| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

গল্প: ওভারব্রিজের ছেলেটি । আতোয়ার রহমান

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

বাসটা ফার্মগেটের সামনে এসে জ্যামে আটকা পড়ল, অধ্যাপক গাড়ি থেকে নেমে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। নগরীর সব পথ এখানে এসে মিশেছে। চারিদিকে ছোটাছুটি, ব্যস্ততা, হুড়াহুড়ি। পথচারী, ছাত্র, বখাটে, গার্মেন্ট কর্মী, প্রতারক, সাধু, পকেটমার, সমাজকর্মী, ছিনতাইকারী, সিনেমা হলের ব্লাকার, পাগল, পতিতা- এরকম নানা কিসিমের মানুষ আর নেড়িকুকুরের ভিড়বহুল কুশ্রী কোলাহলদীর্ণ জায়গাটা। খাবার হোটেল, কলেজ, কোচিং সেন্টার, সিনেমা হল, প্রসাধনী, কাপড়-চোপড়ের দোকান,-সব মিলিয়ে এলাকাটা অনেক রাত পর্যন্ত অনিঃশেষ জীবনচাঞ্চল্যে জমজমাট থাকে। রিকশা-ভ্যান,ট্যাক্সি-ট্রাক-দোতলা-একতলা বাস-এইসব যাবতীয় যানবাহনের উৎকট স্বরে হর্ণ বাজিয়ে নিত্য চলাচল। সব মিলিয়ে এক এলাহী কান্ড। ভিড়ের বাসে গাদাগাদি করে মানুষের ঘামের গন্ধ নিয়ে কুশ্রী আর অনিষ্টের কোলাহল একপাশে রেখে ওভারব্রিজের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে সেটা যেখানে তেজগাঁও কলেজের দিকে গিয়েছে, সেখানে ব্যস্ত রাস্তায় হাতের ডানপাশে প্রতিদিন কলেজে যাওয়া আসার পথে এক কোনায় শিশুটিকে দেখেন অধ্যাপক। ওর নাম মনির। বয়স সাকুল্যে সাড়ে দশ। ব্রিজের মেঝেতে পেতে রাখা এক টুকরো চটের উপর বসে আছে। ময়লায় চুল জট বেঁধে আছে। চোখে পিচুটি। আধ ময়লা গেঞ্জিটা জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। এক পা সরু লাঠির মতো।ডান হাতের দুটো আঙুল কাটা। কপালের দিকে যে জায়গায় দুটো চোখ থাকার কথা, সেখানে দুটি লালচে গর্ত। একটা চোখ দিয়ে শুধু কাছের জিনিস ঝাপসা দেখতে পায়। অন্যরা তা বুঝতে পারেনা, সেও অন্যদের বুঝতে দেয়না। সারা শরীরে ফুসকুড়ি। গা থেকে আসছে দুর্গন্ধও। ডান কাঁধটা একপাশে ঝুলে থাকে। চার পাশে অফুরন্ত ধুলো। ছেলেটি একটি টিনের থালা হাতে ঝাঁকাচ্ছে: ‘সাব, কিছু, কিছু দিয়া যান। সাব, সাব, কিছু  দ্যান…’। 

ভিক্ষাপাত্র প্রায় খালি, শুধু দু-একটা সিকি আধুলির কয়েন। ঝাঁকানোর কারণে পয়সাগুলো ঝনঝন করে। প্রাত্যহিক কাজে যোগ দিতে অনেকেই তাকে পাশ কেটে দ্রুত হেঁটে যায়। পথচারীদের দৃষ্টি কাড়ার জন্য তাদের দিকে তাকিয়ে টিনের থালাটা নাড়িয়ে  ভাঙা কণ্ঠে বলে দু’দিনে কিছু খায়নি। তারা ওর দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকায়, কোনো পেশাদারের মতো চোখের যোগাযোগ এড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়, কারও চোখ ঘেন্নায়  ছোট হয়ে আসে। কেউ দেয়, কেউ দেয় না। ওর থালায় দুটাকা ছুঁড়ে দিলেও আবার এক টাকা চেয়ে নেয়। মনির দাতাকে আশীর্বাদ করেন ও তার জন্য বিড়বিড় করে শুভকামনা করেন।শহরের মানুষগুলো কেমন যেন। আজকাল দান খয়রাত করতে চায়না, খুচরো টাকা পয়সা পকেটে রাখেনা। তাদের চোখে আর দয়া-মায়া, স্নেহ-ভালোবাসার দেখা মেলেনা, দেখা মেলে স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, ঘৃণা…।কেউ কারও দিকে ফিরে তাকায় না। নিজেকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত।অধ্যাপক ওর কষ্ট দেখে কেঁদে ফেলার উপক্রম। সদ্য প্রয়াত তার প্রতিবন্ধী শিশু সিয়ামকে যেন খুঁজে পায় ওর মধ্যে। সিয়ামের সমবয়সী মনির। ওর জন্য কিছু একটা করার জন্য মনটা ছটফট করে। আহা বেচারা! যে বয়সে একটা শিশু মা-বাবার আদর সোহাগে, খোলা মাঠে খেলাধুলা আর খেলার সাথিদের সাথে হাসিঠাট্টায় দিন কাটায়, সে বয়সে শিশুটি দিনের পর দিন কী দুর্বিষহ কষ্টই না করছে, ভাবা যায়! অধ্যাপিকা ছেলেটার ভিক্ষাপাত্রে একটা মুদ্রা ফেলে, ঠং শব্দে ধন্যবাদ জানায় পাত্রটি।

দিন বাড়ে। সূর্য মাথার ওপর উঠতে থাকে। গরমও বাড়তে থাকে। ওর মুখ দেখে বোঝা যায়, সকাল থেকে দানাপানি পেটে পড়েনি। পথচারীরা ওর দিকে চীনা বাদাম, পাউরুটি ছুঁড়ে দেয়। টাকার চেয়ে খাবার পেলে বেশি খুশি হয় মনির। ওর সারাদিনের যা ‘ইনকাম’ তার সবটুকুই চলে যায় সুরুজের পকেটে। ওর পোড়া কপালে জোটে শুধু একবেলার পচা-বাসি খাবার। কালেভদ্রে গরম ঝোলভাত শাকভাত খায়। সারাদিন ওর পেট কাঁপে, খিদা ওর পেটে লবন দেয়া কেঁচোর মতো থপ থপ করে মোচড় দেয়। অনেকে ব্রিজের ওপর দিয়ে ছেলেমেয়েদের স্কুলে নিয়ে যায়।নিরাপদ দুরুত্বে দাঁড়িয়ে মনিরকে দেখিয়ে পাঁচছয় বছরের বাচ্চাদের নীতিকথা শেখায়। বাচ্চাদের বোঝানো হয় ভালোভাবে পড়াশোনা না করলে তাদের দশাও মনিরের মতো হবে। তার বয়সি ছেলেমেয়েরা কত সুন্দর সেজেগুজে স্কুলে যায়। পিঠে ঝুলানো বইভর্তি স্কুল ব্যাগ। যেন আকাশ থেকে নেমে আসা একেকটি পরি। কি সুন্দর তাদের জীবন…মনিরের দৃষ্টি একবার থালার দিকে আর একবার ওদের চোখে-মুখে, রঙ্গিন স্কুল ব্যাগে। মনিরের সাধ জাগে ওদের মতো থরে থরে স্বপ্ন সাজিয়ে ব্যাগে ভরে স্কুলে যাবে। বই পড়ার জন্য মনটা আকুলিবিকুলি করে।     

পাঁচ বছর বয়স থেকে দিনের পর দিন সে এ কাজটাই করছে এখানে বসে। সুরুজের সূত্রে ওভারব্রিজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে। এখন এটা শুধু মনিরের জীবন–জীবিকা নয়, এটা তার নেশা, তার প্রাণ। ব্রিজ থেকে সে নিজেকে আলাদা ভাবতে পারে না একটা মুহূর্তও। তবে কখনও কখনও সে কারওয়ান বাজার পার হয়ে পাশের শাহবাগ ওভারব্রিজেও চলে যায়।  সর্দার যদি কখনও খবর পায় যে কোথাও বড় রকমের দান খয়রাতের ঘটনা আছে, তখন সে মনিরকে নিয়ে অনেক দূরেও চলে যায়।

মা বাবার হদিস মনির জানেনা। জানার কোনো আগ্রহও নেই। তবে ওর  মনিবের মুখে শোনা, একদিন একজন আপাদমস্তক কালো বোরখাপরা মহিলা এগিয়ে যাচ্ছে-কারওয়ান বাজারের কাছে একটা কানাগলির শেষপ্রান্তে, নেড়িকুকুরগুলো অযথাই ঘেউ ঘেউ করছে, ঐ মহিলার কাছ থেকে  সুরুজ তাকে কিনে নিয়েছে দুই হাজার টাকায়, তখন তার বয়স তিন মাস। ওই মহিলা সদ্যজাত মনিরকে হাতিরপুল কাঁচাবাজারের কাছের এক ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পেয়েছিল। যে ভিক্ষুক সর্দার সুরুজ  ওকে প্রতিদিন সকালে তার দামি ধূসর লাল রঙের টয়োটা কারে এখানে এনে স্পটের অদূরে নামিয়ে দিয়ে একটা চাকাওয়ালা কাঠের গাড়িতে করে ব্রিজের উপরে উঠিয়ে এখানে বসিয়ে দিয়ে যায়, আবার সন্ধ্যা হলে তাকে বেগুনবাড়ির পানির পাম্প এলাকায় দুদু মিয়ার বস্তির নিজ আখড়ায় ফিরিয়ে নেয়, সেই তার মনিব। যাওয়া আসার যে সময়টুকু কারে বসে থাকে সেটুকুই ওর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময়, শান্তির সময়। কারের কাঁচ নামানো জানালা দিয়ে তাকিয়ে মনিরের সে কী আনন্দ! সে এক স্বপ্নের সময়।তখন মনে হয়, এ জগতে তার মতো সুখী বুঝি আর কেউ নেই।

ভিক্ষুক সর্দার সুরুজ ভিক্ষুক কিনে নিজের কাছে আটকে রেখে ভিক্ষা করায়।ওই আখড়ায় অনেক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক গাদাগাদি করে থাকে। এটা তার বাপ দাদার পুরনো ব্যবসা। তবে সুরুজের নিজস্ব ধরণের শৈলীতে সেই ব্যবসা শিল্পের স্তরে পৌঁছিয়েছে,  পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। মনিরকে দিয়েও একইভাবে ভিক্ষে করানো হয়। সুস্থ্ থাকলে রুজি রোজগার কম। তাই তাদের সবসময় অসুস্থ্ করে রাখা হয়, পঙ্গু, নুলো করা হয়, হাত পা কাটা হয়। আবার কাউকে কাউকে ঘাড়ে, মাথায় আঘাত করে শরীর অচল বানিয়ে দেয়া হয়, বোবা বানানো হয়। অভিনব কৌশলে কীভাবে হাত পাততে হয়, গান গাইতে হয়, ভিক্ষে করতে হয় তার রীতিমত ট্রেনিং দেয়া হয়। সবাই এটা চট করে আয়ত্ব করতে পারেনা, কিন্তু মনির পেরেছে।

ওভারব্রিজের প্রাণপুরুষ মনির।ওর মতো ‘ইনকাম’ এখানে কেউ করতে পারেনা।ছোট হওয়াতে সকলের মনযোগ কাড়ে। তাছাড়া পথচারীদের আবেগ অনুভূতিকে কাজে লাগাতে অন্যদের চেয়ে সে বেশি পটু। ওর স্পটটাও ভাল, এবং এ নিয়ে এখানে প্রায়ই  মারামারি হয়। এজন্য ওর  ‘ইনকাম’ বেশি। মনিরের পাশেই অল্প দূরে ব্রিজের দেয়ালঘেঁষে বসে আছে গোদরোগের রোগী নরেশ। তার বাঁ পায়ে গোদ, বিশাল হাতির পায়ের মতো পা। পায়ের চামড়া ফেটে ফেটে খোদাই করা। সেই ক্ষত থেকে পুঁজ আর কষ ঝরে পড়ে মাঝেমধ্যে। একটি সিসার বাটী হাতে নিয়ে ঝাঁকাচ্ছে :‘কত টাকা কত পয়সা কত দিকে চলে যায়, আল্লার রাস্তায় দান করিলে আখিরাতে পাওয়া যায়’…। সর্দারের শিখিয়ে দেয়া বুলি একজন নিষ্ঠাবান শিষ্যের মত অনর্গল আওড়িয়ে যায়। মাঝেসাজে মনির গান গায়। নরেশ জুড়ি দিয়ে মানিরের গাওয়া গানের সাথে তাল মিলায়। এভাবে সুরেলা গান গেয়ে একটু বেশি ভিক্ষে জোটে।বারবার শুনতে শুনতে ব্রিজের ওপর দিয়ে নিয়মিত চলাফেরা করা মানুষের কাছে ওদের গান পরিচিত হয়ে গেছে। অনেকেই তাদের গান পছন্দ করে।  

একজন এসে নরেশকে কয়, তুই এখানে কেন? এখানে তো একটা চাচা বসতো।তুই কি তার কোনাটা দখল করেছিস? 

স্যার, আপনি ঠিকই ধরেছেন।আসলে হইছি কি  স্যার, আমি ওনার মাইয়ারে বিয়ে করছি তো। জায়গাটা যৌতুক হিসেবে পাইছি।

ওভারব্রিজের এই কোনায় বসার জন্য প্রতিদিন মনিরকে ‘ট্যাক্স’ গুনতে হয়, চল্লিশ টাকা। করোনাভাইরাস যেমন আমাদের জীবনে ওঁত পেতে থাকে জীবন উপড়ে নেবার জন্য, তেমনি ওর টাকা খাওয়ার জন্য পুলিশ থেকে ওয়ার্ড কমিশনারের লোক ওঁত পেতে  থাকে। কিশোর প্রেমিক তার প্রথম প্রেমের ঘোর আমেজে যেমন তার প্রেমিকার পেছনে ঘুরঘুর করে, চাঁদাবাজরাও তেমনি টাকার জন্য মনিরের পিছনে সবসময় ঘুরঘুর করে। ওয়ার্ড কমিশনারের ক্যাশিয়ার স্বপন নির্দিষ্ট সময়ে এসে কুড়ি টাকা নিয়ে তা গুনতে গুনতে সিগারেটে টান দেয়। সিগারেটের ধোঁয়া মশা মারা কয়েল থেকে ওঠা ধোঁয়ার মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে একসময় মিলিয়ে যায় পলায়নপর সাপের সরু ও কুচকুচে কালো লেজের মতো। একটু পরেই নীল জামার পুলিশটি মনিরের কাছে এসে দাঁড়ায়, শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে ওর টিনের থালায় তাকায়, বলে কুড়ি টাকা ফেল। ছেলেটার মুখ শুকিয়ে যায়। সকাল থেকে বৃষ্টির কারণে আজ কামাই নাই। সে টাকা দিতে ইতস্তত করে, পুলিশটি চিৎকার দিয়ে অশ্রাব্য কুৎসিত গালিগালাজ করে, খিদে পাওয়া বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, বন্দুকের নল দিয়ে মনিরের ঘাড়ে, পাছায় বাড়ি দেয়, কপাল ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্তের চিকন ধারা বেরিয়ে আসে। মেঝেতে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। আশে পাশের লোকজন তাকে দ্রুত চ্যাংদোলা করে কাছেই ‘আল রাজি’ হাসপাতালে নিয়ে যায়। দুটো সেলাই দেয়ায় সে যাত্রায় বেঁচে যায় মনির। ওর ছেঁড়া গেঞ্জি ভেদ করে বুকের পাজরগুলি কাঁটার মতো যেন ফুটে বের হয়।

একটু ধাতস্ত হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি করে চেঁচাতে থাকে, আমার ভিক্ষার পয়সা কেড়ে নেয় কেন ওরা? ওদের বাপের পয়সা? তার চোখের গর্ত দু’টো পাকা মরিচের মতো লাল হয়ে যায়। 

ওর চিৎকারে স্তব্দ হয়ে যায় চারপাশ। ব্রিজের রেলিং এর উপর দিয়ে উড়ে যায় ওর কন্ঠস্বর, বিশাল হয়ে তা আকাশে ছড়ায়। ধুলোবালিতে ওর পুরো শরীর মাখামাখি।একজন হাঁটু গেড়ে বসে মনিরকে টেনে জোর করে বসায়। মনিরের প্রশ্নে উপস্থিত লোকজন বিমূঢ় হয়ে যায়। বোকার মতো এদিকওদিক তাকাতে থাকে। ওর জন্য সকলের কেমন যেন মায়া হচ্ছিল।   

সকলে দেখল সেপাইটি টাকা পয়সা গুনে নিয়ে পরিতৃপ্তির সাথে পশ্চিম দিকের সিঁড়ি বেঁয়ে একটি ছায়া মূর্তির মতো নিচে নেমে ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। একবার পেছন ফিরে তাকায়, ভাবখানা যেন তার নিজের পাওনা টাকা আদায় করে নিয়ে গেল। কনস্টেবলের অপসৃয়মাণ মূর্তির দিকে চেয়ে মনিরের কপালের ব্যথা তীব্র হয়ে সমস্ত শরীরকে আছন্ন করে। পুলিশটি বন্দুক নিয়ে কোথায় কী যুদ্ধ করেছে কেউ জানেনা। কিন্তু সে প্রতিদিন নিয়ম করে একই সময়ে এসে তার কাছ থেকে কুড়ি টাকা নিয়ে যায়, এর কোন ব্যত্যয় নেই। জিজ্ঞেস করলে মনিরকে একদিন বলেছিল এ টাকার ভাগ ওপর মহল পর্যন্ত যায়।শুনে এক ধরণের আড়ষ্ঠতা তার শরীর মনকে নিস্তেজ করে দেয়,বুক কুঁকড়ে যায়, অন্ধ চোখগুলো আরও গাঢ় অন্ধকার দেখে। আস্তে আস্তে একটু উঠে শরীরটা টান করে আর হাই তুলে মনির।    

রাজাবাজারের ছোট সরু গলিটি তেজগাঁ কলেজের পাশ ঘেঁষে ইন্দিরা রোডের যে জায়গায় এসে মিশেছে সেখানে একটা বিতিকিচ্ছিরি পাকিয়ে তোলা রিকশার জট।রাস্তা থেকে কাছের ওভারব্রিজটায় যেতে হলে ফুটপাথ দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু রাস্তার পাশ বরাবর পুরো ফুটপাথটাতেই হকারদের রাজত্ব। পায়ে চলার রাস্তাটা দখল হতে হতে ক্রমশ চাষের জমির আলপথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার উপর কর্পোরেশনের দয়ালু হাতে বসানো ফুটপাথের টালিগুলো  আলগা হয়ে এখন হোঁচট খাওয়ার ফাঁদ। রাস্তায় নেমে যে  লোকজন হেঁটে যাবে, সেখানে আবার বাস আর ট্রাকের সুপারসনিক গতি, কখন যে কাগজ হয়ে রাস্তার বুকে সেঁটে যাবে তার ঠিক নেই।

জট কেটে সামনে এগোতেই ফুটপাতে হকারের চিৎকার- ‘যেটা খুশি কুড়ি টাকা, নিয়ে জান কুড়ি টাকা, সার্ট প্যান্ট কুড়ি টাকা, সালোয়ার কামিজ কুড়ি টাকা’।

সামনে এগিয়ে ওভারব্রিজে উঠল অধ্যাপক। রাস্তার ওপাশে দূরে দেখা যায় কারওয়ান বাজার জামে মসজিদের সবুজ গম্বুজ। সিনেমা হলের কোনায় একজন ম্যাজিক দেখায়, লোকজন গোল হয়ে তা দেখে। কতগুলো কুকুর রাস্তার ডাস্টবিনের ময়লা থেকে খাবার খুঁজে খাচ্ছে আর ঘেউ ঘেউ করছে। পাশেই গায়ে কাঁদা মেখে নাচছে একটা পাগল গোছের লোক। ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক, হাড়-পাঁজর বেরনো ক্ষয়াটে চেহারা, মুখেচোখে তবু উথলে পড়ছে সুখ।

উদগ্র কোলাহলের মধ্যে অদূরে খামার বাড়ির পার্কের এক পাশে মেরুদন্ড ভেঙে যাওয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারু গাছের ছায়ায় অল্পবয়সি ভবঘুরে ছেলেরা শর্ট হ্যান্ড ক্রিকেট খেলছে। পার্কের ওপারে কুড়িতলা কন্ডোমনিয়াম। আনন্দে উদ্বেলিত পথশিশুদের উড়ানো ঘুড়ির চেয়ে উঁচু এ ভবন।  

অধ্যাপক আস্তে আস্তে আবর্জনার মতো গুটিসুটি বসে থাকা মনিরের কাছে যায়, হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে,এই বাবু বলতো আমি কে? তোর নাম কী? চোখে না দেখলেও অধ্যাপকের  উপস্থিতি সে দ্রুত টের পেয়ে যায়। মাথা ঘুরিয়ে বলে, কেডা?  কলেজের ভালো ম্যাডাম না?

হ্যা, আমি। তুই জানলি কেমনে?

তা আমি বুঝতে পারি।

অন্ধ মানুষরা খুব স্পর্শকাতর হয়। তাদের শ্রবণশক্তি ও স্মরণশক্তি খুব প্রখর। কোন শব্দ হলেই  টের পেয়ে যায়। মনিরেরও শ্রবনশক্তি বেশ প্রখর।

আমি  তোকে হাসপাতালে নিয়ে তোর চিকিৎসা করাতে চাই। তুই কী বলিস? তোকে আমি এই ভিক্ষার-টিক্ষার কাজ করতে দিতে চাইনা, আমার কাছে রাখতে চাই। তোকে লেখাপড়া শেখাতে চাই।

খুশিতে ঝলমল করে হেসে ওঠে মনির। অনেকদিন পর ওর চোখে মুখে একটুখানি হাসি ঝিলিক দিয়ে যায়। কতো অসহায় অথচ ওর মুখের হাসি কতো অমলিন, উচ্ছল। দুঃখকষ্ট যন্ত্রণা যে মানুষের মন থেকে খুশির আমেজ কেড়ে নিতে পারে না মনিরের মুখে তাকালেই তা বুঝা যায়।

অধ্যাপকের দিকে মাথাটা একটু এগিয়ে নিয়ে বলে- কবে হাসপাতালে নিবেন, কন। আমারও বড় পড়বার শখ। চোখটা ভালো হলে লেখাপড়া করতাম।

অধ্যাপক  বলে—তুই চাইলে আগামীকালই হতে পারে।

মনির কোন কথা বলে না। অধ্যাপক  জিজ্ঞেস করে-তোর বিশ্বাস হচ্ছেনা?

হইতাছে। কিন্তু আপনার তো অনেক টাকা ক্ষতি হইবার পারে!

অধ্যাপক মিষ্টি করে হাসে-বলে তাতে কোন সমস্যা নাই।তার মনের ভেতরের মাতৃস্নেহ যেন ফল্গুধারার মতো একটা পথ খুঁজে পেল।  

নিজের কানকে বিশ্বাস হয়না মনিরের। এ দুনিয়াতে এত ভালো মানুষও আছে, এটা ওর মাথায় আসেনা। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি, যেন সহসা আসা এক পশলা দুর্বার দখিন হাওয়া।এর অজানা মধুর আনন্দে মনিরের বুকের মধ্যে এক মৃদু শিহরন বয়ে গেল। অজানা কী একটা উত্তেজনায় যেন হাঁপাতে থাকে।   

মায়ের মত স্নেহভরা চোখে মনিরের দিকে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ, তারপর বল লেন, মনির আগামীকাল আমি তোকে এখান থেকে নিয়ে যাব, হাসপাতালে ভর্তি করাবো। খবরদার তোর সর্দারকে একথা একদম বলবিনা। তাহলে তোকে যেতে দেবেনা।

হ্যাঁ, সর্দার জানলে আমাকে মেরে ফেলবে। ঠিক আছে ম্যাম, আমি বলবো না।

কথা শেষ করে অধ্যাপক পূর্বদিকের সিঁড়িতে যায়। গেট বন্ধ। রাইফেল আর রবারের লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে নীলজামার পুলিশ।

প্রধানমন্ত্রী যাবেন।

কড়া শব্দের বাঁশী বাজিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে ছুটে যায় সুদৃশ্য হেলমেটধারী রাজকীয় মোটরবাইক। কিছুক্ষণ পরপর পুলিশের গাড়ি ছুটে যায় সাঁইসাঁই সিগন্যাল বাজিয়ে। একটা পুলিশের গাড়ির সাইরেন বাজিয়ে ছুটে যাওয়ার শব্দ মিলিয়ে গেল।

তার পর শুন্য রাজপথ শুনসান। মিহি শিশি শব্দ তুলে ব্রিজের নিচ দিয়ে ছুটে যায় প্রধানমন্ত্রীর গাড়ির বহর। হুইসেলে স্তদ্ধ চারিপাশ নিরবতা। সতর্ক চাহনি। ব্রিজের গেট খুলে যায়।

সোমবার বিকেল; দোকানপাট ও অদূরে সুদৃশ্য এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের কাঁচে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া আগুন রঙ সূর্যের আলো ঠিকরে উঠছে, পার্কের সুউচ্চ গাছের ডালপালা আর পাতার ফাঁকফোকর গলিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে হলুদ আভার আলো ওভারব্রিজের খসখসে পাটাতনের উপর, মনিরের চোখে মুখে। আকাশে এক ফোঁটা মেঘ নেই। মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে দক্ষিণ থেকে।

মিষ্টি হেসে অধ্যাপক  বলেন, মনির কেমন আছ? চলছে তো সব ঠিকঠাক? 

উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই ওকে একটি অটোরিক্সায় করে চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে ওয়ার্ডে ভর্তি করালেন অধ্যাপক। সকলে কানাঘুষা করতে লাগল অপারেশনের খরচ কে দিবে। অধ্যাপকের টাকা দেয়ার কথা শুনে আশ্বস্থ হলো। এক্স-রে করা হলো,  অন্যান্য আনুষঙ্গিক পরীক্ষা করা হলো।

 

অবশেষে মনিরকে অপারেশন রুমে নেয়া হলো। ওয়েটিং রুমের পেছনের দিকে একটি চেয়ারে বসলেন অধ্যাপক। দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলেন।ঘড়ির কাঁটা একটু একটু করে এগিয়ে চলছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার এসে বললেন, ‘এখনও ভাল করে জ্ঞান আসেনি।’ শুনে অধ্যাপকের শরীরটা কেঁপে ওঠে। আরও কিছুক্ষণ পরে হাসিমুখে নার্স এসে বলল, জ্ঞান ফিরেছে আপনার রোগীর। অপারেশন সাকসেসফুল।        

অধ্যাপক মনিরকে দেখে অবাক হন। ও ঠোঁট চাটলো এবং ওর ভিক্ষা করার প্লেটটি হাতের মৃদু ছোঁয়ায় পরখ করল আবার। ডান হাতটি কাঁপছিল তাই সে এটি পিঠের পেছনে বাম দিকে চাপিয়েছিল। সে নিঃশ্বাস ফেলল এবং একটা দমকা শ্বাস ছেড়ে দিল।

সুস্থ্ হলো মনির, এখন এক চোখ দিয়ে সব দেখতে পারে, অন্য চোখটা দিয়েও একটু  ঝাপসা দেখতে পায়। মনির বিস্ময় ভরে চারদিক দেখে ভাবছিল একি! খুশিতে কেঁদে ফেলল। হাসপাতালের লোকজন জড়ো হয়ে গেল। সবাই এটাকে অলৌকিক ঘটনা বলে মনে করল। সকলে মিলে মনিরকে হাসপাতালের এক কোণায় নিয়ে গেল। পানি দিয়ে ধুয়ে দিল তার শরীর। নতুন কাপড় দিল পরার জন্য। অধ্যাপক আঁচল দিয়ে হাত বুলিয়ে ওর গাটা মুছিয়ে দিতে থাকে পরম স্নেহে, যেন কোন মা গাভি তার সদ্য জন্ম নেওয়া বাছুরকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। নতুন সাজে সজ্জিত করা হলো তাকে, গায়ে সুগন্ধি দেয়া হলো। অধ্যাপক অবাক হয়ে মনিরের সাজগোজ দেখে। মনির অপার বিস্ময়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখছে আর আনন্দে বিহ্বল হয়ে বসে আছে। ওকে এভাবে দেখতে পেয়ে আনন্দে খুশিতে চোখ ছলছল করে উঠল অধ্যাপকের। চশমা খুলে চোখ মুছে ফের কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পরে হাসিমাখা মুখে অধ্যাপক  মনিরকে বলেন,

তুই আমাকে দেখতে পাচ্ছিস?

হ্যাঁ, ম্যাম। একটা চোখ দিয়ে আমি সব পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি, আপনাকেও দেখতে পাচ্ছি।

স্নেহময়ী জননীর মতো মনিরের দিকে তাকিয়ে এক পশলা হাসলেন অধ্যাপক। ভেতর থেকে একটা আনন্দ উপচে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। মনিরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, ও বিস্ময়ে বিমোহিত হয়ে পড়ে।

ডাক্তার মনিরের পোষ্ট অপারেটিভ চেক আপ করেছেন। সব কিছু ঠিক আছে। রোগিকে রিলিজ করে দিয়েছেন। আপনি রিসিপশনের ক্লিয়ারেন্স নিয়ে রোগীকে আজকেই নিয়ে যেতে পারেন।

নার্সের কথা শুনে অধ্যাপিকা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রিসেপশনিস্টের কাঁচ ঘেরা রুমের জানালার কাছে গেলেন। বিলের পরিমান জানতে চাইলে তরুনী রিসেপশনিস্ট বলল, সার্জন স্যার নিজেই বিলের সব টাকা দিয়েছেন। আপনি রোগী নিয়ে যেতে পারেন। কোন সমস্যা নেই।

অধ্যাপক কথাগুলো শুনেই চমকে ওঠে। না না। এ অসম্ভব।

নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, উনি কেন টাকা দিলেন! ওনাকে বলেন নি আমি ওকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। ওর অপারেশনের টাকা আমি দিব।

বলেছি। কিন্তু স্যার শুনলেন না।  তিনি নিজের যমজ পুত্র সন্তানের জন্মদিন পালন করবেন বলে  রেখেছিলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়েই বড় অনুষ্ঠান করার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু সে অনুষ্ঠান পালন না করে মনিরের চিকিৎসায় পুরো টাকাটা দান করেছেন!

আমিও তো অনেকদিন ধরে ওর চিকিৎসার জন্য টাকা জমা করেছি, ধার কর্জ করে টাকার ব্যবস্থা করেছি।

হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর স্যার রোগী দেখতে ওর কাছে এসে কথা বলেছিলেন। তখন তিনি ঠিক করে ফেলেন ছেলেদের জন্মদিনের অনুষ্ঠান বাতিল করে দিয়ে টাকাটা অসহায় কিশোর মনিরের চিকিৎসা ও পড়াশোনার কাজে দিয়ে দেবেন। তিনি তাই করলেন, নার্সের মন্দ্রমধুর কন্ঠস্বরে সরস হাসির প্রলেপ পড়ে।

কাচের জানালা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল, এবং অধ্যাপক সার্জনের মহানুভবতায় বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে গেলেন।

এমন মানুষ আজও আছেন সমাজের বুকে…? ওঁরা আছেন বলেই সমাজের বুকে কিছু কল্যাণকর কাজ ঘটে চলেছে।

বলতে বলতে চোখ থেকে জল গড়িয়ে আসে অধ্যাপকের।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত