যেখানে যাওয়া হয়নি কখনো, অথচ কতবার গিয়েছি

Reading Time: 4 minutes
জাম্বেজি নদী

 

সে এমন একটা জায়গার কথা, যেখানে আমার কখনো যাওয়া হয়নি অথচ কতবার গিয়েছি ! মহামারী, দারিদ্র, অনাহার আর গৃহযুদ্ধের আফ্রিকা। সেই আফ্রিকার মোজাম্বিক। গৃহযুদ্ধ যাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। সাভানার বিস্তৃত তৃণপ্রান্তরও ক্রমশঃ হয়ে উঠেছিল একটা মাইন ফিল্ড। বছর বারো আগে, টাটারা তখন মোজাম্বিকে একটা কয়লা খনির প্রকল্পের সাথে যুক্ত হয়েছে ; পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কয়লার ভান্ডার রয়েছে সেই আদিম ভূমির নীচে। সেই কয়লাকে খনি থেকে তুলে এনে প্রায় ছশো কিলোমিটার সড়কপথে বা রেল পথে নিয়ে আসতে হবে সমুদ্রবন্দরে। বন্দরের নাম ‘বেইরা’। পথে পড়বে বিচিত্র সব জায়গার নাম, -বেঙ্গা, মোয়াতিজে, মুতারারা, ভিলা নোভা, হিনামিঙ্গা, মুয়াঞ্জা, ডোনা আনা, ডোন্ডো, -তারপরে বেইরা বন্দর। সেখান থেকে জাহাজে করে দূরদেশে হবে কয়লা রপ্তানি। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে পাতা রেলপথের একটা বিরাট অংশকে যে বিদ্রোহীরা বম্ব আর গ্রেনেড মেরে বেঁকেচুরে তুবড়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। রেলপথে সাভানার তৃণপ্রান্তর জুড়ে পুঁতে রেখেছে অজস্র মাইন। ভারতবর্ষ থেকে সেই রেললাইন সারিয়ে তুলতে গিয়েছেন রাইট্‌স আর ইরকন-এর ইঞ্জিনীয়াররা, প্রতিপদে বিস্ফোরণের ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়ে। বিশ্বখ্যাত বিদেশী কম্পানীরা তখন টাটাদের সাথে মিলে সেই খনিপ্রকল্পের জন্য লজিস্টিক্সের নক্সা তৈরী করছেন।

এইরকম এক সময়ে টাটাস্টীলের এমডির ইচ্ছায় আমাকে নিরপেক্ষভাবে বিদেশীদের প্রস্তাবগুলো খুঁটিয়ে দেখে, বিচার করে, সড়কপথ, নদীপথ নাকি রেলপথ, কোনটা কেন এবং কিভাবে সবচেয়ে ভালো হবে সেই পরামর্শ দিতে বলা হয়েছিল। প্রয়োজনে মাস ছয়েক ওখানে গিয়ে থাকতে হবে, তখনই। – টেলিফোনে হঠাৎ এমন একটা প্রস্তাব শুনে আমি থমকে গিয়েছিলাম। একটা গোটা রাত ঘুম হয়নি। বাড়িতে বৃদ্ধা মা, প্যারালিসিস। স্ত্রীও খুব সুস্থ নয়। আর আমি এসব ছেড়েছুড়ে সুদূর আফ্রিকার মোজাম্বিকে ?


জাম্বেজি নদীর অববাহিকায়, সাভানার বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে তখন ঘাস শুকিয়ে ঝলসে গিয়েছে। আর বেঙ্গার সেই খনি অঞ্চলে গ্রীষ্মে তাপমাত্রা ওঠে পঞ্চাশ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আমার মনে পড়লো, এই সেই আদিম গন্ডোয়ানা ল্যান্ড, এই মধ্য আফ্রিকাতেই তো আমাদের পূর্ব পুরুষ হোমো স্যাপিয়েন স্যাপিয়েন, নিয়ান্ডারথাল। এখানেই তো সেই আদি প্রকৃতি, ক্ষিপ্র চিতা, যূথবদ্ধ টাস্কার, বাওবাব, মহাদ্রুম, বজ্রগর্ভ মেঘ, জাম্বেজি নদীর মহাপ্লাবন। পরদিন ভিপি-র ‘গ্লোবাল মিনারাল্স‌’ অফিসে গিয়ে আমি জানালাম যে আমার পক্ষে ওখানে যাওয়া এখন সম্ভব নয়, আমি বরং একজন আসিস্ট্যান্টকে পাঠাবো, আর নিজে জামসেদপুরে বসেই সমস্ত রিপোর্ট খুঁটিয়ে দেখে, স্টাডি করে, দিতে থাকবো আমার মতামত। – ম্যানেজমেন্ট রাজি হলেন, আর শুরু হোল আমার মানসভ্রমণ। পরবর্তী একবছর আমার কাটলো–ওই মাইনগুলো খুঁটে খুঁটে তুলে ফেলে রেলপথ বসানো অথবা, খনি থেকে কয়লা নিয়ে জাম্বেজি নদীপথে বার্জে করে ভারত মহাসাগরে এসে উপকূল-সমুদ্রপথে বেইরা বন্দরে নিয়ে আসা–এর মধ্যে কোনটা বেশী উপযোগী ও কম খরচে হবে সেইসব বিচার। অর্থাৎ প্রথম গন্তব্য হবে বেইরা বন্দর, যেখান থেকে পরে বড় জাহাজে করে কয়লা রপ্তানি করা হবে ভারতে ও অন্যান্য দেশে। তো, তন্ন তন্ন করে খুঁজতে হোল জাম্বেজি নদীর নাব্যতা সারা বছর কোন সময়ে কেমন থাকে, কোথায় গিরিখাত আর ভয়ংকর গর্জের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে নদী, কী কী পণ্যবাহী লঞ্চ চলে সেখানে, মোহানায় জোয়ার-ভাটা, আর উপকূল-সমুদ্রের স্রোতগুলো কী রকম, এইসব। কত অজস্র টেকনিকাল রিপোর্ট আর ব্লু-প্রিন্ট তখন আমার টেবিলে। কত নতুন নতুন জিনিষ শিখছি আমি, একা একা, আগে তো দেশের বাইরে এমন জটিল অ্যাসাইনমেন্ট পাইনি। এর আগে আমার অভিজ্ঞতা ছিলো শুধু কলকাতা, হলদিয়া আর পারাদীপ বন্দরের লজিস্টিক্স নিয়ে। তাই কবিতা লেখার চেয়েও বেশি রোমাঞ্চকর হয়ে উঠলো এত দূরে বসে মধ্য আফ্রিকার প্রান্তরের মাইন-অধ্যুষিত রেলপথ, নদীপথ, আদিম প্রকৃতি ও সমুদ্রস্রোতের সাথে মনে মনে যুক্ত হয়ে থiকা। তখন জাম্বেজি নদী আমাকে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নেও ডাক দিত। মনে হোত চলে যাই।

কঙ্গো নদীতে বার্জের ওপরে বাজার বসেছে

ইন্টারনেটে অনেক খুঁজতে খুঁজতে এসময় একটা দারুণ ভ্রমণকাহিনী পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। একজন কানাডিয়ান ট্রাভেলারের ডায়েরী। সে একটা বড় বার্জে চড়ে কয়েকশো লোকের সাথে ভিড়ে, কঙ্গোর ‘যায়রে’-নদীপথে ছ’দিন ধরে তার সফরের দারুণ রোমাঞ্চকর বিবরণ লিখে রেখেছিল, বোধহয় আমার জন্যই। তাদের সেই বার্জকে দেখলেই জঙ্গলের ভেতর থেকে কাছে দূরে অনেক ড্রাম বাজতো, আর নদীতীরের গ্রামগুলো থেকে কোলের শিশুকে পিঠে বেঁধে, মাথায় কোঁকড়া চুলে পিগটেল বাঁধা মেয়েরা হৈ হৈ করে নৌকো (ক্যানয়) ভর্তি পাকা কলা, টাটকা মাছ, মদের হাঁড়ি, আর হাজার জিনিষ নিয়ে এসে ঘিরে ধরতো। থাকতো জ্যান্ত ছাগলের পাল, আর দড়ি দিয়ে মুখ বাঁধা ছোট ছোট কুমির। নৌকো থেকে বড় বড় মাছ কাঠের সিঁড়ি দিয়ে হুড়হুড় করে বার্জের ডেকে তুলে আনত তারা। বার্জের রাঁধুনি কিনে নিত সেইসব ছাগল, মাছ, কুমিরছানা আর বিনিময়ে বিক্রী করতো রংবেরঙের কাপড়, জামা, সাবান। সবই বার্টার পদ্ধতিতে বেচাকেনা। তিনটে কুমিরছানার বদলে একটা জামা আর একটা সাবান—এই রকম। পুরুষরা কেউ বার্জে উঠে নাপিতের কাছে চুল কাটতে বসে যেত। সন্ধে বেলা খাওয়াদাওয়া। ভাজা মাছ, কুমিরের মাংস, আর অনেক রাত অব্দি নাচগান, মদ্যপান, হুল্লোড়। ‘যায়রে’-নদী (এখন যার নাম ‘কঙ্গো নদী’) যেখানে ইকোয়েটর ক্রস করে যায়, সেখানে দেখা সূর্যাস্ত নাকি অসাধারণ। অনেক বড় সেই গোলক, কমলা গোলাপি রক্তাভ। – সেই ডায়েরী আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল অনেকদিন, অনেক রাত। ঘুমের মধ্যেও আমি সেই বার্জের আপার ডেকে। আকাশে জ্বলজ্বল করছে নক্ষত্রমালা। কখনো দুএকটা তারা খসে পড়ছে। নদীর দুপারে আদিম অরণ্য। চারিদিকে অদ্ভুত আঁধার।

 

অদ্ভুত আঁধার আজ পৃথিবীতে। শুধু রাজনীতির হাটে নয়, সঙ্গীত চিত্রকলা সাহিত্য সর্বত্র। অসৌজন্য, অসূয়া, পদলেহন, ক্ষমতার লোভ, নীতিহীনতা, মিথ্যাচার। “নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয় লিবিয়ার জঙ্গলের মতো” –কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন।   


দশ বছর পেরিয়ে গেল, সেই মোজাম্বিক দেশটায় আমার যাওয়া হয়নি আজও।

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>