| 28 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

অণুগল্প: সন্ধ্যাকুমার সন্ধ্যাকুমারী । অলীক অনামিকা

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

“শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত | গভীর সন্ধ্যায়

নরম, আচ্ছন্ন আলো ; হলদে-ম্লান বইয়ের পাতার

লুকোনো নক্ষত্র ঘিরে আকাশের মতো অন্ধকার ;

অথবা অত্বর চিঠি, মধ্যরাতে লাজুক তন্দ্রায়

দূরের বন্ধুকে লেখা | “

(বুদ্ধদেব বসু, রাত তিনটের সনেট – ১)

১.

তিনি বসেছিলেন হাসিমুখে সভার মধ্যমণি হয়ে।

হাতে সিগারেট, গভীর কালো চোখে জটিল দুষ্টামি, গাঢ় লাল ঠোঁটের ফাঁকে গজদাঁত দেখে মনে হয় তিনি মানুষের মতন কিন্তু আসলে মানুষ কিনা কে বলতে পারে?

ঈদ উপলক্ষে প্রবাসী লোকেরা,

কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু বা খ্রীষ্টান, কেউ নাস্তিক বা স্পিরিচুয়াল –

সকলেই উৎসব, নাচগান আর দক্ষিণ/পশ্চিম এশীয় সুস্বাদু খাবারের লোভে বিকাল বেলা জড়ো হয়েছে বার্লিন শহরের একটা খোলা মাঠে।

সেদিন গ্রীষ্মকাল।

বাংলার বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ্য মাসের মত এই উত্তরের শহরে ঠাঠা রোদ উঠে নাই, মাঝেমধ্যে শুধু গরম হাওয়া দিচ্ছে, তবু আমরা কেউ কেউ অপ্রত্যাশিত উষ্ণ আবহাওয়ায় আহা উহু করে যাচ্ছি।

কয়েক দফা খাওয়া-দাওয়া হয়ে যাওয়ার পর কেউ কেউ ঘাসের উপর চাদর পেতে শুয়ে পড়েছে। আমি তেমন কাউকে চিনি না। বারবার ঘড়ি দেখছি আর ভাবছি কখন উঠে চলে যাওয়াটাকে কেউ অভদ্রতা ভাববে না।

হায় ভদ্রতা!

ঢাকা থেকে হাজার মাইল দূরে উড়ে এসে এই অজানি দেশের নাজানি কি নগরীতে বসতি স্থাপন করার পর একটা বিষয় টের পেয়েছি:

“আমি যাই বঙ্গে, আমার কপাল যায় সঙ্গে।”

বাংলাদেশ হোক বা বার্লিন, কোনটা ভদ্রতা, কোনটা অভদ্রতা এই বিষয়টা আমার কাছে খুব পরিষ্কার না। সেইজন্য সবসময় একধরণের সামাজিক সংশয়ে ভুগি।

“আপনি অলীক না?”

হঠাৎ সভার সেই মধ্যমণি, হাতে সিগারেট, গভীর কালো চোখে জটিল দুষ্টামি, গাঢ় লাল ঠোঁটের ফাঁকে গজদাঁত দেখিয়ে হাসতে থাকা মানুষটি আমার দিকে ঘুরে চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেন।

আমার প্রথমে বলতে ইচ্ছা করে:

“না, আপনি ভুল করছেন। আমি মোটেই অবাস্তব বা কাল্পনিক কেউ নই। রক্তহাড়মাঙ্সের অস্তিত্ব। আমাকে অলীক বলবেন না প্লিজ!”

গজদাঁত বের করে মানুষটি ক্রমাগত ধূমপান করে চলেছেন।

আমার আপাত নীরবতায় খুব একটা বিচলিত না হয়ে গভীর কালো চোখে আমার সংশয়ী মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। লক্ষ্য করছি তিনি তাঁর ডান চোখ দিয়ে আমার বাম চোখের মণির দিকে স্থিরদৃষ্টিতে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছেন।

চোখ সরিয়ে নিতে চাইলেও আমি চোখ সরিয়ে নিতে পারছি না।

“মানে, আপনি বলতে চাইছেন আপনি কোন কাল্পনিক চরিত্র নন?” (তাঁর আর আমার মাতৃভাষা আলাদা, আমাদের ইংরেজী কথোপকথনের ভাবানুবাদ করছি।)

এবার আমি সম্পূর্ণ ভড়কে গিয়ে হড়হড় করে কথা বলতে শুরু করলাম।:

“আপনি কে? আমাদের কি আগে কখনও দেখা হয়েছে কোথাও? আপনি আমার নাম জানলেন কি করে? আমি চুপ করে থাকা সত্ত্বেও আমার মনের কথা শুনলেন কী করে?”

“হা হা হা। আপনি জানেন না? আমার তো সুপার পাওয়ার আছে।”

বলেই তিনি খিলখিল করে হাসতে শুরু করলেন। তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সারা দুনিয়া চক্কর দিয়ে আমার মাথা ঘুরতে শুরু করল। আমি কিছু বুঝতে না পেরে ঘাসের উপর পেতে রাখা চাদরের উপর প্রথমে বসে তারপর শুয়ে পড়লাম। দু’চোখ বন্ধ করে।

This is too much!

এদিকে সূর্যের তাপ কমতে শুরু করেছে। অচেনা নামের পাখিরা চেঁচামেচি করছে। পাশে একদল সাদাকালোবাদামী মানুষের দল গাঁজা খেয়ে হৈচৈ আনন্দ করছে। আমাদের ঈদ উদযাপনকারী দলের কেউ কেউ আগুনের জন্য সরকার নির্ধারিত জায়গায় আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছে।

আমি চোখ বন্ধ করেও টের পাচ্ছি তিনি আমার পাশে বসে আছেন। তাঁর হাতের সিগারেটের গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকা পাঁচুলি আর লবঙ্গ তেলের সুগন্ধিভরা একটা মিষ্টিকড়া বাতাস আমার নাকমুখ দিয়ে ফুসফুসের গভীরে প্রবেশ করছে।

চোখ না খুলেই আমি বুঝতে পারছি তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন।

আমি তাঁর ফুসফুসের ওঠানামা শুনতে পাচ্ছি। তাঁর হৃদপিন্ডের নিয়মিত ছন্দ আমার হৃদপিন্ডের ছন্দ এলোমেলো করে দিচ্ছে।

কয়েক মিনিট এই অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে শুয়ে থাকার পর আমি টের পেলাম তিনি আমার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বলছেন:

“আপনি আমাকে চিনতে পারেননি। কিন্তু আমি আপনাকে ঠিক চিনেছি। আমার নাম সন্ধ্যাকু…।”

২.

তাঁর সঙ্গে যখন আমার প্রথম আলাপ হয় তখন তাঁর নাম সন্ধ্যাকুমার বা সন্ধ্যাকুমারী ছিলো না।

বার্লিনের একটা বিখ্যাত ক্লাবে তাঁকে প্রথম দেখি। আলো আঁধারির মধ্যে কারো মুখ ঠিক স্পষ্ট দেখা যায় না। যারা আসে তাঁদের কারো মুখে মুখোশ, কারো মুখে রঙ মাখা, ঝিকিমিকি তারার মেকআপ।

সকলেই নাচের তালে কিঞ্চিৎ দিশাহারা। সেই রাতে আমি খুব মন খারাপ করে ক্লাবে ঢুকি। সুরাপান শরীরে একেবারে সহ্য হয়না বলে আমি মাতাল ও নৃত্যরত পাবলিক থেকে একটু দূরেই থাকি। বসে বসে বেরীফলের রসে বরফ দেওয়া পানীয়তে চুমুক দিতে দিতে ভাবছি:

“আমি এখানে কী করছি? এই ক্লাবে, এই শহরে, এই দেশে?”

এমনিতেই সকাল থেকে মাথা ধরে আছে। গতকাল খবরে শুনলাম দেশে নির্বাচনের আগে আবার খুব গন্ডগোল। হরতাল, অবরোধ, পুলিশী নির্যাতন। আম্মার প্রেশার খুব হাই। ওদিকে হার্ট অ্যাটাকের পর থেকে আব্বার মেজাজ আরো গরম। টেলিফোনে বুড়াবুড়ির ঝগড়া শোনার পর থেকে মন অস্থির। দেশে থাকা কঠিন, দেশের বাইরে থাকাও কঠিন।

আমি যাবো কোন গ্রহে?

“আপনার কাছে কি লাইটার আছে?” পেছন‌ থেকে আমার কানের পাশে কেউ একজন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।

সাথে সাথে মেজাজ খিচড়ে গেলো। চারপাশে এত লোক থাকতে আমাকে এই প্রশ্ন কেন?

ধূমপান আমি একদম সহ্য করতে পারেনি। এই নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে প্রায় ঝগড়া লাগে।

তাঁদের বক্তব্য: “তুই একটা anti-smoking fanatic!”

আমার কাছে কেউ সিগারেট বা লাইটার চাইলে আমি প্রচন্ড খেপে যাই। খেপে গিয়ে ছোটখাটো বক্তৃতা দিয়ে ফেলি।

এবারেও ঘুরে দাঁড়িয়ে সবসময় তৈরি থাকা ধূমপান বিরোধী বক্তব্য পেশ করার জন্য আমি প্রস্তুত। কিন্তু ততক্ষণে আমার পাশ থেকে ফস করে আরেকজন পকেট থেকে লাইটার বের করে প্রশ্নকারীর সিগারেট ধরাতে গেছে।

আমি লাইটার আর সিগারেটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রশ্নকারীকে বললাম: “দেয়ালে কী লেখা আছে দেখতে পাচ্ছেন?”

ঝলমলে তারার মেকআপে সাজানো মুখের মানুষটি ঠোঁটের ফাঁকে গজদাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল:

“না দেখতে পাচ্ছি না। কী লেখা আছে?”

“Smoking is prohibited! চোখ মেলে দেখুন একবার।”

বলে অত্যন্ত অহঙ্কারী আঙুল দিয়ে দেয়ালের no smoking চিহ্নটা 🚭 দেখিয়ে দিলাম।

তিনি তাঁর ডান চোখ আমার বাম চোখের মণিতে নিবদ্ধ করে জানতে চাইলেন:

“আপনার নাম কী? আপনি কোন গ্রহে থেকে এসেছেন?”

আমি একটু বিব্রত হয়ে নিজের নাম বললাম। ভদ্রতাবশত তাঁর নামও জানতে চাইলাম । তিনি কি একটা আরবী না ফারসী না দারী ভাষার নাম বললেন, আমি প্রথমবার শুনে ঠিক বুঝতে না পেরে দ্বিতীয়বার আর জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না।

তিনি আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন:

“আপনার anti-smoking প্যাশন দেখে আমি খুব ইমপ্রেসড। শুধু আপনার খাতিরে আজকে আর সিগারেট খাবো না। কিন্তু আপনাকেও তার শাস্তি পেতে হবে। আপনি সারারাত নাচবেন আমার সাথে‌!”

আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার প্রিয় গান বেজে উঠলো। আমার বন্ধুরা তাঁকে ও আমাকে সঙ্গে করে গোল হয়ে পায়ে পায়ে ছন্দ মেলাতে শুরু করলো।

তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সারা দুনিয়া চক্কর দিয়ে আমার মাথা ঘুরতে শুরু করল।

হাতে সিগারেট, গভীর কালো চোখে জটিল দুষ্টামি, গাঢ় লাল ঠোঁটের ফাঁকে গজদাঁত বের করে নক্ষত্রমন্ডলীর আলো ভরা সেই মুখের মানুষটির সঙ্গে সেই রাতের পর আমার আর কখনো কথা হয়নি, দেখাও হয়নি।

৩.

তাঁর নাম সন্ধ্যাকুমার বা সন্ধ্যাকুমারী।

তাঁকে খুঁজলে পাওয়া যায় না।

তিনি নিজে যদি নিজের খেয়ালে আসেন, যদি তাঁর ডান চোখ দিয়ে আপনার বাম চোখের মণির দিকে তাকিয়ে তিনি আপনার নাম জানতে ইচ্ছা করেন বা আপনার মনের কথা না বললেও শুনে ফেলেন, তবে আপনার সমূহ বিপদ।

সারা দুনিয়া চক্কর দিয়ে আপনার মাথা ঘুরতে শুরু করবে।

সুতরাং সন্ধ্যাবেলায় খুব সাবধানে থাকবেন।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত