কালো, শরণার্থী মানুষের লেখক আব্দুর রাজ্জাক গুরনাহ ও তাঁর দশটি উপন্যাস : অদিতি ফাল্গুনী
এবছর সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী আব্দুর রাজ্জাক গুরনাহই গোটা পূর্ব আফ্রিকা থেকে প্রথম নোবেল প্রাপ্ত সাহিত্যিক। তবে, নোবেল প্রাপ্তির আগে তার নাম যে সারা পৃথিবীর প্রতি ঘরে ঘরে আলোচিত হতো এমনটা নয়। মিলান কুন্ডেরা বা হারুকি মুরাকামির মত বিশ্বায়িত পৃথিবীর সব শিক্ষিত, নাগরিক ঘরের পরিচিত নাম তিনি এই সেদিনও ছিলেন না। আরো মজার বিষয় হলো যে বড় বড় প্রকাশকের বদলে তাঁর শুরুর দিকের উপন্যাসগুলো উল্টো প্রকাশিত হয়েছে ছোট ছোট, স্বাধীণ প্রকাশনা সংস্থা থেকে।
গুরনাহ, যাঁর জন্ম আফ্রিকার জাঞ্জিবারে ১৯৪৮ সালে, তিনি শরণার্থী হিসেবে প্রথম ইংল্যান্ডে আসেন ১৯৬০ সালে। এবং তখন থেকেই মূলত: অভিবাসীর জীবন যাপন করছেন তিনি। এই উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগের শেকড়চূত জীবনের তিনি অন্যতম সূক্ষ্ম এবং সংবেদী, অনুভবক্ষম লেখক। কয়েক দশক জুড়েই তাঁর উপন্যাসসমূহ উপনিবেশবাদ, বিপ্লব, নির্বাসন এবং অভিবাসন বিষয়ে নেশা জাগানো ও জটিল বুননকর্মের মতই মনোহর। গুরনাহর এই আখ্যানমালা উনিশ শতকের শুরুর তাঞ্জানিকা থেকে ১৯৭০ সালের জাঞ্জিবার এবং সাম্প্রতিক কালের ইংল্যান্ড অবধি সময় ও স্থানাবলীর গল্প বলে।
নিচে গুরনাহর দশটি উপন্যাসের একটি তালিকা দেয়া হলো:
সমুদ্রের পাশে (বাই দ্য সী) : বৃটেনে বসবাসরত আফ্রিকীয় উদ্বাস্তÍদের জীবনের আর্তি ও একাকীত্ব এতটা প্রবলভাবে খুব কম উপন্যাসেই ফুটে উঠেছে। এই উপন্যাসটি ২০০১ সালে বুকার প্রাইজের জন্য লং লিস্টে এবং পরে লস এ্যাঞ্জেলস টাইমস বুক প্রাইজের জন্য শর্ট লিস্টে স্থাণ পায়। সালেহ ওমর এবং লতিফ মাহমেদ কারা এবং জাঞ্জিবারে তাদের একই ধরণের জীবনের ইতিহাস নিয়ে কি বলা হয়েছে এই উপন্যাসে? যা তাদের প্রায় একই রকমের নিয়তির বাঁধনে গ্রথিত করে? বৃটেনে বসবাসরত অভিবাসীরা- শীতল এবং নি:সঙ্গ সমুদ্রের পাশে সময় কাটাতে কাটাতে তাদের আফ্রিকার দ্বীপ দেশ জীবনের কথা কি স্মরণ করে?
নুড়ি পাথরের হৃদয় (গ্র্যাভেল হার্ট): এই উপন্যাসটিও অন্তরঙ্গ ও সূক্ষ নানা ডিটেইলসের কাজের মাধ্যমে সময় ও স্থাণিক পরিসরের অসম্ভব সব দূরত্ব অতিক্রম করে। এই উপন্যাসটি সেলিম নামে এক তরুণ স্বাপ্নিকের আখ্যান যে ১৯৭০-এর বিক্ষোভ উত্তাল জাঞ্জিবার ছেড়ে বৃটেনে তার ক‚টনীতিক পিতৃব্যের বাসার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়। কিন্তÍ ঠিক তখনি এক পারিবারিক রহস্য বুদ্বুদের মত ভেসে ওঠে এবং সেলিম বুঝতে পারে যে পৃথিবীটা তার কল্পনার চেয়েও অনেক জটিল।
নৈ:শব্দ্যের প্রশংসায় (এ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স, ১৯৯৬): গুরনাহর আখ্যানমালা প্রায় সময়ই নৈ:শব্দ্য এবং জটিল, অর্দ্ধেক না-বলা গল্পের চরিত্রগুলোর পাশে ঘুরে বেড়ায় যে চরিত্ররা তাদের যার যার নিজস্ব পৃথিবী নিজের মত করে বয়ে বেড়ায়। এই উপন্যাসে জাঞ্জিবারের এক পুরুষ দীর্ঘ দিন ধরে ইংল্যান্ডেই থিতু এবং এক ইংরেজ নারীকেই বিয়েও করেছেন। তিনি পরে জাঞ্জিবার ফেরেন এবং তাঁরই অতীত জীবনের নানা আখ্যানের মুখোমুখি হন।
শেষ উপহার (দ্য লাস্ট গিফট, ২০১৪): এই উপন্যাসে ইংল্যান্ডের নরউইচে বড় হয়ে ওঠা দুই ভাই-বোন জামাল এবং হান্না যাদের বাবা জাঞ্জিবারের কালো আফ্রিকান ও মা বৃটিশ, তাদের জীবনেই মূলত: আলোক সম্পাত করা হয়েছে। এই দুই ভাই-বোন জাঞ্জিবারে তাদের বাবার অতীত সম্পর্কে খুব কম জানে। সারা পৃথিবী জুড়ে নাবিক বাবার ভ্রমণ সম্পর্কেও তারা তেমন কিছু জানে না। শুধুমাত্র পিতার মৃত্যু ঘনিয়ে আসার দিনগুলোয় তারা কিছু রহস্যের টুকরো জোড়া দিতে পারে যা তাদের বাবার জীবনকে একটি নির্দিষ্ট আকার দিয়েছিল এবং ওদের দুই ভাই-বোনের জীবনেও রং লাগাচ্ছে।
স্বর্গ (প্যারাডাইস, ১৯৯৪) : ১৯৯৪ সালে বুকার পুরষ্কারের জন্য শর্ট-লিস্টেড এই বইটি মহাকাব্যিক পরিবর্তনের মুখোমুখি পূর্ব আফ্রিকার মানুষের জীবনের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি- কিভাবে জার্মান ঔপনিবেশিকদের দখলদারী শক্তি তাঞ্জানিকার আফ্রিকীয় গ্রামবাসীর জীবনে গেঁড়ে বসে- সেটাই ইউসুফ নামে এক বারো বছরের বালকের চোখে দেখা হয়েছে। নিপুণ কুশলতায় গুনরাহ ইউসুফের জীবনের গল্পকেই এই কালো মহাদেশ বদলে দেয়া ইতিহাসের বৃহত্তর শক্তিগুলোর সাথে বুনে তোলেন। আর এই বুনন কার্য তিনি সম্পন্ন করেন একটি লীলাময় তবে প্রলুব্ধকারী ভাষায় যার রয়েছে গল্প বলার অসামান্য ক্ষমতা। এই উপন্যাসেই যেন লেখক দেখিয়েছিলেন তার চকমকি পাথরের সেই আগুন যে আগুনকে সুইডিশ একাডেমি প্রায় পঁচিশ বছর বা এক শতকের চার ভাগের এক ভাগ সময় পার হবার পর স্বীকার করবে।
বিচ্ছেদ স্মৃতি (‘মেমোরি অফ ডিপারচার‘) : গুরনাহর প্রথম উপন্যাস ‘বিচ্ছেদ স্মৃতি‘ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। এটা হাসান নামে এক আরব যুবকের গল্প যে কিনা পূর্ব আফ্রিকার উপক‚লীয় এলাকার বন্দীত্ব থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। যখন সে দেশের বাইরে এক অভিজাত আত্মীয়ের বাসায় থাকা শুরু করে, তখন এক চকমকে, নতুন পৃথিবীর সাথে তার পরিচয় হয়।
তীর্থযাত্রার পথ (পিলগ্রিমস ওয়ে): বাস্তব জীবনে ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত দাউদ আশ্রয় নেয় চিঠি লেখায় যা তাকে তার অতীত ও বর্তমান মেনে নিতে শেখায়।
দোত্তি: গুরনাহর আর সব কাজের মত এই উপন্যাসও এক তরুণীর কাহিনী যে রঙীন চশমা পরে অথচ জানে না যে তার আফ্রিকীয় পরিবারকে বৃটেনে প্রতিষ্ঠা পেতে কত সংগ্রামই না করতে হয়েছে!
পলায়ন (ডিজার্শন): হাসান আলী নামে এক আফ্রিকীয়র সাথে পরিচয় হয় মার্টিন পিয়ার্স নামে এক ওরিয়েন্টালিস্ট বা প্রাচ্যবাদীর যে কিনা হাসানকে তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ জানায়। হাসান আলীর বোনের সাথে পরিচয় হয় মার্টিনের। দু‘জনের ভেতরকার শুরুর ভাল লাগা একটা সময়ে গভীর ও পূর্ণাঙ্গ প্রণয়ে পরিণত হয় যা কিনা হাসান আলীদের সমাজে নিষিদ্ধ। ২০০৬ সালে ‘কমনওয়েলথ লেখক পুরষ্কারে‘র জন্য এই উপন্যাসটি সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হয়েছিল। এই উপন্যাস সংঘাত ও দ্বন্দের ভেতর ভালবাসার কথা বলে।
১০.পরকাল (আফটার লাইভস): একটি বিভক্ত, উপনিবেশিত আফ্রিকায় ‘পরকাল‘ হলো ইলিয়াস নামে এক বালকের আখ্যান যাকে জার্মান ঔপনিবেশিক বাহিনী চুরি করেছে। বেশ কয়েক বছর পর বাড়ি ফিরতে পারলেও ততদিনে তার বোন কোথাও হারিয়ে গেছে (হয় জার্মানরা নিয়েছে বা এমন কিছু) এবং বাবা-মা মৃত।
তথ্য সূত্র: ১. লস এ্যাঞ্জেলস টাইমস (৭ অক্টোবর, ২০২১) ও
২. টাইমস অফ ইন্ডিয়া (১১ অক্টোবর, ২০২১)।
কবি,কথাসাহিত্যিক