চলে গেলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী অমর পাল

Reading Time: 7 minutes

বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী অমর পালের প্রয়াণে ইরাবতী পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

জীবনাবসান হল প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতশিল্পী অমর পালের। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শনিবার বিকেলে কলকাতার এক হাসপাতালে প্রয়াত হলেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর।

সূত্রের খবর, শনিবার সকালেও ছাত্র-ছাত্রীদের গানের ক্লাস করিয়েছেন অমর। তার পরই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর প্রয়াণে শোকের ছায়া নেমে এসেছে শিল্পী মহলে।

সুরকার তথা গায়ক অমর পালের জন্ম ১৯২২-এর ১৯ মে, বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। মা দুর্গাসুন্দরী দেবীর কাছে লোকসংগীতে হাতেখড়ি হয় তাঁর। আট বছর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের ছোট ভাই আয়েত আলি খানের কাছে। ১৯৫১-এ আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের লোকসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে গান পরিবেশন করেন। দেবকী বসু, সত্যজিত্ রায়ের পরিচালিত ছবিতে গান গেয়েছিলেন তিনি। সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি সহ দেশে, বিদেশে একাধিক সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন অমর।

‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে অমরের গাওয়া ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’ জনপ্রিয় হয়েছিল। এ ছাড়া তাঁর প্রভাতী সঙ্গীত, ভাটিয়ালি গানও শ্রোতারা মনে রাখবেন।

অমর পালের একটি সাক্ষাৎকারঃ

বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী অমর পালের বাড়িতে যখন পৌঁছলাম তখন বেশ কুয়াশাজড়ানো সকাল। উনি টালিগঞ্জের যেখানে থাকেন তখনও সেই পাড়ায় কেমন ঘুম ঘুম ভাব। তাঁর বাড়ি খুঁজতে হয় না। লোকে এক কথায় চোখ বুজে দেখিয়ে দেন।

তাঁর বাড়িতে পৌঁছে, বারান্দা ভেঙে যখন আধ ভেজানো দরজা দিয়ে উঁকি দিলাম তখন বিরল এক দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম। ঘরের খোলা জানালার দিকে হাতে একতারা নিয়ে অমর পাল গাইছেন গান। খোলা জানালার পাশে গাছের ডালে একটা ফিঙে। নজরুলের কবিতার কথায় বললে, ‘ফিঙ দিয়ে দু’ তিন দোল’—এইভাবে তুরীয়ানন্দে ফিঙেটা এডাল ও ওডাল করছে। আর শিল্পী মগ্ন হয়ে যে গান ধরেছেন, সেই গান হলো, ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়, ভাইরে, ভাই…।’ তিনি কি রঙ্গ দেখছেন? একেবারে সুরে মগ্ন হয়ে? আর এই গান তো সকলের চেনা। ‘হীরক রাজার দেশে’—সত্যজিৎ রায়ের ছবির গান। অমর পালেরই গাওয়া। ভাবছিলাম, এখনই কি বেল বাজাবো? ‍‌ইচ্ছা করলো না। দু’চার লাইন গাওয়ার পর থামলেন ৯১বছরের জাদুকণ্ঠের লোকসম্রাট। ফিরতেই চোখাচোখি। আরে, ভেতরে এসো।

একতারাটা রেখে দিলেন। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, এই বয়সেও কণ্ঠের ওই মাধুর্য থাকে কী করে! মনে পড়ে গেল সেই ছোটবেলার কথা। মামার বাড়ি। পল্লীগ্রাম। দাদু ভীষণ পছন্দ করতেন অমর পালের গান। রোজ সকালে গ্রামোফোনে তাঁর রেকর্ড চাপিয়ে দিতেন। আমরা তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। অমন মাধুর্যময় কণ্ঠে বেজে উঠত—‘প্রভাত সময়ে শচীরও আঙিনার মাঝে গৌর চাঁদ নাচিয়া বেড়ায় রে…’। পল্লীগ্রামের ভোর ভোর সকাল। স্তব্ধ গাঁয়ে সেই গান যখন ঘুমাচ্ছন্ন অনুভূতি স্পর্শ করতো। তখন আমাদের নড়াচড়ার শক্তি থাকতো না। মনে হতো সুর দিয়ে কেউ যেন আমাদের সম্মোহিত করেছেন। সেসব দিন অবশ্য চলে গেছে। আপাতত অমর পালের বা‍ড়িতে তাঁরই মুখোমুখি। কথা শুরু করলেন প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়।

প্র: আপনার ছেলেবেলা দিয়েই শুরু করা যাক, বলুন।

উ: কুমিল্লা জেলার তিতাস নদীর পাশে ব্রাহ্মণবেড়িয়া শহরে ১৯২২সালে আমার জন্ম। আমরা চার ভাই-বোন। বাবা-কাকাদের ব্যবসা ছিল। সুতরাং আমি ব্যবসায়ীর ছেলে। তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। ভাগ হয়নি। আমার জেলায় অনেক বিপ্লবী ছিলেন। তাঁদের কথা শুনেছি, দেখেছি। নিজেকে তৈরি করার একটা ভাবনা পেয়েছি। আমি ছোটবেলায় শরীরচর্চা করতাম। তখনই একজনের গান শুনি। নাম মনমোহনবাবু। তাঁর গান শুনলেই আমি সেখানে চলে যেতাম। তখন স্কুলে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু পড়াশোনায় মন ছিল না আমার। আমি স্কুলে যাবার পথে যেখানে সেখানে কলের গান শুনলেই দাঁড়িয়ে যেতাম। তখন কলের গানে বাজত অনন্তবালা বৈষ্ণবী, ইন্দুবালা’দের গান এছাড়া শচীন কর্তার গান, আব্বাসউদ্দিনের গান। এখন হাসি পায়। তখন কিন্তু স্কুলের কয়েকজন বন্ধু মিলে কলের ভেতর কণ্ঠস্বর শুনে ঝগড়া করতাম। মনে আছে, ইন্দুবালা দেবীর গান শুরু হওয়ার আগে, তিনি বলতেন, ‘মাই নেম ইজ ইন্দুবালা’। তখন নিজেকে পরিচিত করার রীতি ছিল এটাই। আমরা ঝগড়া করতাম—কলের ভেতর মানুষ আছে বলে। কি ছেলেমানুষী বলো তো?

ওদিকে স্কুলে ঘণ্টা পড়ে যেত। আর যেতাম না। দিনের পর দিন এই হতো। বাড়িতে মায়ের খুব আদর ছিল আমার প্রতি। কারণ, আমার আগের জন মারা গিয়েছিল। তারপর আমি। আমার প্রতি মা-বাবা দু’জনেই খুব দুর্বল ছিলেন। এই গান আর গান, ছোটবেলা থেকেই আমায় পাগল করে রাখতো। লেখাপড়াও হলো না এই জন্যেই। মাথায় থাকতো শুধু গান। লুকিয়ে যাত্রাপালা দেখতে চলে যেতাম। যে পালা গানপ্রধান থাকত। দেখেছি নিমাই সন্ন্যাসসহ অনেক কিছু। খুব ভালো লাগতো কে এল সায়গলের গান, কৃষ্ণচন্দ্র দে’র গান। আমার পড়াশোনার শত্রু হলো গান।

তখন আমার ১৬বছর বয়স। ওখান থেকে কলকাতায় পালিয়ে এসেছিলাম। মায়ের গহনা চুরি করে, বাবার দু’টি আংটি নিয়ে এবং ২৫টাকা জোগাড় করে। ট্রেনেই ধরা পড়লাম গ্রামের এক লোকের কাছে। তিনি অবশ্য সঙ্গে নিয়ে এলেন কলকাতায়। উঠেছিলাম রতন সরকার গার্ডেন স্ট্রিটে। কিছুদিন ছিলাম। সারা কলকাতা ঘুরেবেড়িয়ে আবার ফিরে গেছিলাম। মনে আছে ১২বছর বয়সে প্রথম গান গাই ‘ডফলীলা’ (ছোট যাত্রা) দলে। মা কিছুতেই গাইতে দেবেন না। কিন্তু গ্রামের এক বয়স্ক মানুষ কিছুতেই শুনলেন না। জোর করে নিয়ে গিয়ে বিবেকের চরিত্রে গান গাওয়ালেন। অল্প বয়স থেকেই আমি নানা রকম কাজ করেছি। এমন কি রঙপুরে একবার চায়ের দোকানও করেছি। ওখানে একটা ছোট এয়ারপোর্ট ছিল। সেখানে এক মামার রেশন দোকান ছিল। সেই দোকানেই কাজ করেছি। যখন চায়ের দোকান চালাতাম, তখন দুধ খেয়ে পয়সা দেয়নি এক সাহেব। পয়সা চাওয়ার জন্য মারও খেয়েছি। শেষ পর্যন্ত‍‌ দোকান বিক্রি করে একদিন চলে এলাম। যখন আমার ২০বছর বয়স, তখন এইসব হলো।

প্র: তারপর গানে এলেন কী করে?

উ: আমাদের ওখানের এক কবিরাজ শচীন ভট্টাচার্য একদিন আমার গান শুনলেন। উনি কবিতা লিখতেন। আমার গান শুনে বললেন, দারুণ গলা। গান শেখো। হঠাৎ উনি নিয়ে চলে গেলেন পণ্ডিত আয়াত আলি খানের কাছে (বাবা আলাউদ্দিনের ভাই)। তিনি তখন ঢাকা রেডিওয় গাইতেন। গিয়ে সোজাসুজি বললেন, ওস্তাদজী অমরের গলা ভালো। একে গান শেখান। আপনার কাছে তালিম দিন।

তিনি আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললেন, নিষ্ঠা রাখতে পারবে তো? কোন নেশা করা চলবে না। আর আমায় না জিগ্যেস করে কোথাও গাইবে না।

মনে পড়ছে সালটা ৪২হবে। গানের তালিম নেওয়া শুরু হলো।

১৯৪৭সাল। দেশ স্বাধীন হলো। শচীন কর্তার সঙ্গে আমার ভালোই বন্ধুত্ব। তিনি বললেন, অমর আমি ‘ইন্ডিয়া’য় চলে যাবো। দেশভাগ হয়ে গেছে তখন। উনিই প্রথম তালিম নেবার সময় চট্টগ্রামে নিয়ে গেলেন গান গাইতে। ওস্তাদকে জিগ্যেস না করেই চলে গেলাম। পরে ওস্তাদজী জানতে পেরে আমায় বললেন, বাবা, বড় ওস্তাদ হয়ে গেছ। আর কি হবে গান শিখতে এসে? আমারও রাগ হলো, আমি আর গেলাম না। একদিন আমাদের এক পরিচিত মানুষকে বললেন, আচ্ছা অমর আসছে না কেন? ওর কি খুব রাগ হয়েছে? আবার আমি গেলাম ওঁর কাছে।

প্র: ওখানেই থেকে গেলেন? শচীন দেব বর্মণ কি চলে এলেন এখানে?

উ: না না, আমি ওস্তাদজীকে বললাম, দাদা (শচীনকর্তা) চলে যাবেন ভারতে। উনি চলে গেলে আমার গানই হবে না যে! দাদাকেও বললাম।

দাদা বললেন, তুমি আমার সঙ্গে যাবে। আমি তোমার ব্যবস্থা করবো। আমি দাদা মানে শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে কলকাতায় চলে এলাম। উঠলাম, দাদার এক আত্মীয়ের বা‍ড়ি ভবানীপুরে। একমাস পড়ে বললাম, মা’কে বলে আসিনি। একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। দাদা বললেন, বেশ, যাচ্ছিস যখন আমার ডিসপেনসারিতে যা কিছু আছে বিক্রি করে দিয়ে আসবি। উনি ডাক্তারিও করতেন। সেইমত কাজ সেরে আবার কলকাতায় চলে এলাম।

প্র: আচ্ছা, আপনার সঙ্গীতজীবন শুরুর ক্ষেত্রে পরিবারের কারো প্রভাব কি আছে?

উ: বলা হয়নি। মায়ের প্রভাব কিছুটা আছে, মা অনেক রকম লোকাচারের গান জানতেন, যেমন বিয়ের গান, বিভিন্ন পার্বণের গান। অনুষ্ঠানের সময় মা গাইতেন। আমার গাওয়া একটা জনপ্রিয় গান মায়ের কাছে শেখা। গানটি হলো, ‘রাই জাগো, জাগো শুকসারি বলে’।

প্র: কলকাতায় চলে এলেন, তারপর?

উ: সুরেশ চক্রবর্তী পল্লীকবি ছিলেন। লিখতেন, গাইতেন। বললেন, আর্য সঙ্গীত বিদ্যাপীঠে শেখো। মণি চক্রবর্তী ছিলেন, ক্লাসে যেতাম, গান শিখতাম। গাইতে গাইতে মেডেল পেলাম। তখন ৫১সাল, মণিবাবুর মতো মাস্টার পাওয়া মুশকিল। বললেন, রেডিওতে পরীক্ষা দাও। ওখানে ছিলেন বিমান ঘোষ, বিমল চক্রবর্তী। অডিশন দিলাম। বললাম পল্লীগীতি গাইবো। ওরা বললেন, আধুনিক গান। তাই গাইলাম। অডিশন দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে শুনতে পেলাম, ওরা বলছেন, গলাটা ভালো।

তখন এক ছাত্রীর পরিবারের সঙ্গে থাকি। একদিন দুপুরে তাঁরাই বললেন, চিঠি আছে। সুযোগ পেলাম রেডিওতে। গাইলাম, গিরীন চক্রবর্তী তবলা বাজালেন। তিনিই বললেন, রেকর্ড করবেন? নিয়ে গেলেন, রেকর্ড হলো, ২৫টাকা পেলাম। ওই বছরই, তখন আমি কুঁদঘাটের ওপারে থাকি। ক্যালকাটা ও সুরশ্রী অর্কেস্ট্রার বড় কর্তা পবিত্রবাবুর কথায় ‘চড়কে শিবের জটা’ গানটি গাইলাম। রেকর্ড হলো। আদ্যাপীঠের ওখানে একটা স্টুডিওয় রেকর্ডিং হয়েছিল। গানটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই প্রকৃত পক্ষে শুরু হলো। আমার গাওয়া প্রথম ছবি ‘চাষী’। নায়ক, নায়িকা ছিলেন শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র। গানটি ছিল ‘ধান কাটি ধান’। সুরকার কালিপদ সেন নিয়ে গিয়েছিলেন শৈলেন রায়ের কাছে। আমি লিড দিয়েছিলাম। কোরাসে ছিলেন শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখার্জি, মৃণাল চক্রবর্তী। পরে গানটি হিন্দুস্তানে রেকর্ড করি। তারপর গাই অপরেশ লাহিড়ীর সুরে। ছবির নাম ‘ও আমার দেশের মাটি’। আর একটা ছবি ‘শিউলি বাড়ি’। শৈলেন রায় নিয়ে গেলেন রাইচাঁদ বড়ালের কাছে। রাইচাঁদ বড়াল, দেবকী কুমার বসু নিউ থিয়েটার্সের পাশাপাশি ঘরে বসতেন। দুই ঘরেই রিহার্সাল চলত। গানটি ছিল ‘আমি সপন দেখি মধুবালার মুখ রে’। ছবির নাম ‘সাগর সঙ্গমে’।

গান শুনে রাইবাবু বললেন, পাস করে গেলেন। কিন্তু দেবকীবাবুকে শোনাতে হবে। ওঁর বাড়ি ছিল মেনকা সিনেমার কাছে। যাওয়া হলো তাঁর বাড়ি। ছিলেন রাইবাবু, অমর মল্লিক, ভারতীদেবী, শৈলেন রায়। গান গাইলাম দেবকীবাবুর কাছে দুরু দুরু বুকে। গান শেষ হতে দেবকীবাবু বললেন, তুমি কোনোদিন অভিনয় করেছ? আমি বললাম, না স্যার, করিনি। তারপর দেবকীবাবু ঘরের ভেতর চলে গেলেন। সবাই বললেন, কি ভালো গেয়েছ। শৈলেন দা বললেন, এক চড়ে মাথা ঘুরিয়ে দেবো। অভিনয় করব বলতে পারলি না? আমি মোট চব্বিশটা ছবিতে গান গেয়েছি। তারমধ্যে রয়েছে অমৃতকুম্ভের সন্ধানে, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, হীরক রাজার দেশে, বেহুলা লখীন্দর, নিষ্কৃতি, তাহাদের কথা— আরো অনেক। আমাকে অনেকে বলেছিল, কণ্ঠ এত ভালো আধুনিক গান গাইতে পারেন না? অনেক অর্থ পাবেন জীবনে। কিন্তু গাইনি।

প্র: কেন গাননি?

উ: গাই‍‌তে ইচ্ছা করেনি। আমি মনে করি লোকগানের মধ্যেই প্রাণ আছে। আদি সৃষ্টির এই গান। কর্মের মধ্যে আছে এই গান। আমাদের সংস্কৃতির শিকড় এই গান। তাই মাটি’র গন্ধে সারা মন ভরিয়ে রেখেছি সারাজীবন।

প্র: কত ধরনের লোকগান রয়েছে?

উ: অনেক। কিছু নাম বলছি। এখন তো আর শোনাই যায় না—ছাদ কোটার গান। এছাড়াও নৌকা বহিসের গান, সারি গান, ভাওয়াইয়া, গাজীপীর, মনসামঙ্গল, বিয়ের গান, বাউল, ভাটিয়ালি, টুসু, ভাদু, ধামাইল গান—লোকসঙ্গীতের অসম্ভব বৈচিত্র্য।

প্র: এখন লোকসঙ্গীতের কীরকম অবস্থা। যে সব গান শোনা যায়, সেগুলি কতটা লোকসঙ্গীত।

উ: আমাকে বলতে বলো না। অনেকের রাগ হবে। নাম বলে ফেলব। কষ্ট পাই, দুঃখ হয় অনেক কিছু শুনলে।

প্র: এইসব গান কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়। আপনি কিছু ভেবেছেন?

উ: আমি তো সব সময়ই ভাবি। আমাদের দেশের লোক কেন এইসব গান, সুর ধরে রাখতে চেষ্টা করে না? আমি চেষ্টা করেছি। সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের ১১০টা লোকসঙ্গীত স্বরলিপিসহ সংগ্রহ করতে, করেওছি। বইটি প্রকাশ হবার কথা। একটা কথা মনে পড়ে গেল। এখন ঢেঁকির গান গ্রাম থেকেও অবলুপ্তির পথে, গোরুর গাড়ির গান তো শোনাই যায় না। যেমন এক সময় খুব প্রচলন ছিল— ‘ও মোর গাড়িয়াল রে, আস্তে করিয়া চালান তোমার গাড়ি’। এসব গান আর কোথায়। কয়েক প্রজন্ম পরে ধরে না রাখলে কেউ কি জানতে পারবে?

দেখো, আমাদের লোকসঙ্গীতে সারা পৃথিবীর আকর্ষণ আছে। এখানে কিছুদিন আগে জাপান থেকে একদল গবেষক এসেছিলেন। তাঁরা গ্রামে ঘুরে, আমাদের কাছে এসে তথ্যচিত্র, ভিডিও করে রেখেছেন। অথচ আমাদের প্রচেষ্টা কই। সামান্যভাবে দু’একবার হয়তো চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু ভাবতে হবে, ধরে না রাখলে আগামী প্রজন্ম খুঁজে পাবে না। লোকসঙ্গীত গান আলাদাভাবে গাইতে হয়, তাও পাওয়া যাবে না। এই নিয়ে সকলের ভাবা উচিত।

প্র: সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে গান গাওয়ার প্রেক্ষাপট যদি বলেন।

উ: সে এক ঘটনা। অনুপ ঘোষাল আমার বাড়ি আসতো। একদিন বললো, আপনাকে মানিক মামার কাছে নিয়ে যাবো। আসলে মানিক মামা আপনাকে ডেকেছে।

সেটা ১৯৭৯সাল। অনুপ নিয়ে গেল ওঁর বাড়ি। দরজা খুলে সত্যজিৎবাবু বললেন, আসুন। উনি তখন লিখছেন। চা খেলাম। উনি বললেন, আমার একটা ছবিতে গান গাইতে হবে। আপনাকে নিয়ে একটু ভাবছি। একটা গান শোনান। আমি ‘এ ভব সাগরে’ গানটি গাইলাম। বললেন, বাঃ, রেডি হলে খবর দেবো।

যথারীতি একদিন ডাক এলো। তার আগে আমার রাতের ঘুম চলে গেছে। দিনরাত চিন্তা করছি। ডাক আসতেই ওঁর বাড়ি গেলাম। স্বরলিপি সমেত কাগজ এগিয়ে দিলেন। নিজে পিয়ানোর সামনে বসে দু’লাইন গাইলেন। গেয়ে বললেন, ঠিক আছে? আমি উত্তরহীন। একদিন এইচ এম ভি-তে রেকর্ড হয়ে গেল।‍‌ সেই গান ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়।’ অভিনয় করেছিলেন রবীন মজুমদার।

আর একটা স্মৃ‍‌তির কথা বলি। একবার রাজকাপুর বলেছিলেন, তুমি ভাগ্যবান, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে গান গেয়েছ। আমি সেই ভাগ্য করিনি। শেষ কথা বলি, অবহেলিত লোকসঙ্গীতকে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাই বাঁচিয়ে রাখার। পদ্মশ্রী, পদ্মবিভূষণ পাইনি। পেয়েছি সত্যজিৎবাবু’র ছবিতে গান গাওয়ার সম্মান। আর লক্ষ লক্ষ মানুষের ভালোবাসা। এই আমার সারা জীবনের সম্বল।

কথা শেষ করার পর অনেকটা বিষণ্ণ দেখালো ওঁকে। সারা শরীর ছুঁয়ে আছে বয়সের দুরন্ত শাসন। যেখানে বসে আছেন, পাশের চেয়ারটা খালি। ওদিকে একতারা, তানপুরা, হারমোনিয়াম। ঘরজুড়ে সুর সুর গন্ধ। কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও পাশের চেয়ারটা যে খালি! এত গানের উত্তরাধিকারী কোথায়? প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনজুড়ে।

 

কৃতজ্ঞতাঃ গণশক্তি

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>