| 26 এপ্রিল 2024
Categories
কবিতা সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

আজীজুল হকের কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

পঞ্চাশের দশকের অন্যতম কবি আজীজুল হক। দুই বাংলায় আজো সেভাবে পাঠ করা হয়নি তাঁর কবিতা। মফস্বলে কাটিয়ে দেয়া এই কবির কবিতা বাংলা কবিতার অমূল্য সম্পদ,খুব কম সংখ্যক কবিই এসেছেন যাদের লেখায় শব্দের অপচয় নেই, কবি আজীজুল হক সেই ধারার কবি। তাঁর জন্ম ২ মার্চ ১৯৩০ সালে মাগুরা জেলায়। সুবক্তা ও সংগঠক এই শিক্ষক-কবি জনকোলাহল থেকে দূরে নিজস্ব সৃষ্টিশীলতার জগতে জীবনযাপন করতে পছন্দ করতেন। তার বাবা মুনশি মোহাম্মদ জবেদ আলী ও মা রহিমা খাতুন। ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে সাতক্ষীরা ডিগ্রি কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৫৮ সালে তিনি মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন এবং দীর্ঘদিন শিক্ষকতার পর ১৯৮৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তার কবিতার উপজীব্য বিষয় মানুষ, সমাজ, সময়, দেশ, প্রকৃতিপ্রেম, নদ ও নারী। শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অসাধারণ নিপুণ শিল্পী। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝিনুক মুহূর্তে সূর্যকে’। ১৯৭৬ সালে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বিনষ্টের চিৎকার’, ১৯৮৯ সালে তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ঘুম ও সোনালী ঈগল’ এবং ১৯৯৪ সালে ‘আজীজুল হকের কবিতা’ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে তার নিরীক্ষাধর্মী চিন্তা-চেতনা পাঠকসমাজকে করেছে বিমুগ্ধ। তার কবিতায় একদিকে যেমন ইতিহাস ও ঐতিহ্যসচেতন শিল্পদৃষ্টি প্রতিভাত, অন্যদিকে অস্তিত্ববোধ ও ভাবনাপ্রসূত অনুষঙ্গ অভিনব মর্যাদায় সমৃদ্ধ হয়েছে। সাহিত্যক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৮৬ সালে যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও মধুসূদন অ্যাকাডেমি পুরস্কার, ১৯৯৪ সালে যশোর শিল্পীগোষ্ঠী পদক এবং ১৯৯৬ সালে চাঁদের হাট পদক অন্যতম।


ঝিনুক মুহূর্তে সূর্যকে

আজন্ম দুহাতে এক অদৃশ্য প্রেতের সাথে যুদ্ধ করে করে
আমিও অদৃশ্য। এই লোকালয় থেকে
কিছুদূরে গেলে এক ধূসর প্রান্তরে
পিছু-পিছু হাঁটি, অন্ধকারে তাকে তাড়া করি,
যদিও নিশ্চিত জানি সে
আয়ুর নিষিদ্ধ রেখা অতিক্রম করে না কখনো।

বন্ধুর শীতল হাতে হাত রেখে বন্ধুরা যখন
হলুদ বাতির নিচে কথা বলে, ‘ফের দেখা হবে
আসি তবে’ এবং বিশ্লিষ্ট হয় জুতোয় মাড়িয়ে
চিনেবাদামের খোসা,
বরফকুচির ধুলো ওড়ে ছায়াপথে,
নির্বিকার নক্ষত্র সমাজ,
প্রত্যেকে প্রত্যক্ষ করি কোনো এক দুর্ঘটনাকে,
প্রত্যেক নক্ষত্র এক দূরত্বের নিঃসঙ্গ শিকার।
ভূমিতে প্রোথিত দেখি অর্ধাঙ্গ আমার,
নদীর নিকটে
সুতীক্ষ্ণ শব্দের স্রোত, কঠিন রুপালি ঢেউ, ইস্পাত মসৃণ
চাকা দ্রুত ফেলে গেছে,
দ্রুত, আরও দ্রুত
সোনালি কাঁকড়া দাঁতে, হলুদ পতঙ্গে খাবে
ছিঁড়ে ছিঁড়ে উদ্বৃত্ত আমাকে।

আমি তবে প্রেতটাকে কী করে ফেরাবো? তার প্রেম
অনিবার্য, অদৃশ্য শীতল,
সমাধি স্তম্ভের ছায়া
আত্মার শিয়রে,
সময়ের যক্ষ দেয় অনন্ত আয়ুকে পাহারা,
কী করে ফেরাবো।

ঘৃণার বুদ্বুদ আর ক্ষোভের তরঙ্গ আর স্রোতের আবর্ত দিয়ে যাকে
সমুদ্র লুকিয়ে রাখে অতল গভীরে
তাকে প্রেম দেবে বলে ঝিনুকের ঠোঁটে
ঠোঁট রাখে সূর্যের হৃদয়,
আযুর সীমান্তে এলে পর
তুষার তাড়িত ফল বীজের ভিতরে আনে
কী গাঢ় ইচ্ছাকে, কিছুক্ষণ রঙ মাখে
কী বিষণ্ন সবুজ শরীরে।

 

 

রক্তমুখী নীলা

নীলাভ কাচের প্লেটে হৃৎপিণ্ড রক্তাক্ত উজ্জ্বল
ছিঁড়ে এনে রাখলে টেবিলে
সূর্যোদয় হলো
সমুদ্রের জলে।
আজকের প্রগাঢ় সকালে
কী দেবো তোমাকে? কী দেবো, কী দেবো!
রক্তমুখী নীলা।
এর চেয়ে অন্যতর কী বা দিতে পারি।

উত্তোলিত প্রাসাদের নিচে
অবধ্বস্ত সে নগরী একদিন আবিষ্কৃত হবে।
রমণীর ধবল করোটি, ডানচক্ষু দৃষ্টির কবর,
অন্যতর চোখের কোটরে সুদুর্লভ মণি
রক্তমুখী নীলা,
যেন তার তীরবিদ্ধ গাঢ় নীল চোখ
এক ফোটা রক্ত জ্বেলে অন্ধকারে চেয়ে থাকে
কারো দিকে।

কার দিকে হে বিশ শতক?

 

 

সূর্য শিকার

আমি কথা বলতে বলতে হঠাৎ চিৎকার করে উঠি
এবং চিৎকার করতে গিয়ে হঠাৎ কথা বলে ফেলি।
আমার ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডটা কী বিশ্বাসঘাতক!
আহা, আমি যদি আমার মাথাটার প্রভু হতে পারতাম।

আমার পিতা-পিতামহরাও প্রভু ছিলেন না।
তাদের গাদা বন্দুকটা একটা বংশানুক্রম মাত্র,
ওটা দিয়ে আমি মশা তাড়াই
এবং বইখাতা কলমকে তাক করি।

ওরা জানালা দিয়ে লুকিয়ে তাকিয়ে দেখে
দেখে আর হাসে
হাসে আর দেখে
যেন দেখছেও না হাসছেও না।
আহা, হাত দুটি যদি আমার বন্ধু হতো
সূর্যকে একটা থাপ্পড় মেরে আসতাম।

 

 

মেঘমুখী সূর্যমুখী

আমারো প্রার্থনা ছিলো উচ্চারিত হৃদয়ের কাছে,
মেঘমুখী ফুল তুমি সূর্যমুখী হও,
সূর্যই আমাদের প্রথম নায়ক
চিরকাল আমাদের নায়কই সে আছে।
প্রেম থেকে শানি- আর ক্রোধ থেকে প্রদাহ অবধি
স্পর্শ তার। ইতিহাস সময় আকাশ
করতলে রাখে ফুল স্মৃতি স্বপ্ন জ্বালা,
আর নীল অন্ধকার আমাদের আকাশের তলে
পৃথিবীর সব কটি মানুষের মুখ
সূর্য হয়ে জ্বলে।

আমাদের মতো সব অবিকল মানুষেরা
কতবার দেখেছে এখানে
ফসলের ফুলঝুরি মাঠ,
আম জাম আমলকি গাছের পাতায়
গাঢ় নীল সবুজ আগুন
ঝিল বিল নদীর ভিতর
আলোর কুচির মতো ঝিকিমিকি মাছ আর
রুপালি ঝিনুক,
অবিকল মানুষেরা সব
সকলেই দেখেছে এখানে
মানুষের প্রেমে আর জ্ঞানে আর ক্রোধে এক
আলোর বিভব।

আমিও তো কতবার হৃদয়কে দিয়েছি প্রবোধ,
যে-সব নগর গ্রাম বন্দর স্বদেশ
অরণ্য কি ফসলের মাঠ
দাও-দাও পুড়েছে একদা
তারা সব হয়েছে নিঃশেষ?
তাদেরি শিখায় দেখ কেমন জ্বলছে রোজ ভোরের ললাট।
যে-সব নগর গ্রাম বন্দর স্বদেশ বন
আর এই ফসলের ক্ষেত
দাউ-দাউ পুড়ছে এখন
সূর্যেরই আরো কাছে সুনিশ্চিত গেছে তারা সব
প্রেম রক্ত যন্ত্রণা সমেত।
অবিকল মানুষেরা চিরকাল আসেনি কি দেখে
যন্ত্রণার অর্থ নেই জীবনের সত্য আর
স্বপ্ন ব্যতিরেকে?

মেঘমুখী ফুল তবে সূর্যমুখী হও,
সূর্যই আমাদের প্রথম নায়ক
চিরকাল আমাদের নায়কই সে আছে
প্রেম শান্তি জ্ঞান ক্রোধ প্রদাহ প্রবাহ
লোকালয়
অরণ্য নগর পথ জনতা ও নদী
চিন্তা ও সংশয়
জন্মান্ধ চিৎকার আর চিতাদীপ্ত চেতনা অবধি
স্পর্শ তার।
আর দেখ অন্ধকার আমাদের আকাশের তলে
পৃথিবীর সব কটি মানুষের মুখ
সূর্য হয়ে জ্বলে।

 

 

বিনষ্টের চিৎকার

অবশ্যই আমি সেই ব্যবহৃতা রমণীর সজ্ঞান প্রেমিক।
জীবনকে সুনিপুণ আলিঙ্গনে বেঁধে
চিরকাল বেঁচে থাকে নির্বিঘ্নে যেমন
মৃত্যুটা, তারো চেয়ে অধিক নিকটে
আমি তার। নিমজ্জিত আমি তার সকল বিষয়ে।
সে আমার স্নায়ুর ভিতরে
সমস্ত নর্তকীদীপ জ্বেলে রেখে প্রায়ান্ধ কুটিরে
কম্প্রচিত্ত ডেকে নিয়ে যায়। এবং যখন
রক্তের ধ্রুপদী কান্না উচ্চকিত
অন্ধকারে,
আরও অন্ধকারে
আরণ্য ব্যাধের মত অতিদ্রুত সেইসব প্রিয়দৃশ্য খুঁজি,
হরিণ চিতার দেহ, কামাতুর বাঘিনীর মুখ,
মাংসল পাখির ডানা, স্বজাতির হাড়,
পিচ্ছিল প্রাণীর ত্বক, নখ,
সোনালি পালক।
এবং তখন
একটি অনার্য ক্ষুধা, স্বভাবের প্রমত্ত চিৎকার
আমাকে বিশুদ্ধ করে তোলে,
আমি নামি যত
অন্ধকার নিষিদ্ধ পাতালে,
রক্তের জোনাকিবিন্দু জ্বলে ক্রমাগত।

খুলে ফেলি সন্তর্পণে আমি তার সমস্ত পোষাক,
শতাব্দীর ক্রমান্বিত ভাঁজে
বণিক বিলাসী গন্ধ, দাগ,
বর্ণবিত্ত নৃপতির দস্যুদের কামার্দ্র সোহাগ
মুছে ফেলি। ঢেউ কেবলি উত্তাল হয় মধুমতি মেঘনার
প্রশাখা শাখায়,
মাছের কাজল চোখ, সুনীল ময়ূরী গ্রীবা, মুখ,
কুমারী ঝিনুক ঠোঁট, সব-সব দ্রুত করাঙ্গুলে
স্পর্শ করি আমি এক স্মৃতিবিদ্ধ বিনষ্ট যুবক,
ধূসর শঙ্খের মত স্তনে
ধানের দুধের গন্ধ আর
শ্যামল সুঘ্রাণ ওঠে শরীরের পলল মন্থনে।

অতঃপর আমি সেই স্মৃতিগন্ধা রমণীর বিকলাঙ্গ গ্রীবা
সুদীর্ঘ চিন্তার মত দু-হাতে জড়িয়ে ধরে হাঁটি,
আমার পশ্চাতে হাঁটে ছায়া-ছায়া মুহূর্ত সকল
শতাব্দীর লাশের বাহক,
প্রেম এক মৃত্যু ছাড়া দিতে পারে কী বা।
আমি তাকে নিয়ে যাই বন্দরের বেসাতি গুঞ্জন
এবং নগর থেকে সন্ধ্যারেখা নদীর নিকটে,
সেখানে চিৎকার করি, নদী,
তুমি কি সময়ভ্রষ্ট, তবে
ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন তীক্ষ্ণ কেন প্রান্তর অবধি?

 

 

ঠিক এই মুহূর্তে

ঠিক এই মুহূর্তে আমি ভাবছি না আমার শত্রুকে
বরং জন্মাবধি সেই ভাইকে
সূর্যের দিকে তাকাতে গিয়ে যার চোখ ঝলসে গেল,
বরং বন্ধুকে
যার আলিঙ্গন দুটি গুলিবিদ্ধ বাহুর মত কবোষ্ণ
ও সুদীর্ঘ,
এবং মাকে
যিনি ঘাসের সবুজে মিশে নিজেই বাংলাদেশ হয়ে গেলেন।

ঠিক এই মুহূর্তে আমি অসতর্ক। বরং নির্ভয়
আগের চেয়ে। যেন
পদ্মা ও মেঘনার জলে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে আমার
সীসা বারুদের মন্ত্রকবচ।
এখন আর ভালোবাসার জন্যে আমি কাঁদছি না,
এবং এই মুহূর্তে আমার আশ্রয় এমনই দুর্গম যে
বাংলাদেশের হৃৎপিণ্ডকে ছিঁড়ে তবে আমাকে
স্পর্শ করতে হয়।

 

 

চিৎকার প্রতিধ্বনিহীন

তুমি তো সুকণ্ঠ ছিলে, তবে কোন মতিভ্রমে শুধু
গলায় চিৎকার তোলো, ঢালো সুজন সভায়
অশোভন রুক্ষস্বর। কর্কশ চিৎকারে
কণ্ঠের ভিতরে ক্ষত প্রদাহ বাড়াও। প্রচুর ফাটল
ধরে শব্দে ও ধ্বনিতে, ফাটলের ফাঁকে ফাঁকে
রক্তের আভাস। তুমি
যৌবনের ঘনিষ্ঠ আলাপে
প্রণয়ের শিল্পিত কথায়
প্রবীণের ধ্রুপদী আড্ডায়
কখনো বসো না। বরং তোমার
জন্মের মুহূর্তে শেখা চিকন চিৎকার
একমাত্র পুঁজি। তবে কি তুমিও এই
বিশ শতকের
প্রতিরোধহীন কোন ব্যাধির শিকার?

কৈশোরে স্বেচ্ছায়
তুমিই তো কণ্ঠে নিতে চেয়েছিলে গূঢ়
সঙ্গীতের দায়। কলকণ্ঠ পাখির স্বভাব
ছিল তোমার সন্ধানে। সমুদ্র-শঙ্খের মুখে
কান পেতে রাখা, রোজ
নদীর নিকটে গিয়ে জলের কল্লোলে গলা সাধা
তোমারি অভ্যাসে ছিলো। কথা ছিল
পাহাড়ে যাবার। সেখানে ধ্বনিরা নাকি ঘুরে ঘুরে অলৌকিক
প্রতিধ্বনি হয়। এ-রকম প্রতিশ্রুত তুমি
কোন অপজ্ঞানে তবে হাতে তুলে নিলে এই
শব্দের কঙ্কাল? অলৌকিক প্রতিধ্বনি
ফেরে না চিৎকারে, হা-হা করে ওঠে শুধু
স্বজন বান্ধব,
ঠাস ঠাস বন্ধ হয় সকল দরজা।

 

 

মঞ্চ রহস্য

স্টেজ থেকে ফিরে এসো সিরাজউদ্দৌলা
মঞ্চ বিভুল ঘূর্ণিত হয়েছে।
ক্লাইভ নতুন মেক-আপ নিচ্ছে
মীরজাফরের দাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না
মীর মদন মদে চূর।
লুৎফা! লুৎফা!
মানে, ডিরেক্টর সাহেব কোথায় গেলেন!

দর্শকেরা রুদ্ধ দরজায় সারিবদ্ধ,
প্রম্পটারের হাতের বইখানা কে নিয়ে গেল?

আজ তবে পলাশীর যুদ্ধ হবে না?
তা’লে বাংলার ইতিহাসের কী হবে?
বাংলা, হায় অভিশপ্ত বাংলা!
সিরাজউদ্দৌলা,
দ্রুত সাজঘরে ফিরে এসো,
এখানে সকলেই আছে-
মীরজাফর লর্ড ক্লাইভ জগৎশেঠ।
দর্শকেরা রুদ্ধ দরজায় সারিবদ্ধ,
শেষ দৃশ্য এখান থেকেই,
এখান থেকেই সিরাজউদ্দৌলা।

 

 

আত্মবিনাশের আগে

যৌবনকে প্রায়শই কাছে ডেকে বলি ফিসফাস,
কেন যে জ্বালাস তুই এইভাবে চিরকাল,
কেবলি দেখাস ভয়
থমথম মুখে ছেড়ে চলে যাবি।
বলেছি তো, কতোবার বলিনি কি, যা-,
দু’চোখ যেদিকে চায়, দুই পা যেদিকে হাঁটে, যা।
পারিস তো আকাশে ওঠ, উঠে
মুঠো ভরে আন নক্ষত্রের বীজ, এনে
বুনে দে মাটিতে।
সমুদ্রে পাতালে গিয়ে ছিঁড়ে নিয়ে আয়
জলজ উদ্ভিদ থেকে রহস্য কুসুম।
নিষিদ্ধ পশ্চিম দ্বার খুলে যা বাগানে,
কুটজ বৃক্ষের পাশে
সর্পগন্ধা গুল্মের ভিতর
দুইটি সুড়ঙ্গমুখ ডানে বায়ে, মুখে
লাল নীল যুগল পাথর,
একপথে মণিকুম্ভ, বিপথে কঙ্কাল।
স্খলিত স্বভাব তুই
কোনোদিন কোনোদিকে কোথাও গেলি না।

বলেছি তো, কতোবার বলিনি কি তোকে
প্রেম থাকে বুকের ভিতর,
সেই বুক চাপড়ানো পাপ?
শান্তি থাকে প্রাণের ভিতর
সেই প্রাণে কষ্ট দেওয়া পাপ?
স্বপ্ন থাকে চোখের ভিতর
সেই চোখ ঢেকে রাখা পাপ?

এতো পাপ নিয়ে তোর কিসের যৌবন?

সালেহার মুখ থেকে গাঢ় নীল অন্ধকারটুকু
মুছে নে দু’হাতে,
নদীর ভিতর-স্রোতে মিশিয়ে দে সেই অন্ধকার,
নদী আরো নীলবর্ণ হবে,
সেই জলে সিক্ত কর গোলাপের তৃষিত শিকড়,
ফুল আরো রত্তবর্ণ হবে।
ভুলে যা কৈশোর তুই। কিশোরী হেনাকে
লেবু আর জামরুল পাতার আঘ্রাণে
কেন যে খুঁজিস,
হারালে নদীর চরে, বনের ভিতর,
হেনারা আসে না আর জনপদে ফিরে,
বুঝাবে কে, আত্মনাশী তুই।

শতাব্দীর জ্ঞানের ফসল
বৃক্ষশাখে কিছু ফল আছে।
বললাম, আদি পাপ নে,
মাটিকে বিদীর্ণ কর, রক্ত আর ঘাম
সেইখানে ঢাল, ঢেলে
সুনীল প্রবাহ আন, সবুজ প্লাবন।
চারদিকে এত যুদ্ধ
যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা
কোনো এক যুদ্ধ চিনে নে,
চারদিকে টগবগ এত যে মিছিল
কোনো এক সঙ্গ বেছে নে।
স্খলিত স্বভাব তুই
কোনোদিন কোনোদিকে কোথাও গেলি না।

কখনো বলিনি তোকে তুই ক্রীতদাস
আমি তোর আয়ুর মনিব।
সহস্র বর্ষের আয়ু করতলে ছিল,
উপরে আকাশ ছিল নক্ষত্র এবং
চন্দ্র-সুর্য-গ্রহ প্রজ্জ্বলিত,
নিচেয় সমুদ্র নদী অরণ্য পাহাড়
উর্বর মৃত্তিকা আর প্রগাঢ় মানুষ,
মাঝখানে ছিল
মানুষের তৃষ্ণা আর গ্রন্থের আদেশ
সম্রাটের আজ্ঞা আর
জনতার ক্রোধ আর
মৃত্যু ও জীবন।
যদি সেই জীবনের স্বপ্ন দেখে থাকি
যন্ত্রণায় কোনোদিন নীল হয়ে থাকি
ঘৃণা-ক্ষোভে ক্রুদ্ধ হয়ে থাকি
সেই ক্রোধ ক্ষোভ আর যন্ত্রণার জ্বালা
পিতা-মাতামহদের পাপ-তাপ-ঋণ
বহনের ভার
দিই নি তো তোকে,
তবু তুই এ-মুক্তির সপক্ষ নিলি না,
অসহ্য এ অভিমান নিষ্ফল করুণ।

সর্বনাশা অভিমানে তিল তিল বিনাশের আগে
তোর উদ্ধার এখন,…
অন্তিমে অকালে তুই আমারি দাসত্ব মেনে নে।

 

 

ঘুম ও সোনালি ঈগল

ঘুমুতে গেলেই দেখি স্বপ্নেরা তেড়ে আসে চতুর্দিক থেকে। ঘুম
তাদের প্রধান খাদ্য, যে-কোনো প্রকার ঘুম। এমন কি
যে-সব নিশ্চিন্ত ঘুম ক্যাপসুলে সুরক্ষিত থাকে, ছড়ায় সময়ে
সমুদ্রের শাদা নীল সোনালি গোলাপি ফেনা, পাতালে পতন-দৃশ্য
আঁকে অন্তহীন, মগজের কোষে-কোষে নীল-নীল ঝাঁঝালো শূন্যতা
ভরে দেয়, শঙ্খচূড় সর্পিণীর ডিমের কুসুম ক্রমে রক্তের ভিতরে
মিশে গিয়ে
গড়ে তোলে হলুদ চেতনা।

তারা খায় বিনিদ্র মায়ের
চোখের তারার থেকে শিশুর চোখের পরে নেমে আসা
রূপকথা-ঘুম, পড়ার টেবিলে রাখা কোঁকড়ানো কালোচুল মাথা
বালকের নিদ্রার ভিতরে ঢুকে পড়ে, অবলীলাক্রমে
খেয়ে ফেলে গণিতের সংখ্যারাশি স্থলভাগ জলভাগ দ্বীপ
কবিতা ছড়ার মিল ইতিহাস ও সন্ধি সমাস।
পিকনিক ফুটবল টুর্নামেন্ট থেকে
অথবা শিকার থেকে দল বেঁধে ফিরে এলে উত্তপ্ত যুবারা
সন্ধ্যায়, প্রেমিকেরা সঙ্গোপনে সঙ্গ দিলে পর
যখন ঘুমায় তারা মধ্যরাতে সঙ্গীহীন, স্বপ্নেরা তখন
পেটিকোট খুলে ফেলে প্রচুর বিবস্ত্র নাচে, আর রুপালি ক্যাসেটে
অদম্য শীৎকার গান বাজাতে বাজাতে
সঙ্গম শিল্পতা আর সংগ্রাম শেখাতে শেখাতে
নিদ্রা খেয়ে ফেলে। এইভাবে নীল রাতে নিদ্রা খেতে খেতে
লাল ঠোঁটে স্পর্শ করে ধূসর মগজ।

কিছু-কিছু লোক যারা
বিশেষ প্রক্রিয়াযোগে ঘুমকে আনেন ডেকে চোখের কোটরে
স্বপ্নের ভিতরে তারা কেবলি দেখেন এক দেবদূত সোনালি তাবিজ
দিচ্ছেন বাহুতে বেঁধে, বলছেন কী-ভাবে বৈদূর্যমণি মহার্ঘ পাথর
সতর্ক পাহারা দেবে আমৃত্যু ভাগ্যকে, কী-ভাবে তাড়াবে
দিনরাত ঘুমকে স্বপ্নেরা। কিছু-কিছু লোক যারা অতি নিমজ্জিত
এইসব অতীন্দ্রিয় রহস্য বিষয়ে, বিশেষত ব্যক্তিগত শোকার্ত সময়ে,
কণ্ঠস্বরে তুলছেন অলৌকিক আর্দ্র রাগ বিমূর্ত সঙ্গীত, তারা
হাতে তুলে নিচ্ছেন চিত্রময় গ্রন্থরাজি সোনালি প্যাকেট,
অতঃপর সন্তর্পণে নিদ্রাকে ডিঙ্গিয়ে
সরাসরি যাচ্ছেন স্বপ্নের সাক্ষাতে।

এইভাবে কিছু-কিছু লোক
আগ্রাসী স্বপ্নের কাছে কৈশোর ও যৌবনকে সঁপে দিয়ে যারা
হেঁটে এসেছেন বার্ধক্য অবধি, মধ্যরাতে নিদ্রাহীন শয্যার ওপর
স্পষ্টত দেখেন তারা শুয়ে আছে অবিকল নিজেরি কঙ্কাল,
করোটির খোল থেকে বেরিয়ে আসছে কোটি জ্বলন্ত জোনাকি,
পুনরায় ঢুকে যাচ্ছে খুলিরই ভিতর। তারা দেখেন তখন
কী-ভাবে স্বপ্নেরা ক্রমে নিদ্রাকে নিঃশেষ করে অতি সন্তর্পণে
জাগরণ খেতে শুরু করে, জাগরণ খেতে খেতে প্রকাশ্যে কী-ভাবে
সোনালি ঈগল সব উজ্জ্বল রুপালি ঠোঁটে দ্রুত বিদ্ধ করে
হৃদপিণ্ড, মস্তিষ্কের গ্রন্থিকোষ, চোখ, গ্রীবায় নিপুণ মুদ্রা তুলে
ছিঁড়ে আনে অস্তিত্বের মূল। তারা দেখেন শয্যায়
শুয়ে আছে প্রতিচ্ছায়া কৈশোরের যৌবনের বার্ধক্যের, চারপাশে
ঈগলের সোনারঙ পালকের প্রচুর স্খলন, দেয়ালে দেয়ালে
নৃত্যরত ডানর প্রচ্ছায়া, যেন
দারুণ দুঃস্বপ্ন ছাড়া গাঢ় কোনো মধ্যরাত নেই
নীল-নীল মৃত্যু ছাড়া স্বপ্নহীন দীর্ঘ ঘুম নেই
অনিদ্রার জ্বালা ছাড়া নিদ্রাস্নাত জাগরণ নেই।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত