Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,anif rubed story iraboti

ইরাবতী গল্প: করোনার কঙ্কাল । আনিফ রুবেদ

Reading Time: 5 minutes

১. রূপকথা

একটা খাঁচা ঝোলানো আছে। দুটো দরজা এ খাঁচাতে। মাঝখানের দণ্ডে পাখি বসে আছে। পাখির সামনে দরজা। পিছনে দরজা। দুটো দরজায় খোলা। পাখি বের হচ্ছে না। পাখি দানা খাচ্ছে। ঝিমুচ্ছে। ঝিমুনি থেকে জেগে উঠে দানা খাচ্ছে আবার। দানা খাওয়া হলে আবার ঝিমুচ্ছে। পাখির উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, শীত বয়ে যাচ্ছে, কষ্ট পাচ্ছে তবু বের হচ্ছে না। পায়ের আঙুল দিয়ে প্রাণান্ত হয়ে চেপে ধরে আছে দাঁড়। কিন্তু একসময় বিরাট একটা ঝড় এলো আর পাখিকে ঠেলে বের করে দিল সামনের দরজা দিয়ে। ঝড়ের ধুলো একটু পরিস্কার হতেই দেখা গেল নতুন পাখি এসে হাজির হয়েছে খাঁচার ভেতরে। পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকেছে নতুন পাখি। এ পাখির জন্যেও একই ব্যাপার ঘটবে।

২. ইতিহাস

প্রতিটা মানুষ যুদ্ধে যুক্ত। জগতের প্রতিটি জীব আর জড় যুদ্ধে যুক্ত। জগতের প্রতিটি কণা যুদ্ধে যুক্ত। মানুষের কথা বলি। মানুষ টিকে থাকার যুদ্ধে লিপ্ত। কিন্তু টিকে থাকা হয় না এক মুহূর্তও তার আগেই কবর তাদের খুঁজে বের করে নিজের পেটের ভেতর ঢুকিয়ে নেয়। কবরও টিকে থাকার লড়াই করে কিন্তু তার আগেই নতুন কবর এসে ষাঁড়ের মতো লাফিয়ে পড়ে পুরাতন কবরের গায়ে। এক কবর আরেক কবরকে দেখে ডরাই। কবরে কবরে লড়াই চলে। মানুষ কবরকে দেখে ডরাই। মানুষকে দেখে জগতের আর সব জীবেরা ডরাই। অন্যসব জীবদের দেখে গাছ পালারা ডরাই। সবাই সবাইকে খেয়ে নেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। এর মধ্যে সবচে আশ্চর্য আর আজব আর ভয়ঙ্কর যে মানুষও মানুষকে খেয়ে ফেলে।

তবু এগুলোকে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়ে আছে। শত বেদনার ভেতর থেকে বেদনা কিভাবে একটু কম পাওয়া যেতে পারে তার কসরত করতে করতে বেঁচে থাকছে। মানুষ মানুষ দ্বারা অপমানিত হচ্ছে, প্রকৃতি দ্বারা অপমানিত হচ্ছে। অপমানিত হতে হতে কে কতটা কম অপমানিত হচ্ছে তার হিসাব করতে করতে বেঁচে থাকছে। যতটা কম অপমান হওয়া যায় বা যতটা বেশি অপমান ভুলে থাকা যায় তার চেষ্টা করতে করতে মানুষ চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে, সূর্যের কিরণের গায়ে গা ঘষে। চাঁদের কাছে ব্যথা পেলে সূর্যের কাছে বিচার দেয়, সূর্যের কাছে ব্যথা পেলে চাঁদের কাছে বিচার দেয়। চাঁদ সুরুজ দুবারই খুব করে হেসে নিয়ে থুথু ফেলে। মানুষ মনে করে জোছনা, মানুষ মনে করে রোদ। চাঁদের থুথু, সূর্যের থুথু গায়ে মেখে থাকতে থাকতেই মানুষ অভ্যস্ত হয়ে নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে আছে।

৩. খবর

এবার ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে গেল। করোনা ভাইরাস মরণকাঠি নিয়ে জগতে হাজির হয়েছে। মানুষের ফুসফুস দখল করে নিয়ে মাতলামী করে। বাইরের বাতাসকে মানুষের ভেতর ঢুকতে দেয় না। ডাঙায় উঠে পড়া মাছের মতো মানুষ দম বন্ধ হয়ে তড়পাতে তড়পাতে মরে যাচ্ছে।

পৃথিবীতে মৃত্যুজল বেড়ে গেছে প্রচন্ডভাবে। কবরের বন্যা ঘরের ভেতর ঢুকে গিয়ে তার জীভ দিয়ে টেনে নিচ্ছে মানুষকে। মানুষ দিশাহারা। হাজার হাজার মানুষ, লাখে লাখে মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে কবরের তলায়, আগুনের পেটে। প্রতিদিন খবর আসছে, ইতালিতে কত হাজার মরল, ফ্রান্সে, আমেরিকায় কত মরল, চীনে, জাপানে কত মরল। মানুষ মানুষের মরণের হিসাব করতে করতে ক্লান্ত। মানুষ আতঙ্কিত। যে লোকটা আজ মৃত্যুর হিসাব করছিল পরদিন দেখা গেল সেই ঐ সংখ্যাতে যোগ হয়ে গেছে। হতবিহ্বল মানুষ অপেক্ষা করে আছে তার ভাগ্যে কি আছে তাই দেখার জন্য। আর কিছু করার নেই। এই ভাইরাসের উপযুক্ত ওষুধ বাহির হয়নি। পুরাতন ওষুধ দিয়েই কোন রকমে চিকিৎসা চলছে। কেউ বাঁচছে কেউ মরছে। যে মরেছে সে আর মরবে না, যে বেঁচে আছে সে মরবে, সে মরণের আতঙ্কে আছে।

এবার এ দেশেও করোনা ভাইরাস আক্রমন করেছে বলে খবর হয়ে গেল। সব মানুষ আতঙ্কিত। কিন্তু জোরেশোরে যে খবর প্রচার হলো তা হচ্ছে, এ ভাইরাসে বেশিরভাগ বৃদ্ধরা মারা পড়ছে। শিশু, তরুণ, যুবকেরাও আক্রান্ত হচ্ছে কিন্তু তারা মারা যাচ্ছে কম। বিভিন্ন দেশের সরকার বৃদ্ধদের চিকিৎসা দেবার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করছে। তাদের বক্তব্য, বৃদ্ধরা বহুদিন বেঁচে থাকল তাদের আর বেঁচে থাকার দরকার নাই। তারা বিনা চিকিৎসাতেই বেঁচে থাকতে পারলে পারুক নইলে যাক। সরকার পক্ষের এমন মনোভাবের খবর শুনে রীতিমত অবাক হলো আর আতঙ্কিত হলো আর অপমানিত হলো বৃদ্ধ মানুষেরা। তারা ভাবল, আমাদের গায়ের চাম দিয়ে, ঘাম দিয়ে দুনিয়া গড়ে উঠল আর আমাদের প্রতিই এই ব্যবহার!

৪. গল্প

বাইরে করোনা আর মৃত্যু আর মানুষের গতি আর সরকারের মতি নিয়ে অনেকগুলো খবর হা করে গিলে নিয়ে বাড়িতে ঢুকেই আনসার আলি হাঁপাতে লাগল। রমেসা তার স্বামী আনসার আলিকে দেখে এগিয়ে আসে। রমেসা তাকে তার অস্থিরতার কারণ পুছ করে। আনসার আলি কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। বিষন্নভাবে রমেসার দিকে তাকায়। রমেসা আনসারের দিকে তাকায়। তাদের চোখ মিলিত হয়। আনসার ধীরে ধীরে বাইরের খবর বলে। বাইরের খবর ধীরে ধীরে রমেসার ভেতর ঢুকে। রমেসার ভেতর খবর ঢুকতেই সেও হাঁপাতে থাকে অস্থিরতায়।

তারা খবর হজম করার চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে খবর হজম হয়। তারা শান্ত হয়ে আসে। আনসার রমেসার দিকে তাকায়, রমেসা আনসারের দিকে তাকায়। আনসার রমেসার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। কতদিন পর আনসার তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। কবে তারা শেষ হাত ধরাধরি করেছে তা মনে পড়ছে না। তাদের একসাথে থাকার বয়স চল্লিশ হয়ে গেছে। যৌনতা ধীরে ধীরে মৌনতা পেয়েছে কখন তা তারা টের পায়নি। ভালোবাসা কখন শুধু কর্তব্যে পরিণত হয়েছে তা তারা বুঝতে পারেনি। রমেসা আনসারের কাঁপা কাঁপা হাতের ভেতর নিজের হাত তুলে দেয়। দুটো হাত কাঁপছে। আনসার বলে, চল রমেসা আমরা বাগানে হাঁটতে যাই। বাগানে গাছ দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষ হাঁটে। এ এক অদ্ভুত। তারা দোতালা থেকে নামে।

বাগানে গাছ দাঁড়িয়ে আছে। গাছেরও হাঁটা আছে। গাছ মাটির নিচের দিকে হাঁটে। মানুষ মাটির উপর দিয়ে হাঁটে। মাটির নিচে গিয়ে স্থির হয়। পাখি হাঁটে আকাশে, হাঁটে গাছের ডালে, হাঁটে মাটিতে। আনসার আর রমেসা হাত ধরাধরি করে বাগানে এলো। একটা প্রজাপতি উড়ে এসে বসল আনসারের গায়ে। হেসে উঠল রমেসা, আরে তোমার আবার বিয়ে হবে নাকি! প্রজাপতি বসলে বিয়ে হয়। আনসার হাসে। সে প্রজাপতির দিকে তাকায়। প্রজাপতি উড়ে গিয়ে রমেসার মাথায় বসে। আনসার হেসে ওঠে, তোমারও তো বিয়ে হবে দেখছি। প্রজাপতি উড়ে গিয়ে ফুলের উপর বসে, ফুল দুলে ওঠে। দুজনে হাসতে হাসতে হাতহালি, আরে ফুলদেরও বিয়ে হবে।

তারা হাঁটছে। বড় প্রজাপতির মতো একটা পাতা, হলুদ পাতা উড়ে এসে পড়ল তাদের পায়ের কাছে। আনসার পাতার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি ভেবেছিলাম বড় কোনো প্রজাপতি বা হলুদ পাখি উড়ে এসে পড়ল কিন্তু না এটা একটা পাতা, আমগাছের হলুদ পাতা। আমগাছের হলুদ পাতা খুলে পড়ে গেল।

রমেসা একটা গোলাপ গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আনসার সেখানে যেতেই বলে উঠল, আরে গোলাপের পাতা দেখতে কী সুন্দর! গোলাপের আড়ালে এতদিন পাতার রূপ ঢেকে ছিল। গোলাপের দিকে তাকাতে তাকাতে মানুষ গোলাপের পাতা দেখার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়। এবার আনসারের একটা গোলাপের দিকে চোখ গেল, সে রমেসাকে বলল, দেখ, গোলাপ কত সুন্দর, আগে যতটা সুন্দর মনে হতো তার চেয়েও হাজার গুন সুন্দর। ছোট একটা নিমগাছে একটা কচি পাতা ছিঁড়ে শুঁকে দেখে রমেসা। আরে নিমপাতার গন্ধও বেশ, পাতার ডিজাইনটাও কত চমৎকার।

একটা ফড়িং উড়ে এলো কোথা থেকে। রমেসা কিশোরীর মতো ফড়িংয়ের পিছে ছুটতে লাগল। আনসার ছুটতে লাগল রমেসার পিছন পিছন। তারা সারা বাগান জুড়ে নবীন কিশোর কিশোরী হয়ে ঘুরে, যা দেখে তাতেই আনন্দ পায়। যেন তারা এর আগে কখনো গাঁদা ফুলের গাছ দেখেনি, পিঁপড়ের সারি দেখেনি, কাঠবিড়ালির লেজ দেখেনি। যা দেখে তাই দেখে হাততালি দেয়।

তারা ক্লান্ত হয়ে এক সময় বসে। চুপচাপ বসে থাকে। শ্রান্ত হয়ে বসে থাকে। আনসার কথা শুরু করে রমেসার দিকে তাকিয়ে, বউ তুমি কি নেবে, পাট না নাইলন? রমেসা বলল, পাট নিব। আনসার বলল, আমিও পাট নিব। তারা বিষন্ন হয়ে পরস্পরের দিকে তাকায়। তাদের চোখে বিষাদ। তাদের ঠোঁটে কাঁপুনি। তারা আরো কিছু সময়কে তাদের উপর দিয়ে বয়ে যেতে দেয়। সময় বয়ে যায়। সময়ের শব্দ তারা কান পেতে শোনে।

এবার রমেসা কথা বলে ওঠে, দিন নিবে না রাত নিবে গো বুড়া? আনসার বলে, রাত নিবো। রমেসা বলল, আমিও রাত নিবো। আনসার বলল, কখনের রাত নিবে, আমি আজকের রাতই নিব গো বুড়ি।  রমেসা বলল, আমিও আজকের রাতই নেব।

চারদিকে লকডাউনের গুমোট। রাস্তায় রাস্তায় ছুঁচো, বিড়াল, কুকুরের পদচারণা। মানুষ নাই। মানুষ তাদের ভয়ের ভেতর মরে পড়ে আছে, মানুষ তাদের আতঙ্কের ভেতর মরে পড়ে আছে। চারদিক থেকে প্রচুর খবর আসছে। খবরের কোষ বিভাজন হচ্ছে জ্যামিতিক হারে, ব্যস্তানুপাতিক হারে। করোনার আঘাতে মানুষ মারা যাচ্ছে, খবরের আঘাতে মানুষ মারা যাচ্ছে। শ্বাস নিতে না পেরে মানুষ মারা যাচ্ছে। মারা গিয়ে মানুষ শ্বাস নিতে পারছে না। মরে গেলে শ্বাসের আর দরকার নেই।

আনসার আর রমেসা বহুক্ষণ আবার চুপচাপ বসে আছে। আবার মুখ খোলে আনসার, ডাল নিবে না সিলিং নেবে বুড়ি? রমেসা বলে, তুমি কি নিতে চাও? আনসার বলে, আমি ডাল নিতে চাই। রমেসা বলে, আমিও ডাল নিব।

তারা ঘাসের উপর বসে আছে। সন্ধ্যা আসছে। তারা সন্ধ্যার গায়ের গন্ধ পাচ্ছে। এক পরত অন্ধকার পড়ল তাদের উপর। তারা বসে আছে। আরেক পরত অন্ধকার পড়ল তাদের উপর। আরেক পরত তারপর আরেক পরত তারপর আরেক পরত পড়তে থাকল অন্ধকার… পড়তে থাকল অন্ধকার… ঝপাঝপ অন্ধকার পড়ছে…

৫. কল্পিত গল্প

তারপর কয়েকমাস কেটে গেছে। এ বাড়িতে কোনো মানুষ আসেনি। এ বাড়ি থেকে কোনো মানুষ বাইরে যায়নি। করোনার ভেতর গুম হয়েছিল মানুষ। এখন কিছুটা কমেছে রোগের প্রকোপ। চারদিকে প্রচন্ড- খাবারের অভাব। এক চোর পাঁচিল টপকে এ বাড়ির ভেতর ঢুকে। ঢুকেই সে দেখতে পায় সামনের আমগাছটার ডালে পাটের দড়িতে দুটো কঙ্কাল ঝুলে আছে, বাতাসে নড়ছে। চোরটা মূর্ছা যায়। চোরটা বহুদিন ধরে ভালো করে কিছু খেতে পায়নি। শরীর দুর্বল। এ মূর্ছা যদি না ভাঙে তবে তাকে আর কোনোদিন চুরির চেষ্টা করতে হবে না। যদি আরো কিছুদিন পর কেউ এ বাড়িতে ঢুকে তবে তিনটি কঙ্কালের হিসাব তারা কেমন করে মেলাবে কে জানে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>