অনেক দূরে- পাড়ি দিতে হবে

Reading Time: 4 minutes

আমরা কি তাহলে দুঃস্বপ্ন দিয়ে আমাদের স্বপ্ন সাজাচ্ছি? এই সৌন্দর্য্য আমাদের মুখোমুখি করে দেবে এমনই এক প্রশ্নের। এক একটা মোড়ক কত সুন্দর, কত মসৃণ! কত সুন্দর তার রঙ! কী মায়াবী!
হায় সৌন্দর্য্য! তুমি কি মৃত্যুদূত হয়ে গেলে?
আমাদের খাদ্যচক্র, বায়ুচক্র, পানিচক্রে ঢুকে গেছে নানাবিধ বিষ, প্রকৃতির নিয়মকে ভেঙে ফেলে গড়ে উঠছে অন্য এক নিয়ম। ক্রমশই চওড়া হয়ে উঠছে শয়তানের বিকট হাসি।
আমরা কি তাহলে আবাহন করছি ধ্বংসের, মৃত্যুর! মেতে উঠেছি সৌন্দর্য্যের আড়ালে সৌন্দর্যকে ধ্বংস করার এক আত্মঘাতি খেলায়?

নারায়ণগঞ্জ শহরে দাগ আর্ট স্টেশনের সৃষ্টি হয়েছিল স্বপ্ন সম্ভাবনা ও দায়িত্বের একটা সম্মিলিত তাগিদ থেকে। সমাজ, রাজনীতি ও চলমান জীবনের সাথে দূরত্ব ঘুচিয়ে জীবনের নব নব উল্লাস ও বেদনা আবিস্কার করার নেশায় আমরা মিলিত হয়েছি। আমরা মিলিত হয়েছি শহরের সুখ-দুখ-সঙ্কট-সম্ভাবনা ও স্বপ্নের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান ছাড়া শিল্প কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে না। আবার সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা ছাড়া আর্ট কখনো তার জীবনমুখী রূপ নিয়ে আবির্ভূত হতে পারে না।

কেনো শিল্পের প্রয়োজন? কারণ শিল্পীর হৃদয় এবং মস্তিস্ক প্রকৃতি, পরিবেশ এবং সমাজের বিভিন্ন উপাদানগুলোর সম্পর্ক, কার্যপ্রণালী এবং পরিবর্তনসমূহ অনেক বেশি স্পষ্টভাবে দেখতে এবং আত্মস্থ করতে পারে এবং শিল্প হিসেবে প্রকাশ করতে পারে। শিল্পী চায় মানুষ তার আনন্দ, বেদনা, কৌতুহল, আকাঙ্খা, ভালোবাসা এবং ঘৃণার সাথে যুক্ত হোক। যে যত সুন্দরভাবে মানুষের সাথে সংযোগ তৈরি করতে পারে সে ত
তবে দেখা, বোঝা এবং প্রকাশের এই সুক্ষ্মতা এবং কৌশল অর্জন করা একটা জীবনব্যপী সাধনার বিষয়।

দাগ আর্ট স্টেশনের সবাই মিলে ভাবছিলাম কিভাবে আমরা যুক্ত হতে পারি এক প্রতিরোধের মিছিলে, পালন করতে পারি এক অগ্রনী ভূমিকা; কিভাবে আমরা আমাদের শিল্পসাধনাকে লিপ্ত করতে পারি এই বর্জ্য দানবের বিরুদ্ধে; কিভাবে আমরা ভূমিকা রাখতে পারি মানুষের চিন্তাকে নাড়িয়ে দিতে, এগিয়ে নিতে।
কিন্তু ফুল-ফল লতাপাতার জগতে আটকে যাওয়া তরুনদের নতুন জগতে বের করে আনাও এক চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে কিছু তরুন শিল্পীকে যুক্ত করা গেল এক নতুন যুদ্ধে। এ যুদ্ধ শিল্পের, মননের, ভালোবাসার। এ যুদ্ধ জীবনের সাথে মৃত্যুর।

সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন তরুন শিল্প-সমাঝদার মুনতাসির মঈন।
এরই মধ্যে কিউরেটরের দায়িত্ব নিয়ে আমাদের সাথে যুক্ত হলেন মাসুম চিশতি যিনি নারায়ণগঞ্জেরই সন্তান। যাত্রা শুরু হল কর্মশালা বর্জ্য নামতা।
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন আমাদের নানাবিধ সহযোগিতা করে চলেছেন সেই প্রথম থেকেই।

২০১৯ সালের জানুয়ারীর ১২ তারিখ থেকে আটজন তরুন তরুনী নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া গেল। কিউরেটরের সাথে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সহকারী কিউরেটর সুমনা আক্তার আর কর্মশালা সমন্বয়ক নাসির আহমেদ।

নারায়ণগঞ্জের অলিগলি, মাঠ-ঘাট, খাল-নদী-জলাশয় চষে ফেললো সবাই মিলে। তন্ন তন্ন করে খুঁজে মনি মুক্তো নয় আবিস্কার করলো প্লাস্টিক বর্জ্যের অসংখ্য টিলা, রঙ-ক্যামিকেলের রঙিলা প্রবাহ আর দুর্গন্ধে ভরা থমথমে বাতাস। এক রকম ধারণা আগে থেকেই ছিল কিন্তু ভয়াবহতার মাত্রা পাওয়া গেল কল্পনার অতীত। সরোজমিনে তদন্ত করে যা বের হলো তা হজম করা কঠিন। আরও কঠিন সেটাকে শিল্পরূপে প্রকাশ করা। নবীন এইসব শিল্পীদের জন্য এ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। সব দেখেশুনে তারা স্তম্ভিত। স্তম্ভিত আমরা সবাই। সবাই নতুন করে আবিস্কার করলো নিজেদের অস্তিত্ব যা দখল করে নিচ্ছে নানাবিধ বর্জ্য চিন্তার স্তুপ।

দুইহাজার উনিশের জানুয়ারীর ১৮ তারিখে প্রদর্শনী হল আলী আহম্মদ চুনকা মিলানায়তন ও পাঠাগার ভবনের বেজমেন্টে। বিপুল সংখ্যক মানুষ দেখলেন। প্রতিক্রিয়া জানালেন। দর্শকের উৎসাহী এবং আন্তরিক প্রতিক্রিয়ায় আমরা বুঝলাম আমাদের প্রচেষ্টা বৃথা যায় নি। দায়িত্ব বেড়ে গেল। বুঝলাম নিজেদের চিন্তা এবং শিল্প নিয়ে যেমন ছড়িয়ে পড়তে হবে তেমনি চিন্তা এবং শিল্পকে ক্রমাগত আরও কার্যকরী করে গড়ে তুলতে হবে।

এরই মধ্যে কলাকেন্দ্র থেকে শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান আহবান জানালেন একটা প্রদর্শনী করার জন্য।
স্বাভাবিকভাবেই আমরা এ সুযোগ লুফে নিলাম। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এপ্রিলের ২৬ তারিখ থেকে কলাকেন্দ্রে শুরু হল বর্জ্য নামতার দেড় মাস ব্যাপী দ্বিতীয় প্রদর্শনী। শুরু হল আমাদের দ্বিতীয় পর্যায়। আমরা সংযুক্ত হলাম অনেক নতুন দর্শকের সাথে অনেক নতুন শিল্পীর সাথে। অনেক চিন্তার বিনিময় ঘটলো। এ বিনিময় থেকে সৃষ্টি হতে যাচ্ছে আরও নতুন নতুন পরিকল্পনা, নতুন নতুন কাজ, নতুন নতুন স্বপ্ন। এখন আমরা চিন্তা করছি এই প্রদর্শনী নিয়ে আমরা ছড়িয়ে পড়বো সারা দেশে। সেক্ষেত্রে একটি দূষণমুক্ত পরিবেশের লক্ষ্যে আমরা সবার কাছে সহযোগিতার আহবান রেখে গেলাম।

সভ্যতার যে সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা পার করছি আমাদের জীবন সেখানে আমাদের ভূমিকা কী?
কিভাবে কী দিয়ে প্রকাশ করা যায় এই লোভ, এই একাকীত্ব, এই অনাচার, এই বেদনা, এই আত্মহত্যা?
সেই প্রশ্নেরই শৈল্পিক জবাব খোঁজার পথে এই প্রদর্শনী এখনো পর্যন্ত একটি সাময়িক উত্তর মাত্র। চিন্তাগুলো দানা পাকিয়ে উঠছে। অ্যাক্টিভিজম আর্ট হিসেবে এগুলো অনেক বড় কিছু হয়েছে এমন দাবী না করা গেলেও বলা যায় এগুলো দর্শকের মনোযোগের দাবী রাখে, দাবী রাখে আলোচনার ও সমালোচনার। আমরা সেটাই চাই। সত্যিকারের আলোচনা সমালোচনা দিনে দিনে আমাদের এই শিল্প-প্রয়াসকে করে তুলবে আরও শাণিত, আরও সুনির্দিষ্ট, আরও লক্ষ্যভেদী।
আমরা জানি আমাদের পাড়ি দিতে হবে আরও অনেক পথ, আমাদের ডুবতে হবে আরও অনেক গভীরে।
আমি তবু বলিঃ
“এখনও যে-ক’টা দিন বেঁচে আছি সূর্যে-সূর্যে চলি,
দেখা যাক পৃথিবীর ঘাস
সৃষ্টির বিষের বিন্দু আর নিষ্পেষিত মনুষ্যতার
আঁধারের থেকে আনে কী ক’রে যে মহা-নীলাকাশ,
ভাবা যাক—ভাবা যাক-
ইতিহাস খুঁড়লাই রাশি-রাশি দুঃখের খনি
ভেদ ক’রে শোনা যায় শুশ্রুষার মতো শত-শত
শত জলঝর্ণার ধ্বনি।”
–জীবনানন্দ

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>