অদ্ভুত আঁধার

Reading Time: 5 minutes

আজ ১৯ সেপ্টেম্বর কবি ও কথাসাহিত্যিক রিমি মুৎসুদ্দির জন্মতিথি।ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


লোডশেডিংটা আচমকাই হল। দিল্লিতে তো আজকাল লোডশেডিং বহুদিন হয় না। ইনভার্টারটা সেই কবে থেকেই খারাপ হয়ে পড়ে আছে। প্রয়োজন পড়ে না তাই সারানোও হয়ে ওঠে না। নিমেষে গোটা ফ্ল্যাট জুড়েই কেমন একটা বোবা নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল। আসলে লোডশেডিং হওয়ার আগে পর্যন্ত টিভিটা চলছিল। নীতিন ভারত-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট ম্যাচ দেখছিল। টিভিটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই দুকামরার ফ্ল্যাট যেন শতাব্দী প্রাচীন মৌন কোন ভাস্কর্য্যের মত নিশ্চুপ হয়ে পড়ে রইল। অন্ধকারে চোখ কিছুটা সয়ে যেতেই ত্রিপর্ণা কিচেনের দিকে মোমবাতি আনতে এগোয়।নীতিন হলঘরের জানলার পর্দাগুলো সরিয়ে দেয়। কাচের জানলার মধ্যে দিয়ে স্ট্রিট লাইটের আলো এসে ঘরের অন্ধকার কিছুটা দূর করে। নীতিন ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে শুধু ওদের আবাসনই অন্ধকার। কিছু একটা ফল্ট বা ওই জাতীয় সমস্যা হয়েছে বোধহয়। চারিদিকের তীব্র আলো আর বহুতলের জঙ্গলের মাঝে ওদের অন্ধকার আবাসনটা মোটেই বেমানান লাগছে না। বরং শান্ত এক নৈশব্দের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা আবাসন জুড়ে। যদিও নিস্তব্ধতা ঠিক বলা যায় না। আবাসনের গেট দিয়ে ক্রমাগত গাড়িদের আনাগোনা হয়ে চলেছে। কেউ দিনের শেষে ঘরে ফিরছে আবারও কারো ব্যস্ততম সময় শুরু হতে চলেছে। তারই মাঝে নীতিন অন্ধকারের নিঃশব্দতা অনুভব করে।নীতিনের ছেলেবেলা কেটেছিল শান্তিনিকেতনে। পাঞ্জাবী পরিবারের ছেলের শান্তিনিকেতনে বড় হওয়ার পিছনেও একটা গল্প আছে। ঠিক পাঞ্জাবী পরিবার কথাটা তার ক্ষেত্রে খাটেও না। শান্তিনিকেতনের স্কুল শিক্ষক মা সুদেষ্ণা আর পাঞ্জাবের উপলি গ্রাম থেকে আশির দশকে কলকাতায় ব্যবসা করতে আসা বাবা গুরপ্রীতের একমাত্র সন্তান নীতিন কউর।রক্ষণশীলতার গণ্ডি পেরিয়ে কিভাবে এক বঙ্গ ললনা পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী যুবকের প্রেমে পড়েছিল। সেই প্রেম বিয়ে অবধি গড়িয়েছিল, সে গল্প আপাতত মুলতুবি থাক। তবে এই অসবর্ণ বিবাহের জন্য গুরুপ্রীতকে তার পৈতৃক সম্পত্তি ও ব্যাবসার ভাগীদার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। তখনও কলকাতায় ৯০-এর দাঙ্গা শুরু হয় নি। গুরপ্রীত কলকাতায় নিজের চেষ্টায় ব্যাবসা জমানোর চেষ্টা করছিল। এরই মাঝে সুদেষ্ণা শান্তিনিকেতনের একটা স্কুলে চাকরি পায়। স্বামীর সাঙ্গে সেই চাকরির সূত্রেই শান্তিনিকেতনে বসবাস। নীতিনের জন্ম ও পড়াশোনা শাল-পলাশের দেশেই।বাবা গুরপ্রীতের একটা ছোট্ট বই-এর দোকান ছিল। এখন অবশ্য সেসব পাট চুকে গেছে। মায়োপিয়ায় আক্রান্ত গুরপ্রীত তার ক্রমাগত ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টি নিয়ে রোজ দুবেলা প্রায় কয়েকঘণ্টা কাটায় শুধুই বারান্দায় বসে। আশেপাশে ক্রমাগত কংক্রিটের জঙ্গল হয়ে গেলেও এখনও তাদের বাড়ির সামনের শিমূল পলাশের বন থেকে আদি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।


কবি ও কথাসাহিত্যিক রিমি মুৎসুদ্দি

গুরপ্রীত প্রাণভরে সেই গন্ধের আস্বাদ নেয়।সুদেষ্ণার পেনশনের সামান্য টাকায় এ নিশ্চিন্ততা সম্ভব ছিল না। একমাত্র ছেলে নীতিন দিল্লিতে একটা সংবাদপত্র সংস্থার স্টাফ-রিপোর্টার ও সিনিয়ার এডিটর। বাবা-মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব সে নিজেই কাঁধে তুলে নিয়েছে। পুত্রবধূ ত্রিপর্ণাও ভারী মিষ্টি মেয়ে। দূরাভাষে সব সময়েই সে খোঁজ খবর রাখে এই দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার।মোবাইলের আলোয় রান্নাঘরে মোমবাতি খুঁজতে গিয়ে ত্রিপর্ণা গ্যাস-ওভেনের উপর একটা আরশোলা দেখতে পেল। আদ্যন্ত শহুরে মেয়ে ত্রিপর্ণার গায়ে কোনও এক সময়ে গত জন্মের ন্যাকামি লেগে ছিল। আর তখন সে আরশোলা দেখে চিৎকার করে উঠত। বিয়ের পর পর তার এই আরশোলা ভীতি দেখে নীতিনও খুব মজা পেত। একটা আরশোলাকে ঘিরে নবদম্পতির মধ্যে বেশ একটা রোমান্টিক মুহুর্ত তৈরি হত। যে মুহুর্তগুলো হয়ত সফল ও ব্যর্থ উভয় নববিবাহিতের জীবনেই একটু আধটু ঘটে থাকে।মোবাইলের আলোয় আরশোলাটা কিন্তু একটুও ঘাবড়ায় নি মনে হয়। পতঙ্গটি সেই একই জায়গায় এখনও ঠায় বসে আছে। ত্রিপর্ণা মোবাইলের আলোয় দেখতে পেল গ্যাস-লাইটারটা শীতের রোদ্দুরের সিলভার মেডেলের মত জ্বলজ্বল করছে। এখুনি যদি গ্যাসওভেনের সঙ্গে তার মিলন ঘটে যায় তাহলে আরশোলার সম্পূর্ণ অস্তিত্বটাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আবার বরাত জোরে অথবা, ছোট্ট ডানার আত্মবিশ্বাসে ভর করে সে উড়ে পালাতেও পারে।মোমবাতিটা হাতে নিয়ে ত্রিপর্ণা মোবাইলের আলোটা বন্ধ করে দেয়। দেশলাইটা অবশ্য নেওয়া হল না। নীতিনের সিগার লাইটারেই জ্বালালো যাবে। রান্নাঘর জুড়ে এখন বড়ই আঁধার। এই অন্ধকারই তাকে কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে আজ। এইরকম বহুবার হয়েছে তার সঙ্গে। আলোর থেকে অন্ধকারই সে যেন বেশি আরাম খুঁজে পেয়েছে। এই অদ্ভুত আরামই বোধহয় তার কাছে আশ্রয়।ত্রিপর্ণা তখন ক্লাশ এইটে পড়ত। অ্যাসেম্বলির পরে সবে প্রথম পিরিয়ডের ক্লাস চলছিল। ক্লাসের মাঝেই স্কুলের কর্মচারী স্বপনকাকু এসে গম্ভীর মুখে কি যেন বললেন ঋতুপর্ণা ম্যামকে। ম্যাম ত্রিপর্ণাকে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে স্টাফরুমে আসতে বলেন। ঋতুপর্ণা ম্যামই সেদিন গাড়ি করে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। আচমকাই কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে সেদিন তার মা মারা গিয়েছিল।ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে মাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে শশ্মান ও সমস্ত লৌকিক, পারলৌকিক ক্রিয়ার মধ্যেই বারবার আঘাত করা এক নাথহীনতা তাকে অস্থির করে তুলছিল। সে তখনও একটুখানি আন্ধকার খুঁজছিল। যেখানে সে সরাসরি মুখোমুখি হতে পারবে এই বোধের সঙ্গে।আলোর সামনে এরকম বহুবার সে বিপণ্ণ বোধ করেছে। এক এক করে সেই সব বিপণ্ণতা যেন আজ এই অন্ধকার রান্নাঘরের ভিতর সমস্ত বাসনপত্র, মশলার কৌটো, মিক্সার-গ্রাইণ্ডার, মাইক্রোভেন, ওটিজি, গ্যাসওভেন –প্রতিটা জিনিস ফুঁড়ে বের হয়ে আসতে চাইছে। এই বেরিয়ে আসার মধ্যে অবশ্য কোনও দীর্ণতা নেই, বিপণ্ণতা বোধ নেই। বরং বোধহীনতার স্বস্তিই গ্রাস করেছে আজ তাকে। স্ট্রিট লাইটের আলো এসে হলঘরকে তো আলোকিত করেই ফেলেছে। মোমবাতিটার তাই আর কোনও প্রয়োজন নেই ভেবে সেন্টার টেবিলের উপর সে রেখে দেয়। ব্যালকনি থেকে এবার নীতিনও এসে ঘরে ঢুকল। ‘মোমবাতিটা জ্বালাও নি এখনও?’ না, মোমবাতির আর প্রয়োজন কোথায়? চারিদিকেই তো আলো। এই লোডশেডিং-এর মধ্যে তো এখন বই নিয়ে বসবে না তুমি?”নীতিন আচমকাই জানলার পর্দাগুলো টেনে দেয়। চড়ারঙের ভেলভেটের পর্দা দিয়ে আর কোন আলো এসে ঘরে ঢুকতে পারে না। অন্ধকার ঠাউরেই সে এসে বসে ত্রিপর্ণার পাশে।বছর চার আগে নীতিনকে বিয়ে করে দিল্লিতে আসে ত্রিপর্ণা। তারও আগে দুবছর ইউনিভার্সিটিতে চুটিয়ে প্রেম করেছিল তারা। দিল্লিতে আসার পর, প্রথম বছর ত্রিপর্ণার চাকরি-বাকরির প্রতি অতটা হেলদোল ছিল না। নতুন সংসার গোছানোর ফাঁকে ফাঁকে দুএকটা জায়গায় আবেদনপত্র পাঠাত। ছ’মাসের মাথায় একটা বড় প্রকাশনা সংস্থায় তার চাকরিও হয়ে যায়। নীতিনও জুনিয়ার থেকে স্টাফ-রিপোর্টার ও সিনিয়ার এডিটর হয়ে যায়। এরপরের গল্প অবশ্য প্রায় প্রতিটা পরবাসী দম্পতির ক্ষেত্রে যা হয়, এক্ষেত্রেও তারই পুনরাবৃত্তি ঘটে। দুজনই টাকা রোজগারের নেশায় মশগুল। শহরের প্রিমিয়াম লোকেশনে ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া, গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ, প্রেসক্লাবে ভদকার ফোয়ারা- এইভাবেই চলছিল। এই বছর চারের মধ্যে তাদের কোনও সন্তান না হলেও খুব একটা মাথাব্যথা এই বিষয়ে দুজনেরই ছিল না।চাকরিজীবনের একঘেয়েমি ও ক্লান্তি সত্ত্বেও কেটে যাচ্ছিল সময় একরকম। এই কেটে যাওয়া সময়ের এক সন্ধ্যেবেলা দম্পতি তখন সবে বাড়ি ফিরেছে। যদিও তখন ঘড়িতে রাত আটটা। দিল্লির বিকেলগুলো বেশ দীর্ঘস্থায়ী। ঝুপ করে নামা রাতের কারণে সন্ধে টের পাওয়া যায় না। বাড়ি ফেরার সময় অনুযায়ী এক একজনের এক একরকম সন্ধে। তা সেই রাত আটটার সন্ধেবেলায় টিভিতে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ভেসে আসছে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে। মুদ্রারহিতকরণের ঘোষণার মধ্যে দিয়ে দেশ নতুন ইতিহাস রচনা করতে চলেছে। যদিও মন্ত্রীর আশ্বাস চাকরীজীবিদের কোনও কিছু হারানোর ভয় নেই। নীতিনের কপালে তবু অসংখ্য ভাঁজ এসে পড়ে।সেই ভাঁজ আর চওড়া হয় আর কিছুদিনের মধ্যেই। তাদের সংবাদসংস্থা এবার ব্যায় সঙ্কোচের জন্য বহুল পরিমাণে কর্মী ছাঁটাই-এর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ছাঁটাই প্রক্রিয়া দ্রুতগতিতে শুরুও হয়ে গিয়েছে। উপরমহল থেকে নিম্নমহল অফিসের সবাই খুব চিন্তিত। যেকোনও মুহুর্তে যে কারোর উপর ঝুলে উঠবে বরখাস্তের খাঁড়া। ত্রিপর্ণার রোজগার থাকলেও নীতিনের বাবা-মা সম্পূর্ণ নির্ভর করে তার উপার্জনের উপর। এহেন অবস্থায় সে কোথায় আশ্রয় খুঁজে পাবে ভেবে পায় না।ত্রিপর্ণার পাবলিশিং হাউসে এখনও লে-অফের গল্প শুরু না হলেও ব্যয় সঙ্কোচের কথা উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বারেবারেই মিটিং-এ আলোচনা করছেন। এরমধ্যে ডেটলাইনের জন্য ত্রিপর্ণাকে বেশ কয়েকদিনধরেই অফিসে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছিল। তার বস ও কোম্পানির এমডি বছর পঞ্চাশের অভিষেক মেহেরা তাকে গাড়ি করেই বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছিল। দুএকদিন বারিস্তায় ডিনারও করেছে সে আর মেহেরা। একটুখানি হেসে কথা বলা, সামান্য গল্প আর একসঙ্গে ডিনারে ত্রিপর্ণার মধ্যে কোনও পাপবোধ তৈরি হয় নি এতদিন।আজ অফিসের শেষে মেহেরা ডেকেছিল তার চেম্বারে। মেহেরার অফিসরুমের চড়া আলোয় কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল তার। সেই আলোর প্রতিফলনে মেহেরার মাথার টাক চকচক করেছিল। তার কাছ থেকে প্রোমশনের সুখবরটা পেলেও আবার সেই আলোর সামনে বিপণ্ণতা ঘিরে ধরে ত্রিপর্ণাকে। এই বিপণ্ণতা কি শুধুই চাকরি হারানোর? না, তার গোটা অস্তিত্বের বিপণ্ণতা? তার কাজ, নিষ্ঠা, মেধা, মানুষ হিসাবে মর্যাদা সবই প্রশ্নচিহ্নের সামনে এসে দাঁড়ায়।অন্ধকারের মধ্যে তারা দুজনে পাশাপাশি বসে আছে। আরও কত বহু বহু জন্ম লাগবে নীতিনের হাতটা ত্রিপর্ণার হাতে রাখতে! ত্রিপর্ণাও তো পারছে না তার পরম প্রিয়জনের বুকে মাথাটা রেখে একটুখানি শান্তি খুঁজে নিতে। আজ অফিসে আলোর সামনে তার যে চূড়ান্ত অসহায়তা ও অপমান হল, তার থেকে একটুখানি মুক্তি পেতে!এই পর্যন্ত পড়ে পাঠক কি ভাবছেন? কি হতে পারে এই গল্পের পরিণতি? আমি নিজেও দ্বিধাগ্রস্থ। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি কি সাহায্য করবে এই গল্পের পরিণতি লিখতে। প্রয়োজন নেই বলে সেন্টার টেবিলে রেখে দেওয়া মোমবাতির সামান্য আলো-আঁধার কি সব বিপণ্ণতাকে চাপা দিতে পেরেছিল? এরপরও কি মাঝরাতে দুজনের কোনও একজনের ঘুম ভেঙে গেলে যদি তার মনে হয়, মাঝগাঙে সে হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন আরেকজনের উদ্যত হাত কি তাকে টেনে ডাঙায় তুলবে! আর দুজনেই তখন হয়ত দেখবে রাতের কালো আকাশেও যেন বরফের চাদর বিছানো রয়েছে।

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>