| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
কবিতা সাহিত্য

কাব্যগ্রন্থ: শীতকাল করে আসবে সুপর্ণা । ভাস্কর চক্রবর্তী

আনুমানিক পঠনকাল: 16 মিনিট

রচনাকাল : ১৯৬৫-৭১ 

প্রথম প্রকাশ : ১৯৭১ 

প্রচ্ছদ শিল্পী : দেবাশিস রায় 

উৎসর্গ – বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে 

ভূমিকা 

‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’ প্রথম প্রকাশ করেন কৃষ্ণগোপাল মল্লিক। উনিশশো একাত্তর তখন শেষ হতে চলেছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বইটার বোধহয় বয়স হলো একটু। 

প্রায় গত দশবছর, অনেকেই আমাকে, এমনকী চিঠিপত্র লিখে খোঁজখবর করেছেন বইটার। রাস্তাঘাটে অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছেন কীভাবে বইটা পাওয়া যায়। বইটা, কথাটা ঠিক, পাওয়াও যাচ্ছিল না অনেক বছর। সুধাংশুশেখর দে যখন বইটি প্রকাশে উৎসাহী হলেন, আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম, যদিও আমার নিজেরই আলস্যবশত পাণ্ডুলিপি তাঁর হাতে পৌঁছে দিতে দেরি হয়ে গেল আরও সাত-আট মাস। 

আমি সুধাংশুর কাছে সত্যিই কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞ অরিজিৎ কুমারের কাছে। বইটাতো আমাদের পাঠকদের কাছে এবার সহজেই পাওয়া যাবে, কিন্তু পাঠকদের ভালোবাসা এখনও পাওয়া যাবে কি না সে বিষয়ে একটু খট্‌কা থেকে গেল। 

ভাস্কর চক্রবর্তী 
২২ জুলাই ২০০৩


 

দিগভ্রান্তি 

শেষ রাত্তিরের ঝড়ে আমার হলদে চাদর উড়ে গিয়েছিলো, তোমাদের
বাগানবাড়ির দিকে—সারাদিন 
ফুঁ দিয়ে বালি উড়িয়েছি—পাঁচ আঙুলে 
করুণ আগুন জ্বলেছে সারা সন্ধেবেলা—এখন রাত দশটায় 
সাদা জামা-প্যান্ট পরে তোমাদের বাগানবাড়ির দিকে যেতে যেতে 
আমি এক অসম্ভব ফাঁকা মাঠে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছি

মনে হচ্ছে, এই মাঠে বিশাল বাড়ি ছিলো কোনোদিন, আজ আর নেই—হিম
অন্ধকার ছুঁয়ে, মাঠখানা 
পড়ে আছে—যেন পৃথিবীর শেষ ফুল 
এখনই ফুটে উঠবে, শব্দহীন, কাল রাতে স্বপ্নে ভৌতিক জ্যোৎস্নায়
তোমারই মৃতদেহ আমি, এই মাঠে 
পচে ফুলে ঘাড় বেঁকিয়ে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম 

শোক এলেই মা-র কথা মনে পড়ে 

শীতের শেষে সেবার হৈ হৈ করে সার্কাসের তাঁবু পড়েছিলো 
তিন বোতল মদে ক্লাউন সেজে 
আমি আরও তিন বোতল মদ…মুর্খেরা সকলেই 
খুব হাততালি দিয়েছিলো সেবার—তুমি 
ঘর চেয়েছিলে 

হাতির পিঠে চড়ে আমরা বনভোজনে গিয়েছিলাম সেবার—তোমার মা 
তোমাকে নীল শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিলো—তোমার রক্তে 
বেজে উঠেছিলো মন্দিরের ঘণ্টা, ঈশ্বর 
আমি বোঝাতে পারিনি 
মন্দিরে থুতু ছিটিয়ে দিলেও মানুষের কিছুমাত্র ক্ষতি হয় না 
যা কিছু বলার ছিলো—এই ডিসেম্বরের রাতে 
এক অন্ধকার ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে আমি গান গাইছি 
তুমি শীতের রাতের মতো শব্দহীন—আমার ভালোবাসা
তোমাদের বাগানবাড়ি জানে 

চৌ-রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমরা চারজন 

‘এদিকে স্বর্গের পথ’—বলে এক একচক্ষু নারী হঠাৎ হারিয়ে গ্যালো—
চৌ-রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমরা চারজন হেসে উঠলাম—এ-ওর মুখের 
দিকে, তাকিয়ে আমরা            হেসে উঠলাম 
যেন স্বর্গে যাবো ব’লে 
সেই ভোরবেলা—অদ্ভুত ছাতা হাতে আমরা বেরিয়েছি, পায়ে 
আশ্চর্য চপ্পল 

এ-ওর শরীর নিয়ে গন্ধ শুঁকছি সন্ধেবেলা—সন্ধেবেলা 
এ-ওর বুকের মধ্যে উঁকি মেরে              কোথায় দুঃখ পাপ 
লুকোনো টাকার মতো রয়ে গেছে, কোথায় ঈশ্বর 
টুপি খুলে হাঁটু মুড়ে 
বসে আছেন, চেয়ে দেখছি— 
পোস্ট-মাস্টারের মেয়ে শুধুমাত্র জুতোজোড়া নিয়ে বাড়ি থেকে চলে গ্যাছে 
তার সঙ্গে গোলাপি যুবক—তারা স্বর্গে যাবে 

আমাদের স্বর্গ নেই স্যারিডন আছে 

দ্বিতীয় চিৎকার 

হাস্যকর তোমার অতীত—হাস্যকর তোমার ভবিষ্যৎ 

পুরোনো মুখগুলো তোমার থেকে সরে যাচ্ছে আরও তোমার পিছন দিকে
ঘুম থেকে উঠে, তোমার জন্যে উনুনে-সেঁকা পাঁউরুটি কোনোদিন
আর খবরের কাগজ, আর রাতদিন 
শুকনো ঘাসের ওপর তুমি ওলোট-পালোট খাচ্ছো শুয়ে শুয়ে
জামার হাতায়, মুছে নিচ্ছো মুখের তেজস্ক্রিয় ঘাম 
ঘটনাহীন ঘটনাহীন মস্তো ঘটনাহীন তোমার জীবন 
কফির কাপে, মিছেই তুমি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছো তোমার ব্যগ্র চামচ
তোমার মাথার ওপর চিরপুরাতন, সেই এক, পতনোন্মুখ চাঁদ 

এই সেদিন তোমার জ্বর হলো খুব 
এই সেদিন তুমি ঘুরে এলে এক অজ পাড়া-গাঁ থেকে— 
এক কুশ্রী মহিলা একুশদিন তোমাকে তিরস্কার করেছে প্রত্যেক সন্ধেবেলা
এক শুয়োর এই সেইদিন তোমাকে অপমান 
করেছে, তোমার আত্মা, লম্বা জুতোর চেয়েও আরও লম্বা হয়ে গেছে হঠাৎ—
সমস্ত রাস্তা জুড়েই সাদা বিছানা পাতা তোমার জন্যে 
তোমার বিছানার পাশে, তোমার জন্যেই, ডাকবাক্সহীন তিনহাজার 
অর্ধশায়িত ডাকঘর—তুমি 
কলকাতায় ঘুরতে দেখেছো চিতাবাঘ—দেখেছো বাঁদর 
বছরের প্রথম দিনেও তুমি ঘুরে বেড়িয়েছো একা একা 
বছরের শেষ দিনেও তাই 

রুপোর এক যীশু একসময় মশারীর মতো টাঙানো ছিলো তোমার ঘরে 
ফুটবল হাতে, ছাদময় তুমি দৌড়ে ফিরেছো এক দীর্ঘসময়— 
সবুজ গাছে গাছে বিষণ্ণ আতাফলের মতো তুমি—
বিশাল হোটেলের নিচে, তুমি 
দাঁড়িয়ে থেকেছো কতোরাত-কতোরাত ঘরে ফেরা হয়নি তোমার— 
তোমার পিছনে জ্বলন্ত হ্যারিকেন আর তীক্ষ্ণ বর্ণা—মাঝরাতে 
হাতে চিঠি তোমার দু’অক্ষরের 
মাঝরাতে তুমি ছুটে গিয়েছো নিজের কাছে খুন করতে নিজেকে 

দেখতে দেখতে শ্রাবণমাস এসে গ্যালো আরেকবার 
তোমার দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এলো এইবছর এক হলুদ মুখোশ—
এইবছর আবার বৃষ্টি হবে খুব 
এইবছর বাবুদের বিছানায় লাফিয়ে উঠবে আবার, সোনালি মাছ—
ঘুম ঘুম ঘুমের জন্যে তুমি ছুটে বেড়ালে অনেক 
রান্নাঘরের আলোয় তুমি লিখে ফেললে কবিতা, তোমার কবিতা হারিয়ে গ্যালো
রান্নাঘরের আরও অনেক ভেতরে—ফাঁকা দুপুরে 
তোমার জন্যে নয় ছিমছাম জানালা, নয় ইজিচেয়ার, নয় এলিয়ে পড়া সুখ
বিছানা-বালিশ ভেদ করে ঐ জেগে উঠছে তোমার থলথলে পাজামা
ঐ ঢুকে পড়ছো ঐ বেরিয়ে পড়ছো তুমি, নির্জন বাথরুম থেকে 

ঘুমের মধ্যে 

ঘরের নিচে—এক অনেক নিচের ঘরে, অসংখ্য ভাঙা খোলামকুচির মধ্যে
শুয়েছিলাম কাল রাতে—কে একটা, কোথাকার বাচ্ছা মেয়ে-বরফকুচির
মতো ঠাণ্ডা—হাসতে হাসতে : এই যে শুনছেন, এই যে, আপনি মরে গ্যাছেন : 

কোথাও নদী নেই—অথচ কোথায় যে পাড় ভাঙার শব্দ, এ্যাতো ঠাণ্ডা, এ্যাতো
ঠাণ্ডা অন্ধকারে-এ কোথায় আমি? 

যারা মরে যায়—তারা ঘরের নিচে, এক 
অনেক নিচের ঘরে যায় 

নীল জামাশুদ্ধু মেয়েটাও হঠাৎ হারিয়ে গ্যালো-অন্ধকারে, আমার কঠিন মুখ
নীল হয়ে রইলো কিছুক্ষণ—সারি সারি ছায়ার মতো অন্ধকার, সেই অন্ধকারে
অসংখ্য ভাঙা খোলামকুচির মধ্যে শুয়ে শুয়ে শুয়ে শুয়ে শুয়ে— 
এ কোথায় আমি? 

যারা মরে যায়—তারা ঘরের নিচে, এক 
অনেক নিচের ঘরে চলে যায় 

১৯৬৭ 

এখনও আমি বেঁচে আছি ঘুরে বেড়াচ্ছি ভাবতেই অবাক লাগে কেমন
কিরোর মতে আমার মরে যাওয়া উচিত ছিলো গতবছরেই 
অথচ এখনও—ফুরফুরে হাওয়া লাগছে গায়ে প্রতিদিন 
এই নিয়ে তোমাকে একটা মজার চিঠি লিখবো ভেবেছিলাম
সেই চিঠি আজও আমার লেখা হলো না 

ক্যাপ্টেন ঘোষের বাড়ি গিয়েছিলাম আমি সেদিন 
ক্যাপ্টেন ঘোষের মেয়ে, রীনা—হারমোনিয়ম বাজিয়ে গান শোনালো তিনটে 
রীনা সপ্তাহে দু’বার গীতবিতানে যায়, চুলে কেয়ো-কার্পিন মাখে 
টুকিটাকি সাহিত্যও পড়ে শুনলাম— 
ক্যাপ্টেন ঘোষ বাংলা ছবি একটাও দ্যাখেন না 

মোড় বেঁকানোর সময়, মোটরগাড়ি, একটু আস্তে চালানো উচিত 

এক শিকারী ভদ্রলোকের সঙ্গে সেদিন আলাপ হলো আমার
চওড়া একটা চাতালে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম— 
তিন টোক পুরোনো মদে তিনি হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন :
আমার চামড়া আগে কালো ছিলো 
আপনি জানেন, কোন্ আবহাওয়ায় বাঘের চামড়া মোটা হয়? 

সারা বছর—কলকাতার প্রত্যেকটা গলি, কানাগলি, ঘুরে বেড়িয়েছি আমি
ক্যারাম্-ও খেললাম কয়েকদিন আগেকার মতো— 
যেসব বইগুলো কিনবো ভেবেছিলাম আজও আমার কেনা হয়নি সেসব
যেখানেই গেছি, হৈ-হট্টগোল চিৎকার আর বাজিমাৎ 
হৈ-হট্টগোল চিৎকার, আর সারাটা বছর 
কতো বিদেশী অতিথি এলো কলকাতায়—স্কুলের মেয়েরা 
এক রঙের কাপড় পরে গাইলো জাতীয় সঙ্গীত— 
হাওয়ায় ফুলে উঠলো সাতষট্টি 
তোমার মুখ শব্দহীন ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে 

শুধুমাত্র তোমাকে

লম্বা, সর্দি—সমস্তদিক অন্ধকার করে, আজ 
বৃষ্টি নামলো—তোমার 
দূর সম্পর্কের ভাই, প্রতিদিন, খবর আনে আমার জন্যে 
তুমি নাকি সেই কবে পাহাড়ে বেড়াতে বেরিয়েছো, ফেরোনি
এখনও—সুটকেশ ভর্তি ক’রে 
তুমি নাকি রাশি রাশি জামা-কাপড় নিয়ে গ্যাছো, বই নিয়ে গ্যাছো
আরও কতো কী নিয়ে গ্যাছো, সবকিছু অবশ্য 
এখন মনে পড়ছে না আমার—তোমার ভাই 
আমার জানলায় এসে বসে আছে এখন—ওকে আমি
অবনীন্দ্রনাথ পড়তে দিয়েছি—অসময়ে প্রায়ই, হঠাৎ
ঘুমিয়ে পড়ি আজকাল—ও এসে 
চটপট আমাকে ডেকে তোলে, বলে : তুমি নাকি একেবারেই
চিঠি লেখো না—আমাকে না জানাও 
ওকে জানাও, কবে ফিরছো— 
ও বেচারা, আমার চেয়েও কষ্টে আছে—আজকাল
কেবলই মনে হয় এইরকম 

তোমার হাসি 
ভালো লাগে আমার-পথের
মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে 
তুমি যখন হেসে ওঠো হঠাৎ—পুলিসও 
মুখ ফিরিয়ে দেখে নেয় আমাদের 

সিগারেট ধরায় 

দরজা খোল, মা 

নরম মাটির গন্ধে, এরোপ্লেন, নিঃশব্দে নেমে আসছে নিচুতে
দরজা খোল মা, আমি ফিরে এসেছি আবার তোমার সেই পুরোনো ছেলে 

আমি তো গৌতম নই, রাস্তায় কোনো 
মৃতদেহ দেখলেই আলোর জন্যে অন্য কোথাও ছুটে যাবো—এক ভিড়
অন্ধকারে, সারাদিন আজ ঘুরে বেড়িয়েছি—সারা শরীর নুন-বাতাসে
আজ ভর্তি হয়ে গ্যাছে—চোখের তলায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে পক্ষীরাজ
দরজা খোল মা, আমি ফিরে এসেছি আবার তোমার সেই পুরোনো ছেলে 

পরিব্রাজকের মতো চোখ, আজ সন্ধেবেলা গাঢ় জবাফুলের সামনে
ঝুঁকে পড়েছিলাম একটু হলে—ঠিক সে মুহূর্তে, ঘূর্ণিঝড়ে ঘূর্ণিঝড়ে
যেন অসম্ভব ক্ষয়ে গেছি আমি—সাত লাফে সরে এসে রাস্তার বাঁ-পাশ দিয়ে
হনহন করে হেঁটে গেছি—এ দিক ও দিক থেকে, কতো মানুষ পিছলে 
সরে গ্যালো যে তখন 
কতো ট্রাম-বাস ছুটে এলো এ দিক ও দিক থেকে, কতো মহিলা অদ্ভুতভাবে 
হেসে উঠলো ও রাত এলো 
আমি কোনো কিছুর শব্দই পেলাম না 

বছর বছর ধরে মিউজিয়মের 
কাচের বোতলে যেন উবু হয়ে আমি বসেছিলাম 
বছর বছর ধরে ইস্কুলের ছেলেমেয়ে ও তাদের মাস্টারমশাই ও দিদিমণি 
ইস্কুলের ছেলেমেয়ে ও তাদের বাবা-মা ও ভাই-বোন—উৎসুকভাবে 
তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে 
আজ সেই কাচের বোতল আমি ভেঙে ফেলে বেরিয়ে এসেছি—আমি আজ 
ভয়ঙ্কর ভাঙা কাচ চারিদিকে ছুঁড়ে ফেলে 
নিজেরই শরীরে ঢুকে, কুঁজো হয়ে, লুকিয়ে আছি রাত্তিরবেলা 
দরজা খোল মা, আজ সারাদিন যতোক্ষণ একা একা ঘুরে বেড়িয়েছি
একজোড়া গম্ভীর লাল চোখ—সারাক্ষণ আমার পেছন পেছন 
আমাকে তাড়া করে ফিরেছে। 

শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা 

শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকবো—প্রতি সন্ধ্যায়
কে যেন ইয়ার্কি করে ব্যাঙের রক্ত 
ঢুকিয়ে দ্যায় আমার শরীরে—আমি চুপ করে বসে থাকি—অন্ধকারে
নীল ফানুস উড়িয়ে দ্যায় কারা, সারারাত বাজি পোড়ায় 
হৈ-হল্লা—তারপর হঠাৎ 
সব মোমবাতি ভোজবাজির মতো নিবে যায় একসঙ্গে—উৎসবের দিন 
হাওয়ার মতো অন্যদিকে ছুটে যায়, বাঁশির শব্দ 
আর কানে আসে না—তখন জল দেখলেই লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার 
মনে হয়—জলের ভেতর—শরীর ডুবিয়ে 
মুখ উঁচু করে নিশ্বাস নিই সারাক্ষণ—ভালো লাগে না সুপর্ণা, আমি 
মানুষের মতো না, আলো না, স্বপ্ন না-পায়ের পাতা 
আমার চওড়া হয়ে আসছে ক্রমশ—ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শুনলেই
বুক কাঁপে, তড়বড়ে নিশ্বাস ফেলি, ঘড়ির কাঁটা 
আঙুল দিয়ে এগিয়ে দিই প্রতিদিন—আমার ভালো লাগে’ না—শীতকাল
কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকবো। 

একবার ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই মেঘ ঝুঁকে থাকতে দেখেছিলাম
জানলার কাছে—চারিদিকে অন্ধকার 
নিজের হাতের নখও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো না সেদিন—সেইদিন 
তোমার কথা মনে পড়তেই আমি কেঁদে ফেলেছিলাম—চুলে দেশলাই জ্বালিয়ে
চুল পোড়ার গন্ধে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার—
এখন আমি মানুষের মতো না—রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে 
হঠাৎ এখন লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার—ভালোবাসার কাছে দীর্ঘ তিনমাস
আর মাথা নিচু করে বসে থাকতে ভালো লাগে না—আমি 
মানুষের পায়ের শব্দ শুনলেই 
তড়বড়ে নিশ্বাস ফেলি এখন—যে-দিক দিয়ে আসি, সে-দিকেই দৌড় দিই 
কেন এই দৌড়ে যাওয়া? আমার ভালো লাগে না 
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকবো 

কে

এক সপ্তাহ চলে গেলে আবার অন্য এক সপ্তাহ চলে আসে
দুপুরে বাড়িগুলো 
সেইরকমই ছায়া ফেলে অর্ধেক দাঁড়িয়ে থাকে গলির ভেতর
একলা আইসক্রীমওলা, সেইরকমই, গলির ভেতর দিয়ে 
অন্য গলিতে চলে যায় 
চলে যায় দুপুর, এক সপ্তাহ চলে যায় 
চশমা পরে মানুষ, খালি গায়ে, হঠাৎ একদিন পাঁজি দেখতে বসে উঠোনে 

এই আমার হাত, আমার পা, আমার চোখ নাক কান 
ক’সপ্তাহ বয়স হলো এদের? 
আমি বাড়িশুদ্ধু লোকের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি 
আমার চুরি হওয়ার কিছু নেই, আমি 
দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়ে পড়ি রাত্তিরবেলা 
আমাদের ছোটো-পিসীমা আসে, ছোটো-পিসীমা চলে যায় 
কে বসে থাকে আড়ালে, আমার সমস্ত কিছু অন্ধকার করে দ্যায় এমন? 

বিছানায় 

মাথার পোকাগুলো, মুখ বাড়িয়ে, আজ দেখতে চাইছে আমাকে
পাশের বাড়ির বুড়োটা 
আজ ভোরবেলা থেকেই কাঁদতে শুরু করেছে ঘুমের জন্যে, ঘুম, 
ওই বাড়ির ছোটো ছেলে 
চুরি করতো সিমেন্ট আর হঠাৎ মরে গ্যালো একদিন 
আমি একদিন প্রচণ্ড লাথি মেরেছিলাম ওকে—আজ বিছানায় 
পড়ে রয়েছে আমার সকালবেলার হাত-পা আর মুখ—আমার আত্মা
আজ ভোরবেলা থেকেই সেদ্ধ হচ্ছে আমার ঘরে 

তোমাদের কথা, দেয়ালে-দেয়ালে লিখে রাখতে ইচ্ছে করে কলকাতায়
কার্পেটের ওপর ভ্রমণশেষে 
কোন্ বাড়িতে এখন তামাকের জন্যে হাঁক দিচ্ছেন বড়বাবু? 
আমার আত্মা 
গাদা-বন্দুকের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ুক আজ 
একটা ডবল-ডেকার সমস্ত কলকাতা ঘুরে এসে 
আমার দরজার সামনে আজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুক—ছাতার মতোই, আজ
বন্ধ হয়ে আসছে দিন 
বন্ধ হয়ে আসছে চোখ 
ক্ষমা করুক কেউ 

ভিখারী 

মুখের চামড়া টান, লোকে বলে—‘গম্ভীর মানুষ, একলা ঘরের কোণে থাকে’—
কিসের গাম্ভীর্য? আহা, দু’তিনটে কবিতা লিখি বলে? 
তুমি জানো, আমি শালা ভিখারীর চেয়েও ভিখারী 
সিঁড়ির তলায় জুতো ছেড়ে 
তোমার নিরালা ঘরে উঠে যাই, নেমে আসি—মাঝখানে তুমি 
চায়ের বাজার নিয়ে কথা বলো, কথা বলো এ-বছর কোথায় বা বেশী বৃষ্টিপাত
কোনো কোনো দিন হেসে চোখটা ওপরে তুলে, ‘আরে তুমি? এসো এসো 
সেই কবে এসেছো সাতাশে’— 
আমি দেখি চেয়ে, বোর্ণভিটা তোমাকে যতো পুষ্টতা দিয়েছে
মুখরা করেছে তারও বেশী—

সকাল ন’টায় তবু টেলিফোন দেখলেই বুকের ভেতরে হাঁস ছটফট করে
কচি ছাগলের মতো রোদ নাচে ছাদের কার্নিশে— 
সব কি মাটিতে যাবে? 
একবার এই জন্ম—ছুটে যাই, তুমি জানো ছুটবোই আমি 
যেখানে তোমার ছায়া বসবোই হাঁটু ভাঁজ করে 
আমি ইট, আমি কাঠ—চুণ বালি অথবা খড়কে-কাঠি আমি 
তুমি জানো, আমি শালা ভিখারীর চেয়েও ভিখারী 
বোকার মতন আজও হেসে 
তোমার নিরালা ঘরে উঠে যাই, নেমে আসি, লোকে বলে—‘গম্ভীর মানুষ 
একলা ঘরের কোণে থাকে’ 

ভ্ৰমণ 

নতুন রাস্তার ওপর দিয়ে, বহুদিন পর, আমি হেঁটে চলেছি আজ 
বহুদিন পর, ‘দু’পাশে ফলের দোকান 
অন্ধকার ডাক্তারখানার পাশ কাটিয়ে রহস্যময় ল্যাম্পপোস্ট, স্থির, শোকাকুল
পায়ে চটি, বড়দিনে দেখেছিলাম এবার 
ফাঁকা মোটরগাড়ির ভেতর বেতের ঝুড়ি-ভর্তি ফুল 
মেমসাহেব চুমু খাচ্ছে বাড়ির দারোয়ানকে 
আঃ আমি সুন্দরভাবে মরে যেতে পারি আজ 
ছেঁড়া কপি-পাতার ওপর আজ ভেসে থাকুক আমার নিরুত্তাপ মুণ্ডু
গম্ভীরভাবে চিঠি আসুক তাড়াতাড়ি : 
দু’দিন পর ধর্মভ্রষ্ট শরীর এসে পৌঁছবে 

লাল বাড়ির পাশাপাশি হাঁটতে চিরকালই ভয় করে আমার—যেমন
আমি গিয়েছিলাম আমহার্স্ট স্ট্রীট—
আমি গিয়েছিলাম আরও অনেক জায়গায়, যেমন 
বন্ধুর বিয়েতে সাতটা ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো আমার 
আমি নিয়ে গিয়েছিলাম পুরোনো এক ক্যামেরাম্যান—
আমি আবিষ্কার করেছিলাম বাথরুম 
বাথরুমের ভেতর দিয়ে, বিশাল কোট পরে, আমি একদিন ভবানীপুর গিয়েছিলাম
বারান্দায় বসে 
হাসতে হাসতে সেইসব বলা যাবে তোমাদের একদিন 
আরও বলা যাবে, কীভাবে আমার শরীর লম্বা হলো এ্যাতোটা 
কীভাবে এক সন্ধেবেলা, আমি মুখোমুখি এক ষাঁড়ের সামনে পড়েছিলাম 
এক গলির ভেতর 

প্যান্টের পকেটে, সিগারেটের নষ্ট তামাক—আর আমি মা-র জন্যে
বিছানার নতুন চাদর কিনে বাড়ি ফিরবো একদিন— 
দেখে এলাম, কালো বুট-জুতোর ভেতর ঘুমিয়ে রয়েছে সাদা ইঁদুর
মাস্টার মশায়ের পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ফেলেছে 
মাস্টার মশায়ের অর্ধোন্মাদিনী স্ত্রী— 
দিনের শেষে, একটাই ইচ্ছে তবু জেগে থাকে মানুষের 
কাদামাখা চটিজোড়ার ওপর আছড়ে পড়ে না সে-সময় স্নেহের ছাপ—
ইয়ার্কি নয় ডিয়ার—রাতদুপুরে, মানুষের জানলায় উঁকি মেরে দেখেছি আমি
খোলা শরীরের ওপর, খেলা করছে, খোলা শরীর 
হলুদ বিছানা, ভেসে চলেছে স্বর্গের দিকে 

দুপুরে 

দুপুরে এমনভাবে জানলার কাছে আর কখনও বসিনি
বৃষ্টি নেই, পাতা ঝরে 
তিনটে পিঁপড়ে এসে আমার খবর নিয়ে চলে যায় ফের
জ্বলে ওঠে শূন্য ঘর, জিভ, আর 
এই যে হঠাৎ 
সব শব্দ থেমে যায়—কর্কশ দুপুরবেলা ভরে যায় পাপে—

টবের মাটিতে আজও দুই পা ডুবিয়ে, হাত ছড়িয়ে দাঁড়ালে
শরীরে কি ফুল হবে? 
আঙুলের থেকে পাখি উড়ে যাবে দুরূহ আকাশে? 
আরও দূরে যায় প্লেন—পাখা বন্ধ 
হয়ে আসে দুপুরে এখন 
সব দূরে গ্যাছে আজ—উপমাও যায় দূরে—উৎকীর্ণ দিন 

মোষ 

তোমারই শিংয়ের কাছে গুঁড়ি মেরে বসে থাকি—কখন যে চাঁদ 
ওঠে, কখন যে মেঘ 
ঢেকে দিয়ে চলে যায় তোমাকে আমাকে—
চারিদিকে বালি ওড়ে, তোমার দেহের ছায়া অন্ধকারে আরও 
দীর্ঘ হয় 
বেঁকানো শিংয়ের কাছে খড় ঝোলে, ফুলে যায় পেট 
কোথায় নধর কাক ডাক দিয়ে উড়ে যায়—মাইল মাইল যেন হেঁটে
কেরানিরা বাড়ি ফেরে, লম্প জ্বেলে, স্ত্রী-কে চুমু খেয়ে 
চোখ বোজে বিছানায়
কোথায় কাদের চোখে বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠে—তারা রাত্রিবেলা
চুল খুলে, পা ছড়িয়ে কাঁদে? কীভাবে বছর যায়, বছর বছর 
যায়, আমি
তোমারই শিংয়ের কাছে গুঁড়ি মেরে বসে থাকি—কখন যে 
চাঁদ ওঠে, কখন যে মেঘ 
ঢেকে দিয়ে চলে যায় তোমাকে আমাকে 

সে 

সে পেতে রেখেছিলো পুরোনো বিছানা— 
নতুন ভাবে ঘুমোতে চেয়েছিলো কিছুক্ষণ— 

বেড়াতে বেড়াতে ঘুরে এসেছিলো সে এক রেলওয়ে কলোনি 
ওইখানে, এক দার্শনিক বিড়াল, সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিলো তাকে— 
সে বন্ধ করেছিলো চিঠি লেখা—খবরের কাগজ 
সে খুশী হয়েছিলো কিছু 
ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো সে—
সে অনেক খুশী হয়েছিলো—শুধু, অনেক দিন পর 
যখন আবার যুদ্ধের কথা ঘুরে ঘুরে উঠেছিলো তার মাথায় 
যখন আবার, তার মনে পড়েছিলো 
কামানের কথা 

শক্ত হয়ে উঠেছিলো তার হাত—সে, সত্যি, কেঁদেছিলো 

চিলেকোঠা থেকে 

সমস্ত কবরখানা জুড়ে আজ, ভোর থেকে, অন্ধকার ঘন হয়ে এলো 
হাওয়া ও হাওয়ায় 
ছড়িয়ে পড়েছে আজ নিরস্ত্র হাত-পা, চুল, হাড়—
তারের জামা-কাপড় 
খুব স্থির যেরকম 
পাশের বাড়িতে আজ খুব স্থির যেরকম কণ্ঠস্বরগুলো 
কোনো অঘটন ঘটবে কি? 
জানলার খড়খড়ি ভেঙে, হাসতে হাসতে, কেউ ঘরে লাফিয়ে ঢুকবে? 
বেশ তো ছিলাম শুয়ে, বৃষ্টি এলো 
বৃষ্টি এলো আর হা হা স্কুলের বারান্দা থেকে উড়ে এলো শীত— 
ঘরে ওষুধের শিশি, আলোয়ান 
যারা মরে গ্যাছে, তারা শান্তিতে আছে তো? 

দুঃসময় 

এমন বিকেল যেন কখনো না আসে আর বাবার গায়ের গন্ধ
ফোলা মুখ, এবড়ো-খেবড়ো কালো পাথরের— 
কখন দুপুর থেকে গত বছরের মতো একা একা বসে আছি 
একা একা বসে থাকা ভালো নয় খুব—
শুনি তো গ্রামের থেকে লোক আসে শহর দেখতে
তারা কি আসে নি কেউ আজ? দেখি 
সকলেই সুস্থ হয় একদিন—কঙ্কালের নাচ দেখে যে-যুবতী
মাঝরাতে ভয় পেয়েছিলো, সে-ও শুনি 
কলেজ পেরিয়ে আরও দূরে যায়, বালি ও বেলুড়ে—
আমি কি এমনই থাকবো, যাবো না কোথাও? আজ এ কেমন দিন
জাহাজ ছেড়েছে যেন ঘাট থেকে—স্বপ্ন নেই 
যেন বা রাজার ছেলে মরে গ্যাছে কোনোখানে, আর শুধু বৃষ্টি পড়ছে 

চব্বিশ বছর, আমি 

আলমারির পেছন থেকে বেরিয়ে এসে, সারাদিন, আমি আজ বসে থাকতে চাই
তোমার কাছে—চব্বিশ বছর, দ্যাখো 
সরু জলের মতো 
উঠোনের একদিক থেকে অন্যদিকে আমি গড়িয়ে গেছি—গলার স্বর 
চুরি হয়ে গ্যাছে আমার, আমার বন্ধুরা 
আমাকে ফেলে রেখে পালিয়েছে—তোমাদের বাগানবাড়ি থেকে
কতো দূর, আমি চলে এসেছি আজ—কতো অল্পতেই মানুষ 
সুখী হতে পারে আজ মনে হয়—কতো অল্পতেই মানুষ বুড়িয়ে যায় এক রাত্তিরে—

অসংখ্য ছেঁড়া চটিজুতোর পাশে বসে বসে, প্রত্যেক দুপুরে, অদ্ভুত খেলা আমার—
আমি হাঁ করি, মুখ দিয়ে ধুলো বেরোয় আমার 
আমি চোখ বুজি, চোখ খুলে যায় আমার ভেতর থেকে—
একলা থাকতে থাকতে, থাকতে থাকতে 
আমার গায়ে সবুজ শ্যাওলা গজিয়ে উঠবে একদিন 
পোড়ো বাড়ির মতো আমি অদ্ভুত দাঁড়িয়ে থাকবো একদিন গম্ভীর জঙ্গলের মধ্যে —

ভালোবাসবার আগেই কতো মানুষের ভালোবাসা ফুরিয়ে যায় হঠাৎ—সশব্দে
ঘুমোতে ঘুমোতে, কতো মানুষ 
চশমা পরেই হঠাৎ চলে যায় কবরে 
ঘরের জানলা, চব্বিশ বছর, পাপের মতো খোলা ছিলো আমার 
চব্বিশ বছর ধরে নুনের মতো, আমার লোভ, নথের ভেতরে ঢুকেছিলো
জুতোর ফিতের মতো, ভাঁজ হয়ে 
আমি আর শুয়ে থাকতে চাই না বিছানায় 
অলস ছায়ায় মতো, আমি আর চাই না বিছানায় মিলিয়ে থাকতে 
ঘুম থেকে উঠে—কতোদিন—আবার ঘুমিয়ে পড়েছি আমি 
আমার সমস্ত শরীর, কর্পূরের মতো, হঠাৎ মিলিয়ে যাওয়ার আগে 
আলমারির পেছন থেকে বেরিয়ে এসে, আমি আজ সারাদিন দেখতে চাই তোমাকে 

অসুখ 

আমি কি চেয়েছিলাম বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা বেড়ে চলুক আমার
বিছানায়, ভোরবেলার সিগারেট থেকে হঠাৎ পড়ে যায় ছাই
কিছু একটা করা উচিত আমার 
এই শুয়ে থাকা, এই বসে থাকা, এই উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানোর
চিম্‌টে বাতাস থেকে 
সরে দাঁড়ানো উচিত কি আমার 
আমি কি চেয়েছিলাম সজ্জিত হয়ে উঠুক জীবন 
শুকনো জানলা দিয়ে, ভোরবেলাকার আলো এসে পড়েছে 
ফাঁকা জুতোজোড়ায় 
আমি কি চেয়েছিলাম ওইসব, ব্রাদার 
আমি কি চেয়েছিলাম, এই

চলো 

বাইরে, উঁচু-নিচু জ্যোৎস্না 
আমাদের স্বপ্নের রেলগাড়ি এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে আজ আমাদের উঠোনে— 

চলো, খাটের নিচ থেকে 
টেনে আনো তোমার ভাঙা সুটকেশ— 

সমস্তরাত আমরা ব্রিজের ওপর দিয়ে—চলো—আমাদের পুরোনো জুতো
পড়ে থাকবে আমাদের স্তব্ধ বাথরুমে 

আদিবাসীরা এগিয়ে এসে আমাদের শুধুই ভেতরের দিকে নিয়ে যাবে আরও 

চেয়ার-টেবিলের জন্যে 

এবারের শীতেও আমি টাকা পাইনি তেমন—যা দিয়ে কাঠের 
চেয়ার-টেবিল—কিনে ফেলতে পারি একটা— 
মানুষ পোস্ট-অফিসে যায়, ডাকটিকিট কেনে 
মানুষ পোস্ট-অফিসে যায়, টাকা পাঠায় বিদেশে—জন্মদিনে কোথাও 
মোমবাতি জ্বালিয়ে কেক কাটা হয় এখনও 
নরম সোফার মধ্যে সতেজ তরুণ-তরুণী ডুবে থাকে—এবং 
আমি লিফটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি যথারীতি 
আমার বুটজুতো পরতে ভালো লাগে না 
অন্ধকার রেস্তোরাঁর মধ্যে একা একা বসে থাকতে ভালো লাগে না
আমার কোনো চেয়ার-টেবিল নেই 

খুব জোরে হেসে উঠলে, দুপুরবেলায়, দূরের দেয়াল থেকে চুণ বালি 
খসে পড়ে—টেঁটী-বিড়াল
লেজ উঠিয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ—এমন নিঃস্ব দুপুরে 
আমি কি বসে বসে চিঠি লিখবো সকলকে 
আমি কি লিখবো, ভালো আছি? 
ভালো থাকার জন্যে, মানুষ 
খাঁকি হাফ-প্যান্ট পরে ট্রেনিং নেয়, দৌড়য় মাঠের মধ্যে 
শশা খায়—সমস্ত দিন শুয়ে শুয়ে 
রক্তের গম্ভীর চলাফেরার শব্দ শুনি আমি 
আমার বাঁ-হাতের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে ডান হাত 
ডান হাতের কথা ভাবতে ভাবতে মাথা টিপটিপ করে 

ওয়াল্ট ডিজনি এসে, এক রাতে, হাত ধরে নিয়ে গ্যালো আমায় ডিজনিল্যান্ডে— 
এক ছোক্রা মাড়োয়ারি, অন্যরাতে 
হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো আমার, চেয়ার-টেবিল সমেত—
ঘুমের ভেতর ঘুম নয় এইসব, সারারাত 
ফরফর ফরফর হুইসিল বাজে
ভৌতিক চেয়ার-টেবিল, ঘরময়, ঘুরে বেড়ায়—এবং 
আমি হাসতে হাসতে ঢোঁক গিলি যথারীতি 
আমার মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না
আমার ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না
আমার কোনো চেয়ার-টেবিল নেই 

ছোটো বোন 

আমি কি পাহারা দেবো
ছোটো বোন ঘুমায় যখন 

দুপুরে, আকাশ নীল
শরীরের, শান্ত কলরব 

আমি কি ঘুমোবো পাশে 
ছোটো বোন ঘুমায় যখন

কবরের থেকে উঠে এসে 

একটা মোরগ ডেকে উঠে, ভোরবেলা, বাগানের দিকে চলে গ্যালো—পৃথিবীর 
সমস্ত কবরখানা দরজা, সে-মুহূর্তে 
ঝনঝন করে উঠলো, রোদ এসে আছড়ে পড়লো গাছের মাথায় 
বিছানায় শুয়ে আমি বুঝলাম—আমি, 
এখন মৃতরা সব সারারাত ঘুরে ফিরে আবার কবরে ফিরে যায় 
এখন কবর থেকে উঠে এসে জ্যান্ত মানুষেরা— সমস্ত পৃথিবীময় ঘোরাঘুরি করে—

অশরীরী হাওয়া এসে জানলার পর্দা, চুল, মা-র হাসি উড়িয়ে নিয়ে গ্যালো
এখন বৃষ্টি শুরু—ভিজে কাক 
দূর থেকে উড়ে এসে নিয়ে এলো দুঃসংবাদ : কয়েকদিন আমাদের গাঁয়ে
বৃষ্টি নেই, হাওয়া নেই : মাঠের ওপারে চাঁদ 
ডুবে গ্যালো এইমাত্র—বুঝলাম সবই, আমি বুঝলাম 
শস্য নেই, তবু এই নির্জনে পালনে ওঠে ঝড়, ঝড় ওঠে—কিন্তু তুমি কই? 

বাপীর কানের মধ্যে আরশোলা ঘুমিয়ে থাকে, সারারাত ঘুরেফিরে 
এখন কবরে চুপচাপ, বাপী শুয়ে আছে— 
আমিও কবর থেকে উঠে, সাদা তুলো, ছুঁড়ে দিই বাংলাদেশে—এ্যাতো অভিমান
এ্যাতো অভিমান আমি কোথায় রাখবো, দ্রুত 
ছুটে যাই বাথরুমে—বাথরুমে স্নানের জল, ফুলে, ফেঁপে 
ভয় দেখায় আমাকে—বলে, ‘ডুব দাও’—
আমি হেসে উঠি—পুকুরে ডোবার ইচ্ছে পুরোপুরি ছিলো স্যার 
ছিলো আমারও—যখন দুল্কি-চালে 
শরীরের ছায়া হাঁটতো পাশাপাশি—পাশাপাশি হাঁটতো আরও কেউ— 

সকাল গড়িয়ে তারোপরে, দুপুর অনেক আগে হাত-পা ছড়িয়ে ভেসে গ্যাছে 
ফের সন্ধেবেলা—ফের কবরের মধ্যে শুয়ে আমি 
চেয়ে দেখি, প্রতিদিনকার মতো সেজেগুজে 
আমার কবরে তুমি একটা একটা করে ফুল দিচ্ছো—চেঁচাতে পারিনা, তবু 
এ্যাতো ভুল সহ্য হয় না—’আরতি আরতি 
তুমিও বুঝলে না 
ডাক্তারখানায় যারা ডাক্তারের আগে এসে বসে থাকে, আমি তাদেরই একজন’ 

শীত 

তোমার চুল উড়ছে হাওয়ায়—বাঁ-হাতে, তুমি ধরে আছো তোমার টেলিফোন
শীতের আলোয়, আবার আমি ফিরে এসেছি আজ তোমার ঘরে 
তোমাদের বিড়াল—দেখি, আগের মতো 
ততোটা ক্ষিপ্র নয় আর—তোমার পশমের বল 
দেখি, গড়িয়ে চলেছে—আরও গড়িয়ে চলেছে ঢালু খাটের নিচে—
চুপচাপ বসে আছি আমি—চুপচাপ হাই তুলছে তোমাদের বিড়াল
শীতের ঝর্না, ডেকে ডেকে ফিরে যাচ্ছে আমাদের 

হায়, জীবন 

জানি না আমি আজ সন্ধেবেলা কী ভেঙে পড়বে আকাশ থেকে—
মোটরগাড়ি, ল্যাম্প-পোস্টের ভেতর দিয়ে 
দেখি, কলকাতার দিকে চলে গ্যালো—আমাকেও ঐরকম 
কলকাতার দিকে চলে যেতে দাও—ছাব্বিশ বছর, শেষ হতে চললো আমার
হে ঈশ্বর, আমি জানি—আটাশ বছর, তিরিশ বছর, এইরকমভাবেই
কেটে যাবে আমার—আমার পা 
বিকেলের আলোয় খোলাখুলি ছড়িয়ে থাকবে বিছানার ওপর 
হাত, অলসভাবে তুলে নেবে জলের গেলাস—দূরে, বহুদূরের
সেই দিনও হয়তো থমথম করবে এই রকম—মাথার ওপর দিয়ে, দ্রুত
চকিতে উড়ে যাবে মুখর উড়োজাহাজে—আমার ভালোবাসা 
আবার আমি ফিরে পাবো কি কোনোদিন? জানি না 
জানি না আমি, কোন্ শুভ্র হাত থেকে 
ঝরে পড়ে ভালোবাসার সবুজ তৃণ—কোন্ অলৌকিক আলোয়, কুষ্ঠ রোগী 
মুখ তুলে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে—আশেপাশে 
কেউই থাকে না আজকাল, কেউ নয়—
মানুষের থেকে, আরও নিপুণভাবে লুকিয়ে পড়া শিখে নিয়েছে 
এমনকী বিড়ালগুলো—অনেক চিঠি লেখা 
শেষ হলো আমার—জানলার পাশে বসে শেষ হলো আমার, অনেক 
ভাঙা দুপুর—আমার এই ঘর 
আমি ছেড়ে যাবো একদিন—আমার চেয়ার থেকে নিঃশব্দে উঠে, একদিন 
আমি অদ্ভুত নির্বাসনে চলে যাবো—গ্রীষ্মের দুপুরে 
কুকুরগুলো ঝিমোতে ঝিমোতে অতীতের কথা ভাবে? আমি জানি না
জানি না আমি—অর্থহীন বারান্দা 
শুধু শুধুই জেগে ওঠে আমার বুকের ভেতর-হায়, জীবন 
আর কিছুই মনে পড়ে না আমার-আমার কিছুই মনে পড়ে না আর 

কেন 

কেন, উন্মাদ করে না ভালোবাসা—
আমি শুধু, নতুন 
কাগজ কিনি—খালি গায়ে 
ঘুরে বেড়াই ঘরের মধ্যে—চারপাশ থেকে
কতোশতো ব্যর্থ দিন বহে গ্যালো—
লাল মোটরগাড়িতে আমার 
হাসা হলো না—বিয়েবাড়িতে, যথাযথ 
হাসা হলো না আমার—চিহ্নহীন 
বছরগুলো, ওই পড়ে আছে পেছনে—প্রত্যেক 
জানলার পর্দা সরিয়ে, আমি 
বাড়িয়ে দিই মুখ—আমি দেখি 
একটা দিন, আরেকটা দিনের মতো
আরেকটা দিন, আরেকটা দিনের মতো
এইরকম, অস্থিসার, ফাঁকা 

রাত্রি 

কোনো টাইপ-রাইটারের শব্দ নেই এখন—দু’একটা
ভাঙা গলার স্বর 
ভেসে আসছে ঘরে—এবং রাত্রির আকাশ থেকে
ঝরে পড়ছে নক্ষত্র, শব্দ নেই, শুধু মানুষ 
মাদুর পেতে শুয়ে রয়েছে বারান্দায় 
মশা মারছে 
বুড়ো হয়ে যাচ্ছি আমি 

প্রতিশোধ-১ 

এমন কি আমার চুরুট, বন্দুকের মতো, ছুটে যাবে তোমার ঘরে—
সকালবেলা আমি 
বসে থাকবো আমার বিছানায়—একটা বিড়াল, রোজ, রুটিন-মাফিক
চেটে দেবে আমার পা-কোথাও যাবো না আমি— 
আমার ঘাম বিশাল জলের মতো 
আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকবে তোমার ঘর—তুমিও কোনোদিন 
যেতে পারবে না কোথাও— দু’হাজার মাইল দূরের 
ছোট্টো এক ঘর থেকে, প্রতিদিন, আমি কথা বলবো তোমার সঙ্গে
তুমি খেতে পারবে না ঘুমোতে পারবে না 
তুমি গান গাইতে পারবে না হাসতে পারবে না 
তুমি থেকে থেকে—সারাজীবন—কেবলই আঁতকে উঠবে ভয়ে— 

কালো আকাশ ফাঁসিয়ে, বর্ষাকালে, ঝনঝন নেমে আসবে বিদ্যুৎ
মানুষ, মানুষের ভালোবাসার জন্যে 
চিরকাল, পথের ওপর বসে বসে কাঁদবে—আরও রাত্রি হ’লে 
আমি বিড়াল নিয়ে শুতে যাবো বিছানায়— দু’চোখ বন্ধ করে, আরও
পরিষ্কারভাবে আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো তোমার 
লম্বা, দুঃখিত মুখ—তোমার নীল জামা হাওয়ায় ওড়াউড়ি করবে
তোমার ঘরে—তুমি জানলায় এসে দাঁড়ালে 
জানলা থেকে সরে যাবে তোমার বাগান—পৃথিবীর সমস্ত নদী
তোমার ঘরের বহুদুর দিয়ে গান গাইতে গাইতে বহে যাবে—

এ ঐ ও ঔ সারাক্ষণ বসে আছে তোমাকে ঘিরে—হাঃ, ওরা কেউ 
তোমাকে বাঁচাতে পারবে না—ওরা প্রত্যেকে 
নিজেদের হাঁপানি নিয়ে, একদিন, দৌড়োদৌড়ি করে মরবে—আমার রক্তে 
এখনও বেজে চলেছে অপমানের বাঁশি -আলো 
আরও কমে আসছে আজ আমার ছোট্টো ঘরে—তৈরি হও, তৈরি হও তুমি— 
ঘুম থেকে উঠে, আমি বহুদিন 
টেনে নেবো চায়ের কাপ—ঘুম থেকে উঠে, তুমি বহুদিন 
ধুয়ে নাও তোমার শুকনো আগোছালো মুখ—
তারপর বিশাল ঘণ্টা বেজে উঠবে কোথাও একদিন—সময় হ’লে 
মরা মাছের মতো আমি ভেসে উঠবো জলের ওপর 
মরা মাছের মতো জলের ওপর ভেসে থাকবে তুমি 

হেমন্ত 

আমরা হেমন্তকালের কথা কোনোদিন ভুলি না—হোটেল থেকে বেরিয়ে, আমরা
কেবলই ছেলেবেলার হেমন্তকালের দিকে চলে যাই— 
ঐখানে কোনো দারোয়ান বন্ধ করে দেয় না দরজা—ঐ পথে 
হ্যারিকেন লাগে না কোনো—আমরা অফিস থেকে ফিরে এসে
মোজা খুলতে খুলতে হঠাৎ নিশ্বাস ফেলি-আমরা রাস্তায় 
হঠাৎ চুলকে নিই হাত—প্রবন্ধে, এইসব কথা লেখা থাকে না কখনোই—
আমরা পুরোনো হোটেলে যাই, শুধুমাত্র, হেমন্তকালের জন্যে
আমরা ভালোবাসি সিগারেট—আমাদের, চারপাশে হেমন্তকাল 

তোমাদের-১ 

ভাঙা রান্নাঘরে ভেতর, ভিজে কাঠের ধোঁয়া—
তোমার ছোটো বোন 
বাঁ-হাতে লণ্ঠন তুলে ধরেছে ঐ— 
ওকে একটা চলনসই জামা কিনে দেবো আজ 
আর, শোনো 
ক্যামেরাম্যান 
এসেছিলো সেইদিন 
সেইদিন, আলো পড়ে এলো খুব তাড়াতাড়ি 
এরকমভাবেই সমস্তকিছু ভণ্ডুল হয়ে যায়—তুমি ভেবো না
অন্য একদিন, আমি ফটো তুলে দেবো তোমাদের 

অবশিষ্ট 

সরু রাস্তার মতো, লম্বা করিডর 
শুধু একটা চেয়ার, আজ সমস্ত রাত, বসে থাকবে করিডরে 

ঝোপ থেকে 
লাফ দিয়ে উঠে আসবে চাঁদ 
সিঁড়ির কোণ থেকে বিড়াল আজ সরে যাবে উনুনের পাশে 

শুধু একটা আলপিন, আজ সমস্তরাত, দোল খাবে হাওয়ায়
শুধু একজন মানুষ, খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকবে 

স্তব্ধতা বিষয়ে 

ওইরকম ছিলো আমার জীবন—অচেনা বাড়িগুলোর, ভেতর
পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতাম—

রাত্তিরে, তোমার পুরোনো চিঠির ওপর ঝুঁকে পড়েছি আজ
মিশরের রাস্তা, এখন 
আমাদের থেকে অনেকদূরে—একদিন, হাঁটতে চেয়েছিলাম
মনে আছে তোমার সেইসব? মনে আছে? 

স্তব্ধতা বিষয়ে, যদি চাও, আরও কিছু আমি লিখে জানাতে পারি
তোমাকে—এখন, আমাকে দ্যাখো 
দ্যাখো, একা একা আমি রান্নাঘরে নেমে আসছি কীরকম 
ও বাড়ির গুরুপদ সেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে 
ইঁদুর-মারা কল এখন ছুটে চলেছে ইঁদুরের পেছন পেছন 

পোড়া কয়লা, এ-দিক ও-দিক, জ্বল জ্বল্ করছে মেঝেতে 

পুরোনো, কাগজের মালা 

হাতে, পুরোনো কাগজের মালা—তুমি জানো শুধু, অপেক্ষা করতে হয় কীভাবে— 

সবুজ পানাপুকুর পেরিয়ে, ছোট্টো তোমাদের বাড়ি 
তোমাদের পুকুরে কাঠের নৌকো ভাসে না কোনোদিন-তোমাদের গলিতে
লাফাতে লাফাতে ঢোকে না সাহেব, আর মেমসাহেব হেসে ওঠে না সহসা
শুধু দুপুর হলে, চলে যায় ট্রেন 
শুধু বিকেল হলে, স্কুল থেকে ফিরে আসে ছেলেরা, আর কমলালেবুর খোসা
জমে ওঠে রাস্তার ওপর—তোমার ছাপানো শাড়ি, হঠাৎ 
আমি অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখি তোমাদের বারান্দা থেকে—তোমার পুরোনো চিঠি
হঠাৎ আমি খুঁজে পাই আমার বাক্সের ভেতর—
সত্যি, এক নম্বরের হাবাটে আমি 
আমার দিনগুলো আমি কাটিয়েছি যথার্থ একটা উল্লুকের মতো— 
মনে পড়ে তোমার, শুকনো, বিক্ষিপ্ত মুখ 
মনে পড়ে তোমাদের, পারিবারিক, শান্ত অ্যালবাম—অসুখ থেকে উঠে 
তুমি সেবার বেড়াতে গেলে না কোথাও—তোমার সুটকেশ 
পড়ে রইলো তোমার খাটের নিচে—তোমার টেবিলে, এলোমেলো 
পড়ে রইলো তোমার ইতিহাসের বই—
আমার ভুলগুলো আজ পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারি আমি—সন্ধেবেলা
হাঁটতে হাঁটতে ঐ বাড়ি ফিরে চলেছে মানুষ—শুকনো গাছটায় 
দেখি, আবার যাতায়াত শুরু করেছে পাখিরা—শোনো, সমস্তকিছুই নষ্ট হয়নি
সমস্ত কিছুই শেষ হয়ে যায়নি আমাদের—বৃষ্টির মধ্যে 
আবার আমার কাগজ-পত্তর টেনে আনবো আমি—আবার আমরা ব’সে ব’সে
মজার গদ্য পড়বো আমাদের বারান্দায়-আমার অসুখের কথা 
হয়তো সকলেই জেনে ফেলবে সেদিন, আর আমাদের ম্যাট্রিক-ফেল মেজদি 
বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে থাকার জন্যে 
প্রতিদিনই হয়তো দুঃখ করবে—প্রতিদিনই, হয়তো কাঁদবে খুব—শীত-গ্রীষ্মে
সকলের জন্যেই ঝলমলে পোস্ট-কার্ড পাঠিয়ে দেবো আমরা—সকলের জন্যেই
শুভেচ্ছা আর গরীব ভালোবাসা আমাদের 
হৈ হৈ করে, হঠাৎ আমরা ঘুরে আসবো একদিন বর্ধমান 

শুধুমাত্র তোমাকে-৩ 

তোমার মাথার ওপর দিয়ে, দ্রুত, উড়ে গ্যালো একটা এরোপ্লেন—
দূরে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি দেখি 
কী বিশাল ছায়া পড়লো তোমার শরীরে—আর পাখিরা
এই উনিশশো একাত্তরেও ভয় পেলো খুব—সত্যি
পাখির বিষয়ে আমরা কতো কম জানি—গাছের বিষয়েও
আমরা বিশেষ কিছুই জানি না—এক একটা গাছের সঙ্গে
সারাজীবন থেকে যেতে ইচ্ছে করে—এক হাজার পাখির মধ্যিখানে
বসে থাকতে ইচ্ছে করে দুপুরবেলা—সত্যি 
দুপুরবেলা, আরও কতো কী করতে ইচ্ছে করে—হলুদ শাড়ি প’রে
যখন তুমি দাঁড়িয়ে থাকো বারান্দায় 

এসো 

ভঙ্গী পাল্টাও, এসো, ছুটে ধরি দু’ঘণ্টার ট্রেন—
বিকেলবেলার এই 
পৃথিবী, বুকের কাছে এসে—কিছু থেমে আছে—
পাগল চলেছে ওই পাগল ছুটেছে ওই ওকে তুমি
বসতে দেবে কি? 
ওকে দেবে, জল? 
যতোটুকু ভুলে যাই তারো বেশী মনে পড়ে ফের
ওই যে ধবল কুষ্ঠ ছুঁয়ে আছো—ভুলে যাও তুমি— 
এসো, নড়াচড়া করি 
বিশাল বৃক্ষের নিচে—বসে থাকি—পাখির মতন 

তোমাদের-২ 

কেরোসিনের গন্ধে, আবার মনে পড়লো তোমাদের—অন্ধকার উঠোন—
কোথায়, ট্রেন চলে যাচ্ছে দূরে 
আর এই সন্ধেবেলা, আমি একা একা বসে আছি 
চেয়ে দেখছি, আমার জানলা, আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে দু’দিকে 
তোমাদের কাপড়-কাচা শেষ হয়েছে এখন? 
অনেক বছরের পর, আরও অনেক বছর, কীরকম পার হয়ে গ্যালো 
মনে পড়ছে আজ তোমাদের সাদা বিড়াল ছানাটার কথা—মনে পড়ছে
তোমাদের হাসি—চোখের জল, তোমাদের 

স্টেশন 

তোমার রোগা মুখের ওপর, সন্ধেবেলা, ফুটে উঠলো এক দীর্ঘ রেখা—
তুমি বন্ধুর থেকে চেয়ে আনলে বই, ফিরিয়ে দিলে আবার 
তুমি একদৃষ্টে, চেয়ে রইলে খোঁড়া মেয়েটার দিকে—খোঁড়া মেয়েটা
উপহার দিলো তোমাকে এক অবিস্মরণীয় হাসি, 
একটা মালা, দুলে উঠলো অনেকদুরে— 
ঝরঝরে বাস, নামিয়ে দিলো তোমাকে এক ফাঁকা রাস্তার ওপর 

যে ডাকছে পিছন থেকে—তোমাকে ডাকছে না—চলো, টিকিট কেনো 

প্রীতি-উপহার 

মনে হচ্ছে, আর কোনোদিনই দেখতে পাবো না তোমাকে—এই রাত্তিরবেলা, আজ 
ঝড় উঠেছে ভীষণ—আমার সমস্ত শরীর ও আত্মা 
আজ দুপুর পর্যন্ত আয়ত্তে ছিলো আমার—আজ দুপুরেও দেখেছি 
গাছের ছায়া মাটির ওপর সুন্দর দোল খাচ্ছে হাওয়ায়, সরু পাঁচিলের 
আড়ম্বরহীন ট্রেন; দৌড়ে যাচ্ছে—অন্ধকার দোকান থেকে 
পাশ দিয়ে 
এইমাত্র আমি ফিরে এলাম—অন্ধকার দোকান থেকে ফিরে এসে 
পৃথিবীর জন্যে চমৎকার দুঃখের এক কবিতা আজ লিখে রাখছি আমি—আমি
মোজা খোলার বদলে এখন উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছি বিছানায়—
দূরে, শুকনো পাতা 
একে একে ঝরে পড়ছে, আমি স্পষ্ট শব্দ শুনতে পাচ্ছি তার
আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমার মুখ তোমার গলা
আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আমার সমস্ত কিছু, শব্দহীন আজ ঝরে পড়ছে 
একে একে 

ঐ একা তুমি বসে রয়েছো জানালায়— তোমার বন্ধু আজ তোমাকে ফেলে
থিয়েটার দেখতে চলে গ্যাছে—কলেজের খেলাধুলো থেকে
তুমি বরাবরই দূরে সরে গিয়েছিলে এইরকম—ধর্মসভা শোকসভা থেকে
তুমি এইরকমই আরও দূরে সরে গিয়েছিলে তোমার ঐ ব্যক্তিগত জানালায়—
তোমার জন্যে, পাথরের একটা হাতি কিনতে চেয়েছিলাম আমি
তোমার জন্যে কিছুই কেনা হয়নি আমার, আমি ভোরবেলা ছুটে গিয়েছি
বন্ধুর বাড়িতে— 
সাদা জামা-প্যান্ট, কতো প্রিয় ছিলো আমার 
কতো প্রিয় ছিলো তোমাদের কুয়াশা-ঢাকা বাগানবাড়ি আর নিথর বারান্দা
বৃষ্টির জল যেখান থেকে সশব্দে গড়িয়ে পড়তো নিচে 
যেখানে একসময় চুপচাপ বসে থাকতাম আমরা বিকেলবেলা 

পৃথিবীর সমস্ত পুকুরপাড়ের সরু রাস্তার পাশে একটা লম্বা গাছ, অকারণে
দাঁড়িয়ে থাকে—তোমার পাশে 
আমি দাঁড়িয়ে থেকেছি সেইরকম—দুপুর বারোটায় 
আমি বাসন পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনেছি মেঝেতে—কলাপাতায় রোদ্দুর দেখে 
আমি দৌড়ে, বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিলাম একদিন—আমি কোনোদিন
কোথাও যাইনি, কোথাও যাওয়া হয়নি আমার, এক আধবুড়ো ডাক্তার এসে
আমার চামড়া পরীক্ষা করে গ্যাছে গতকাল-আজ সমস্ত দিন 
আমার হারিয়ে-যাওয়া দিনগুলোর কথাই শুধু ভেবেছি আমি—আমি
জিভ দিয়ে ছুঁয়ে দেখেছি মৃত্যু, ছুঁয়ে দেখেছি জীবন—এবার গ্রীষ্মে
আমার অসুখ আরও ভয়ংকর ছড়িয়ে পড়বে মনে হচ্ছে 
এবার গ্রীষ্মে, এক নতুন হাতপাখা আমি উপহার দিয়ে যাবো তোমাকে 

উট 

আমিও তোমার সঙ্গী—বালির ওপর দিয়ে চলেছি সারাজীবন 
লম্বা গলা—উৎসবহীন ম্লান চোখে— 
শোনো, আমি 
জেগেছি অনেক রাত—লিখেছি বোকার মতো অনেক কবিতা—
তোমার আছে কি ম্যানেজার? 
আমি দেবো, আরও কাঁটাগাছ, আধুলি ভাঙিয়ে—অথবা দুপুরবেলা 
হোটেলের রান্নাঘরে উঁকি দেবো 
তোমার আমার জ্বর সন্ধেবেলা 
চেয়ে দ্যাখো, ঝুম্পার মা আর ঝুম্পা একা বসে আছে বারান্দায়
এসেছে ফাল্গুন মাস—চলো যাই—নিয়ে চলো তোমাদের দেশে 

হারে রে রে 

পত্র-পত্রিকার মতো, সারি সারি পুরোনো জুতো, আমি সাজিয়ে রাখি ঘরে—
আসে, বন্ধু-বান্ধব 
আসে, বুড়ো এবং আধবুড়ো আরও অনেকজন 
আমি শুনি, জীবনবীমা-র উপকারিতা সম্পর্কে অনেককিছু
নোংরা-পা—আমি চাই না, সকালবেলা কুঁচকে থাকুক আমার কপাল
আমি গল্প জুড়ি : তেল মাখতে মাখতে আমি দেখেছি 
তেলের শিশি থেকে হাসতে হাসতে উঠে আসছে রাজকুমারী…
এবং বিশ্বাস করে না কেউ, পায়ের ওপর পা তুলে, আমি পা নাচাই
ঘুমোতে যাবার আগে, ওঃ 
ঘুমোতে যাবার আগেই আমি স্বপ্ন দেখি সুখের 
ঘুম থেকে উঠে, আমি ঘষে ঘষে সাজিয়ে রাখি আমার 
পুরোনো জুতো 

বেরিয়ে পড়ি তখনই, যখনই, সাড়া পাই দূরে—
একবার এইরকম হলো : 
চুপ করে থাকতে বলা হলো আমাকে—আমি
কথা না বলে রইলাম, একবছর দু’বছর তিনবছর—
শেষের দিকে, কোথাও যেতাম না আমি 
শেষের দিকে, জামা-প্যান্ট পরে, চুপচাপ 
শুয়ে থাকতাম সন্ধেবেলা—
আমাকে ঐরকম দেখে, এক ভদ্রলোক, একদিন 
রেগে আগুন—তিনি 
বলেছিলেন আমাকে—‘সমস্ত কিছুই খাবে, কম বয়স তোমার 
গাড়ি-চালানো শেখো 

মৃত কবিদের জন্যে আমি নিয়ে এলাম ঘরে, সবুজ একটা ফুল—
নদীর দু’তীরে দুটো জাহাজ, দু’তীরেই 
ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম আমি—আমার পায়ে পুরোনো জুতো, হাতে 
মাফলার-জড়ানো একটা মেয়ে, সেই বিকেলবেলা 
নতুন সিগারেট— 
চুমু খেয়েছিলো আমাকে, আর বিকেলবেলা ভেঙে পড়েছিলো 
আর বিকেলবেলা ছড়িয়ে পড়েছিলো, মৃত, সমস্ত কবিদের বুক পর্যন্ত—
আমি লুকিয়ে, যোগাযোগ রেখেছি ওদের সকলের সাথে 
ওদের সকলের কাছেই আমি পাঠিয়ে দিয়েছি আমার নতুন কবিতা
মোজার মতোই, যা ঝলমলে 

বিশাল নাকের ওপর, বসে রয়েছে, ছোট্টো একটা মাছি— 
আমি আরও ছোট্টো ছিলাম যখন 
চাদর মুড়ি দিয়ে দেখতে যেতাম ‘শাজাহান’ 
চাদর মুড়ি দিয়ে দেখতে যেতাম ‘সিরাজদ্দৌলা’—
এখন আমি জুতোর দোকানে যাই, জুতো কিনি 
বাস থেকে নেমে, বাসের টিকিট, ফেলে দিই ফুটপাতে 
সাতবছর, আমি একটা ভূতের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি কলকাতা 
আমার হাত ছিলো না, পা ছিলো না 
আমার বই আমি আর বিক্রী করবো না কোনোদিন 
আমি এখন ভুলে যেতে চাই সবকিছু 
আমি বেঁচে থাকতে চাই তোমাদের সঙ্গে, জয়হিন্দ 

দাঁতের হাসপাতাল হাঁ-করে দাঁড়িয়ে আছে, এসো আজ আমরা দুজনে
দাঁতের হাসপাতালে গিয়ে দাঁত দেখিয়ে আসি—
লাফ দিয়ে দাঁত পড়ে—মনে রেখো—এসো আজ আমাদের দাঁতের হলুদ
ধুয়ে আসি—কিংবা চলো ডাক্তারের কাছে ছুটে গিয়ে 
এমনিই বসে থাকি—চেয়ে থাকি—সঙ্গে সঙ্গে থাকি ডাক্তারের 
দাঁতের হাসপাতাল হাঁ-করে দাঁড়িয়ে আছে, এসো আজ আমরা দুজনে 

উঠে এসো। ভালো নয়, এইসব ভালো নয়, জানো—
এই যে নিজের সঙ্গে ইয়ার্কি করছো 
এই যে সমস্ত দিন 
ফালি-কুমড়োর মতো শুয়ে আছো 
ভালো নয়— 
উঠে এসো—মোটা উরু, লাথি মারো, ভাঙো 
ঘরের মেঝেতে পোঁতো—লেবুগাছ 
ওই ওই 
ওই তো বাবার জেবঘড়ি 
ছুঁড়ে দাও, ও বাড়িতে। কিংবা পকেটে পোরো, চলো 

সমস্তদিন বসে বসে, আমি আজকাল, আমার পায়ের কথা ভাবি—
কাল সমস্তরাত, আমার পা-র জন্যে 
আমি বসে বসে কেঁদেছি—আমার পা, হায় 
আগের মতো নেই আর—ক্রমশই রোগা হয়ে যাচ্ছে—আজকাল 
জুতোই পরতে চায় না কিছুতে— 
আমি, কতো ধমক দিই—দেশ-বিদেশের গল্প শোনাই কতো—
তোমাদের লম্বা পা, যথেষ্ট খুশী করে আমাকে—সন্ধেবেলা
আমার পা এখন ঘুমিয়ে পড়েছে, মোটা একটা ছুঁচ দিয়ে, আমি
খোঁচা দিচ্ছি, দেখছি ওরা বেঁচে আছে কিনা… 
দ্যাখো হে, ওরা চিৎকার করছে—দ্যাখো হে, ওরা জেগে উঠছে—দ্যাখো, ওরা
আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ছে রাস্তায় 

লাল পিঁপড়ের লাইন ধরে, ঘুরে বেড়ালাম, সমস্ত সকালবেলা—
ছুটতে ছুটতে দেখে এলাম 
দু’একটা দাড়ি পাকছে সন্দীপন চাটুয্যের—এবং 
সমস্তকিছু ঠিকঠাক আছে, সমস্তকিছু, 
রাতদিন মাইক বাজাচ্ছে 
শুধু ও-পাড়ার ছেলেরা 
হষ্টেলের বারান্দা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মেয়েরা ঝুঁকে পড়েছে, আমার 
সর্দি হলো খুব—
তবু, হেই হেই করে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে 
আমি খড়ম হাতে ছুটে গেলাম রান্নাঘরে—
ঝুলভর্তি রান্নাঘর থেকে ডাক পড়লো আমার, আহা, বিছে মারার জন্যে 

আমি লক্ষ করছিলাম, আমার ভিজে জুতোটা, বৃষ্টিতে আরও ভিজছিলো—
পা, জুতোর থেকে অনেক দূরে—তোমার থেকে 
আরও অনেক দূরে বসে বসে আমি চেয়ে দেখছি এখন 
মানুষের, সরু হাত 
ছুঁয়ে রয়েছে, আরও সরু একটা জানলা-আমার কিশোর বন্ধুরা 
খেলার জন্যে, আমাকে ডেকে ডেকে ফিরে গ্যাছে—আমি যাবো—আর
দুর্ভাবনা নেই আমাদের 
খুব তাড়াতাড়ি ঐ এসে গ্যালো আমাদের হাসির দিন 
জানলার পাশে, এই যে বৃষ্টিতে ভিজে পড়ে আছে দর্শনের বই 
ভালো লাগছে খুব, আশেপাশে 
ভালো লাগছে আমার 
দৌড়তে দৌড়তে যাওয়া-আসা করছে মানুষ—দাড়ি-কামাতে, দ্রুত
ঐ ঢুকে পড়ছে সেলুনে 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত