| 27 জানুয়ারি 2025
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

সীতা, দ্রৌপদী ,শকুন্তলা এবং আমি । নিশিগন্ধা তালুকদার

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ—বাসুদেব দাস

লেখক পরিচিতি-

১৯৮২ সনে মরিগাওঁ জেলার জাগীরোডে জন্ম।জাগীরোড মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং ডিমরীয়া মহাবিদ্যালয় থেকে অসমিয়া বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ।২০০৬ সনে ‘গরীয়সী-চন্দ্রপ্রসাদ শইকীয়া গল্প প্রতিযোগিতা’য় পুরস্কার লাভ।বর্তমানে ডিমরীয়া মহাবিদ্যালয়ে প্রবক্তা রূপে কর্মরত।


 

আজ অনেকদিন হল আমাদের বাড়িতে কোনো অতিথি আসেনি। আমিও মা-বাবার সঙ্গে একসঙ্গে বাইরে না যাওয়া অনেকদিন হয়ে গেল। আজকাল ভাতের টেবিলটা ছাড়া তাদের সঙ্গে সারাদিন আমার মুখোমুখি হয় না। আমি ইচ্ছা করেই চাই না। আসলে মা-বাবার ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া চোখ জোড়ার দিকে তাকানোর সাহস আমার নেই। কখনও কিছুক্ষণের জন্য অতিথি এলেও মনটা ভালো হয়ে যায়। ধীরে ধীরে অতিথি আমাদের বাড়িতে আসতে লজ্জা পেতে শুরু করল। কখনও আমার মনে হয়, এই ধরনের তিক্ততা পূর্ণ জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু ভালো। কিন্তু পরের মুহূর্তে মনে হয় কার হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি আত্মহত্যা করব বলে ভাবছি।
আজ ঘরের আরাম কেদারায় বসে নিজের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে । ইচ্ছা করছে জীবনটাকে পুনরায় একবার বিচার করে দেখতে । আসলে আমি কে? কেন আজ আমার এই অবস্থা হল? আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী কে?
আমি চয়নিকা বরুয়া— যে নিজের অস্তিত্বের সন্ধানে হাবুডুবু খাচ্ছি। আজ আমার আছে একটি পরিচয়বিহীন জীবন। স্বামীর দ্বারা, পুরুষ প্রধান সমাজের দ্বারা পরিত্যক্তা একজন নারী আমি। বিয়ের আগে পিতার পরিচয় এবং বিয়ের পরে স্বামীর পরিচয়ে এই সমাজ আমাকে চিনতে পারল। আজ আমার জীবন একটি বোঝা ছাড়া বড়ো বিশেষ কিছু নয়। সীতা, দ্রৌপদী, শকুন্তলা নিজের বৈবাহিক জীবনের বিফলতাকে বুকে নিয়ে এই পৃথিবী ত্যাগ করেছে। আমিও এর ব্যতিক্রম নয়। কারণ আমি এই নারীরই একটি রূপ মাত্র। আজ পুনরায় আমার কাহিনিটা শুরু থেকে লিখব।
আমি জনক নন্দিনী সীতা। যৌবনের দোরগোড়ায় পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে একজন যুবতী স্বপ্নের রাজকুমারকে যেভাবে নিজের করে নিতে চায়, আমিও আকুল হয়েছিলাম নিজের স্বপ্নের কুমারকে স্বামী রূপে পেতে। সয়ম্বরের দিন সুদর্শন চেহারার অধিকারী রামচন্দ্রকে দেখার মুহূর্তে আমার মন রূপী সাগরে আলোড়নের সৃষ্টি হল। তাকে দেখার মুহূর্ত থেকেই রামের অবিহনে বেঁচে থাকাটা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। যেন ভগবান তাকে আমার জন্যই সৃষ্টি করেছে।ভগবান এবং পিতা-মাতার আশীর্বাদ নিয়ে আমরা বৈবাহিক জীবনের যাত্রা আরম্ভ করলাম।ফুলশয্যার রাতে রাম আমার পাশে বসে বলল—সীতা,অযোধ্যার রাজকুমার এই রামচন্দ্র আজ তোমার রূপে সম্পূর্ণ পাগল।আজ থেকে আমি তোমার প্রতিটি সুখ-দুঃখের সমভাগী হলাম।সঙ্গে আমি তোমাকে বচন দিলাম আমার প্রেম জীবনের প্রতিটি ক্ষণে তোমাকে নিরাপত্তা দেব।এখন এসো,আমার দুই বাহুর মধ্যে এসে আমাকে সম্পূর্ণ কর।’
রামের কথার মধ্যে একজন নারী স্বামীর কাছ থেকে কামনা করা সমস্ত নিরাপত্তা আমি পেলাম।তাই রামের সঙ্গে অতিবাহিত করা প্রতিটি মুহূর্তই ছিল আমার কাছে অধিক সুখের এবং শান্তির।কিন্তু এই সুখ আর শান্তি আমি অনুভব করলাম রাবণ বন থেকে আমাকে হরণ করে নিয়ে যাবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত।এর পরেই আমার জীবন অধিক তীব্র রূপে গতি বদলাল।
রাবণের বন্দিশালায় থাকার মুহূর্তেও আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে একদিন হলেও রাম,আমার প্রেম আমাকে রাবণের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করবে।এইসময় একদিন গভীর মাঝরাতে রাবণ আমার কাছে দাঁড়িয়ে বল্ল।‘সীতা,আগামীকাল সকালে হয়তো রাম লঙ্কা জয় করে তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে।হতে পারে এটাই তোমার সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ।আগামীকালের সুর্য আমার ভাগ্যে আছে কিনা আমি জানি না।কিন্তু এই পৃ্থিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে আমি একটা কথা বলতে চাই।সীতা,সমগ্র পৃথিবী জানে আমি তোমাকে হরণ করার উদ্দেশ্য রামের ওপরে নিতে চাওয়া প্রতিশোধ।কিন্তু এই হরণের দ্বিতীয়টি উদ্দেশ্য এতদিনে আমার আর আজ তোমার বাইরে কেউ জানে না।হে সীতা,আমি তোমার প্রেমে পড়েছি।হয়তো এই কথাগুলি আমার প্রতি তোমার ঘৃণা আরও দ্বিগুণ করে তুলবে।কিন্তু এটা সত্য আর আমার প্রেমের জন্য আমি একটুকুও লজ্জিত নি।মানুষের দৃষ্টিতে তুমি কেবল সীতা,আমার সীতা—যার নীরব দর্শনই আমার প্রেমের প্রাপ্তি।’
কথাটা বলেই একটা রথে উঠে তীব্রবেগে আমার সামনে থেকে রাবণ সরে গেল।রাম আমাকে লঙ্কা নগর থেকে উদ্ধার করে নেওয়ার সময় আমার আনন্দের সীমা ছিল না।কিন্তু এই আনন্দ যে এত ক্ষণিকের আমি ভাবিই নি।সমাজের সামনে দেওয়া অগ্নিপরীক্ষা আমার সতীত্বের শেষ পরীক্ষা ছিল না।প্রত্যেক রাতেই আমাকে রামের কাছে একটা অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হ্য।রামের প্রশ্নশেলে আমার হৃদয় রক্তাক্ত হয়ে পড়ে অথচ তার সন্দেহে পরিপূর্ণ প্রশ্নের শেষ হয় না।আমাকে রাবণের কবল থেকে উদ্ধার করার আড়ালের উদ্দেশ্য ছিল রামের নিজের পুরুষত্ব এবং বীরত্বকে জন্মানসে তুলে ধরা ।অবশেষে রামের সন্দেহ আমার প্রেমের মৃত্যু ঘটাল।তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে ত্যাগ করার এবং আমিও কোনো প্রশ্ন না করে রাজমহল ছেড়ে বনবাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।সেই সময়ে আমার মনে একটা প্রশ্ন বার বার দেখা দিল।রাম এবং রাবণ দুজনেই আমার প্রেমের খাঁচায় বন্দি।রাম তার স্ত্রী রূপে এবং রাবণ তার সীতারূপে আমাকে প্রেম নিবেদন করলেন।অথচ দুজনের একজন ও এটা জানতে চেষ্টা করল না আমি কী চাই? আসলে সীতা কাকে পেতে চায়?
সীতার রূপে উদ্বেলিত হওয়া আশা গুলি হৃদয়ে নিয়ে আমি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলাম। ভাবলাম, দ্রৌপদীর রূপে আমি আমার আশা আকাঙ্ক্ষাকে জীবন্ত রূপ দিতে পারব। পাঞ্চাল দেশের কন্যা আমি দ্রৌপদী যুবতী সীতার মতোই অনেক স্বপ্ন বুকে বেঁধে অর্জুনের সঙ্গে আমি শাশুড়ি কুন্তীর আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য দাঁড়ানোর মুহূর্তে এরকম একটি অস্বস্তিকৰ পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম– যার কল্পনা হয়তো স্বপ্নেও করিনি। এখন থেকেই শুরু হল আমার কন্টাকময় বৈবাহিক জীবন। শাশুড়ি কুন্তী কেবল অর্জুনকে নয়, পঞ্চপান্ডবের বাকি চারজনকেও স্বামী রূপে গ্রহণ করার জন্য আমাকে আদেশ দিলেন। এই ধরনের অসম্ভব প্রস্তাব শুনে আমি আশ্চর্য দৃষ্টিতে অর্জুনের মুখের দিকে তাকালাম। অর্জুন ও মৌন হয়ে মায়ের প্রস্তাবে সম্মতি দান করল। আমার স্বপ্নের সংসারটা গড়ার আগেই ভেঙ্গে যাবার ভয়ে আমি নীরবে পঞ্চপান্ডবকে স্বামী রূপে গ্রহণ করলাম। কিন্তু আমার অন্তর জানত যুধিষ্ঠির ভীমকে গুরু জন বলে শ্রদ্ধা এবং নকুল সহদেবকে ছোটো বলে আমার হৃদয় স্নেহ করত। কেবল অর্জুনের সঙ্গে আমার প্ৰেম ছিল। ভাবলাম, আমার অপূর্ণ প্রেমকে অর্জুনের বিশাল হৃদয় পূর্ণ করবে। কিন্তু আমার এই বৈবাহিক জীবনে সীতার চেয়েও ভয়ঙ্কর পরীক্ষা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।
কৌরবের সঙ্গে হওয়া পাশা খেলায় পরাজয়ের বিনিময়ে স্বামী পঞ্চপান্ডব আমার সতীত্ব হরণের জন্য দুঃশাসনের সামনে আমাকে এগিয়ে দিল। রাজমহলের প্রতিজন পুরুষ নীরব হয়ে আমার বস্ত্রহরণ উপভোগ করল। কেউ কামুকের দৃষ্টিতে আর কেউ বিদ্রূপের দৃষ্টিতে। আমার চোখ কেবল অর্জুনের ওপরে।তাঁর চোখ দুটি খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো লাল হয়ে উঠেছে। সেই সময়ে একজন রাজপুরুষের গর্ব, একজন স্বামীর গর্ব সমস্ত কিছুই যেন ধূলিসাৎ হয়ে পড়ল ।
অবশেষে আমাকে সামনে রেখে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আরম্ভ হল। পঞ্চ পান্ডবের হাতে কৌরব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার রাতে অর্জুন এসে আমার শয়ন কক্ষে প্রবেশ করল। অর্জুন ধীরে ধীরে আমার কানের কাছে বলল —’ শোনো দ্রৌপদী , আজ তোমার প্রতি থাকা আমার প্রেমের প্রমাণ আমি দিলাম। পঞ্চপান্ডবের হাতে কৌরব নিঃশেষ হয়ে গেল। এখন তুমি নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী নারী…।’
অর্জুনের মুখের বচন শুনে থাকার শক্তি আমার হয়তো ছিল না। তাই অর্জুনের কথার মধ্যে আমি চিৎকার করে উঠলাম। আমার এহেন আচরণে অর্জুন কিছুটা আশ্চর্য হল। আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি দ্রুত হল।
‘পুরুষ কখনও পরাজয় স্বীকার করতে পারে না বা জানে না।পঞ্চপাণ্ডব ও তার ব্যতিক্রম নয়।আমি শুধু একটী ক্ষুদ্র কারণ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের।কিন্তু একথা তুমিও ভালো করে জান।কুরুক্ষে্ত্র যুদ্ধের প্রকৃ্ত উদ্দেশ্য হল কৌরবদের থেকে তোমরা পাওয়া পরাজয়ের প্রতিসোধ।তুমি ঠিকই বলেছ—আমি এখন সত্যিই সুখী।কারণ তুমি আমার এত দিনের ধারণাকে ভুল বলে প্রমাণ করলে।আমি ভেবেছিলাম,পত্নী দ্রৌপদীর চেয়ে প্রেমিকা দ্রৌপদীই তোমার হৃদয়ে অধিক স্থান দখল করেছিল।কিন্তু আজ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছি আমি কেবল পঞ্চপাণ্ডবের পত্নী পাঞ্চালী।সমাজের সামনে আমার পরিচয় কেবল তোমার পত্নী দ্রৌপদী রূপে,প্রেমিকারূপে নয়।কেননা একজন স্বামী নিজ পত্নীর পবিত্রতাকে সমাজের সামনে এভাবে উলঙ্গ করতে পারে।একজন প্রেমিকের পক্ষে এটা সম্ভব নয়।আমি তোমাকে চেয়েছিলাম…।’
প্রকৃ্তির অকৃ্ত্রিম ভালোবাসা-সাগরে সাঁতরে আজ আমি যুবতী হ্লাম।এবার আমি সমগ্র আশ্রমবাসীর আদরের শকুন্তলা।ধর্মপিতা কণ্বমুনির পিতৃসুলভ স্নেহ এবং সখী অন্সূয়া-প্রিয়ম্বদার ভালোবাসায় আমার হৃদয় পরিপূর্ণ।তথাপি আমার যুবতী মনে কারুর অভাব ভালোভাবে অনুভব করা।দুষ্মন্তের আগমনে আমার জীবনের প্রেমের অগ্রিম বাতাস বহন করে আনল।রাজমহলের রাজনীতি-কূটনীতির মধ্যে অকৃ্ত্রিম ভালোবাসার জন্য সীতা এবং দ্রৌপদীর মনে হাবুডুবু খেল।আজ শকুন্তলা সেই ভালোবাসা পাবে প্রকৃ্তির মনোমুগ্ধকর পরিবেশে দুষ্মন্তের দুই বাহুর মধ্যে।
গন্ধর্ব বিবাহের রাতে দুষ্মন্ত আমাকে কথা দিল—‘শকুন্তলা ,তুমি আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ প্রেম।জীবনের শেষক্ষণ পর্যন্ত আমি কেবল তোমাকেই ভালোবাসব।আমার ওপরে বিশ্বাস রাখা শকুন্তলা,শীঘ্র তোমাকে এই আশ্রম থেকে আন্নদ-উল্লাসে রাজমহলে নিয়ে যাব।’
‘আমি তোমাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করছি,দুষ্মন্ত।বিশ্বাস করছি বলেই পিতার আজ্ঞা অবিহনে আমি তোমার সঙ্গে গোপনে চিরজীবনের জন্য বিবাহের বন্ধনে বাঁধা পড়েছি।তোমার কাছে কেবল আমার একটিই অনুরোধ,আজকের এই বিশ্বাস যেন তুমি কখনও ভেঙ্গে না দাও।’
‘তাহলে এসো শকুন্তলা,মনের সঙ্গে আজ শরীরেরও মিলন হোক।’
পরের দিন সকালে দুষ্মন্ত প্রতিশ্রুতির নয়নে আমার কাছ থেকে বিদায় নিল।
যে বিশ্বাসের কথা বলে দুষ্মন্ত আমার কাছ থেকে চলে গেল,সেই বিশ্বাসকে কিন্তু তিনি বাঁচিয়ে রাখতে পারলেন না।দুষ্মন্ত আমার কাছে ফিরে না আসায় অবশেষে আমি নিজেই কাছে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম।রাজমহলে উপস্থিত হওয়ার আগের মুহূর্তে আমার মন শংকিত যদিও হৃদয়ের কোনো একটি কোণে দুষ্মন্ত আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভালোবাসায় দুই বাহুর মধ্যে জড়িয়ে ধরার স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম।কিন্তু এই স্বপ্নও অসার হল যখন দুষ্মন্ত আজকের পূর্বে কোনো শকুন্তলা নামের নারীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়নি বলে দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে রাজসভায় মুক্তকণ্ঠে চিৎকার করে করে বল্ল।এই বিশ্বাস যেন দুষ্মন্ত আমাকে দেওয়া বিশ্বাসের প্রতিশ্রুতির চেয়েও বড়ো ছিল।শেষ মুহূর্তে আমি অস্থির হয়ে পড়লাম।সুষ্মন্ত আমার নামে পতিতার কলঙ্ক চাপিয়ে দিল।এর পরে ভুয়া স্বপ্নকে বুকে জড়িয়ে রাজসভায় উপস্থিত থাকার কোনো কারণ আমি খুঁজে পেলাম না।
আজ সুদীর্ঘ সাত বছর পরে রাজা দুষ্মন্তের সঙ্গে্ পুনরায় একবার দেখা হল।প্রত্যেকের অনুরোধে এবং পুত্র ভরতের প্রবল ইচ্ছা আমাকে বাধ্য করল দুষ্মন্তের সঙ্গে রাজমহলে যেতে।সমগ্র জগত জানে যে সুদীর্ঘ সাত বছর বিচ্ছেদের পরে দুষ্মন্ত এবং শকুন্তলার মিলন হল।কিন্তু আমার হৃদয় ভালো করে জানত এই মিলন প্রেমিক দুষ্মন্ত এবং প্রেমিকা শকুন্তলার নয়।এই মিলন কেবল রাজা দুষ্মন্ত এবং ভরতের মাতা শকুন্তলার।আমার এই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য ছিল,ভরতকে অবৈধ সন্তানের কলঙ্ক থেকে চিরজীবনের জন্য মুক্ত করা।আজ একজন প্রেমিকা একজন মাতার কাছে পরাজিত হয়েছে।
মাজনী,মাজনী!
মায়ের ডাকে আমি চমকে উঠলাম।চোখ মেলে দেখি,মায়ের হাতে দুটো বিস্কুটের সঙ্গে্লাল চায়ের একটা কাপ।বাইরে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যা হয়ে গেছে।এতটা সময় কীভাবে পার হয়ে গেল বুখতেই পারলাম না।সন্ধ্যার চায়ের কাপ আমার হাতে দিয়ে মা আমার পাশ থেকে সরে গেল।এককালের মায়ের ভালোবাসা এবং গর্বের চয়নিকা আজ সবার করুণার পাত্র।আজ থেকে সাত-আট বছর আগের আমার জীবনটার কথা ভাবলে স্বপ্ন বলে মনে হয়।আমি মা বাবার একমাত্র কন্যা বলেই শৈশব থেকে তাঁরা আমার ছোটো-বড়ো সমস্ত দাবী পূরণ করতে চেষ্টা করেছিল।
গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে এম এ পড়ার সময় আমার সহপাঠী রাজীব তার বন্ধু অপূর্ব শইকীয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল।প্রত্যেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারা একটা বোঝাতে না পারা শক্তি অপূর্বের শরীরে ছিল।অপূর্বের সঙ্গে এই পরিচয় ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব এবং সেই বন্ধুত্ব কখন প্রেমের রূপ লাভ করল বুঝতেই পারলাম না।অপূর্ব ব্যাবসায়ের ক্ষেত্রে কিছুটা সফল হতেই আমরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলাম।বাবা আমাদের বিয়ে নিয়ে প্রথমে আপত্তি করেছিলেন যদিও পরে রাজি হলেন।
আজ আমাদের বিয়ের পাঁচ বছর সম্পূর্ণ হল।বিয়ের দুটো বছর আমাদের বৈ্বাহিক জীবন অতি সুন্দরভাবে পার হয়ে গেল।ব্যাবসার ব্যস্ততার মধ্যেও অপূর্ব আমার জন্য সময় বের করতে ভুলল না।আজও সেই দিনগুলির কথা ভাবলে মনটা ভালো হয়ে যায়।কিন্তু ধীরে ধীরে অপূর্ব বদলে গেল।ব্যাবসায়িক ব্যস্ততার ফলে সাংসারিক দায়িত্বগুলি ভুলে যেতে লাগল।ধীরে ধীরে আমার অনুভব হতে লাগল অপূর্বের কাছে যেন স্বার্থ পূরণের জন্যই আছি।বলতে গেলে একজন পত্নীর মান মর্যাদা তাঁর কাছে গৌণ।
এক সপ্তাহেরও বেশি হল অপুর্ব বাড়িতে আসছে না।একজন ছেলের হাতে তিনি একটি চিঠি লিখে পাঠিয়েছেন।
চয়নিকা,
তুমি আমাকে ভুল বোঝ না।ভেবেছিলাম,তোমার সঙ্গে আমি একটা সুখের সংসার করব।কিন্তু এখন আর তোমার সঙ্গে একসঙ্গে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।সিদ্ধান্তটা তুমিই নেবে এখন তুমি কোথায় থাকবে।পারলে তুমি বাপের বাড়িতে চলে যাও।ইতি-
অপূর্ব।
আজ অপূর্বের বাড়ি ছেড়ে আসা সাতমাস হয়ে গেল।এই সাত মাসে অপূর্ব আমাকে একদিনের জন্যও দেখা করতে আসে নি।আজ শরীরটা খুব বিরক্ত করছে।বড়ো দুর্বল অনুভব করছি।আজথেকে কিছুদিন পরে হয়তো আমাকে এই পৃ্থিবী থেকে যেতে হবে।কিন্তু আমার মৃত্যু কবেই ঘটে গেছে।আমার শরীরকে খুবলে খুবলে খাওয়া এই দুরারোগ্য রোগটার নাম এইডস।সত্যি কথা বলতে গেলে এইডসের মৃত্যু যন্ত্রণা আমাকে এতটা শংকিত এবং মানসিক কষ্ট দেয় নি—যত কষ্ট আমার অন্তরাত্মা অপূর্বর কাছ থেকে পেয়েছে।
ধীরে ধীরে টাকার লালসা অপূর্বকে এভাবে পাগল করে তুলল যে নাম-যশের মুখোস পরে থাকা পুরুষের সামনে আমাকে এগিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করল না।প্রথমে অপূর্বের এই লজ্জিত প্রস্তাবকে আমি একবাক্যে অস্বীকার করলাম।কিন্তু পরে আমি অপূর্বের সামনে পরাজিত হলাম।তারপরে ভাবলাম ,প্রত্যেক রাতেই অপূর্ব আমার শরীরকে ধর্ষণ করার মতোই এখন হয়তো কোনো ক্ষুধার্ত বাঘ আমার শরীরের প্রত্যেকটি অংশকে আঁচরাবে।তাহলে অপূর্ব আর সেই পুরুষগুলির মধ্যে পার্থক্য কোথায়?তাই পরাজিত হরিণ হিংস্র বাঘের সামনে নিজেকে সঁপে দেওয়ার মতো আমিও অপূর্বর সামনে এনে দেওয়া পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণ করলাম।কিন্তু যখনই এই এইডস রোগী চয়নিকার কথা প্রত্যেকেই জানতে পারল,আমার কাছ থেকে ধীরে ধীরে পুরুষেরা দূরে সরে গেল।ভেবেছিলাম,আমার এইডসের কথা শুনে অপূর্ব আমার এই অবস্থার জন্য আক্ষেপ করবে বা আমার কাছে ক্ষমা চাইবে।কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে অপূর্ব তার বাড়ি ত্যাগ করার জন্য আদেশ দিল।
আজ আমি অবশ দৃষ্টিতে পশ্চিমের অস্তায়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলাম—সীতা,দ্রৌপদী,শকুন্তলার মতোই ধীরে ধীরে আমার এই রূপও অস্ত যাবে।এই জীবনে আরও কত পরীক্ষা দিতে হবে আমি জানি না।কিন্তু আমি জানি পুনরায় এই পৃ্থিবীতে আমি ফিরে আসব একটি নতুন রূপে।কাহিনি পুনরায় একই,রূপ নিশ্চয় আলাদা হবে।কিন্তু সেবারও আমার জীবনের সূর্যাস্ত হবে কি?…

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত