| 27 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে প্রবন্ধ সাহিত্য

এইদিনে: আমার ছফা আবিষ্কার । আহমাদ মাযহার

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট
ahmad mazhar, irabotee.com
আজ ২৭ মার্চ প্রাবন্ধিক, গবেষক, শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক, সম্পাদক আহমাদ মাযহারের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা। 

 

আহমদ ছফার নামের সঙ্গে আমার পরিচয় কৈশোরেই। মনে হয় সত্তরের দশকের প্রথম দিকে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই চিত্তরঞ্জন সাহা কলকাতায় শুরু করেছিলেন ‘মুক্তধারা’র প্রকাশনা কার্যক্রম। সেই একাত্তরেই আহমদ ছফার জাগ্রত বাংলাদেশ প্রকাশ করেছিল ‘মুক্তধারা’। স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন উদ্দীপনায় চিত্তরঞ্জন সাহা ‘মুক্তধারা’ নামে সৃষ্টিশীল-মননশীল বইয়ের প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করেছিলেন আরও জোরেশোরে। ‘মুক্তধারা’ প্রকাশিত বইয়ের খবর যেন আগ্রহীরা জানতে পারে সেজন্যে নিউজপ্রিন্টে ছাপিয়ে প্রচুর ক্যাটালগ বিলি করা হতো। বিভিন্ন সময় ‘মুক্তধারা’র সেই ক্যাটালগ আমার হাতে এসেছিল। স্পষ্ট মনে পড়ে তালিকায় জাগ্রত বাংলাদেশ নামটা দেখেছিলাম। সম্ভবত সত্তরের দশকেই, সাপ্তাহিক বিচিত্রায় বা অন্য কোথায় যেন দেখেছিলাম তাঁর আর একটা বইয়ের নাম, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭৩)। নামটার মধ্যে একটা গভীর কিছুর ব্যঞ্জনা তখনই অনুভব করেছিলাম। তবে ঐ বয়সে এও বুঝেছিলাম সেই বই পড়ে আমার পক্ষে কিছু বোঝা সম্ভব হবে না। পরে যখন পড়লাম তখন অনুভব করলাম কী অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন বই এটি।

আশির দশকের প্রথম দিকে, সম্ভবত ১৯৮০ সালেই ইত্তেফাক-এ বা কোনও একটা দৈনিক পত্রিকায় দেখেছিলাম আহমদ ছফা সংক্রান্ত একটি সংবাদ। সংবাদটির শিরোনাম ছিল ‘আহমদ ছফা পুরস্কৃত’। বিস্তারিত পড়ে জেনেছিলাম ইতিহাস সমিতি তাঁর সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস (১৯৮০) বইয়ের জন্য পুরস্কার দিয়েছে। তাঁর জাগ্রত বাংলাদেশ বইয়ের নাম তো ‘মুক্তধারা’র লিফলেট-এর সূত্রে আগেই জানতাম; এই খবর পড়ে বুঝলাম তিনি খুব পণ্ডিত লোক। কিন্তু তাঁকে সামনাসামনি দেখি আরও কিছুদিন পরে, বাংলা একাডেমীতে। সামনাসামনি দেখে, তাঁর কথা শুনে, বিশেষ করে কথা বলার ভঙ্গি দেখে, উচ্চারণ শুনে মনে তেমন একটা সমীহ জাগল না। কথাবার্তা শুনে মনে হল বেশ ঝামেলা সৃষ্টিকারী মানুষ। কী বলেছিলেন তা আজ আর মনে নেই। তবে তিনি যা বলেছিলেন তাকে পুরো উড়িয়েও দিতে পারছিলাম না তা মনে আছে। সুস্পষ্ট লক্ষ্য ছাড়া আগ বাড়িয়ে মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে আমার সংকোচ হয়। মনে হয় সংকোচবশতই তাঁকে সামনাসামনি কয়েকবার দেখলেও নিজে যেচে পরিচিত হই নি। অন্য কোনও কারণে কথা বলবার প্রয়োজন তখনও পড়ে নি। এর মধ্যে বছরদুয়েক পেরিয়ে গেছে। উচ্চ মাধ্যমিক পেরিয়ে ঢাকা কলেজে বিএ সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছি। জড়িয়ে গেছি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে।

আশির দশকের প্রথম দিককার ঐ সময়টায় তরুণরা বেশ রাজনীতি-সচেতন ছিল। মনে পড়ছে ঐ সময়েই লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি বেশ আলোচিত ছিলেন। লিবিয়ার সঙ্গে আহমদ ছফার কী যেন একটা যোগ ছিল। শুনেছিলাম গাদ্দাফির সবুজ গ্রন্থ নামের বইটার প্রকাশনার সঙ্গে তিনি জড়িত। লিবিয়া থেকে টাকাপয়সা পান ছফা। লিবিয়া সম্পর্কে মানুষের মধ্যে তখন ধারণা ছিল মিশ্র। তাঁর ঐ লিবিয়া কানেকশন নিয়ে অনেককেই সমালোচনা করতে শুনেছি। বাংলাদেশে অনেক এনজিও গড়ে উঠতে শুরু করেছে তখন। বিদেশী সাহায্যে চলা এনজিও সম্পর্কে বাম রাজনীতিকদের মধ্যে তীব্র নেতিবাচক মনোভাব ছিল। তরুণদের মধ্যে এই নেতিবাচকতা সেই সময় ছিল আরও বেশি। আমরা তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তখন পর্যন্ত এনজিও রেজিস্ট্রেশন নেয় নি। নেয় নি বিদেশী সাহায্যও। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের টেলিভিশন অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তাসূত্রে মানুষের কাছে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ ও কিছু ধনী লোকের সঙ্গে সুসম্পর্কের সূত্রে ব্যক্তিগত অনুদানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চলছে। এনজিও সম্পর্কে সমকালীন নেতিবাচকতার দ্বারা আমিও তখন বেশ প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলাম। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে নিজের যুক্ততার ব্যাপারেও প্রশ্ন করছি নিজেকে। সুতরাং এনজিও সংশ্লিষ্ট আহমদ ছফাকে সামগ্রিকভাবে পছন্দ করতে পারি নি। আহমদ ছফার বিদেশ কানেকশন তখন কেবল লিবিয়ার সঙ্গেই নয়, জার্মানীর সঙ্গেও। গোয়েটের ফাউস্ট অনুবাদ করছেন শুনছিলাম। এই ফাউস্ট-এর অনুবাদের সূত্রেই তাঁর সঙ্গে জার্মানী কানেকশনের সূচনা। ১৯৮৬ সালে ফাউস্ট প্রকাশিত হল ‘মুক্তধারা’ থেকেই। শুনেছি গোয়েটে ইনস্টিটিউট থেকে এর জন্য অনেক টাকা এসেছিল। ফাউস্ট-এর অনুবাদের ভাষা তখন আমার ভালো লাগে নি ভাষা সম্পর্কিত আমার তখনকার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। বলে নেয়া ভালো যে, আমার সেই দৃষ্টিভঙ্গি আমার নিজস্ব বিচার বা উপলব্ধিজাত নয়, বরং সমসাময়িক কালে অন্যদের কাছ থেকে শোনা ধারণাজাত। বলা বাহুল্য, আধুনিকবাদীদের মতে ছফার অনুবাদে যে বাংলা পাওয়া যায় তা প্রাচীনগন্ধী। অনেক পরে বুঝেছিলাম ফাউস্ট অনুবাদে ব্যবহৃত বাংলাভাষা ছিল তাঁর নিজস্ব ভাষানিরীক্ষার প্রকাশ। এক কথায় একে নাকচ করে দেয়া যাবে না। মনে পড়ে ১৯৮২ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ৩৭ ইন্দিরা রোডের ভাড়াবাড়ি থেকে যখন ১৪ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউতে চলে এল তখন একদিন তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে যে জায়গাটা আমতলা নামে পরিচিত হয়েছিল সেখানে বসে সায়ীদ স্যারের সঙ্গে গল্প করেছিলেন। সেদিন কিন্তু তাঁকে অনেকটা সাধারণ ভদ্রলোকের মতোই আলাপ করতে দেখেছি। মনে পড়ে সায়ীদ স্যারের সম্পাদিত কণ্ঠস্বর পত্রিকায় তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধটির কথা উল্লেখ করেছিলেন। আমি তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত অবস্থায় বিভোর। সায়ীদ স্যার এবং তিনি বেশ হাসি ঠাট্টার মধ্য দিয়ে আলাপচারিতা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। যতদূর মরে পড়ে নজরুলের কবিতা সম্পর্কে জাতীয় কবিতা পরিষদে প্রদত্ত হুমায়ুন আজাদের ভাষ্য সমর্থন পায় নি তাঁর। এর মধ্যে একদিন শিবনারায়ণ রায় সম্পাদিত জিজ্ঞাসা পত্রিকায় আহমদ ছফার ওঙ্কার নিয়ে পড়লাম রশীদ করীমের লেখা। রশীদ করীম ওঙ্কার-এর প্রশংসা করেছিলেন। রশীদ করীমের লেখাটি পড়েই আমি উদ্বুদ্ধ হই বইটি পড়ার ব্যাপারে। অভিনব এই রচনাটির মধ্যে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক অসামান্য প্রতীকী উপস্থাপনা দেখতে পাই। নানা পত্রিকায় ছফার লেখাপত্র পড়ি, তাঁর ভাষ্য অধিকাংশ সময়েই ভালো লাগে, উস্কে দেয় আমার ভাবনাকে, কিন্তু নিঃসংশয়ে তাঁকে গ্রহণ করি না। এখানে ওখানে তাঁকে দেখি, কথা হয় না তেমন। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে, তিরাশির শেষের দিকে বা চুরাশির দিকে, চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ প্রায়শই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আসতেন। তাঁর কাছে ছফার অনেক চাঞ্চল্যকর কথা শুনতাম। তিনিই ছফার বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৭৯) বইটার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। বিশেষ করে নাম প্রবন্ধটি এবং ‘বাঙলার চিত্র ঐতিহ্য ও সুলতানের সাধনা’র কথা বলেছিলেন। দুটি প্রবন্ধই আমার চিন্তাগঠনে প্রভাব ফেলেছিল। তারেক মাসুদ ছফার উপন্যাস একজন আলী কেনানের উত্থান পতন (১৯৮৯), অলাতচক্র (১৯৯০) এবং গাভী বৃত্তান্ত (১৯৯৪)-এর কথাও বলেছিলেন আমাকে। এখন মনে হয় যে তাঁর বইগুলোর যথার্থ মূল্যায়ন বা সমালোচনা নেই! একজন আলী কেনানের উত্থান পতন এবং গাভী বৃত্তান্ত শৈল্পিক মূল্যায়নে কতটা মূল্যবান তারেক মাসুদের তখনকার কথায় সেটা আমার কাছে স্পষ্ট হয় নি। আমি তখন আহমদ ছফার উপন্যাসকে খানিকটা কৌতুকের চোখে দেখতাম। আমার ধারণা ঐসময় যথার্থ সাহিত্য সমালোচনার অভাবে বইগুলোর দিকে যথেষ্ট সংখ্যক পাঠকের দৃষ্টি পড়ে নি। শিবনারায়ণ রায় ছফার মরণ বিলাস (১৯৯০) উপন্যাস নিয়ে সলিমুল্লাহ খানের একটি দীর্ঘ সমালোচনা ছেপেছিলেন তাঁর জিজ্ঞাসা পত্রিকায়। আরও পরে লেখা তাঁর লেখা উপন্যাস অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬), পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ (১৯৯৬) যথোচিত সমালোচনা পায় নি। তুলনায় অনেক সাধারণ মানের লেখাকে সামাজিক মূল্য দেয়া হয়েছে। সামগ্রিক ভাবে মনে হয় আহমদ ছফা প্রতীক সৃষ্টিতে পারঙ্গম ছিলেন। নিজের শৈল্পিক বক্তব্য উপস্থাপন করতেন রূপকের মাধ্যমে। এই রূপকগুলো সমালোচকের ব্যাখ্যায় স্পষ্টতা পেলে আমার মনে হয় ছফার উপন্যাসের গুরুত্ব ক্রমশ বাড়বে।

গোটা নব্বইয়ের দশক জুড়েই তিনি বাংলা মোটরের গলির যে বাড়িতে থাকতেন তা ছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একেবারেই কাছে। শিল্পী এস এম সুলতান ছফার কাছে আসতেন প্রায়শই। সেখানে এলে মাঝে মাঝে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রেও আসতেন তারেক মাসুদ বা অন্যদের সঙ্গে। মনে পড়ছে জার্মান সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সুলতানের যে প্রদর্শনী করেছিল তার আয়োজনে ছফার ভূমিকা ছিল। ঐ সময় সুলতান ঘন ঘন আসতেন। তারেক মাসুদ যে সুলতানকে নিয়ে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন তার পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল ছফার ‘সুলতানের সাধনা ও বাংলার চিত্র ঐতিহ্য’ প্রবন্ধটি। জার্মান সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রদর্শনীর আগে বা পরে শিল্পকলা একাডেমীও একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল সুলতানের ছবির। তাতেও ছফার ভূমিকা প্রধান ছিল বলে শুনেছি। বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৭৯) বইয়ে ‘সুলতানের সাধনা ও বাংলার চিত্র ঐতিহ্য’ প্রবন্ধে সুলতানকে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল তাতে রসিক মহলে সুলতানের গুরুত্ব বেড়েছিল; নানাজনের সঙ্গে কথা বলে তখনই আমি অনুভব করেছিলাম সেকথা। আহমদ ছফা ‘সুলতান পাঠশালা’ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এখানেই। এই গলিতে যাতায়াতের সময় প্রায়শই দেখা হতো তাঁর সঙ্গে। আমি সালাম দিতাম। সালাম গ্রহণ করতেন হাসিমুখে। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা প্রায় সবাই যেত তাঁর কাছে। গোটা নব্বইয়ের দশকজুড়ে তিনি কত যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন! যতদূর মনে পড়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নেয়া শুরু করেছিল কবি সাজ্জাদ শরিফ আর ব্রাত্য রাইসু। সেগুলো পড়েও চমকিত হতাম। আমার তো মনে হয় দৈনিক-সাপ্তাহিকে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারও যে একই সঙ্গে বিনোদনপূর্ণ ও মননশীল হতে পারে তার পরিচয় প্রথম দিকে রেখেছিলেন আহমদ ছফা ও হুমায়ুন আজাদ। পরে অবশ্য আরও অনেকেরই সাক্ষাৎকার আকর্ষণীয় ও চাঞ্চল্যকর হয়ে উঠেছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও আমার সংকোচ তখনও অবিনাশী রয়ে যায় তাঁর সম্পর্কে। সংকোচের কারণ, তাঁর কথা ও জীবনযাত্রা সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয় নি আমার কাছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাশের বাড়িতে থাকতেন বলে তাঁর বাড়িতে আড্ডা দিয়ে কেন্দ্রে এসে অনেকেই তাঁর প্রসঙ্গ তুলত। আমি প্রায় নিশ্চুপ থাকতাম। এমনও হয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এসে জানতে অনেকে জানতে চাইত তাঁর খোঁজ। অনেক সময় বিরক্তি লুকিয়ে দেখিয়ে দিতাম। বিরক্তির কারণ তাঁর বিস্ময়কর ব্যবহার! একদিন কে যেন এসে বলল তাঁকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কোনটা জানতে চাইলে তিনি চেনেন না বলে জানিয়েছেন। আমি খুবই কূপিত হয়েছিলাম তা শুনে। সায়ীদ স্যারকে জানিয়েওছিলাম সে-কথা। স্যার তেমন একটা পাত্তা দেন নি আমার কথায়। বলেছিলেন, ছফা প্রতিভাবান মানুষ। প্রতিভাবানেরা তো আর সাধারণ মানুষের মতো হয় না! স্যারকে ছফার ব্যাপারে বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখি নি কখনও।

সম্ভবত ১৯৯৭ সালে রাজু আলাউদ্দিন বাংলাবাজার পত্রিকায় প্রফেসর রাজ্জাককে নিয়ে ছফার ধারাবাহিক লেখা যদ্যপি আমার গুরু ছাপিয়েছিলেন। দৈনিক পত্রিকার পাতায় নিয়মিত ভাবেই পড়তাম রচনাটি। পরে ১৯৯৭ সালে বই হয়। ঐ বছর বা তার পরের বছর একদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বইটি সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন রাজনীতিক ও অর্থনীতিবিদ শিক্ষক এম এম আকাশ। দু-একটা বিষয়ে খানিকটা নেতিবাচক কথা বললেও তিনি বেশ প্রশংসা করেছিলেন বইটির। তারপরে আবার পড়েছিলাম বইটি। বাংলাদেশের সাহিত্যে এটিও এক অসাধারণ বই। শ্রদ্ধা ও সমালোচনার এমন দৃষ্টান্ত আর নেই। বই হিসাবে এর স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় রয়েছে অনেক দিক থেকেই। বাংলাদেশের মানুষ যে তার সাধারণ কথ্যভাষায় বড় ভাব প্রকাশ করতে পারে তার এক অসামান্য দৃষ্টান্ত এই বইটি।

আহমদ ছফার গল্পের বই নিহত নক্ষত্র-এর কথা কারও কারও কাছে শুনেছি। শুনেছি উপন্যাস সূর্য তুমি সাথী-র কথাও। কিন্তু কবি আহমদ ছফার কথা উল্লিখিত হতে শুনি নি তেমন। ষাটের দুটি কবিতা সংকলনের একটিতেও ছফা উপস্থিত নেই! তাঁর মৃত্যুর পর হাতে আসে একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা (১৯৭৭), আমি পাঠ করি এর দ্বিতীয় সংস্করণ যেটা পাঠক সমাবেশ প্রকাশ করেছে। আগে দেখলেও পড়া হয়ে ওঠে নি। জল্লাদ সময় (১৯৭৪) পড়েও ভালো লেগেছিল। তবে দুর্মর জীবনাকাঙ্ক্ষার কবিতা একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা অসাধারণ। ওঙ্কার (১৯৭৫) উপন্যাসে যেমন তিনি মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ও জাগরণকে ভাষা দিতে পেরেছিলেন তেমনি মহাকাব্যিকতার আঙ্গিকে ভাষা দিতে পেরেছিলেন একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনায়। তিরিশি আধুনিকতার অবসানে এই কবিতার আধুনিকতা ক্রমশ ভাস্বর হয়ে উঠবে।

ছফা সম্পর্কে আমার সংশয় কাটাতে সহযোগিতা করেছেন ছফার আর এক অনুরাগী ড. সরদার আবদুস সাত্তার। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে একদিন আমি ছফা সম্পর্কিত অস্বস্তিগুলো তুলে ধরি তাঁর সামনে। সরদার সাত্তারকেই ছফা জ্ঞান করে আমি আক্রমণ চালাই। তিনি যেন ছফা হয়েই উত্তর দেন আমার সব আক্রমণের। তিনি আমাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, ছফার কোনও আচরণকেই এর বহিরঙ্গ দেখে বিচার করা ঠিক হবে না। খুব শান্ত ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে তিনি আমাকে বুঝিয়ে দেন যে তাঁর মতো বিবেকী, মননশীল, হৃদয়বান ও সৃষ্টিশীল মানুষ আমাদের সমাজে খুব কমই আছে। সেই কারণে তিনিও তাঁকে শ্রদ্ধা করেন।

ছফার মৃত্যুকে বেদনাদায়ক অকাল মৃত্যু বলতে হবে। কারণ ছফা তাঁর নিজের জীবনদৃষ্টির স্বভাবকে যখন অন্যদের সামনে কার্যকর ভাবে হাজির করতে সক্ষম হয়ে উঠছিলেন, যখন তাঁর অনুরাগী অনুজেরা সমাজে প্রভাবশালী হয়ে উঠছিল প্রায় তখনই ঘটল তাঁর প্রয়াণ! বেঁচে থাকলে হয়তো আরও অনেক কার্যকর ভূমিকা আমাদের সমাজের জন্য তিনি রাখতেন। জীবিত ও সচল মানুষের জীবনের বৃত্ত থাকে অসম্পূর্ণ। ফলে সেই মানুষটাকেও অনুভব করা হয় অসম্পূর্ণভাবেই! মৃত্যুর মধ্য দিয়েই পূর্ণ হয় মানুষের জীবনবৃত্ত। পূর্ণ হয়েছে আহমদ ছফারও জীবনবৃত্ত। ছফা নিজে আর নতুন কিছু যোগ করতে পারবেন না। কিন্তু তাঁর জীবনসন্ধান করে অনেক কিছু এখনও পাবার আছে আমাদের। তিনি ছিলেন মুক্তপ্রাণ এক ভাবুক। রাজনীতিতে অংশ নিলেও পরিপূর্ণ অর্থে রাজনীতিবিদ তিনি ছিলেন না। আবার ছিলেন না শুধু সাহিত্যিকও। ব্যক্তিস্বভাবে তাঁর স্বাতন্ত্র্য অনেক সময় অন্যদের বিভ্রান্ত করত। খানিকটা উড়নচণ্ডী স্বভাবের হলেও ছিলেন সামাজিক মানুষ। মৃত্যুর পর তাঁর পারিবারিক চিঠিপত্রের যে সংকলন প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে দায়িত্বশীল পিতৃহৃদয়কে উন্মোচিত হতে দেখি। দেখি সামাজিক এক সম্পন্ন মানুষকে। আর দেখি বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন ইহজাগতিক এক মানুষকেও। অর্থের প্রয়োজন ছিল তাঁর, কিন্তু তা কেবল ভোগের জন্য নয়, ত্যাগের জন্যও। জ্ঞান তিনি অর্জন করেছিলেন অর্থলাভের জন্য নয়, জীবনকে বিকশিত করবার জন্যে। তাঁর সারাটা জীবন ছিল অভিযাত্রায় পূর্ণ। হয়তো সে-কারণেই জীবনকে ভারাক্রান্ত হতে দেন নি কখনও। কারও শিখিয়ে দেয়া বুলির প্রচার করেন নি। কথা বলেছেন অন্তরাত্মার ভাষায়। অন্তরাত্মার ভাষায় কথা বলবার মানুষ খুব কমে গেছে আমাদের চারপাশে। এইখানেই তিনি এগিয়ে থাকলেন তাঁর আশপাশের অনেক তথাকথিত উজ্জ্বল মানুষদের থেকে। এইভাবে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখছি ধীরে ধীরে নানা ভাবে আহমদ ছফাকে আবিষ্কার করে চলেছি আমি যা এখনও চলমান।

 

আহমাদ মাযহার জন্মেছেন ঢাকায়। জন্ম ২৭ মার্চ ১৯৬৩। লেখাপড়াও ঢাকায়। খিলগাঁও উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ১৯৭৮ সালে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে এইচ এস সি (১৯৮০), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় [ঢাকা কলেজ] থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মান সহ স্নাতক (১৯৮৩) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর (১৯৮৪)। আধুনিকতা: পক্ষ বিপক্ষ (২০০১)[প্রবন্ধ-সমালোচনা-গবেষণা], ব্যক্তি সমাজ সাহিত্য (২০০৮)[প্রবন্ধ-সমালোচনা], রবীন্দ্রনাথ নারী বাংলাদেশ (২০০৯), শিশুসাহিত্যের রূপরেখা (২০০৯) [সমালোচনা-গবেষণা], বাঙালির সিনেমা (২০০৯) [গবেষণা-সমালোচনা], দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী (১৯৯৭) [অনুবাদ], ঘুমের বাড়ি (১৯৮৫) [ছোটদের কবিতা], নীল পিয়ানো (১৯৮৬) [ছোটদের গল্প], ইঁদুরকে মেরেছি পালোয়ান হয়েছি (১৯৯৭) [ছোটদের গল্প], রূপের ঝিকিমিকি (২০১১) [ছোটদের কবিতা], আমার উপেক্ষিত কবিতাগুলো (২০১০) [কবিতা], ছড়াতত্ব ছড়াশিল্প (২০১১) [গবেষণা-সমালোচনা], বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস (২০০০) [ইতিহাস] ইত্যাদি। রচনা-সম্পাদনা মিলিয়ে বইয়ের সংখ্যা পঞ্চাশেরও বেশি।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত