| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-৩৮) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায় চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।


অনুবাদকের কথা

কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে। নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা।


 

তুফানের মতো এসে উপস্থিত হয়েছিল রমেন।

তার সব কাজেই হুলস্থুল, তাড়াহুড়ো।

তখন পেমাদের ঘটনাটা ঘটে গিয়েছে কিন্তু মেয়েটি থাকা আমেরিকান ট্রেকিং এর দলটি তখনও মেকলডগঞ্জে আসে নি। অনেকদিন থেকেই সে আসবে আসবে বলছিল, কিন্তু দিল্লির ছেলে তার আসাটা হয়ে উঠছিল না। ডেকে পাঠিয়েছিল, কিন্তু আজ যাব কাল যাব করতে করতে আমারও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আসলে জায়গাটা ছেড়ে দিল্লি যেতে আমারও ইচ্ছা করছিল না। কেউ আমাকে চিনতে না পারা সেই আশ্চর্য পরিবেশটাকে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছিল–সেই এক প্রকারের নামহীনতা , স্থিতিহীনতা সহজ এবং আকর্ষণীয় হয়ে পড়ছিল। রমেন জোর করে থাকা সত্ত্বেও তাই আমার যাওয়া হচ্ছিল না। সে ফোনের মধ্যেই রাগ প্রকাশ করেছিল।

‘কিরে ব্যাপার কি? সেই জায়গাটা ছেড়ে আসতে পারছিস না যে? প্রেমে টেমে ফেসে গেছিস নাকি? তোদের লেখক ইন্টেলেকচুয়ালদের তো কোনো বিশ্বাস নেই। তোরা ফাঁসতে ওস্তাদ।কে, মেয়েটি কে বে? সেই গ্যটশ্বরের যে একজন বোন ছিল–পেমা না থেমা, তাই নাকি?’

আমি বলেছিলাম ,’না সেরকম কোনো কথা নেই।’

কী, কোনো মেয়ে নেই রমেন আশ্চর্য হওয়ার মতো বলেছিল ।মেয়ে নেই। তাহলে কি ছেলে নাকি? চুল দাড়ি লম্বা হিপি সাহেবের প্রেমে পড়লি নাকি—দেখবি ওদের খুব চুলকানি থাকে,’ ফোনের পর্দা ফাটার মতো জোরে হা হা করে হেসেছিল সে।না, রমেনের ওপরে রাগ করে লাভ নেই।

 ‘সত্যি করে বলতো?’ সে সিরিয়াস সুরে জিজ্ঞেস করেছিল।

  ‘সত্যিই কিছু নেই,’ আমি রমেনকে বলেছিলাম। ‘এখানে একা  লুকিয়ে থাকার মতো থাকতে ভালো লাগছে— কার থেকে লুকিয়ে আছি বলতে পারব না। বোধ করি নিজের থেকেও।’

 ‘তোকে সেখানে বিজনেস করতে পাঠানো হয়েছে। লুকানোর জন্য পাঠানো হয়নি।’

 বিজনেস তো ঠিকই চলছে।পুরো বিজি। সব ট্যুর বুকড।আমেরিকার একটা টিম আসা বাকি আছে— ফুল ট্রেকিংয়ের।

  আরে লাথি মার তোর বিজনেসকে,’রমেন গড়গড় করে উঠেছিল। ‘ঠিক যতটা বিজনেস না হলে একটা কোম্পানি বন্ধ হয়ে না যায়, ততটা বিজনেস হয়েছে। না হলে সেই ঘোড়া, খচ্চর, পুরোনো  তাঁবু এবং দুর্গন্ধ থাকা মানুষ নিয়ে করা বিজনেস বন্ধ করে দেওয়া যেত।’

  রমেনের কথায় না হেসে কোনো উপায় নেই।

‘আমার সত্যিই তোকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে বুঝেছিস,’ রমেন বলেছিল। তুই দরকারের চেয়ে বেশি আবেগপ্রবণ। আচ্ছা তুই কোনো ভাবে সেই লাল আলখাল্লা পর লামাদের খপ্পরে পড়েছিস নাকি?’

‘পড়তেও পারি,’ তাকে বলেছিলাম ।

‘পড়িস না, পড়িস না’ সে সিরিয়াসলি বলেছিল। ওদের শরীরে গন্ধ করে।’

‘গন্ধ করে ।আরাধনার ধুপ এবং সুগন্ধি উদ্ভিদের মতো গন্ধ করে।’

‘ওহো হিঙের মতো।’

‘তুই অসমে হিং বিক্রি করতে আসা ভুটিয়ার সঙ্গে কোন লটি-ঘটি করেছিস।’

‘একই এক্‌ই, সব একই।’ 

রমেন আসতে রাজি হয়েছিল। আসলে আসব বলে ঠিক করেই সে সেবার ফোন করেছিল। আসার সময়ও সে হুলুস্থুল করে এল।টয়োটা কোয়েলিছ  গাড়ি ভাড়া করে  সে আরামে এল। অফিসে এসেই সে হইচই শুরু করে দিল। 


আরো পড়ুন: অর্থ (পর্ব-৩৭) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


‘পাঞ্জাবিটাকে ধরেছি বুঝেছিস,’ প্রথমেই সে আরম্ভ করেছিল।‘একদিন সন্ধ্যাবেলা তাকে এক জায়গায় পেয়ে গাড়িতে উঠিয়ে আনলাম। তাকে বললাম, চল এখন গুয়াহাটিতে। সেখানে তোকে অনেক হিসেব দিতে হবে। তোকে গাড়িতে ভরে নিয়ে যাব— রাতে রাতে যাব।’ সে কাকুতি মিনতি করল। অবশেষে আমাদের পাওনা টাকা অর্ধেক পরের দিনই দেবে এটা ঠিক করা হল। বাকিটা সে নাকি কানাডা থেকে পাঠিয়ে দেবে। সেটা বাদ দে—অর্ধেক যে বের করতে পেরেছি…’

‘ওর পিতাজি কী বললেন।’

‘বুড়ো চিৎকার জুড়ে দিল– হা হা হাম লুট গয়া। আমি তাকে এক ধমক দিলাম– হামিকো লুটকে হামি কো কহতা লুট গায়া। ‘

‘তোর সেই ধমকিতে ওরা মেনে নিল?’ তার হিন্দির নমুনা শুনে না হেসে  উপায় ছিল না। 

‘কোথায় ধমকে মানবে? উকিলের মাধ্যমে একটা চুরি জালিয়াতির কেস আমি আগেই ঠিক করে রেখেছিলামতার চার্জশিট প্রমাণ সমস্ত কিছুই রেডি ছিল।দেখিয়ে পুলিশকে দেব বললাম। বললাম পুলিশ কেস দিব নাকি সস্মমানে বোঝাবুঝিতে আসবি। ওরা বোঝাবুঝিতে আসতে চায় বলে জানাল। বেশ খেল খতম। সেই অধ্যায়ের অন্ত পড়ল।’

  রাতের বেলা তাকে আমি পেমার কথা বলেছিলাম।

সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল ওরা কাদের কাছ থেকে স্বাধীনতা চাইছে।

আমি বলেছিলাম ‘চিনের কাছ থেকে।’ 

সে কিছুক্ষণ চিন্তা করার মতো চুপ করে থেকে স্বীকার করল যে এই বিষয়ে সে বিশেষ কিছু জানে না।আমি তাকে সংক্ষেপে সমস্ত কিছুই বললাম। চিনে তিব্বত প্রবেশ করার পর থেকে দালাইলামা পালিয়ে আসা পর্যন্ত, ভারতে থাকা তিব্বতি শরণার্থীদের কথা এবং তাদের সংগ্রামের কথা। সে খুব মন দিয়ে শুনল এবং তারপরে গভীর মন্তব্য করল চিনাদের রাজি করানো মুশকিল হবে। ওরা কিছুই করবে না—তিব্বতের সঙ্গে আলোচনাও করবে না, কিছুই করবে না। আন্তর্জাতিক মঞ্চে গন্ডগোল হলেই বা  চিনকে সেইসব ক্ষতি করবে নাকি?ওরা খুব ধৈর্যের সঙ্গে বুড়াটার  মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।’

‘বুড়ো,কোথাকার বুড়ো? ‘

‘তোর দালাই লামা।’

রমেনের কথা শুনে হতবাক হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।

‘বুড়োটা মারা গেলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে, তখনই চিনারা বাকিদের সঙ্গে একটা বোঝাবুঝি করে ফেলবে।তুই বলিস নি কি দালাই লামার মৃত্যুর তিন চার বছর পরে অন্য একজন দালাই লামার জন্ম হয়।সেই শিশুটি বড়ো হয়ে কথাবার্তা বুঝতে পারা পর্যন্ত আরও কুড়ি বছর লাগবে। লাগবে না কি?’

‘সেই সময়ে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে একজন এজেন্ট থাকবে।’

  কথাটা তো একই। এই দালাই লামাকে পৃথিবীর প্রত্যেকেই মানে।তার অবর্তমানে  এজেন্টদের মানবে কিনা ।কিন্তু এই দালাই লামাকে  শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় নাই কি? ‘

‘সেই জন্যই দালাই লামা একটা নির্বাচিত তিব্বতি পার্লামেন্ট গঠন করেছে। প্রধানমন্ত্রীও এখন নির্বাচিত। দালাই লামার অবর্তমানে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।’

‘হলেও কথাটা একই নয় বুঝেছিস। বুড়োটা মারা গেলে সমস্ত কিছু ওলট-পালট হয়ে যাবে।

চিনারা শকুনের মতো অসীম ধৈর্যের সঙ্গে পথ চেয়ে থাকবে দালাই লামার মৃত্যুর জন্য।‘

রমেন বিশেষ কিছু না জেনেও নির্ভুলভাবে হাত দিয়েছে তিব্বতি সংগ্রামের  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর অংশটিতে, নির্ভুলভাবে। তিব্বতি এমিগ্রেমরা দালাই লামার অবর্তমানে সেই ক্ষণটি পর্যন্ত সবচেয়ে ভয় করে এবং চিন হয়তো অপেক্ষা করে সেই সময়ের জন্য।

 এই তিব্বতি শরণার্থীদের জন্য  সত্যি খারাপ লাগে বুঝেছিস,’ রমেনকে বললাম। ‘ওরা সত্যিই দুর্ভাগা —আর এখন ক্রমে ক্রমে হতাশও হয়ে পড়েছে।’

‘আমরা দেশের ভেতরেই রাজ্য ছেড়ে থাকতে হলে এত মন খারাপ হয় আর এদের নিজের দেশ ছেড়ে লোকের দেশে ঝুলে থাকতে ভালো লাগবে কি? আমি এখনই দিল্লি থেকে কবে ফিরে যাব, কখন ফিরে যাব ভাবছি।’

‘সত্যিই লাগে কি?’

‘সত্যিই লাগে। তোর লাগেনা?’

‘এখন পর্যন্ত লাগেনি। আমি যা সব দেখলাম, যা শুনলাম, যে সময় পার করে এলাম— সেইসব অভিজ্ঞতাই এখনও আমাকে, আমার মনটাকে পঙ্গু করে রাখতে চাইছে বুঝেছ। আমি সেই দুঃস্বপ্ন থেকে যতটা পারি দূরে থাকতে চাই। সেই অতীতের স্মৃতি আমার জন্য বোঝার মতো হয়ে পড়েছে। আমি সেই স্মৃতি থেকে দূরে বিস্মরণের গর্ভে থাকতে চাই– বিস্মৃতি আমার জন্য আশীর্বাদের মতো। আমি এই পাহাড়ে এভাবেই থাকতে চাই।

‘ আমি কিন্তু সেরকম ভাবি না,’ আমার আবেগিক কথার উত্তরে রমেন বলেছিল। দিল্লি বড়ো শুকনো। বেঁচে থাকার ফুৰ্তি এবং উত্তেজনা সেখানে নেই— অন্তত আমার জন্য নেই। ক্লাব ডিস্ক সবকিছুতেই গিয়ে দেখেছি। ওহো। দেখছ না, আমার ওজন বেড়ে গেছে, ভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে। কাজ না করে থাকতে থাকতে মরে যাব বলে মনে হচ্ছে । বোর হচ্ছি। মানুষ এবং ঘটনা থেকে এত দূরে আছি বলে মনে হয়। কখনও আমার এরকম মনে হয় যে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমি সত্যিই ফিরে যাবার কথা ভাবছি। আমি অঞ্জুদাকেও ইতিমধ্যেই বলেছি। তোর কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। আমি তোকে জিজ্ঞাসা করে জানাব বলেছি।’

আমরা সন্ধ্যাবেলা অফিস বন্ধ হওয়ার পরে অফিসে বসে বিয়ার খাচ্ছিলাম।গ্যাটশ্ব বাইরে অপেক্ষা করছিল। অফিসে আমরা কথা বলতে থাকলে তাকে না ডাকলে সে বাইরের সিঁড়িতে বসে থাকত, যেতে বললেও সে যেত না। পরে তাকে আর যেতে বলা হত না। অফিসে বসে এভাবে কথা বলতে থাকলে মনটা ভালো লাগে। রমেন আসার পরে তাকে জোর করে রেখে দিলাম। সেও খুব একটা আপত্তি না করে কয়েকদিন থাকতে রাজি হল।

‘তুই যে ফিরে যাওয়ার কথা বলছিস,’ রমেনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,’ এখন কি আর সেখানে কোনো বিপদ নেই?’

জিজ্ঞেস করব না ভেবেও কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। জিজ্ঞেস করলেই কথা গুলি মনে করতে হবে– মনে পড়বে পুরোনো কথাগুলি, ছবিগুলি। আর আমি সেই কথাগুলি একেবারেই মনে করতে চাইছি না। বেশিরভাগ সময়ই অতীতের কথাগুলি মনে না করার জন্য আমি সক্ষম হয়েছিলাম যদিও কখনও বিশেষ একটি মুহূর্তে কিন্তু স্মৃতিগুলি মনের মধ্যে জেগে ওঠে, কখনও বেশ আচম্বিতে  আর হিংস্রভাবে। এরকম মনে হয় যেন হঠাৎ মুখে কেউ একটা ভেজা কাপড় দিয়ে জোরে ছাঁট মেরে দিয়েছে।

দুটো ফ্ল্যাটই এখন ভাড়ায় দেওয়া হয়েছে। কোনো ব্যাংকের কর্মচারীকে। মা-বাবা এখনও পুরোনো বাড়িতেই  থাকে। ফ্ল্যাটে এসে থাকার ইচ্ছা বাবার পূরণ হল না। ছোটো ভাইও দিল্লিতে, একটা হাসপাতালে রেসিডেন্সি করছে। এবার এন্ট্রান্স দিয়েছিল–পোস্ট গ্রাজুয়েটের জন্য, ভালো বিষয় পেল না। পুনরায় পরের বছর পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। দুই ছেলে বাইরে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই মা-বাবার ফ্ল্যাটে থাকাই হল না। বাবা ফোনে বলেছিল–’আমরা পুরোনো বাড়িটাতেই থাকা ভালো হবে। ফ্ল্যাট দুটো ভাড়া দিলে ভালো টাকা পাওয়া যাবে। তার মধ্যে আমাদের পুরোনো বাড়িটা ভালোভাবে মেরামতি করা যাবে এবং আরও দুটো ঘর বাড়ানো যাবে। আমি আর্কিটেককে দিয়ে সমস্ত কিছু ঠিকঠাক করে রেখেছি। আর আমি নিজে সেখানে থেকে কাজগুলি চোখের সামনে করালে ভালো হবে তাই নয় কি?’ফোনে মাঝেমধ্যে বাবা বাড়ির কাজ কতটুকু এগিয়েছে, কী হচ্ছে সেই সমস্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানিয়ে দিত। কিন্তু বাবার কথা গুলি বেশিরভাগ সময়ই আমার মনে দাগ কাটত না, বরং সেই কথাগুলি কখনও পুরোনো স্মৃতিগুলি, ভুলে থাকতে চাওয়া কথাগুলি বহন করে আনত বলে মনে মনে বিরক্ত হয়েছিলাম।

কখনও ঘর বানানোর কথা, ফ্ল্যাটের কথা–এই কথাগুলি এত অবাস্তব বলে মনে হত–সমস্ত কথাগুলোই যেন একটি স্বপ্ন, এরকম মনে হত। ফ্ল্যাটটার, পান বাজারের সেই বাড়িটার ছবি ইতিমধ্যেই আমার মনের ভেতরে ধূসর হয়ে এসেছিল। দেখতে কী রকম ছিল সেই বাড়িটা সেটা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার স্মৃতি ধূসর হয়ে পড়েছিল। 

এরকম হওয়ায় আমি খারাপ পাইনি, বরং ভালোই লেগেছিল, কারণ আমি অনুভব করেছিলাম যে আমি আর স্মৃতির দাস হয়ে নেই। সেই সময়ের বেশিরভাগ কথাই আমি ভুলে গিয়েছিলাম।

কিন্তু তথাপি এই স্মৃতিগুলি কখনও বিক্ষিপ্তভাবে ফিরে আসত–ভেতরের কোথায় যেন কিছু একটা সার পাচ্ছিল। একটা মিহি ব্যথার মতো, জমাট বাধা সংশয়ের মতো, কিছুটা বিষাদপূর্ণ নস্টালজিয়ার মতো। না না আজকাল সেই নীল বেগুনি মুখটার  ছবি আর মনে ভেসে আসে না–সেই হাঁ করে থাকা মুখটা! চকচক করতে থাকা হলুদ দাঁতগুলি!–সেই ছবিটা আর মনে আসেনা। কখনও আসতে চায়, আর তখনই আমি সচকিত  হয়ে যাই, ভেতরের গভীর কোনো সুরঙ্গে যেন কিছু একটা হঠাৎ উশখুশ করে উঠে– আর আমার সমগ্র সত্তায় ছড়িয়ে পড়ে এক অসহজ এবং অবাঞ্ছিত অনুভূতি। আমি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজেকে অন্য কিছু কাজে ব্যস্ত করে ফেলতে চাই –যাতে, যাতে সেই চিন্তা ,সেই অনুভূতি নাই হয়ে যায়।

স্মৃতি থেকে আসলে কোনো মানুষ পালাতে পারে কি? 

অসুখে মগজ বিকল না হয়ে পড়া পর্যন্ত বোধ করি স্মৃতি হারানো সম্ভব নয়। 

রমেন আমার প্রশ্নের সোজাসুজি উত্তর দেয়নি। সে বলেছিল,’বিপদ? তুই বিপদ যতটা আছে বলে ভাববি ততটাই থাকে, বেশিও থাকে না, কমও থাকে না। আর বিপদ কি? বিপদটা তুই মনে থেকে ভেবে নেওয়া একটা কথা নয় কি?’

‘এভাবে তুই কীভাবে বলতে পারিস? যখন সত্যি সত্যি বাতাসে গুলি উড়ে বেড়ায়, তোর মতো মানুষ গায়ে গুলি লেগে যখন ঘায়েল হয়, কোনো মানুষ যখন সত্যিই গুলি লেগে মারা যায়–তখন বিপদটা মনে ভেবে নেওয়া একটা কথা নয়, এটা সত্যি, এটা বাস্তব।’

বিপদ বাস্তব বলেই ভয়, সন্ত্রাস এগুলোও সত্যি। মানুষ সত্যি আতঙ্কগ্রস্ত।’

‘তুই এই বিষয়ে কী করবি? কী করতে পারিস?’রমেন প্রশ্ন করল। তুই কিছুই করতে পারবি না তোর আয়ত্ত বা নিয়ন্ত্রণের বাইরের জিনিস এইসব। এগুলোর মধ্যেই তোকে বেঁচে থাকতে হবেআমি সত্যিই ফিরে যাবার কথা ভাবছি। অঞ্জুদা বোধহয় এসে কিছুদিন দিল্লিতে থাকবে। এখানেও কিছুদিনের জন্য আসতে পারে। ওখানে পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়েছে। এখন দুই পক্ষই বেছে বেছে আক্রমণ করার চেষ্টা করছে। নেতাদের তাই বেশি ভয়। আমাদের মত লাল্লু পাঞ্জুদের  বিশেষ ভয় নেই। আমাকে অঞ্জুদা ছেলের জন্য স্কুল দেখতে বলেছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। চল আমরা দেরাদুন মুসৌরি ইত্যাদি জায়গায় স্কুল গুলো দেখে আসব।’

অঞ্জুদার ছেলে আছে নাকি?‘আমি অবাক হয়েছিলাম। আগে কথাটা আমি জানতাম না।’ছেলেটা কত বড়ো হয়েছে?’

‘ছোটো, ছোটো ছেলে,’রমেন বলেছিল। কত হবে আর, পাঁচ- ছয় বছরের মতো হবে। অঞ্জুদা ওকে এখন থেকেই নিজের অনিশ্চিত জীবন এবং বিপদ থেকে দূরে রাখতে চাইছে। কথাটা খুব গোপন। তোর আর আমার বাইরে অন্য কেউ জানেনা।’

আমি অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। রমেনের জন্য আমার থাকা জায়গায় একটা ঘর ভাড়া করেছিলাম–পেয়ি গেস্ট হিসেবে। আমি জানি রমেন হোটেলে থাকার চেয়ে এখানে থেকে খুশি হবে। হ্যাঁ তাই ,সে ঘরোয়া পরিবেশটায় খুশি হয়েছিল। পরিবেশটা ভালো হওয়ার ফলেই সে দুই তিন দিন থেকে যেতে রাজি হয়েছিল। সেই রাতে ভাত খেয়ে বিছানায় শোয়ার সময় আমি অঞ্জুদার কথা, বিপদের কথা এবং ছোট্ট ছেলেটিকে বোর্ডিং স্কুলে গিয়ে লুকিয়ে রাখার কথা ভাবছিলাম। 

নিজের পৃথিবীর বিপদ থেকে, নিজের বিপদ থেকে ছেলেকে তিনি দূরে রাখতে চান। হ্যাঁ, লুকিয়ে রাখতে চাইছেন। লুকিয়ে রাখতে যদি না চান কেন এভাবে উড়ন্ত গুলির হাত থেকে, মৃত্যুর বিপদ থেকে নিজের একটি অংশকে সুরক্ষিত করে রাখতে চাইছেন। নিজের ছেলের মধ্যে নিজেকে…

আমি থাকা বাড়িটাতে অন্য প্রান্তের ঘরের আবাসী পন্ডিত রামপ্রসাদের কথা মনে পড়ল। রামপ্রসাদ বৌদ্ধ ধর্মের ওপরে বিদগ্ধ পন্ডিত। মাঝেমধ্যে তিনি এসে মেকলডগঞ্জে বহুদিন থাকেন। এখনকার তিব্বতি বৌদ্ধ গ্রন্থাগারে মানুষটা পড়াশোনা করেন, গবেষণা করেন। তিনি থাকার সময় অনেকগুলি লামা তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। আমাদের থাকা ঘর গুলির মধ্যে থাকা খালি জায়গাতে বসে তারা অনেকক্ষণ আলোচনা করেন। কখনও রামপ্রসাদজি আমাকে দেখলে ডেকে পাশে বসায়। তাঁদের ধর্ম এবং দর্শনের আলোচনায় আমিও এভাবে ভাগ পাই। বেশিরভাগ কথাই বুঝতে পারিনা– যতটুকু বুঝতে পারি ভালো লাগে।

এই পন্ডিত রামপ্রসাদ আমাকে একদিন একটা কথা বলেছিল, কী প্রসঙ্গে বলেছিল এখন মনে নেই। কথাটা এখন হঠাৎ মনে পড়ল।

‘ জান বেটা, এই সমগ্র জীবজগতের মধ্যে মানুষই হল একমাত্র জন্তু, যে জানে যে নিজের মৃত্যু নিশ্চিত। একদিন না একদিন অমোঘ মৃত্যু আসবেই। কিন্তু অন্য জন্তু-জানোয়ার নিজের যে মৃত্যু হবে সে কথা জানে না। তাই ওদের মৃত্যু ভয় নেই, কিন্তু মানুষের আছে। জন্তু-জানোয়ার শারীরিকভাবে দুঃখ পাওয়াকে ভয় করে। সেই ভয়ই ওদেরকে পরিচালিত করে। কিন্তু মানুষ ত্ৰাসিত  হয় মৃত্যু ভয়ে। এই নশ্বর দেহ, এই বিনন্দীয় পৃথিবীর অভিজ্ঞতা, এই জীবনের স্মৃতি শেষ হয়ে যাবে , তার জন্য মানুষ ব্যথিত, ত্ৰাসিত। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মানুষ কল্পনা করে অমরত্বের– আর তার জন্য প্রয়াস করে।’

‘অমরত্বের প্রয়াস করে?’

‘অমরত্বের প্রয়াস করে বেটা!’ পন্ডিত রামপ্রসাদের মুখটা এক ইঙ্গিতময় হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল।’ কেন, রাজা-মহারাজারা বিশাল বিশাল স্মৃতিসৌধ বানায় না? বিশাল প্রাসাদ ,ইমারত গড়ে না? আজকের রাজনৈতিক নেতারা বিভিন্ন জিনিস উদঘাটন করে ফলকে নাম খোদিত করায় না? পরবর্তী প্রজন্ম অগ্রজদের নামে সেতু বিমানবন্দর ইত্যাদি দিয়ে নিজের নামটা চিরকাল বাঁচিয়ে রাখার পথ সুগম করে। মৃত্যুর পরেও মানুষ স্মৃতিতে জীবিত হয়ে থাকতে চায়, বেটা…’

স্মৃতিতে জীবিত হয়ে থাকতে চায়– কথাটা আমার খুব ভালো লেগেছিল।

‘লেখকে যা লেখে, সে চায় লেখার মধ্যে, বইয়ের মধ্যে বেঁচে থাকতে, কবি কবিতার মধ্যে অমরত্ব চায়, গীতিকার সুরকার ভাবে গানের সুরের মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন।’

‘চিত্র শিল্পী ভাবে তাঁর চিত্র তাকে অমরত্ব দান করবে, ভাস্কর ভাবে ভাস্কর্য তাকে অমরত্ব দেবে। বিভিন্ন ধরনে এভাবে মানুষ অমোঘ মৃত্যুর বিরুদ্ধে জয় লাভ করার প্রয়াস করে।’

কথা বলতে বলতে পণ্ডিত রামপ্রসাদ বিভোর হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মনটা যেন দূরে চলে গিয়েছিল। চোখের দৃষ্টি হয়ে পড়েছিল উদাস। জীবনের নশ্বরতা এবং অমোঘ নিয়তির বিরুদ্ধে মানুষের করুণ সংগ্রামের কথা ভেবে তিনি হয়তো উদাস হয়ে পড়েছিলেন।

চিন্তায় ডুবে যাওয়া পণ্ডিত রামপ্রসাদকে সেদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম’ সাধারণ মানুষ? সাধারণ মানুষ কী করে প্রসাদজী?’

‘সাধারণ মানুষ, বেটা? সাধারণ মানুষ বেটা নিজের সন্তানের মধ্যে বেঁচে থাকতে চায়– নিজের সন্তানের মধ্যে।’












error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত