে আস্তে আমাদের মতন হয়ে যায়।’

একটি রমণী তার বুকের ফুটফুটে শিশুটিকে দেখিয়ে বলল, ‘এই দ্যাখো, এখন কেমন সুন্দর দেখতে। ও আমার পেটেই জন্মেছে। ওর বাবারও কুষ্ঠ ছিল, দু’দিন হল মরে গেছে। আমার এই ছেলে যখন একটু বড় হবে, তখন ওরও কুষ্ঠ হবে। কিন্তু সেসব নিয়ে আমি ভাবি না। রাত হলেই পুরুষের সঙ্গে ছাড়া আমি থাকতে পারি না। তুমি নতুন এসেছ, এখন থেকে আমি তোমার সঙ্গেই থাকব।’

সবাই হইহই করে সমর্থন করল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এখন থেকে তুমিই ওর সঙ্গে থাকবে। মেয়েদের মধ্যে ও এখন সব থেকে বয়সে ছোট। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি আগে বেশ সুপুরুষ ছিলে।’

পুচ্ছহীন রক্তাভ চোখে, শিশু কোলে রমণীটি শাম্বর দিকে তাকিয়ে ইশারা করল।

একজন চিৎকার করে বলল, ‘এখানে সবাই রোগ সারাতে আসে, কিন্তু এমন কোনও দিব্য ব্যাপার নেই যে, রোগ সারে। চামড়া ভেদ করে আমাদের হাড়ে দুব্বো গজিয়ে যায়, আর আমরা মরে যাই। আমাদের ছেলেমেয়েরা থাকে, তার আগের জন্মিত ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যায়, আর তোমার মতন নতুন নতুন লোক এখানে রোগ সারাতে আসে।’

শাম্বর মনে হল, কোনও মায়ার দ্বারা তিনি আবিষ্ট হয়েছেন। তাঁর কোনও বাহ্যজ্ঞান নেই। অচৈতন্য অবস্থায় তিনি কোনও নরকে এসে উপস্থিত হয়েছেন। এ স্থান কখনওই মিত্রবন হতে পারে না। এদের সকলের পরিহাসের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে একটি অসহায় অবিশ্বাসই ধ্বনিত হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন, নানা স্থান থেকে এরা এখানে এসেছে, সংঘবদ্ধভাবে জীবনযাপনের দ্বারা সন্তান উৎপাদন করেছে। এদের কারও সঙ্গেই কারওর কোনও সম্পর্ক নেই। বংশপরম্পরা বলেও কিছু নেই। সমাজ ও সংসার থেকে বহিষ্কৃত এক ব্যাধিগ্রস্ত বাহিনী, যারা আরোগ্যের আশা নিয়ে এসেছিল। কিন্তু আরোগ্যলাভ দূরের কথা, ব্যাধিতে ভুগে মৃত্যুকেই এরা অবধারিত জেনে কিছুদিনের জন্য যদৃচ্ছা জীবন ধারণ করে যাচ্ছে। এদের কোনও আশা নেই, অতএব, কোনও বিশ্বাসও নেই। অথচ এরা অবিশ্বাসী ছিল না। তা হলে এখানে আসত না।

শাম্ব সহসা দেখলেন, তাঁর চারপাশে ছায়ার মতো সবাই এসে দাঁড়িয়েছে। একজন চিৎকার করে বলল, ‘ওহে, তুমি যে একেবারে মুনি-ঋষিদের মতন দেবতায় পাওয়া লোক হয়ে গেলে! জিজ্ঞেস করছি, কোথা থেকে আসছ?’

শাম্ব সংবিৎ ফিরে পেয়ে, সকলের দিকে তাকালেন। দেখলেন সেই শিশুবুকে যুবতী কুষ্ঠ রোগিণীটি তাঁর গায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি জবাব দিলেন, ‘কোথা থেকে এসেছি, সে-কথায় আর কী কাজ? অতীতকে ভুলে যাওয়াই শ্রেয় নয় কি?’

অনেকে একসঙ্গে বলে উঠল, ‘ঠিক ঠিক! কিন্তু তোমার কথাবার্তার ধরন-ধারণগুলো বড্ড জ্ঞানীগুণীদের মতন লাগছে। বলি, তোমার কি ক্ষুধা তেষ্টা বলে কিছু আছে? থাকলে আমরা দিতে পারি।’

শাম্ব প্রকৃতই ক্ষুধার্ত ছিলেন। সেই ভোরে, নদীতীরের নরম মৃত্তিকার জঙ্গল থেকে, কয়েকটি মূল তুলে জলে ধুয়ে চিবিয়েছিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি ক্ষুধার্ত। তোমাদের সকলের সংকুলান হলে, আমাকেও কিছু খেতে দাও।’

শাম্ব এই কথা বলামাত্র, তাঁর পার্শ্ববর্তিনী সেই রমণী তার শিশুটিকে তাঁর বুকের উপর প্রায় নিক্ষেপ করে বলল, ‘তা হলে তুমি আমার ছেলেকে ধরো, আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।’

সকলেই সমর্থন করে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নীলাক্ষিই আমাদের নতুন সঙ্গীকে খেতে দিক।’

শাম্ব মনে মনে উচ্চারণ করলেন, ‘নীলাক্ষি!’ নাম শুনে বোঝাই যায় না, এই রমণীও একদা নীলাক্ষি ছিল। অবিশ্যি, কাকেই বা বোঝা যায়? এ চিন্তা বাতুলতা। কিন্তু শিশুটিকে নিয়ে তিনি অস্বস্তিতে পড়লেন। নতুন মানুষের কোলে সে কিছুতেই থাকতে চাইছে না, চিৎকার কান্না জুড়ে হাত-পা ছুড়তে আরম্ভ করেছে। তিনি অসহায় চোখে, উদ্ধারের প্রত্যাশায় আশেপাশের সকলের দিকে তাকালেন। কিন্তু বৃথা। তাঁর প্রত্যাশা পূর্ণ করার জন্য উপস্থিত পুরুষ বা রমণীগণের মধ্যে কেউ এগিয়ে এল না, হাত বাড়িয়ে দিল না। বরং তাঁকে শিশুটি নিয়ে বিব্রত ও উদ্‌ব্যস্ত হতে দেখে, সকলেই যেন বিশেষ কৌতুক বোধ করে নিজেদের মধ্যে হাস্যপরিহাস করতে লাগল। কেউ কেউ বলল, ‘নীলাক্ষির ছেলে নতুন বাপকে এখনও চিনতে পারছে না। ওহে ছেলের বাপ, ছেলেকে একটু আদর করছ না কেন?’

কেউ বলল, ‘তোমার ঘরে কি বউ ছিল না? তোমার কি ছেলেমেয়ে ছিল না? তুমি কি গৃহস্থ ছিলে না? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি যেন মোটেই ঘরকন্না করা জানো না। কেন হে, তুমি কি রাজ-রাজড়ার ছেলে নাকি?’

শাম্ব মনে মনে বললেন, ‘আমার একটাই মাত্র পরিচয়, আমি অভিশপ্ত।’ তিনি শিশুটির অবস্থা সম্যক উপলব্ধি করলেন, তাঁর মনে করুণা ও স্নেহের উদ্রেক হল। শিশুটিকে নানা ক্রীড়া কৌতুকের ভঙ্গি করে, শান্ত করতে চেষ্টা করলেন। বুকে চেপে, শূন্যে দুলিয়ে তাকে খুশি করবার বিবিধ কৌশল অবলম্বন করলেন। শিশুটি এখনও আশ্চর্য উজ্জ্বল, স্বাস্থ্যবান এবং নিষ্পাপ। সে শাম্বর আচরণে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হল। কান্না থামল। জন্মাবধি সে কুষ্ঠরোগগ্রস্তদের দেখে অভ্যস্ত, অতএব শাম্বর মুখের প্রতি কৌতূহলবশে তাকিয়ে সে ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল না। রোগাক্রান্ত কুৎসিত মুখের দিকে তাকিয়ে সে স্নেহ ও সোহাগ সন্ধান করে নিতে পারে। শিশুটির চোখের বর্ণ নীল। নীল আকাশ প্রতিবিম্বিত চন্দ্রভাগার রৌদ্রচকিত জলের ন্যায় উজ্জ্বল। নীলাক্ষির চোখ দুটিও কি একদা এইরকম ছিল?

শাম্ব দেখলেন, তাঁর চারপাশে পুরুষ ও রমণীদের মধ্যে কিছু বালক-বালিকা রয়েছে, যারা ইতিমধ্যেই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এরা সকলেই সুস্থ দেহে জন্মগ্রহণ করেছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, ব্যাধি এদের আক্রমণ করেছে। এরাও কি অভিশপ্ত? অন্যথায়, কী অপরাধ এইসব বালক-বালিকাদের, যাদের অসহায় চোখে মুখে হতাশা ও অবিশ্বাস? এদের যদি কোনও অপরাধ থেকে থাকে, তার একমাত্র কারণ, তারা এইসব পুরুষ ও রমণীদের ঔরস ও গর্ভজাত সন্তান। এ কি কোনও পূর্ব জন্মের পাপের ফল? অমোঘ ভবিতব্য?

শাম্ব নিজেও ব্যাধিগ্রস্ত, কিন্তু পিতার দ্বারা অভিশপ্ত। অমোঘ তাঁর পরিণতি। তাঁর অন্তর কাতর হল, ব্যথায় দ্রবীভূত হল, এইসব রমণী-পুরুষ বালক-বালিকা আর শিশুদের দেখে। এদের মুক্তির কি কোনও উপায় নেই? তাঁর নিজের মুক্তিরই বা কী উপায়? মহর্ষি নারদোক্ত বৃত্তান্ত তো কখনও মিথ্যা হবার না। তিনি কি প্রকৃতই মহর্ষি কথিত সেই সূর্যক্ষেত্র মিত্রবনেই এসেছেন? অথচ এই স্থান, এইসব হতমান অবিশ্বাসী ব্যাধিগ্রস্তদের দেখে তা মনে হয় না।

শিশুটি আবার হাত-পা ছুড়ে কান্নাকাটি শুরু করল। সৌভাগ্য; নীলাক্ষি নাম্নী রমণীটি খাদ্য নিয়ে এল। শাম্বর সামনে খাদ্যের মৃত্তিকাপাত্র রেখে, ছেলেটিকে নিজের কোলে নিয়ে বলল, ‘বসো, খাও।’

শিশুটি মায়ের কোল পেয়ে যেন ইন্দ্রজালের দ্বারা বশীভূত ও শান্ত হল। শাম্ব পার্শ্ববর্তী একজন পুরুষকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হাত ধোয়া আর কুলকুচার জন্য জল পাওয়া যাবে?’

লোকটি হইহই করে উঠল, ‘দ্যাখো দ্যাখো, এ নিজেই বলছিল, অতীতের কথায় কাজ কী? কিন্তু এ নিজেই এখনও আগের জীবনের কথা ভুলতে পারেনি। খাবার আগে হাত ধুতে চায়, মুখ ধুতে চায়।’

আর একজন বলল, ‘আমরা তো এখন হাতে কোনও সাড়ই পাই না। জল দিয়ে ধুলেও টের পাই না, আগুনে পোড়ালেও টের পাই না। ভিক্ষের অন্ন ফুটিয়ে খাব, তার আবার হাত ধোয়াধুয়ি কীসের?’

অন্য আর একজন বলল, ‘এর কথাবার্তা ভাবভঙ্গি সবই যেন আমাদের থেকে আলাদা।’

এক কুষ্ঠরোগগ্রস্ত বৃদ্ধ গলিত দন্ত, রক্তাভ হাঁ-মুখে হাস্য করে বলল, ‘কিছুদিন যেতে দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখবে ও আমাদের মতোই হয়ে গেছে।’

এই সময়ে সদ্য রোগাক্রান্ত একটি বালিকা, জলপূর্ণ একটি মৃত্তিকার পাত্র শাম্বর খাদ্যের পাত্রের সামনে এনে রাখল। শাম্ব কৃতজ্ঞ চোখে বালিকাটিকে দেখে, মৃদু হাসলেন। জলের পাত্র নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে খাদ্যের পাত্রের সামনে বসলেন। সকলকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আমি একলাই খাব? তোমরা?’

নীলাক্ষি বলল, ‘আমরা ভিক্ষা শেষে ফিরে এসেই, ফুটিয়ে নিয়ে খেয়েছি। ওই দেখছ না, এখনও রান্নার আগুন জ্বলছে।’

একজন পুরুষ বলল, ‘আমরা সারাদিন দূরদূরান্তরে ভিক্ষে করি, ফিরে এসেই আগে পেটের জ্বালা মেটাই। যা তণ্ডুল থাকে, কিছু খাই, বাকিটা কাল সকালের জন্য রেখে দিই। সকালে খেয়েই আবার বেরিয়ে পড়ি।’

শাম্ব নীলাক্ষির দিকে ফিরে বললেন, ‘এই খাদ্য তুমি আগামী সকালের জন্য রেখে দিয়েছিলে? রাত পোহালে তুমি কী খাবে?’

নীলাক্ষি তার রক্তিম ক্ষতযুক্ত স্ফীত অধরোষ্ঠ বিস্ফারিত করে হেসে বলল, ‘ওহে প্রাণ, তোমাকে যা দিয়েছি, তা খাও। আমার এখনও কিছু রাখা আছে, সকালে তাই খাব। তোমার খিদে না মিটলে যেটুকু রেখে দিয়েছি, তাও তোমাকে দিয়ে দেব।’

একজন রমণী বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। তুমি খাও। নীলাক্ষি তোমাকে পেয়ে খুশি, তোমাকে খাইয়ে ও আরও খুশি। তুমি তোমার দানটা রাত্রে ভাল করে দিয়ো, নীলাক্ষিকে সুখী কোরো।’

সবাই হইহই করে উঠল। আগুনের শিখার আলোয়, তাদের সবাইকেই অতি ভয়ংকর প্রেতমূর্তির ন্যায় দেখাল। নীলাক্ষি খিলখিল করে হেসে, শাম্বর হাঁটুতে একটা চাপড় মারল, এবং তার পৃচ্ছহীন রক্তাভ চোখে অতিপ্রার্থিনীর উল্লাসে ইশারা করল। শাম্ব যেন অন্তরে শিহরিত হলেন। এই শিহরনে কোনও সুখ বা কামোচ্ছ্বাস নেই। এই শিহরন তাঁর কাছে পূর্ব জীবনের স্মৃতিযুক্ত, অথচ ভয়জাত। তিনি অভিশপ্ত, কারণ তিনি রমণীমোহন ছিলেন। সেই অভিশাপের ফল তিনি বহন করছেন। গৃহ থেকে বিদায়ের পূর্বে, লক্ষণার অতি কাতর প্রার্থনায়, পত্নীর ধর্মরক্ষার্থে, তিনি জীবনের শেষবারের জন্য রমণ করেছেন, অথচ তা কামোদ্দৃপ্ত ভোগের উচ্ছ্বাসে তৃপ্ত হবার জন্য না। এখানে নীলাক্ষির আশাও তিনি পূরণ করতে পারবেন না।

শাম্বর মনে স্বতঃই একটি বিরোধ সৃষ্টি হল। যার সারা দিনের আহরিত অন্ন তিনি গ্রহণ করবেন, সে একটি বিশেষ প্রত্যাশায় তা পরিবেশন করছে। অথচ তার প্রত্যাশা পূর্ণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব না। অতএব খাদ্যপাত্র স্পর্শ না করে তিনি নীলাক্ষিকে বললেন, ‘আমি তোমার প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পারব না, তোমার সঙ্গে সহবাস আমার দ্বারা সম্ভব না। কিন্তু আমি ক্ষুধার্ত, আমি কি তবু এই অন্ন খেতে পারি?’

নীলাক্ষি হেসে উঠল এবং শাম্বর কথা যারা শুনতে পেল, সবাই হইহই করে হেসে উঠল।

একজন বলল, ‘ওহ নয়া মানুষ, এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমাদের নীলাক্ষি ও-বিষয়ে অনেক তুকতাক জানে। যা করবার সে-ই করে নেবে।’

সবাই উল্লাসে হেসে উঠল। নীলাক্ষিও তাদের মতো হেসে শাম্বকে বলল, ‘আমি বলছি তোমাকে, এখন পেটের খিদে তো মেটাও। অন্য খিদের কী হয়, তা পরে দেখা যাবে।’

নীলাক্ষির কথার মধ্যে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত সকলেই বুঝতে পারল, এবং সবাই একসঙ্গে নীলাক্ষিকে সমর্থন করল। শাম্ব দেখলেন, বালক-বালিকারাও বয়োজ্যেষ্ঠদের কথা শুনে, নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। তাদের চোখ মুখের অভিব্যক্তি দেখলেই বোঝা যায়, বয়স্কদের কথার অন্তর্নিহিত অর্থ ও তাদের ক্রীড়া কৌশলের কোনও কিছুই তাদের অজ্ঞাত না। যখন মানুষের বিশ্বাস হারিয়ে যায় তখন তার জীবনে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। থাকে কেবল শিশ্নোদরপরায়ণতা। এদের দেখে, শাম্ব তাঁর জীবনে এই অভিজ্ঞতাই অর্জন করলেন। কিন্তু মুক্তির কী উপায়? ব্যাধি থেকে আরোগ্যই মুক্তি। মুক্তিই দেয় নতুন জীবনের সন্ধান।

শাম্ব এইসব হতমান অবিশ্বাসীদের সামনে বসেও, অন্তরের অটুট বিশ্বাসকে অনুভব করলেন। তিনি যদি ভুল স্থানে এসে থাকেন, তবে আবার মহর্ষি নারদের সন্ধানে যাবেন। এই কল্প গ্রহণ করে তিনি নীলাক্ষির দেওয়া খাদ্য খেলেন। বিভিন্ন প্রকারের তণ্ডুলের সহযোগে, নানা শাক ও মূল সিদ্ধ করা খাদ্য। শাম্ব অতি উপাদেয় জ্ঞানে এই খাদ্য খেলেন। জলপান করে তৃপ্ত হলেন। তারপরে, তাঁর চারপাশে যারা উপবিষ্ট ছিল, তাদের উদ্দেশ করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা বললে এখানে একটি মন্দির আছে, সেই মন্দিরের মধ্যে এক বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত আছেন।’

সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আছে আছে। আমরা রোজ তাকে গড় করি।’

শাম্ব হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে বললেন, ‘মন্দিরে বিগ্রহ থাকলেই তাঁর নিত্য পূজাদি হয়। এই মন্দিরের বিগ্রহের পূজার কী ব্যবস্থা আছে?

সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, যার ফলে শাম্ব কোনও কথাই উদ্ধার করতে পারলেন না। তিনি সবাইকে নিরস্ত করে একজন বৃদ্ধকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘তুমি বলো, তোমার কাছ থেকে শুনি।’

বৃদ্ধের অঙ্গ এখন গলিত-প্রায়। নাসিকার হাড় সম্পূর্ণ ক্ষয়প্রাপ্ত, দুইটি ছিদ্র ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। সে সানুনাসিক স্বরে বলল, ‘আমি ওই মন্দিরে কখনও পূজা হতে দেখিনি। তবে মন্দিরের পুবদিকে একজন মুনিপুরুষের আশ্রম আছে। সে কখনও মন্দিরের বিগ্রহের পূজা করে না।’

‘কিন্তু আমাদের বেহ্মচয্যি পালন করতে বলে।’ একজন ব্যঙ্গের স্বরে বলে উঠল।

আর একজন বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই মুনি ব্যাটা আমাদের উপোস করতে বলে। বেহ্মচারি হতে বলে। রোজ ভোরবেলা চান করে, সূর্যের দিকে মুখ করে বসে থাকতে বলে।’

‘সে আরও অনেক কিছু বলে।’ আর একজন বলে উঠল। ‘তার কথার মাথামুন্ডু আমরা কিছুই বুঝি না। আমরা জানতাম এখানে এসে চন্দ্রভাগায় নাইলেই আমরা ভাল হয়ে যাব। কিন্তু সবই ফক্কিকারি। আমরা যদি তপস্যাই করব, তবে ভিক্ষে করব কখন? আমাদের খেতে দেবে কে? মুনিটা বলে, তোমরা এই নদীর ধারে চাষ আবাদ করো। আমরা কি এখানে ঘর-সংসার করতে এসেছি? আমরা সবাই একদিন পচে-গলে মরে যাব। রোজই একটু একটু করে আমাদের হাত-পা খসে যাচ্ছে।’

লোকটির কথা শুনে কেউ কেউ আর্তনাদ করে উঠল। আহত পশুর ন্যায় সেই আর্তনাদে, নদীকূলের বিস্তৃত অন্ধকার ভূমি, ঝোপঝাড়, গাছপালা, এখনও অবশিষ্ট কয়েকটি আগুনের শিখায় যেন এক ভয়ংকর নরক সদৃশ হয়ে উঠল। অচিরাৎ মৃত্যুভয়েই যেন কেউ কেউ নিজেদের আলিঙ্গন করে ক্রন্দন করতে লাগল। অন্যদিকে অন্ধকারে চলে গেল কেউ। শাম্ব গম্ভীর আর চিন্তিত হয়ে পূর্বদিকে তাকালেন। কে মুনি ঋষি এখানে আশ্রম করে আছেন? অথচ তিনি মন্দিরের বিগ্রহের কোনও পূজা করেন না। কিন্তু এদের নানা প্রকার উপদেশ দান করেন? এদের কথাবার্তা থেকে সম্যক কিছুই বোঝার উপায় নেই। শাম্বর কাছে এ স্থান অপরিচিত। এই রাত্রের অন্ধকারে এখন মন্দির প্রাঙ্গণে বা মুনির আশ্রমে যাওয়া উচিত হবে না। যদিও সেই স্থানে যাবার জন্য তিনি ব্যাকুলতা বোধ করছেন, কাল এবং স্থান চিন্তা করে চিত্তকে দমন করলেন।

শাম্ব দেখলেন, প্রায় সকলেই যে যার মৃত্তিকা গহ্বরে বা পাতা ঝোপের কুটিরে গমন করেছে। দু’-একজন রমণী পুরুষ বালক-বালিকা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বসে আছে। প্রায়-নিভন্ত দু’-একটি ক্ষীণ আগুনের শিখা এখনও জ্বলছে। নীলাক্ষি এখনও ঘুমন্ত শিশু কোলে নিয়ে তাঁর পাশে বসে রয়েছে। শাম্ব স্মরণ করতে পারেন না, কতক্ষণ পূর্বে শৃগাল প্রহর ঘোষণা করেছে। কিন্তু করেছে, তিনি শুনতে পেয়েছিলেন। এখন মাঝে মাঝে মাথার ওপর দিয়ে কালো পাখা বিস্তার করে রাত্রিচর পাখিরা উড়ে যাচ্ছে। নদীর কলকল শব্দের মধ্যেও পাখিদের পক্ষ সঞ্চালনের মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। সন্ধ্যাতারা পূর্ব দিগন্ত থেকে অনেকখানি উঠে এসেছে। সপ্তর্ষিমণ্ডল ও বিভিন্ন নক্ষত্ররাশি, কৃষ্ণ আকাশে অতি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।

শাম্ব নীলাক্ষির দিকে তাকালেন? নীলাক্ষি তার পুচ্ছহীন রক্তাভ চোখে শাম্বর দিকেই তাকিয়ে ছিল। সহবাস কামনার অতি ব্যাকুলতা তার চোখে নেই, কিন্তু গভীর প্রত্যাশা নিয়ে সে বসে আছে। শাম্ব কোমল স্বরে বললেন, ‘সকলেই যে যার আশ্রয়ে চলে গেছে। তুমিও তোমার ছেলেটিকে নিয়ে ঘুমোতে যাও।’

নীলাক্ষি আশাহত বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আর তুমি? তুমি কী করবে? কোথায় থাকবে?’

শাম্ব বললেন, ‘আমি যেখানে আছি, সেখানেই রাত্রিটা কাটিয়ে দেব।’

নীলাক্ষির পুচ্ছহীন রক্তাভ চোখে আতঙ্ক ফুটে উঠল। চারপাশে তাকিয়ে দেখে নিয়ে বলল, ‘কী করে তুমি সারা রাত বাইরে থাকবে? এখনই নেকড়েরা ছুটে আসবে। তারা কুষ্ঠ রোগীদের রেহাই দেয় না। আমাদের মাটির গর্তের ঝাঁপে আর পাতার ঘরেও তারা হামলা করে, নখ দিয়ে আঁচড়ায়। তুমি বাইরে থাকলে, ওরা তোমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।’

শাম্ব মুহূর্তেই ভেবে নিয়ে বললেন, ‘আমি এখনই অগ্নিকুণ্ডের আগুন উসকে তুলব, আগুনের পাশে বসে থাকব। নেকড়ের দল এলে আমি আগুন নিয়ে তাদের তাড়া করব।’

নীলাক্ষি শাম্বর কথা বুঝতে পারল, তিনি যা বলছেন, তা করবেন। সে বলল, ‘কিন্তু আমি তোমার আশায় বসে আছি। আমি একলা থাকতে পারি না। একজন পুরুষ না থাকলে আমার সবই ফাঁকা লাগে।’

শাম্বর কাছে এই সরল স্বীকারোক্তি মর্মন্তুদ বোধ হল। তিনি কৌতুহলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘যে-পুরুষ দু’দিন আগেও তোমার সঙ্গে থাকত, তার জন্য তোমার শোক-দুঃখ কিছু নেই? তাকে কি তুমি ভুলে গিয়েছ?’

নীলাক্ষি মাথা নেড়ে বলল, ‘কেন ভুলে যাব? তাকে আমার ভালই মনে আছে। আমি তার জন্য অনেক কেঁদেছি। কিন্তু আমাদের জীবনে ওসব শোক-দুঃখের কী দাম আছে? তুমি শুনলে না, আমরা রোজই একটু একটু করে পচে-গলে মরে যাচ্ছি? তোমার মতন নতুন যারা আসে তারা সবাই কয়েকদিন এইরকমই ভাবে। আলাদা আলাদা দূরে সরে থাকতে চায়। তারপরে যখন বুঝতে পারে, ওতে কোনও লাভ নেই, তখন সকলের সঙ্গে মিশে যায়। তুমিও যাবে। তবে মিছে কেন দেরি করছ? আমাদের ঘর সমাজ বলে এখন কিছুই নেই। মরতে মরতেও আমরা আমাদের নিয়েই থাকব। আমাদের এখন কোনও পাপও নেই পুণ্যও নেই। পুড়ে-যাওয়া-পাখা মৌমাছি যেমন ফুলের গায়ে লেগে থেকে মরে যায়, আমরা সেইভাবেই মরতে চাই। যেটুকু সুখ মেটে তাই মিটিয়ে নিই। তুমি আমার সঙ্গে চলো। তোমাকে আমি সুখী করব।’

শাম্ব অনুভব করলেন, নীলাক্ষির প্রতিটি কথাই অতি নিষ্ঠুর বাস্তব। ব্যাধি ও নিশ্চিত বীভৎস মৃত্যু আশাহীন জীবনের কথা। কিন্তু তিনি বিচলিত নন, এখনও মুক্তির অভিলাষী। তিনি কোনও যুক্তি দেখালো না, বললেন, ‘নীলাক্ষি, আমি তোমার কথা বুঝেছি। তুমি আমাকে মার্জনা করো, আমাকে ত্যাগ করে তুমি তোমার শিশুটিকে নিয়ে আশ্রয়ে যাও।’

নীলাক্ষি তথাপি বলল, ‘আমার যদি রোগ না হত, আমি যদি সমাজ সংসারে থাকতাম, তুমিও যদি সুস্থ থাকতে, তবে কখনওই আমাকে এভাবে এড়িয়ে যেতে পারতে না। তোমার কথা থেকেই বোঝা যায়, তুমি রাজরাজড়া ঋষিদের মতো সবই জানো। কিন্তু তুমি কি বুঝতে পারো না, আমার এই যে শরীরটা, এর বাইরে কোনও সাড়ই এখন আর নেই। তুমি যদি আমার বুকেও হাত দাও, আমি টের পাব না। এখন শুধু শরীরের ভেতরেই সাড় আছে। যেমন জিভ দিয়ে এখনও খাবারের স্বাদ পাই। হয়তো মরার আগে পর্যন্ত এই সাড়ই থাকবে। এই সুখটুকু তুমি কেন আমাকে দেবে না?’

শাম্ব বুঝলেন, নীলাক্ষির এইসব উক্তি অধিকতর বাস্তব ও মর্মন্তুদ। সে কোনও কথাই প্রচ্ছন্ন রাখেনি। কিন্তু কী করে বললেন, তিনি পিতার দ্বারা অভিশাপগ্রস্ত। শাপমোচনের জন্যই তিনি গৃহত্যাগ করেছেন। তাঁর জীবনে সে-ই ধ্রুব ও মোক্ষ। তিনি করজোড়ে বললেন, ‘নীলাক্ষি, আমাকে ক্ষমা করো। তোমাকে সামান্য সুখী করতে পারলেও আমি সুখী হতাম। আমাকে অক্ষম জ্ঞানে তুমি ক্ষমা করো।’

নীলাক্ষির পুচ্ছহীন রক্তাভ চোখ হতাশায় ও ক্ষোভে জ্বলে উঠল। তার ভগ্ন নাসা, ক্ষয়-ক্ষত ঠোঁট, স্ফীত পাংশু মুখ শক্ত হল। শিশু কোলে সে উঠে দাঁড়াল, ‘তুমি অক্ষমই থাকো। তোমাকে ধিক! আমি যখন সুস্থ ছিলাম, তখন ঋষি পুরুষরাও আমার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হত। এখানে এখন যত পুরুষ আছে, আমি যাকে ডাকব, সে-ই আমার কাছে ছুটে আসবে। এর পরে তুমি আমাকে চাইলেও আর পাবে না।’ এই বলে সে ঝোপঝাড়ের অন্তরালে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

শাম্ব নতমুখে বসে রইলেন। তিনি জানেন, নীলাক্ষির অভিশাপ তাঁকে স্পর্শ করবে না, কারণ তিনি অভিশপ্ত হয়ে এখন এক কল্প গ্রহণ করেছেন। কিন্তু নীলাক্ষির জন্য তাঁর অন্তর দুঃখে দ্রবীভূত হল। কিছুক্ষণ এইভাবে অধোবদনে বসে থাকবার পরেই তিনি ঘ্রাণে হিংস্র পশুর উপস্থিতি টের পেয়ে চকিত হলেন। দেখলেন, এখন আর কেউ বাইরে নেই। তিনি একলা। দূরে অন্ধকারে তাকিয়ে শ্বাপদের প্রজ্বলিত চক্ষু দেখতে পেলেন। তৎক্ষণাৎ উঠে, অগ্নিকুণ্ডের কাছে গিয়ে, খুঁচিয়ে আগুনের শিখা উসকিয়ে তুললেন। জ্বলন্ত একটি কাঠের টুকরো নিয়ে তিনি চারপাশে তাকালেন। অগ্নিশিখার প্রভায় জ্বলন্ত শ্বাপদ চক্ষুগুলো দূরান্তরে আত্মগোপন করেছে। কিন্তু তারা প্রত্যাশায় আশেপাশেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে। শাম্ব আশপাশ থেকে কাঠের টুকরো নিয়ে, অগ্নিকুণ্ড বিস্তৃত করলেন। জ্বলন্ত কাঠ ছড়িয়ে, নিজের চারপাশে ব্যুহের সৃষ্টি করলেন, এবং নিশ্চিন্ত হয়ে উপবেশন করলেন। এখন শুধু নক্ষত্ররাজি অতি ধীরে আকাশের কক্ষপথে গমন করছে। নদীস্রোতে নক্ষত্রেরই রেখা মাঝে মাঝে ঝিলিক দিচ্ছে, আর কলকল ধ্বনি ভেসে আসছে।

শাম্ব নদীর দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন।

অতি প্রত্যুষে, অন্ধকার বিদায় নেবার আগে, যখন গাছে পাখির প্রথম স্খলিত জিজ্ঞাসু ডাক শোনা গেল, শাম্ব তখন চন্দ্রভাগার বেগবতী শীতল স্রোতে অবগাহন করলেন। জলের ধারা যেন তাঁর দেহের গভীরে প্রবেশ করে, অন্তর-স্থল পর্যন্ত ধৌত করে দিল। তাঁর মন ও প্রাণ যেন গভীর এক আনন্দানুভূতিতে ভরে উঠল। স্নানের শেষে তাঁর একমাত্র সম্বল দ্বিতীয় বস্ত্রখণ্ডখানি দেহে জড়িয়ে, ভেজা বস্ত্র নিংড়ে, গা মাথা মুছলেন।

আকাশের পুব দিগন্ত ক্রমে রক্তিম হয়ে উঠছে। শাম্ব দেখলেন, পাতার কুটিরে বা মৃত্তিকা গহ্বরের কেউ এখনও জাগেনি। তিনি এদের সঙ্গে এখন আর দেখা করতে চাইলেন না। বরং তারা জেগে ওঠে, এই আশঙ্কায় তিনি দ্রুত পূর্বদিকে গমন করলেন।

অনতিঘন অরণ্যানী ও বনস্পতির ফাঁকে ফাঁকে একটি মন্দিরের আকৃতি দেখা গেলেও, তার দূরত্ব যে কিছু কম, তা মনে হল না। সেই মন্দিরের কিঞ্চিৎ দর্শনে, শাম্ব তাঁর হৃদয়ে একরকমের ব্যাকুলতা বোধ করলেন, এবং যথাসম্ভব দ্রুত অগ্রসর হলেন। ক্রমেই পাখিদের স্খলিত স্বর স্পষ্ট ও সরব হয়ে উঠতে লাগল। দেখলেন, যে অঞ্চলকে নিতান্ত অরণ্যানী মনে করেছিলেন, তা নানা ফুলে ফলে সুশোভিত এক সুবিশাল রমণীয় কানন। তাঁর মনে হল জীবনের বাকি দিনগুলো এমন রমণীয় কাননে কাটিয়ে যেতে পারলেও, তাঁর অভিশপ্ত প্রাণ অনেক শান্তিতে মৃত্যুকে বরণ করতে পারবে।

শাম্ব যতই মন্দিরের নিকটবর্তী হলেন, ততই যেন কাননের শোভা অধিকতর রমণীয় হয়ে উঠতে লাগল। মন্দিরের আকৃতি ও বিবিধ দেবতা যক্ষ, গন্ধর্ব, অপ্সরাদের মূর্তি, প্রায়ই চোখের সামনে ভেসে উঠল। পূর্বের আকাশ ক্রমে গাঢ় থেকে গাঢ়তর সিন্দূরের মতো লাল হয়ে উঠল। তাঁর ডানদিকে বেগবতী চন্দ্রভাগার বুকে যেন রুধিরের তরল স্রোত বয়ে চলেছে। নদীর কলকল, বাতাসের মৃদু শনশন, পাখির সুমিষ্ট ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। শাম্বর মনে হল, মানুষের সমাজ সংসার ছাড়িয়ে, তিনি যেন এক অপার্থিব মায়াময় স্থানে পৌঁছেছেন। এখানে কি প্রকৃতই সেই অত্যুজ্জ্বল পুরুষ পরমাত্মা অবস্থান করেন?

শাম্বর মনে এই চিন্তার উদয়মাত্রই তাঁর শরীর রোমাঞ্চিত হল। কারণ মহর্ষি কথিত সেই অত্যুজ্জ্বল মূর্তির এক কল্পনা তাঁর অন্তরে গ্রথিত হয়ে আছে। তিনি নদীর তীরবর্তী মন্দিরের দক্ষিণ দ্বারে এসে উপস্থিত হলেন।

যথার্থ দক্ষিণে বলা যায় না, দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এবং একটি বৃহৎ রথের ন্যায় মন্দিরের গঠন। দ্বার আছে, কিন্তু কোনও প্রাচীরের দ্বারা মন্দিরটি বেষ্টিত নয়। রথের ন্যায় মন্দিরের চারদিকে চারটি দ্বার, পিঙ্গলা-দণ্ডনায়ক, রাজ্ঞা ও স্তোশ্রা, কালমাস-পক্ষীন, ভিওমান ও নগ্নদিণ্ডি, দ্বারপালগণ রয়েছেন। অপ্সরাগণ রথের বিভিন্ন অংশে নৃত্যে সংগীতে ও বাদ্যযন্ত্রাদি বাদনের অপরূপ ভঙ্গিতে রয়েছেন। তা ছাড়া দেবতাগণ, যক্ষ, গন্ধর্বগণ, আদিত্যগণ, বসুগণ, অশ্বিনীগণ, মারুতগণ সকলেই যথাস্থানে অবস্থান করছেন। মাথার ওপরে ছত্র, সেই আশ্চর্য পুরুষমূর্তি অবস্থান করছেন। শিরস্ত্রাণ তাঁর মস্তকে, কোমরবন্ধরূপে রয়েছে অভিয়ঙ্গ, পদতলের কনুইয়ের ঊর্ধ্ব পর্যন্ত পাদুকা শোভা পাচ্ছে।

শাম্বর অন্তরে গ্রহরাজের নানা বিস্ময়কর ও বিচিত্র কাহিনী উদিত হল। তিনি আভূমি নত হয়ে, সেই পুরুষমূর্তিকে প্রণাম করলেন, ভাবলেন, এই কি নারোদোক্ত সেই সূর্যক্ষেত্র? তবে কেমন করে এই সর্বদেবমান্য পরমাত্মাকে আমি আরাধনা করব? তাঁর তুষ্টিবিধান করে, শাপমুক্ত হব? তিনি কি মূর্তিমান রূপে আমার সামনে কখনও দেখা দেবেন? কেমন করে তাঁর আশীর্বাদ পাব? তিনি কি আমাকে সেই ব্রহ্মরূপ শব্দের দ্বারা, শাপমোচনের নির্দেশ দেবেন? এই চিন্তা ও জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে তাঁর অন্তরে যেন এক গভীর কল্পবোধ দৃঢ়তর হল। তিনি এই পরমাত্মার দুই পাশে তাঁর দুই পত্নী, রাজ্ঞি ও নিক্ষুভাকে দেখলেন। সকলেই যেন তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করে আছেন। শাম্বর অন্তর বারে বারে শিহরিত হতে লাগল।

এইরূপ চিন্তার মধ্যে, শাম্ব চারটি দ্বার প্রদক্ষিণ করে আবার নদীতীরে এসে দাঁড়ালেন। এই সময়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য তাঁর দৃষ্টিগোচর হল। দেখলেন, পূর্বাকাশব্যাপী রক্তাভার মধ্যে এক বিশাল সিন্দূর গোলকের ন্যায় সূর্য উদিত হচ্ছেন। একজন উজ্জ্বলবর্ণ পুরুষ, তাঁর সারা গায়ে জল, শুভ্র কেশ ও গুম্ফ ও শ্মশ্রু বিন্দু বিন্দু জলে চিকচিক করছে। সামান্য একখণ্ড সিক্ত ধুতি তাঁর পরিধানে। সদ্যোত্থিত সূর্যের আভায় সেই পুরুষের সর্বাঙ্গ যেন রক্তিম দেখাচ্ছে। তিনি নদীতীরে দাঁড়িয়ে, চোখ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে সূর্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করে আছেন। তাঁর করজোড় দুই হাত সূর্যের প্রতি প্রসারিত। তিনি কি কোনও মন্ত্রোচ্চারণ করছেন? কিন্তু তাঁর ঠোঁট নড়ছে না। কী করে তিনি রক্তবর্ণ তেজোদৃপ্ত সূর্যের দিকে অপলক দৃষ্টিপাত করে আছেন? শাম্বর ধারণা, এইরূপে মানুষের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। অথচ এই সদ্যোস্নাত উজ্জ্বল পুরুষের চোখে কোনওরকমে বিকার দেখা যাচ্ছে না।

শাম্ব সহসা তাঁর সামনে গেলেন না। অপেক্ষা করতে লাগলেন। ভাবলেন ইনিই কি সেই ব্যক্তি, যাঁর কথা গত রাত্রে হতমান অবিশ্বাসী ব্যাধিগ্রস্তরা বলছিল? কে ইনি? প্রকৃতই কি একজন ঋষি, যিনি সর্বদা রক্তমাংসের দেহ ধারণ করে সূর্যকে বেদোক্ত ভাষায় বন্দনা করেন? মহর্ষি নারদ বলেছিলেন, ঋষিগণ সে স্থানে বেদোক্ত প্রার্থনাদি আবৃত্তি করেন।

শাম্বর এই ভাবনার মধ্যেই সেই পুরুষ দুই হাত দিয়ে তাঁর দুই চোখ ধীরে মার্জনা করলেন। তারপর তীরের উচ্চভূমিতে উঠে, মন্দিরের দিকে না এসে, উত্তরদিকে গমন করলেন। শাম্ব যেন চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণে সেই পুরুষের পশ্চাতে অনুসরণ করলেন। মৃদুমন্দ বাতাসে নানা ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। পাখিরা যেন সদ্যোত্থিত সূর্যকে বন্দনা করে গান করছে। কিছুদূর যাবার পরে রমণীয় কানন মধ্যে একটি কুটির ও তপোবন দেখা গেল। শাম্ব সেই পুরুষকে আর অনুসরণ করতে যখন দ্বিধাগ্রস্ত, তখনই তিনি পিছন ফিরে শাম্বর দিকে তাকালেন। শাম্বর মনে হল, রৌদ্রোলোক তাঁকে অত্যুজ্জ্বল করেছে। আর অগ্রসর না হয়ে সেখান থেকেই নতজানু হয়ে, সেই পুরুষকে আভূমি প্রণাম জানিয়ে বললেন, ‘হে মহাভাগে অত্যুজ্জ্বল পুণ্যদেহ! আপনি আমার অপরাধ নেবেন না। আপনাকে আমি নদীতীরে সূর্য নমস্কার করতে দেখেছি। অন্তরে যথেষ্ট দ্বিধা থাকা সত্ত্বেও, আমাকে যেন কোনও অদৃশ্য শক্তি আপনার প্রতি আকর্ষণ করল। আমি আপনাকে অনুসরণ না করে থাকতে পারলাম না। হে মহাতপাঃ, আপনি আমাকে মার্জনা করুন।’

সেই পুরুষ প্রস্তরমূর্তির মতো অপলক চোখে শাম্বর দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিন্তু তৎক্ষণাৎ কিছুই বললেন না। তাঁর অপলক চোখের দৃষ্টি অতি তীক্ষ্ণ ও অন্তর্ভেদী। শাম্বর মনে হল, তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করে এই পুরুষ যেন তাঁর সমুদয় বিষয় অবগত হলেন। তথাপি শাম্ব এই তপোধনের অসন্তুষ্টির আশঙ্কায় হাত জোড় করে আবার বললেন, ‘মহাত্মন, আপনাকে অশেষতেজঃপ্রভাযুক্ত দেখছি। আমি মহাব্যাধি আক্রান্ত অভিশপ্ত। এই মহাক্ষণে আপনার দৃষ্টিকে আমি হয়তো আহত করেছি। আপনার পবিত্র অন্তরের শান্তিকে বিঘ্নিত করেছি! আপনি আমার প্রতি ক্রুদ্ধ হবেন না। আমি যেন এক অলৌকিক আকর্ষণের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে আপনাকে অনুসরণ করেছি। আপনি আমাকে অজ্ঞ জ্ঞানে ক্ষমা করুন।’

শাম্বর কথা শেষ হতেই অদূরে বহুকষ্ঠের কোলাহল শোনা গেল। পুরুষমূর্তি বললেন, ‘আমার সঙ্গে এসো।’

শাম্ব যেন নিজের শ্রবণকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। সদ্যোস্নাত উপাসক যে তাঁকে এক কথায় আহ্বান করবেন, এ কথা তিনি ভাবতে পারেননি। মহাপ্রভঃ ঋষি আবার পিছন ফিরে চলতে আরম্ভ করেছিলেন। শাম্ব তাঁর অন্তরে গভীর আস্থা অনুভব করে দ্রুত পায়ে ঋষিকে অনুসরণ করলেন। দূরে দক্ষিণের কোলাহল শুনে তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর সমব্যাধিগ্রস্ত সেইসব পুরুষ-রমণী বালক-বালিকারা বোধহয় নদীর জলে স্নান করছে। তারপরে মন্দিরে নমস্কার করে সদলে সবাই ভিক্ষে করতে বেরোবে।

ঋষি পুরুষ কুটির প্রবেশে উদ্যত হয়ে থমকিয়ে দাঁড়ালেন, পিছনে ফিরে তাকালেন। শাম্ব আগেই অনেকখানি দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। প্রভাযুক্ত পুরুষ বললেন, ‘তুমি তপোবন মধ্যে মুক্ত রৌদ্রে কোথাও বসো। তুমি স্নান করে এসেছ, দক্ষিণ-পূর্ব হয়ে বসো। অল্পক্ষণেই আমার পূজা সাঙ্গ হবে। তারপরে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব।’ এই বলে তিনি কুটির মধ্যে প্রবেশ করলেন।

শাম্ব প্রতিটি নির্দেশই যথাবিহিত পালন করলেন। তিনি ফুল-ফল সুশোভিত তরুবীথির ছায়া পরিত্যাগ করে দক্ষিণ-পূর্বে মুখ করে মুক্ত রৌদ্রে উপবেশন করলেন। এ স্থানমাহাত্ম্য কি না তিনি বুঝতে পারলেন না, যুগপৎ তাঁর অন্তরে এক অনুশোচনা ও অনির্বচনীয় আনন্দবোধ তরঙ্গায়িত হতে লাগল। অনুশোচনা এই কারণে, তিনি এমন আশ্চর্য রমণীয় তপোবনে কখনও একান্ত একলা বসেননি। এর মধ্যে যে এক মহত্তর আনন্দ ও সৌন্দর্যবোধ বিরাজ করছে, আগে কখনও অনুভব করেননি। ভোগ, বীরত্ব, শত্রুনিধন, ক্ষত্রিয় ধর্মপালন এ সবই তিনি জানতেন। কিন্তু অভিজ্ঞতার স্বরূপ অনন্য। কেন তিনি আগেই এই অনন্য সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেননি! এই অনুশোচনা তাঁর মনে জাগছে, এবং এক অনির্বচনীয় আনন্দের ধারা প্রতি মুহূর্তে তা ধৌত করে দিচ্ছে।

নারদোক্ত বৃষ্ণিব্যাঘ্র যেভাবে বসেছিলেন, সূর্য তাঁর মুখোমুখি ছিলেন না, অথচ সর্বাঙ্গে রৌদ্র স্পর্শ করছিল। তিনি নদী, পরবর্তী তীর এবং দূরের আকাশে তাকিয়ে রইলেন, এবং ক্রমে এক ভাবাবেশে তিনি চোখ মুদ্রিত করলেন। তাঁর চোখের সামনে কুসুমের বর্ণ দুলতে লাগল। কতক্ষণ তিনি এভাবে ছিলেন, অনুমান করতে পারেন না। হঠাৎ শুনলেন, ‘এই নাও, এই ফলমূলাদি খাও। যৎসামান্য মিষ্টি খেয়ে জলপান করো।’

শাম্ব সংবিৎ ফিরে পেয়ে দ্রুত গাত্রোত্থানে উদ্যত হলেন। সেই প্রভাযুক্ত ঋষি তাঁর সামনে জলপদ্মের পাতায়-ফলমূল মিষ্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শাম্বকে গাত্রোত্থানে উদ্যত দেখে, নিরস্ত করে বললেন, ‘তোমাকে উঠতে হবে না। যেখানে বসে আছ, সেখানেই বসো। এই নাও, এই যৎসামান্য ফলমূলাদি খাও। তুমি নিশ্চয় ক্ষুধার্ত। তার আগে একবার গ্রহরাজকে প্রণাম করো।’

শাম্ব সূর্যকে আভূমি নত হয়ে প্রণাম করলেন। তারপরে ঋষির প্রতি হাত প্রসারিত করলেন। ভেবেছিলেন, প্রভাযুক্ত ব্রাহ্মণ নিশ্চয়ই জলপদ্মের পাতা তাঁর দিকে ছুড়ে দেবেন। কিন্তু তিনি তা আদৌ করলেন না। যেমনভাবে একজনকে পাতায় খাদ্য পরিবেশন করতে হয়, তেমনি ভাবেই শাম্বর সামনে তা ভূমিতে রাখলেন। তাঁর বাঁ হাতে ছিল একটি মৃত্তিকার জলপূর্ণ পাত্র। সেটিও পাতার পাশে রাখলেন, বললেন, ‘খাও। আমি বসছি। তোমার খাওয়া হলে, বৃত্তান্ত শুনব।’

শাম্বর হৃদয় অতি আকুঞ্চিত হয়ে, নিশ্বাস অতি গভীরে আবর্তিত হল, এবং মনে হল, তাঁর চোখ ফেটে জল আসবে। হতভাগ্যের মতো অনেকগুলো দিন অতিবাহিত করবার পরে এইরকম প্রভাযুক্ত একজন উজ্জ্বল ঋষি পুরুষ তাঁকে স্বহস্তে খাদ্য পরিবেশন করলেন, সুবাক্য বললেন, এবং তাঁর মুখের অভিব্যক্তিতে বিন্দুমাত্র ঘৃণার কুঞ্চন দেখা গেল না। তিনি যেন একজন বিকলাঙ্গ কুৎসিত কুষ্ঠরোগগ্রস্তের সামনে নেই, এমনই স্বাভাবিক, বরং তার অধিক, শান্ত সৌম্য তার মুখভাব, আচরণ আশ্চর্য অনায়াস ও ভব্যযুক্ত।

শাম্ব অতি কষ্টে তাঁর হৃদয়াবেগ দমন করলেন ও অশ্রুসংবরণ করলেন। দেখলেন তাঁর কপালে চন্দ্রভাগা তীরের মৃত্তিকারই একটি গোলাকার ফোঁটা চিহ্ন। মাথায় সুদীর্ঘ চুলে এক খণ্ড বস্ত্র জড়িয়ে চূড়ার মতো বাঁধা। তাঁর শুভ্র শ্মশ্রু যেন উজ্জ্বল রৌপ্যের ন্যায়, মুখমণ্ডলে সুবর্ণ দীপ্তিতে কোথাও বার্ধক্যের বলিরেখা পড়েনি। ইনিই প্রকৃত মহর্ষি নারদোক্ত অত্যুজ্জ্বল পরমাত্মা গ্রহরাজ নন তো? কায়ারূপ ধারণ করে শাম্বকে আচ্ছন্ন করছেন না তো?

প্রভাযুক্ত পুণ্যদেহধারী আবার বললেন, ‘খাও। খাওয়া হলে তোমার সঙ্গে আমি কথা বলব।’

শাম্ব আবার করজোড়ে তাঁকে নমস্কার জানিয়ে, ফল মুখে দিলেন। কিন্তু তাঁর হৃদয় মধ্যে সেই আবর্ত বারে বারে আকুঞ্চিত হতে লাগল এবং চোখ জলে ভরে উঠতে চাইল। তিনি নিজেকে অতি কষ্টে সংবরণ করলেন, এবং অমৃতবৎ ফলমূলাদি খেতে লাগলেন। প্রভাযুক্ত ঋষি নিকটেই একটি আমলকী বৃক্ষমূলে উপবেশন করলেন এবং নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শাম্ব দুগ্ধজাত মিষ্টি খেয়ে, জলপান করলেন। ঋষি তাঁর দিকে ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাকে আমি গতকাল এখানে দেখিনি।’

শাম্ব বললেন, ‘আমি গত সন্ধ্যায় এখানে এসে পৌঁছেছি।’

ঋষি পুরুষ বললেন, ‘তোমাকে দেখে, আমি সেইরকমই অনুমান করেছি। কিন্তু এখানে তোমার মতো যারা আসে, তারা সকলেই জীবনের প্রতি বিশ্বাসহীন বীতশ্রদ্ধ অসংযমী হয়ে যায়। তাদের কথাবার্তা আর পূর্বের সুস্থ জীবনের মতো থাকে না। আচরণও বদলে যায়। তোমাকে আমি তার ব্যতিক্রম দেখলাম।’

শাম্ব বললেন, ‘আমি সাত ঋতু অতিক্রম করে এখানে এসে পৌঁছেছি। আমি শত শত গ্রাম জনপদ ও নগরীর মধ্যে দিয়ে এসেছি। অধিবাসীদের আমাকে দেখে ভয় ও ঘৃণার জন্য, তাদের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র রাগ হয়নি। আমি নিজেকে দিয়েই তাদের মনোভাব বিচার করেছি। তথাপি তারা আমাকে খেতে দিয়েছে। দুরন্ত বর্ষায়, তীব্র শীতে, খামারে গোয়ালের ধারে বহির্বাটির মাথাঢাকা দাওয়ায় থাকতে কোনও বাধা দেয়নি। সারমেয়কুল সর্বত্রই একরকম এবং অবোধ বালক-বালিকাগণও। তারা আমাকে নানাভাবে তাড়না করেছে, পীড়ন করেছে। কিন্তু আমি রাগ করিনি। পরমাত্মার কাছে তাদের সুমতির প্রার্থনা করেছি। তবে হে মহাত্মন, গৃহত্যাগ করার পরে, আপনার মতো দয়াময় ব্যক্তির সাক্ষাৎ আমি এই প্রথম পেলাম; তাতে আমার এই প্রত্যয় জন্মেছে, হয়তো আমি সিদ্ধিলাভ করতে পারব।’

‘সিদ্ধিলাভ? কীসের সিদ্ধিলাভ?’

‘শাপমোচন।’ কথাটি উচ্চারণ করেই, শাম্ব যেন সহসা বিব্রত বোধ করে আবার বললেন, ‘আরোগ্যলাভই আমার সিদ্ধি।’

প্রভাযুক্ত ঋষি কয়েক মুহূর্ত শাম্বর দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই স্থানের কথা তোমাকে কে বলেছে, কী বলেছে?’

শাম্ব এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বললেন, ‘যিনি সকল বর্ষসমূহ ও অন্তরীক্ষ ভ্রমণ করেছেন, সেই মহর্ষি নারদ।’

‘নারদ!’ প্রভাযুক্ত পুরুষ বিস্মিত স্বরে উচ্চারণ করলেন, জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় তোমার সঙ্গে মহর্ষির সাক্ষাৎ হয়েছিল? তোমার পরিচয়ই বা কী?’

শাম্ব মৌনাবলম্বন করে মাথা নত করলেন। প্রভাযুক্ত পুরুষ তীক্ষ্ণ চোখে শাম্বকে দেখলেন, কিন্তু তিনি ক্রুদ্ধ হলেন না, বরং কোমল স্বরে বললেন, ‘পরিচয় দিতে যদি কুণ্ঠা থাকে, তবে থাক। হয়তো এই তোমার উপযুক্ত কাজ।’

শাম্ব প্রকৃতই কুণ্ঠাবোধ করছিলেন। তিনি যে বাসুদেবতনয়, এই পরিচয় দেওয়ার অর্থ এক সুদূরপ্রসারী কৌতূহল ও জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করা। একমাত্র বংশপরিচয়ের দ্বারা অপরের উৎসাহকে তিনি বৃদ্ধি করতে চান না। কিন্তু এই মহাত্মা এ-কথা কেন বললেন, ‘হয়তো এই তোমার উপযুক্ত কাজ?’ শাম্ব বললেন, ‘আপনি আমাকে মার্জনা করবেন, অসন্তুষ্ট হবেন না। এখন আমার একমাত্র পরিচয়, আমি অভিশপ্ত। শাপমোচনের দ্বারা মোক্ষ লাভই আমার লক্ষ্য।’

প্রভাযুক্ত ঋষি বললেন, ‘বুঝেছি। তোমার যদি আপত্তি না থাকে, তবে মহর্ষি নারদ তোমাকে কী বলেছিলেন, কী নির্দেশ দিয়েছেন তা আমি শুনতে চাই।’

শাম্ব নির্দ্বিধায় নারদোক্ত সূর্যক্ষেত্র ও তার বর্ণনাদি এবং এখানে আগমন করে চন্দ্রভাগায় স্নান ইত্যাদি সব কথাই বললেন। তাঁর গতকাল অতিসায়াহ্নে আগমন, হতমান অবিশ্বাসী রোগগ্রস্তদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও রাত্রিবাসের বর্ণনা দিলেন এবং তারা এই প্রভাযুক্ত ঋষির বিষয়ে কী বলেছে, তাও বললেন। বর্ণনা দিলেন, আজ অতি প্রত্যুষে চন্দ্রভাগায় স্নান করে, সূর্যক্ষেত্র দর্শনের পর, মহাত্মার দর্শন, এই রমণীয় কানন ও তপোবন তাঁর মনে কী গভীর শান্তি ও অনির্বচনীয়তা এনে দিয়েছে। তিনি বারে বারে মহাত্মার প্রশস্তি করে বললেন, ‘আপনি যদি বিরক্ত বা ক্রুদ্ধ না হন, তা হলে এক বিষয়ে আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।’

প্রভাযুক্ত ঋষি প্রসন্ন মুখে বললেন, ‘একটা কেন, তোমার যা জিজ্ঞাস্য আছে, করো। আমি সাধ্যমতো জবাব দেব।’

শাম্ব বললেন, ‘আমি দেখলাম, আপনি সূর্যদেবকে নমস্কার করে, কুটিরে গমন করলেন। মন্দিরের বিগ্রহকে তো আপনি পূজা করলেন না?’

ঋষি হেসে বললেন, ‘তুমি গতকালই রাত্রে, আস্তানার কুষ্ঠরোগীদের কাছে শুনেছ, মন্দিরের বিগ্রহের পূজা হয় না। আমার ওই পরমাত্মা বিগ্রহকে পূজা করার কোনও অধিকার নেই। বেদ বলেছেন, গ্রহরাজ সূর্য সর্বদেবমান্য, সর্বভূতমান্য, সর্বশ্রুতিমান্য। বেদে আমার অধিকার থাকলেও বিগ্রহপূজা সকল শ্রেণীর দ্বারা সম্ভব না। বিশেষত আমি দেবলক ব্রাহ্মণ, আমার বিগ্রহ পূজা নিষেধ। কিন্তু আমি এই মিত্রবনে বাস করি, অতি প্রাচীনকাল থেকে এ স্থান সূর্যলোক নামে খ্যাত, আমি প্রতিদিন গ্রহরাজেরই পূজা করি। প্রাচীনতম কালে যখন এই গ্রহরাজের কোনও মূর্তি কল্পনা করা হয়নি, তখন একটি রক্ত মণ্ডলাকার অঙ্কন দ্বারা সর্বত্র তাঁর উপাসনার প্রচলন ছিল। আমি প্রতিদিন একটি মণ্ডলাকার অঙ্কন করে সবিত্রের উপাসনা করি।’

শাম্ব নতুন বৃত্তান্ত শুনে অবাক হলেন, তাঁর কৌতূহল বর্ধিত হল। তিনি বললেন, ‘মহাত্মন, মহর্ষির কথা শুনে আমি ভেবেছিলাম এখানে এসে আমি গ্রহরাজকে কায়ারূপে দর্শন করব। এখন বুঝতে পারছি, আমি মহর্ষির কথা অর্বাচীনের ন্যায় ভেবেছি। আপনি আমাকে অনুগ্রহ করে বলুন এই গ্রহরাজের মূর্তি কীভাবে, কবে থেকে মন্দিরে বিগ্রহের ন্যায় কল্পিত হয়েছিল?’

ঋষি প্রীত হয়ে বললেন, ‘যে সব মহাপুরুষগণ এই পৃথিবী নামক গ্রহকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান অবস্থাপ্রাপ্ত হতে দেখেছেন, তাঁরা বলেছেন, এই গ্রহরাজ আদি ও অনন্ত। তিনিই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা, রক্ষাকর্তা এবং নিয়ন্তা। তিনি ভয়ংকর কিন্তু শান্ত। তিনি প্রচণ্ড অগ্নিময়, কিন্তু জীবের জীবনধারণের কারণ। আমরা বিভিন্ন রূপে তাঁকে পূজা করেছি, বিভিন্ন নামে তাঁকে অভিহিত করেছি। আমাদের স্বভাব এইরকম যে যাকে আমরা ঈশ্বর রূপে ধ্যান করি, তাঁকে নিজেদের মনোমতো একটি রূপ দিতে চাই। সেই রূপ হওয়া চাই অতি তেজোদৃপ্ত, মহাবলশালী, অতি ক্ষমতাসম্পন্ন। গ্রহরাজের এক নাম আমরা দিয়েছি, ‘বিবস্বান’। কে এই বিবস্বান, তুমি কি জানো?’

শাম্ব অতিশয় চমৎকৃত হয়ে বললেন, ‘আমি সূত মুখে এক অতি পরাক্রান্ত গন্ধর্বরাজ বিবস্বানের নাম শুনেছি। তিনি ছিলেন এই ভারতবর্ষ ও ইলাবৃতবর্ষের মধ্যস্থল পর্বতের অন্তরীক্ষবাসী। তাঁর সন্তানগণের নাম বৈবস্বত মনু, যম, যমী, সাবর্ণি মনু আর অশ্বিদ্বয়। আমি আরও শুনেছি, এই মহাবল গন্ধর্বরাজ চাক্ষুষ মন্বন্তরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইক্ষ্বাকু এই বিবস্বানেরই বংশধর ছিলেন। পরবর্তীকালে এই ইক্ষ্বাকু রাজের বংশধরেরা সূর্যবংশীয় নামে খ্যাত ছিলেন।’

ঋষিপুরুষ অতি প্রসন্ন ও বিস্মিত মুগ্ধ চোখে শাম্বর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি পরিচয় না দিলেও, আমি ঠিকই অনুমান করেছি, তুমি কোনও খ্যাতনামা সদ্‌বংশজাত; নিতান্ত অর্বাচীন নও। তুমি যা শুনেছ, আর মনে রেখেছ, তা অতীব সত্য। সেই গন্ধর্বরাজ বিবস্বান এমনই পরাক্রান্ত মহাবলশালী তেজোদৃপ্ত ছিলেন যে, সেই কালের লোকেরা তাঁকে গ্রহরাজ সূর্যের সঙ্গে তুলনা করতেন। কালে এমনই হল, বিবস্বান বললে সূর্যকে বোঝায়, আবার রাজাকেও বোঝায়। সেই কারণেই ইক্ষ্বাকুবংশকে সূর্যবংশ বলা হয়। কিন্তু আমরা গ্রহরাজকে বিবস্বান নামে অভিহিত করলাম। তাঁর বহু নামের মধ্যে এইটি একটি। গ্রহরাজের বর্তমান যে-মূর্তি কল্পিত হয়েছে, তা গন্ধর্বরাজ বিবস্বানের ন্যায় হওয়া বিচিত্র নয়। বিশ্বকর্মা সম্প্রদায়ের শিল্পীগণ অতিশয় পরিশ্রমী ও গুণী। তাঁরাই এই কল্পনাকে মূর্তির রূপদান করেছেন। তাঁরা বিবিধ যন্ত্রের ব্যবহার জানেন। তাঁদের চাক্ষুষ সৃষ্টি মানুষের মনে মায়ার সঞ্চার করতে সক্ষম।’

শাম্ব বিস্মিত ও উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ‘আমি আপনার কথার সমুদয় অর্থ হৃদয়ঙ্গম করেছি। এখন আমি জানতে ইচ্ছা করি, এখানে কে এই সূর্যক্ষেত্র সৃষ্টি করলেন, মন্দিরই বা কার সৃষ্টি। এই পরম রমণীয় কাননই বা কে সৃষ্টি করেছেন?’

ঋষি বললেন, ‘আমি যাবৎকাল এখানে এসে বাস করছি, তখন থেকেই এ-সব দেখছি। আমাদের বংশে চর্মরোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। আমি আমার পূর্বপুরুষগণের কাছে শুনেছি, এই স্থানকে গ্রহরাজের মূলস্থান বলা হয়। আরও শুনেছি, গ্রহরাজের এটি অস্তাচলমানস্থান। তিনি যখন এই ভূমণ্ডলের চক্রে অন্য পৃষ্ঠে আলোক দান করেন, তখন এখানে তাঁর শেষ কিরণের একটি গুণ কার্যকরী হয়।’

শাম্ব সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দয়া করে আমাকে বলুন, শেষ কিরণের সেই গুণ কী? অস্তাচলমানস্থানই কী? কাকেই বা মূলস্থান বলে?’

ঋষি বললেন, ‘এই ক্ষেত্রকে মূলস্থান কল্পনা করা হয়েছে। অস্তাচলমানস্থান বলা হয়, কারণ, গ্রহরাজ যখন ত্রিগুণ সীমাতিক্রান্ত হন তখন তিনি ‘পুরুষ’ রূপে অভিহিত হন। তাঁর সেই অস্তাচলাভাব বিবিধ চর্মরোগ, দেহের বিকৃতি বিনাশ করে। আমি অস্তাচলগামী গ্রহরাজের পূজা প্রতিদিন স্নানাদি শেষে করে থাকি।’

শাম্বর অন্তর আশার আলোয় উদ্ভাসিত হল। তিনি অধিকতর আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গ্রহরাজের কিরণের কি এরূপ আরও স্থান ও কাল বিভাগ আছে?’

ঋষি পুরুষ বললেন, ‘আছে। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই তোমাকে বলছি। এই মহাদেশের পূর্বাঞ্চলে লবণদধি তীরে উদয়াচলে তিনি প্রথম আবির্ভূত হন। সেখানে তিনি পূর্বোওর কোণে উদিত হন, সেজন্য তাঁকে সেখানে কোণাদিত্য বলা হয়। এই আদ্যস্থানে তিনি পশ্চিম-দক্ষিণে অস্তাচলে যান। যমুনার দক্ষিণ ভাগে দ্বারকার নিকটবর্তী স্থানে তিনি মধ্যাহ্নে তাবস্থান করেন। তখন তিনি কালপ্রিয় নামে অভিহিত হন। মহাব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য, এই তিন স্থানে, তিন কালে তাঁর প্রভা অঙ্গে ধারণ কর বিধেয়।’

শাম্ব মনে মনে সংকট অনুভব করে, ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এক উদয় থেকে অস্তকালের মধ্যে, এই সুদূরবর্তী তিন স্থানে তিন কালে কী করে মানুষের পক্ষে গমনাগমন সম্ভব?’

ঋষি শাম্বকে আশ্বস্ত করে হেসে বললেন, ‘সম্ভব না। সম্‌বৎসরে এই তিন কালকে ভাগ করে তিন স্থানে তোমাকে অবস্থান করতে হবে। আমিও করেছি।’

শাম্ব প্রভাযুক্ত ঋষিকে প্রণাম করে বললেন, ‘আপনাকে দর্শনমাত্রেই আমি অনুভব করেছিলাম, আপনি অশেষগুণসম্পন্ন উজ্জ্বল পুরুষ। আপনি জ্ঞানী, মুক্ত পুরুষ। আপনার সান্নিধ্য অতি আনন্দদায়ক। আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন, যেন আমি এই ত্রিক্ষেত্রে গমন করতে পারি।’

ঋষি স্বস্তিবাক্য উচ্চারণ করে বললেন, ‘তোমার বিশ্বাসই তোমাকে উত্তরণের পথে নিয়ে যাবে। তার আগে, তোমার আরও একটি বিশেষ পরিশ্রমসাধ্য কাজ করতে হবে।’

‘মহাত্মন, আমি শ্রমবিমুখ নই। আপনি আমাকে আজ্ঞা করুন, প্রাণপণে আমি তা পালন করব।’

‘আজ্ঞার বিষয় কিছু না, তোমারই কল্পকর্মের কথা আমি বলছি। যে-দ্বাদশ নামে গ্রহরাজ অভিহিত হয়ে থাকেন, আমি সেই নাম সকল বলছি। আদিত্য, সবিত্র, সূর্য, মিহির, অর্ক, প্রভাকর, মার্তণ্ড, ভাস্কর, ভানু, চিত্রভানু, দিবাকর, রবি। এই দ্বাদশ নাম এবং দ্বাদশ রূপে তিনি দ্বাদশ মাসে দ্বাদশ তীর্থ ও নদ নদীতে, অতি ক্রিয়াশীল থাকেন। দ্বাদশ মাসে, দ্বাদশ দিন সেই সব নদ নদীতে স্নান ও রশ্মিযুক্ত হলে, ব্যাধির আরোগ্য ঘটে।’

শাম্ব ব্যগ্র কৌতুহলে জানতে চাইলেন, ‘সেই দ্বাদশ তীর্থ ও নদ নদীর নাম আপনি দয়া করে বলুন।’

ঋষি বললেন, ‘এই চন্দ্রভাগা তার মধ্যে একটি। এ ছাড়া, তোমাকে যেতে হবে পুষ্কর, নৈমিষ্য, কুরুক্ষেত্র, পৃথুদক, গঙ্গা, সরস্বতী, সিন্ধু, নর্মদা, পয়স্বিনী, যমুনা, তাম্রা, ক্ষিপ্রা এবং বেত্রবতী। এই সমস্ত অঞ্চলই উত্তর অংশে, বিন্ধ্যপদে, দক্ষিণের উত্তরাঞ্চল সীমানায়। তুমি প্রত্যেক স্থানে একদিন অবস্থান করলেও, আমার মনে হয় ছয় ঋতু অতিক্রম করবে। সাত ঋতুতে তুমি এখানে পৌঁছেছ। আরও ছয় ঋতু এইভাবে পরিভ্রমণ করা তোমার পক্ষে সম্ভব কি না তোমারই বিচার্য।’

শাম্ব অতি উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘মহাভাগে, আপনি আশীর্বাদ করুন, আমি নিশ্চয়ই পারব। আপনি আমাকে আর কিছু নির্দেশ দেবেন?’

ঋষি বললেন, হ্যাঁ, আমি শুনেছি, প্রতি মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথিতে গ্রহরাজের প্রভা উজ্জ্বলতর হয়। এই দিনটি উপবাস করা বিধেয়।’

শাম্ব দ্বিধাভরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মহাত্মন, আপনি বলছেন, ‘আমি শুনেছি’, আপনি হৃষ্ট মনে আমাকে জবাব দিন, কোথায় কার কাছে শুনেছেন? আপনার পূর্বপুরুষদের নিকট?’

ঋষি হাস্য করে মাথা নাড়লেন, বললেন, ‘না। তুমি দ্বাদশস্থান পরিভ্রমণ করে আসার পরে, আমি তোমাকে নতুন বৃত্তান্ত বলব।’

শাম্ব করজোড়ে বললেন, ‘আমার মহাভাগ্য। আমি আপনাকে আর একটি কথা বলব। আমি গতকাল অতিসায়াহ্নে যখন এখানে এলাম, টিলার মৃত্তিকা গহ্বরে ও পাতার কুটিরে ব্যাধিগ্রস্ত হতাশ অবিশ্বাসীদের দেখে, আমার অন্তর বিষাদে পূর্ণ হয়েছে। আপনার উপদেশ ওরা গ্রহণ করেনি। আমি এক হতভাগ্য, ওরা যেন আরও অধিক হতভাগ্য। আমি ওদের জন্য এতই বিচলিত বোধ করছি, কেবলই মনে হচ্ছে, ওরাও কি দ্বাদশ স্থানে যেতে পারে না? আরোগ্য লাভ করতে পারে না? আমি কি ওদের সঙ্গে আহ্বান করতে পারি না?’

প্রভাযুক্ত ঋষি সহসা কোনও কথা বললেন না, অপলক নিবিড় চোখে শাম্বর মুখের দিকে তাকালেন। শাম্বর চোখের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন। শাম্বর ব্যাধিগ্রস্ত বিশাল শরীরের প্রতি লক্ষ করলেন। শাম্ব অন্যায় আশঙ্কায় ক্ষমা প্রার্থনা করতে উদ্যত হলে, তিনি হাত তুলে তাঁকে নিরস্ত করে বললেন, ‘আমি তোমার কথায় বিরক্ত হওয়া দূরে থাক, অত্যন্ত বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছি। তুমি যে-ই হও, আমার বিশ্বাস, তোমার শাপমোচন ঘটলে, তার সঙ্গে কোনও মহৎ কর্মেরও সাধন হবে। অন্যথায় এ চিন্তা তোমার মনে উদিত হত না। ওই সব কুটিরের অধিবাসীদের প্রতি আমি বিমুখ নই। তোমাকে আমি যা যা বলেছি, ওদেরও তা বলেছি। হতভাগ্য অবিশ্বাসীরা মানেনি। তুমি যদি ওদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারো, এক বিশাল জনসংখ্যা আস্তে আস্তে রোগমুক্ত হতে পারে। তুমি যদি ওদের সম্মত করাতে পারো, তা হলেই সার্থক।’ এই বলে ঋষি বৃক্ষমূল থেকে গাত্রোত্থান করে বললেন, ‘তুমি কাছেপিঠে যদৃচ্ছা ঘুরে বেড়াও। স্থানীয় অধিবাসীরা আমাকে তণ্ডুল ফলমূলাদি দেয়। এক গোপরমণী দুধ ও দুগ্ধজাত ক্ষীর মিষ্টান্ন দেয়। আমি দিনান্তে একবার স্ব-পাকে রান্না করি। অস্তগামী আদিত্যের পূজা ও মন্ত্রোচ্চারণ করে, অন্নগ্রহণ করি। তুমিও আমার অন্নের ভাগ গ্রহণ করবে।’

শাম্ব আবার আভূমি নত হয়ে ঋষিকে প্রণাম করলেন। ঋষি তাঁর কুটিরে গমন করলেন। শাম্বও গাত্রোত্থান করলেন, কিন্তু বেশি দূরে কোথাও গেলেন না। চন্দ্রভাগা তীরে গিয়ে, জলের সামনে বসে, ঋষির কথিত কর্তব্যকর্ম বিষয়ে ভাবতে লাগলেন। আর মনে মনে বললেন, ‘হে বিশ্বের স্রষ্টা, নিয়ন্তা, তুমি আমাকে শক্তি দাও, শক্তি দাও।’

শাম্ব সূর্যাস্তের পরে, ঋষির পূজা শেষে, তাঁর কাছ থেকে অন্ন গ্রহণ করে, রাত্রের মতো বিদায় চাইলেন। ঋষি তাঁকে বললেন, ‘তুমি এখন ওই টিলার গায়ে যাবে। সাবধানে থেকো। এই মিত্রবনের কোথাও তুমি একটি কুটির নির্মাণ করে থাকো এই আমার ইচ্ছা। তবে তার আগে তুমি দ্বাদশস্থানে ঘুরে এসো, এবং সেই অবিশ্বাসীদের যদি সম্মত করাতে পারো, তার চেষ্টা পাও।’

শাম্ব ঋষিকে প্রণামপূর্বক বিদায় নিয়ে, নদীতীরের সেই বিস্তৃত টিলা অঞ্চলে উপস্থিত হলেন। অন্ধকার নেমে এসেছে। অগ্নিকুণ্ডগুলো জ্বলছে, এবং সেই আলোয় দেখা গেল, পুরুষ-রমণীগণ বালক-বালিকাগণ ইতস্তত গুচ্ছ গুচ্ছ বসে আছে। দেখেই বোঝা যায়, তাদের রান্না খাওয়া সবে শেষ হয়েছে। তখনও কেউ কেউ খাচ্ছিল। শাম্বকে দেখে সবাই ব্যঙ্গবিদ্রূপপূর্ণ বাক্যে কলরব করে উঠল। একজন চিৎকার করে বলল, ‘নীলাক্ষি, গতকালের সেই লোকটা ভোর রাত্রেই কোথায় চম্পট দিয়েছিল, আবার এখন ফিরে এসেছে। নিশ্চয়ই ও আজ তোমার খাবারে আবার ভাগ বসাতে এসেছে।’

‘আজ হয়তো ও সারাদিন না খেয়ে বুঝেছে, নীলাক্ষির সঙ্গে থাকাই ভাল।’ আর একজন বিদ্রূপ করে বলল।

একজন কাছে এসে বলল, ‘তোমার সঙ্গে কি ওই ঋষি লোকটার দেখা হয়েছিল? নিশ্চয়ই অনেক জ্ঞান দিয়েছে?’

শাম্ব বললেন, ‘উনি একজন প্রকৃত জ্ঞানী। তবে উনি আমাকে কিছু উপদেশ দিয়েছেন।’

শাম্বর আশেপাশে যারা ছিল, আর তাঁর কথা শুনতে পেল, সবাই হইহই করে উঠল, ‘হতেই হবে, হতেই হবে। ও ব্যাটা যাকে পায়, তাকেই গুচ্ছের উপদেশ দেয়। তোমরা শোনো, একেও সেই ঋষি লোকটা অনেক উপদেশ দিয়েছে।’

শাম্ব গম্ভীর অথচ দৃঢ়স্বরে বলে উঠলেন, ‘থামো। তিনি একজন প্রকৃতই জ্ঞানী। তাঁর সম্পর্কে তোমরা সংযত বাক্য উচ্চারণ করো।’

শাম্বর গম্ভীর অথচ দৃঢ় স্বরে এমনই একটি প্রত্যয় ছিল, সকলেই কেমন সচকিত বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনও কথা বলল না। কিছুক্ষণ পরে একজন বলে উঠল, ‘এ লোকটা রাজরাজড়া ঋষিদের মতো কথা বলে। এও নিশ্চয়ই আমাদের কোনও জ্ঞান দেবে।’

‘না, আমি তোমাদের কোনও জ্ঞান দেব না।’ শাম্বর স্বর যেন গম্ভীর শঙ্খের নিনাদে ধ্বনিত হল, ‘আমি তোমাদের একটিমাত্র অনুরোধ করব।’

সকলেই কিছুটা হতবাক বিস্ময়ে নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। এই সময়ে নীলাক্ষি তার শিশুটিকে বুকে নিয়ে শাম্বর সামনে এসে দাঁড়াল। তার ক্ষয়-ক্ষত স্ফীত ঠোঁটে বিস্ফারিত হাসি। শাম্ব শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নীলাক্ষি, তোমার আজ ভিক্ষার ঝুলি পূর্ণ হয়েছে তো?’

নীলাক্ষি ঠোঁট কুঞ্চিত করে বলল, ‘ওসব পূর্ণটুর্ণ জানি না। ঝুলি কোনওদিনই ভরে না, লোকে ঠ্যাঙা নিয়ে তাড়া করে আসে। কিন্তু তুমি কী যেন বলছিলে?’

‘ও আমাদের কী একটা অনুরোধ করবে।’ কয়েকজন সমস্বরে বলে উঠল, ‘ওর ভাবগতিক মোটেই সুবিধের না। ও নিশ্চয়ই আমাদের জ্ঞান দেবার তালে আছে।’

শাম্ব দৃঢ় এবং কিছুটা তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, ‘না, আমি তোমাদের কোনও জ্ঞান দেব না। তোমরা ভুলে যাচ্ছ, আমিও তোমাদের মতোই মহাব্যাধিগ্রস্ত দুর্ভাগা অভিশপ্ত। তোমাদের সঙ্গে আমার কোনও প্রভেদ নেই, প্রভেদ শুধু একটাই—’

‘যে তুমি ঋষি রাজরাজড়াদের মতন কথা বলো।’ কয়েকজন বাধা দিয়ে বলে উঠল।

শাম্ব সেই কয়েকজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘না। প্রভেদ এই, তোমরা বিশ্বাস হারিয়েছ, আমি এখনও বিশ্বাস হারাইনি।’

‘কীসের বিশ্বাস? আমাদের আবার কীসের বিশ্বাস থাকতে পারে?’ সমস্বরে রমণী পুরুষ বলে উঠল।

শাম্ব কয়েক মুহূর্ত প্রায় সকলের মুখের দিকে যেন আলাদা আলাদা করে তাকালেন, বললেন, ‘আরোগ্যলাভের বিশ্বাস।’

‘তখনই বলেছিলাম লোকটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটা জ্ঞান দেবে!’ কয়েকজন লাফালাফি করে বলে উঠল, ‘ও আমাদের বিশ্বাস করতে বলছে, আমরা ভাল হয়ে যাব।’

সবাই নানা ইতর ভাষা উচ্চারণ করে, বিকৃত উচ্চ স্বরে হাসতে লাগল, আর ধিক্কারের ভঙ্গিতে বলতে লাগল, ‘মিথ্যা স্তোর্ক, মিথ্যা মিথ্যা মিথ্যা।’…

শাম্ব শান্ত ভাবে অপেক্ষা করলেন। যখন ওরা কিঞ্চিৎ শান্ত হল, তখন তিনি বললেন, ‘একটু ধৈর্য ধরে শোনো, আমরা সমগোত্রীয়, সকলেই সমান। সংসারের সব মানুষ আমাদের কারওকে আলাদা চোখে দেখে না। আমার জীবনে যা সত্য, তোমাদের জীবনেও তা সত্য। তবে কেন তোমাদের আমি মিথ্যা কথা বলব। তোমরা ব্যাধিগ্রস্ত হয়েও যদি সম্পদশালী হতে, তা হলে আমি তস্করের ন্যায় মিথ্যা কথা বলতে পারতাম, ছলনা করতে পারতাম। এক্ষেত্রে তারও কোনও সম্ভাবনা নেই।’

সকলের মধ্যে একটা দ্বিধাগ্রস্ত ভাব দেখা দিল। একজন বৃদ্ধা কাছ থেকে বলল, ‘এটা ঠিক, আমাদের ঠকাবার কিছুই নেই। আর ও আমাদের মতনই একজন কুষ্ঠরোগী।’

‘কিন্তু ও যে কী সব বিশ্বাস-ফিশ্বাসের কথা বলছে। ও-সব তো মিথ্যা। ছলনা।’ একজন বলে উঠল।

শাম্ব বললেন, ‘কখনওই না। যার বিশ্বাস হারায়, তার সবই হারিয়ে যায়।’

‘আমাদেরও সবই হারিয়ে গেছে।’ কয়েকজন সমস্বরে বলে উঠল, ‘আমাদের আর কোনও কিছুতে বিশ্বাস নেই।’

শাম্ব বললেন, ‘আমার সঙ্গে তোমাদের এই প্রভেদের কথাই বলছিলাম। আমি বিশ্বাস করি, আমার পাপই আমাকে বিনাশ করতে উদ্যত হয়েছে, আর একমাত্র মুক্তির উপায়, দুস্কর প্রায়শ্চিত্ত। এই আমার বিশ্বাস।’

‘কী সেই প্রায়শ্চিত্ত?’ নীলাক্ষি জিজ্ঞেস করল।

শাম্ব বললেন, ‘আরোগ্যলাভের চেষ্টা। এসো, আমরা সবাই আরোগ্যলাভের চেষ্টা করি।’

সকলে সমস্বরে হইহই করে উঠতেই, নীলাক্ষি তীক্ষ্ণ স্বরে বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘চুপ করো। ও আমাদের মতোই কুষ্ঠরোগী। ওর কথা আমাদের শোনা উচিত। ও কী বলে, আমরা শুনব।’

শাম্ব চমৎকৃত বিস্ময়ে দেখলেন, নীলাক্ষির প্রতিবাদে এক অবিশ্বাস্য আশাতীত প্রতিক্রিয়া ঘটল। নীলাক্ষির প্রতিবাদও যেন উপস্থিত সকলের কাছে আশাতীত বোধ হওয়ায়, তারা স্তম্ভিত স্তব্ধ হয়ে গেল। অনেকে নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। নীলাক্ষি শাম্বকে বলল, ‘এসো, তুমি বসো, আমরাও বসি। তুমি কী বলো, আমরা শুনি। তোমার কথা যদি আমাদের মনে লাগে, ভাল। নইলে তোমাকে আর তোমার কথা আমরা ছুড়ে ফেলে দেব।’

শাম্বর মনে হল, এ যেন সেই গত রাত্রের কুষ্ঠরোগগ্রস্ত রমণী না, যে অতিপ্রার্থিনী হয়ে তাঁকে উত্তম যুক্তির দ্বারা রমণে প্ররোচিত করেছিল। উত্তম যুক্তি ছিল তার কথায়, কারণ এই ব্যাধি এবং দেহের বহিরাবরণ ও অভ্যন্তরের অনুভূতি আর মানসিকতা বিষয়ে ওর বক্তব্যে কোনও ত্রুটি ছিল না। কিন্তু এই রমণী যে এমন অঘটনঘটনপটিয়সী হতে পারে, তিনি অনুমানও করতে পারেননি। তার কথার মধ্যে এখনও তেজ ও যুক্তি লক্ষণীয়। শাম্ব এদের সম্পর্কে যতটা হতাশ হয়েছিলেন, ততটাই আশান্বিত হলেন। তিনি নীলাক্ষির সঙ্গেই একটি অগ্নিকুণ্ডের অদূরে বসলেন। দেখা গেল, অনেকেই সামনে এসে বসল। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে রইল। যেন বন্যহস্তীযূথ এখনও পুরোপুরি নতি স্বীকার করতে পারছে না, অথচ বিদ্রোহও করতে পারছে না, এইরকম তাদের অবস্থা। তার মধ্যেই তিনি শুনতে পেলেন, কেউ কেউ বলাবলি করছে, ‘নীলাক্ষি যখন বলছে, তখন শোনাই যাক, কী বলো হে! লোকটা আমাদের কেউ না হতে পারে, নীলাক্ষি তো আমাদের।’

শাম্ব দেখলেন, নীলাক্ষি এবং সকলেই তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি বললেন, ‘আমার যা বলবার, তা তোমাদের বলেছি। তবু আমি আবার তোমাদের বলছি, আমাদের সামনে জীবনের আর কী অবশিষ্ট আছে?’

‘মরা মরা। পচে গলে মরা।’ কয়েকজন সমস্বরে বলে উঠল।

শাম্ব দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, ‘না। সুস্থ হয়ে বাঁচা। লয় ক্ষয় ও মৃত্যু অনিবার্য। স্বর্গলোকেও এই জীবনমৃত্যুর লীলা চলছে। যাঁরা মহৎ কর্মের দ্বারা দিবি আরোহণ করেছেন, তাঁরা নক্ষত্রলোকে বিরাজ করছেন। আমরা তাঁদের স্মৃতিচারণ করি, পূজা করি। কিন্তু মৃত্যু অনিবার্য জেনেও আমরা সুস্থ সবল ভাবে বাঁচতে চাই। আমাদের সামনে জীবনের এইটাই একমাত্র অবশিষ্ট আছে।’ বলে তিনি নীলাক্ষির কোল থেকে তার শিশুটিকে নিয়ে তুলে ধরে দেখিয়ে বললেন, ‘এই সুন্দর শিশুটি কী অপরাধ করেছে যে, সে তার পিতামাতার ব্যাধি নিয়ে অকালে মরে যাবে? ওর অপরাধ কি এই, এই পৃথিবীতে ও জন্মেছে। নিজেদের আর ওকে, ওর মতো আমাদের এখানে আরও শিশুদের বাঁচিয়ে রাখার কোনও দায়িত্ব কি আমাদের নেই?’

সহসা কেউ কোনও জবাব দিল না, কি প্রতিবাদে চিৎকার করে উঠল না। শিশুটিও যেন বিশেষ কৌতুক ও আকর্ষণে শাম্বর দিকে তাকিয়ে রইল, কেঁদে উঠল না। শাম্ব আবার বললেন, ‘ব্যাধি হলে, আরোগ্যলাভের নানা উপায় আছে। আমাদের সেই উপায় অবলম্বন করতে হবে। এখনও আমাদের আশা আছে। মনে বিশ্বাস থাকলে আমরা আরোগ্যলাভ করতে পারব। এইসব শিশু বালক বালিকারাও সুস্থ হবে। বড় হয়ে ওরা তোমাদের জয়গান করবে।’

নীলাক্ষি বলল, ‘ভাল হওয়ার কী উপায়?’

শাম্ব বললেন, ‘হতাশ হয়ে, এক স্থানে পঙ্গুর মতো বসে থাকা না।’ বলে তিনি ঋষি কথিত দ্বাদশ স্থান ও নদনদীর কথা বললেন।

কয়েকজন চিৎকার করে উঠল, ‘এ সেই ঋষি লোকটার কথাই বলছে।’

‘কিন্তু ও নিজে আমাদের মতোই একজন কুষ্ঠরোগী।’ নীলাক্ষি উচ্চ স্বরে বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘ও সুস্থ লোকের মতন আমাদের কেবল উপদেশ দিতে আসেনি। ও আমাদের সঙ্গে যাবে, ও আমাদের মতন একজন। আমি ওর সঙ্গে যাব।’

তৎক্ষণাৎ কয়েকজন নীলাক্ষির কথার প্রতিধ্বনি করল, ‘হ্যাঁ, আমিও যাব, আমিও যাব। ও আমাদের মতনই একজন।’

একজন রুদ্ধ স্বরে শান্বকে দেখিয়ে বলে উঠল, ‘ওকে আমার ছদ্মবেশী যক্ষ বলে মনে হচ্ছে। কুষ্ঠরোগী সেজে এসেছে, আমাদের ভুলিয়ে নিয়ে যাবে।’

আর একজন মাটিতে লুটিয়ে কেঁদে বলল, ‘হা ঈশ্বর, আমি কি আবার সত্যি ভাল হয়ে যাব? এ কী আশ্চর্য কথা শুনছি?’

শাম্ব নীলাক্ষির কোলে তার শিশুটিকে তুলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভূলুণ্ঠিত ক্রন্দনমান লোকটিকে জড়িয়ে ধরে তুলে বলল, ‘আশা রাখো, বিশ্বাস রাখো। আমার অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি, সংসার প্রকৃতই বিস্ময়কর, ঘটনাবলী সকল আশ্চর্যজনক।’

‘তা নইলে কেন আমাদের এই মহারোগ হবে?’ নীলাক্ষি বলল, এবং শাম্বর দিকে তাকিয়ে আবার বলল, ‘আমার মনে আশা জাগছে। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাদের মনেও আশা জাগছে। তোমাকে আমরা বিশ্বাস করি।’ অনেকে সমস্বরে বলে উঠল।

শাম্বর চারপাশে অল্পবয়স্ক বালক-বালিকারা এসে দাঁড়াল! শাম্ব সকলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। রমণীরা তাদের শিশুদের শাম্বর দিকে এগিয়ে দিল। শাম্ব শিশুদের কপালে মাথায় তাঁর অসাড় হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন। ফিরে তাকালেন নীলাক্ষির দিকে। নীলাক্ষি এগিয়ে এল। শাম্ব তার শিশুটিকে স্পর্শ করলেন। তাদের এই আচরণে যেন তাঁর কাছে আত্মসমর্পণের সংকেত। কিন্তু নীলাক্ষি বিষয়ে তাঁর মনে তখনও একটি দ্বিধা ও সন্দেহ ছিল। তিনি আশঙ্কা করছিলেন, নীলশি হয়তো গত রাত্রের মতোই, অভ্যস্ত বাসনায় রমণেচ্ছা প্রকাশ করবে।

নীলাক্ষি সেই মুহূর্তেই বলে উঠল, ‘কাল রাত্রে আমি তোমার ওপর অন্যায় রাগ করেছিলাম। তোমাকে এই কারণেই আমি আরও বিশ্বাস করি, তুমি আমাদের মতন হয়েও আমাদের থেকে তোমার মনের জোর বেশি। তুমি যেন কাল রাত্রের কথা মনে রেখে আমার ওপর রাগ কোরো না।’

শাম্বর অন্তর মুহূর্তের জন্য দুর্বল হল। বহদিন তিনি কোনও রমণীকে স্নেহ ও সোহাগ করেননি। এখন মনে হল, নীলাক্ষিকে তিনি সোহাগ ও আদর করবেন, তার বাসনা পূর্ণ করবেন। আবার ক্ষণ পরেই তিনি মনের দুর্বলতা দমন করলেন, বললেন, ‘আমি কখনওই তোমার ওপর রাগ করিনি। বরং আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি দেখছি, তোমার মধ্যেও শক্তি আছে।’

নীলাক্ষির ভগ্ন নাসা, পুচ্ছহীন রক্তাভ চোখ, ক্ষয়-ক্ষত ঠোঁট, স্ফীত মুখে সলজ্জ হাসি ফুটল। বলল, ‘না না, আমার কোনও শক্তি নেই। আমি তোমার কাছ থেকেই শক্তি পেয়েছি। এবার বলো আমরা কবে কখন যাত্রা করব।’

শাম্ব বললেন, ‘শুভ কাজে বিলম্ব করতে নেই। আমরা সকলেই কল্প গ্রহণ করে, আগামীকাল প্রত্যুষে চন্দ্রভাগায় স্নান করে যাত্রা করব।’

কেউ কেউ তাদের সংগৃহীত অতি সামান্য বস্তুর জন্য আর্তস্বরে বলে উঠল, সে-সব কেমন করে তারা ফেলে যাবে? শাম্ব বললেন, ‘এখানে সব যেমন আছে, তেমনই থাকবে। আমরা কেবল আমাদের এই দেহগুলো নিয়ে যাত্রা করব। আর নিতান্ত ব্যবহার্য বস্তু সকল বহন করব।’

‘আজও আমার কিছু বাড়তি খাবার আছে।’ নীলাক্ষি শাম্বকে বলল, ‘তোমাকে এনে দিই, খাও।’

শাম্বর হৃদয় এক অনাস্বাদিত ব্যথায় ও আনন্দে ভরে উঠল। বললেন, ‘নীলাক্ষি, তোমার হৃদয় অতুলনীয়। এখানে আসার আগে, তপোবনের ঋষিই আমাকে তাঁর স্বপাক অন্ন খেতে দিয়েছিলেন। তোমার বাড়তি খাবার তুমি কাল স্নানের পরে খেয়ো।’

‘কিন্তু তুমি আজও কি চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে সারা রাত জেগে বসে থাকবে?’ নীলাক্ষি উদ্‌বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল।

শাম্ব বললেন, ‘না। আমি এখন তপোবনে যাব। কাল প্রত্যুষে এসে তোমাদের জাগিয়ে তুলব।’

এক বৃদ্ধা বলল, ‘হ্যাঁ, তাই যাও। আমি শুনেছি ওই তপোবনে কোনও জন্তু জানোয়াররা হামলা করে না।’

শাম্ব রাত্রের জন্য সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। তাঁর তপোবনে যাবার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল, আগামীকাল প্রত্যুষেই সকলকে নিয়ে তাঁর যাত্রার কথা ঋষিকে জানানো। অবিশ্যি তিনি কুটির বন্ধ করে নিদ্রিত থাকলে তাঁকে জাগাবার কোনও প্রশ্নই নেই। তা হলে শাম্ব আজ রাত্রিটা মন্দির সংলগ্ন কাননে কোথাও কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু এই ঘটনায় তিনি এখনও বিস্ময় বোধ করছিলেন। তিনি একজন ক্ষত্রিয়। কোনও কার্য সমাধা করতে হলে অস্ত্র ও বাহুবলেই তিনি অধিকতর বিশ্বাসী। অথচ ঘটনাটি ঘটে গেল এক মানবিক আবেদনে। এ ক্ষেত্রে তিনি দেখলেন, নীলাক্ষিই তাঁর অস্ত্র স্বরূপ কাজ করল।

শাম্ব মন্দিরের নিকটবর্তী হতেই, অন্ধকারে ঋষির কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন, ‘তুমি বোধহয় আমার সন্ধানে যাচ্ছ?’

শাম্ব থমকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। এই রমণীয় কানন অন্ধকার হলেও সবই যেন আবছায়ার মতো দেখা যাচ্ছে। ঋষির পিছনেই নদী ও নক্ষত্রখোচিত আকাশ। শাম্ব তাঁকে স্পষ্ট দেখতে পেলেন। করজোড়ে তাঁকে নমস্কার জানিয়ে শাম্ব বললেন, ‘মহাত্মন, আপনিই যথার্থই অনুমান করেছেন।’

‘অনুমান না বৎস, আমি দূরের অন্তরাল থেকে সবই দেখেছি ও শুনেছি।’ ঋষি শাম্বর কথা শেষের আগেই বলে উঠলেন, ‘তোমার অভিপ্রায় শুনে, আমার অত্যন্ত কৌতূহল ও আগ্রহ জন্মেছিল। প্রকৃতপক্ষে আমার মনে গভীর সন্দেহ ছিল। কিন্তু তুমি যে-ই হও, অশেষ তোমার ক্ষমতা। আমি আবার তোমাকে আশীর্বাদ করি, তুমি শাপমুক্ত হও, তোমার অনুগামীরা সকলে আরোগ্যলাভ করুক। এখন আর বাক্যব্যয়ে প্রয়োজন নেই। এই কানন মধ্যে এক আশ্চর্য শাখাবিস্তৃত বৃক্ষ আছে। একজন মানুষ অনায়াসে নিশ্চিন্তে সেখানে শয়ন করতে পারে। কোনও হিংস্র শ্বাপদ তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। এসো, তোমাকে আমি সেই বৃক্ষ দেখিয়ে দিই। কাল প্রত্যুষে যাত্রাকালে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে।’

শাম্ব বুঝলেন, ঋষিপুরুষও শুভ কাজের মধ্যে আর কোনও আলাপাদি বা বিলম্ব করতে চান না। তিনি ঋষিকে অনুসরণ করলেন।

অন্ধকারে পাখির প্রথম ডাকেই শাম্বর নিদ্রাভঙ্গ হল। এ ডাক রাত্রিচর পাখির, প্রভাতের প্রত্যাশায় ব্যাকুল স্খলিত জিজ্ঞাসু পাখির স্বর। শাম্ব দেখলেন, পূর্বাকাশে ঈষৎ রক্তাভা জেগে উঠেছে। তিনি সেই খট্টিকার ন্যায় প্রশস্ত ও বিস্তৃত শাখাযুক্ত বৃক্ষ থেকে অবতরণ করে আগেই গেলেন সেই টিলা অঞ্চলে। তখনও সকলেই নিদ্রিত। শাম্ব যদি জানতেন নীলাক্ষি কোন কুটিরে বা মৃত্তিকা গহ্বরে বাস করে, তা হলে প্রথমে তাকেই ডাকতেন। তা জানা না থাকায় তিনি প্রতিটি কুটিরের সামনে, মৃত্তিকা গহ্বরের কাছে গিয়ে সবাইকে ডেকে তুললেন।

মুহূর্ত মধ্যেই সমস্ত অঞ্চলটি কোলাহলে পূর্ণ হল। সকলেই প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপন করে চন্দ্রভাগার জলে স্নান করে নিল। শাম্বও তাদের সঙ্গে স্নান করলেন। পুবের আকাশে ক্রমেই অতি উজ্জ্বল রক্তাভা ছড়িয়ে যেতে লাগল। শাম্বর নির্দেশে সকলেই দ্রুত প্রস্তুত হল। ব্যবহার্য বস্ত্রাদি, খাবারের রন্ধনের পাত্রাদি ঝোলায় বেঁধে নিল। শাম্বর মনে পড়ে গেল, শাল্ব এবং অন্যান্য বীরদের সঙ্গে যুদ্ধের কথা, কুরুক্ষেত্রের সংগ্রামের চিত্র ভেসে উঠল চোখের সামনে। আজও যেন তিনি যুদ্ধযাত্রা করছেন। এ যুদ্ধের রূপ আলাদা। তিনি আগেই স্থির করে রেখেছিলেন, চন্দ্রভাগার তীর ধরে উত্তরে গমন করবেন এবং সিন্ধু ও চন্দ্রভাগার সঙ্গমে উপস্থিত হবেন। সিন্ধুর উৎপত্তিস্থল হিমালয়। চন্দ্রভাগা যে-স্থানে শাখা নদী রূপে অবতরণ করেছে, সে-স্থানও হিমালয়ের ওপরে।

নদীর তীর ধরে যাবার সময়ে, সেই প্রভাযুক্ত ঋষি, গতকাল যেখানে ভোরে দাঁড়িয়েছিলেন, এখনও সেখানেই প্রতীক্ষা করছিলেন। এখনও গ্রহরাজ উদিত হননি। শাম্ব তাঁর সামনে গিয়ে আভূমি নত হয়ে প্রণাম করলেন। তাঁর সঙ্গের দল কখনওই ঋষিকে কোনওরকম শ্রদ্ধা দেখায়নি। আজ তারা কপালে করজোড় স্পর্শ করে, নানা জনে নানারকম মন্তব্য করল। কেউ বলল, ‘তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হল হে ব্রাহ্মণ।’

কেউ বলল, ‘আমরা ভাল হয়ে আবার এখানে আসব।’

ঋষি দু’হাত প্রসারিত করে সকলের শুভযাত্রা ও মঙ্গলকামনা করলেন।

শাম্ব যাত্রার আগেই গণনা করেছিলেন, শিশু থেকে বৃদ্ধ, নানা বয়সের নরনারী সর্বসাকুল্যে সত্তরজন ছিল। দ্বাদশ স্থানে ও নদনদীতে স্নান করে, দ্বাদশ মাস পরে তিনি যখন আবার চন্দ্রভাগাকূলে অস্তাচলমান স্থানে ফিরে এলেন, তখন তাঁকে বাদ দিয়ে চৌদ্দজন মাত্র জীবিত। বাকি কিছু সংখ্যক লোক ব্যতিরেকে, সকলেই পথিমধ্যে প্রাণত্যাগ করেছে। কেউ কেউ ব্যাধির অতি প্রাবল্যে মারা গিয়েছে। সুদীর্ঘ পথ পরিভ্রমণ করাও সকলের সাধ্যায়ত্ত ছিল না। বিশেষত অসুস্থ বালক-বালিকাগণ। কিছু সংখ্যক লোক নানা স্থানে থেকে গিয়েছে। কষ্ট স্বীকার করতে রাজি হয়নি। নীলাক্ষির শিশুটিও মারা গিয়েছে। কিন্তু অন্যান্য মায়েরা তাদের শিশুকে হারিয়ে যেমন শাম্বকে অভিসম্পাত দিয়েছিল, নীলাক্ষি তা দেয়নি।

শাম্ব যে-চৌদ্দজনকে নিয়ে ফিরে এলেন, তাদের মধ্যে তিনজন রমণী, দুইটি বালক-বালিকা, বাকি সকলেই পুরুষ। তাদের সকলের বিকৃত দেহে একটি পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। শাম্ব যেমন অনুভব করেছেন, ক্ষীণতর হলেও তাঁর সম্পূর্ণ অসাড় দেহে, এই এক বৎসরের মধ্যে অনুভূতিবোধ ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হচ্ছে, বাকি চৌদ্দজনের অভিজ্ঞতাও তাঁর মতোই। ভ্রূ বা মস্তকের কেশের ভঙ্গুরতা ও পতন বন্ধ হয়েছে। তাঁর মতো, পুরুষদের সকলের গুম্ফ ও শ্মশ্রুও এখন অভগ্ন ও ঘন। দেহের ক্ষয় ও ক্ষতের বৃদ্ধিলাভ ঘটেনি। যদিও অনেক সঙ্গীকে হারাতে হয়েছে এবং সকলেই শোকার্ত, তথাপি সকলের মধ্যেই নবজীবন লাভের একটি উদ্দীপনা জেগেছে। অথচ সেই উদ্দীপনার মধ্যে কোনওরকম উচ্ছৃঙ্খল উচ্ছ্বাস নেই। আছে এক নতুন আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা, সকলের আচরণে এক প্রশান্ত গাম্ভীর্য লক্ষণীয়। শাম্বও অন্তরে এক গভীর আস্থা ও প্রশান্তি লাভ করেছেন। এই নবজন্মের সূচনায়, যেন একটি নতুন সংঘের স্থাপনা ঘটেছে।

রমণীদের মধ্যে এবং সকলের মধ্যেই নীলাক্ষিকে নেত্ৰীস্থানীয়া মনে হয়। সে হয়ে উঠেছে সর্বাপেক্ষা শ্রীময়ী, মন্দিরের অপ্সরাদের ন্যায় তার সর্বাঙ্গে যেন রূপ ও লাবণ্যের সঞ্চার হয়েছে, অথচ গ্রহরাজের প্রতি তদ্‌গত ভক্তিতে এক ধ্যানমগ্না পূজারিণী। তাকে দেখলে এখন আর বিশ্বাস করা যায় না, সে ছিল বিশ্বাসহীনা, প্রত্যহ যে-কোনও পুরুষের সহবাসে অভ্যস্ত কামতাড়িতা। সকলের মধ্যেই এই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে।

সর্বোপরি এক বিশিষ্ট ঘটনা এই, সিন্ধু ও চন্দ্রভাগা সঙ্গমের জলে, শাম্ব পেয়েছেন একটি দারুমূর্তি যাঁর সঙ্গে এই মিত্রবনের গ্রহরাজের মূর্তির আশ্চর্য সাযুজ্য বর্তমান। মাথায় শিরস্ত্রাণ, কপালের ওপর এসে পড়েছে যেন এক খণ্ড বস্ত্রের আবরণ, বিশাল চক্ষুদ্বয়, শিরস্ত্রাণের বাইরে বিন্যস্ত কেশপাশের অংশ, মনোহর গুম্ফ, কুঞ্চিত শ্মশ্রু, রাজকীয় পোশাকের কোমরে অভিয়ঙ্গ বন্ধন এবং চরণদ্বয় পাদুকাবৃত। দারুমূর্তিটি মোটেই খুব ছোটখাটো না, একজন দীর্ঘদেহ ক্ষত্রিয়ের ন্যায় এবং নিতান্ত হালকাও না। বর্ষসমূহে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর ন্যায় শাম্বর মনও সেই মূর্তি প্রাপ্তিতে, যেন এক গভীর সংকেতময় আনন্দে উদ্‌বেল হয়ে উঠেছিল। জীবনের কিছুই নিরর্থক না। সকল প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির মধ্যে একটি অর্থপূর্ণ নির্দেশ বর্তমান।

শাম্ব মূর্তি প্রাপ্ত হয়ে, ব্যাকুলিত চিত্তে বক্ষে ধারণ করেছিলেন, আর কখনওই ত্যাগ করেননি। এই সমস্ত ঋতুগুলো এবং সমস্ত পথপরিক্রমায় দারুমূর্তিটি তিনি স্কন্ধে বহন করেছেন। একসঙ্গে স্নান করেছেন, এই মিত্রবনের ঋষি-উক্ত তিনটি বিশেষণের দ্বারা প্রত্যহ পূজা করেছেন, সর্বদেবমান্য, সর্বভূতমান্য, সর্বশ্রুতিমান্য।

মিত্রবনের ঋষি শাম্বর সঙ্গীগণসহ প্রত্যাবর্তনে, যেন পরিবার ও স্বজনকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে শিশুর ন্যায় উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। প্রণামের জবাবে তিনি সকলকেই আলিঙ্গন করলেন, রমণীদের মস্তকে ও কপালে হাতের স্পর্শ দিয়ে স্বস্তিবচন উচ্চারণ করলেন। শাম্বর মূর্তিপ্রাপ্তিতেই তিনি সর্বাপেক্ষা বেশি চমৎকৃত, বিস্ময়ে উদ্‌বেলিত ও চঞ্চল হলেন। শাম্বকে বললেন, ‘এই মিত্রবনেই, রমণীয় কানন মধ্যে তুমি এই মূর্তিকে প্রতিষ্ঠা করো। আমি দেখেই বুঝতে পারছি, এ মূর্তি কল্পবৃক্ষের দ্বারা তৈরি। এ নিশ্চয়ই কোনও নিপুণ বিশ্বকর্মার সৃষ্টি। কিন্তু তোমার দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল।’

শাম্ব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দায়িত্ব!’

ঋষি তাঁকে এই প্রথম নিজের কুটিরের মধ্যে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘বসো। তোমার সঙ্গে আমার একান্তে কিছু কথা আছে। তোমাকে এবার প্রস্তুত হতে হবে আর এক বিরাট পরিশ্রমসাধ্য কাজের জন্য।’

শাম্ব মৃত্তিকায় জোড়াসনে বসে বললেন, ‘আজ্ঞা করুন।’

ঋষি বললেন, ‘আজ্ঞা নয়, তোমার আরব্ধ কাজ সমাপ্ত করতে হবে। হয়তো মহর্ষি নারদ উপস্থিত থাকলে তিনিই তোমাকে বলতে পারতেন।’

শাম্ব বললেন, ‘আপনাকে মহর্ষির তুল্য অভিজ্ঞ মনে হয়। আপনিই আমার কর্তব্যের কথা বলুন।’

ঋষি মহর্ষির উদ্দেশে কপালে জোড় হাত ঠেকিয়ে বললেন, ‘আমার অভিজ্ঞতা জীবনের তাগিদে। মহর্ষি বিশ্বভ্রমণ করে জ্ঞানলাভ করেছেন। যাই হোক, তোমার নিশ্চয় মনে আছে, তুমি যখন আমার কাছে জানতে চেয়েছিলে, কেন গ্রহরাজ বিগ্রহের কোনও পূজা হয় না, তোমাকে বলেছিলাম, আমার সে-অধিকার নেই। এখন তোমাকে বলি, সে-অধিকার আছে শাকদ্বীপের ব্রাহ্মণদের। তোমাকে যেতে হবে সেই শাকদ্বীপে, সেখানকার ব্রাহ্মণদের তোমাকে ভারতবর্ষে নিয়ে আসতে হবে!’

শাম্ব অজ্ঞতাবশত বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কখনও শাকদ্বীপের নাম শুনিনি। সে-স্থান কোথায়, গমনযোগ্য কি না, আপনিই বা সে-স্থানের কথা কেমন করে জানলেন আমাকে সবই ব্যক্ত করুন।’

ঋষি বললেন, ‘সবই তোমাকে বলব। তোমরা এই যে দ্বাদশস্থান পরিভ্রমণ করলে, স্নান করলে, উপবাসাদি করলে এ সবই প্রাকৃতিক চিকিৎসা রূপে গণ্য হবে। শাকদ্বীপের ব্রাহ্মণেরা কেবল সূর্যোপাসক নন, এই ব্যাধিকে দেহ থেকে আমূল ধ্বংসের চিকিৎসাবিধি একমাত্র তাঁরাই জানেন। সূর্যালোকের বিবিধ স্থান ও কাল, তাঁরাই নির্ণয় করেছেন, কারণ তাঁরা জানেন, গ্রহরাজই এইসব ব্যাধির নিরাময় করতে পারেন। তাঁরা উপাসনা ও বিবিধ কর্মের দ্বারা এই গুণ আয়ত্ত করেছেন। আমার মনে হয় কখনও কখনও তাঁরা কোনও পরাক্রান্ত রাজার দ্বারা ভারতবর্ষে আনীত হয়েছিলেন, কিন্তু যথোপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায়, আবার নিজ স্থানে প্রত্যাবর্তন করেছেন। মিত্রবনের এই মন্দির দেখেই তা বোঝা যায়। কারণ একমাত্র শাকদ্বীপের ব্রাহ্মণরাই গ্রহরাজবিগ্রহের পূজার অধিকারী।’

শাম্ব অতি কৌতূহলাক্রান্ত হয়ে বললেন, ‘মহাত্মন, এ সকল সংবাদই আমার কাছে নতুন। আমি সেই ক্ষমতাশালী ব্রাহ্মণদের দর্শনের জন্য বিশেষ ব্যাকুল হচ্ছি, কারণ তাঁরাই একমাত্র এই ব্যাধি দেহ থেকে আমূল ধ্বংসের চিকিৎসাবিধি জানেন! এখন বলুন এঁদের কথা আপনি কেমন করে জানলেন, কোথায় এবং কোন পথেই বা শাকদ্বীপে গমন করা যায়। আমি তাঁদের আনয়নের যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’

ঋষি বললেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, তোমার দ্বারাই তা সম্ভব। শোনো, আমি পূর্বপুরুষদের কাছে এই শাকদ্বীপের ব্রাহ্মণদের কথা শুনেছিলাম। সেখানে মগ ও ভোজক দুই শ্রেণীর ব্রাহ্মণ আছেন, উভয় শ্রেণীই সূর্যোপাসক। শুনেছি ভোজক শ্রেণীর মধ্যে বিবাহাদি সম্পর্কের ক্ষেত্রে, রক্তের সম্পর্ক মানামানি নেই। এই রীতি আমাদের দেশে সম্মানের চোখে দেখা হয় না, পরন্তু বিরাগ ও বিতৃষ্ণারই সৃষ্টি করতে পারে। তুমি সেখানে গেলেই সব চাক্ষুষ করতে পারবে। পথ নিঃসন্দেহে খুবই দুর্গম। এখান থেকে তোমাকে অন্তরীক্ষে গমন করতে হবে। অন্তরীক্ষ অতিক্রম করে দেবলোক ইলাবৃতবর্ষের নিকটবর্তী কোনও স্থানের নাম শাকদ্বীপ। সেখানে গমন করলে, অধিবাসীরা তোমাকে সম্যক শাকদ্বীপ চিনিয়ে দেবে। শাকদ্বীপ গমনের পূর্বে, তুমি গ্রহরাজ মূর্তিকে কানন মধ্যে স্থাপন করো। তথাপি একটি সমস্যা থেকে যাচ্ছে।’

‘কী বলুন। চেষ্টা করব, যাতে সমস্যা দূর করা যায়।’

‘বিশ্বকর্মা সম্প্রদায়কে এখানে আনয়ন করে তোমার কল্পবৃক্ষমূর্তির জন্য একটি মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। এখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সেই মহান শিল্পীরা বাস করেন। তাঁরা এখানে এসে কাজে হাত দিলে, তাঁদের ভরণপোষণের কী উপায়!’

শাম্ব কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বললেন, ‘মহাত্মন, অর্থানুকূল্য ব্যতীত এইরূপ এক বিশাল কাজ সম্ভব না। আমি একজন ক্ষত্রিয়। ক্ষাত্র ধর্মানুযায়ী আমি শত্রুকে নিধন ও পরাজিত করে, তাদের ধনসম্পত্তি সকল লাভ করেছি। এই কাজে কি আমি সেই সকল ধনসম্পদ ব্যয় করতে পারি না?’

ঋষি বিস্মিত ও অত্যুৎসাহী হয়ে বললেন, ‘তুমি এবং তোমার নিজের যা-কিছু সংগ্রহ, সকলই তুমি এ বিশাল যজ্ঞকাণ্ডে ব্যয় করতে পারো।’

শাম্ব এখন ঋষির নিকটে নিজের পরিচয় দিলেন এবং পিতার অভিশাপের বিষয়ের বর্ণনা করলেন। বললেন, ‘মহাত্মন, জন্মসূত্রে আমি বাসুদেবপুত্র, যদুবংশের বৃষ্ণিশাখার বংশধর। ক্ষাত্রবীর্যের স্পর্ধা, প্রণয়শীলা রমণীগণের দ্বারা পরিবেষ্টিত সুখী ও বিলাসের জীবন এখন আমার কাছে অতীত স্মৃতিমাত্র। তা আমাকে আকর্ষণ করে না, বিচলিত করে না। যে কল্পারম্ভের দ্বারা আমি কর্ম ও মোক্ষলাভের পথে চলেছি আমার গৌরব তা ছাড়া আর কিছু নেই।’

ঋষি শাম্বকে আলিঙ্গন করে, চমৎকৃত হয়ে বললেন, ‘সাধু সাধু!’

শাম্ব ঋষিকে প্রণাম করে বললেন, ‘আমি এখন অশ্বচালনায় সমর্থ। এ অঞ্চল থেকে অশ্ব সংগ্রহ করে, আমি অবিলম্বে দ্বারকায় যাব। ধনসম্পদ নিয়ে পশ্চিম দক্ষিণাঞ্চলের বিশ্বকার্মাগণকে আমার অভিপ্রায় নিবেদন করব। এখানে ফিরে এসে, আমি কালমাত্র অপেক্ষা না করে, শাকদ্বীপে যাব। নীলাক্ষি এবং অন্যান্য সকলে এখানে থাকবে, প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্ম ও অন্যান্য সকল কাজের প্রতি লক্ষ ও যত্ন করবে।’

ঋষি বললেন, ‘মাত্র কয়েকদিন পরেই শুক্লা সপ্তমী তিথি। তুমি সেইদিন তোমার কল্পবৃক্ষমূর্তি কানন মধ্যে কোনও উৎকৃষ্ট স্থানে স্থাপন করে দ্বারকায় গমন করো। তোমার যাত্রা শুভ হোক।’

শাম্বর সঙ্গে ঋষির কথার পরে, এক নতুন কর্মযজ্ঞের সূচনা হল। শাম্ব তাঁর সঙ্গীদের সবাইকেই তাঁর পরিচয় দিলেন, ইচ্ছার কথা জানালেন। সকলের যা-কিছু কাজ সবই বুঝিয়ে দিলেন। সপ্তমী তিথিতে উপবাস করে, চন্দ্রভাগাকূলের কানন মধ্যে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। পরদিবসেই সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, বেগবান অশ্বে আরোহণ করলেন। যাত্রার পূর্ব মুহূর্তে, নীলাক্ষির মুগ্ধ ও বিস্মিত চোখের সঙ্গে তাঁর দৃষ্টিবিনিময় হল। শাম্ব গম্ভীর হলেন, নীলাক্ষির সামনে গমন করলেন। বললেন, ‘নীলাক্ষি, তোমার চোখে এই মুগ্ধতা কীসের?’

নীলাক্ষি বলল, ‘মানুষের। তাকিয়ে দেখো, সকলেই তোমার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছে।’

শাম্ব দেখলেন, নীলাক্ষি মিথ্যা বলেনি। তথাপি নীলাক্ষির চোখে মুখে যেন প্রকৃতি লক্ষণ অতি গাঢ়তর মনে হল। এ কি নিতান্ত তাঁরই ভ্রম? নীলাক্ষির আবার বলল, ‘আমি তোমার শুভযাত্রা কামনা করছি। কাজ শেষ করে তুমি দ্রুত ফিরে এসো।’

শাম্ব নীলাক্ষির দিকে আবার তাকালেন। নীলাক্ষি হেসে বলল, ‘আমাকে ভুল বোঝার কোনও কারণ নেই।’

শাম্বও হাসলেন, বললেন, ‘আমরা সকলেই মানুষ, ভুল আমারও হতে পারে। কিন্তু আমাদের কল্প কর্ম শেষ হতে এখনও অনেক বিলম্ব আছে।’

নীলাক্ষি বলল, ‘অনর্থক চিন্তা কোরো না। তোমার শুভযাত্রা ত্বরান্বিত করো।’

শাম্ব আশ্বস্ত হয়ে অশ্বচালনা করলেন। এক পক্ষকাল মধ্যে তিনি দ্বারকায় পৌঁছোলেন। বাসুদেব পুত্র দর্শনে অত্যন্ত প্রীত হয়ে তাঁকে আলিঙ্গন করলেন। জাম্ববতী শাম্বকে আলিঙ্গন করে আনন্দাশ্রু বিসর্জন করলেন এবং মাতৃগণ সকলেই তাঁকে অশেষ সাধুবাদের দ্বারা স্নেহ ও সোহাগ জানালেন। শাম্বর নিজ গৃহে উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে গেল। কিন্তু শাম্ব একদিন মাত্র দ্বারকায় অবস্থান করবেন জেনে তাঁর অন্তঃপুরে যেন শোকের ছায়া নেমে এল। সংবাদ পেয়ে বাসুদেবও বিস্মিত উদ্‌বেগে দেখা করতে এলেন।

শাম্ব পিতা, মাতৃগণ, লক্ষ্মণা ও অন্যান্য অন্তঃপুরিকা রমণীগণের সামনেই তাঁর আগমনের কারণ ও আসন্ন কর্মের কথা সব ব্যক্ত করলেন। তিনি সকলের সম্মতি ও শুভাকাঙ্ক্ষা প্রার্থনা করলেন। বাসুদেব ম্রিয়মাণ হলেন, কিন্তু শাম্বর কল্পের কথা শুনে, তাঁকে বাধা দিতে পারলেন না, বরং সম্মান করলেন। জাম্ববতীর অন্তর বিদীর্ণ হল, তথাপি তিনি স্বামীর কথানুযায়ী সম্মতি দিলেন।

লক্ষ্মণা অতি কাতর হয়ে দুই হাতে শাম্বকে আকর্ষণ করে, কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, ‘স্বামী, আমি কী নিয়ে এই দ্বারকায় থাকব? কেন থাকব? কতকাল থাকব?’

শাম্ব লক্ষ্মণাকে নানা বাক্যে সান্ত্বনা ও প্রবোধ দিয়ে বললেন, ‘কুরুকন্যা, শোনো, আমার ব্রত এখনও শেষ হয়নি। আমাকে দেখেই তুমি বুঝতে পারছ, আমার এখনও মুক্তি ঘটেনি। নিতান্ত অর্থের প্রয়োজনেই আমি এখানে এসেছিলাম। আমার অতীত জীবন আর কখনওই ফিরে আসবে না। তোমার যদি ইচ্ছা হয়, তবে যে-কোনও সময় পঞ্চনদীর দেশে, চন্দ্রভাগাতীরে মিত্রবনে এসো। সেখানেই তোমার যদি বাস করতে ইচ্ছা হয়, বাস কোরো। আরও শোনো লক্ষ্মণা, জীবন কখনও এক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে না, তা সতত সঞ্চরমাণ, পরিবর্তনশীল। তুমি তপোবনে গেলে, রৈবতকের এই হর্ম্যতলের বিলাসকক্ষের জীবন পাবে না। তোমার স্বামীকেও পূর্বের ন্যায় পাবে না। তোমাকে বলেছিলাম, অভিশাপ প্রশ্নের অতীত। এখন তুমি একমাত্র আমার অমোঘ নিয়তির সঙ্গেই মিলিত হতে পারো।’

শাম্ব দ্বারকায় এক রাত্রি বাস করলেন। যদুবংশের বিশিষ্ট পুরুষ জ্যেষ্ঠ ও ভ্রাতৃগণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল। পরের দিন তিনি রথারোহণে তাঁর বিবিধ সুবর্ণ, মণিমুক্তা ইত্যাদি নিয়ে প্রত্যাবর্তন করলেন। মিত্রবনের পথে যাত্রা করে তিনি বিশ্বকর্মা সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার যাবতীয় রত্নাদি ও রথ তাদের পারিশ্রমিক হিসাবে দান করে মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রার্থনা জানালেন। বিশ্বকর্মা সম্প্রদায় প্রীতির সঙ্গে মিত্রবনে গিয়ে মন্দির তৈরি করতে স্বীকৃত হলেন।

শাম্ব আর এক পক্ষকালের মধ্যে অশ্বারোহণে মিত্রবনে পৌঁছে, একটি সপ্তমীতিথি পর্যন্ত অবস্থান করলেন। অষ্টমী তিথিতে সকলের সম্মতি নিয়ে পদব্রজে শাকদ্বীপ যাত্রা করলেন। পঞ্চনদীর দেশের সমতলভূমি অতিক্রম করে, হিমালয়ের পাদদেশে পৌঁছোতে তাঁর মাসাধিক কাল কেটে গেল। শুরু হল অন্তরীক্ষের পথ। অতি দুর্গম গিরিশিখর ও বনভূমির মধ্য দিয়ে গমনের সময় শাম্ব তাঁর জীবনে এক অনন্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন। অন্তরীক্ষের পার্বত্যপথ অতি দুর্গম, কিন্তু শান্ত ও গম্ভীর। দৃশ্যাবলী অতি মনোমুগ্ধকর। ফলমূল এবং পার্বত্য ঝরনার জলই তাঁর খাদ্য ও পানীয়। তবে যতই অন্তরীক্ষ নিকটবর্তী হতে লাগল, সেখানকার অধিবাসী গন্ধর্বদের সাক্ষাৎ পেতে লাগলেন। গন্ধর্ব রমণী ও পুরুষরা সকলেই অতি মনোহর রূপ। ধবল গিরিশৃঙ্গে প্রথম আদিত্য কিরণপাতে যে বর্ণ ধারণ করে এদের গাত্রবর্ণ সেইরকম। কেশ এবং চক্ষু নিবিড় কৃষ্ণ। অশ্বযুক্ত রথ, অশ্ব ছাড়া কৃষ্ণবর্ণ বৃহৎ পার্বত্য ছাগ পৃষ্ঠে অনেকে গমনাগমন করে। প্রকৃত অন্তরীক্ষ পর্বত মধ্যস্থিত এক বিশাল উপত্যকাভূমি। সুদীর্ঘ হ্রদ ও একটি বেগবতী নদীতে গন্ধর্বরা নৌকারোহণেও চলাচল করে।

শাম্ব স্বভাবতই এই অপরিচিত জাতি সম্পর্কে শঙ্কিত ও চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর আশঙ্কার কোনও কারণ ছিল না। অন্তরীক্ষের অধিবাসীরা সকলেই তাঁর সঙ্গে ভাল আচরণ করেছে। তাঁর শারীরিক বিকৃতির জন্য কেউ ঘৃণা করেনি। খাদ্য ও আশ্রয় দিয়েছে। পথ দেখিয়ে দিয়েছে এবং সাবধান করে দিয়েছে, ইলাবৃতবর্ষের অধিবাসীদের সঙ্গে অসুরদের প্রায়ই যুদ্ধ চলছে। শাম্ব যেন সাবধানে গমন করেন।

শাম্ব এই বিচিত্র পার্বত্যদেশসমূহ ও তার অধিবাসীদের দেখে দুর্গম পথের ক্লান্তি অনেকখানি ভুলে থাকতে পেরেছেন। উত্তর পশ্চিমের নির্দিষ্ট পথে যেতে গিয়ে তিনি অসুর সৈন্যদের অনেকগুলো অবরোধ সৃষ্টিকারী স্কন্ধাবার দেখতে পেয়েছেন। তাঁকে সর্বত্রই নিজের পরিচয়, গন্তব্য ও গন্তব্যস্থলে গমনের কারণসমূহের বিবরণ দিতে হয়েছে। অসুরদের সীমানা অতিক্রমের পরে শাকদ্বীপে গমনের আগে সুরসেনাদের সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে। স্বর্গের প্রতিটি মানুষেরই তিনি পদধূলি গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তাঁদের ব্যবহার খুব ভাল ছিল না।

দশ ঋতু অতিক্রান্ত করে, শাম্ব শাকদ্বীপে পৌঁছুলেন। দেখলেন, সে স্থানের অধিবাসীদেরও উজ্জ্বল গৌরবর্ণ দীর্ঘকান্তি। চোখের রং মিশ্রিত, কৃষ্ণ নীল এবং গোমেধ বর্ণ। অন্তরীক্ষের অধিবাসীদের তুলনায় স্বর্গলোকের দেবতাদিগের সঙ্গেই শাকদ্বীপের মানুষদের সাদৃশ্য বেশি। শাম্বকে সর্বাপেক্ষা বিস্মিত করল শাকদ্বীপ মগ ব্রাহ্মণদের বেশবাস। পুরুষদের কাঁধ থেকে পায়ের কনুই পর্যন্ত পোশাকের কোমরে। অভিয়ঙ্গের বন্ধন। পায়ে পাদুকা। মাথার ওপরে কপাল পর্যন্ত একখণ্ড বস্ত্রদ্বারা আবৃত। সকলেরই জটা ও শ্মশ্রু রয়েছে এবং প্রতিদান পুবঙ্ক ও বর্ম ধারণ করে থাকেন।

শাম্ব মগ সম্প্রদায়শ্রেষ্ঠ এক ব্রাহ্মণের পাদ্যার্ঘ্য গ্রহণ করে তাঁকে পরিচয় এবং আগমনের কারণ সকল ব্যক্ত করলেন। এবং করুণ ও বিনীতভাবে তাঁর প্রার্থনা জানালেন। তাঁর আচরণে মগশ্রেষ্ঠ প্রীত হলেন। বিভিন্ন পরিবারকে আহ্বান করে আলাপ আলোচনা করলেন। তাঁর আশঙ্কা প্রকাশ করলেন, সুদূর ভারতবর্ষে তাঁদের যথার্থরূপে প্রতিষ্ঠা করা হবে কি না? এবং কতজনকে শাম্ব নিয়ে যেতে চান?

শাম্ব বললেন, ‘আপনাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনাদের কেউ কখনও ভারতবর্ষে গমন করে থাকবেন। হয়তো আপনাদের প্রতিষ্ঠা ও যত্নের অব্যবস্থায় আপনারা বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু আমি এক কল্প করে আপনাদের আহ্বান করতে এসেছি। আপনাদের প্রতিষ্ঠা ও যত্নের কোনওরকম ত্রুটি হবে না। আমি আপনাদের গৃহ, গার্হস্থ্যজীবনধারণের সমস্ত ব্যবস্থাদি করব। কর্ষণযোগ্য ভূমি ও গাভী দান করব। আপনারা আঠারোজন ব্রাহ্মণ, আপনাদের পরিবারবর্গ নিয়ে চলুন। আমাদের বিশাল দেশে এই মহাব্যাধির অতি প্রাদুর্ভাব হয়েছে। আপনারাই একমাত্র এই মহাব্যাধির আমূল ধ্বংস করতে পারেন। আমার ব্যাকুল প্রার্থনা আপনারা রক্ষা করুন।

মগ ব্রাহ্মণগণ শাম্বর কথা বিবেচনা করলেন। শাম্ব বহু দূরদেশ থেকে অমানুষিক ক্লেশ সহ্য করে তাঁদের নিতে এসেছেন। শাম্বর ব্যবহার আচরণ কথাবার্তায় তাঁদের বিশ্বাস উৎপাদিত হল। পরিবারস্থ মহিলাগণ শাম্বর প্রতি প্রীত হলেন। মগ ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ অষ্টাদশ পরিবারকে শাম্বর সঙ্গে যেতে অনুমতি দিলেন, এবং তাঁদের গমনের প্রস্তুতিপর্বের মধ্যেই শাম্বর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বললেন।

শাম্বর শাকদ্বীপে যেতে যত বিলম্ব হয়েছিল, ফিরে এলেন তার থেকে দ্রুত। কারণ আঠারোটি পরিবার তাঁদের অশ্ব পার্বত্য গর্দভ ও বিরাটাকৃতি ছাগ, অর্ণবচালিত রথে ভারতবর্ষে এলেন। অস্তাচলমানস্থানের মিত্রবনে ফিরে শাম্ব দেখলেন, এক বিশাল রথের ন্যায় মন্দির অনেকখানি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। অগ্নিহোত্র গৃহের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন তাঁর জন্য বাকি ছিল। তিনি ফিরে আসায় সে-কাজ দ্রুত সম্পন্ন হল।

মিত্রবনের ঋষি ও সকলেরই শাম্বর প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। তাঁর রূপের আশ্চর্য পরিবর্তন হয়েছে। তাঁর উজ্জ্বলবর্ণে চারিপার্শ্বের প্রকৃতি, নদী, নরনারী সকলেই যেন প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। এই রূপই শাম্বর সেই প্রকৃত রূপ। তাঁর রূপদর্শনে সকলে মোহিত হয়ে তাঁকে স্পর্শ করার জন্য ব্যাকুল হল।

নীলাক্ষি শাম্বর পদধূলি নিয়ে বলল, ‘প্রণাম হে বিবস্বান।’

শাম্ব চমকিত হয়ে বললেন, ‘নীলাক্ষি, ওই নামে আমাকে কখনও সম্বোধন কোরো না। এক মহাপরাক্রান্ত রাজা ও গ্রহরাজ ছাড়া ওই নাম আর কারও হতে পারে না।’

‘কিন্তু তোমাকে দেখে আমার সেই রূপের কথাই মনে হচ্ছে।’ নীলাক্ষি বলল।

শাম্ব বললেন, ‘তুমি আমাকে শাম্ব নামে সম্বোধন করবে।’

নীলাক্ষি বলল, ‘না, তোমাকে আমি এখন থেকে বৃষ্ণিরত্ন বলে ডাকব।’

শাম্ব বললেন, ‘সেই ভাল।’

কিন্তু শাম্বর কার্য সমাধার অবকাশ কম ছিল। মিত্রবনের ঋষির সঙ্গে আলোচনান্তে তিনি মগদের ছয়টি পরিবারকে মিত্রবনে প্রতিষ্ঠিত করলেন। বাকি বারোটি পরিবার ও বিশ্বকর্মা বংশধরদের নিয়ে প্রথমে যাত্রা করলেন, মথুরার সন্নিকটে যমুনার দক্ষিণ তীরে। সেখানে একটি অগ্নিহোত্র গৃহের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ছয়টি মগ ব্রাহ্মণ পরিবারকে প্রতিষ্ঠা করলেন। বিশ্বকর্মা বংশধরদের, যাঁদের সঙ্গে এনেছিলেন, তাঁদের একাংশের কাছে প্রার্থনা করলেন, এই কালপ্রিয় স্থানে একটি মন্দির আপনারা তৈরি করুন।’

এক মহাযজ্ঞ যখন শুরু হয় তখন সকলেরই হৃদয়ে ও মনে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে। বিরোধ এবং আলস্য সেখানে কোনও বাধার সৃষ্টি করতে পারে না। বিশ্বকর্মাগণ স্বীকৃত হলেন। অতঃপর শাম্ব, বাকি ছয়টি মগ ব্রাহ্মণ পরিবারকে নিয়ে উদয়াচলের ওড্রদেশে লবণদধির তীরে উপস্থিত হলেন। সেখানে প্রাচী নদীর একটি শাখা চন্দ্রভাগা নামে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে পতিত হয়েছে। এখানে তিনি অবশিষ্ট ছয়টি মগ পরিবারকে প্রতিষ্ঠা করলেন। শেষ বিশ্বকর্মা বংশধরগণ যাঁরা ছিলেন, তাঁদেরও সেখানে একটি মন্দির তৈরি করতে অনুরোধ করলেন। তাঁরা সম্মত হলেন। শাম্ব এখানেও একটি অগ্নিহোত্র গৃহের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন।

এক বছর পরে তিনি যখন মিত্রবনে ফিরে এলেন তখন দেখলেন, সেখানে একটি ছোটখাটো নগরী সৃষ্টি হয়েছে, সকলেই তার নাম দিয়েছে শাম্বপুর। শাম্ব বিন্দুমাত্র উৎসাহিত হলেন না, কারণ তাঁর এরকম কোনও অভিপ্রায় ছিল না। বরং তিনি দেখে সুখী ও চমৎকৃত হলেন, মগ ব্রাহ্মণদের চিকিৎসায় সকলেই পূর্ণরূপে আরোগ্যলাভ করেছে। সকলেই যেন দিব্যমূর্তি ধারণ করেছে। এবং কল্পবৃক্ষ মূর্তির নিত্য পূজাদি অতি সুচারুরূপে সম্পন্ন হচ্ছে।

মিত্রবনের ঋষির নির্দেশ মতো শাম্ব প্রতি চার মাসে তিন স্থানে বৎসরান্তে ভ্রমণ করতে লাগলেন। মূলস্থান-মিত্রবন, কালপ্রিয়-কালনাথক্ষেত্র, উদয়াচলের সমুদ্রতীরে কোণবল্লভ ক্ষেত্র। এই সময় তাঁর সঙ্গে আদি চৌদ্দজন তিন স্থানেই গমনাগমন করল।

দ্বাদশ বৎসর শেষে তিনটি মন্দির পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হল। নীলাক্ষি উদয়াচলের মন্দিরে আজীবন বাস করার প্রার্থনা জানাল। শাম্ব বললেন, ‘তুমি যেখানে থেকে গ্রহরাজকে সেবা করে সুখী থাকবে, সেখানেই থাকো।’

নীলাক্ষি বলল, ‘আমি এই সমুদ্র ও চন্দ্রভাগা তীরের মধ্যবর্তী স্থলেই থাকতে চাই। বৃষ্ণিরত্ন, আমি আজীবন কোণাদিত্যের পূজা করব, কিন্তু আমি নিতান্ত প্রস্তরের অপ্সরামূর্তি নই। আমি মানুষ, তুমি আমার মহামৈত্র। তোমার দর্শনের আশায় আমার প্রাণ ব্যাকুলিত হবে। বৎসরান্তে একবার দেখা দেবে তো?’

শাম্ব দেখলেন, নীলাক্ষির ঘনকৃষ্ণপক্ষ্মযুক্ত নীলচক্ষুদ্বয় অশ্রুকণায় চিকচিক করছে। শাম্ব হৃদয়ে অনুভব করলেন, এক অনাসক্ত অথচ কাতর আবেগ। বললেন, ‘নীলাক্ষি, মিত্রবনের প্রথম এবং দ্বিতীয় রাত্রের কথা আমি ভুলিনি। তুমিও আমার অতি শক্তিময়ী মমতাময়ী মৈত্র। তুমি বিনা আজ এ সার্থকতা সম্ভব ছিল না।’

নীলাক্ষি শাম্বর পদযুগল স্পর্শ করে বলল, ‘শক্তির কথা বোলো না, তুমিই আমার শক্তি। তবে আজ থেকে এই কোণাদিত্যক্ষেত্রের নাম হোক মৈত্রেয়বন।’

শাম্ব আনন্দিত হয়ে বললেন, ‘নীলাক্ষি, অপরূপ তোমার কল্পনা, এর অধিক ভাল নাম আর এ স্থানের হয় না।’

নীলাক্ষি বলল, ‘হে মৈত্রেয়, যে কারণে এ স্থানের নাম আজ থেকে মৈত্রেয়বন, সেই কারণ রক্ষা করো।’

শাম্ব নীলাক্ষির কপালে ডান হাত স্পর্শ করে বললেন, ‘মৈত্রেয় কখনও মৈত্রেয়কে মিথ্যা বা দ্বিধাসূচক কথা বলে না।’

নীলাক্ষি অশ্রুপূর্ণ চোখে হাসল। মৈত্রেয়বনে বাতাস শনশন নিস্বনে প্রবাহিত হচ্ছে। কোণাদিত্য যেন তাকেই স্নেহপূর্ণ লোচনে অবলোকন করছিলেন।

মহর্ষি নারদ এলেন মিত্রবনে। মন্দিরকে কেন্দ্র করে শাম্বপুর নগরী এখন ক্রমবর্ধমান। শাম্ব নারদকে অভ্যর্থনা করলেন, পূজা করে পাদ্যার্ঘ্য গ্রহণ করলেন। মহর্ষি বললেন, ‘শাম্ব, তোমাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি। তুমি কি আর কখনও দ্বারকায় প্রত্যাবর্তন করতে চাও না? সেখানে রাজকীয় সুখভোগ করতে চাও না?’

শাম্ব বললেন, ‘মহর্ষি, আমার আর ঐশ্বর্যপূর্ণ, দ্বারকায় রাজকীয় সুখভোগের কোনও বাসনা নেই। আমি এই মিত্রবনে, কালপ্রিয়ক্ষেত্র ও মৈত্রেয়বনে এক অপরূপ আনন্দে অতিবাহিত করছি। মগ ব্রাহ্মণদের প্রতিষ্ঠা সুদৃঢ় হয়েছে, ব্যাধিগ্রস্তরা চিকিৎসিত হচ্ছে এবং তিন স্থানের তিনকালের আলোকে স্নান করছে। অভিশাপ কী, ব্যাধি কী, আমি তা জেনেছি, অতএব এখন যা দেখছি, এর তুল্য আনন্দ আমার আর কিছু নেই।’

মহর্ষি মুগ্ধবিস্ময়াপন্ন চোখে শাম্বর মুখের দিকে দেখলেন, বললেন, ‘চলো, আমি তোমার প্রতিষ্ঠিত গ্রহরাজকে পূজা করব।’

‘চলুন।’ শাম্ব ব্যস্ত হয়ে পূজাদির নানা উপকরণ নিয়ে মহর্ষিকে অনুসরণ করলেন।

মহর্ষি চন্দ্রভাগার জল ও ফুলপত্রাদিসহ কৃতাঞ্জলিপুট হয়ে সেই কল্পবৃক্ষ মূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি গ্রহরাজকে সম্বোধন করে উচ্চারণ করলেন, ‘হে সর্বদেবমান্য, সর্বভূতমান্য, সর্বশ্রুতিমান্য, হে শাম্বাদিত্য! আপনি সন্তুষ্ট হন, আমার পূজা গ্রহণ করুন।’

শাম্বর সারা শরীর শিহরিত হল। শাম্বাদিত্য! এ কী নামে মহর্ষি গ্রহরাজকে সম্বোধন করলেন?

মহর্ষি শাম্বকে স্পর্শ করে বললেন, ‘হ্যাঁ, আজ থেকে এই বিগ্রহের আর এক নাম শাম্বাদিত্য। এই নামেই তিনি এখানে পূজিত হবেন।’

শাম্ব তাঁর অভিশাপের দিনেও অশ্রুমোচন করেননি। আজ এই মুহূর্তে তাঁর পক্ষে অশ্রুপাত রোধ করা কঠিন বোধ হল। তিনি দেখলেন মহর্ষির দুই চোখও অশ্রুপূর্ণ, মুখে অনির্বচনীয় হাসি। তিনি ধীরে ধীরে মন্দির থেকে বাইরে চলে গেলেন।

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত