এপ্রিল ফুল
এপ্রিল ফুলস ডে’র জন্ম ইতিহাস আজও রহস্যজনক। সভ্যতার ইতিহাসে ঠিক কোন বছর থেকে এই দিনটি চালু হয়েছে তা মানুষের কাছে অাজ পর্যন্ত অজানা। ইংরেজি সাহিত্যের জনক জিওফ্রে চসার ১৩৯২ সালে লেখা ‘নানস প্রিস্ট টেল’ কবিতায় মার্চ মাসের একটি ৩২তম দিনের কথা উল্লেখ করেন। কারও কারও মতে, এই ৩২তম দিনটি বলতে চসার পয়লা এপ্রিলকে বুঝিয়েছিলেন। তবে ঐতিহাসিক পিটার ট্রাভিস বলেন, ৩২তম দিন বলতে চসার কোনো নির্দিষ্ট দিনের কথা বোঝাননি। তিনি মূলত মধ্যযুগীয় দার্শনিকতা নিয়ে ঠাট্টাচ্ছলে এটি ব্যবহার করেছেন।
‘এপ্রিল ফুলস ডে’র জন্ম ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ‘পঞ্জিকা-পরিবর্তন তত্ত্ব’। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে রোমান শাসক জুলিয়াস সিজার রোমান পঞ্জিকা সংস্কার করে জুলিয়ান পঞ্জিকা চালু করেন। এ পঞ্জিকা অনুসারে ঈস্টার (যিশুখ্রিষ্টের পুনর্জন্মের দিন) ছিল বছরের প্রথম দিন। তবে চান্দ্রচক্রের সঙ্গে জড়িত হওয়ার কারণে ঈস্টারের তারিখ প্রতি বছর পরিবর্তিত হয়ে যেত। মোটামুটিভাবে ব্যতিক্রম বাদ দিলে ঈস্টার পড়ত প্রতি বছরের ৩১ মার্চ বা পয়লা এপ্রিল। এ পরিবর্তনের কারণে সাল গণনায় মাঝে মাঝে সমস্যা দেখা দিত। ১৫৮২ সালে ১৩তম পোপ গ্রেগরি তাঁর এক আদেশে ইতালিতে জুলিয়ান পঞ্জিকার পরিবর্তে গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা চালু করেন। ১৫৮৩ সালে ফ্রান্সের রাজা নবম চার্লস গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা অনুসারে পয়লা জানুয়ারিকে নববর্ষ বলে ঘোষণা করেন। ২২ ডিসেম্বর, ১৫৬৪ সালে এটি ফ্রান্সের পার্লামেন্টে আইন হিসেবে পাস হয়। তবে ফ্রান্সের অনেকেই এ আইনটিকে মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা আগের মতই পয়লা এপ্রিলকেই নববর্ষ হিসেবে পালন করতেন। ফলে নববর্ষ পালন নিয়ে জনগণ দু ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যাঁরা পয়লা জানুয়ারিকে নববর্ষ বলে পালন করতেন তাঁরা পয়লা এপ্রিলকে নববর্ষ হিসেবে পালনকারীদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা আরম্ভ করে দিলেন। পয়লা এপ্রিলে তাঁরা প্রতিপক্ষের পিঠে গোপনে মাছের ছবি আঁকা স্টিকার লাগিয়ে দিতেন। যাঁর পিঠে স্টিকার লাগানো হতো তাঁকে বলা হতো ‘পওয়াহসোঁ ডাভরিল’। ‘পওয়াহসোঁ ডাভরিল’ শব্দগুচ্ছটি এসেছে ‘এলয় দ্য আমেরভাল’ নামক একজন ফরাসি কবির কাছ থেকে। তিনি ১৫০৮ তার ‘লে লিভরে ডে লা ডিয়াবলেরিয়ে’ কবিতায় ‘বোকা লোক’ বোঝাতে প্রথম এ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেন। এর আক্ষরিক অর্থ ‘এপ্রিলের মাছ’; তত্রাপি ফরাসি ‘পওয়াহসোঁ ডাভরিল’ বলতে ‘এপ্রিল ফুলস ডে’কে বোঝায়। তবে এই পঞ্জিকা-তত্ত্ব নিয়ে অনেকেই একমত নন।
‘এপ্রিল ফুলস ডে’ নিয়ে জার্মানদের ধারণা আবার ভিন্ন। তাদের মতে, ১৫৩০ সালের পয়লা এপ্রিল জার্মানির অগসবার্গে তৎকালীন আইনসভা সদস্যদের মধ্যে অর্থনৈতিক বিষয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। তবে সময় সংকুলানের অভাবে ওই সভাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ দেখা যায়। সভা দেখতে আসা অসংখ্য দর্শক সভা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে পারস্পরিক বািজতে জড়িয়ে পড়েন। সভাটি হয়নি। ফলে যাঁরা সভা অনুষ্ঠানের পক্ষে বাজি ধরেছিলেন তাঁরা হেরে গিয়ে অন্য সবার ঠাট্টা-তামাশার পাত্র হয়ে পড়েন। তবে পয়লা এপ্রিলে মানুষকে বোকা বানানোর প্রথাটি আসে ১৫৩৯ সালে ফ্লেমিশ (জার্মানদের একটি উপজাতি, যারা বেলজিয়ামের নাগরিক এবং ডাচ ভাষায় কথা বলে; এরা মূলত ‘বেলজিয়ান ডাচ’) কবি ‘এডুয়ার্ড ডে ডেনে’ একটি হাস্য রসাত্মক কবিতা থেকে। কবিতাটির ইংরেজি নাম ছিল ‘রিফ্রেইন অন এরান্ড-ডে, হুইচ হু দ্য ফারস্ট অভ এপ্রিল’ অর্থাৎ এপ্রিলের প্রথম দিনে অপ্রাপ্তি। কবিতাটির কাহিনিতে একজন ভদ্রলোক পয়লা এপ্রিলে তাঁর চাকরকে বোকা বানিয়েছিলেন। এভাবেই নাকি জার্মানিতে ‘এপ্রিল ফুলস ডে’র প্রথা প্রচলিত হয়। অন্যদিকে জামার্নির সীমান্তবর্তী দেশ নেদারল্যান্ডসের অধিবাসী ডাচদের কাছে পয়লা এপ্রিলের গুরুত্ব ভিন্ন। ১৫৭২ সালের এই দিনে তারা লর্ড আলভা নামক সেনার নেতৃত্বে স্প্যানিশ সৈন্যদের কাছ থেকে ‘ডান ব্রিয়েল’ নামে একটি শহর দখল করে নেয়। শহরটি দখলের ঘটনা পরম্পরায় নেদারল্যান্ডস স্প্যানিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে বলে ডাচরা মনে করে। তাই এই দিনটি তাদের কাছে সৌভাগ্যের দিন বলে গণ্য।
১৬৯৮ সালের ২ এপ্রিল ব্রিটিশ পত্রিকা ‘ডকস নিউজ-লেটার’ এক রিপোর্টে লিখেছিল, ‘গতকাল পয়লা এপ্রিল ছিল বলে গুটিকতক লোককে লন্ডন টাওয়ারে সিংহের গোসল দেখতে পাঠানো হয়েছে’। ‘ওয়াশিং দ্য লায়ন্স’ বা ‘সিংহের গোসল’ বাগধারাটি তৎকালে ব্রিটেনের একটি জনপ্রিয় প্রাঙ্ক ছিল, যা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো অসম্ভব বস্তু বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। এ রিপোর্ট থেকে বোধ্যগম্য যে, ওই সময়ে এই দিনটি ব্রিটেনেও পুরোদমে পালিত হতো।
এ কথা অনস্বীকার্য যে ‘এপ্রিল ফুলস ডে’র সুনির্দিষ্ট জন্ম ইতিহাস ও এর কালানুক্রমিক বিস্তৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য বিদ্যমান। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কমল-হীরের পাথরটাকেই বলে বিদ্যে, আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার’। ‘এপ্রিল ফুলস ডে’ও তেমনি একটি কালচার বা সংস্কৃতি বৈ আর কিছু নয়।
