আমার শহর

Reading Time: 2 minutes

কিছুদিন আগে একটা অ্যাপ খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো। স্টুলিশ।আমিও বেশ উৎসাহিত হয়ে যথারীতি ডাউনলোড করে ফেললাম।বেশ মজা।আমার সম্বন্ধে কে কি ভাবে জানা যাবে বেশ।একটু ভুল বললাম।কে ভাবেন,সেটা জানা যাবে না।কি ভাবেন সেটি জানা যাবে।যাই হোক,শুরু হল মেসেজ আসা।সে কত কি।সব কি আর মুখপুস্তিকাতে পোস্টানো যায়?

তা সে যাই হোক।কোন এক বন্ধুবর প্রশ্ন রেখেছিল, কুচবিহার ছেড়ে কেমন লাগে।উত্তর দিলাম একটা।সে দেওয়া, না দেওয়া সমান।ওই দু তিন লাইন এ কি এর উত্তর দাওয়া সম্ভব? তাই ভাবলাম চেষ্টা করে দেখি,কতটা প্রকাশ করে উঠতে পারি।যদিও জানি সব অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই।সেই চেষ্টা করাও ধৃষ্টতা।

উত্তরবঙ্গের ছোট্ট শহর কুচবিহারে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। আমার প্রাণের শহর।যারা উত্তরের মানুষ, বা উত্তরবঙ্গের সাথে পরিচয় আছে,তারা জানেন উত্তরের আকাশ বাতাস মাটি সবেতেই প্রাণ আছে।আমি জানি।জন্ম থেকে সেই প্রাণের স্পর্শ পায় সব উত্তরবঙ্গবাসী।আমিও পেয়েছি।আমার শহরের বাতাস বড্ড মিঠে।যদি কখনো যাও,একবার বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে দেখো।আমার শহরের মাটির গন্ধই আলাদা।সারাদিনের রোদে তেঁতে থাকা মাটিতে যখন বৃষ্টির ফোঁটা পরে,সেই সোঁদা গন্ধ ফরাসী সুগন্ধিকে হার মানায়।এত জায়গা ঘুরলাম,কিন্তু বৃষ্টি ভেঁজা মাটির সেই গন্ধ আর কোথাও পেলাম না।আজ যখন অনেক অপেক্ষার পর এই মহানগরীর বুকে বৃষ্টি নেমেছে,মনে হল এই মেঘ কি আমার শহরকে ছুঁয়ে এসেছে।সেই মূহুর্তে মেঘকে আমার বড্ড আপন বলে মনে হল।

রাজার শহর তো,তাই বড্ড অহংকারী আমার শহর।মাথা নোয়াতে জানে না।ভালবাসায় ধরা দেয়।বড্ড ভালবাসি তো,তাই আমার কাছে বারবার ফিরে ফিরে আসে,আমার অবসরের মূহুর্তে, বা রাতের ঘুমের গভীরে।কখনো বা কোনও নির্ঘুম রাতে আমার সঙ্গী হয়।আমি এই মহানগরের বুকে বসে তখন ঘুরে বেড়াই আমার শৈশব কৈশোরের রাস্তা ধরে।যে শহরে পাড়া প্রতিবেশি সবাই আত্মার আত্মীয়।সবাই আপন।এখনও দূরে বসে আমার বাবা মাকে নিয়ে এজন্য নিশ্চিন্তে থাকতে পারি,যে পাড়ার লোকেরা আছে।কোন বিপদে ওরা পাশে থাকবে জানি।

আমার প্রথম হামা টানা,ভ্যান গাড়ি চেপে প্রথম স্কুলে যাবার শহর আমার কুচবিহার। চঞ্চল দাদামনির কাঁধে চেপে ঘোরা,বা সুবল দাদার টিনের নীল সাদা ভ্যান গাড়িতে সারা কুচবিহার ঘুরে বাড়ি ফেরা,সেই স্নেহ মাখা মুখগুলো আজকের মেকী মুখোশের আড়ালে মেকী হাসির মুখের ভীরে জ্বলজ্বল করে আমার মনের মনিকোঠায়।আমার স্কুলের সেই বকুল গাছটা,তার ফুলের গন্ধ আমি এখনও পাই কোন অলস দুপুরে।মিথ্যে সম্পর্কের ভীরে প্রাণ যখন হাঁফিয়ে ওঠে,মনে হয় নমিতা দিদিমনির মত কেউ যদি কান মুলে চোখ পাকিয়ে খুব করে বকে দিত?কেউ দেয় না।আমি বড় হয়ে গেছি। আমার মনটাও বড় হয় গেল কি?তাহলে কেন এখনও সুনীতি একাডেমির বারান্দায় ছুটে বেড়ায় আমার স্বপ্নগুলো?

আমার সেই হীরো সাইকেলটা চুরি হয়ে গেছে।আমার কৈশরের বন্ধু সে।আমার জীবন ও হৃদয়ের অনেক ওঠাপড়া ভাঙাগড়ার সাক্ষী ছিল সে।পরম বন্ধুর মত পাশে থেকেছে।কত স্মৃতি ছিল তাকে ঘিরে।প্রবল বর্ষনে তার সাথে ভেজা শাড়িতে বাড়ি ফেরার সময় অকারনে ঘুরপথে যাওয়া,আরেকটু বেশি সময় ভিজতে পারার লোভে।হাঁটুজল ভেঙে টিউশনে যাবার সাথিও ছিল আমার সেই সাইকেল।আমার প্রথম প্রেমের সাক্ষীও ছিল সে।

কুচবিহার আমার কাছে কি,ঠিক কতটা,আমিই কি ছাই ঠিক জানি?কি করে উত্তর দেই, কুচবিহার ছেড়ে কেমন লাগে।দু হাত ভরে শুধু দিয়েই গেছে আমায়,ফিরে চায়নি কিছু কোনদিন।আমিও শুধু নিয়েই গেছি।এই শহর আমায় দিয়েছে অফুরন্ত ভালবাসা।আমার ব্যক্তিত্বে মিশিয়ে দিয়েছে পেলবতা।এই শহর আমায় বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে।শিখিয়েছে ভালবাসতে।এই শহরেই একদিন খুঁজে পেয়েছি আমার জীবনসঙ্গীকে।

আজ যখন ফিরে যাই,বুক ভরে মাটির গন্ধ সাথে নিয়ে ফিরি।আমার গাড়ি যত নিউ কুচবিহার স্টেশনের দিকে এগোতে থাকে,একটা কান্না দলা পাকিয়ে উঠতে থাকে গলার মধ্যে।আমি কিন্তু কাঁদি না।আমি বড় হয়ে গেছি।উদ্যত কান্নাকে গিলে নিতে শিখে গেছি।এই শহরের মাটি মা এর মত আমার অনেক চোখের জল পান করেছে।আমি জানি আবার যদি সেই ছোটবেলার মত হোচট খেয়ে পড়ে যাই, আবার যদি চোখের জলে আশ্রয় চাই,আমার শহর আমায় বুকে টেনে নেবে।আমার শহর আমার ঘরে ফেরার অপেক্ষায় আছে, ঠিক যেমন এই শহরেরই এক কোনে অপেক্ষায় আছে আমার মা।

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>