| 10 নভেম্বর 2024
Categories
প্রবন্ধ সিনেমা

ঋতুপর্ণ ঘোষ: এক ব্যতিক্রমী নির্মাতা । আহমদ আল রাজী

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

ঋতুপর্ণ ঘোষ কি নারী ছিলেন, নাকি পুরুষ এ কানাঘুষা, ফিসফাস ছাড়িয়ে তার পরিচয়টা আসলে অনেক বড়। তিনি কলকাতার চলচ্চিত্রকে নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়; বাড়িয়ে তুলেছেন এর আন্তর্জাতিক পরিচিতি।

সত্তর বা আশির দশকে কলকাতার চলচ্চিত্র যখন কলহ আর সম্পর্কের টানাপড়েনের অতিরঞ্জনের বাইরে কিছু দিতে পারছিল না, তখন অল্প যে কয়েকজন মানুষ স্রোতের বাইরে এসে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন তাদের অন্যতম ঋতুপর্ণ ঘোষ। বিজ্ঞাপন নির্মাতা হিসেবে তার উত্থান। আশির দশকের কিছু জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনের সংলাপও তার হাত ধরে এসেছে। ১৯৯২-এ বড় পর্দায় তার অভিষেক হয় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘হিরের আংটি’ চলচ্চিত্রায়ণের মধ্য দিয়ে। এরপর ‘দহন’, ‘উনিশে এপ্রিল’, ‘বাড়িওয়ালি’ কিংবা ‘তিতলী’র মতো চলচ্চিত্রের ভেতর দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে নিজের নামটি পাকাপোক্ত করে নেন তিনি।

তিনি সত্যজিৎ রায়ের অনুসারী ছিলেন, ভাব-শিষ্য বলা যেতে পারে। সত্যজিতের চিন্তাধারা, কাজের দর্শন তার বিভিন্ন চলচ্চিত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। তার নির্মাণশৈলী এবং গল্প বাছাইয়ে সেটা লক্ষ করা যায়। ব্যক্তিজীবনে অবশ্য তিনি গে কমিউনিটির সদস্য ছিলেন; আর সেটা স্বীকার করতেও দ্বিধা করতেন না। তার যৌন-জীবন সম্পর্কে ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখা যায় তার কাজে। তার পোশাকেও ছিল সেই দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। তিনি যৌনতা নিয়ে উপমহাদেশ, বিশেষ করে বাংলা অঞ্চলে প্রচলিত চিন্তাধারা, গোপনীয়তা বা ‘ট্যাবু’ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করেছিলেন। নিজের জীবনে সে চিন্তাধারার প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছিলেন।

photo-1464600277যৌনতার বাস্তবমুখী এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর নিষ্ঠুরতাটা বেরিয়ে পড়েছে তার চলচ্চিত্রে; বিশেষ করে উপমহাদেশে যৌনজীবনে নারীর অবস্থানটা। আমরা যখন ‘অন্তরমহল’ দেখতে বসি, শুরুতেই একটু ধাক্কা খেতে হয় যখনÑগল্প শুরু হয় মিলনদৃশ্য দিয়ে। কিন্তু তাতে উত্তেজনার চেয়ে ছোট বউয়ের কষ্টটাই বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। বংশের গতি রক্ষায় ছেলে প্রয়োজন। তাই কর্তার ইচ্ছা আর বামুনের কথায় চলে বিভিন্ন যজ্ঞ। যৌনতা এখানে শুধু একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। ব্রিটিশ সরকারকে তুষ্ট করতে দেবী দুর্গার চেহারা রানি ভিক্টোরিয়ার আদলে গড়া, ছেলের আশায় সঙ্গমকালে পণ্ডিত ডেকে মন্ত্র পড়ানো ইত্যাদি উপাদান দর্শককে নিয়ে যায় ব্রিটিশশাসিত বাংলার সেই অন্ধকার অংশে, যা রবীন্দ্রনাথ বা শরৎচন্দ্র ঢেকে রেখেছিলেন তাদের মতো করে। অন্যদিকে ‘দহন’-এ উঠে এসেছে কলকাতার রাস্তায় ধর্ষিত এক নারীর গল্প এবং সে বিষয়ে সমাজ আর পরিবারের উদাসীনতা।

‘উৎসব’-এ তিনি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প বলেছেন। খুবই সাদামাট ভাষায়, কোনো অতিরঞ্জন ছাড়াই যে পারিবারিক গল্প বলা সম্ভব। একান্নবর্তী পরিবারের বিভিন্ন সমস্যা কোনো রকম নাটকীয় সংলাপ বা পরিস্থিতি তৈরি না করেই, একেবারে বাস্তব থেকে তুলে আনা যায়Ñতার প্রমাণ এ চলচ্চিত্র। দুই ভাই আর দুই বোনের পরিবার একত্র হয় পৈতৃক বাড়িতে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে। ছোট ভাইয়ের চাকরির অনিশ্চয়তা, ছোট বোনের ভঙ্গুর বৈবাহিক জীবন আর বড় বোনের অভিমান এবং তার ভেতর পিঠাপিঠি মাসতুতো-পিসতুতো ভাই-বোনের খুনসুটি এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন, সব মিলে খুব শান্ত-ধীর অথচ শক্তিশালী গল্পের অবতারণা হলো ‘উৎসব’। ২০০০ সালে মুক্তি পায় চলচ্চিত্রটি এবং শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার লাভ করে।

Image-3‘বাড়িওয়ালি’ ঋতুপর্ণ ঘোষের অন্যতম মাইলফলক। এখানেও তার সেই শান্ত-সাবলীল ভাষায় গল্প বলার ভঙ্গিটি দেখা যায়। সেই একই আড়ম্বর বা চাকচিক্যহীন অথচ শক্তিশালী বাচনভঙ্গি। ‘জধরহপড়ধঃ’ ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রথম হিন্দি চলচ্চিত্র। ঙ. ঐবহৎু-র বিখ্যাত ছোটগল্প ‘ঞযব রেভঃ ড়ভ ঃযব গধমর’ অবলম্বনে সাজানো গল্পটি। তবে ঋতুর প্রতিভার বড় স্ফুুরণ হলো ‘চোখের বালি’। রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে তিনি নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছেন। গতানুগতিক রাবীন্দ্রিক স্বাদে মিশিয়েছেন দৈনন্দিন বাস্তবতার খুঁটিনাটি উপাদান। ফলে আমরা বিনোদিনীকে নতুন চোখে, নতুনভাবে দেখতে পাই; চিন্তা করতে বাধ্য হই।

যেমন বলছিলাম, ঋতুপর্ণ ঘোষ সত্যজিৎ রায়ের থেকে অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত। তাই বলে তিনি অন্ধ অনুসারী ছিলেন না। তার কাজে সত্যজিতের ছাপ থাকলেও মৌলিক কাজ হিসেবে সেগুলো অস্বীকার করার উপায় নেই। সাদামাটাভাবে বলে যাওয়া গল্পগুলো চিন্তাশীল মস্তিষ্ককে খোরাক আর প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে আসার প্রেরণা জোগায়। তিনি ২০১৩ সালের ৩০ মে হƒদ্রোগে মারা যান। বড় পর্দার কর্মজীবন মাত্র দুই দশকের হলেও এর ভেতর তার ঝুলিতে অনেক পুরস্কার জমা হয়েছে। তাতে যেমন অনেক জাতীয় পুরস্কার আছে, তেমনি অন্যান্য দেশের চলচ্চিত্র উৎসবের সম্মাননাও আছে। সম্ভবত সত্যজিতের পর ঋতুপর্ণ ঘোষই কলকাতার চলচ্চিত্রশিল্পকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে গেছেন সফলভাবে। তার মৃত্যু চলচ্চিত্র জগতের জন্য দুর্ভাগ্যজনক হলেও ঋতুপর্ণের কর্মজীবন এখনও ঈর্ষার যোগ্য।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত