Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,abdullah abu sayeed interview

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: তারুণ্যের অভিবাবক । আদনান সৈয়দ

Reading Time: 4 minutes

বিভিন্ন সময়ে সায়ীদ স্যারের সঙ্গ পেয়েছি। নিউইয়র্ক বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে ২০০৫ সালে সায়ীদ স্যার যখন নিউইয়র্ক বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আমন্ত্রনে এলেন তখন তাঁর সাথে দল বেঁধে আমরা রোড আইল্যান্ড ঘুরতে গিয়েছিলাম। সায়ীদ স্যারের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া যে স্বর্গে যাওয়ার চেয়েও বেশি লোভনীয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্যার আবার নিউইয়র্ক এলেন ২০১৪ সালে নিউইয়র্ক আন্তুর্জাতিক বইমেলার আমন্ত্রনে। সত্যি বলতে সায়ীদ স্যারকে দেখলেই মনে হত আমার সামনে এক আলোকিত বাংলাদেশ স্বয়ং দাড়িয়ে। একজন গুণী, কর্মঠ, সৃজনশীল, সমাজবাদী এবং নীতিবান মানুষের পক্ষে যা করা সম্ভব সায়ীদ স্যার যেন তার সব কিছুরই এক উজ্জ্বল সমাহার। সায়ীদ স্যার মানেই আলোকিত মানুষ গড়ার এক স্বপ্নদ্রষ্টার। চোখ বুজলেই দেখতে পাই বাংলাদেশের এক ঝাঁক বই পাগলের দল সারাক্ষণ সায়ীদ স্যারের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে নিজেদের জ্ঞ্যান পিপাসাটা মিটিয়ে নিচ্ছেন। এই আলোকিত মানুষটি তাঁর উদার হাত দিয়ে জ্ঞানের প্রতিটা মশাল তুলে দিচ্ছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মদের হাতে।

আর শুধুই কি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র? কোথায় নেই সায়ীদ স্যার? বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের তিনি পুরোধা (বর্তমানে বাফার প্রেসিডেন্ট), একজন শিক্ষাবীদ হিসেবে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসে রীতিমত বিস্ময়! তিনি যেন আমাদের সেই প্রমিথিউস যিনি সূর্যের আলো চুরি করে এনে পৃথিবীর মানুষকে আলোকিত করেছিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এমন একটি মানুষের সঙ্গ পাওয়া বা যদি বলি তার ছায়ায় ছায়ায় কিছুটা সময় পথ হাটার সৌভাগ্য ছাড়া আর কি? সায়ীদ স্যারের সঙ্গে নানা সময়ে কথামালায় টুকে রাখা ভাবনাগুলো আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করা হল।

স্যার, বাংলা বই এর ভবিষ্যত কি? সবাইতো এখন ভিডিও গেম, ফেসবুক, আইপ্যাড, কিন্ডেল ইত্যাদি নিয়ে ব্যাস্ত। বই এর পাঠক কি তাহলে ধীরে ধীরে কমে যাবে?

দেখ, এটাত সত্যি কথা যে মানুষ এখন খুব বেশি পরিমান আত্বকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। তারা শুধু টাকা চায় আর প্রতিপত্তি চায়। বই পড়ার সুযোগ কোথায়? তবে যারা বই পড়েন তারা সবসময়ই বই পড়বেন। আমি মনে করি, যে মানুষটা তার মূল্যবান সময় বইয়ে দিত এখন সেই লোকটা কিন্তু তার সেই সময়ের অনেকটাই তার ব্যাবসা বানিজ্য, টাকাপয়সার দিকে দিচ্ছে।

তাহলে কি বলা যায় এই ডিজিটাল যুগে মূদ্রিত বই এর ভবিষ্যত অন্ধকার?

মোটেই না। একটা বিষয় লক্ষ্য কর। পেছনের দিকে যদি তাকাও তাহলে দেখবে মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে বই এর বিবর্তন হয়েছে। এক সময় বই লেখা হয়েছে পাথরে খোদাই করে তারপর গাছের পাতায় বই লেখা হয়েছে এবং সবশেষে এসেছে মূদ্রিত পুস্তক। এখন দেখছি চারপাশে ডিজিটাল বই। আমি বলবো তারপরও সেতো বই ই। বই এর কোন বিনাশ নাই। যুগের প্রয়োজনে এর চেহারাটা পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। একটা কথা বলি শোন, একেকটি বই হল একজন লেখকের আত্মার ফসল। বই মানেই শুধু কয়েকটি ছাপার অক্ষরের শব্দ নয়। কয়েকটি পাতা নয়। বই হল লেখকের আত্মায় যে আগুনের শিখা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে তারই প্রতিফলন হচ্ছে বই এর প্রতিটা গোট গোটা অক্ষর। রবীন্দ্রনাথের কথাই ধরা যাক। আমরা যখন রবীন্দ্রনাথের কোন বই পড়ি তখন তা কি শুধুই রবিন্দ্রনাথের গল্প, কবিতা বা উপন্যাস পড়ি? তা নয়। আমরা সেই বইটায় খুজে পাই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেই। তিনি সেখানে বিদ্যমান। তাঁর জ্ঞানের আলো জ্বলছে প্রতিটা শব্দে।

স্যার, আমরা জানি আপনি যখন ঢাকা কলেজে ক্লাস নিতেন তখন প্রথাগত নিয়ম অনুযায়ী কোন রোল কল করতেন না। অথচ দেখা যেত আপনার ক্লাসের ছাত্র সংখ্যাই বেশি এবং তারা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত আপনার কথা শুনছেন। বর্তমান সময়ের শিক্ষা ব্যাবস্থা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

বর্তমান আমাদের দেশে পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে ছেলেপুলেদের যেভাবে বই পড়ানো হয় তা রীতিমত ভয়াবহ। আমি এটাকে কোন শিক্ষা ব্যাবস্থাই বলি না। যে শিক্ষা ব্যাবস্থা একজন ছাত্রকে ছেলেবেলা থেকেই বই ভীতি তৈরি করে দিচ্ছে সে শিক্ষা ব্যাবস্থা দিয়ে আমাদের কি হবে? দেখ, আমাদের কোমলমতি শিশুরা ছেলেবেলা থেকেই এই বই ভীতিতে ভুগছে। তারা বই দেখলেই এখন ভয় পায়। কারণ ত্রুটিগত শিক্ষাপদ্ধতীর মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক দিয়ে সে ভয়টা শিশুটার মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা রীতিমত ভয়াবহ!

স্যার, সাহিত্যর ভাষা নিয়ে একটা তর্ক এখন খুব চালু আছে। আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণ তথা মুখের ভাষায় সাহিত্য রচনা কি সম্ভব? তাছাড়া ইদানিং বাংলা ভাষার পিন্ডি চটকানোর জন্য একদল লেখক সাহিত্যে প্রমিত ভাষা ব্যবহারের পরিবর্তে আঞ্চলিক শব্দ জুড়ে দেওয়ার একটা রীতি শুরু করে দিয়েছেন তারই বা যৌক্তিকতা কতটুকু? এ বিষয়ে আপনার মতটা জানতে চাই।

আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহারে সাহিত্যের শৈল্পিক গুণাবলী হারানোর কোনো রকম সম্ভাবনাই নেই। বরং উল্টো বিভিন্নরকম এবং বহুমুখী আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহারে নিঃসন্দেহে সাহিত্যের একটা শক্তিশালী শাখা বের হবে। তবে কখনো কখনো প্রমিত ভাষার ব্যবহার সাহিত্যে খুবই জরুরি হয়ে উঠতে পারে, সেদিকটা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। আঞ্চলিক শব্দ নিয়ে যারা ভীত তাদের ভয়ের কিছুই নাই। ভবিষ্যতেই একমাত্র এর উত্তর পাওয়া যাবে।

স্যার, ঠিক এমন আরেকটি বিষয় নিয়ে একটা জিজ্ঞাসা ছিল। আমাদের বাংলা ভাষার সাথে প্রচুর বিদেশী শব্দ অর্থাৎ আরবি শব্দ জুড়ে দিতেও এক গোপন ষড়যন্ত্রের নীল নকশা আঁকতে একদল সকাল বিকাল কাজ করে যাচ্ছে। যে ভাষার জন্য এত ত্যাগ সেই বাংলা ভাষার উপর এ ধরনের ষড়যন্ত্র আপনারা কী চোখে দেখছেন?

বাংলার সাথে আরবী অথবা অন্যান্য অনেক বিদেশি ভাষার মিশ্রণ নতুন কোনো ঘটনা নয়। ভাষার পরিবর্তন হয় এবং হতেই পারে। ইংরেজি ভাষার সাথেও পৃথিবীর বহু ভাষার অপূর্ব মিশ্রণ ঘটেছে। বাংলার সাথে যদি কোনো বিদেশী ভাষার মিশ্রণ ঘটে তাহলে সেটাতে খারাপ কিছু আমি দেখি না। তবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ভাষার পরিবর্তন হয়, কিন্তু ভাষা হারিয়ে যায় না।

বাংলা ভাষা কি ভবিষ্যতে তাহলে বাংলাতে টিকে থাকবে বলে আপনারা মনে করেন?

অবশ্যই। আমি তো বাংলাদেশে দেখি না যে আমাদের ছেলেমেয়েরা হিন্দিতে কথা বলছে। তবে বাংলার উপর হিন্দি অথবা ইংরেজির একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব যে পড়ছে না তা নয়, তবে সেজন্য বাংলা ভাষা বিলীন হয়ে যাবে সেটা আমি বিশ্বাস করি না। ভাষার প্রায়োগিক একটা পরিবর্তন হতে পারে তাই বলে একটা ভাষা কখনো শেষ হয়ে যেতে পারে না।

স্যার, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নিয়ে কিছু বলেন… বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মাত্র ১৫ জন ছেলেমেয়ে নিয়ে সেই ১৯৭৮ সালে শুরু করেছিলাম। সেই সংখ্যা গত বছর ১৫ লক্ষে ছাড়িয়ে গেছে। আর এ বছর(২০১৫) তা ২০ লক্ষে পৌছেছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এটা এক বিরাট সাফল্য।

বই নিয়ে আপনার শেষ কথা কি?

বই এর কোন বিকল্প নেই। মানুষ হতে হলে বই পড়তে হবে। তবে এটাও বলবো সবাইকে যে বই পড়তে হবে তাও নয়। সব কিছুতেই একটা ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন। সবাই যদি শুধুই বই-ই পড়ে তাহলে তো পৃথিবী এক দিকে। কি ঠিক না?

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>