Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

আনোয়ারা সৈয়দ হক : অস্বীকৃত সফলতা

Reading Time: 4 minutes

আজ ০৫ নভেম্বর চিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হকের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


 

মফিদুল হক

আনোয়ারা সৈয়দ হক, ঝকঝকে নামের ধারালো ব্যক্তিত্বের মানুষটি বহু গুণের অধিকারী। সেটা যেমন তাঁর যোগ্যতা, তেমনি তাঁর দায়ভারও বটে। বাংলাদেশের নারীদের অর্জনের একটি মাপ সমাজ নির্ধারণ করে রেখেছে, সেই লক্ষণরেখা যাঁরা পেরিয়ে যান তাঁরা সাফল্যের পাশাপাশি নিজেদের জন্য বিপদও তৈরি করেন। সেই সাফল্য ও বিপদ দুই-ই আনোয়ারা সৈয়দ হককে সর্বদা অনুসরণ করে চলেছে। ফলে তাঁকে বুঝতে কিংবা জানতে সমাজ অনেক ভুল করেছে, অন্যদিকে নানা সাফল্যের আড়ালে বহুমাত্রিক বহুবর্ণিল মানুষটিকে সঠিকভাবে জানা কখনো হয়ে ওঠেনি। এখানে আমরা সাফল্যের এই সমস্যার ওপর কিঞ্চিৎ আলোকপাত করে বুঝতে চেষ্টা করবো আনোয়ারা সৈয়দ হককে।

তিনি চিকিৎসক হিসেবে উচ্চ দক্ষতা ও কৃতিত্বের অধিকারী। মনোচিকিৎসায় আমাদের দেশে পথিকৃৎদের একজন। বিলেতে বিভিন্ন হাসপাতালে কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করেছেন, উচ্চতর ডিগ্রিও অর্জন করেছেন। তবে পেশাগত সেসব ডিগ্রির কথা, এতকাল তাঁর সঙ্গে চলেও, কখনো আমরা জানতে পারিনি। দেশে ফিরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বারডেম হাসপাতালসহ বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন, মনোচিকিৎসক হিসেবে খ্যাতিও পেয়েছেন, তবে প্রাইভেট প্র্যাকটিস বা নিজস্ব চেম্বার-কেন্দ্রিক ব্যবসা গড়ে তুলতে কখনো বিশেষ আগ্রহী বা উদ্যোগী হননি।

উদ্যোগী যে হননি তার প্রধান কারণ পেশায় চিকিৎসক হলেও মনেপ্রাণে তিনি একজন লেখক। পেশায় তাঁর কোনো অবহেলা ছিল না, কিন্তু জীবনের ধ্যান-জ্ঞান সেটা নয়। মনের অসুখ দূর করার যে বিদ্যা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন সেটা তাঁর লেখক-সত্তার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল, কেননা সাহিত্যে তো মানুষকে নিয়েই চলে কারবার, আর মানুষকে যেমন বাইরের বৃহত্তর জীবনের পটভূমিকায় বিচার করতে হয়, তেমনি মনের গহিনেও লেখককে ডুব দিতে হয়। সেই বিচারে আনোয়ারা সৈয়দ হকের পেশা ও নেশার একটা মিল কোথাও ঘটে গিয়েছিল। বিশেষভাবে তাঁর উপন্যাসে আমরা দেখি তিনি ক্রমেই মানুষের, বিশেষভাবে নারীর, অন্তর্জগতের রূপকার হয়ে উঠেছেন। ‘নিঃশব্দতার ভাঙচুর’ কিংবা ‘নখ’ উপন্যাসে তিনি পাঠককে যে অতলে টেনে নিয়ে যান তা তুলনারহিত। আবার তাঁর চরিত্রসমূহ আমরা যদি বিবেচনায় নেই, সেটাও মধ্যবিত্ত অথবা উচ্চবিত্তে সীমিত নেই, তিনি নিচুতলার মানুষের জীবনও জেনেছেন ঘনিষ্ঠভাবে, যার সাক্ষ্য দেবে তাঁর বিভিন্ন রচনা।

যশোরের চুড়িপট্টি গলির ব্যবসায়ী পরিবারের এই কন্যা ছিলেন, বলতে গেলে, প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী, অকালে ঝরে যাওয়া ছিল যে পরিবারের সন্তানদের শিক্ষার স্বাভাবিক পরিণতি। সেখান থেকে আনোয়ারা যে ঢাকায় এলেন মেডিকেল কলেজে পড়তে সেজন্য তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছিল দীর্ঘ পথ। তিনি সফলতার সঙ্গে সমাপ্ত করলেন চিকিৎসা-বিদ্যার শিক্ষা, উচ্চতর ডিগ্রিও অর্জন করলেন বিদেশ থেকে এবং পেশায় অর্জন করলেন খ্যাতি। সদাতুষ্ট সদালাপী সদাপ্রফুল্ল এই মানুষটিকে দেখে বোঝার উপায় থাকে না তিনি কোনো কঠিন পথ পেরিয়ে পৌঁছেছেন আজকের অবস্থানে। তিনি নিজে থেকে না বললে এসব জানাবার কোনো উপায়ও থাকে না। তাঁর কৈশোর জীবনের স্মৃতিগ্রন্থ ‘নরক ও ফুলের কাহিনী’ এক অজানা বালিকার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় যে বলেছিল, ‘এক হাতে ফুলের গন্ধ, আরেক হাতে নরকের দুর্গন্ধ মেখে আমার জন্ম।’

অসামান্য এক সূচনা লেখকের ছেলেবেলার কথকতার, যাকে তিনি বলেছেন কালবেলা, লিখেছেন : ‘আমি জন্মেছিলাম এক শীতের প্রারম্ভে, হেমন্তের শেষ বেলায়, বিবর্ণ পাতা ঝরার দিনে। পেটে দুরন্ত এক খিদে নিয়ে জন্মেছিলাম আমি। জন্মের কিছুদিন পরেই এক অজানা চর্মরোগের আক্রমণে হয়েছিলাম ধরাশায়ী। সমস্ত শরীর আমার আবৃত হয়েছিল দগদগে ঘায়ে। ছোট্ট শরীরে সর্ষে পরিমাণ জায়গাও ছিল না আমার শরীরটিকে চোখে দেখার এবং প্রশংসা করার। অবস্থা আরো করুণ হলে, তরুণী মা আমার ঘৃণাভরে যেন আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন। তুলে দিয়েছিলেন বড়মার হাতে।’

মেডিকেলের শিক্ষা সমাপন করে যখন পেশাগত তরক্কির সোপানে পা রাখার কথা তখন আনোয়ারা প্রেমের বন্ধনে জড়িয়ে বিয়ের পর হলেন আনোয়ারা সৈয়দ হক। সাহিত্যিক হওয়ার নেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ পরিত্যাগ করে সৈয়দ শামসুল হক তখন প্রচলিত অর্থে বেকার, পূর্ণ সময়ের সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর, আর বাস্তবে কঠিন ক্ষয়রোগে আক্রান্ত। য²াক্রান্ত এমন এক তরুণকে ভালোবাসার মতো তরুণী অনেক মিলবে, কিন্তু তাঁকে বিয়ে করার ঝুঁকি কে নেবে! সবাই যেখানে দ্বিধাগ্রস্ত আনোয়ারা সেখানে ঝাঁপ দিতে কালক্ষেপ করেন না, তবে তাঁকে দেখে তেমনটা বোঝার উপায় থাকে না।

ব্যক্তিত্বের এই মহিমা আনোয়ারা সৈয়দ হকের লেখক সত্তায়ও অন্তর্নিহিত রয়েছে, তবে সেই সত্তার হদিস খুব যে আমরা করেছি তা বলা যাবে না। নারী এবং তার শরীর, সেই সাথে সমাজ-সংসার মিলিয়ে যেভাবে আনোয়ারা সৈয়দ হক অবলোকন করেছেন জীবন তা বিশেষ আলোচিত হয়নি, এমনকি তাঁর উপন্যাসসমূহ বিশেষ পঠিতও হয়নি, অন্তত কতক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের প্রকাশক হিসেবে এটা তো আমার ভালোভাবে জানা রয়েছে।

‘নিঃশব্দতার ভাঙচুর’ আনোয়ারা সৈয়দ হকের লেখার অনন্যতা মেলে ধরে, তিনি চরিত্রের কোন গহিনে ডুব দিয়ে মানবসত্তার জটিলতা অনুভব করতে পারেন তা পরিস্ফুট হয় তেত্রিশ বছরের অবিবাহিত সংগ্রামী ও সংবেদনশীল রাবেয়া চরিত্রে। সমকালীন বাংলাদেশে নানা উত্থান পরিবর্তনের মধ্যে উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীদের স্থাপন করে জীবনের সারসত্য বুঝে নিতে চান আনোয়ারা সৈয়দ হক। এমন প্রয়াস আমাদের সব লেখকেরা নেন না, আনোয়ারা সৈয়দ হক নিয়েছেন, সেটাই বুঝি তাঁর সাফল্য ও ব্যর্থতা। এর মাত্রা কিছুটা বোঝা যাবে উপন্যাসের রাবেয়া চরিত্রের বয়ানে, যা এই উপন্যাসের বড় সম্পদ। তিনি লিখেছেন : ‘এই পৃথিবীতে রাতের একটা নিজস্ব ভাষা আছে, যা প্রতিটি দিনের চেয়ে আলাদা। একটি দিনে যা এলোমেলো ছড়ানো, একটি রাতে তা পাটির মতো মসৃণ হয়ে গুটিয়ে চলে আসে। প্রতিটি রাতের এক নিজস্ব সৌরভ আছে, যা অতীত থেকে খুঁড়ে বের করে আনে ঝরা পাতার গন্ধ। রাত এখন অনেক হয়েছে বটে, এই রাতটিকে ঘিরে চারপাশে এখন নিস্তব্ধতার গমগম শব্দ।’

‘খাতা ভর্তি বড় বড় গোলাকার এঁকে চললো রাবেয়া। তার হঠাৎ মনে হলো, মানুষের জীবন ও মৃত্যুতে শূন্যের এক বিশেষ স্থান আছে। একেবারে শূন্য থেকে মানুষের জীবন হয় শুরু এবং অতি দ্রুততার সাথে সে জীবন শেষ হয়ে শূন্যে হয় বিলীন। খুব ছোট শূন্য থেকে বৃহৎ শূন্যে মানুষের যে ক্রমাগত যাতায়াত সেই সকল ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শূন্যদের একত্র করার দায় পড়েছে যেন রাবেয়ার। একটি ক্ষুদ্র শূন্যের সাথে সে মেলাচ্ছে বৃহৎ এক শূন্যের, তারপর আবার একটি ক্ষুদ্র শূন্যের সাথে আরো এক বৃহৎ শূন্য। এইভাবে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ বহু শূন্য একত্র হয়ে গড়ে তুলছে এক অভিনব শূন্যতার প্যাটার্ন। মেয়ে কলিগদের কথা এই সময় মনে পড়তে লাগল তার। বেশ কয়েকটি শূন্য নিয়ে ঘর-সংসার গড়ে তুলেছে তারা। সেই শূন্যগুলোর কেউ তাদের স্বামী, কেউ সন্তান, কেউ সংসার, কেউ জীবন। চাঁদনি চক, মোজা, গাউসিয়া, পাঞ্জাবি, নিউমার্কেট, সুঁই-সুতো, মুখ খিস্তি, কাজের বেটির শাড়ি, ফুটপাতের ব্রা, আন্ডারঅয়ার এইসব মিলে চমৎকার এক শূন্যের জীবন।’

মনে হতে পারে আনোয়ারা সৈয়দ হক সিরিয়াস ধরনের লেখক যাদের রচনা খুব একটা পাঠকপ্রিয়তা পায় না। তবে পাশাপাশি আমাদের স্মরণ করতে হয় তাঁর রচনার হিউমার, যা অনেক সময়ে নবনীতা দেব সেনকে মনে করিয়ে দেবে। তবে রস-রচনা আনোয়ার সৈয়দ হক বিশেষ লেখেননি, রম্যরচনায় তিনি মাঝেমধ্যে ব্রতী হয়েছেন, আর এই হিউমার চমকপ্রদভাবে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কিশোর গল্প-উপন্যাসে। তাঁর সৃষ্ট ছানা-চরিত্র এবং সিরিজগ্রন্থ সেই পরিচয় বহন করে। এ ছাড়া রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক কৈশোর গল্প-উপন্যাস। লেখক হিসেবে তিনি বহুমাত্রিক এবং কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন অনেকভাবে, তবে সেসব দিকে সাহিত্যব্রতীদের নজর পড়েছে কম।

আনোয়ারা সৈয়দ হকের সাফল্য অনেক, প্রচলিত বৃত্ত তিনি নানাভাবে ভেঙেছেন, কিন্তু সেই স্বীকৃতি তাঁর মেলেনি। কেন তা আমার জানা নেই, হয়তো সাফল্যই তাঁর কাল হয়েছে, একজন নারীর এত কৃতিত্ব স্বাভাবিকভাবে গ্রহণের সমাজ মানসিকতা বুঝি এখনো আমাদের গড়ে ওঠেনি। অর্গলমুক্ত মানুষদের বিধিলিপি তাই রক্ষণশীলতার শিকার হওয়া, তবুও সৃষ্টিশীলতার জয়যাত্রা থাকে অব্যাহত, সেখানেই বিজয়ী আনোয়ারা সৈয়দ হক।

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>