মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-১২) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী
মিজোরামের আইজল শহরের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী (১৯৪৮) অসমিয়া সাহিত্যের একজন সুপরিচিত এবং ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। আজ পর্যন্ত আটটি উপন্যাস এবং দুটি উপন্যাসিকা, অনেক ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ইংরেজি ভাষার একটি নতুন দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাস্ট থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিভাজন, প্রব্রজন, ভেরোণীয়া মাতৃত্ব (ভাড়াটে মাতৃত্ব), ধর্ম এবং সামাজিক বিবর্তন ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়। আলোচ্য ‘মহানগরের নয়জন নিবাসী’উপন্যাসে ১৯৩২ সনে স্টালিনের বিরুদ্ধে লেলিনগ্রাডের নয়জন টলস্টয়বাদী গান্ধিজির অহিংসা নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করা আন্দোলনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ দুটি হল From Valley to Valley (Sahitya Akademi, New Delhi, 2010) এবং The Highlanders (Blue Rose Publishers, New Delhi, 2010)। বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ‘স্থানান্তর’ (অর্পিতা প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৭)। বাসুদেব দাসের অনুবাদে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে মহানগরের নয়জন নিবাসীর পর্ব-১২।
ফিয়োডরের মনে পড়ল মারিনা এন্টনভনার গ্রামের বাড়িতে কয়েকবার যাওয়ার কথা। প্রত্যেকবারই গরমের দিনে গিয়েছিল। দু’বারের মতো মারিয়ার সঙ্গে গিয়েছিল অন্যপ দুবার গিয়েছিল বৌদি বারবারার সঙ্গে। কিন্তু প্রতিবারই তার সঙ্গে ছিল টানিয়া।
তিন বছরের বড় টানিয়ার সঙ্গে কিশোর কালে হওয়া ফিয়োডরের অভিজ্ঞতা ছিল বড় মধুর। যখনই সে মারিনা এন্টনভনার গ্রামে টানিয়ার সঙ্গে গিয়েছিল তখনই তারা গ্রামের নির্জন পথে-ঘাটে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াত। মাঝেমধ্যে কখনও কখনও ব্যাঙের ছাতা কুড়োত। সেই গ্রীষ্মকালের বরফহীন মাঠগুলিতে চাষি মানুষদের ক্ষেতের পাশে পাশে দৌড়ে বেড়াত। মাঝেমধ্যে তৈরি করে রাখা কুয়োর পারে মহিলারা জল তুলে কাঠের কলসে করে বাড়িতে জল নিয়ে যেত। শুয়োর এবং বাচ্চাগুলোকে ওরা খাবার দানা দিত । শুয়োরগুলি দানা খেত। ওরা দুই একবার গরুর দুধও দুইয়েছিল। লেনিনগ্রাড মহানগরে না দেখা সেই রঙ্গিন পরিবেশে বাছুর গুলিকে দৌড়াতে দেখে দৌড়ে দৌড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলছিল এবং গায়ের গরম কাপড় খুলে ফেলেছিল ।
ফিয়োডর বারবারা গ্রিগরয়েভনা জিজ্ঞেস করলেন–’ মাসি-ঠাকুরমা এখন বোধহয় বেশ বুড়ি হয়ে গেছে, তাই না বৌদি?’
‘ বুড়ি হবে না?’– মহিলাটি বললেন –’ আমিই এখন ধীরে ধীরে বুড়ির সারিতে পড়েছি। মাসির বয়স হয়তো এখন চার কুড়ি ছুঁই ছুঁই।
ফিয়োডর জিজ্ঞেস করল–’ মাসিঠাকুরমার সঙ্গে দেখা করার জন্য যেতে পারব কি?’
‘ কেন পারবি না? টানিয়াকে আসতে দে?’
টানিয়া ফিরে আসার জন্য ওদেরকে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল না। বত্রিশ বছর যদিও উঁচু লম্বা সুন্দর টানিয়া ঘরটিতে যৌবনোচ্ছল আনন্দ বয়ে আনল।ফিয়োডরকে দেখে সে–’ ও ফিয়োডর বলে জড়িয়ে ধরল।– তুই কেন এত দিন আসিস নি বলে অভিযোগ করল। পুত্র আন্টনের খবরা-খবর নিয়ে তারপর টানিয়া ফিয়োডরের সঙ্গে, নাটালিয়ার সঙ্গে, একইসঙ্গে মা শ্রীমতী গ্ৰিগরয়েভনার সঙ্গেও কথা বলতে লাগল।
সে বলল–’ জান,নাটালিয়া , এই ফিয়োডর বড় লাজুক ছিল। এখন তো দেখছি তোমার মতো সুন্দর বন্ধুও জোগাড় করতে পেরেছে।
নাটালিয়া একটু লজ্জা পেল।
সে কিছু বলার আগেই ফিয়োডর বলল–” ওআমার বন্ধু। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা আমরা দুজনেই একই বিষয়ে গবেষণার সহকর্মী।’
ফিয়োডর তাদের বিষয়টা মোটামুটি ভাবে টানিয়াকে বলল।
কথা শুনেই টানিয়া বলল–’ জান নাটালিয়া, ওর সবসময়ই ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ ছিল। আর আমি ছিলাম ভূগোলের প্রতি ।’
নাটালিয়ার টানিয়াকে বেশ ভালো লাগল। কেননা টানিয়া তাকে উপেক্ষা করেনি। বারবার তাকে কথার মাঝখানে টেনে এনেছে।
ফিয়োডরের তখন সেই কিশোর অবস্থার কথা মনে পড়ল । বন্ধের দিনে ওরা দুইজন সম্পূর্ণ শহরটা ঘুরে বেড়াত। এখনকার সেতু গুলি, পাথরে বাঁধানো পথঘাট গুলি, ময়দান এবং মার্গগুলি এবং জাদুঘর গুলিতে ঘুরে বেড়াত। টানিয়া তাকে কথা গুলি বুঝিয়ে বলেছিল। ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত লাগলেই ওরা একই পার্কে প্রবেশ করে বিশ্রাম নিত।
একবার ওরা এভাবে বসে থাকার সময় পার্কে দুজনেরই কতজন পরিচিত মুখ দেখতে পায় তার হিসাব করেছিল। ওদের হিসেব শেষ হওয়ার পরে ফিয়োডর বলেছিল–’ দিদি টানিয়া, তুমি জিতে গেলে। কিন্তু তুমি আমাকে হিসেবে ধরেছ তো?’
কিশোরী টানিয়া তার কথা শুনে হাসতে শুরু করেছিল। টানিয়া তার পিঠে আলতো করে চাপড় মেরে বলেছিল–’ তোকে হিসেবে ধরব না? তুই আমার এক নম্বর। তুই তো আমার একমাত্র ভাই।’
ওদের কথার শেষ ছিল না।
আরো পড়ুন: মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-১১) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী
ফিয়োডর একদিন অন্য বিষয়ে পড়াশোনা করার সময় ফরাসি এবং জার্মান ভাষায় আভাস নেওয়ার কথা বলতেই টানিয়া বলেছিল–’ আভাস নিয়েছিস মানে? পড়তে শিখতে হবে।’
‘ জার্মান ভাষাটা একটু শক্ত বলে মনে হয় দিদি।’
টানিয়া বলেছিল–’ যতদিন না শিখছিস ততদিনই শক্ত।–ও বলেছিল–’ জানিস, আমাদের এখানকার মহানগরটির যে পুরোনো নাম– সেন্ট পিটার্সবার্গ, এর পিটার ছাড়া বাকিটুকু জার্মান শব্দ। আর আমাদের এখানে যে শীত প্রাসাদ তৈরি করা হয়েছিল, সেই মহান ক্যাথেরিন জন্মগতভাবে ছিলেন জার্মান। মাতৃভাষা হিসেবে জার্মান ভাষাতো জানতেনই আমাদের রুশ ভাষাটা ও অনর্গল বলতে পারতেন। তিনি এতটাই রুশ সংস্কৃতিবান হয়ে পড়েছিলেন যে একবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় ডাক্তারকে বলেছিলেন–’ আমার শরীরে থাকা জার্মান রক্ত বের করে রুশ রক্ত ভরিয়ে দিন।
ফিয়োডর হাসতে শুরু করেছিল। বলেছিল–’ আমি বলে থাকি ইতিহাস আমার প্রিয়, এখন দেখছি তুমিই ইতিহাসের কথা বলছ। অথচ তোমার নাকি ভূগোল প্রিয়।’
টানিয়া বলেছিল–’ হ্যাঁ, ভূগোল আমার প্রিয়। আমি আমার দেশের উরাল পর্বতের কথা জানি। কিন্তু আল্পস তার চেয়েও উঁচু। ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ হল ককেশাস পর্বতমালার এলব্রুস। কিন্তু হিমালয় পর্বতশ্রেণীর এভারেস্টই হল পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বত শৃঙ্গ।’
ফিয়োডর বলল–’ তুমি সত্যিই ভূগোল জান।’
‘ হ্যাঁ, জানিই তো, এখন তুই বলতো’– টানিয়া বলেছিল–’ তোর যে ইতিহাস প্রিয়, বলতো ইতিহাসের কথা।’
ফিয়োডর বলেছিল মহান পিটার এই নেভা ব- দ্বীপ অঞ্চলে সেন্ট পিটার্সবার্গ মহানগর প্রতিষ্ঠা করে রাজধানী এখানে স্থানান্তর করে আনার আগে তিনি পদাতিক বাহিনীর সার্জেন্ট পিটার মিখাইলভ ছদ্মনামে হল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডে কয়েক বছর ধরে জাহাজ নির্মাণের প্রশিক্ষণ নিয়ে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে আসার কথা।
সে বলেছিল মহান পিটার পশ্চিম ইউরোপ থেকে অভিযন্তা এবং কলাকুশলী আনিয়ে পথ-ঘাট- সেতুর সঙ্গে ফ্রান্সের ভার্সেলসে থাকা প্রাসাদের সঙ্গে তুলনা করতে পারা গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদের মতো অনুপম প্রাসাদ তৈরি করার কথা। বলেছিল তাঁর সময়ে পুব দিকের সম্পূর্ণ সাইবেরিয়ার সঙ্গে পশ্চিম দিকে ইউরোপ পর্যন্ত দরজা খুলে বাল্টিক সাগরীয় উপকূল অঞ্চল নিজের দখলে এনে সাম্রাজ্য বিস্তার করার কথা। সে আরও বলেছিল রুশ ভাষার জার শব্দটি ল্যাটিন ভাষার সিজার শব্দ অথবা গ্রিক রাজা সিজার থেকেহওয়ার কথা , কেননা দশম শতকের শেষভাগে আসা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের খ্রিস্টান মিশনারিরা স্থানীয় মানুষগুলিকে গ্রিক অর্থডক্স চার্চের অন্তর্ভুক্ত করেছিল এবং সঙ্গে সাইরিলিক লিপির ব্যবহার করতে শিখিয়ে গ্রিক বাতাবরণের আভাস দিয়েছিল।
ফিয়োডরের কথাগুলি শুনে টানিয়া প্রশংসা করেছিল এবং খুব খুশি হয়েছিল।
সেই টানিয়াই তাকে ঠাকুমার মারিয়া বলার জন্য শীত প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে সেখানকার সুন্দর তৈল চিত্রগুলি দেখিয়ে যতটা পারে ততটা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছিল।
এই আত্মীয়তার জন্যই ফিয়োডর টানিয়াকে ঠাকুরমা মারিনার বাড়িতে একসঙ্গে যাবে বলে বলার জন্য অপেক্ষা করছিল। সে টানিয়াকে বলল–’ টানিয়া দিদি, আমার ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ থাকার জন্যই আমি গবেষণা করছি। সেই বিষয়ে পড়াশোনা করে থাকার সময়েই পেলাম এই’ লেনিনগ্রাডের নয় জন নিবাসী’ কেসটির কথা। তার প্রসঙ্গে আমরা দুজন ঠাকুরমা মারিনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে কি?
টানিয়া বলল–’ ঠাকুমার বাড়ি যেতে হলে খুশিই হব। কিন্তু আগামীকাল নয়। পরশুদিন। দিনে দিনে।
ফিয়োডর সায় দিল।
টানিয়া হেসে নাটালিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল–’ বুঝেছ নাটালিয়া, আমি একে মহানগরের প্রায় সমস্ত কিছুই দেখিয়েছিলাম। পরে মহানগরের ইতিহাস ওই আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারার মতো হল। আগামীকাল তুমি ওর সঙ্গে শহরটা দেখবে।ও তোমার ভালো গাইড হবে।’
দুদিন পরে ফিয়োডররা যখন শ্রীমতী মারিনা এন্টন’ভনার গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হল, তখন তিনি উঠোনের একটি বেঞ্চে বসে রোদের তাপ নিচ্ছিলেন। বাড়িটার কোনো পরিবর্তন হয়নি। গ্রামটিরও কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাড়ির চারপাশের কাঠের তৈরি কিছু বেড়া হেলে পড়েছিল। ভেতরে থাকা ঘরগুলিও মাঝেমধ্যে পুরোনো বলে মনে হয়েছিল। সবার জন্য নির্মিত কুয়ো থেকে তখনও মানুষ জল বহন করে আনত।
পরিবর্তন হয়েছিল গ্রামে যাওয়া পথটির। একটু বড়োসড়ো হয়ে পড়া পথটিতে বাসের চলাচল বেশি বলে মনে হয়েছিল। মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছিল বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ক্ষেতের মাঠ, দেখতে পেয়েছিল তার মধ্যে একত্রিত হয়ে থাকা ত্রিশ চল্লিশ ঘর মানুষের কম বসতিপূর্ণ গ্রাম। মারিয়া এন্টনভ’নার গ্রামটিও সেই ধরনের গ্রাম ছিল।
ফিয়োডরদের দূর থেকে দেখতে পেয়ে মারিনা এন্টনভ’না চিনতে পারলেন না। কাছে গিয়ে টানিয়া যখন ডাকল তিনি তাকে চিনতে পারলেন।ফিয়োডরকেও চিনতে পারলেন।তাঁর জরাগ্রস্ত ফোকলা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল এবং বসে থাকা অবস্থাতেই ওদের গাল দুটি কাছে টেনে এনে আদর করলেন।
টানিয়া ঠাকুরমাকে ফিয়োডরদের আসার কারণটা বলল–’ ওরা ঠাকুরমা নাদিয়া পপভনার কথা জানতে চায়। ঠাকুরমা মারিয়া আর বেঁচে নেই। তুমি তো তাকে পেয়েছিলে। তাঁর কথা একটু বলবে কি?’
মারিনা এন্টনভ’না কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর মনে করে করে বলতে লাগলেন–’ নাদিয়া দিদি এবং আমার দিদি মারিয়া গলায় গলায় বন্ধু ছিল। বড় প্রিয় বন্ধু। সেই জন্য আমিও তাকে মাঝেমধ্যে দেখতে পেতাম। তাঁরা ছিলেন লেনিনগ্রাডের পাশের অঞ্চলের । আমি দু-একবার গিয়েছিলাম।’– তিনি অল্প মনে করার চেষ্টা করলেন এবং পরে বললেন–’ওখটিনস্কি সেতু পার হয়ে তারপর আধ ঘণ্টার পথ ট্রামে গিয়েছিলাম । ট্রাম থেকে নেমে দক্ষিণ দিকে চল্লিশ মিনিটের মতো পথ পায়ে হেঁটে গিয়েছিলাম। গরমের দিনে পথটা কিছুটা ধুলায় ধুসরিত ছিল।’
নাটালিয়া দু’একটি কথা লিখে নিল।
মারিনা এন্টনভ’না বললেন–’ মারিয়া এবং নাদিয়া দিদি একই জিনিস ভালোবাসতেন– পড়া-শোনা, কলা-সংস্কৃতি। তাঁরা বই পড়তেন, ভাষা শিখেছিলেন। গালিনা ওলান’ভার বেলে দেখার জন্য পয়সা জমিয়েছিলেন।’
মহিলাটি একটু থামতেই ফিয়োডর জিজ্ঞেস করল–’ ঠাকুরমা, তাঁরা টলস্টয়ের বই পড়ত কি?’
মারিনা এন্টনভ’না যেন সজাগ হয়ে পড়লেন। স্পষ্ট কণ্ঠে বললেন–’ টলস্টয়? লিও টলস্টয় ছিলেন তাঁদের একেবারে বুকের কাছটিতে। ওদের দুজনেই বিদেশি ভাষা শিখেছিলেন একটি কারণে– টলস্টয়ের মা– হ্যাঁ মনে পড়েছে– টলস্টয়ের মায়ের নাম আর আমার দিদির নাম একই ছিল– মারিয়া– মারিয়া নিক’লায়েভনা টলস্টয়। টলস্টয়ের মা নাকি রুশ ভাষা ছাড়াও চারটি বিদেশি ভাষা জানতেন। সঙ্গে ভালো পিয়ানো বাজাতে পারতেন। নাদিয়া দিদির সঙ্গে আলোচনা করে মারিয়া দিদিও ঢাকনি থাকা একটা পিয়ানো কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তা হয়ে উঠল না।’
নাটালিয়া ফিয়োডরের দিকে তাকাল।ফিয়োডর কিন্তু উৎসুক হয়ে ঠাকুমার দিকে তাকিয়ে ছিল। সে জিজ্ঞেস করল–’ ঠাকুরমা, তুমি নাদিয়া ঠাকুমাদের বাড়িতে কাকে কাকে দেখতে পেয়েছিলে?
মহিলাটি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন–’ আমার এত ভালো মনে নেই। মা ছিলেন। কিন্তু নাদিয়া দিদির একজন দাদাও ছিল। নামটা–।’
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ঠাকুরমা বললেন–’ মিখাইল। মিখাইল প’পভিছ ছিল তাঁর নাম।’
ফিয়োডর উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল–’ মিখাইল প’পভিছ ভেছিলিয়েভ?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ ওটাই তাঁর সম্পূর্ণ নাম।’
ফিয়োডরের প্রশ্ন এবং মহিলাটির কথা শুনে নাটালিয়ার মনে পড়ল সেই নামটিও’ লেনিনগ্ৰাডের নয়জন নিবাসী’র কেসটিতে সন্নিবিষ্ট একটি নাম। হয়তো চার নম্বরে রয়েছে।
মহিলাটি কিছুটা ভাবুক হয়ে পড়লেন। তিনি বললেন–’লিঅ’নিডই কেবল নয় মিখাইলও দেখতে খুব সুন্দর ছিল।’
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পুনরায় বললেন–’ বড় সুন্দর স্বভাবের ছিল সে।’
টানিয়া ঠাকুমার আবেগ দেখে মনে মনে খুব খুশি হল। সে জিজ্ঞেস করল–’ ঠাকুরমা তুমি তার প্রেমে পড়েছিলে নাকি?’
মহিলাটির মুখটা কিছুটা কোমল হয়ে এল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হাসি ছড়িয়ে তিনি বললেন– ‘আমি খুব ছোট ছিলাম। দিদিদের থেকে পাঁচ বছরের ছোট। নাদিয়া দিদি লিঅ’নিডকে ভালোবাসত। মিখাইলকে অবশ্য আমারও ভালো লেগেছিল। কিন্তু ছোট ছিলাম।’
কিছুক্ষণের জন্য সবাই নীরব হয়ে পড়ল। নীরবতা ভাঙল ফিয়োডর। সে জিজ্ঞেস করল–’ ঠাকুরমা, তোমার কাছে ওদের কোনো চিহ্ন আছে কি?’
ঠাকুরমা কিছুক্ষণের জন্য ভাবতে লাগল। তারপর বলল–’ থাকতে পারে।’
টানিয়া জিজ্ঞেস করল–’ ঠাকুরমা, দেখাতে পারবে কি?’
‘বলতে পারি না কোথায় আছে। দেখতে পারি।’
লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে মারিনা এন্টন’ভনা র সময় লাগল। টানিয়া তাকে সাহায্য করল। সঙ্গে গ্রামের একটি মেয়ে সাহায্য করল।
তিনি থপ থপ করে ভেতরে গেলেন। ভেতরের সেলফে বইপত্রের সঙ্গে টলস্টয়ের তিনটি বই পাওয়া গেল। একটিতে ছিল লিঅ’নিড এডলারের সই,দ্বিতীয়টিতে ছিল মিখাইল প’পভিছ ভেসিলিয়েভের এবং তৃতীয়টিতে ছিল পিটার যেলেনক’ভরের।
নাটালিয়া বইগুলির সই করা পৃষ্ঠার ওঅপরে হাত বোলাতে লাগল। ওদের খুব ইচ্ছে করল বই গুলি সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু ঠাকুমার আবেগকে আঘাত দিতে ইচ্ছে করল না।
‘ দেশের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকায় দিদি নাদিয়া আমার দিদিকে লেনিনগ্ৰাডের বাড়িতে রেখে আসতে বলেছিল । তারপর মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় দিদি একবার এখানে আসার সময় বইগুলি সেখান থেকে এখানে নিয়ে এসেছিল। মেটে বর্ণ লাভ করা বইয়ের পাতাগুলি নাটালিয়া আলগোছে উল্টে যাচ্ছিল । হঠাৎ বইয়ের ভেতর থেকে দুটি ফোটো মেঝেতে খসে পড়ল । নাটালিয়া দ্রুত ফোটো দুটি তুলে নিল। ফোটো দুটি যথেষ্ট পুরোনো– ধোঁয়া এবং পাতলা হলুদ বর্ণ লাভ করা। সে একটা ফোটো চিনতে পারল–ঝুলে পড়া দীর্ঘ দাড়িতে ওটা লিও টলস্টয়ের ফোটো। অন্যটি কার সে বুঝতে পারল না। কোট টাই পরা একজন গাঢ় মোচ থাকা যুবকের। মাথার চুলের সিঁথি সুন্দর করে আঁচড়ানো।
নাটালিয়া ফোটোটা ফিয়োডরের দিকে এগিয়ে দিল ।ফিয়োডরও ফোটোটা চিনতে পারল না।
ঠাকুরমা পুনরায় বললেন – ওদের আরও একটি জিনিস আছে ।
ফিয়োডর এবং নাটালিয়া মহিলাটির দিকে মাথা তুলে তাকাল।
‘ একটি চেস বোর্ড। কোথায় বা আছে? সেই বোর্ডটিতে মিখাইল এবং লিঅ’নিড দাবা খেলছিল। সেটিও নাদিয়া দিদি মারিয়াকে দিয়েছিল ।’
টানিয়া বলল–’ ঠাকুরমা, সেটা তুমি খুঁজে রাখবে। আমরা পুনরায় আসব– দেখার জন্য।’
টানিয়া হাতের ঘড়িটার দিকে তাকাল।
ফিয়োডর দ্রুত জিজ্ঞেস করল–’ ঠাকুরমা, তোমার দিদিরা টলস্টয়বাদী ছিলেন কি?’
বুড়িটি কিছু সময় অবাক হয়ে রইল। তিনি বললেন–’তাঁরা ছিল কি? ছিল বোধহয়। কিন্তু নাদিয়া টলস্টয়বাদীর প্রেমে পড়েছিল। মারিয়া দিদি তাদের সাহায্য করেছিল। নাদিয়া দিদিদের বাড়িতে মাঝেমধ্যে সেই মানুষগুলির সভা বসত। সেটাই শেষ পর্যন্ত অনেক দূর্যোগ ডেকে এনেছিল।’
মানুষটার নিস্তেজ চোখজোড়া অশ্রুসজল হয়ে উঠল।
তাদের জীবনে কী দুর্যোগ নেমে এসেছিল? বারবার জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও মারিনাএন্টন’ভনা চুপ করে রইলেন। তাঁর চোখ দুটো দিয়ে ধারাসার চোখের জল বইতে লাগল।
ফিয়োডররা ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হল।
তখনই কাঠের গেটটা খুলে একজন বুড়ি মানুষ ধীরে ধীরে ভেতরে চলে এল।তাঁর হাতে থাকা ছোট একটি বেতের ঝুড়িতে কয়েকটি ফল ছিল।পা টিপে টিপে আসা বুড়িটি কম্পিত কন্ঠে বলল– টানিয়া এবং ফিয়োডর এসেছে শুনলাম। ওদের জন্য এই কয়েকটি এনেছিলাম।
টানিয়া এবং ফিয়োডর প্রতিবেশী মহিলাকে অভিবাদন জানাল । থাকতে পারছে না বলে দুঃখ প্রকাশ করল এবং ফলগুলি বেঁধে নিয়ে ঘর থেকে
বেরিয়ে এল।
পরের দিন ফিয়োডররা লেনিনগ্রাডের ওখটিনস্কি সেতুর কাছে গেল। ওরা দক্ষিণ দিকে ট্রামে করে আধ ঘণ্টার পথ গেল। সেখানে নেমে একটু মাঠের দিকে নেমে গেল। সেখানে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছিল খেতির মাঠ। ঠাকুরমা নাদিয়া পপভ’নার ঘর কোন দিকে ছিল তা তারা বুঝে উঠতে পারল না।
ফিয়োডর বলল–’ কোনদিকে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। দেশটা অনেক বদলে গেছে।’
নাটালিয়া সায় দিয়ে বলল–’ হ্যাঁ ফিউডোর, ষাট বছর আগের ঠিকানাটা আমাদের খুঁজে বেড়ানো বৃথা হবে। তাহলে আমাদের লেলিনগ্ৰাডের কাজ শেষ হল নাকি?’
ফিয়োডর সায় দিয়ে বলল–’ শেষ হল বলেই মনে হচ্ছে। আমাদের এখন ঠাকুরমা নাদিয়া প’পভনার খোঁজে যেতে হবে। গন্তব্যস্থান হবে লেনা অঞ্চলের য়াকুরিম গ্ৰাম। তার জন্য আমাদের ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথ দিয়ে মস্কো থেকে যেতে হবে।’
‘ কিন্তু।’– সে চিন্তিতভাবে বলল–’ ঠাকুরমা বেঁচে আছেন তো ।’

অনুবাদক