irabotee.com,copy righted by irabotee

অনন্ত ঢাকি 

Reading Time: 4 minutes
(১)
– অ্যানি তোর হলটা কী বলতো ! এরকমটা তো আগে কখনো করিস নি, আমরা তো বরং এখানে যাবো না, সেখানে যাবো না বলে বায়না করেছি! তুই তো কোনদিন ঘ্যান ঘ্যান করিস নি!
– কোনদিন করিনি। আজ করছি তার কারণ আছে নিশ্চয়ই কিছু। 
– হ্যাঁ তো সেই কারণটাই তো জানতে চাইছি।
 কী বলবে অ্যানি! সবাইকে কী আর সব কথা বলা যায়! আজকাল অ্যানি ডাকস্ ব্যান্ডের বেশ নামডাক হয়েছে! কলেজের সোশ্যাল তো অ্যানি ডাকস্ এর প্রোগ্রাম ছাড়া একেবারে অচল। এখন পুজো আসছে তিন মাস আগে থেকে সব বুকিং হয়ে গেছে। এক একদিনে দুটো করে শো। ইচ্ছে না থাকলেও উপায় নেই। এমন ভাবে পায়ে এসে পড়ে না বলার কোন উপায় নেই।
দলের মাথা হচ্ছে অ্যানি! দারুণ ড্রাম বাজায়! এই পুরো দলটার পরিকল্পনা ওর মাথা থেকেই এসেছে। তাছাড়া আছে গিটারিস্ট বেণু , কি বোর্ডে ফেকলু , বাঁশিতে বাপ্পা, ম্যান্ডোলিনে মল্লার। এই ব্যান্ডের বিশেষত্ব হল এখানে সবাই ইনস্ট্রুমেন্ট বাজায়। গান টানের বালাই নেই। এরকম একটা ব্যান্ড যে এতটা পপুলার হবে কেউ ভাবেনি। এরা নিজেরাও কেউ ভাবেনি। এমনিই শুধু বন্ধুদের মধ্যে ব্যাপারটা চালু হয়েছিল। এখন তো আর বলার নেই। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে অ্যানি কিন্তু প্রথম থেকে অনেক খেটেছে। যখন যেখানে শো –এর ডাক পেয়েছে ছুটে গেছে। ফেকলুর বরং একটু নাক সিটকানো ব্যাপার আছে। কলকাতা থেকে বেশি দূরে হলে ও আবার যেতে চায় না। মফস্বলে যাওয়ার নাম শুনলে গায়ে জ্বর আসে। বলে কিনা পায়খানা বাথরুমের ঠিক নেই, তিন চার দিন পেট এঁটে বসে থাকতে পারব না। অ্যানির ওসবে কিচ্ছু যায় আসে না। দরকার হলে বাঁ হাতে কীবোর্ড বাজিয়ে আর ডান হাতে ড্রাম পিটিয়ে দারুণ ম্যানেজ করে নেয় ও !
সেই অ্যানি নাকি বলছে যাবে না, খাস উত্তর কলকাতার সাবেকি পুজো। পুরো টাকাটা এক কথায় অ্যাডভানস করে দিয়েছে। জমিদারি চলে গেছে চার পুরুষ আগে, তা বলে জমিদারি মেজাজ তো আর যায়নি! এইসব জায়গায় কাজ করেও আনন্দ! না হলে একেকটা জায়গা আছে শালা আর্টিস্টের সম্মানই দেয় না। টাকা পয়সা নিয়ে এমন হুজ্জতি শুরু করবে যেন ওরা ব্যান্ড নয়, মাছের ব্যবসা করতে এসেছে। 
– বন্ধু আমার টাকা নেওয়া হয়ে গেছে!
ফেকলু বলল
– ফেরত দিয়ে দে!
– সেটা কি ভালো দেখায় !
বাপ্পা মন্দ বলেনি। বাজারে মুড়ি মুড়কির মত সব ব্যান্ড গজিয়ে উঠছে! এখন একটা ভুল করা মানে বাজার হাতের বাইরে!  এসব নাম টাম করতে দশ বারো বছর লাগে। আর সে নাম খোয়াতে দশ বারো ঘণ্টাও লাগে না। 
– টাকা নেওয়ার আগে কি একবারও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলি তোরা ! 
একদম ঠিক, এটা কিন্তু ওদের একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। সত্যি তো অ্যানিকে তো একবার জিজ্ঞাসা করা উচিৎ  ছিল। না ঠিক লিডার বলে আইনত তাদের দলে কেউ না থাকলেও, অ্যানিকে তারা দলের সর্দারই মনে করে। টাকা নেওয়ার আগে তাকে একবার জিজ্ঞাসা করা উচিৎ ছিল বইকি! এমনিতে তারা যে কোন ব্যাপারে  আগে অ্যানির কথা শোনে, শুধু এবারটাই…। আসলে এত বড় জায়গা থেকে বায়না এল, অ্যানির যে আপত্তি থাকতে পারে তারা তো ভাবতেই পারেনি। 
– মানে একটু ঝেড়ে কাশ না ভাই! ওখানে যেতে তোর আপত্তি কোথায়! 
বেণু একটু আমতা আমতা করে বলল। কারণটা যদি সত্যিই তেমন গুরুতর কিছু হয়, তাহলে না হয়, তারা টাকা ফেরতই দেবে। বন্ধুর থেকে তো টাকা বড় হতে পারে না। 
– ঠিক আছে তোদের যখন এত আপত্তি , তখন না হয়, তোরা চলে যা। আমি তো কতবার ফেকলুর হয়ে কাজ সামলেছি, তোরা  কেউ একবারটি আমার ব্যাপার টা ম্যানেজ করতে পারবি  না!
সবাই চুপ করে রইল,  সকলের বিকল্প অ্যানি হতে পারে , কিন্তু আর কেউ যে তার বিকল্প হতে পারে না, সেটা অ্যানিও বোধ করি ভালো করেই জানে। 
  (২)
 
– মা! 
– অনন্ত এলি বাবা!
সারা পৃথিবী থেকে লোকানো এই একটাই জায়গা! যেখানে অনন্তকে অ্যানি বলে কেউ চেনে না। 
– মা আমার একটা অনুরোধ রাখতেই হবে!
– না, 
– না মানে!
মা যে তার অনুরোধ শোনার আগেই নাকচ করে দেবে সেটা বোধহয় ভাবেনি অনন্ত। 
– তুই তো এটাই বলবি , এবার পুজোয় বাবাকে ঢাক বাজাতে হবে না,  সেটা হবে না। হাজার বললেও তোর বাবা শুনবে না। 
খুব একটা ভুল কথা বলেনি মা, প্রতি বছর পুজোর সময় অনন্ত একবার এসে বলে–ও মা, এবার বাবাকে বল না যেন ঢাক বাজাতে কলকাতায় না যায়! মায়েরও যে খুব একটা ইচ্ছে , সেটা নয়।  তবে বাবাকে কে বোঝাবে! কিন্তু এবার যে বোঝাতেই হবে। 
উত্তর কলকাতার বসু বাড়িতে মদন ঢাকি চার পুরুষ ধরে ঢাক বাজাচ্ছে। আর সেখানেই ফেকলুরা এবার ব্যান্ডের বায়না করেছে।  যে মণ্ডপে দাঁড়িয়ে বাবা খেটো ধুতি পরে কোমরে গামছা বেঁধে ঢাক বাজাবে, সেখানে অনন্ত কি করে মঞ্চে উঠে ড্রাম বাজাতে পারে!
– মা বাবার শরীর খারাপ, প্রায়ই দমকে দমকে কাশি ওঠে।  এই অবস্থায় চার –পাঁচ দিন টানা এভাবে বাজানো কি ঠিক!
– আমি কী জানি তোর বাবাকে বোঝা!
সিদ্ধেশ্বরী অল্প কথার মানুষ। যে কাজ করে লাভ নেই সে কাজে বেশি সময় নষ্ট করা তার পছন্দ নয়। মানুষটাকে তো আজ থেকে নয়, প্রায় চল্লিশ বছর ঘর করা হয়ে গেল। এর আগে অনেকবার বলেছে সে,
– ওগো আর নাই বা গেলে কলকাতা, এখানে জমিজমা আছে, বেশ তো চলে যাচ্ছে!
তার উত্তরে অনন্তর বাপ শুধু বলেছে, 
– তা যাদের দয়ায় জমিজমা করলাম, তাদের দিকটা দেখব না! কত্তামশাই আর কদিন, তারপর তো পুজো উঠেই যাবে, ছেলেমেয়েরা সব বিলেতে থাকে, কে কী করবে কে জানে! তবু যতদিন পুজোটা হয়, মায়ের পুজো হবে আর মদন ঢাকি ঢাক বাজাবে না তাই কখনো হয়! 
অকাট্য যুক্তি , কে খণ্ডাবে!
বিকেলের দিকে অনন্ত এল বাবার কাছে, 
– আর কোনদিন বলব না, এবার অন্তত বলে দাও তুমি যাবে না। 
কোনো কিছু লুকিয়ে লাভ নেই , অনন্ত পুরোটা বলল, কেন এবার অন্তত সে চায় না ,বাবা কলকাতায় যাক। 
মদন ঢাকি সব শুনল, চুপ করে রইল খানিকক্ষণ তারপর আস্তে আস্তে বলল,
– তা বাবা, তুমি যদি তোমার বায়না না ফেরাতে পারো , আমিইবা কী করে বায়না ফেরাই  আমার তো চার পুরুষের বায়না! 
আবার একটু থামল মদন,
– তবে তুমি চিন্তা কোরো না, এই মদন মরে গেলেও ওখানে বলবে না, যে অ্যানি ডাকসের অ্যানি আসলে মদন ঢাকির ছেলে অনন্ত ঢাকি। 
  (৩)
আজ দশমীর বাজনা বাজছে, ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ , ঠাকুর যাবে বিসর্জন’। বনেদি বাড়ির পুজো সকাল ৯ টায় তিথি শেষ হতেই দর্পণ বিসর্জন হয়ে গেছে। মায়েরা বোনেরা এ ওর সিথিতে সিঁদুর দিচ্ছে। মদন ঢাকি বাজিয়ে চলেছে এক মনে  ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন’। হঠাৎ মাথাটা কেমন ঘুরে গেল, এই বয়সে চার দিন, ঠায় নেচে নেচে বাজিয়ে যাওয়া কি মুখের কথা!
হায় হায় এ কী হল , বিসর্জনের সময়ই ঢাক বাজবে না , একী অলুক্ষুনে কাণ্ড!
মদন ঢাকি তার ঢাক আবার কাঁধে তুলতে যাচ্ছিল, এই হয়ত তার শেষবারের বাজনা, আজ মুখে রক্ত উঠে গেলেও থামলে চলবে না। 
হঠাৎ কে যেন তার কাঁধ থেকে ঢাকটা ছিনিয়ে নিয়ে নিল,  
– আরে ওই ব্যান্ডের ছেলেটা এত ভালো ঢাক বাজাতেও পারে! 
– করছিস টা কি অ্যানি 
ফেকলু বলল
– মায়ের পুজোয় ব্যান্ড না হলেও চলে কিন্তু পুজোতে ঢাক বাজবে না, সে কি কখনো হয়! 
মদন ঢাকি অবাক হয়ে দেখল ছেলেকে, ভারি মিষ্টি লাগছে তো তাকে! হাতটাও বড় মিষ্টি। হবে না হাজার হোক মদন ঢাকির ছেলে সে অনন্ত ঢাকি! না না, অনন্ত ঢাকি হোক সেটা সে চায় না, তবে অনন্ত যেন অনন্তই থাকে।    
         

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>