‘সারা জীবন মানুষ যা হওয়ার স্বপ্ন দেখে, বার্ধক্য তা-ই’
২০১৫ সালের ১ আগষ্ট প্রথম আলো দৈনিকের অন্য আলোয় সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিলো। আজ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্মতিথিতে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য তা পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
আনিসুল হক: স্যার, গতকালই ৭৬ বছর পার করে ৭৭-এ পা দিয়েছেন আপনি। দীর্ঘজীবন পাওয়াও একটা সার্থকতা। এই চিন্তার প্রেক্ষাপটে আপনি কি কিছু বলবেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: এই মুহূর্তে সিসেরোর একটা লেখা মনে পড়ছে। সিসেরো বলেছেন, বেঁচে থাকাটাও একটা সার্থকতা। তিনি বলেছেন, বৃদ্ধ হওয়াটাও একটা যোগ্যতা। আমি মনে করি, এই কথার মধ্যে সত্যতা আছে। বৃদ্ধ হতে গিয়ে মানুষ যে বহু রকমের তথ্য, জ্ঞান ও বিজ্ঞতা অর্জন করে, সেটা অল্প বয়সে কিছুতেই সম্ভব নয়। এটা হলো একটা কথা। আরেকটা কথা হলো, সারা জীবন মানুষ যা হওয়ার স্বপ্ন দেখে, বার্ধক্য তো তা-ই। একবার এক ছাত্র আমাকে বলেছিল, ‘স্যার, আপনি তো প্রবীণ।’ আমি তাকে বলেছিলাম, দেখো, তুমিও বেঁচে আছ, আমিও বেঁচে আছি। সেদিনই নির্ধারিত হবে কে প্রবীণ, যেদিন আমাদের মধ্য থেকে একজন মারা যাবে। সেটা যে আমিই হব, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং, তুমি যা হতে চাইছ বা হওয়ার স্বপ্ন দেখছ, সেটা হতে পারাটাই সার্থকতা। অর্থাৎ বৃদ্ধ হতে পারাটাও একটা সার্থকতা বটে।
আনিস: প্রবীণ হলে অতীতের গল্প করতে খুব ভালো লাগে। আমাদের সময়ে আমরা এটা করতাম ওটা করতাম, যৌবনে আমরা এই করেছি সেই করেছি, অথবা আমার যৌবনকালটাই ছিল একমাত্র যৌবন…ইত্যাদি। এ রকম কি আপনারও মনে হয়?
সায়ীদ: না। এক মুহূর্তের জন্যও আমার এ রকম মনে হয়নি। কারণ, তুমি যে রকম প্রতিটি লেখার আগে একটা পাতার মতো কাঁপতে থাকো, ঠিক তেমনি যদি নিত্যনতুন ঘটনা তোমার জীবনে ঘটতে থাকে এবং প্রতিদিন সকালে উঠে যদি তুমি নতুন পৃথিবীর মুখোমুখি হতে থাকো, তাহলে এই পৃথিবীই তোমার কাছে চিররহস্যময়, চিরবিস্ময়কর এবং নতুন। সুতরাং যে মানুষ নতুন হচ্ছে, নতুন প্রজন্মের মতোই উৎসাহ-আগ্রহ ও বিস্ময় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তার কাছে তো অতীত বলে কিছু নেই। বর্তমানকে মোকাবিলা করতেই তো তার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। সে অতীতের গল্প করবে কখন? অতীতের গল্প সে-ই করবে, যার জীবন থেমে গেছে। পালামৌ লেখার সময় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘আমি যখন পালামৌ গিয়াছিলাম, ফিরিয়া আসিলে পর সকলেই আমাকে পালামৌ সম্পর্কে লিখিতে বলিল। আমি তাহাদের কথা শুনিয়া হাসিলাম। এখন কেহ আমাকে লিখিতে বলে না। কিন্তু আমি লিখিতে বসিয়াছি। কারণ কথা বলা এই বয়সের রোগ। কেহ বলুক না বলুক, বৃদ্ধ গল্প বলে।’ গল্প কেন বলে? তিনি যখন পালামৌ গিয়েছিলেন, তখন তো সেটা লেখেননি। কারণ, তখন তো তিনি জীবনের এক পালামৌ থেকে আরেক পালামৌ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যেদিন আর পালামৌ নেই, সেদিনই পালামৌ অসম্ভব সুন্দর। আমাদের মধ্যে যারা জীবনকে ছেড়ে দিয়েছি, তারাই বৃদ্ধ।
আনিস: আপনি একবার বলেছিলেন, আপনার মধ্যে যৌবন বারবার ফিরে আসে। যখন আপনি কণ্ঠস্বর বের করলেন, তখন একবার যৌবন ফিরে এল, যখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র করলেন, যৌবন ফিরে এল, আবার আপনি যে সময় পরিবেশ আন্দোলন করলেন, সে সময়ও একবার যৌবন ফিরে এল আপনার। তো এখন আপনার যৌবন ফিরে আসার উপলক্ষটা কী?
সায়ীদ: গতকাল এক বক্তৃতায় বলেছিলাম, একসময় যখন আমি যে কাজই করতাম, সেই কাজটা পাগলের মতো করতাম—একেবারে চাঁদে পাওয়া মানুষের মতো। এক কাজ নিয়েই পড়ে থাকতাম। কিন্তু একই সঙ্গে এখন আমি সাত রকমের কাজ করতে পারি। এটা বয়স ও অভিজ্ঞতার ব্যাপার। আর এই সাত রকম কাজের মধ্যে যে বৈচিত্র্যের আনন্দ, সেটা আমার অল্প বয়সের মধ্যে ছিল না। তখন যেটার মধ্যে প্রথিত হয়ে যেতাম, সেটার মধ্যেই আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকতাম। এখন যেটা হয়েছে, সেটা হচ্ছে লেখা আমাকে পেয়ে বসেছে।
আনিস: আপনি যদিও বলেন, তোমরা যেভাবে তরতরিয়ে লিখতে পারো, আমি সেভাবে পারি না। তারপরও আপনি কিন্তু প্রচুরই লেখেন। আপনি এটাও বলেন যে আপনার সবই হওয়া হলো, শুধু লেখকই হওয়া হলো না।
সায়ীদ: লেখক হওয়া হলো না মানে আমার মন যত দিকে যেতে পারত, আমি তো ততদিকে যেতে পারলাম না। আমি উপন্যাস লিখতে পারলাম না, গল্প লিখতে পারলাম না, প্রবন্ধ লিখতে পারলাম না।
আনিস: এখন আপনি কী লিখছেন?
সায়ীদ: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের যে সংগ্রামের গল্প, এটা তো আমার লেখা হয়নি। সেটা লিখছি। আর গল্প লিখছি। একটা জিনিস আমি লক্ষ করি, গল্প লিখতে গিয়ে আমার খুব কষ্ট হয়। কারণ, আমার মন খুব ডিটেইল-প্রবণ। আমার আত্মজীবনী আমি ৩০০ পৃষ্ঠার মধ্যে শেষ করতে পারতাম। কিন্তু দেখলাম, আমি তো নানা ধরনের কাজের মধ্যে থেকেছি—কখনো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, কখনো টেলিভিশন, শিক্ষকতা, কখনো বা সাহিত্য আন্দোলন। একেকটা একেক রকমের। তো আমি দেখলাম, ৩০০ পৃষ্ঠার মধ্যে আমার সবকিছু লেখা সম্ভব নয়। তাই আমার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়কে আলাদাভাবে লিখে আমি এখন এটা ১৮০০ পৃষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি বুঝি, আমার মনটা একটু ডিটেইল-প্রবণ।
আনিস: যেসব সাহিত্যকে আমরা উচ্চতর সাহিত্য বলি, সেসব সাহিত্য ডিটেইল-প্রবণ। ছোট লেখক আর বড় লেখকের ভেতর পার্থক্য হলো, ছোট লেখক চট করে গল্পটা বলে ফেলেন, আর যাঁরা বড় লেখক, তাঁরা ডিটেইলে লেখেন।
সায়ীদ: তার মানে ডিটেইল করতে গিয়ে কতগুলো আবর্জনা দিয়ে দিলাম, সেটা কিন্তু ঠিক নয়। আমার মনে হয়, যার বুদ্ধির মাপ যা, তার লেখার ডিটেইলেও সেটার প্রমাণ থাকে। গত মাসে আবার মেঘনাদবধ কাব্য পড়লাম। আমি বিস্মিত হই যে এই মানের বই এখনো বাংলাদেশে আর একটিও নেই। বইজুড়ে এত ইনফরমেশন, এত তথ্য। চৌদ্দ মাত্রার একেকটা বাক্যের প্রতিটিতেই আছে তিন-চারটে করে ইনফরমেশন। এতটুকু একটি বই কিন্তু পড়ার পর মনে হয় বিশাল একটি বই পড়ে এলাম।
আমি যখন গল্প লিখতে শুরু করি, তখন আমার প্রথম গল্পই হয়ে গেল ৩৫ পৃষ্ঠা! এ সময় অনেকে আমাকে বলল, এটা তো উপন্যাস হয়ে গেছে। আমি বললাম, না, এটা উপন্যাস নয়। এটার যে প্রবণতা, সেটা গল্পের এবং শেষে এক বিজ্ঞ সম্পাদক এটাকে উপন্যাস হিসেবেই ছেপে দিল! তাতে অবশ্য আমি একটু বেশি টাকা পেলাম। পরে ও রকম আরও চার-পাঁচটা গল্প আমি লিখেছি। এর অনেক পরে আমি টের পেলাম, ওগুলো ছোট গল্প নয়, ওগুলো বড় গল্প। তো আমার প্রবণতাটাই এটা। আমি যদি কোনো দৃশ্য সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে আঁকতে চাই, তাহলে অনেক কিছু দরকার। আমাকে দিয়ে হয়তো উপন্যাস লেখা সম্ভব হতো, কিন্তু তা লেখার মতো সময় আর আমার হাতে নেই।
আনিস: আমার মনে হয়, আমাদের কালের গদ্যটা একটু বেশি সরল হয়ে গেছে। আমরা রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু কিংবা প্রমথ চৌধুরীর গদ্য পড়ে যে আনন্দ পাই, এখনকার লেখকদের গদ্য পড়ে সেই আনন্দটা একটু কমই পাই। কিন্তু আপনার লেখা একই সঙ্গে আধুনিক, সাম্প্রতিক এবং তাতে গদ্যের সেই ধ্রুপদি প্রসাদগুণ পাওয়া যায়।
সায়ীদ: এখন আমাদের মধ্যে একটা অস্থিরতা চলছে। সবকিছুর মধ্যে একটা দ্রুততা। সবকিছুকে সহজ করে ফেলার একটা প্রবণতা শুরু হয়েছে। ফলে গদ্যের যে শিল্পরূপ, সেটার দিকে কেউ মনোযোগ দিচ্ছে না। যদিও আমি মনে করি, সেই ক্ষমতা এখনকার লেখকদের আছে।
আনিস: আমাদের কয়েক প্রজন্মের হাতে বই তুলে দিয়েছেন আপনি। দিনে দিনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পার করেছে অনেকটা পথ। আলোকিত মানুষ গড়ার আন্দোলনে কেন্দ্রের রয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। ‘আলোর ইশকুল’ এর অন্যতম। আলোর ইশকুল নিয়ে আপনার স্বপ্নটা আসলে কেমন?
সায়ীদ: মানুষ তার জ্ঞানকে যে আলাদাভাবে ভাগ করে, সেটাই জ্ঞানের আসল চেহারা। তবে জ্ঞান কিন্তু একটাই। বিশাল হয়ে যাওয়াতে প্রকোষ্ঠ করে নিতে হয়েছে। যেমন একটা ট্রেন যখন যায়, তখন একটা ইঞ্জিনই তাকে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু যেহেতু অনেক যাত্রী, তাই আলাদা আলাদা বগির ব্যবস্থা। জ্ঞানও তা–ই। তো একসময় আমার মনে হলো, এমন একটা কিছু যদি করতে পারতাম, যেখানে একটা ছেলে বা মেয়ে সব রকম জ্ঞানের শাখাগুলোর ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়াবে; তাহলে সে বুঝতে পারবে যে সব জ্ঞান আসলে এক। গাছের পাতা নড়লে আমার বুকের ভেতরে যে কেমন কেমন করে বা চাঁদ উঠলে তার কিরণে আমার যে ভালো লাগে—এর কারণ কী? কারণ, গাছ বা চাঁদ যা দিয়ে তৈরি, আমিও তা দিয়ে তৈরি। বিশ্ব চরাচর যা দিয়ে তৈরি, আমিও তা দিয়ে তৈরি। এ জন্য এদের কোনো কিছুতে আমাদের সাড়া জাগে। আর টোটাল নলেজ জানার ফলে মানুষ একজন টোটাল হিউম্যান বিং হিসেবে গড়ে উঠবে—আলোর ইশকুলের মাধ্যমে এমন স্বপ্ন দেখি আমরা। আমরা চাই যে আলোর ইশকুলের সদস্যরা জ্ঞানের নানা শাখা ভ্রমণ করতে করতে যার যেদিকে ঝোঁক সেদিকে যাক। ৬০ থেকে ৭০টি কোর্স আছে এখানে। এতে যেমন সংগীত, কবিতা, চিত্রকলা ও স্থাপত্য আছে, তেমনি রয়েছে দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ে কোর্স। এসব কিছুর মাধ্যমে একজন ছেলে বা মেয়ে গড়ে উঠবে।
আনিস: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভবনের নির্মাণ শেষ হয়েছে। একধরনের সুসংহত কাঠামোর মধ্য দিয়ে চলছে এর কার্যক্রম। আশা করা যায়, এখন কেন্দ্র তার নিজের শক্তিতেই চলতে থাকবে। সুতরাং এখন কী আপনার এ রকম মনে হয় যে এই মিশনটা সাফল্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ হয়েছে, এর দিকে আর সেভাবে তাকানোর প্রয়োজন নেই। ভবন নির্মাণের পর একটা লক্ষ্যে, একটা চূড়ায় তো পৌঁছানো গেল। তাই বিষয়টাকে যদি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়: আপনি এভারেস্টের চূড়ায় উঠে গেছেন, এখন নামতে হবে।—কী বলবেন?
সায়ীদ: সব কাজেই কিছুদিনের জন্য একটা সাময়িক বিশ্রামের দরকার আছে। এখন আমি আমার লেখালেখিতে মনোযোগী হতে চাই। ফলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে এবার আমার লেখালেখির যে একটা ঝগড়াঝাঁটি হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।