| 27 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস

কস্তুরীর সন্ধানে আরবদের তিব্বতযাত্রা | শাকের আনোয়ার

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

মধ্যযুগের প্রথম দিকে তিব্বত থেকে রেশমপথ হয়ে আরবভূমিতে অনেক বিলাসী দ্রব্যই রফতানি হতো বটে—কিন্তু সেগুলোর মধ্যে একটি বিশেষ জিনিস এ বাণিজ্যযাত্রার ইতিহাসে যেন আলাদা সমাদর পেয়েছিল। তা হলো কস্তুরী বা সুগন্ধি মৃগনাভি। বস্তুত সিল্করুটের বাণিজ্য অভিযাত্রা চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত কস্তুরীর ঘ্রাণ বা এর ব্যবহার সম্পর্কে আরব দেশে কোনো সাক্ষাৎ ধারণা ছিল না। শুধু নামটুকুই শোনা আরকি। কিন্তু ক্রমে ক্রমে কস্তুরীই হয়ে ওঠে সেখানকার অতি আদরণীয় সুগন্ধি দ্রব্য। তা যে-সে কস্তুরী হলে হবে না, আরবদের কাছে হিমালয়ের পাদদেশে বেড়ে ওঠা কস্তুরীমৃগ থেকে আহরিত মৃগনাভিরই চাহিদা ছিল অধিক। তিব্বতি হরিণের কস্তুরীর বিশেষ তীব্র মোহনীয় ঘ্রাণ এর চাহিদাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

মধ্যযুগের আরব সমাজে সুগন্ধি দ্রব্য হিসেবে কস্তুরীর গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক।চৌদ্দ শতকের আরব পণ্ডিত ইবনে কাইয়ুম আল জাওজিয়া তাঁর বই ‘আল-তিব-আল-নাবাকি’-তে লিখেছিলেন: ‘[কস্তুরী] সকল প্রকার সুগন্ধির মধ্যে বাদশাহতুল্য, সবচেয়ে চমত্কার ও মিষ্ট। এ জিনিস নিয়েই প্রবাদ তৈরি হয়…বাকি সব জিনিসকে অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনা করা হলেও একে কিন্তু আর কিছুর সঙ্গেই তুলনা করা অসম্ভব। এ হলো বাগানের মধ্যে একটি বালিয়াড়ি।’

কস্তুরীর ঘ্রাণ সরাসরি নেয়ার আগে আরব অঞ্চলে ভারতের কস্তুরীর সংবাদ ইতিউতি আকারে পৌঁছেছিল, ইতিহাসে এমন তথ্য মেলে। নবম শতাব্দীর আগের সময়ে ভারতীয় কস্তুরীর কথা এক আরব কবির পদ্যে ‘হিন্দের কস্তুরী’র উল্লেখ লভ্য। নবম শতকের মাঝামাঝি অবশ্য তিব্বতের কস্তুরীর প্রশংসা আরবে ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময়ের এক খ্রিস্টধর্মাবলম্বী চিকিৎসক ইবনে মাসাওয়াহ তিব্বতের কস্তুরী সম্পর্কে বলেছিলেন: ‘সেরা [কস্তুরী] তিব্বতের সোগডিয়ান এলাকার।…এটা দিগন্তবিস্তৃত ভূমির ওপর দিয়ে নিয়ে আসা হয়।…’ ইবনে মাসাওয়াহ তিব্বতের কস্তুরীর শ্রেষ্ঠত্বের কথা লিখতে গিয়ে তা যে ‘ভূমির ওপর দিয়ে নিয়ে আসা’ হয়, জাহাজে করে বা নৌপথে নয়—এ কথা বারবার করে লিখেছেন। এ থেকে ধারণা করা যায় যে নৌপথে আসার কারণে অপরাপর এলাকার (বিশেষত ভারত বা চীন থেকে আসা) কস্তুরী প্রায়ই তখন বিনষ্ট হতো, তুলনায় সেসবের থেকে স্থলপথে আগত তিব্বতি কস্তুরীর ঘ্রাণ ও মান থাকত অটুট। ওই একই সময়ের বিখ্যাত আরব জীববিজ্ঞানী আল জাহিজ তাঁর ‘কিতাব-আল হায়ওয়ান’ গ্রন্থে কস্তুরীর কথা লিখেছিলেন—তিনি জানান, কস্তুরী একটি ‘ছোট আকারের প্রাণীর দেহ থেকে আসে যা কিনা তিব্বতে লভ্য’। আরেক আরব মনীষী ভূগোলবিদ ইবনে খুররাদাবিহও ‘কিতাব আল মাসালিম ওয়া মামলিক’-এ একাধিকবার কস্তুরীর প্রসঙ্গ এনেছেন। বিশেষ করে একটি আখ্যানের কথা এখানে বলতে হয়। খুররাদাবিহ জানান, সম্রাট আলেকজান্ডারকে তিব্বতের রাজা বিপুল পরিমাণ কস্তুরী উপহার দিয়েছিলেন। তিনি এত বেশি কস্তুরী উপহার পেয়েছিলেন যে তা বহন করতে দরকার পড়েছিল চারশ ভারবাহী গাধার। আলেকজান্ডার উপহার পাওয়া কস্তুরীর দশ শতাংশ তাঁর স্ত্রী রোক্সানাকে দিয়ে দেন। বাকি অংশ অন্যদের বিলিয়ে দেন। এ ঘটনার ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে সংশয় থাকলেও তা থেকে এটুকু অন্তত আঁচ করা যায় যে তখনকার আরবের সারস্বত সমাজে কস্তুরী বৌদ্ধিক আগ্রহ আলোচনার বিষয়রূপে পরিগণিত হতে নিশ্চিতভাবেই। আবার হয়তো, আমজনতার পরিসরে রোমাঞ্চকর গল্পগাছার প্রসঙ্গ হিসেবেও এই বিলাসী দ্রব্যটির কথা উঠে আসত।নবম শতাব্দীর ঐতিহাসিক আহমেদ ইবনে জাফর আলা-কুবি তিব্বতের কস্তুরী পাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে ভারি কৌতূহলোদ্দীপক বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন তিব্বতের খ্যাতনামা কস্তুরী বণিকেরা ‘ভূমিতে এক হাত সমান মিনারের মতো কাঠের তৈরি কাঠামো বসায়। কস্তুরী ধারণকারী প্রাণিকুল [হরিণ] ওই কাঠামোতে তাদের নাভি ঘষে এবং ওই কাঠামোর মধ্যে তাদের নাভি খসে পড়ে যায়। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে বণিকেরা ফিরে এসে তা সংগ্রহ করে। তারপর তারা তা তিব্বতে [মূল বাণিজ্য কেন্দ্রের কথা বলা হচ্ছে] নিয়ে আসে।’

নবম শতক পার করে দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি আরবি সাহিত্যেও কস্তুরীর কথা উঠে আসতে থাকে। সেরা কস্তুরী পাওয়া যায় তিব্বতের ঠিক কোন জায়গা থেকে তা নিয়েও সেকালের আরবে নানা আলোচনা ছিল। এক্ষেত্রে বারবার উত্তর-পূর্ব তিব্বতের কথা উঠে আসত। ওই সময়ের অন্যতম সেরা আরব লেখক সাইদ আল-তামিমির ‘জয়ব আল-আরশ ওয়া-রায়হান আল-নাফুস’-এ কস্তুরীর কথা উঠে এসেছে এভাবে: ‘কস্তুরী বহু ধরনের ও ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের হয়ে থাকে। সেগুলোর মধ্যে সেরা এবং সবচেয়ে চমত্কারটি হলো তিব্বতের কস্তুরী।’ আল-তামিমি আরো জানান, উত্তর-পূর্ব তিব্বতে অবস্থিত কস্তুরী উৎপাদনের এলাকা থেকে তিব্বতের মূল বাণিজ্য কেন্দ্রের দূরত্ব দুই মাসের যাত্রার। সেখান থেকে তা খোরাসান এলাকায় আসে। তারপর আরবের নানা অঞ্চলে তা বিপণন করা হয়। আল জাহিজের নামে প্রচলিত থাকা (যদিও তিনিই এর রচয়িতা এমন পোক্ত প্রমাণ নেই) একটি বই ‘কিতাব আল তাবাসসুর বিলতিজারা’য়—চলতি ভাষায় যার অর্থ বণিকের গাইডবই—বলা হয়েছে যে ‘সেরা কস্তুরী শুকনো, হালকা রঙের [এবং] তিব্বতি।’ ওই বইতে আরো লেখা হয়েছে, নিকৃষ্ট মানের কস্তুরী আসে ভারত থেকে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে পারস্যের পর্যটক আবু জায়েদ আল সিরাফির একটি বিবরণের কথা। আনুমানিক দশম শতাব্দীর প্রথম দিকে সমুদ্রপথে ভারত ও চীন ভ্রমণ করে আসা সিরাফি লিখেছিলেন, সবচেয়ে উত্তম তিব্বতি কস্তুরীর প্রাপ্তিস্থান আদতে মধ্য তিব্বত নয়। তা সেখান থেকে খানিক দূরে। তিব্বতি কস্তুরী ঠিক কোথায় বিশিষ্ট তার বর্ণনা সিরাফ দিয়েছেন এভাবে: চীনা কস্তুরীর বদলে তিব্বতি কস্তুরীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দুটি কারণে। প্রথমটি হলো তিব্বতের মধ্যে চরে বেড়ানো কস্তুরীমৃগ সেখানে সহজেই গজিয়ে ওঠা সুগন্ধি ভেষজ স্কিনেকার্ড ফুল খেয়ে থাকে। ফলে তাদের নাভি অধিকতর সুগন্ধ লাভ করে। যা কিনা চীনের কস্তুরীমৃগের কাছে সহজলভ্য নয়। আর দ্বিতীয়ত তিব্বতি বণিকরা মৃগনাভি অক্ষত অবস্থায় বিক্রি করলেও চীনা বণিকরা তাতে ভেজাল মিশিয়ে দেয়। উপরন্তু চীনা বণিকরা যেসব পথে কস্তুরী রফতানি করে তা-ও দুর্গম ও দীর্ঘ। সমুদ্রপথে রফতানি করায় আর্দ্রতা-আক্রান্ত হয়েও কস্তুরীর ক্ষতি হয় বৈকি।

এ তো গেল কস্তুরী সংগ্রহের কথা। কিন্তু সুদূর তিব্বত থেকে আনা এ সুগন্ধি দ্রব্য থেকে ঠিক কীভাবে বহুমূল্য চমত্কার সুগন্ধি তৈরি হতো সেকালের আরবে? আরবি কবিতায় প্রিয়তমার উদ্দেশে আস্ত সুগন্ধি কস্তুরী নিবেদনের উল্লেখ অবশ্য মেলে।তবে প্রক্রিয়াজাত কস্তুরী ব্যবহারই ছিল প্রধান। কস্তুরীর খণ্ডাংশ অনেক সময় ব্যবহার করা হতো বা তা থেকে তরল ও চূর্ণ পাউডার জাতীয় সুগন্ধি তৈরি করা হতো। কস্তুরী থেকে ধূপ তৈরির কথাও শোনা যায়। দশম-একাদশ শতকের আরবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল কস্তুরী, অম্বর ও শজনে গাছের বীজ থেকে পাওয়া তেল মিশিয়ে তৈরি একধরনের মাখনসম পেস্টজাতীয় সুগন্ধি। যাকে বলা হতো ‘ঘালিয়া’। আল কিন্দির ‘কিতাব কিমিয়া আল-আতর’-এ পাওয়া যায় নানা রকম ‘ঘালিয়া’ তৈরির বিবিধ ফর্মুলা। যেখানে কিনা আবার কোন ধরনের ‘ঘালিয়া’ কারা ব্যবহার করবেন তা-ও বলে দেয়া হয়েছে। আল কিন্দি জানান, এ বস্তু মোটমাট তিনভাবে বানানো হয়। একরকম হলো কস্তুরী, অম্বর ও শজনে বীজের তেল মিশিয়ে তৈরি। দেশের শাসকরা, খাজাঞ্চি, কাজী ও তাদের সহযোগীরা এবং ডাক ব্যবস্থাপকরা এ সুগন্ধি ব্যবহার করে। দ্বিতীয় কিসিমের সুগন্ধিতে শজনের তেল ও অম্বরের পরিমাণ অধিক থাকে। সেখানে অল্প কস্তুরীর সঙ্গে সুক (আখরোট, কিশমিশ ও ডালিমের বীজ দিয়ে তৈরি এক ধরনের আতর) মিশিয়ে দেয়া হয়। মধ্যস্তরের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা তা ব্যবহার করেন। আর তৃতীয় কিসিমের কস্তুরীনির্ভর সুগন্ধিটিতে কস্তুরীর পরিমাণ আরো কমিয়ে তাতে সুক, অম্বর, শজনের তেল আর আগার মেশানো হয়। এই বারোয়ারি সুগন্ধি আমজনতা এবং বণিকরা ব্যবহার করে থাকে। আল কিন্দির এ বিবরণ থেকে আরবের জনমানসে কস্তুরীর মূল্য কতটা ছিল আর সুগন্ধির ব্যবহার বিষয়ে তাদের প্রবণতাগুলোই বা ছিল কী কী—তা বেশ ভালোমতোই বোঝা যায়।

 

শাকের আনোয়ার: প্রাবন্ধিক

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত