অভিসারিকা

Reading Time: 3 minutes

 

 

ঝনঝনে ভোঁতা আওয়াজ তুলে বাসনগুলো ছড়িয়ে পড়ছে মাটির উঠোনে। ছবি হাউমাউ করে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে ছুড়ে ফেলছে বাসনগুলো। যেন ভিতরে চেপে রাখা দীর্ঘ দিনের একটা দুঃখ রাগ হয়ে আছড়ে পড়ছে মাটিতে। মাঝে মাঝে রাগ হয় ঐ পোড়ারমুখি মেয়েটার উপর, নিজের ভাগ্যের উপর। ভীষণ রাগ হয়, কিন্তু অসহায়ের মতো ঘরে বসে আস্ফালন করা ছাড়া আর তো কোনো উপায় নেই ওঁর! রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, পাথরেরও ক্ষয় হয়, সেখানে ছবি তো আস্ত একটা রক্ত মাংসের মানুষ। তবু ওর ব্যক্তি সত্তা কোনো লড়াইয়ে হার মানে না, কিন্তু মাতৃসত্তা যেন নিয়তির কাছে শেষ পর্যন্ত হার মেনেছে। এ যেন সেই অসহায় আস্ফালনেরই বহিঃপ্রকাশ।

বাসন গুলো ছুড়ে ফেলেই উঠোনের উপর উবু হয়ে বসে ছবি। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। কতদিনই বা এভাবে প্রান্তজনের মতো সকলকে এড়িয়ে চলবে?কেনই বা চলবে? ওর সোনার প্রতিমার মতো মেয়ে কাজলি। আর কেউ না জানুক,ঈশ্বর তো জানে সব! তাই আজ অনেক সাহস সঞ্চয় করে পুকুরঘাটে সবার সঙ্গে বাসন মাজতে গিয়েছিল। ভেবেছিল পাঁচবছর পরে নিশ্চয় সকলে অন্য আলোচনার বিষয় পেয়ে গিয়েছে। বুঝতে পারেনি ওকে দেখে আবার সবার মনে সহানুভূতির ছলে খোঁচা মারার ইচ্ছাটা ফিরে আসবে।

মাটির দাওয়ার কাছে বাঁশের খুঁটি ধরে বসে আছে মেয়েটা। দু’চোখ ভরা জল আর অনন্ত প্রতীক্ষা! মায়ের এই অবস্থা দেখে কাছে আসার জন্য ছটফট করছে,কিন্তু পারছে না! মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট আওয়াজ করছে, আর দু’হাতে প্রাণপণে পায়ের বাঁধনটা খোলার চেষ্টা করছে। না পেরে আরও যেন অধৈর্য হয়ে উঠছে।

এতদিন তবু সামলানো যেত,কিন্তু দিনে দিনে যেন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে ওর আচরণ। আর আয়ত্তে রাখা যাচ্ছে না। ‘মা হওয়া যে কত জ্বালা!’ মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে উঠে দাঁড়ায় ছবি। ছড়িয়ে পড়ে থাকা বাসনগুলো একে একে জড়ো করে তুলে রাখে মাটির রোয়াকে। মেয়েটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই কাজলি বাঁধন খোলার চেষ্টা ছেঁড়ে মুখ তুলে করুণ চোখে তাকায় ছবির দিকে। হাতের ইশারায় খুলে দিতে বলে পায়ের বাঁধন। ছবি মাথায় হাত বুলিয়ে বলে—
–দেব তো। এত অধৈর্য হলে হবে?
–কাজলি মাথা নিচু করে নখের সাথে নখ ঘষতে থাকে। কবজির দিকে ইশারা করে সময়ের কথা বলতে চায়।
–ছবি মাথা নেড়ে আশ্বস্ত করে বলে, ‘ মনে আছে আমার। রোজই তো মনে থাকে পাগলি’।
–কাজলি আবার মাথা নিচু করে নখে নখ ঘষতে থাকে।
কাজলির পায়ের কাছে বসে পড়ে ছবি, খুলে দেয় পায়ের বাঁধন। কাজলি খিলখিল করে হেসে ওঠে। জড়িয়ে ধরে ছবিকে।মুখ দিয়ে একটা শব্দ করতে থাকে। এ শব্দ মা’কে আদরের। সেই জন্ম থেকে আজ পঁচিশ বছর ধরে মেয়ের মুখের শব্দ শুনে শুনেই ছবি জেনে গিয়েছে কাজলির সবরকম আবেগের প্রকাশ ভঙ্গি। জন্ম থেকেই মেয়েটা শুনতে ও বলতে পারে না। প্রথম প্রথম ছবির খুব মনখারাপ হত। কে না চায়; নিজের সন্তানের মুখ থেকে মা ডাক শুনতে! ছবির তো এই একটি মাত্র সন্তান। কিন্তু একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে কাজলির বুদ্ধির প্রকাশদেখে, সব মনখারাপ যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল ছবির।
মেয়ের কপালে চুমু খায় ছবি, ঠিক সিঁথির কাছে।পাঁচ বছর আগে যে সিঁথিটা রাঙা হয়েছিল একদিনের জন্য। সব ভুল ছিল, সব ভুল! পুরোনো সেইসব অপ্রিয় ছবিগুলো ঝলকে ঝলকে ফিরে আসে যেন! ডুকরে ওঠে ছবির বুকের ভিতরে। নিজের হাতে মুছে দিয়েছে সিঁথির রং। একটুও হাত কাঁপেনি, যেমন হাত কাঁপেনি নিজের সিঁথির রং মুছে ফেলতে গিয়ে। এই রং কেড়ে নিয়েছে কাজলির বেঁচে থাকা।

পায়ের বাঁধন খুলে দিতেই উঠে দাঁড়ায় কাজলি। সন্ধের ঠিক আগের মুহূর্ত। আকাশটা প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। ছবি একটা সুন্দর শাড়ি পরিয়ে দেয় কাজলিকে। একটা পোঁটলা ভর্তি সাজের জিনিস নিয়ে ধীরে ধীরে রেললাইন পেরিয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ায় কাজলি। একটা প্রত্যন্ত গ্রামের নির্জন স্টেশনের কাছেই ওদের বাড়ি। এই স্টেশনে সন্ধে ছটাতেই শেষ ট্রেন আসে। বিগত পাঁচ বছর ধরে কাজলির জীবনে এই একটি ছবিই স্থির হয়ে আছে। স্টেশনের হলুদ আলোটার নিচে বসে কাজলি সাজছে। কাজল, লিপস্টিক। কপালের মাঝখানে একটা গোল লাল টিপ। দূর থেকে দেখছে ছবি।কাজলিকে ঠিক বিরহিনী রাধার মতো সুন্দর লাগছে। অভিসারে এসেছে কাজলি। শেষ ট্রেনটা ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। কাজলির কাজলপড়া টানা টানা চোখ দুটোতে টলটলে জল আর এক অনন্ত প্রতীক্ষা।

 

 

 

 

 

[গল্পটি পূর্বে সংক্ষিপ্ত আকারে “অবকাশ” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশের পর গল্পটিকে আরও বর্ধিত করেন লেখক। এখানে সেই বর্ধিত গল্পটিই প্রকাশ করা হলো।]

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

One thought on “অভিসারিকা

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>