| 22 অক্টোবর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-৩৬) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায় চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।


অনুবাদকের কথা

কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে। নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা।


      আমি একটি ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্নের মরুভূমি আবিষ্কার করেছিলাম।

      সত্যি সত্যিই একটি ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্নের মরুভূমি। আর সেই আবিষ্কার হয়েছিল আচম্বিতে— অভাবনীয়ভাবে।

      মেকলডগঞ্জে এসেও, একটা তিব্বতি পরিবারে পেয়িংগেস্ট হয়ে থেকেও, প্রায় সব সময় তিব্বতি মানুষের সঙ্গে থেকেও— তাদের বিষয়ে আমি খুব কমই জেনেছিলাম, জানার জন্য খুব একটা চেষ্টাও ছিল না।

      মেকলডগঞ্জের চারপাশে, দোকানের আয়নায়, দেওয়ালে, বিদ্যুতের খুটিতে লাগিয়ে রাখা ছোটো ছোটো কাগজের স্টিকারগুলি আমার চোখে পড়েছিল— সেগুলোতে লেখা ছিল’ ফ্রি তিব্বত’ যার অর্থ ছিল’ তিব্বতকে স্বাধীন কর’। ছোটো শহরটার যেদিকেই যাওয়া যায় সেদিকটিতেই এই স্টিকারগুলি চোখে পড়ে। এসব আমার মনে বিশেষ একটা দাগ কাটেনি। চার পাশের জীবনটা সাবলীলভাবেই চলে যাচ্ছিল– রাস্তা দিয়ে মানুষ দৈনন্দিন কাজে যাওয়া আসা করছিল, বাজারের দোকান খুলছিল, দোকানে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী,কেনা বেচা চলছিল; পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকরা সতৃষ্ণ  নয়নে পার হয়ে যাওয়া যুবতি মেয়েদের দেখছিল: ভ্রমণকারীরা এসেছিল— একা একা বা দুই তিনজন মিলে এদিকে ওদিকে ঘোরাফেরা করছিল। ওরা কী ভাবছিল, কী চাইছিল কেউ সেই বিষয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল বলে মনে হচ্ছিল না। চোখের সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল দৈনন্দিন জীবনের নিরুদ্বেগ নদী।

      আমি নিজেও খাচ্ছিলাম ঘুমোচ্ছিলাম, অফিসে বসে ছিলাম, কর্মচারী দুজনের সঙ্গে আড্ডা মারছিলাম, পথে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। দিল্লিতে করা চিকিৎসার ঔষধ তখনও চলছিল। ঔষধগুলি আমার চিন্তা করার শক্তি যেন কমিয়ে দিয়েছিল। বেশিরভাগ সময়ই মনটা খালি খালি লাগত। সেই খালি মন নিয়ে পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে আনা থ্রিলার উপন্যাস গুলি মনে খুব একটা দাগ কাটছিল না— কাটার মতো বইও অবশ্য ছিল না । সময় পার হয়ে যাচ্ছিল — নিরুত্তেজক, নিরাবেগ সময় । একটা শূন্য গোলকের মধ্যে ভেসে বেড়ানোর অবস্থিতি। রমেন কখনও দিল্লি থেকে করা ফোনটা বা বাড়ি থেকে আসা ফোনটা আমার অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে একমাত্র যোগসূত্র  ছিল। কিন্তু সেই সূত্রও আমার মনে বিশেষ গভীর রেখাপাত করত না। কখনও ভ্রমণকারীর দল এলে মাত্র ব্যস্ততা বেড়ে যেত, কিন্তু তখনও আমি যেন সেই ব্যস্ততা থেকে বাইরে ছিলাম। বাস্তবতার মধ্যে, তাতে জড়িত হয়ে থেকেও, আমি ছিলাম পর্যবেক্ষকের মতো। 

      বয়সের যৌনতাও আমাকে কমই বিরক্ত করছিল তখন। এরকম সময়েই আমি বাইরের ব্যস্ত আবরণের নিচে প্রবাহিত জীবনের গভীর স্রোতের আভাস পেয়েছিলাম ছোটো শহরটিতে। আর এটা ঘটেছিল আচম্বিতভাবে।

      আমাদের অফিসে কাজ করা হাসিখুশি মেয়েটি– পেমা, একদিন কাজে এল না।আমি তার দাদা গ্যাটশ্বকে জিজ্ঞেস করলাম,‘পেমা আসেনি?’

      ‘ওর শরীরটা ভাল নয় নাকি, খবর পাঠিয়েছে,’গ্যাটশ্ব বলেছিল।

      পরের দিনও পেমা এল না।

      ওর দাদাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম,’ কী হল,পেমার শরীর ঠিক হয়নি নাকি?’

      ‘হয়তো হয়নি’, ওর দাদা কেমন যেন এড়িয়ে যাওয়া বলে মনে হল। 

      ‘বেশি শরীর খারাপ হয়েছে নাকি? একটা খবর করা উচিত ছিল,’ বলে বলে রাখলাম যদিও সেদিন কিছু করা হল না। পরের দিন কিছু কাজে আমার অফিসে যেতে কিছুটা দেরি হয়েছিল, দুপুরবেলা গিয়ে অফিসে পৌঁছেছিলাম। তখনও যখন দেখলাম প্রেমা আসেনি, চিন্তা হল। কে জানে,হয়তো অসুখ বেড়েছে। কাউকে দেখিয়েছে কি। তিব্বতি মানুষরা অসুখ-বিসুখ হলে সহজে ডাক্তার দেখায় না। ঘরোয়া ঔষধপত্র খায়।

      দুপুরবেলা পাশের একটি হোটেল থেকে চা রুটি এনে আমরা সকলে অফিসে দিনের আহার করি। খাবার সময় গ্যাটশ্বকে বলেছিলাম,’ পেমার অসুখ হয়তো বেশি হয়েছে। চল একবার তার খবর করে আসি।’

      ‘লাগবেনা লাগবেনা, সে আগামীকাল এসে যাবে।’

      ‘তুমি কীভাবে জানলে?’

      ‘আজ হয়তো অসুখ ভালো হয়ে যাবে’, সে দায়সারা গোছের উত্তর দিল।

      ‘ভালো হবে মনে হয়’?’আসলে হয়েছেটা কী? তুমি খবর নিয়েছ কি?’

      ‘না।সাধারণ সর্দি জ্বর হবে । আর কী হবে । ভালো হয়ে যাবে ।

      গ্যাটশ্বর কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল যেন তার আমাকে পেমার কাছে নিয়ে যাবার ইচ্ছা নেই। তার সম্বন্ধীয় বোন পেমা, সে বা আসলে খোঁজখবর করেছে কিনা! কোনো ঠিক নেই, না করতেও পারে।

      ‘তিন দিন ধরে মেয়েটি অফিসে আসছে না, সে কখনও কামাই করে না। কী হয়েছে, কী অসুখ হয়েছে কেউ ভালো করে বলতেই পারছে না। এটা একটা কথা হল নাকি? আমি রাগ করেছিলাম,’ চলো এখনই চলো। ওর একটা খবর নিয়ে আসতে হবে।’

      ‘ঠিক আছে, চলুন,’গ্যাটশ্ব এবার যাবার জন্য প্রস্তুত হল।

      আঁকাবাঁকা পাহাড়ি একটা পথ দিয়ে আমরা অনেক নিচে নেমে গিয়েছিলাম। গাড়ি যাওয়া পাক্কা রাস্তা কখনই পার হয়ে এসেছি। তারপরে তিনফুটের মতো প্রশস্ত কংক্রিটের একটা পথ, মাঝেমধ্যে সেখানে সিঁড়ি ছিল। কোনো জায়গায় শুধুই সিঁড়ি। আমরা এত নিচে নেমেছিলাম যে ফেরার সময় কীভাবে উঠে যাব সে কথাটা ভেবেই আমার চিন্তা হচ্ছিল। তার মানে পেমাকে প্রতিদিন এতগুলি সিঁড়ি অতিক্রম করে অফিসে আসতে হয়। তার কথা ভেবে আমার খারাপ লাগছিল।

      পথের দুপাশে পর্বতের ঠিক গায়ে বা অন্য দিকের খাড়াইয়ে তৈরি করা ছোটো ছোটো বাড়ি। দুপাশের বাড়ির চালাগুলি পথের সমানই ছিল, কোথাও একটি দোতলা বাড়ি পথটার চেয়ে উঁচু ছিল। এই পথ দিয়ে আমি আগে কখনও আসিনি।গ্যাটশ্বকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি এদিকটাতে থাক নাকি?’

      ‘না, আমাদের বাড়ি একেবারে উল্টোদিকে। আমাদের বাড়ি যেতে হলে উঠে যেতে হয়।’

      পেমাদের বাড়িটা ছোটো একটি ছিমছাম বাড়ি। পুরোনো কিন্তু পরিষ্কার। আমাদের দেখে সে খুব অস্বস্তিতে পড়েছে বলে মনে হল।গ্যাটশ্ব তাকে তিব্বতি ভাষায় কিছু একটা বলেছিল। পেমা আমার কাছে বারবার ক্ষমা চাইছিল, বলছিল, ‘আমি জানি কোনো রকম খোঁজ খবর না দিয়ে থাকাটা আমার দায়িত্বজ্ঞান হীনতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু বাড়িতে এমন কিছু সমস্যা হয়েছে যাতে আমি অসহায় হয়ে পড়েছি।’ সে আমাদের নিয়ে গিয়ে সামনের ছোট্ট একটি ঘরে বসিয়ে দিল। সেখানে একটা সংকীর্ণ বিছানা এবং তিনটি চেয়ার ছিল। দুটি যুবক সেখানে বসে ছিল। ওরা আমাকে ‘গুড আফটারনুন’ জানিয়ে গ্যাটশ্বর সঙ্গে তিব্বতি ভাষায় কথা বলতে বলতে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল।

      আমি অসহজ অনুভব করছিলাম।

      ‘তোমার ঘরোয়া সমস্যা হয়েছে বলে জেনে চিন্তা হচ্ছে,’ আমার কী বলা উচিত বুঝতে না পরে ইতস্তত করে শুরু করেছিলাম।’ আমি যদি, আমি যদি কোনো সাহায্য করতে পারি তুমি তাহলে আমাকে বলতে বিন্দুমাত্র সংকোচ কর না। দাদার কাছে বোনের আবদারের মতো তুমি মন খুলে বলতে পার। কোনো কিছু করতে না পারলেও তোমার পাশে দাঁড়াতে পারব অন্তত।’ নিজের কথায় আমি নিজেই চমৎকৃত হয়েছিলাম।

পেমার চোখ থেকে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ছিল।


আরো পড়ুন: অর্থ (পর্ব-৩৫) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


      আমি ছোটো ঘরটার দেওয়ালের কাছে একই সারিতে রাখা দুটো হাতল থাকা কাঠের চেয়ারে বসেছিলাম। আমাদের মাঝখানে ছিল লাল সাদা ঘরে পরা কাপড় দিয়ে ঢাকা একটি ছোটো টেবিল। সেখানে একটা কাঠের ফুলদানিতে কাপড় দিয়ে বানানো ফুল সাজিয়ে রাখা ছিল। সামনের দেওয়ালটাতে ছিল ধ্যানে বসে থাকা দলাই লামার একটি ছবি। আমরা বসে এটা ওটা কথা বলছিলাম। কী কথা বলব বুঝতে পারছিলাম না। পেমা তার অসুবিধার কথা নিজে না বললে আমার আর জিজ্ঞেস করার পথ ছিল না। কিছুক্ষণ পরে সে নিজেই বলতে শুরু করেছিল,‘ আমরা তিব্বতিরা একটি অভিশপ্ত জাতি, স্যার,’ পেমা বলতে শুরু করেছিল। আমরা নিজের দেশ থেকে পালিয়ে এসে আপনাদের দেশে শরণার্থী হিসেবে থাকতে হচ্ছে। আমার তো এখানেই জন্ম, কিন্তু আমার মায়ের জন্ম হয়েছিল তিব্বতে। বাবার ও। দুজনেই দেশ ছেড়ে পৃথক পৃথক ভাবে পালিয়ে এসেছিল। এসে ভারতে তাদের বিয়ে হয়েছিল।

      পর্দার আড়াল থেকে কেউ ডাকছিল। পেমা উঠে গিয়ে চায়ের ট্রে-টা নিয়ে এল। চা বিস্কুট সুন্দর করে পিরিচ- পেয়ালায় সাজিয়ে রাখা। প্রত্যেকের হাতে হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়েছিল সে।

      ‘তিব্বত ছেড়ে আসার প্রায় চল্লিশ বছরের ওপর ধরে দালাই লামার নেতৃত্বে আমাদের তিব্বতিরা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে আসছে, সম্মুখীন হয়েছে প্রচন্ড কষ্ট এবং নির্যাতনের। সেই সংগ্রাম চলছে। আপনি হয়তো এখানে থেকে এই সমস্ত কিছু জানতে পেরেছেন…’

      ‘কিন্তু তোমার ঘরোয়া সমস্যা বলেছিলে যে?’ তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।

      ‘এটাই তো ঘরোয়া সমস্যা।’ পেমা বলেছিল।

      আমি আশ্চর্য হওয়ার মতো তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সামনে বসে থাকা গ্যাটশ্বর দিকেও তাকিয়ে ছিলাম। অভিব্যক্তিহীন একটা মুখ নিয়ে সে বসেছিল। যেন  কথাগুলি সে শুনতেই পায়নি। আমি পেমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম—’ সেটাই তো ঘরোয়া সমস্যা! সেই সেটা কি?’

      নিচের ঠোঁটটা কিছুক্ষণ কামড়ে ধরে রাখল। তারপর ধীরে ধীরে বলেছিল,’ নিজের একজন দাদা আছে। মোটামুটি ভালো কাজ করে। পড়াশোনাতেও ভালো ছিল। আমাদের তিব্বতিদের ভারতীয় নাগরিক না হওয়ার জন্য ভালো কাজ পাওয়াটা খুব শক্ত। সে বিয়েও করেছে। স্ত্রী– আমার বৌদিও একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষয়িত্রী, ছোটো একটি বাচ্চাও আছে। ছাত্রাবাস্থা থেকেই অবশ্য সে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন চাকরি-বাকরি সমস্ত কিছু ছেড়ে সে পুরোদমে রাজনীতিতে যুক্ত হতে চাইছে। সে আর তার একজন বন্ধু। বৌদি আর শিশুটিকে এখানে এনে রাখার কথা বলছে। আমাদের এই শরণার্থী তিব্বতিদের রাজনীতির কী ভবিষ্যৎ আছে বলুন তো।’

      কী উত্তর দেব বুঝতে পারছিলাম না। তিব্বতি শরণার্থী রাজনীতি সম্পর্কে তখন আমার বিশেষ ধারণা ছিল না। আমি প্রায় বোকার মতোই তার দিকে তাকিয়েছিলাম।

      ‘পেমার দাদার সঙ্গে যে বন্ধুটি রাজনীতি করার জন্য যেতে প্রস্তুত হয়েছে,’গ্যাটশ্ব এবার বলে উঠল।’সে পেমার– মানে তার সঙ্গে পেমার বিয়ে হওয়ার কথা।’

      পেমার সাদা গাল দুটি হঠাৎ লাল হয়ে উঠেছিল। সে মাথা নিচু করেছিল।

ওর সমস্যা তাই একটি নয় দুটি। গ্যাটশ্ব বলেছিল  দাদা এবং ভবিষ্যৎ স্বামী।

       পেমা এবার বসা থেকে উঠে চায়ের সরঞ্জাম গুলি ট্রেতে গুছিয়ে নিচ্ছিল।‘আমি আরও এক কাপ গরম চা করে নিয়ে আসি’ বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে সে উঠে ভেতরে চলে গিয়েছিল।

       আমি দালাই লামার ফোটোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম।শান্ত সৌম্য দালাই লামা চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসেছেন।

      ছেলেটি কোথায় কাজ করে গ্যাটশ্বকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।

      ‘সেও চন্ডিগড়ে থাকে। ব্যাবসা করে। তিব্বতি হস্তশিল্পের ব্যাবসা। সেখানে ছোটো একটি দোকান এখনও আছে। ব্যাবসা খারাপ নয় মোটামুটি। সে বিয়ের পরে পেমাকে চন্ডিগড়ে থেকে ব্যাবসা দেখতে বলেছে।’ 

      পেমা পারবে কি?

      ‘আমাদের তিব্বতি মেয়েরা ব্যাবসায় খুব একটা খারাপ নয়। পারবে বলেই মনে হয়। কিন্তু পেমা চন্ডিগড়ে গিয়ে একা থেকে ব্যাবসা চালাতে রাজি হয়নি। কথাটা সত্যি। বৌদি যদি এখানে চলে আসে সে সেখানে একা থেকে কী করবে। অবশ্য সেখানে আরও অনেক তিব্বতি লোকজন আছে। অন্যদিকে ছেলেটি এখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ের আয়োজন করার জন্য জোর করছে।’ গ্যাটশ্ব বলেছিল । তারপরে সে খুব বিজ্ঞের মতো মন্তব্য করেছিল ‘সমস্ত গন্ডগোলের মুলেই হল রাজনীতি।’ 

       গ্যাটশ্বরের কথা বলার ধরণ দেখে হাসি পেয়ে গেল।

       ‘কী হলো হাসছ যে?’  হাতে পকোড়ার একটা প্লেট নিয়ে পেমা ভেতরে চলে এল। ‘গরম চা আসছে। পকোড়া  খান।’এবার যেন তাকে খুশিখুশি দেখাচ্ছিল। 

      ‘কিন্তু হঠাৎ এভাবে তাড়াহুড়ো করে সব কিছু ছেড়ে রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো কী হল’ পকোড়া খেতে খেতে পেমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ।তাছাড়া কাজকর্ম ছেড়ে যেতে হবে কেন? কাজকর্ম করেও রাজনীতি করা যায়।’

      রাজনীতির কথাটা হঠাৎ আসেনি বহুদিন থেকে কথাটা চলছিল।  সামনে তিব্বতি সংসদের নির্বাচন  রয়েছে। তাই এখন তারা সম্পূর্ণভাবে কাজে লেগে পড়তে চায়। মাথা নিচু করে প‍েমা উত্তর দিয়েছিল। 

      ‘তাছাড়া চাকরি করে সিরিয়াস রাজনীতি করা যায় না’  গ্যাটশ্ব বলে উঠেছিল। আর করাটা উচিতও নয়।

       পেমা তার দিকে কিছুক্ষণ ক্রোধিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।‘তোদের ছেলেদের পক্ষে এই সমস্ত কথা বলাটা সহজ’ পেমা বলেছিল। ‘আমরা মেয়েরা বুঝি একটা সংসার গড়েপিটে তৈরি করার কষ্টের কথা। সব সময়ই দুঃখগুলি আমাদেরকে সহ্য করতে হয়।’

      ‘ইস ছেলেরা কষ্ট পায় না? কী কথা বলছিস তুই?’গ্যাটশ্ব প্রতিবাদ করেছিল ।মা ভেতর থেকে ট্রেতে চায়ের  সাজ- সরঞ্জাম নিয়ে বেরিয়ে আসায় আমাদের কথা বন্ধ হয়েছিল ।ঘরোয়া সমস্যায় যে মানুষগুলি বিপর্যস্ত হয়ে আছে সেটা দেখলেই বুঝতে পারা যায়।

      ‘এত খেয়েছি আর না হলেও চলত।’

      ‘খান এক কাপ গরম গরম চা’মহিলাটি বলেছিল। ‘কতদিন থেকে ভাবছি আপনাদের নিমন্ত্রণ করে এক বেলা ভাত খাওয়াব, কিন্তু এটা ওটা সমস্যার জন্য আর হয়ে উঠছে না । আজ আপনি এসেছেন, বড়ো ভালো লেগেছে ।আমাদের তো বিপদের কথা শুনেছেন।’

      আমি মাথা নাড়লাম। ভেবেছিলাম— ঠিক বিপদ বলা যায় কি? রাজনীতির প্রতি মানুষের আকর্ষণ সার্বজনীন। অনিশ্চয়তা, হ্যাঁ ,অনিশ্চয়তা নিশ্চয় এসে পড়ে পরিবারের ওপরে।

      ‘কিছু একটা সমাধান হয়ে যাবে,’ মহিলাটিকে আশ্বস্ত করার জন্য বলেছিলাম। যে কোনো সমস্যারই সমাধান আছে।’ 

       মহিলাটি ধীরে ধীরে মাথা নেড়েছিল। 

      একটা সময়ে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। মহিলাটি পুনরায় আসার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। পেমা বলেছিল সে পরের দিন অফিসে আসবে। সে পুনরায় ক্ষমা চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম,’ অফিসে এলে মনে হয় তোমার ভালোই লাগবে ।বাড়িতে বসে বসে চিন্তা করতে থাকলেই তো আর সমস্যার নিজে নিজে সমাধান হয়ে যাবে না।’ সে মাথা নেড়েছিল। 

      নিঃশ্বাসের কষ্ট হওয়ায় উঁচু পথটা দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ধীরে ধীরে উঠে আসার সময়  গ্যাটশ্বকে বকে দিয়েছিলাম,’ তুমি তো সমস্যাটির বিষয়ে আমাকে আগেই বলতে পারতে। তাহলে আমাকে গিয়ে এতটা অপ্রস্তুত হতে হত না, পেমাকেও না।তুমি তো আগে থেকেই কথাগুলি জান।’ 

      ‘সমস্যাটা এত বড়ো হয়ে গেছে আমি ধারণা করতে পারিনি। কথাগুলি তো অনেকদিন থেকেই চলছিল। প্রথম দিন পেমা অসুখ  বলায় আমিও অসুখ হয়েছে বলেই ভেবেছিলাম।’

      ‘পেমার দাদা এবং ছেলেটি রাজনীতিতে ঝাঁপিয়েপড়ার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে কেন?’

      ‘রাজনীতি এরকমই,’ দার্শনিকের মতো গ্যাটশ্বমন্তব্য করেছিল।

      রাজনীতির সঙ্গে এতদিন সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে এসেছে। আমরা এই সমস্ত কথা জানি। কিন্তু এখন নির্বাচনের কথা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ওরা বোধহয় অনুভব করেছে যে এখন যদি সম্পূর্ণভাবে রাজনীতিতে ঝাপিয়ে না পড়ে তাহলে ঘটনা তাদেরকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে। ওদের কোনো ভূমিকা এবং গুরুত্ব থাকবে না।’

      ‘এখন আছে নাকি?’

      ‘এখন তারা এমিগ্রে তিব্বতি রাজনীতির ক্রোধী যুবক বলে পরিচিত। ওরা তিব্বতের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার সমর্থক। কমিউনিস্ট চিনের সঙ্গে ওরা কোনো ধরনের আপোস করতে চায় না।’

      উঁচু পথটা উঠে আসার সময় নিঃশ্বাস সংক্ষিপ্ত হয়ে আশায় কথা বলতে পারছিলাম না। মূল পাকা রাস্তাটায় না ওঠা পর্যন্ত আর কথাবার্তা বলতে পারলাম না। রাস্তায় উঠে পাশে থাকা চায়ের একটা দোকানে বেঞ্চে বসে পড়লাম। দেখলাম  গ্যাটশ্বও হাঁপাচ্ছে। এক বোতল মিনারেল ওয়াটার আনিয়ে ঢক ঢক করে আধা বোতল খেয়ে বাকিটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম।

      ‘ইস উপরের দিকে উঠার অভ্যাস না থাকলে বড়ো ক্লান্ত লাগে,’গ্যাটশ্বকে বলেছিল। 

      ‘অভ্যাসটাই আসল কথা।’ সেও উত্তর দিয়েছিল।

      দোকানের মেয়েটিকে দুই কাপ লাল চা দেবার নির্দেশ দিয়ে গ্যাটশ্বককে বসতে বলেছিলাম।

      ‘স্বাধীনতার দাবি না করা কোনো গ্রুপ আছে নাকি?’তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।

      ‘দেশান্তরে থাকা বেশিরভাগ তিব্বতি নেতা, এমনকি দালাইলামাও -তিব্বতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায় না। তারাচিনের ভেতরে তিব্বতের জন্য কার্যকরী স্বায়ত্তশাসন চাইছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং স্বায়ত্তশাসন।’

      ‘চিন সেরকম কোনো দাবি মেনে নেওয়ার সম্ভাবনা আছে কি?’

      ‘ওটা গণতন্ত্র না থাকা একটি একদলীয় শাসনের দেশ– আপনি তো জানেনই,’গ্যাটশ্ব বলেছিল।’ গণতন্ত্র না থাকা দেশে স্বায়ত্ব শাসনের কোনো অর্থ আছে কি? আমার মতে নেই।’

      ‘ভবিষ্যৎ?’

      ভবিষ্যতের কথা কীভাবে বলবে? এখন এই মুহূর্তে এইসবের কোনো ভবিষ্যৎ আছে বলে আমার মনে হয় না। তিব্বতের তো নয়ই। সেই জন্যই পেমা আপনাকে তখনই বলেছিল আমাদের এই শরণার্থী তিব্বতিদের রাজনীতির কোনো ভবিষ্যৎ নেই বলে। আমাদের দেশ নেই— আমরা আছি আপনাদের দেশে শরণার্থী হয়ে। এখানে থেকে আমরা তর্ক করি স্বায়ত্ব শাসন লাগে না স্বাধীনতা লাগে সেই বিষয়ে। এর কোনো অর্থ আছে কি?গ্যাটশ্ব কথাটা খুব ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিল– তাঁর কণ্ঠস্বর হতাশায় ভেঙ্গে পড়েছিল। সেদিন আমি তাকে কিছু বলিনি।

      আমার মন বলছিল অর্থ আছে— মানুষের চিরন্তন স্বাধীনতা প্রয়াসের অর্থ কীভাবে নাই হয়ে যাবে? পৃথিবীতে কোনো জাতি আছে যে অন্যের আধিপত্য মেনে নিয়েছে? স্বাধীনতা সমতা এবং গণতন্ত্রের সংগ্রামই তো মানুষের সংগ্রামের মূলধারা। তাই সংগ্রাম থাকবেই, তৎকালে ভবিষ্যৎ না থাকলেও সংগ্রাম থাকবে, থাকবে সংগ্রামের রাজনীতি।

কিন্তু ,কথাটা তাকে তখন বলিনি। বলতে পারিনি। অর্থহীনতার মধ্যে অর্থের সন্ধান করাটাই হল জীবন।

      অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে দূরের কাছের পর্বত গুলিতে জ্বলে উঠতে শুরু করেছিল সন্ধ্যার আলোক মালা । পাহাড় কন্দরের বুকে যেখানে যেখানে মানুষের ঘর গড়ে উঠেছে সেখানেই জলে উঠেছিল সন্ধ্যার আলো। আলোর বিন্দুগুলি ক্রমে বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। পথের পাশের চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে আমরা পাহাড়ের বুকে বিদ্যুতের বাতি জ্বলে উঠা দৃশ্য  দেখছিলাম।

      গ্যাটশ্ব বলে চলছিল তিব্বতি শরণার্থী সমাজের বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এখন প্রচন্ড হতাশা। তাদের পিতারা আশা করেছিল যে তিব্বতের সমস্যার কিছু একটা সমাধান বের হবে। বিশ্বাস ছিল ,স্বপ্ন ছিল ,প্রত্যাশা ছিল। আজ কিন্তু দিন যাবার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস কমে এসেছে, আশা  অর্ন্তহিত হয়েছে, রাজনীতির কঠোর বাস্তবে ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়েছে অন্তরের অর্ধেক রোপিত স্বপ্ন। প্রবাসী তিব্বতি সমাজটা ক্রমে পরিণত হয়েছে একটি নিরাশার মরুভূমিতে। ভাঙ্গা স্বপ্নের এক শুকনো মরুভূমিতে।

‘আমরা বড়ো অসহায় অনুভব করি ,স্যার,’গ্যাটশ্ব বলেছিল।’ বড়ো অসহায়!’

 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত