বাংলা সাহিত্যে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটির কোনো জুড়ি নেই। এই উপন্যাসের একটি চরিত্রে মানিকবাবু যে সুগভীর ইতিহাসবোধ, জীবন-অভিপ্সা এবং মনীষার পরিচয় দিয়েছেন, বোধকরি চরিত্র-সৃজন-কুশলতায় তারও কোনো জুড়ি নেই। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটির কথা উঠলেই কুবের, মালা, কপিলা, রাসু, গণেশ ইত্যাকার মানুষদের মুখগুলো আপনা-আপনিই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মানিকবাবু তেমন শিল্পী (বিশেষ করে ‘পদ্মা নদীর মাঝিতে’) যা স্পর্শ করেছেন, জীবন্ত করে তুলেছেন। ক্ষিপ্রটানে একেকটি চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র প্রমত্তা পদ্মা থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক তাণ্ডব, ঝড়, বন্যা, সমুদ্রের ভয়ঙ্কর বিস্তার, এমনকি সে আকুরটাকুর গ্রামের শ্যামাদাসের বাড়ির গম্ভীর পাঁঠাটি পর্যন্ত আশ্চর্যরকম জীবন্ত। যে নৈসর্গিক পটভূমিকায় জীবন-সংগ্রামে কাতর মানুষগুলোকে তিনি স্থাপন করেছেন; সেই নিসর্গ যেমন ভীষণে-সুন্দরে জীবন্ত, তেমনি জীবন্ত বিচিত্র আবেগের মানুষগুলো। কেউ বাড়তি নয়, কোনো ঘটনা বাহুল্য নয়, কোনো দৃশ্যপট অতিরিক্ত নয়। তাই উপন্যাসটির কথা উঠলেই সবকিছু মনে পড়ে যায় এবং সব মিলিয়েই উপন্যাসটি। যার যতটুকু প্রাপ্য ঠিক ততটুকু আয়তনের মধ্যেই লাগসই ভাবে বসে গেছে। কুবের-মালা-কপিলা-রাসু এসব চরিত্রের ক্রমিক উন্মোচনের মধ্যে যে হৃদয়-ভাবনার উৎসার হয়েছে, গভীরতম চিন্তাটি পর্যন্ত পরিবেশের সঙ্গে পূর্ণ সামঞ্জস্য রেখে যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, সে উপস্থাপনার বাস্তবতা এবং শিল্প-সৌকর্য নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা করা সম্ভব।
উপস্থিত মুহূর্তে আমরা তাঁর ‘হোসেন মিয়া’ চরিত্রটির প্রতি একটু অভিনিবেশ সহকারে তাকাবার চেষ্টা করছি। বেবাক বাংলা সাহিত্যে এমন আশ্চর্য চরিত্র আর কোনো শিল্পী সৃষ্টি করেছেন কিনা সন্দেহ। শুধু অন্তর্দৃষ্টি, শুধু জীবনবোধ কিংবা লেখকসুলভ নির্লিপ্ততা, লেখার রাজনৈতিক-সামাজিক দর্শন অথবা মানবচরিত্র সম্পর্কে জ্ঞান থাকলেই এরকম একটা চরিত্র সৃষ্টি করা যায় না। আরো অধিক কিছুর প্রয়োজন।
সমস্ত উপন্যাসে যদিও ‘হোসেন মিয়া’র উপস্থিতি অধিক নয়, তবুও ‘হোসেন মিয়া’ই উপন্যাসের প্রাণ। কিন্তু তাই বলে ‘হোসেন’ উপন্যাসের নায়ক নয়। নায়কের যে আবেগ থাকে, দুর্বলতা থাকে, হোসেনের চরিত্রে তাঁর ছিটেফোঁটাও নেই। ইলিয়ড মহাকাব্যে দেবরাজ জিউসের নির্দেশে যেমন সবকিছু একের পর এক ঘটে যাচ্ছে – বিজয়ী-বিজিত, হত এবং হন্তা শুধু নিমিত্ত মাত্র, সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়েই মহা ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন দেবতার চূড়ান্ত ইচ্ছারই বিজয় সূচিত হয়েছে। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তেও পাদপ্রদীপের একটু পেছনে দণ্ডায়মান মিঠেমিঠে বুলি এবং গুছিগুছি দাড়িবিশিষ্ট এই শান্ত, একেবারে অনুত্তেজিত মানুষটিও সেরকম শক্তির অধিকারী। তার প্রকাণ্ড ইচ্ছাশক্তির প্রবল বাধ্যবাধকতা পদ্মার তীরবর্তী জেলে-সমাজে অত্যন্ত সক্রিয়, তারা কেউ সে নিগড় ছিন্ন করতে পারে না। এই মহাস্বাপ্নিকের স্বপ্ন সফল করার জন্য আনন্দ-বেদনা-স্পন্দিত প্রেম-ভালোবাসা-কল্লোলিত অন্তর নিয়েই স্বেচ্ছায় হোসেন মিয়ার কাছে তাদের আত্মসমর্পণ করতে হয় অথবা তাঁদের বেঁচে থাকবার গভীর আকাঙ্ক্ষাই তাদেরকে বাধ্য করে হোসেন মিয়ার কাছে যেতে। পদ্মাপারের এই এক টুকরো পৃথিবী, যেখানে জেলে-সমাজের বসবাস, মায়ামমতা, ঝগড়া-বিবাদ এবং প্রাণধারণের সমূহ আর্তি গভীর করুণ সুরে বেজে ওঠে, তা যখন কোনো কারণে দৃষ্টিসীমানা থেকে অবলুপ্ত হয়ে যায়, বিশাল পৃথিবীর অন্য কোনো স্থান, অন্য কোনো জনপদ তাদের দৃষ্টিতে নিবাসভূমি হিসেবে ভেসে ওঠে না; জঙ্গলাকীর্ণ, বাঘ-সিংহে ভরা, লোনাজল-বেষ্টিত ঊষর-অনুর্বর ময়নাদ্বীপের ছবিই চোখে-চোখে দৃশ্যমান হয়। সেখানে যাবার দুঃস্বপ্ন তাদের পেয়ে বসে এবং শেষপর্যন্ত যেতেও হয়। হোসেন মিয়া এই ময়নাদ্বীপের রাজা এবং আবিষ্কারক দুই-ই। হোসেন মিয়ার পরিচয় এভাবে দিয়েছেন লেখক। তার বাড়ি ছিল নোয়াখালী অঞ্চলে। বেশ কয়েক বছর আগে পদ্মার তীরবর্তী কেতুপুর গ্রামে সে আসে এবং সে সময়ে জহুর মাঝির বাড়িতে আশ্রিত হিসেবেই ছিল, অন্যান্য মাঝিদের সঙ্গে মাঝিগিরি করেই জীবিকা নির্বাহ করত। এ কয় বছরে সে বেজায় ধনী হয়ে উঠেছে। এখন দাড়িতে মেহেদীর রং লাগায়, ফিনফিনে আদ্দির পঞ্জাবী শরীরে চড়ায়, মাত্র অল্প কিছুদিন আগেই দু’নম্বরের স্ত্রীকে বিয়ে করে এনেছে। ধনী হওয়া সত্ত্বেও সে জেলেপাড়ার লোকেদের সঙ্গে আগের মতোই মেলামেশা করে। ধনসম্পদ হাতে এলে যে সামাজিক প্রতিষ্ঠার উন্মত্ত মোহ মানুষকে পেয়ে বসে, হোসেন মিয়ার মধ্যে তার কণামাত্রও নেই। বড়লোকের সঙ্গে সে ব্যবসা করে, সমাজ করে না। আরেকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন লেখক, হোসেন মিয়া একজন স্বভাবকবি। ঘটনাচক্রে যদি হোসেনের জীবনধারা বদলে না যেত তাহলে অনায়াসে কবিত্বশক্তির বলে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন একজন সাধুপুরুষ হিসেবে বিবেচিত হতে পারত। ‘লালন শাহ’, ‘হাসন রাজার’ মতো তারও অনেকগুলো রচনা পল্লীগ্রামের গীতিসংগ্রহে স্থান করে নিত। আশেপাশের দশ গ্রামের মানুষ জাগতিক কল্যাণাকাঙ্ক্ষায় কবরে ভক্তিভরে মোমের প্রদীপ জ্বালাতো। কিন্তু ঘটনাচক্রে হোসেনকে অন্য জীবন বেছে নিতে হয়েছে। তাই বলে তার কবিত্ব শক্তির উৎস একেবারে রুদ্ধ হয়ে যায়নি। এখনও সে ইচ্ছে করলে মুখেমুখে চমৎকার গান রচনা করতে পারে। তার আত্মপ্রত্যয়ের জুড়ি নেই। তাই হোসেন যখন বলে, খুশি হলে সে সব করতে পারে, একটুও অস্বাভাবিক শোনায় না। অপরিসীম আত্মবিশ্বাস-সম্পন্ন, নানা গুণে গুণান্বিত হোসেন মিয়ার আত্মসংযমেরও তুলনা নেই। কেউ তার ক্ষতি করলে শাস্তি সে দেয় কিন্তু কখনো কোনো ব্যাপারে তাকে রাগ করতে দেখা যায়নি।
হোসেন মিয়া পাকা মাঝিও বটে। এত নির্ভাবনায় সে গভীর সমুদ্রে নৌকায় হাল ধরে বসে থাকতে পারে, পদ্মাপারের বংশ-পরম্পরা মাঝিও হোসেনের হেকমত দেখে চমকে যায়। সে ম্যাপ দেখে দ্বীপের অবস্থা নির্ণয় করতে জানে। রাতের তারার গতিপথ দেখে সময় কত বলতে পারে। দিক নির্ণয়ের কাজে কম্পাস ব্যবহার করতে জানে নির্ভুলভাবে। চাঁটগায়ে সাহেব কোম্পানীর জাহাজে চাকুরী করার সময় যন্ত্রপাতি চালনার বিদ্যা এত গভীর অনুরাগ নিয়ে শিক্ষা করেছে যে, ইচ্ছা করলে হোসেন একখানি জাহাজ নিয়ে সমস্ত পৃথিবী একাকীই ঘুরে আসতে পারে।
হোসেন মিয়ার বাড়ি নোয়াখালী। মাঝখানে অনেক বছর জাহাজে সে চাকুরী করেছে এবং বর্তমানে পদ্মাপারের কেতুপুর গ্রামের হিন্দু-মুসলমান মাঝিদের সঙ্গেই তার সমাজ।
সংকীর্ণ পৃথিবীর এই অধিবাসীরা অসাধারণ আত্মপ্রত্যয়ী এবং ক্ষমতাসম্পন্ন হোসেন মিয়ার সাথে ঠিক মিশতে পারে না। কিন্তু তাদেরকে তার কাছে যেতেই হয়। হোসেন যদিও বলুক না কেন সে হৃদয়ের মধ্যিখান থেকে তাদের পিয়ার করে, তথাপি মজ্জাগত আদিম অসহায়তার ভীতি তারা কাটিয়ে উঠতে পারে না। যন্ত্রের মত নিখুঁত, দেবতার মতো পারঙ্গম এবং জীন-পরীর মতো রহস্যময় হোসেন মিয়ার কথায় সায় দিলে, তার প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলে যে একদিন অমঙ্গল এসে তাড়া করবে তারা বুঝতে পারে। কিন্তু তাদের নিয়তিই এমন যে তারা যেন হোসেনের কথায় সায় দিতে এবং তার নির্দেশ পালন করার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছে।
বহিরঙ্গের দিক দিয়ে দেখলে হোসেন নোয়াখালী জেলার মুন্সী-মোল্লা জাতীয় মুসলমান। সে মুন্সী-মোল্লার মতো কথা বলে, পোশাক পরে, দাড়ি রাখে, আবার দাড়িতে নুরে মেহেদীর রংও লাগায়। এ হলো বাইরের ব্যাপার। ভেতরের মানুষটি ঠিক একেবারে অন্যরকম। হোসেনের মধ্যে ধর্মীয় কোনো সংস্কারের সামান্য আঁচড়ও নেই। এ নিয়ে সে কোনো কথাই বলে না। সে শুধু বোঝে তার জন্য কোন্টা সুবিধার, কোন্টা অসুবিধার। জগৎ এবং জীবনকে সে যে দৃষ্টিতে দেখে তার সঙ্গে অন্য দশজন প্রাচ্য দেশীয় মানুষের দেখার কোনো মিল নেই।
আজিজ সাহেব প্রস্তাব দিয়েছিলেন যদি ময়নাদ্বীপে মসজিদ স্থাপন করে এবং হিন্দুদের জমি দেয়া বন্ধ করে তাহলে বসবাসকারী সংগ্রহের কিছুই অসুবিধা হবে না। হোসেন সে প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। গ্রহণ না করার পেছনে কারণ হলো, মুসলমানদের জন্য যদি মসজিদ বানিয়ে দেয়, তাহলে হিন্দুদের জন্যও মন্দির বানিয়ে দিতে হবে। আর হিন্দুদের যদি সে না নিয়ে যায়, তাহলে এগারো মাইল দীর্ঘ এই দ্বীপ সে কিভাবে মানুষ দিয়ে পূরণ করবে। তাই হোসেনের যুক্তি হলো, মন্দির-মসজিদ ওসব ফ্যাসাদে গিয়ে কাজ নেই। ওসব ছাড়াই চলবে ময়নাদ্বীপ। ময়নাদ্বীপ আবাদ করে বসবাস স্থাপন করার সঙ্গে মন্দির-মসজিদের কোনো ব্যবহারিক সম্পর্ক নেই। তাই পরম নিশ্চিন্তে সেগুলো বাদ দিতে পারে। ময়নাদ্বীপে সে যে নতুন মানবসমাজ সৃষ্টি করতে চায় তারা সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হবে, হবে নতুন বিশ্বাসে বলীয়ান; নতুন মূল্যচেতনায় সমৃদ্ধ হবে তাদের অন্তর্লোক। অতিকষ্টে যেসব ভাঙাচোরা মানুষকে হোসেন সংগ্রহ করে, পাত্রী ঠিক করে তাদের বিয়ে দেয়, তাদের প্রতিও হোসেনের কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু এই নর-নারীর মিলনে যে নতুন মানুষ-মানুষী আসবে এবং ময়নাদ্বীপে বসবাস করবে, তাদের প্রতি রয়েছে তার প্রকৃত আগ্রহ। যেন হোসেন নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে সম্পূর্ণ মানব-সভ্যতা সৃষ্টি করতে যাচ্ছে একাকী। এই রকম একটি প্রকাণ্ড ঘটনা যার প্রয়াসের মধ্যে থেকে সম্ভাবিত হয়, তাকে বিধাতা-পুরুষের মতো পারঙ্গম, দুর্জ্ঞেয় এবং ইচ্ছাশক্তি-সম্পন্ন হয়ে উঠতে হয়। স্বয়ং বিধাতা-পুরুষও নাকি একজন কবি। এই বিশ্বব্রহ্মান্ড তাঁর কবিতা। মানিকবাবুর হোসেন মিয়াও একজন ক্ষুদে বিধাতা-পুরুষ। সীমিত পরিসরের মধ্যে তার অসাধ্য কোনকিছুই নেই এবং ময়নাদ্বীপ তার একটি কবিতা। একজন ভাবমুক্ত কবি যেমন সমস্ত প্রযত্ন-প্রয়াস বিলিয়ে দিয়ে কবিতাটিকে সার্থক করে তুলতে চান, তেমনি হোসেন মিয়াও স্বপ্নের শেষ বিন্দুটি দিয়ে ময়নাদ্বীপকে লোক-কোলাহলে মুখরিত একটি কাব্যিক ভূখণ্ড হিসেবে নির্মাণ করতে চায়।
যৌনাচারের মতো স্পর্শকাতর বিষয়েও হোসেনের মতামত রীতিমতো কৌতূহলের সঞ্চার করে। বৃদ্ধ বসিরের স্ত্রীর সঙ্গে যুবক এনায়েতের সম্পর্ক নিয়ে ময়নাদ্বীপের ক্ষুদ্র জনসমাজটির জনমত চঞ্চল হয়ে উঠলে লোক দেখানোর জন্য হোসেন এনায়েতকে তিনদিন অভুক্ত বেঁধে রাখার নির্দেশ দেয়। কিন্তু রাত্রে বসিরের স্ত্রীকে যখন এনায়েতকে স্বহস্তে ভাত খাইয়ে দিতে দেখা যায় সে খবর গোপন রাখার জন্য হোসেন অতিশয় সতর্কতা অবলম্বন করে। হোসেনের ওই একই যুক্তি, বৃদ্ধ বসিরের সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা নেই। অথচ তার স্ত্রীর সঙ্গে যুবক এনায়েতের সম্পর্ক নিয়ে দ্বীপবাসীর মধ্যে কথা উঠলে তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য শাস্তির ব্যবস্থাও করে। কিন্তু রাত্রে নিজেই উদ্যোগী হয়ে এনায়েতের সঙ্গে বসিরের স্ত্রীর মিলনের বন্দোবস্ত করে দেয়। তার ফলে একটি নতুন মানুষ জন্ম নিতে পারে। হোসেন মিয়ার চোখে একেকটি নতুন মানুষ হীরা-মুক্তা-মাণিক্যের চাইতেও মূল্যবান। হোসেন মিয়ার চরিত্র বিশ্লেষণ করলে কতিপয় অসাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখে বিস্ময়ে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। যদিও সে গ্রাম্যভাষায় কথা বলে, মুন্সী-মোল্লাদের মতো জামা-কাপড় পড়ে, তথাকথিত সমাজের প্রতিষ্ঠাবানদের এড়িয়ে চলে, তথাপি হোসেন মিয়া বিশ্বাস, হৃদয়বৃত্তিতে এবং কল্পনায় একেবারে খাঁটি আধুনিক মানুষ। যন্ত্রবিজ্ঞানে তার বিলক্ষণ দক্ষতা আছে। বিশ্বপ্রকৃতিও যে নিয়মের নিগড়ে আবদ্ধ, সে নিয়মগুলো আয়ত্ত করতে পারলে প্রাকৃতিক শক্তিকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ থাকে না। প্রকৃতি সম্বন্ধে বিশদ জ্ঞানই হোসেন মিয়াকে অকুল সমুদ্রের বুকে এমন অনুত্তেজিত, সাহসী এবং প্রত্যয়সম্পন্ন করেছে। আসলে জ্ঞানই যে শক্তি তা তার টুকরোটুকরো বাক্যালাপের মধ্যে বিরল হীরের দ্যুতির মতো ঝরে পড়েছে। যে যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রসাদে এবং প্রকৃতি বিষয়ক জ্ঞানের সাহায্যে একসময় ইউরোপীয় ভৌগোলিক অভিযাত্রীর দল আমেরিকা থেকে মেরুপ্রদেশ অবধি অভিসার-যাত্রা করেছিল, হোসেন মিয়া সে কলম্বাস, ক্যাপটেন কুকেরই বঙ্গীয় সংস্করণ। অতি চেনা পোশাকে কোনরকম ভণিতা ছাড়াই দেখা দিয়েছে বলে ঠিক সেরকম মনে হয় না। মানব-সম্পর্কের ক্ষেত্রে হোসেন মিয়া পুরনো চেতনার স্থলে নতুন মূল্যচেতনাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। ধর্ম হোসেন মিয়ার দৃষ্টিতে একেবারে অপ্রয়োজনীয় এবং পুরনো পৃথিবীর স্মারকচিহ্ন। তাই তার নতুন উপনিবেশে নিজের কিংবা অপরের কোনো ধর্মকেই শেকড় প্রসার করতে না দিতে সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ নিয়ে সে বিশেষ বাক্যালাপ করে না। কারণ সমতলভূমির লোকেরা তার এই চূড়ান্ত মতামত সমূহকে কখনো যথার্থ বলে মেনে নেবে না। একটা হৈ-চৈ পড়ে যাবে। তাতে করে তার স্বপ্নের অপমৃত্যুর সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। এত বুদ্ধিমান, এত দক্ষ হোসেন মিয়াও জানে ডাঙার মানুষগুলোর আচার-সংস্কারের বেড়াজালে আটকে পড়লে ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা অল্প। তাই হোসেন মিয়া অজস্র অর্থের মালিক হয়েও কখনো সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জনের পথে পা বাড়ায়নি। ইচ্ছা করলে সে সামাজিক সুনাম-সুখ্যাতি কিনে নিতে পারত। কিন্তু তা করতে যেয়ে হোসেনকে আটকা পড়ে থাকতে হত এবং অচরিতার্থ থেকে যেত কবি হোসেনের একটি নির্জন দ্বীপে একটি নতুন উপনিবেশ, একটি নতুন সভ্যতার একক স্রষ্টা হওয়ার স্বপ্ন।
সামাজিক এবং নরনারীর সম্পর্ক-বিষয়ক যে মতামত হোসেন পোষণ করে তাতে বেঁচে থাকার বাস্তব দাবীর প্রতিই পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ পেয়েছে। ভুল করেও তার মুখ দিয়ে একবার, বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না, কল্পনা দিয়ে ধরা যায় না এমন কোনো ভৌতিক বিষয় উচ্চারিত হয়নি। কি সমাজ-সম্বন্ধের ক্ষেত্রে, কি নরনারীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে হোসেন মিয়ার যে মতামত তা পূর্ণমাত্রায় প্রসারিত করলে সেগুলো যে চেহারা পাবে তা দাঁড়াবে অনেকটা ইউরোপীয় প্রয়োগবাদী দার্শনিকদের মতামতের অনুরূপ।
৩
আসলে হোসেন মিয়ার চরিত্রটিকে লেখক মানিকবাবু মানুষের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার অনেকগুলো পর্যায়েরই ঘনীভূত রূপ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। যন্ত্রবিজ্ঞানে মানুষের দীক্ষা, ভৌগোলিক আবিষ্কারের অভিযাত্রা এবং সামাজিক মানব-সম্বন্ধের ক্ষেত্রে ব্যবহারিক প্রয়োজনের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি এই তিনটি বিষয় অত্যন্ত সন্তর্পণে অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে হোসেন মিয়ার চরিত্রে চাপিয়ে দিয়েছেন। এই তিনটি জিনিসই ইউরোপে ‘এনলাইটেনমেন্ট’ আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি। কোনো বাঙালীর মধ্যে এই তিনটি বিষয় সচরাচর সমান পরিমাণে মিলমিশ খায় না। প্রায় তিন শতাধিক বৎসরের অর্জিত ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ভিন্নতর একটি ভৌগোলিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে প্রাণবান করে তোলা প্রায় অসম্ভব, মানিকবাবু শিল্পে তা সম্ভব করে তুলেছেন। এদিক দিয়ে বিচার করলে হোসেন মিয়াকে বলতে হয় নব্য মেঘনাদ। একটি মাত্র চরিত্রের মধ্য দিয়ে মানবজাতির অগ্রসর অংশের চিন্তা-চেতনা, জীবন-অভিপ্সা দৃশ্যমান করে তোলার জন্য ভূগোল-ইতিহাসের কি পরিমাণ জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল তা অবাক বিস্ময়ে কল্পনা করার বিষয়। যুগ-যুগান্তরের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার প্রতিভূ হিসেবে হোসেনকে উপস্থাপন করেছেন বলেই সমস্ত উপন্যাসে হোসেনের মনোবৃত্তি সমূহের কোনো বিকাশ নেই, রূপান্তর নেই – আগাগোড়া একরকম রক্তমাংসের মানুষ হলেও কোনো মানবিক অনুভূতি তার মধ্যে নেই।
আধুনিক বাংলা উপন্যাসের সমালোচকেরা হোসেন মিয়ার চরিত্রের যে একটা ঐতিহাসিক দূর-বিস্তৃতি রয়েছে, বলতে গেলে তার মর্ম অনুধাবন করতে ব্যর্থই হয়েছেন। কাউকে এ ব্যাপারে কোনো ইঙ্গিত করতে দেখা যায়নি। যতটা চেনা পোশাকে দেখা দিক না কেন হোসেন মিয়া চরিত্রের কোনো বাস্তবতা নেই। এ সম্পূর্ণভাবেই লেখকের মায়াসৃষ্টি। এই হোসেনকে জামাকাপড় পালটে ভিন্নতর পরিবেশে অনায়াসে সায়েন্স ফিকশনের নায়ক করে দেয়া খুবই সহজ। ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসে জীবন্ত নর নারী এবং সজীব প্রাণবান প্রাকৃতিক দৃশ্যের অন্তরালে অবাস্তবতাটুকু ঢাকা পড়েছে। সর্বোপরি মানিক বাবুর অসাধারণ শিল্প-প্রতিভা হোসেন মিয়াকে একান্ত বাস্তবানুগভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।