ভাস্কর চক্রবর্তী
ভাস্কর চক্রবর্তী (১৯৪৫-২০০৫) সেই বিরল জাতের কবি। বাংলা ভাষাতেই এমন কবি বিরল, যাঁর কবিতায় একটি নতুন যুগ, তাঁর নিজের ভাষায় কথা বলে ওঠে বাঙালির নগরজীবন। যে কোনও কবির পক্ষেই এ এক বিরল কীর্তি, তাতে সন্দেহ নেই। বস্তুতপক্ষে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার জন্মলগ্ন থেকেই জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সমর সেন প্রমুখ কবির হাতে নাগরিক মানুষের সংকট ও শূন্যতার সঠিক অভিব্যক্তি রচনার চেষ্টার শুরু। পরবর্তী কালে শক্তি-সুনীল-শঙ্খ-উৎপল আদি পঞ্চাশের কবিদের কলমে সেই প্রয়াস তীব্রতর। কৃত্তিবাসী আন্দোলন এবং হাংরি আন্দোলন এ দুয়েরই মিলিত অভীষ্ট ছিল কবিতায় নাগরিক কণ্ঠস্বরের চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা। সব মিলিয়ে কবিতায় নগর-যন্ত্রণার ভাব জমছিল অনেক, কিন্তু ভাষাটা ঠিক ফুটছিল না। এমন সময়, বিশ শতকের ষাটের দশকে, ভাস্কর চক্রবর্তী নামের এক নতুন কবির কবিতায় হঠাৎ শোনা গেল এই সব আশ্চর্য উচ্চারণ।
প্রেম
……..
আমার স্মৃতি ছিল জটিল ফলে ডাক্তারবাবু কিছুটা ছেঁটে দিয়েছিলেন।
কিন্তু এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে সেই দিন
হাঁটু পর্যন্ত মোজা, আর সকালবেলা চুল ছড়িয়ে পড়েছে পিঠে!
অথবা, কিছুই ঘটেনি হয়তো কোনোদিন-
আমিই হয়তো স্বপ্নে দেখেছিলাম পুরো ব্যাপারটা
একটা কাঠবেড়ালী আমার জন্যে একটা বাদাম নিয়ে ছুটে আসছে।
সারারাত – স্বপ্ন দেখার মহড়া
……………………………….
যেমন মৃত্যু, মনে হয় কি তোমার কোনো পাখির রঙিন পালক? মুখ পর্যন্ত শুধু একটা চাদর ঢেকে দেওয়া ! অথবা চিৎকার, বেসুরো সব চিৎকার আমার তো মনে হয় স্তব্ধতা ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসে না। চারদিকে ভাঙা কাচের টুকরো আর ক্ষয়ে-যাওয়া মুখ কারণগুলো শুধু ছটফটায় আমার মাথার ভেতর আর মোচড় গুলো আমাকে ঘুমোতে দেয় না সারারাত শুধুই চটি-ঘষটানোর শব্দ– দুঃস্বপ্নের শব্দ সারারাত
যে কবিতাটা আমি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম
………………………………………………….. সন্ধেবেলার ডানায় এখন সাদা তিনফোঁটা বৃষ্টিবিন্দু। সুর নেই, তবু দু-একটা গানে গলা মেলাচ্ছে ছেলেরা মেয়েরা। নভেম্বরের রাত্রিতে এক মাতাল ভিজছে চোদ্দ বছর কাটিয়ে দিলাম আত্মহত্যা করিনি। তোমার বাড়ির রাস্তা আমাকে খুঁজে পেতে হবে। ভেবেছি কতই। আজ চেয়ে দেখি, ছোট্ট পাখির ঠোঁট ছুঁয়ে সেই রাস্তা গিয়েছে। বই-খাতা সব ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে স্বপ্নে দেখেছি গতকাল, তুমি আমাকেই ভালোবাসছ। রেডিয়ো এখন খেলনাবাক্স প্রচারগাড়ির সামনে আসুন। উড়তে থাকুন দূর মহাকাশে ভাসতে থাকুন মেঘে মেঘে একা। দিদিরা ভায়েরা, এ সপ্তাহের নতুন ঘোষণাঃ নগদ অথবা সহজ কিস্তি ভালোবাসা এক মিনিটে। বেরিয়ে পড়েছি সকালবেলায় কলকাতাটাকে কিনে নেবো আমি। কিনে নেব দিন রাত্রি কিনবো চিন্তাভাবনা পাঠাব দিল্লি। সামান্য এক ইঞ্চিতে সব ধূলিসাৎ হয় বাবা ভোলানাথ মারুক। কাটুক। বাড়ি আর ফিরে যাব না।
মানুষ
………………….
মানুষের পাশ থেকে মানুষের আড়ালে যাবার শব্দ শুনি শুনি, মহাকাশযুগ শুরু হয়ে গেছে। নিরীহ কবিতা দিয়ে তৈরি এক বর্মের ভেতর ছিলাম নিশ্চুপ আমি ছিলাম নিশ্চুপ আমি একা। আরো এক নবজাগরণ আমাদের শেষ হলো নাকি? দাঁড়িয়ে রাস্তায়, বাসে, ভাবি কোথায় চাহনিগুলো! হাসিগুলো কোথায় হারাল আজ তবে! হয়তো বা শেষতক হাঁটা আর হেঁটে যাওয়া মানুষের ভালোবাসা মানুষের কাছে পড়ে আছে।
ধস্
…………
আমাকে রাস্তা থেকে আজ সন্ধেবেলা কেউ যদি পাখির মায়ের মতো তুলে নিয়ে যেতো দূর কোনো দেশে, যেই দেশে, নখের বাহার নেই তেমন ধূর্ততা নেই শেয়ালের- শুয়োরশিশুর ঘোঁতঘোতানিও নেই- তাহলে কি পান থেকে খসে যেতো চুন? সার্থক জনম আমার ঘুরে-ফিরে দেখা হবে অগ্নিকাণ্ডে, নিরুপায় রাস্তায়, আড়ালে- চোখ বুজে, ঝুঁকে পড়ে, আমিও আবার শুনে যাবো বাংলা কবিতার গতি কোনদিকে- সদ্গতির কুড়ল, বিদ্যুৎ। কেউ অভিশাপ তবে দিয়েছিলো, আমরা তাহলে এমন বালির মধ্যে ঢাকা পড়ছি কেন? কেন উড়ে যেতে চাই ভিড় থেকে – বলো কেন তবে ফণা শুধু রাতদিন? দুঃসহ এ সন্ধে আজ ছায়া নেই গন্ধ নেই একটা রাক্ষসী শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে।
( ০৩-০৬-১৯৮২ দিনকাল, অগ্রন্থিত ও অপ্রকাশিত কবিতা )
আমি আর শয়তান
……………………
শয়তানের মাথায় ঢুকে পড়েছে
আমার হতচ্ছাড়া মাথা।আমার রক্তে শয়তানের দু-এক ফোঁটা রক্ত এসে মিশেছে।আমরা দু-জন পাশাপাশি একই ঘরে থাকি। কখনও চুপচাপ আমি ওকে সিগারেট কিনে এনে দিই- কখনও চুপচাপ সে পা টিপে দ্যায় আমাকে।
এসো, সুসংবাদ এসো
………………………….
দিনগুলো, কেমন চাকার মতো,
অযথা আমাকে পিষে যায়…। – বাস থেকে নেমে মনে হলো বিদেশেই আছি। তবু কে ওই মেয়েটি? আমাদের ঘরের মেয়ের মতো মনে হয়। হয়তো মিনুর বোন হবে। এসো, সুসংবাদ এসো- আর কোনো ইচ্ছে নেই, শুধু ওই মেয়েটির সঙ্গে যেন আমাদের তরুণ কবির বিয়ে হয়।
