| 26 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প পুনঃপাঠ সাহিত্য

ও হেনরি পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্প : গাঁওবুড়ো । অমর মিত্র

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট
বিশ্বের দরবারে অনন্য স্বীকৃতি বাংলা ছোটগল্পের। বিশ্বখ্যাত ছোটগল্পকার ও হেনরি-র নামাঙ্কিত পুরস্কার পেলেন সাহিত্যিক অমর মিত্র। বাঙালি কথাসাহিত্যিকের এই আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্তি সামগ্রিক ভাবে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গৌরবজ্জ্বল মুহূর্ত।
 
বাংলা ছোটগল্পের ঐশ্বর্য বিপুল। কথাসাহিত্যের সেরা শিল্পীরা এই ভাষাতেই তাঁদের শিল্প রচনা করেছেন বললে অত্যুক্তি করা হয় না। তবে আঞ্চলিকতার ঘেরাটোপে হয়তো ব্রাত্যই থেকে গিয়েছে সেই বিস্ময়-সম্ভার। সেভাবে তার উপর পড়েনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আলো। বাঙালি পাঠক আর ভিন্ন ভাষার কতিপয় সাহিত্য অনুরাগীর আদর ছাড়া বাংলা ছোটগল্পের তেমন কদর মেলেনি বিশ্ব সাহিত্যের আঙিনায়। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও, মোটের উপর এটাই ছিল বাস্তবতা। এতদিনে যেন সেই আক্ষেপ পূরণ হল বাঙালি সাহিত্যপ্রেমীর। ও হেনরির নামাঙ্কিত শতাব্দীপ্রাচীন পুরস্কার এল বাংলা সাহিত্যের ঝুলিতে। আনলেন অমর মিত্র, তাঁর ‘গাঁওবুড়ো’ গল্পের দৌলতে।
 
সেই ১৯৭৭ সালে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘অমৃত’ পত্রিকায় গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এক বুড়োর যাত্রাপথের গল্প এটি। কুসুমপুর থেকে কন্যাডিহি চলেছেন তিনি জনৈক বড়বাবুর সন্ধানে। যে বড়বাবু তাঁর যাবতীয় দুঃখ যন্ত্রণা মিটিয়ে দেবেন, এমনটাই বিশ্বাস গাঁওবুড়োর। পথ অতিক্রম করতে আরও কত মানুষের কত কিসিমের দুঃখের সঙ্গে, যাপনের যন্ত্রণার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হতে থাকে। গাঁওবুড়ো এগিয়ে চলেন প্রার্থিত উপশমের সন্ধানে। সেই বড়বাবুর সঙ্গে আদৌ কি তাঁর দেখা হবে? এই প্রশ্নের উত্তরেই গল্প পৌঁছায় তার চূড়ান্ত পরিণতিতে। আসলে অকীর্তিত মানুষের জীবনের চাওয়া-পাওয়া কিংবা না-পাওয়ার যে যাত্রাপথ, আর তার যে অন্তিম বিন্দু, সেখানেই পাঠককে নিয়ে যান লেখক। সেই বিন্দুতে জেগে থাকা আবেদন পাঠককে শুধু মুগ্ধই করে না, জীবন এবং জীবনের মর্মের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। বাংলা ছোটগল্পের ভাণ্ডারে ইতিমধ্যেই এই গল্পটিকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প হিসাবে বিবেচনা করা হয়। অনীশ গুপ্তের ইংরেজি অনুবাদে সেই গল্পই হয়ে ওঠে ‘দ্য ওল্ড ম্যান অফ কুসুমপুর’। যা পেল ও হেনরি নামঙ্কিত পুরস্কার। শতাব্দীপ্রাচীন এই পুরস্কার পেয়েছেন বিশ্বের তাবড় লেখকরা। তাঁদের মধ্যে আছেন উইলিয়াম ফকনার, স্টিফেন কিং, সল বেলোর মতো কিংবদন্তিরা। সেই তালিকায় সংযোজিত হল বাঙালি সাহিত্যিক অমর মিত্রের নাম।
 
শারদীয়া সংখ্যায় ছাপা হয়নি এ-গল্প, প্রকাশিত হয়েছিল পরবর্তী সাধারণ সংখ্যায়। সম্পাদক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় সেদিন তরুণ লেখককে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। 
 

এই পুরস্কারে বাঙালি পাঠক যে আজ খুশি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সামগ্রিক ভাবে বাংলা সাহিত্যের জন্যই এই মুহূর্ত আনন্দ এবং গর্বের।ইরাবতী পরিবারের স্বজন অমর মিত্রের এই অর্জনে ইরাবতী পরিবার গর্বিত। পাঠকের জন্য রইলো সেই গল্পটি।


কুসুমপুরের বুড়ো ফকিরচাঁদ যাবে বড়বাবুর কাছে। পিঠের লাঠিতে ঝুলিয়ে নিয়েছে ছোট্ট পুঁটুলি। সামান্য ঝুঁকে হাঁটে বুড়ো। আলো ফোটার সময় এখন, পৃথিবী কোমল শীতল, এই চৈত্রের ভোরবেলায়। বাতাস আর মাটি আশ্চর্য সুখের। একা মানুষ ফকিরচাঁদ যাবে বড়বাবুর কাছে।মোরগগুলোর গাঁক গাঁক চিৎকার এখনো থামেনি। পিলপিলে বাচ্চাগুলো বেরিয়ে পড়েছে ঘর ছেড়ে। এক পা এক পা এগিয়ে বুড়ো দু হাত জোড় করে নতুন সূর্যকে প্রণাম জানায়। নাহ, চোখটা এখন বেশ লাগছে, শরীরও। হাল্কা হাওয়ায় বুড়োর ঝাপসা চোখে কোমল হাতের স্পর্শ।
তার বয়স তিন কুড়ি দশা পেরুলো নিশ্চিত। কী যে হল এই বয়সেই চোখে ঝাপসা দেখে পৃথিবীটাকে। হাত পা থরথর করে কাঁপে। গায়ের চামড়া শিথিল কুঞ্চিত, চোখ মুখে অসংখ্য ভাঁজ। এ হেন বুড়োর হঠাৎ এই বয়সে ইচ্ছে হয়েছে দশ মাইল দূরে দুর্গাহুড়ি জঙ্গল পেরিয়ে পশ্চিমে সুবর্ণরেখার তীরে কন্যাডিহা গ্রামে বড়বাবুর কাছে গিয়ে সমস্ত দুঃখ দূর করে আসে। মন বড় অস্থির হয়েছে। অদেখা সেই বড় মানুষের কাছে সে যাবেই। তার দুঃখ কষ্ট কি একটা?
যেমন এই চোখ। সেই মানুষ নিশ্চিত সন্ধান দিয়ে দেবেন এমন এক বদ্যির যার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই তার চোখটা ভালো হয়ে যাবে। ছানি কাটলে আবার ছানি পড়ে। পৃথিবীটাকে কতদিন যে বুক ভরে দেখেনি। আর সেই বড় মানুষের কাছেই কত রকম ওষুধ না আছে, বনের শিকড় বাকড়।
যেমন তার একমাত্র পুত্র। গাঁয়ের একটা মেয়ে নিয়ে সে পালিয়েছে চাকুলিয়া। সেখানে কী যেন এক চাকরি জুটিয়েছে। অথচ এই বয়সে পুত্রসন্তানটি কাছে না থাকলে হয় না। বৃদ্ধ বয়সের সুখের জন্যই না পুত্রের জন্মদান। এই পুত্রটিকে ঘরে ফিরিয়ে আনার এমন অব্যর্থ পরিকল্পনার সন্ধান তিনি দিয়ে দেবেন যে ভালোবাসার মেয়েটিকে ছেড়ে সে সুড়সুড় করে ঘরে এসে ঢুকবে।
যেমন তার জমিজমা। একা মানুষ ফকিরচাঁদ। বৌ মরেছে। এখন জমিজমা রক্ষা এই নষ্ট দেহে দায় হয়। ইচ্ছে মত শরিকে ধান কেটে নিয়ে যায়। সেই ফসল বাঁচাবার জন্য বড়বাবুর উপদেশই যথেষ্ট হবে।
আর বৌ মরার পরও এই সত্তর বছরে দেহের রক্ত শীতল হয়নি। যদি একটা গরীবের মেয়ের সন্ধান তিনি দিয়ে দেন। বুড়োর চোখ চক চক করে ওঠে। ঠোঁটের কোণে লালা এসে যায়। সোমত্ত মেয়ে দেখলে এখনো শরীর কেমন করে ওঠে না!
সুতরাং বুড়ো যাবে বড়বাবুর কাছে। তিনি থাকেন কন্যাডিহাতে। সব কথা তাকে খুলে বলবে সে। কাল রাতে ফকিরচাঁদ নিজের মরণের স্বপ্ন দেখেছে। গাঁয়ের মানুষ সব তৈরি হয়ে আছে তার মরার জন্য। মরলেই বেওয়ারিশ জমিজমা সব লুটপুটে খাবে। না তা হবার নয়।
অনেকদিন, বহু বছর ধরে সে শুনেছে বড়বাবুর কথা। একটা সময় তার কত কথাই না কানে আসতো। এ তল্লাটের মাথা নাকি তিনি। তাঁর কথাতেই সব বদলে যেত। ফকিরচাঁদ এই গাঁয়ে এসেছে বছর পনেরো। তার আগে ঘর ছিল সেই পরিহাটি পেরিয়ে। এখানে এসেই তার ঘর হল, অল্পস্বল্প জমিজমা। তখন শুনতো বড়বাবুর কথা। যায়নি কোনোদিন, এবার যাবে। আগে বিশ্বাস হত না, এখন মন উচন পাটন করে।
এই বয়সে মনের ভিতরে যে কী হয়। বউ মরে স্বর্গে গেল। ছেলে নিজের মাগ জুটিয়ে পালালো। সে একা এই পুরী পাহারা দিতে থেকে যায়। একটু আধটু জমিজমা ঘর দুয়ার নিয়ে বুড়ো ফকিরচাঁদ যক্ষের মত বসে থাকে। গাঁয়ের দশটা মানুষ তার মরণ চায়। নাহ, মরণ অত সহজ নয়, বুড়ো হাঁটতে হাঁটতে ভাবে। চোখটা যদি ভালো হয়ে যায় তবে আরেকবার উষ্ণ রক্তের অনুভূতিতে পৃথিবীটাকে দেখে নেবে।
কুসুমপুরের ঝোপঝাড় জলশূন্য ডোবা, পুকুর পেরিয়ে দমকা একটা মাঠের মধ্যে এসে পড়ে। এই মাঠ, কুসুমপুরের বিশাল ডাহি, সামান্য চড়াই উৎরাই, পাথুরে গেরুয়া ভূমি, মাথার উপর বিস্তীর্ণ আকাশ, দিগন্তে বিলীন এই বিশাল পৃথিবীতে আলো গাঢ় হয়ে আসছে। গাঢ় আলোর ভিতর কৃষ্ণবর্ণের মানুষ একা হাঁটছে; এখন এই রকম দৃশ্য। যেতে হবে বহুদূর। মাঠ পার হয়ে গাঁ পেরিয়ে জঙ্গল, সেই জঙ্গল পেরিয়ে আবার মাঠ জঙ্গল গ্রাম ডাহি এই রকমই তো পথ। কত বছর আগে এই গাঁয়ে এসেছিল বুড়ো তা আর স্মরণে থাকে না। সেই যে বার যুদ্ধের উড়োকল ভেঙে পড়েছিল নিশ্চিন্তার ওপারে তারও অনেক আগে। যুদ্ধের উড়াকল। হ্যাঁ। ঘড়ঘড় শব্দে সে আকাশে চোখ মেলে। মাথায় পাখা ঘুরিয়ে হেলিকপ্টার যাচ্ছে কলাইকুন্ডার দিকে।
হাঁটতে হাঁটতে রোদদুর হয়ে গেল পিতল রঙা। লাল টকটকে সূর্য কখন রঙ বদলেছে। সে মাঠ পার হয় ঠান্ডায় ঠান্ডায়। আকাশটা আরো দূরে সরে যায়। এবার হাল্কা ঝাঁটি জঙ্গলের ভিতর সরু পায়ে চলার রাস্তা। এই রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলটা ফর্সা হয়ে গেলে সে থমকে দেখে সামনে এক খাল। এখনো জল এক কোমর হবে। অন্য সময় দেড় মানুষ তো থাকে বটেই। এই চৈত্রে জল কমেছে, বৈশাখে তলানি পড়ে আসবে। এর উপরে একটা সাঁকো থাকতো না? সেটা উধাও। বুড়ো হালুক- চালুক চারদিকে দেখে। কোথাও নেই, কোথাও নেই। তবে কি তার ভুল হল? উহুঁ ভুল হবার কথা নয়। হুই তো সেই বটবৃক্ষ! বুড়ো তার ঝাপসা চোখ মেলে দেয়। বাবুর বনি খালের এই পারাপারের জায়গা তো সেই বট। সেই কালপুরুষের বট। সেটা আছে, সাঁকোটা নেই। চিহ্ন মাত্র নেই এখানে। বুড়ো নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে স্রোত আছে বেশ। এই মরা ডাহি এলাকায় একমাত্র জলের উৎস। ওই ওপারে উদ্ধতের মত দাঁড়িয়ে আছে ঝাঁকড়া বট। অথচ সাঁকোটা উধাও। সে বিপন্ন বোধ করে।
খালের নিচে কাদা আছে। জল আছে আর স্রোতও। এক বর্ষায় বুড়ো নাকফুড়ি মাছ ধরতে গিয়ে ভেসে গিয়ে মরে আটকে ছিল মাইল পাঁচ দূরে কদমডিহাতে। বুড়ো বিব্রত বোধ করে। পার না হলে চলবে কী করে? ডানে বামে তাকায়। এই টলমলে দেহ নিয়ে, এইরকম ঝাপসা চোখ নিয়ে সে জলে নামতে পারবে না। নাকফুড়ির কথা মনে পড়ছে।
বিপদের ভিতরে পড়ে বুড়ো ফকিরচাঁদ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। চারপাশে রোদ খেলতে থাকে। আকাশ হামলে সূর্য উঠেছে অনেকটা। চারপাশ জনশূন্য।
ঠিক এমন সময় দূরে কোথায় বাঁশির শব্দ শোনা যায়। সুর গাঢ় হয়ে ভাসে। সে উৎকর্ণ হয়ে ওঠে। ধুলোবালিতে ঢাকা চোখে এদিক সেদিক দেখে। কোথায়? বাঁশি বাজিয়ে একটা কালো মানুষ ধূমকেতুর মত সামনে এসে দাঁড়ায়। ফকিরচাঁদ মানুষ পায়।
যাবু কাই, ও গাঁওবুড়া? সে বাঁশি থামিয়েছে।
বড়বাবুর নিকট যাবা। ফকিরচাঁদ এগিয়ে এসেছে।
বড়বাবু! সি আবার কোন মানুষ হাঁ! কালো মানুষ বিস্মিত হয়েছে।
বড়বাবু কথা শোনেনি? বুড়ো খিকখিক করে হেসে ফেলে। কী বলবে সে বড়বাবুর সম্বন্ধে, এই পৃথিবী সম্বন্ধে কি সব কথা বলা যায়? তাই বুড়ো হঠাৎ সুর করে বলে ওঠে,
পুষ্প ফুটিলে কে গন্ধ ছড়ায়
মেঘে ভর করি কে বরষে জল?
পুষ্প ফুটিলে সে গন্ধ ছড়ায়
মেঘে ভর করি সে বরষে জল।
কালো মানুষের দু চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। বড়বাবুর কথা বুড়ো অনেক বলে যায়। অনেক।
তু সাচ বুলছিস বুড়া?
হাঁ। ঝুট বুলি না হামি, হামার দুঃখ জানিসনি তু, জুয়ান বেটা ঘর ছাড়ি পলাইছে, বউটি মরি যাইছে,
ঘরে হামার মানুষ নাই, আঁখিতে দেখিনা হামি, সব বড়বাবু ভালো করি দিবে।
বাব্বা, দেওতার মতন! নবীন মেঘের মত শরীরে বিস্ময় উথলে পড়ে।
হাঁ।
তা তু যা। কালো মানুষ ফিরে যেতে চায়। সঙ্গে সঙ্গে বুড়ো তার হাত ধরে ফেলে, পার হবা কী করি?
মু জানি কি? সে হাত ছাড়াতে চায়।
তু পার করি দে। বুড়ো টলমলে কন্ঠে বলে।
তা তু দিবি কী ?
হাঁ, বুড়ো তাকে সব দেবে। বড়বাবুর কাছে গিয়ে বলবে তার কথা, তুর দুঃখ নাই?
হাঁ।
সোউ দুঃখ দূর করি দিবো বড়বাবুরে কহি।।
সাচ ?
হাঁ রে হাঁ, বড়বাবুর নামে ঝুটা কহি না।
ঝপ করে বুড়োর হাল্কা দেহটা কাঁধে তুলে সেই মানুষ খালে নামে। জল ঠেলতে ঠেলতে দুঃখের কথা বলে, বুড়া তুকে পার করি দিলাম, বড়বাবুকে কহিবি কিন্তু। এই ছোট সোনা মান্ডির বুকের ভিতরটা যেন চৈত্র দিনের
মাঠ। ভালোবাসে বঙ্কিম হাঁসদার মেয়েটিকে। সে মেয়েও ভালোবাসে এই মানুষকে, কিন্তু তাতে হবে কী ? মেয়ের বাপ বিয়ে দেবে না ওর সঙ্গে, কুছুতেই না।
বিয়ের কথা শুনেই বুড়োর দেহ ছমছমিয়ে ওঠে, আহা বেহাতে যে কী সুখ। বেহা দিবেনি কেনে?
মোর ঘর নাই জমিন নাই।
অহ শালা হা-ঘরে। বুড়ো খুক খুক করে খুব হাসে।ততক্ষণে পৌঁছে গেছে ওপারে।
তু শুন ব গা বুঁড়া, হামি উহারে ভালোবাসি ঠিক, তু বড় বাবুরে কহিবি।
গাঁওবুড়া তুই বলবি এই নবীন মেঘের মত যুবক ভালোবাসে যে নারীকে তার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া। গাঁয়ের নাম আসনবনি। বড়বাবু যদি ওদের মিলিয়ে দেন। সে এখন যেতে পারবে না, যাবে কলাইকুন্ডার দিকে। দিন মজুরির কাজ আছে সেখানে। কাল বিকেলে এখানেই অপেক্ষা করবে সে। বুড়োকে পার করে দেবে আর তার সুখের খবর শুনবে নিশ্চিত।
উজ্জ্বল রোদে ভেসে সে বাঁশি বাজিয়ে দেয়। হাওয়ায় উড়তে উড়তে কোথায় চলে যায় সেই বাঁশির শব্দ। বুড়োকে পার করে দিয়ে খাল পেরিয়ে সে আবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ফকিরচাঁদ উদাসীন পথ চলে। রোদ ক্রমশ কঠিন হয়ে আসছে। আহা বড় দুঃখ তোর, ভালোবাসার মেয়ে মানুষের সঙ্গে বেহা না হলে বেদনা হয়, বড়বাবুকে সব কহিবো হামি ।
গাঁওবুড়ো পথ হাঁটে। রুক্ষ মাটির গেরুয়া পথ। একপাশে জঙ্গল অন্যপাশে ঢালু মাঠ। গহীন বন, গাছগাছালিতে ঢাকা টিলা। চৈত্র শেষের দিন। টলমলে বাতাসে ভেসে আসে আলুথালু ফুলের গন্ধ। শাল ফুল মহুয়া ফুল।
সেই বিশ তিরিশ বছর আগের শরীর ছিল মোষের মত। সব শেষ হয়ে গিয়েও জেরটা রয়ে গেছে। নাহলে তপ্ত দিনে এতটা পথ হাঁটা এই শিথিল দেহে সম্ভব হয় কী করে? টালমাটাল দেহ ঝাপসা চোখ নিয়ে সে দুলে দুলে হাঁটতে থাকে।
এখন রোদ্দুর রূপা বর্ণের হয়েছে। ঠিকরে যাচ্ছে দেহের উপর পড়ে। বাতাসে অগ্নিময়তা। এমন টিটিয়া রোদে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় ফকিরচাঁদের গলা শুকিয়ে যায়। কাঠ কাঠ হয়ে যাচ্ছে সমস্ত মুখ। জিভে কেমন তেতো স্বাদ। দেহটা শুকিয়ে পোড়া কাঠ হয়ে গেছে। বুড়ো ঝাপসা চোখে সব এলোমেলো দেখে। এ পাশে জঙ্গল ওপাশে রুক্ষ চড়াই উৎরাই। সে বিপন্ন বোধ করে। বড়বাবুর কাছে যাবে। সে তো অনেক দূর। তার চলন শ্লথ হয়ে আসে। জিভ বার করে হাঁপাতে হাঁপাতে সে চলতে থাকে। তারপর এক সময় কোথা থেকে গান ভেসে আসে। ভরা রৌদ্রে গান গায় কারা? মানুষ কোন দিকে? গাঁওবুড়ো শব্দ লক্ষ্য করে হাঁটতে থাকে। ক্রমে গানের ডাক স্পষ্ট হয়ে আসে। ঘুরে হাল্কা জঙ্গল ছাড়িয়ে টুকরো মাঠ। সেখানে মেয়ে পুরুষ জুটেছে অনেক। তারস্বরে গান শুরু করেছে সাঁওতাল মেয়ে পুরুষ। বুড়ো গুটি সুটি সেখানে গিয়ে হাজির হয়। মাথা ঝিমঝিম করছে, চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে।
কি হয়টে ইখানে? ফকিরচাঁদ হাসফাঁস করে।
নেশাতুর এখানে সবাই। বুড়োকে দেখে তারা মজা পেয়ে যায়। বাহারে-
কোন গাঁ থেকে বেরুলো ইটা?
দিবো নাকি চাউলের পিঠা!
হা হা হা। রোদ্দুরে যে চাঁদি ফেটে যায় বুড়োর। সে বসে পড়েছে ছোট নিমগাছটির ছায়ায়।
শালুই পূজা হয়টে কত্তা। একজন বলল।
পানি দাও গো মরে যাই।
পানি দে পানি দে বলে চিৎকার করে ওঠে দু একজন। ঝকঝকে পাত্রে জল আসে। আহ্ বুড়ো মাথার চাঁদিতে জল দেয়। গলায় জল ঢেলে সে ধাতস্থ হয়। দৃষ্টি ফিরে আসছে আবার। নিমের ছায়ায় সে বুক ভরে শ্বাস নেয়।
তা তুদের পূজা ইখানে কেনে?
কেনে? জাহেরা থান, সালুই পূজা, জঙ্গলে যাবো। মানুষটার কথা জড়িয়ে গিয়ে অসংলগ্ন। ওপাশে আবার গান শুরু করে দিয়েছে মেয়েরা। সে ঝাপসা চোখ টান টান করে। কে একজন ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয় ওদের, ভিনদিশি মানুষ কথা কয়, ইখন গান লয়।
মুরুব্বি সাঁওতাল টলে টলে জিজ্ঞাসা করে, হাঁ গা বুড়ো যাবু কাঁই?
কনিয়া ডিহি।
ঘর কাঁই হঁইছে?
কুসুমপুর।
কুসুমপুর! হোয় বাব্বা! যাবু কানিয়াডিহি, কদ্দুরে বটে? তা যাবু কেনে?
বুড়ো এখন স্থির হয়েছে। সবার মুখের দিকে তাকায়। চোখ লাল করে সব টলছে।
মু যাবা বড়বাবুর নিকট।
সি আবার কোন মানুষ, ফরিস্টার?
ধুস! বড়বাবুর কথা জানোনি?…। বুড়ো অবাক হয়। পুষ্প ফুটিলে কে গন্ধ ছড়ায়…। বুড়ো বড়বাবুর কথা বলে। বড়বাবুর মহিমার কথা।
হামাদের বড়বাবু লাগবেনি, হামরা ভালো আছি।
হোয় চুপ যা, কে একজন ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়, বুড়ো হামাদের দুঃখ আছে অনেক, হুই আকাশের সমান দুক্কু।
ফকিরচাঁদ চোখ পিটপিট করে যুবতিদের দেখতে থাকে লুকিয়ে চুরিয়ে। আর অন্যমনা হয়ে বলে, ‘ কহি ফ্যাল তুদের দুঃখ, সব দূর হুই যাবু।’
তা কহিবো, তু হাঁড়িয়া খাবু? খপ করে একজন বুড়োর হাত ধরে ফেলে।
না হে বড়বাবুর নিকট যাবু যে!
আহা তাহলি হামাদের দুকখুর কথা শুন।
আমাদের বড় দুঃখ বুড়ো। শালুই পূজায় ধুমধাম করতে পারিনে। শাল গাছই জোটে না, ফরেস্টার চালান করে দেবে খড়্গপুরে। আমাদের এই দুঃখ। আমাদের কষ্ট হয় যে পূজায় বরাহ বলি দিতে পারিনে, কত দুক্কু! হামার মেয়ে ভিন দিশি হা ঘরের সঙ্গে পালিয়ে যাবে বোধহয়…। বড় দুঃখ শাল গাছ পাইনে, কাঠ কাটতে পাইনে, শালপাতা পাইনে, শিকার জোটে না, সব চালান করে দেবে খড়্গপুরে। বরাহ জোটে না। মারাংবুড়ু সন্তুষ্ট হয় না বুড়ো… নেশা করলে পুলিশে এসে ধরে। সব চালান দিবে ঝাড়গ্রামে।
লোকটা দু হাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে কাঁদতে থাকে। পাশের মানুষগুলোও কাঁদতে থাকে।
বুড়ো তু হলি গিয়া বড়াম ঠাকুর, মুদের দুঃখু শুনতা এয়েছিস, তুই হাঁড়িয়া খা, না খাবি তো ভাত খা। ভাত না খাবি তো পানি খা।
বুড়োকে জোর করে ভাত খাইয়ে দেয় ওরা। মুখে রোচে না, গা গুলোয়। তবুও পেট বাঁচে। এক সময় উঠতে হয়। সাঁওতাল দেহুরি পিছনে পিছনে আসে, বুড়ো তু বলিস সি বড়মানুষরে, বলিস যাতে বেদনাটা দূর হয়, তুরে কত ভালোবাসলাম হাঁ।
ফকিরচাঁদ নরম হয়ে যায়, ‘ কাল ইখানে থাকিস, ফিরার পথে তুদের সব বলে যাবো। ‘
গাঁওবুড়ো পথ হাঁটে। কয়েক পা চলেই ফিক করে হেসে ফেলে তারপর উদাসীন হয়ে যায়। কত কষ্ট মানুষের। বড়বাবুকে সব বলতে হবে। এমনি হাঁটতে হাঁটতে সুয্যি মাথায় উঠে হেলে যায়। আকাশে গুম গুম শব্দ হয়। মেঘের! না মেঘ নয়, কলাইকুন্ডার বোমের শব্দ। মহড়া চলছে।
দুর্গাহুড়ি জঙ্গল পড়ে যায়। বেলা নেমে আসছে। এই বন পার হয়ে দুখানা গাঁ, মাঠ, তা পেরিয়ে সুবর্ণরেখা নদী। সে নদীর তীরেই কন্যাডিহা। সেই নদীর কাছাকাছি ই বড়বাবু থাকেন। দীর্ঘ উন্নত দেহ। টকটকে রঙ। মাথার চুল এতদিনে সাদা হয়ে গেছে নিশ্চিত। বড়বাবুকে দেখেনি ফকিরচাঁদ।, শুনেছে সে তাঁর কথা। চোখে দেখেনি শুধু কানে শুনেছে।
বড়বাবুকে ছোট সোনা মান্ডির কথা বলতে হবে। বলতে হবে ওই গাঁয়ের সাঁওতালদের কথা। নিজের কথাও বলতে হবে। নাহ্, যখের মত পাহারা দিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। হয় একটা বৌ চাই নতুবা ছেলেটা ঘরে ফিরে আসুক। গাঁও বুড়ো থিরথিরিয়ে পথ হাঁটে। আর এই রকম হাঁটতে হাঁটতে কখন যে মাথার গনগনে আকাশটা হারিয়ে গেছে গাছগাছালির আড়ালে তা বুড়ো জানে না। এখন জঙ্গলের গভীরে সে। রৌদ্র কোথাও কোথাও ঠিকরে পড়েছে দু- এক টুকরো নতুবা সব ছায়াঘন। জঙ্গল আগে ছিল ভয়ের, এখন ভয় কম। তবুও কত বিস্ময়
না জমা হয়ে আছে। জানোয়ারের পিঠে চেপে এই জঙ্গলেই না ঘুরে বেড়ান বড়াম ঠাকুর। ওই শাল গাছের গোড়ায় স্তুপাকার মাটির হাতি ঘোড়ায় তাঁর থান হয়ত। কোথায় যেন আছে রাক্ষসী রক্মিনী দেবীর থান। বুড়ো নিঝুম পথ হাঁটতে থাকে। তারপর হঠাৎ এক সময় বিপন্ন হয়ে পড়ে। তিনদিকে তিনটি রাস্তা গেছে। কোনদিকে যাবে সে? ঝাপসা চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে তারপর হঠাৎ দেখে দূরে শালগাছের গোড়ায় কি নড়েচড়ে, মানুষ নাকি!
সে কাঁপা কাঁপা গলায় হাঁক দেয়, কোন মানুষ গো এইদিক আস।
সেই মানুষ হাতছানি দিয়ে ডাকে। বুড়োর ঝাপসা চোখ স্পষ্ট দেখে। বুকের ভিতরটা ধকধক করে ওঠে। জঙ্গলে কত না ভয়! অপদেবতা নাকি। নড়েচড়ে মানুষের মত। যাই হোক না কেন এখন দিকহারা বুড়োকে ওখানেই যেতে হবে। সে এগিয়ে যায়।
ঝাপসা চোখে সব স্পষ্ট দেখে। গা শিউরে ওঠে তার। এ কে ! মানুষই বটে। ফিসফিসিয়ে কথা বলে। মহারোগে দেহটা বীভৎস। টসটসে লাল মুখটা। সে নেতিয়ে জঙ্গলে পড়ে আছে।
কোন গাঁর গো তুই? বুড়ো পয়সা ছুঁড়ে দেয় গাঁট থেকে। মানুষটা ছুঁয়েও দেখে না, সমাজে নাই পয়সা দিয়া কি হবু ?
ফকিরচাঁদ স্তব্ধ হয়ে যায়। কী বলে মানুষটা ? মরণ ধরিছে মুরে, হাঁ গা- বুড়া, যামু কাই? কুন গাঁ?
কানিয়াডিহি, বড়বাবুর কাছে।
লোকটা নির্বিকার বসে রইল।
‘বড় রোগ, কতদিনের তোর?’
পাঁচ সাল হবু ই জষ্টিতে।
বুড়ো সামনে দাঁড়াতেও ভয় পায়। ওই মুখ দেখা যায় না।
কানিয়াডিহি কুন পথে? বুড়ো জবাব পায় না।
তু বুড়ো বাবুর নিকটে গেলে দাওয়াই বাতলে দিত।বুড়ো আবার বলে।
সি আবার কে? গমগম করে ওঠে কুষ্ঠ রোগীর কণ্ঠস্বর জঙ্গলের নিঝুমতায়।
বুড়োর দেহে শীত ঘনায়। সে কাঁপা গলায় কন্যাডিহার বড় মানুষের কথা বলে। কুষ্ঠ রোগীর চোখ স্ফীত হয়ে ওঠে, সে হাত বাড়িয়ে বুড়োকে ধরতে যায় আর কি। বুড়ো সরে যায়।
মু পথ বাতলে দিচ্ছি। তু তোর বড়বাবুকে মুর কথা কহিবি, যদি রোগটা সারে, লোকালয়ে ঘুরতি চাই রে বুড়া।লোকটার স্বর ভারি হয়ে ওঠে।
শেষে মানুষটা পথ দেখিয়ে দেয়।বুড়ো কথা দেয় ওষুধ নিয়ে ফিরবে। বড় মানুষ যদি একবার ছুঁয়ে দেন তো রোগ সেরে যাবে, লোকটাকে বলতে থাকে বুড়ো।
এখন ফকিরচাঁদ জোরে হাঁটে। বুকটা ভার হয়ে আছে। এমন দেহ, বড় রোগে সব গেল। এমন নবীন বয়স। বলবে সে, বড়বাবুকে সবার কথা বলবে।এইসব মানুষ না থাকলে বড়বাবুর কাছে পৌঁছতো কী করে? সকলের কথাই বলবে। সেই মানুষের ইচ্ছায় সকলের দুঃখের শেষ হবে। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে নদীর দিকে। বুড়ো উদাসীন পথ হাঁটে। ওই তো বোধহয় কন্যাডিহা, ওই দেখা যায় সুবর্ণরেখা। ধবধবে সাদা বালুচর। ওখানেই সেই বড় মানুষের ঘর। বুড়ো জোরে হাঁটে। মানুষের কত দুঃখ। কত বেদনা। সকলের কষ্ট যদি চলে যেত তবেই না! ভাবতে ভাবতে বুড়ো চিকন হাসে। কষ্ট না হলে সুখটা বুঝবে কী করে মানুষ? সেই আশায় তো এতটা পথ ছুটে আসা।
বিকেলের পৃথিবীটা বিষণ্ণ হয়ে এল। তার বুকটা হাসফাঁস করছে উত্তেজনায়। শীর্ণ দেহ শিথিল কুঞ্চিত চর্ম ঝাপসা চোখ লগবগে শরীর নিয়ে তার ধকল গেছে বেশ। জিভ বেরিয়ে আসার জোগাড়। শরীরটা নুইয়ে যাচ্ছে বার বার। এখন যদি কোথাও আরামের বিশ্রাম পেত সে। আর সেই ঘরে যদি তার মরা বউটি বেঁচে থাকতো, ছেলেটি ঘর ছেড়ে না পালাতো, তাহলে এতটা কষ্ট হত না। আরামে শিথিল শরীর এলিয়ে সে ঝাপসা চোখে পৃথিবীটাকে দেখত। ছানি কাটিয়ে আনতো, আবার ছানি পড়তো। তারপর একদিন ছেলের হাত ধরে চলে আসত এখানে। ছেলে তাকে কাঁধে চড়িয়ে নিয়ে আসত, ডুলি করে নিয়ে আসত। কন্যাডিহার বড়মানুষ তার চোখ ভালো করে দিত। আবার ফর্সা করে দিত পৃথিবীটাকে। তা হবার নয়, তাই তো জীবন হাতে করে এই চৈত্রের দিন ভেঙে অদেখা বিশাল পুরুষের কাছে জীবন সায়াহ্নে এসে পৌঁছন।
ধকপকান বুক নিয়ে সে হাঁটতে থাকে। ছায়া হয়ে উঠেছে দীর্ঘ। সূর্য নেমে যায়। ফকিরচাঁদ বিষণ্ণ বোধ করে। দিন শেষেই চাঁদের হাট সংসারের কথা মনে পড়ে। গাঁওবুড়া এসে পৌঁছল সুবর্ণরেখার পাড়ে। এরই নাম কি কন্যাডিহা। চারদিক থেকে বিষণ্ণ বাতাস এসে ঘিরে ধরে তাকে। হা হা বাতাস বয়ে যায়। এই গাঁয়েই বড়বাবু থাকেন।
নদী খেয়ে ফেলেছে গাঁয়ের সবটাই। এখানে সেখানে ইতস্তত বাস্তুভিটের চিহ্ন ছড়িয়ে। পাল-কুল, বাবলা আর কত রকম গাছগাছালির ঝোপে অন্ধকার।আর আশ্চর্য কোথাও একটা মানুষও নেই। বুড়োর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। দৃষ্টি অস্বচ্ছ। অস্বচ্ছ চোখেই সে মানুষ খোঁজে। মানুষ তো কেউ না কেউ থাকবে।বড়বাবুর গাঁ তো এটাই হবে এর পরে নদী নিয়েছে বিপজ্জনক বাঁক, আর গ্রাম কোথায়?
শরীর নিঃঝুম হয়ে আসছে। এটা হয়ত কন্যাডিহা নয়। পথ ভুল হল। আশপাশে কোথাও আছে। অন্য কোথাও। অন্য কোনোখানে। ক্রমে অন্ধকার বিস্তৃত হয়। বুড়োর কাছে নদী পেরিয়ে বাতাস আসে। অন্ধকার গাঢ় হয়। বিপন্ন গাঁওবুড়ো এদিক সেদিক মানুষ খোঁজে। তারপর হঠাৎ এক সময় পায়ের কাছে ধূমায়িত লণ্ঠন ঝুলিয়ে একটি মানুষ ফকিরচাঁদকে পার হতে যায়। গাঁও বুড়ো হাসফাঁসিয়ে চিৎকার করে ওঠে, কে যায় গা মানুষ, রসো। সেই মানুষ থেমে যায়।
বড়বাবুর ঘর কোন গাঁয়ে?
বড়বাবু! বিস্ময়ে অন্ধকারে সে চেয়ে থাকে বুড়োর দিকে।
গাঁওবুড়ো কাঁপা গলায় বড়বাবুর মহিমার কথা বলে। তিনি পরিশ্রান্ত মানুষকে বিশ্রাম দেন। অফুরন্ত জীবনের কথা বলেন। অবলীলায় কত দুরূহ সমস্যার সমাধান করে ফেলেন। তিনি বড় মানুষ। বিশাল এক পুরুষ। রোগ শোক তাপে তাঁর কাছেই আশ্রয়।
মানুষটি খুনখুনে গলায় হেসে ওঠে, ‘ হা হা তুমু স্বপ্ন দিখো গাঁওবুড়ো, এমন মানুষ কই? কোথাও নেই। এমন মানুষ আজকাল আর থাকে না, থাকে না। লোকটা মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে পা বাড়ায়। ফকিরচাঁদ আবার একা হয়ে যায়।
তখন অন্ধকারের পৃথিবীতে চাঁদ ভেসেছে গেরুয়া বর্ণের ডিম্বাকার। তার সামনে অন্তহীন চরাচরে কেউ নেই। সেই বিশাল পুরুষও নয়। একমাত্র আছে বিশাল বালুচর নিয়ে এই নদী। সব কেমন রহস্যময়। বুড়োর মাথার ঠিক থাকছে না। সব ভুল হয়ে যাচ্ছে। বড়বাবু তুমি থাকলে না। মানুষে বলে এমন মানুষ আর থাকে না। তুমি থাকলে না তাহলে আমার কষ্ট, ছোট সোনা মান্ডির দুঃখ, কুষ্ঠ রোগীর জীবন আর সেই সাঁওতাল গাঁয়ের কষ্ট বেদনা কিভাবে দূর হয়ে যাবে?
সে নেমে গেছে বালুচরে। বিস্তৃত বালির চড়াতে। অল্প আলোয় ঝিকমিকিয়ে উঠেছে বালুকণা। বিস্তীর্ণ বালিতে নেমে উদার আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে সে আর্তনাদ করে ওঠে যখির মত পাহারা দিবো কী করে বড়বাবু, অন্ধ চোখে বেঁচে থাকবু কী করে বড়মানুষ?
এই নদীটা রয়ে গেছে অথচ সেই মানুষ থাকলো না। নিঃশব্দে কখন চলে গেছে অথচ দুঃখ কষ্ট বেদনা আর বিশ্বাসটুকু রেখে গেছে গাঁওবুড়োর মনে।
চলি গেলে তো সব দুঃখ গুলান নি গেলে নি কেনে? বুড়ো ফিসফিসিয়ে নদীর সঙ্গে কথা বলে। দূরে কোথাও ছপছপ শব্দ হয়। বড় মানুষ হেঁটে যায়।
গাঁওবুড়ো দ্রুত দৌড়তে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে বালুচরে। আকাশের নিচে পৃথিবীর উপর পড়ে থাকে। সব নৈঃশব্দে ডোবে। তারপর এক সময় সবুজ আলো জ্বালিয়ে এক উড়োকল নৈঃশব্দ ভেঙে চলে যায়।
ফেরার পথে সেই জঙ্গলে, সেই মাঠে, সেই খালের সামনে অপেক্ষা করে থাকে যে যেমন। গাঁওবুড়ো কাল ফেরেনি, আজ ফিরলো না, তবু ফিরবে নিশ্চয়।
( অমৃত – অক্টোবর, ১৯৭৭ )

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত