| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ছোট গল্প : অন্ধকারের বাজার । মাহবুব আলী

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

সখি ব্যবসার কী বোঝে? তার বয়স হেসে খেলে বেড়াবার। তবু অতোটুকু মেয়ে বসেছে। দু-তিন দিন ধরেই বসছে। মা অবশ্য কিছুক্ষণ সঙ্গে থাকে। দোকান সাজিয়ে দেয়। তারপর চলে যায় কাজে। দুপুরে ফেরার পথে খাবার দিয়ে যায়। খোঁজখবর নেয়। সখি একাই দোকান চালায়। বিকেলে সবকিছু গুটিয়ে ফিরে চলে। আজ সে একা দোকান সাজিয়েছে। এপ্রিলের চড়া দিনে বাহাদুর বাজারের এই একটি কোণ প্রায় নিরিবিলি-জনবিরল। প্রচণ্ড রোদ। অসহনীয় তাপ। একটি আধছেঁড়া ছাতা দিয়ে সূর্যকে যতটুকু আড়াল করা যায়, চেষ্টার কমতি নেই। তার দৃষ্টি রাস্তার দিকে। জনমানুষের চোখে-মুখে। যদি একজন ক্রেতা জোটে। সামনের কলাঅলার মতো মাঝে মধ্যে সরু কণ্ঠে হাঁক দেয়।

‘ভালা তরমুজ সার, লইয়া যান; এক্কেরে তাজা লাল টকটইকা।’

‘বলিস কি! মিষ্টি হবে? কেজি কত?’

‘মিষ্টি না হইলে টাকা ফেরত মানে মানি-রিটান।’

সখি দু-একটি ইংরেজি শব্দ বলতে পারে। আজকাল হিন্দি ছবিতে এমন অনেক ডায়লগ। শিখতে কতক্ষণ! ফুটপাতে নিজের দোকানে বসে-বসেই কখনো মার্কেটের শো’রুমে তাকায়। টিভিতে চোখ রাখে। ওখানে পাঁচ-ছয়টি টিভি চলে। প্রায় সময় হিন্দি ছবি। বিজ্ঞাপন হয়। সুন্দর সুন্দর মেয়েরা নাচে। সে দেখে। নানারকম নতুন কিছু শেখে। কতকিছু বিক্রির ফ্রি অফার! একটি নিলে অন্য একটি ফ্রি। মানি রিটার্ন খুব চালু কথা। মানি রিটার্ন মানে মূল্য ফেরত। সেখান থেকেই শিখেছে এই টেকনিক। মনে ধরা কথা বলতে হয়। এতে গ্রাহক খুশি থাকে। এখন সামনে এক গ্রাহক।

লোকটির চোখে ভারী চশমা। অকাল বার্ধক্যে পড়ো পড়ো মুখ। সে চেহারায় হাসি মানায় না। তবু আয়েস করে হাসে। একটি তরমুজ হাতে তুলে নেয়। প্রতিটি ফলের গায়ে দাগ কেটে ওজন লেখা। সনাতন হিসাব। এখন দুর্বোধ্য লাগে না। সখি জানে। চার আর এক দাঁড়ি। তিন আর দুই দাঁড়ি। তিন আর সঙ্গে বাংলা দ’এর দাগ। কয়েকটি তরমুজ। বিক্রি তেমন নেই। মনে আশা, শ দেড়েক টাকা জমলে দোকান গুটিয়ে ফেলবে। বাবার জন্য ছোট একটি পাউরুটি আর দুটো কলা কিনবে। বাবার খুব অসুখ। সকালে কাহিল দেখায়। সারারাত ঘুমোয়নি। কাশির গমকে বারবার উঠে বসে। সেও জেগে যায়। আলো-আঁধারের দেয়ালে হাঁসফাঁস ছায়া। জীর্ণ শরীরের সঙ্গে চেপে বসা পেট। চোখ-মুখ শুকনো। কোটরের ভেতরে দু-চোখের মণি। মলিন চেহারায় জ্বলজ্বল করে। মনে হয় সত্তর-আশি বছরের বুড়ো। সখির খুব মায়া হয়। বাবার কষ্ট। কি কষ্ট! সে মায়ের সঙ্গে উঠে বসে। বাবার মাথায় হাত বুলোয়। কিন্তু বাবা বকে। তাই আবার শুয়ে পড়ে। তাকিয়ে তাকিয়ে নিশ্চুপ কষ্ট দেখে যায়। বাবাকে কোনো কষ্ট করতে দেবে না। সে এখন বড় হয়েছে। অনেক কাজ করবে।

কয়েকদিন ফুটপাতে দোকান বসানো হয় না। বাবা অসুস্থ শরীরেই পশরা সাজিয়ে বসতো। সেদিন দুপুরে আকস্মিক ঘরে ফিরে আসে। ভালো লাগছে না। কাশি বেড়েছে। নিশ্বাসে হাঁসফাঁস। অসুস্থ মানুষের কাছে কোনোকিছু কিনতে চায় না গ্রাহক। সখি পরের কয়েকদিন দোকান চালায়। মা কিছুক্ষণ থাকে। আজ মা থাকবে না। যে বাসায় রান্নাবান্নার কাজ করে, সেখানে বেতন আনতে যাবে। ফিরতে দেরি হতে পারে। সখি ভোররাতে এসব শুনে কাজ ঠিক করে নেয়। আজ একাই দোকান সাজাবে। বাবা বলে, আজ ফুটপাতে না বসলে কি? কিন্তু সে একটু তর্ক করেই বের হয়ে আসে। আড়তে গিয়ে দশ-পনেরোটি তরমুজ কেনে। তারপর রিকশা ডেকে চলে আসে বাজারের নির্ধারিত জায়গায়। ফুটপাতের দোকান। অবশেষে বাবা ভাঙা গলায় সাবধান করে দেয়। সখির আবার মনে পড়ে।

‘বুইজা বিক্রি করবি মা। গাহাক যেন অন্যহানে না যায়। পারবি তো?’

‘হ হ পারুম বাবা। আমারে পারতেই হইব।’

‘পারব। তুমার লগে থাইকা শিখছে তো। বড় হইছে না বেডি।’

‘হেইডাই তো ভয়। দিনদুনিয়া ভালা না। চারপাশে শুধু শেয়াল আর কুকুর।’

সখি মাঝখান থেকে মায়ের কথাই শুনতে পায়। সে নিশ্চিত, বরং বাবার থেকে ভালো বেচাবিক্রি করতে পারবে। আগে বাবার অন্য ব্যবসা ছিল। দাঁতের-মাজন সুগন্ধি-তেল আর কি কি সব। ট্রেনে বাসস্ট্যান্ডে বিক্রি। ট্রেনে চড়ে দূর-দূরান্ত যায়। তখন তারা বাংলামটর বস্তিতে থাকে। তারপর সবাই একদিন দিনাজপুর চলে আসে। নতুনপাড়ার বস্তিতে ঠাঁই নেয়। অনেকদিন আগের কথা। মা তখন বালুয়াডাঙ্গার এক বাড়িতে কাজ শুরু করে। বাবা সকালের দ্রুতযান ঢাকা মেইল ধরে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত চলে যায়। সে-সময় সখি কোনোদিন মায়ের সঙ্গে রাত জাগে। পথ চেয়ে থাকে। তার বাবা ফিরবে।

এরপর বাবা দূরে যেত না। শক্তি-ক্ষমতা কমে গেছে। তখন শহরের রাস্তায় ভ্যানগাড়িতে কখনো কলা, কখনো আনারস, আম-কাঁঠাল ঠেলে ঠেলে হেঁটে হেঁটে বিক্রি। এভাবে চলে গেল কয়েক মাস। একদিন ভ্যান বেচে শুরু হয় ফুটপাতের দোকান। বাজারের একটি কোণ। এখন সবাই জানে বাহাদুর বাজারের এই জায়গা হুমায়ুন মিয়াঁর। সে এখানে নানারকম পণ্য নিয়ে বসে। বাজারের টোল দেয়।

এপ্রিলের কঠিন শুকনো দিন চলে যায়। মানুষজনের আকণ্ঠ পিপাসা। ঠান্ডা খেতে চায়। তাই তরমুজের ব্যবসা। প্রথমদিকে তরমুজের কিলো ছিল চার টাকা। এখন দুই-আড়াই। মুনশিপাড়ার আড়তে দুপুরে ট্রাক থেকে মাল নামে। হুমায়ুন মিয়াঁ সেখান থেকে পাইকারি কিনে নেয়। বাজারের নিজ কোনায় যত্ন করে সাজায়। তরমুজের সঙ্গে কখনো নারিকেল-পেঁপে-বেল নানান স্বাদু ফল। আজ সখি বসেছে ক’গণ্ডা তরমুজ নিয়ে। ব্যবসায় আবার ভাটা। সামনে হয়তো খারাপ দিন। সে বাবার জন্য অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে।

‘কি রে কোথায় চলে গেছিস? কত করে দিতে হবে বল্।’

‘দুই টাকা স্যার।’

সখি লজ্জা পায়। আজ মন ভালো নেই। কেমন অস্থির লাগে। অনেকদিন হলো বাবার সঙ্গে দোকানে বসেছে। বাবা স্টেশনের মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে কখনো কখনো সে একা হয়। নিশ্চুপ বসে থাকে। খারাপ লাগে না। বাবা তো কাছেই আছে। আজ বাবা ঝুপড়ি ঘরে শুয়ে-বসে অসহায়। অসুস্থ মানুষ। আজ তার কাছে থেকে অনেক দূরে। মন ভার-ভার অস্থির লাগে। গ্রাহক না থাকলে অদ্ভুত অস্বস্তি আরও বেশি হয়। সকালে দু-জন মাস্তান মতো যুবক ধমকে গেছে। টাকা চায়। বখরা। ওদের একজন মুন্না অন্যজন মিন্টু। কে যে মুন্না আর কে মিন্টু জানা নেই। তবে দু-জনই বেপরোয়া। সখি জানে, এরা চাঁদাবাজ। গরিব ফুটপাত ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে টাকা আদায় করে। রাজনীতির টোকাই। ঠাঁটবাটে থাকে। তাকে বলে, একশ টাকা দিতে হবে; নইলে তাদের সঙ্গে যেতে হবে। সখি এখন ইঙ্গিত বুঝতে শিখেছে। গেল ফাগুনে বারোতে পা। মা-বাবার কথায় কথায় তার মনও আড়ালে আরক্ত হয়। মার্কেটের সামনে কেউ কেউ মটরসাইকেল রাখে। গাড়ি রাখে। সে কখনো ওগুলোর ঝকঝকে আয়নায় নিজের মুখ দেখার চেষ্টা করে। সে যে দেখতে মন্দ নয়, স্নো-পাউডার পেলে আরও সুন্দর দেখাবে; এও জানা। সে তাই সবসময় সলজ্জ সপ্রতিভ। ভদ্রঘরের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কোনো-কোনো কিশোর তরমুজ কেনার ভান করে চোখ মারে। বলে, –

‘কি রে মিষ্টি হবে তো?’

‘হ ভাই মিষ্টি হইব। দেখেন না এক্কেরে লাল।’

‘একেবারে লাল…পেকে পেকে লাল! হি হি হি!’

সখি লজ্জায় মরো-মরো। ওড়না দ্রুত ঠিক করে নেয়। তারা পরস্পরের দিকে চোখ টেপাটেপি করে। তারা হাসতে হাসতে চলে যায়। সখি অপ্রস্তুত-বিব্রত। তবু দ্রুত সহজ হয়। এই জীবন…অথচ এমন হওয়ার নয়। সে একটু একটু বুঝতে পারে। এখানে মেয়েদের পদে-পদে বিপদ। তারা গরিব। অন্যরা বড়লোক। তার বয়সি মেয়েরা কত সুন্দর সেজে ঘুরে বেড়ায়। স্কুলে যায়। বই পড়ে। মার্কেটের দোকানে কত কি কেনে। তারা আকাশ থেকে নেমে আসা একেকটি পরি। কি সুন্দর হাসে! অন্যদিকে তার জীবন…কষ্টে বাঁধা।

সখি আরও ক’জন মেয়েকে দেখে। তাদের সাজগোজ বাড়াবাড়ি। ঠোঁটে গাঢ় লাল-গোলাপি-চকোলেট রং। তেল চপচপে চুল। চোখে অদ্ভুত রহস্যময় চাহনি। কখনো একেবারে অন্যরকম…যার ব্যাখ্যা নেই। পান খেয়ে ঠোঁট-মুখ লাল। উচ্চহাসি। চটুল গান। সখি অবাক হয়ে দেখে। ঘোর কাটে না। মা বলে, –

‘ওদের লগে কতা কবি না। খারাপ মাইয়া।’

‘মানুষে আবার খারাপ হয় মা? মানুষ হয় ভালা না হয় শয়তান। ওরা তো ববিতা-শাবানা।’

‘তুই কথা কইছস? আর কবি না। ওরা খারাপ মাইয়া। তুই বড় হ তহন বুঝবি।’

সখি বড় হয়েছে। সে এখন বোঝে, খারাপ মাইয়া কী? ওরা তো আসলে খারাপ না। কপালের দোষে নষ্ট পথে নেমে গেছে। তারা বাজারের মেয়ে। অচেনা মানুষের সঙ্গে শোয়। শরীর বেচে। অন্ধকার বাজারের মানুষ। ওদের কথা ভেবে বুকে গুমোট দুঃখ বাজে তার। বাতাসে বেদনার বাঁশি হু-হু ভেসে যায়। আহা! কেউ কি ইচ্ছে করে অন্ধকার পথে নামে? সব কপালের দোষ। না না মানুষের দোষ। মানুষের মধ্যে ভালো আছে…মন্দ আছে। মন্দ মানুষের কারণে ভালো মানুষ মন্দ পথে নেমে যায়। তাদের জীবন খুব কষ্টের। সখির দু-চোখ দূর রাস্তার মোড়ে আটকে থাকে। দু-জন মেয়ে বন্ধ এক দোকানের বারান্দায় বসে কিছু-একটা করে। কাগজে মোড়া কোনোকিছু খায়। এই মেয়েগুলো চেনা। কখনো রাস্তায় দেখা যায়। ওড়না বিছিয়ে ভিক্ষে করে। কখনো হাওয়ায় মিলিয়ে উধাও। ওদের বয়স একটু বেশি। তারা খারাপ মেয়ে।

লোকটি তরমুজ না কিনে চলে গেল। সখি পেছন থেকে ডাকতে গিয়ে কি ভেবে নিশ্চুপ থাকে। কেন জানি মন ঠিকমতো কাজে বসে না। অস্থির লাগে। কয়েকটি তরমুজ। কখন যে বিক্রি হয়। দু-টাকার কমে বেচা যাবে না। লস হবে। সে লস করতে চায় না। লসের জীবনে আর কত লস? সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে একটি হাঁক দেয়। এপ্রিলের তপ্ত বাতাসে ধুলো ওড়ে। বাজারের দক্ষিণ কোনে মিষ্টির দোকান। তার সামনের রাস্তায় পানি ছিটানো চলে। সেখান থেকে বয়ে আসা বাতাস হালকা ঠান্ডা। মনে হয় দাবদাহ নেই। আজ খুব গরম। সে বিকেলের শেষে ফিরে যাবে। বিক্রি খারাপ। একশ ত্রিশ টাকা হয়েছে মাত্র। দেড়শ টাকার জন্য অপেক্ষা করতে পারলে ভালো হয়। বাজারে টান। মন্দা বাজার। সে কথা বলে না। মন আকস্মিক ঘরে ফিরে যেতে আকুলি-বিকুলি অস্থির। আজ না এলেই বোধকরি ভালো হতো। জেদ করে আসা। বসে থাকা শুধু শুধু। বেচাবিক্রি নেই।

এখনো কয়েকটি পড়ে আছে। বিক্রি হবে কি না কে জানে। অবশ্য কিছু মানুষ বিকেলের দিকে বাজারে আসে। কেনাকাটা সারে। সখির মনে পড়ে বাবার ট্যাকটিস। একটু একটু করে শেখা। বাবা দাঁতের মাজন, নিদ্রাসুখ তেল বিক্রির সময় হেসে হেসে দৃঢ় গলায় বলে, ‘হান্ড্রেট পার্সেন গ্যারান্টি সার…বিফলে মূল্য ফেরত। এই সেভেন আপে নিত্যদিন আমারে পাবেন স্যার। যে-কোনো হকার রে কইবেন, হুমায়ুন মিয়াঁ কই? দেখায়া দিব। আমি হাজির। আমার নাম মিয়াঁ হুমায়ুন কবির।’

সখি দিন শেষে মা ঘরে ফিরে এলে কাছে গিয়ে বসে। সারাদিন ঘর সামলিয়েছে। এটা-ওটা কাজ করে যেমন বলে যায় মা। কখনো বাইরে গিয়ে রিনা-শম্পাদের সঙ্গে এক্কাদোক্কা খেলে। এতকিছুর মধ্যে কখনো পথের দিকে তাকায়। মা কখন আসে? মা এলে ভাতের ডিশ দেখে। কী তরকারি? বড়লোকেরা কত ভালো ভালো খায়! মা কাজের সুবাদে মাঝে মধ্যে কিছু নিয়ে আসে। তখন খুব মজা হয়। বাবার জন্য তুলে রাখে। সুখ করে খায়। তারপর মায়ের সঙ্গে গল্প। মা ট্রেনে বাবার ফেরি করার গল্প বলে। আনন্দ-খুশিতে কেটে যায় সময়। বাবা গল্পের কথা শুনে হাসে। বাবার হাসি কি সুন্দর!

‘এইডা ব্যবসার ট্যাকটিস মা। এই দেশে গাধাকেও ঘোড়া বলে চালান যায়। কথার জাদুতে গম চোর আর ডাকাতেরা কত কী হবার পারে।’

‘অত বড় কথার দরকার নাই। এবার ফেরি বাদ দিয়া দোকান দাও।’

মা অবশেষে বলে। সে সুরে একটু অভিযোগ…কিছু উৎকণ্ঠা। গত মাসে জংসনে ট্রেন উলটে কত মানুষ মারা গেল। ট্রেনে ফেরি করার দরকার কি? তারা চায় একটি দোকান হোক। বাবা যখন ফেরি করে, সারাদিন উন্মুখ অপেক্ষা; কখন ফিরে আসবে? বাবা কাছে থাকলে পৃথিবীতে আর কিছু চাই না। সখি তার বুকে মাথা রেখে পরম নির্ভরতায় ঘুমোয়। স্বপ্ন দেখে। কখনো বলে, –

‘হ বাবা আমরা ফুটপাতে দোকান দিমু। কত লোকে দোকান দিছে।’

‘যাগো জীবন ফুটপাতে তাগো ওডাই সুপার মার্কেট। উপরে খুলা আসমান…নিচে শীতল জমিন।’

‘দোকান দিবা না বাবা?’

‘দিমু মা দিমু, একটু ট্যাকা গুছাই লই। ট্যাকা লাগব না?’

মাস কয়েকের মধ্যে ফুটপাতে বসতে পারল তারা। অনেক সাধের দোকান। রাস্তার ধারে একচিলতে খোলা জায়গা। এখন সবাই জানে এই জায়গা হুমায়ুন মিয়াঁর। সিজনাল ফলের ব্যবসা করে। তার মেয়ে সখি। কিশোরী সখির গায়ের রং উজ্জ্বল-শ্যাম। মায়াময় পানপাতা মুখ। চোখদুটো সবসময় হাসে। দিঘির টলটলে কালো জলে নীল জোছনায় মাখামাখি। তারা এই শহরে নুতন…বছর দু-এক আগে এসেছে। সখি তখন আশপাশের দোকানে ফাইফরমাশ শোনে। কারও চা কারও পান অথবা সামনের টিউবওয়েল থেকে এক বালতি পানি। কেউ কেউ ভালবেসে এক-দুই টাকার কয়েন দেয়। এখন ওসব কাজ করে না সে। বাবার নিষেধ। সখি বড় হয়েছে। যে নজরুল চাচার অনেক কথা শুনেছে, কাজ করে দেয়; সেও আজকাল কেমন জুলজুল তাকায়। সখির লজ্জা করে।


আরো পড়ুন: ভারতীয় নারীবাদ ও যৌনতার ডিসকোর্স

কয়েকটি তরমুজ পড়ে আছে। গ্রাহক নেই। এগুলো সাইজে বড় নয়। দু-একজন গ্রাহক হয়তো তাই ঘুরে দেখে অন্য দোকানে চলে যায়। সখির কখনো জেঁদ চাপে, এগুলো বিক্রি করে তবেই ফিরবে। রাত পেরোলে বাসি। তখন কেউ কিনবে না। বাবা অসুস্থ…কাশি বেড়েছে। রাতে ঘুমোতে পারে না। গতরাতেও পারেনি। বাবার মুহুর্মুহু কাশির গমক ঝুপড়ি ঘরে বিকট আওয়াজ মনে হয়। সখিরও ঘুম হয় না। বাবার একটু আরাম দরকার। মা হয়তো উকিল সাহেবের বাসার কাজ থেকে ফিরেছে। বেতন পেয়েছে। মা এবার নতুন কাপড় কিনে দেবে তাকে। সখি বলে রেখেছে, নিজের পছন্দের প্রিন্টের থ্রি-পিস নেবে। মা’ও রাজি। মার জন্যও মন খারাপ হয়। প্রচণ্ড কাজ করে মা। সকালে তাদের খাইয়ে…থালাবাসন মেজে চলে যায়। সন্ধেয় ফেরে। আগে দুপুরে আসত। এখন একেবারে সন্ধেরাতে। গামলা-ভরতি ভাত-তরকারি পায়। রাতে রান্না করতে হয় না। গতকাল মা কাজে যেতে পারেনি। বাবার দেখাশোনা করে। আজ দুপুরের আগে একবার দোকানে এসে দেখে গেছে তাকে। সখি ভাত খায়। মা দেখে। যাওয়ার সময় মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘সাবধানে থাহিস্ মা। মাগরিবের আযান দিলে দোকান বন্ধ করিস।’ পান দোকানি নজরুল চাচাকে বলে যায়, সখিকে যেন একটু খেয়ালে রাখে। সখি তাই নিশ্চিন্ত। সবটুকু মনোযোগ দিয়ে দোকানদারি চলে। কতগুলো তরমুজ। বেশিরভাগ বিক্রি হয়েছে। এই কয়েকটি পড়ে আছে। বিক্রি হলে চলে যায়। ফেরত নিয়ে গেলে লোকসান। গাছের ফল…নষ্ট হতে পারে। কে খাবে? তারা তো তিনজন মানুষ। বাবা-মা আর সে।

এদিকে মাগরিবের আযান পড়ে। একটু আগে কিছুক্ষণ বৃষ্টি হয়ে গেল। তখন দপ করে বিদ্যুৎ চলে যায়। আকাশে আলো চমকাতে থাকে। সখি ভয়ে মার্কেটের ভেতর আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে আবছা আলোয় দেখা, তারা যেমন গড়াগড়ি খায়; তরমুজ কয়টি বৃষ্টি-কাদায় মাখামাখি ভাসে। সখির মায়া লাগে। শেষ-বিকেলে বায়ুকোণে জমে থাকা মেঘ-কালো আকাশ। সন্ধের অন্ধকার পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে। গভীর রাত হয়ে যায়। সারাদিনের দাবদাহ উবে গিয়ে কোত্থেকে ভেসে আসে হিম-শীতল বাতাস। শরীরে শিরশির কাঁটা দেয়। সখি ভেবে নেয়, বৃষ্টি থেমে গেলে ফিরে যাবে। তারপর আচমকা বৃষ্টি কিছুক্ষণ ঝমঝমিয়ে সবকিছু ভিজিয়ে থেমে যায়। বিদ্যুৎ এসে ঝলসে তোলে চারপাশ। ঝকঝকে মার্কেট। ফুটপাত…বাজারের প্রান্তসীমা। সখি তখন নজরুল মিয়াঁর দোকানের বালতিতে পানি নিয়ে আসে। তরমুজগুলো যত্ন করে ধোয়।

সে-সময় তিন-চারজন গ্রাহক দোকানে এসে দাঁড়ায়। ক’জনের হাতে বাজার-ভরতি ব্যাগ। কেউ দুটো ব্যাগ ধরে আছে। কোনো বোর্র্ডিং বা মেসের মানুষজন। একজন মধ্যবয়সি বড় রাশভারী-গম্ভীর। চোখে-মুখে ঠান্ডা নিষ্ঠুর ছবি খেলা করে। সখিকে বলতে হয় না, খুব মিষ্টি হবে স্যার, অথবা এক্কেবারে লাল; না হলে পয়সা ফেরত…মানি রিটার্ন। লোকটি জিজ্ঞেস করে, –

‘সবগুলোর দাম কত নিবি?’

‘দুইটা সাড়ে তিন। একটা দুই কেজি। দু-টাকা হিসাবে নয় কেজি। দাম আঠারো টাকা। সতেরো টাকা দিয়েন।’

‘কুড়ি টাকা দিব। এই ছোট বস্তায় ভরে লিলিমোড় পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে। পারবি?’

‘লিলিমোড়ের কোথায়?’

‘সামনেই রে, লাল রঙের একটা বাড়ি আছে না; ওখানে। কি পারবি?’

‘চলেন। ও নজরুল চাচা, আমার সামান আর চাকুটা রাইখেন। আমি আইতাছি।’

নজরুল মিয়াঁ গ্রাহকের পান সাজাতে ব্যস্ত। একপলক তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দেয়। সখি নতুন কড়কড়ে দুটি নোট পুটলির টাকার সঙ্গে মিলিয়ে কোমরে গুঁজে রাখে। এতক্ষণে দেড়শ টাকা। এবার মনের আনন্দে ফিরে যাবে। বাবার জন্য পাউরুটি-কলা। সে তরমুজগুলো ছোট বস্তায় ভরে কাঁধে তুলে নেয়। ওদের পেছনে পেছনে এগিয়ে চলে। লিলিমোড় পুকুরপাড়ের লাল রঙের বাড়ি দেখা আছে তার। দোতলা বিল্ডিং। সকল সময় নিচে মানুষজনের গ্যাঞ্জাম। দশ-পনেরোটি মটরসাইকেল দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো ক্লাব বা পার্টি অফিস হবে হয়তো।

একটি টেইলার্স দোকান। বৃষ্টির সময়ে ঝাঁপ লাগিয়েছে। এখনো পুরোপুরি খোলেনি। সেখান থেকে হালকা নিষ্প্রভ আলো সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আলো-আঁধারের ছায়ায় ঘাসের ডগা অদ্ভুত ম্লান। লোকগুলো এখানে এসে দাঁড়ায়। কেউ একজন বলে, ব্যাগগুলো দোকানের ভেতরে রেখে দিতে হবে। তারা এক-এক করে রেখে ফিরে আসে। সখি কাঁধ থেকে বস্তা নামায়। এখন কী করবে? ওখানে রেখে আসবে? কেউ একজন লম্বা মানুষ ইশারা করে। ঠোঁটে সিগারেট রেখে দেশলাই জ্বালায়। কোনো আলো নেই। সকলে সারিবেঁধে দোকান আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকে। সখি অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ভেতরে ঢোকে। বস্তা থেকে তরমুজ বের করে। আকস্মিক দু-চোখে জমাট কালো পরদা নেমে আসে। সাটার বন্ধ হওয়ার বিকট শব্দ। সখির আর্তচিৎকার।

‘আন্ধার ক্যান মামা?’

‘চুপ্ কর তরমুজঅলি, একদম চেঁচাবি না; খুন কইরা রাখমু।’

কেউ একজন সবল হাতে মুখ চেপে ধরে। সখির সমস্ত শক্তি লোপ পেয়ে যায়। হাত-পা কাঁপে। সে কী করবে? কোনো চিৎকার কিংবা অনুনয়? কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সহসা সবকিছু নিস্তেজ হয়ে পড়ে। সকল চেতনা ঘনিভূত অন্ধকারে হারিয়ে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বর্ণিল কোনো বাজার। অন্ধকারের বাজার। সে অদ্ভুতরকম সেজে ক’জনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। তারা কে? অন্ধকার কালো-সুড়ঙ্গ-গহ্বরে কাউকে চেনা যায় না। কেউ কাউকে দেখে না। নিজেকেও না। সখি স্যাঁতসেঁতে দেয়াল নাকি মেঝে হাতড়ে হাতড়ে নিজেকে খোঁজে। খুঁজতে থাকে। পায় না। এটুকু শুধু বোঝা যায় সে আছে। সে মরে গেছে। তার লাশ কোনো অন্ধকার কাদার উপর উৎকট দেখায়। একফালি কাটা তরমুজ। রক্তাক্ত লাল। মানুষ তার উদোম বুকে হামলে-কামড়ে সকল উত্তাপ ঢেলে দেয়। শীতল হতে থাকে। ঘরের মেঝেয় ফেনিল রক্তের মতো ছড়িয়ে পড়া ছাড়া কিছু বাকি থাকে না সখির!

তখন অন্য-কোথাও একচালার অন্ধকারে অসুস্থ এক বৃদ্ধ রক্তবমি করে সবকিছু ভাসিয়ে দেয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত