অবাকপুরের চিঠি

Reading Time: 2 minutes

সুচতিরাসু কঙ্কাবতী,

পত্র যখন লিখিতে বসিয়াছি তখন তুমি নিদ্রাদেবীর কোলে ঝুমিতেছো। আর এদিকটায় বিপন্ন বৈরী হাওয়ার জলভরা রাত্তিরে আমি ভিজে চুপ-চুপে চুলমাথা লইয়া তোমাকে লিখিতে বসিয়াছি। ‘নিদ্রা’ তোমার বরাবরই প্রিয়। মধ্য-রাত্তিরে মেঘ বরিষণে অতি অল্পবিস্তর মনুষ্য জাগিয়া থাকে। তাহার উপর আজি দিবসের দ্বিপ্রহরে তুমি নিজগৃহ হইতে এতখানি পথ ভ্রমণ করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। নিয়মতান্ত্রিক জীবনে দীর্ঘরাত্রি জাগরণের অভ্যেস তো তোমার নাই তথাপি এই মধ্য-রাত্তিরে নিদ্রা যাইবার সম্ভাবনাই প্রবল।

আমি নিজেও সচরাচর মধ্য-রাত্তিরে গৃহে আসি না। আজ “অনুরোধ অলংকরণ” কার্ডের কর্ম করিতে করিতে কখন যে রাত্রি দ্বিপ্রহর হইয়া গিয়াছে তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। স্টুডিও হইতে বাহির হইবার তোড়জোড় করিবার আগ-মুহূর্তে হঠাৎ বৃষ্টিবর্ষণ শুরু হইয়া গেলো। ভাবিয়া দেখলুম জ্যেষ্ঠের বৃষ্টি ক্ষণকালের জন্যই, এই বুঝি থামিয়া যায়!
কিন্তু প্রায় একশত কুড়ি মিনিট অতিক্রম করিবার পরও যখন থামিবার কোন রেশমাত্র চোখে পড়িলো না। তখন নিতান্তই “অবাকপুরের যাত্রী” হইয়া বসিয়া রহিলাম। বসিবার এই অকস্মাৎ আয়োজনে হঠাৎ মনে পড়িল তোমার কথা। ভাবিলাম দিবসে তো সময় মেলে না এক্ষণে কিঞ্চিৎ কথা বলিয়া লই। পকেট হইতে সেলফোনখানা বাহির করিয়া তোমার সেল নম্বরের উদ্দেশ্যে সঞ্চিত নম্বরে ডায়াল করিলাম। তুমি ঘুমাঙ্ক নিরুত্তাপ কন্ঠে আমার আহবানে সাড়া দিলে। তাহার পর কি হইয়াছে তাহা তো তুমি জানোই। তবে যা জানো না আজ তাহা লিখিব বলিয়াই পত্র লিখিতে বসিয়াছি।

সেইক্ষণে বৃষ্টির তান্ডবে আমি তো বসিয়াই ছিলাম। রাত যখন বারোটার কাটা অতিক্রম করিয়া প্রায় এক ঘটিকা’র মতো বাজিয়া যাইতেছে তখনও বর্ষণ চলিতেছে। অগ্যতা বৃষ্টির সহিত বোঝাপড়া করা বাদ রাখিয়াই পথে নামিলাম।
প্রায় সাত বৎসর পর এই রুপে বৃষ্টিতে ভিজিতে ভিজিতে চলিলাম। স্টুডিও হইতে নিজ গৃহে ফিরিবার পথ সে-তো অনেকখানি। সমস্থ পথ একেবারে বৃক্ষের ন্যায় ভিজিয়া গৃহে প্রবেশ করিলাম। জননী উদিগ্ন হইয়া বারান্দায় দাঁড়াইয়া আমার গৃহপ্রবেশ লক্ষ্য করিলেন।

তাহার পর আরও কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজিলাম। পুরোনো মন্দিরের ধারে খোলামাঠে একাকী নির্জনায় ছুটাছুটি করিলাম। সেই কৈশরের দিনগুলোর মতো নিজেকে খুব হালকা ঘুড়ির মতোন মনে হইলো। সেই বৃষ্টির তান্ডব প্রান্তরে দাঁড়াইয়া দু’চক্ষু বন্ধ করিতেই পুনরায় তোমার কথা মনে পড়িয়া গেলো…
তোমাদের ‘অট্টালিকা’ সে বড়ো ভারি মনোহর! সেখানেই লতিকার ন্যায় তোমার বাড়ন্ত দিবসের শুরু। সে ক্ষেত্রটা ভাবিলে আমার এই কুঁড়েতে তোমায় ঠিক মানায় না। এই দূর্বাপাথর মাঠ, এই রুক্ষতা তোমার কোমলতার কাছে বড়ই বেমানান। পকেটে কড়ি না থাকিলে আর যাই হোক জীবনটা পরম ভাবে উপভোগ করা হইয়া উঠে না।

যে ‘দৈন্যের প্রজাপ্রতি’ কোনদিন তোমাকে স্পর্শ করিতে পারে নাই, সে দৈন্যের সাগরে তুমি সাঁতার কাটিতে পারিবে না। “আবেগ এক আশ্চর্য ফুল, সে কখনো আপনার জন্য উদয় হয় না কিন্তু অপরকে ঠিক লোভাতুর করিয়া তোলে”। আবেগের অরণ্যে সুখের পাতাভরা বৃক্ষ থাকিলেও সেখানে মধুময় হাওয়া নাই।
সেই সব সিনেমার মতো মুখে তুমি যতই বলিয়া বেড়াও বৃক্ষের নিচে সংসার সাজাইয়া জীবন দিনাতিপাত করিয়া লইবে, বাস্তবের যাঁতাকলে তাহা কোনভাবেই সম্ভব নহে। তোমার ওই কোমল হাতে পাথর চালাইবার খঞ্জর তুলিয়া দিলেই কি তুমি তাহা চালাইতে পারিবে? জানি এ তোমার অসাধ্য!
এভাবেই ভাবনাগুলো বিশাল দিগন্ত পাড় করিয়া যাইতেছিলো। বেশ কিছুকাল পর বৃষ্টির ধার থিতু হইয়া উঠিলো বলিয়া আমিও ভাবনা হইতে প্রত্যাবর্তন করিলাম। নিজ কক্ষে যখন ফিরিলাম, তখন তুমি নিদ্রাদেবী’র কোলে দুলিতেছো অনেক কিছু বলিবার ইচ্ছে থাকিলেও সেলফোনের সুরেলা সুরে তোমাকে আর ডাকিলাম না।
কঙ্কাবতী ’ঘুমনগর’ বা জাগ্রত প্রহরে ভালো থাকিও। এরপর আর কখন যে তোমাকে পত্র লিখিব সে কথা এই মুহুর্তে ভাবিতে পারিতেছি না।

 

বিনীত

সকাল

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>