| 27 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-১১) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, Assamese literature Dipak Kumar Barkakati 1মিজোরামের আইজল শহরের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী (১৯৪৮) অসমিয়া সাহিত্যের একজন সুপরিচিত এবং ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। আজ পর্যন্ত আটটি উপন্যাস এবং দুটি উপন্যাসিকা, অনেক ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ইংরেজি ভাষার একটি নতুন দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাস্ট থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিভাজন, প্রব্রজন, ভেরোণীয়া মাতৃত্ব (ভাড়াটে মাতৃত্ব), ধর্ম এবং সামাজিক বিবর্তন ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়। আলোচ্য ‘মহানগরের নয়জন নিবাসী’উপন্যাসে ১৯৩২ সনে স্টালিনের বিরুদ্ধে লেলিনগ্রাডের নয়জন টলস্টয়বাদী গান্ধিজির অহিংসা নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করা আন্দোলনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ দুটি হল From Valley to Valley (Sahitya Akademi, New Delhi, 2010) এবং The Highlanders (Blue Rose Publishers, New Delhi, 2010)। বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ‘স্থানান্তর’ (অর্পিতা প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৭)। বাসুদেব দাসের অনুবাদে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে মহানগরের নয়জন নিবাসীর পর্ব-১১।


দুপুরের আহার শেষ করে উঠে ওরা ডিমিট্রি গরিন পরিবারের বাড়িতে যাবার জন্য প্রথমে পাতাল রেলে উঠল।

ফিয়োডরকে যখন এগারো বছর বয়সে মা ওলগা পেট্রভনাডিমিট্রি গরিন পরিবারের কাছে এনেছিল তখন গরিনের হাড়ে দুব্বো গজিয়েছিল। ১৯৩৫ সনে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং বিভিন্ন জায়গার কারাগারে রেখে অবশেষে তাকে অন্য কয়েদিদের সঙ্গে শ্বেত সাগরের প্রণালী তৈরি করা গুলাগে রাখা হয়েছিল। স্টালিনের মৃত্যুর দুই বছর পরে ১৯৫৫ সনে ৫৫ বছর বয়সে ক্ষীণহয়ে পড়া রোগি ডিমিট্রি গরিনকে শত শত নির্দোষ মানুষের সঙ্গে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। ঢিলেঢালা পোশাক এবং বিশাল টুপি পড়ে তিনি যখন তাদের এপার্টমেন্টেউপস্থিত হয়েছিলেনতখন পত্নী মারিয়া এন্টনভনা ডিমিট্রি গরিনকে চিনতে পারেনি। মানুষটা আবেগবিহ্বল কণ্ঠে বলে উঠেছিল–‘ মারিয়াআমার ভালোবাসার মারিয়াআমি ডিমিট্রিতোমার ডিমিট্রি গরিন।

মারিয়া এন্টনভনা কুড়ি বছর ধরেনা দেখা স্বামীর কাছে এসে ধীরে ধীরে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল। তার দুচোখে সেই শীতের বাতাবরণেও তপ্ত চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল। অনেকক্ষণ ধরে মারিয়ার দু চোখ ভিজে ছিল। তারপরের যে বারো বছর ডিমিট্রি গরিন বেঁচে ছিলেন তিনি নিজের রুগ্ন শরীরটার জন্য পরিবারটাকে বেশি কিছু দিতে পারেননি। কিন্তু অপবাদের মানসিক পীড়া থেকে মুক্ত হওয়া এবং সঙ্গে প্রতিবেশীদের কাছে মাথা তুলে চলাফেরা করতে পারা মারিয়ার দৈহিক কষ্ট ছিল ততটাই নগণ্য।

ডিমিট্রি গরিনের গ্রেপ্তারের সময় তাদের একমাত্র পুত্র গেভরিলের বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। তারপর থেকে বেকারিতে কাজ করা মারিয়া পেট্রভনা বড় কষ্ট করে তাকে লালন পালন করেছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মারিয়া ছেলে গেভরিলকে নিয়ে লেনিনগ্রাড থেকে ২২ মাইল দূরের গ্রামে বোন মারিয়ানার ঘরে থাকতে শুরু করল। কিন্তু যখন ১৯৪১সন থেকে নাৎসিরা লেনিনগ্রাড নিজের দখলে নেবার জন্য অবরোধ করে প্রায় ৯০০ দিন ধরে রাশিয়ার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে শহরটা বিধস্ত করতে শুরু করল এবং যখন আহতদের শুশ্রূষার জন্য অনেক নার্স ক্ষুধার্তদের খাওয়ানোর জন্য অনেক রাঁধুনীকাপড় সেলাই করার জন্য দর্জি এবং শহরের সুদীর্ঘ শীতকালে পড়ার জন্য জুতো তৈরি করার মহিলাদের আবশ্যক হলতখন মারিয়া এন্টনভোনাও কাজে যোগ দিলেন। কিছু মহিলা এমনকি বন্দুক চালানোর প্রশিক্ষণও নিলেন। কিন্তু মারিয়ারা বলল – মানুষকে হত্যা করাটা মহিলাদের কাজ নয়।‘ মারিয়া বলল–‘ আমি বেকারিতে কাজ করেছিলাম। আমি রাঁধুনি হব। মানুষকে খাওয়াব।‘ বোন মারিনা বলল–‘ আমরা গ্রামে দৈহিক কাজ করেছিলামআমি জুতো স্যান্ডেল তৈরি করব।

মারিয়া এন্টনভনা ডিমিট্টি গরিনের প্রতি করা অবিচারের কথা ভুলে মারিনাদের গ্রামে গেভরিলকে ছেড়ে লেনিনগ্রাডের যুদ্ধের মধ্যে এল। আকাশ মার্গথেকে হওয়া বোমাবর্ষণনিচে হওয়া গুলিবর্ষণ এবং তার মধ্যে তীব্র শীতে বরফের স্তুপের মধ্যে যুদ্ধে আহত হয়ে গোঙ্গাতে থাকা সৈনিকদের খাবার জন্য সে ছাউনির রন্ধনশালায় অন্যের সঙ্গে মাংস রাঁধতে লাগল। এপ্রন পরে মাথায় কাপড় বেঁধে ছাউনির এদিকে ওদিকে ভারী ভারী বালতিহাড়ি এবং কাঁসার বাটি নিয়ে সে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সৈনিকেরা সীমান্ত থেকে কিছুটা বিশ্রামের আশায় এবং শান্তির খোঁজে এসেছিল। তারা সবাই ছিল নোংরা এবং ক্লান্তিতে অবশ প্রায়। কিছু ছিল পঙ্গু এবং কয়েক জনের হাত এবং পা তুষার অসার করে তুলেছিল। গরম জায়গার বাসিন্দা উজবেক এবং তাজিক সৈন্যরা বেশিরভাগ হিম–তুষারের শিকার হয়েছিল। তারা হাত দিয়ে একটা চামচও তুলে ধরতে পারছিল না। মারিয়া ওদেরকে লুথুরি (মাংসখাইয়ে দিয়েছিল। মুখগুলি গরম জলে ধুয়ে ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুছে দিয়েছিল।

তাকে মাঝেমধ্যে ভারী লোহার কড়াই ও গায়ের জোরে তুলতে হত। বোমাবর্ষণের মধ্যে খড়ি আনতে হতজল আনতে হত। সঙ্গে বড় বড় আটার বস্তাও বহন করতে হত। যখন সে পাউরুটি এবং মাংস অবশ প্রায় সৈনিকদের খাইয়ে দিচ্ছিলতখন তাদের কয়েকজন তাকে রুশ ভাষায় ধন্যবাদ দিয়েছিল। অন্যরা কিছু অন্য ভাষায় ও কথা বলেছিল। মারিয়া কথাগুলি বুঝতে পারছিল না যদিও মুখাবয়বেরঅভিব্যক্তিতে ভাবগুলি বুঝতে পারছিল। ওদের চাহনিতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছিল এবং সে কাজ করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিল।

অন্যদিকে মারিয়ার বোন মারিনা এন্টনভনা জুতো তৈরির কাজে মনোনিবেশ করেছিল। মারিনা একদিন দুজন নার্সের কাছ থেকে চিকিৎসালয়েরদূরবস্থার কথা শুনতে পেয়ে দেখতে গিয়েছিল। সে দেখেছিল চিকিৎসকরা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে।আহতদের ভালো হওয়ার জন্য অনেক সময়ের দরকার হয়ে পড়ছে। মাঝেমধ্যে রোগগুলির পুনরাগমনহচ্ছে। কেননা রোগীরা ঠাণ্ডা মেঝেতে খালি পায়ে এদিকেওদিকে ঘোরাফেরাকরছে।

চিকিৎসালয় থেকে এসেই মারিনা দেখে আসা কথাগুলি বর্ণনা করে তাদের পরিচারিকাকে বলল– জুতোর চেয়ে রোগীদের জন্য শ্লিপারের বেশি আবশ্যক। আমরা কয়েকজন শ্লিপার তৈরি করতে চাই। অনুগ্রহ করে অনুমতি দিন।

মারিনা এন্টভনাঅনুমতি পেল এবং জুতো তৈরি করা কাজ বাদ দিয়ে ছেঁড়া কম্বল গুলি থেকে ঠান্ডায় পরার জন্য স্যান্ডেল তৈরি করতে লাগল। যে সমস্ত কম্বলের টুকরো স্যান্ডেল তৈরি করার জন্য অনুপযুক্ত হল সেই সব ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের জন্য পুতুল তৈরি করার জন্য পাশের গ্রামের কিশোরকিশোরীদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হল।

বোমা বর্ষণ গোলাগুলি চলতেইথাকল।

মারিনাএন্টভনারএকজন নার্সের সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল। নার্সটি বলেছিল –‘ আমাদের শেখানো হয়েছে যে মাথা এবং পেটের আঘাতই সবচেয়ে গুরুতর। তাই বোমা বা গুলিবর্ষণ হলেই পেট এবং মাথাটা বাঁচাতে হবে। আমরাও আঘাত প্রাপ্ত সৈনিক দেখলেই প্রথমে এই দুটি অংশ পরীক্ষা করি। তারপরেচিকিৎসার গভীরতা নিরূপণ করি।

সেই নার্সটি মারিনা এন্টভনাকে বলেছিল–‘ প্রথম আঘাত প্রাপ্ত সৈনিকের চিকিৎসা করতে গিয়ে আমাদের মধ্যে একজন কিশোরী নার্সের মূর্ছিত হওয়ার মতো অবস্থা হয়ে পড়েছিল। সৈনিকটির পায়ের হাড় ভেঙেছিল এবং প্যান্ট ছিঁড়ে হাড় বেরিয়ে এসেছিল। কিশোরী নার্সটির অবস্থা দেখে আহত সৈনিক কাতরোক্তি করা বন্ধ করে তাকে বলেছিল– সিস্টার তুমি একটু জল খেয়ে সুস্থ হয়ে নাও। তারপরে আমার পা টা বেঁধে দিও।‘ 

আহতদের চিকিৎসা করেখাবার খাইয়ে আস্বাদন দিয়ে মারিয়া এবং মারিনারা কোনো কোনো সন্ধ্যাবেলা একটি আলোহীন ছোট ছাউনিতে একত্রিত হত। ওরা চুপিচুপি রেডিওতে ভেসে আসা খবর শুনত। শহরটিতে নাৎসী বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে ওদের সৈন্যদের স্থিতি দৃঢ়হয়ে আসার খবর ওদের মন গুলিকে কিছুটা সতেজ করে তুলেছিল। তার মধ্যে ওরারেডিওতেশুনতে পেয়েছিল একজন তরুণীর কণ্ঠ। সেই তরুণী কবিতা পাঠ করছিল। সেই তরুণের কন্ঠ শুনলেই ওরা রেডিয়োরআর ও কাছাকাছি চলে আসত। সুরেলা কণ্ঠের এই যুবতি কবিতার মাধ্যমে লেনিনগ্রাডবাসীদের মনের কথা বলছিল– ওদের যন্ত্রণার কথাওদের শত্রুর হাতে বলি হওয়ার কথাওদের ক্ষুধার্ত দেহের কথাতুষারপাতে অসার হয়ে যাওয়া অঙ্গের কথাসঙ্গে আকাশমার্গ থেকে বোমাবর্ষণের কথা।– এই যুবতিটি তার কোমল কন্ঠে আবৃত্তি করে গিয়েছিল মানুষের হৃদয়ের কথা। একবার সে বলেছিল– আমি লেনিনগার্ডের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে যাইনি। আমাদের সৈনিকরাও সরে আসেনি। যুদ্ধ করছেগুলির সম্মুখীন হচ্ছে। আহত হচ্ছে, যন্ত্রণা পাচ্ছে। হয়তো কেউ আত্মবিসর্জন দিচ্ছে। তবু বরফ এবং তুষারপাতকে অবজ্ঞা করে তাঁরা আমাদের জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছে।তাঁরা যেভাবে বাস্তবের মুখোমুখি হচ্ছেসে রকম পরিস্থিতিতে আমিও মুখোমুখি হতে চাইআমিও তাদের দুঃখের সমভাগী হতে চাই। আমার এই পূর্ণবয়সেওযন্ত্রণা দেখতে চাইযন্ত্রণা পেতে চাই। কেননা আমি আমার দেশকে অন্তর থেকে ভালোবাসি। দেশের প্রতি প্রেম দেখানোর জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত সময় আর কি হতে পারে?

সেটা ছিল ওলগা বেরগল্টছের কন্ঠ। সেটা ছিল তার রচনা। তার শব্দ গুলিতেছিল নাৎসী অধ্যুষিত লেনিনগ্রাডের মানুষের অন্তরের ভাবনা। সেই বড় পরিচিত হয়ে পড়েছিল। সেই বড় আপন হয়ে উঠেছিল। লেনিনগ্ৰাডের মানুষের কাছে সে বড় স্নেহের পাত্র হয়ে পড়েছিল। প্রায় মানুষই সন্ধ্যাবেলা অন্ধকার ঘরে রেডিয়োর কাছে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকত।ওলগার স্নেহ বাঁকানো কণ্ঠস্বর শুনে শুনে ওদের ক্লান্ত দেহ হালকা হয়ে পড়ত। দুঃখে ভরা মন বলি সতেজ হয়ে উঠত। প্রেরণায় মহানগরবাসী উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েছিল।

যাত্রাপথে ফিয়োডর নাটালিয়াকে এই কথাগুলির আভাস দিল। বলতে বলতে সে অনুভব করলো অধ্যাপিকা পলিনা আন্ড্রেয়েভনা ওদের মহানগর নিয়ে কেন এত গর্বিত। সে যেন লেনিনগ্রাডকে নতুন করে আবিষ্কার করল।

আর এই মহানগরীর নয়জন আবাসীকেনিয়ে ওরা মামলাটা অধ্যয়ন করছে। এই অধ্যায়ন কোনো নতুনত্বের দিক উন্মোচন করবে কি মহানগরীটির?

ফিয়োডর যখন মহানগরের ডিমিট্রি গরিব পরিবারের বাড়িতে এসেছিল মারিয়া এন্টনভনার বয়স তখন ষাঠের উর্ধ্বে। ঘরের মূল মানুষটির অগি মৃত্যু হয়েছিল। তবু যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলটিতে নতুন করে তৈরি অ্যাপার্টমেন্টটি মানুষটির গুণমুগ্ধদের কাছে ডিমিট্রি গরিণের নামেই পরিচিত হয়ে পড়েছিল।

ফিয়োডর যে কয়েক বছর সেখানে ছিল মারিয়া এন্টয়ভনা তাকে মাঝেমধ্যে তার মার্জিত রুচি আর রসবোধেরপরিচয় দিয়েছিল। এরকম একটি মুহূর্তে তিনি তাকে বলেছিলেন কবি ওলগা বেরগলটছের কথানাৎসী আক্রমণের সময় রেডিওতে শোনা তাঁর কবিতার কথা। পরে ফিয়োডর নিজেই লেনিনগ্রাড শহরটিতে মহাসমরে মৃত্যু হওয়া সাড়ে ছয়লাখ মানুষের স্মৃতিতে তৈরি পিসকারেভস্কয়ে সমাধির মার্বেলের দেওয়ালে খোদাই করা ওলগারকবিতার কিছু পঙক্তি পড়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল–

আমরা কাউকে ভুলে যাইনি,

আমরা কিছুই ভুলে যাইনি।–

মেট্রো রেলটা ওদের গন্তব্য স্টেশনে এসে উপস্থিত হল।ফিয়োডররা নামল এবং সুরঙ্গ পথ দিয়ে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এসে একটা ট্রামে উঠে পড়ল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ধ্বংস হওয়া ঘরবাড়ি ছেড়ে মারিয়া এন্টভনা বোনমারিনারদূরের গ্রামে থাকা বাড়িতে গিয়ে এক বছর ছিল। সেই সময়ে পড়াশোনার প্রতি অবহেলা করে মারিয়ার পুত্র গেভরিল মদের প্রতি আসক্ত হয়ে কিছুটা উগ্র স্বভাবের হয়ে পড়েছিল। বোনের বাড়িতে আর বেশি দিন থাকতে ইচ্ছা হল নামারিয়ার। তত দিনে তাদের অতীতের ঠাঁই ভূমিসাৎহওয়ায় ঘর-দুয়ারের আবর্জনা পরিষ্কার করে কয়েকতলা অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করার কাজ আরম্ভ হয়েছিল। তাই কাজের জায়গায় কোনো প্রকারে একটা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে মারিয়া এন্টভনা পুনরায় লেনিনগ্রাড শহরে ফিরে এসেছিল।

সেই সময়েফিয়োডরেরপিতা বারো বছরের ইভান লিঅনিডভিছ এডলারকে মারিয়ার ওখানে রাখতে এল তাঁর বান্ধবী নাদিয়া পপভনা। মারিয়া কেতিনি বললেন– আমাদের লেনা অঞ্চল এখনও পেছনে পড়ে রয়েছে। জানি তোর কষ্ট হবে। যুদ্ধে বিনষ্ট হওয়া এখানকার ঘরবাড়িগুলি এখন ও মেরামত করা হয়নি। তবু ওকে তোর সঙ্গে থেকে পড়াশোনা করানোর জন্য নিয়ে এলাম। আমার আর কে আছে মারিয়া?

মারিয়া এন্টনভনা বান্ধবীর অনুরোধ আগেও উপেক্ষা করে নিএখন ও করতে পারল না। তিনি ইভানকে রাখতে সম্মত হলেন। ইভানকে রাখার জন্য মারিয়া সরকারের কাছ থেকে মাসে পাঁচরুবল করে পেতেলাগল। পিতৃহীন ছেলেমেয়েকে লালন পালন করার জন্য ষোলো বছরবয়স পর্যন্ত মাকে এই ধরনের সাহায্য দেওয়া হত। মারিয়া একজন লোকের সাহায্যে এই অনুদান ইভানের নামে ব্যবস্থা করে নিয়েছিল। ধীরে ধীরে উগ্র হয়ে ওঠা গেভরিল মারিয়ার এই ব্যবস্থা পছন্দ করল না। সে ইভানকে দেখতে পারত না সুবিধা পেলেই গালিগালাজ করত। তবু সখিমারিয়া ইভানকে সামলে সুমলেরাখত এবং স্কুলের শিক্ষার শেষে অন্তত ফিটারের প্রশিক্ষণের জন্য ঔদ্যোগিক প্রশিক্ষণ নেবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।

ইভান যখন কুড়ি বছরের হল তখন ডিমিট্রি গরিন কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে কয়েক মহল অট্টালিকার নতুন অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এল। ডিমিট্রিগরিন এবং তার পরিবার মারিয়ার জন্য ইভান এবং ইভানের মা নাদিয়া পপভনার স্মৃতি ছিল অত্যন্ত মধুর। ইভানের শিশু অবস্থায় তাঁরা তাকে দেখেছিল এবং কোলে নিয়েছিল। তাই ডিমিট্রি শিক্ষিত হয়েওঠা ইভানকে বোঝা বলে না ভেবে আদর করতে লাগল। ততদিনে সুড়ঙ্গের খনন এবং বাধার কাজে যোগ দেওয়াগেভরিলের ইভানের প্রতি অত্যাচার বেশি হয়ে এসেছিল।গেভরিলবিয়ে করল এবং পরিবার বারবারাগ্ৰিগরয়েভনার সামনে মাঝেমধ্যে খারাপ ব্যবহার করতে লাগল। বারবারা এবং সখি মারিয়ার আপত্তি সত্ত্বেও একদিন ইভান ফিটারের চাকরি নিয়ে সুদূর বাল্টিক সাগরের বন্দর কালিনিনগ্রাডে যাত্রা করল।

ফিয়োডরদের ট্রামের রাস্তা শেষ হল। ওরা দুজন নেমে হাঁটতে লাগল।

বুঝেছ নাটালিয়া‘– যেতে যেতে ফিয়োডর বলল–‘ এগারো বছর বয়সে মা যখন আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল মারিয়া ঠাকুরমারবয়সতখন প্রায় ৬৫ বছর। দাদুর কবেই মৃত্যু হয়েছিল। বারবারা বড়মা তখন বিধবা এবং চল্লিশের কোঠা ছুঁই ছুঁই। জ‍্যাঠা গেভরিলের দশ বছর আগে সুড়ঙ্গে চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে। তখন আমার চেয়ে তিন বছরের বড় তানিয়া দিদি ছিল। অর্থাৎ তাঁরা তিনজন– ঠাকুরমাবড়মা এবং তানিয়া দিদি।

সে বলল–‘ আমাকে যখন লেনা অঞ্চলের ঠাকুমার চিঠি নিয়ে মা ওলগা এখানে নিয়ে এসেছিল কোনো পুরুষ না থাকা ঘরটিতে তারা আমাকে পেয়ে থাকতে তো দিলই বেশ আদর টাদর ও করতে লাগল। আমি যেন ঠাকুরমা এবং বড় মার অন্ধের যষ্টি হয়ে পড়লামতানিয়া দিদির খেলা এবং বেড়ানোর সঙ্গী। ঠাকুরমা আমাকে নাদিয়া ঠাকুরমার কথা বলেছিল। বলেছিল যুদ্ধের সময়ের কথা। বলেছিল শহরটির কথা। বড়মা বারবারাও আমাকে বেশ স্নেহকরত। স্কুলে যাওয়া আসাকাজে তানিয়া দিদিকে করার মতোই সাহায্য করত এবং আমাদের দুজনকে তৈরি করে পাঠাত।‘ 


আরো পড়ুন: মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-১০)


দূরে কয়েক মহলের একটি অট্টালিকা দেখা গেল। সেখানে ডিমিট্রিগরিন পরিবারের অ্যাপার্টমেন্টটা। খোলা জায়গার মধ্যে দিয়ে থাকা সারি সারি বার্চ গাছ দু সারির মধ্য দিয়ে সেখানে যেতে পারা পাথরে বাঁধানো পথ।‌ তারা সেই পথ দিয়ে যেতে থাকল। ফিয়োডরের ঠাকুমার কথা মনে পড়ল। এখন তার ঠাকুরমা মারিয়া এন্টনভনা আর বেঁচে নেই। পাঁচ বছর আগেই ৭৭ বছর বয়সে তিনি ইহসংসার থেকে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু তার মন থেকে এখনও মুছে যায়নি ১৪বছরে দিয়ে যাওয়া তাঁরমার্জিত রসবোধ। সেই জন্যই সে ওর ধোন প্রিয় হয়ে পড়েছিল এবং শিক্ষার্থীর সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে পেরেছিল।

অ্যাপার্টমেন্টযাওয়ার আগে ফিয়োডর একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকল এবং প্রত্যেকের জন্য একটি উপহার কিনল। সঙ্গে কিছু ফলমূল কিনল।

ফিয়োডরের কেনার উৎসাহ দেখে নাটালিয়া আশ্চর্যজনকভাবে চেয়ে থাকায় সে বলল– নাটালিয়াআমি আমার বিদ্বৎ জগৎটা এখান থেকেই পেয়েছিলাম। এটাকি ভুলতে পারব না।

ফিয়োডররা যখন নির্দিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টের সামনে উপস্থিত হয়ে কলিংবেল বাজাল গ্রিগরয়েভনানিজেই দরজা খুলে দিল। তিনি ষাঠের কোঠা অতিক্রম করেন নি যদিও ধীরে ধীরে মোটা হতে শুরু করেছিলেন। হাঁটু পর্যন্ত একটা রঙিন স্কার্ট পরে তার উপরে একটা সোয়েটার পরেছিলেন ।ফিয়োডরকে দেখে কয়েক মুহুর্ত অবাক হয়ে রইলেন। তারপরে আবেগ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন –ফিয়োডর।

তিনি তাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর নাটালিয়া কে দেখে দুজনকে ভেতরে ডাকলেন।

ভেতরের একটি সোফায় ছয়বছর বয়সের একটি ছেলে বসে টিভি দেখছিল। তার পরনেস্কুলের ইউনিফর্ম। তার গলায় ঝুলছেএকটি চাবি। তার দিকে তাকিয়ে বারবারা গ্ৰিগরয়েভনা বলল–‘ দেখতো আন্টন ,এ কে এসেছে?তোর মামা।

আন্টন নামের ছেলেটি ফিয়োডরের দিকে এক মুহূর্ত মাথা তুলে তাকিয়ে বলল–‘ কেমন আছ আঙ্কেল?’

সে পুনরায় টিভি দেখতে লাগল।

‘ তুই আন্টিকে ডাকলি না?’

আন্টন নাটালিয়ার দিকেতাকিয়ে হাত তুলল।

তানিয়ার ছেলে।‘– শ্রীমতী গ্ৰিগরয়েভনা বলল– সেই স্কুল থেকে বাইরে বাইরে আমার কাছে এসেছে। ওদের ঘর দুটি দোতলায়। মা এখনও অফিস থেকে ফিরে আসে নি।

তানিয়া দিদিপাবলিক লাইব্রেরিতে কাজ করছে নাকি ?’ফিয়োডর জিজ্ঞেস করল।

হ‍্যাঁকরছে। আমিই গত বছরে ডাইরি ফার্মথেকে অবসর নিয়েছি।

বসে নিয়ে বারবারা গ্ৰিগরয়েভনা নাটালিয়ার পরিচয় নিল এবং একসঙ্গে গবেষণা করছে জেনে সন্তোষ প্রকাশ করল।

জান নাটালিয়া,ও ফিয়োডর আন্টনের মা তানিয়ার সঙ্গে একসঙ্গে বড় হয়েছিল। সে অবশ্য কয়েক বছরের ছোট ছিল। এখন সেই ছেলে গবেষণাও করছে।

ফিয়োডর সমস্ত রাস্তাটিতে নাটালিয়া কিছুটা অধৈর্য হয়ে পড়াযেন অনুভব করছিল। সেই জন্য শ্রীমতিগ্ৰিগরয়েভনা কোনো ভূমিকা না করে জিজ্ঞেস করল–‘ নতুন বউআমি একটু নাদিয়া ঠাকুরমার বিষয়ে জানতে চাই। তিনিতো ঠাকুমা মারিয়ার আদরের বান্ধবী ছিলতাই না?’

বারবারা গ্ৰিগরয়েভনা কিছু সময় ফিয়োডরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর তাকাল নাটালিয়ার মুখের দিকে।

ফিয়োডর বলল–‘ আমরা একটা কেস অধ‍্যয়ন করছি–‘ লেনিনগ্রাডের নয় জন নিবাসীর। প্রথম নামটিইআমার দাদুর নাম–লিঅনিড এডলার। অন্তত আমার দাদু বলেই আমি ভাবছি। আর আমাদের দাদুকে ভালোভাবে ঠাকুরমা নাদিয়া ছাড়া অন্য কেউ জানে না। আমি প্রথমে ঠাকুরমা এবং তারপরে দাদুর বিষয়ে জানতে চাই।

রান্না করে উঠে যাবার আগে বারবারা গ্ৰিগরয়েভনা কিছুসময় চুপ করে রইল। তাঁর মনের ভেতর হয়তো বহু কথা আনাগোনা করছে। তিনি তিন কাপ কফি করে টেবিলে রাখতে আনার সময় পর্যন্ত চুপ করে রইলেন। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন–‘ খেয়ে নাও।

ওরা কফির পেয়ালায় চুমুক দিল।

শোনো ফিয়োডর‘– মহিলাটি বললেন–‘ আমি তোমার দাদুকে তো দেখিইনিঠাকুমাকেও দেখিনি। তিনি নাকি পিতা ইভানকে রাখার জন্য য়াকুরিম গ্রাম থেকে আসার সময় নয় তারপরও দুবারেরমতো এসেছিল। আমি বিয়ে হয়ে আসার সময়ও তোমার পিতা আমাদের সঙ্গে ছিল। এক বছর পরই তিনি বন্দরে চাকরি করার জন্য চলে যান।

তিনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। তারপর বললেন–‘ হ্যাঁআমার শাশুড়ি মারিয়া এন্টনভনা এবং তোমার ঠাকুরমা নাদিয়া পপভনা বড় গলায় গলায় বন্ধু ছিল। সেই বন্ধুত্বের জন্যই নাকি আমার শাশুড়িকে জীবনে কিছু দুর্যোগ মাথা পেতে নিতে হয়েছিল। তবু তার মুখে বান্ধবীর গুণ গান সব সময় শোনা যেত।

মহিলাটি পুনরায় কফির পেয়ালায় চুমুক দিল। তারপর বলল– আমার শাশুড়িকে আমি পাঁচ বছরের মতো পেয়েছিলাম।তাঁর ভাষাজ্ঞান এবং ভাষার স্পৃহা ছিল অতীব। একবার তিনি বলেছিলেন– তিনি তার বান্ধবী নাদিয়া পপভনারসঙ্গে সেই তখনকার দিনে একসঙ্গে ফরাসি ভাষা শিখেছিলেন।

ফিয়োডর এবং নাটালিয়া এবার কিছুটা উৎসুক হয়ে পড়ল।

মহিলাটি বললেন–‘ তাঁরা বই পড়া ছাড়াও কলা সাহিত্যের কথা বলতেন। টলস্টয়ের বইয়ের কথা বলতেন।

ফিয়োডর জিজ্ঞেস করল–‘ তাঁরা টলস্টয়বাদী ছিল কি?’

টনস্টয়বাদীটলস্টয়বাদী কাকে বলে আমি জানিনা।‘– মহিলাটিবললেন–‘ কিন্তু তারা যে টলস্টয় অনুরাগী ছিলেন সে কথা ঠিক।

বারবারা গ্ৰিগরয়েভনা মনে মনে কিছু একটা ভাবতে লাগলেন। তারপর বললেন–‘ মা মারিয়ানেই। কিন্তু গ্রামে মাসি মারিনা এন্টনভনা এখনও বেঁচে আছেন। তিনি হয়ত নাদিয়া পপভনারকথা বলতে পারবেন।

ফিয়োডর নাটালিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল–‘ আমাদের নিশ্চয় মাসি ঠাকুরমা মারিনা এন্টনভনার সঙ্গে দেখা করতে হবে। গ্রামে যেতে হবে ।

‘ হ্যাঁ।‘– নাটালিয়া সায় দিল।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত