badhu-panchali-tuhu mamo-sakuntala chowdhury

ধারাবাহিক বধূ পাঁচালি: তুঁহু মম । শকুন্তলা চৌধুরী

Reading Time: 7 minutes

                                                         

“পাগলা মনটারে তুই বাঁধ…..” গানটা তিনি খুব ভালো গাইতেন—তিনি মানে গৌরী বসু, প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ বসুর স্ত্রী। নৈহাটির যোগেন্দ্রনাথ মুখার্জি এবং ক্ষেমঙ্করী মুখার্জির প্রথমা কন্যা।

দশ ভাইবোনের বৃহৎ সংসারে বৈভব না থাক, মা সরস্বতীর পদচারণা শোনা যেতো। পিতা যোগেন্দ্রনাথের  প্রভাবে, জ্ঞানচর্চার আবহাওয়া ছিলো বাড়ীতে। অন্য ভাইবোনেরা তেমনভাবে সেই পরিবেশের সুযোগ গ্রহণ না করলেও, গৌরী দু’হাতের অঞ্জলিতে তুলে নিয়েছিলেন পিতার সুরের ধারা এবং জ্ঞানের ধারা। তারপর নিজের নিষ্ঠায় সেই ধারাকে করে তুলেছিলেন আরও পরিশীলিত। কিন্তু ক’দিনই বা?

১৯৪২ সালে, নিজের পছন্দ করা, ভাই দেবশঙ্করের বন্ধু, সুরথনাথ বসুকে ভালোবেসে গৌরী পিতৃগৃহ ছাড়লেন। বিয়ের পর দু’জনে উঠলেন গিয়ে আতপুরের এক ঘরের ক্ষুদ্র আস্তানায়। সুরথ তখন পড়াশোনা বাদ দিয়ে আর সবই করছেন—পার্টি পলিটিক্স, অভিনয়, লেখালিখি, ছোটখাটো কাজ। একে কায়স্থ, তায় বাঙাল, তদুপরি চালচুলোহীন প্রায় বেকার—এই বিয়েতে যে কেউই মত দেবেন না সেটা গৌরী ভালোই জানতেন। তাই তিনি মতের অপেক্ষাই করেননি, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছিলেন এবং নিয়েছিলেন খুবই অল্প বয়সে। সুরথও তখন নিতান্তই ছেলেমানুষ—কুড়ির ঘরেও পৌঁছননি। বাড়ীর লোক তাঁকে (বাঙাল ভাষায়) ডাকেন ‘তরবইরা’ অর্থাৎ ‘তড়বড়ে’। সদাই উত্তেজনায় টগবগ করছেন তিনি—কম্যুনিস্ট পার্টি, লেখা অনেক কিছু করতে চান জীবনে। কিন্তু জীবনসমুদ্রের প্রবল ঢেউয়ে নৌকাখানি টলোমলো—দিক্ নির্ণয় করবে কে? বাবা-দাদারা যাঁর সম্বন্ধে প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, অবশেষে তাঁর জীবনের হাল ধরলেন এসে গৌরী। এবং ধরলেন দৃঢ়হাতেই। বোহেমিয়ান সুরথকে করলেন ঘরমুখো। গৌরী তখনও জানতেন না যে সেই দৃঢ় হাতের মুঠির ফাঁক দিয়েও একদিন গলে যাবে তাঁর যথাসর্বস্ব।


অল্পবয়সে গৌরী বসু

দুর্গাপুজার ষষ্ঠীর দিনে জন্ম গৌরীর। দীর্ঘাঙ্গী গৌরীর মুখের গঠনে এবং শারীরিক অবয়বেই ছিলো দৃঢ়তার প্রকাশ—শুধু দৈহিক নয়, মানসিক শক্তিরও। চোখদুটি ছিল বাঙ্ময়, গভীর, চপলতাবিহীন। গলায় ছিলো সুরের জলতরঙ্গ, যা শুনে একসময় মুগ্ধ হয়েছিলেন সুরসম্রাজ্ঞী স্বয়ং ইন্দুবালা দেবী—গৌরীর ‘ইন্দু মা’।

অসীম দৃঢ়তায় এবং গানের সুরে গৌরী বেঁধে তুললেন দিকশূণ্যপুরের ছোট্ট ঘরখানা—যেখানে অর্থের অভাব ছিলো কিন্তু ভালোবাসার অভাব ছিলো না। একটি একটি করে সন্তান আসছে তখন — বুলবুল, দেবকুমার। কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই। একজনের গানের গলা, আরেকজনের কলম—দু’টোই আদরণীয় পার্টির বন্ধুদের কাছে।

বিয়ের কিছুদিন পরে সুরথ ইছাপুরের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে একটি কাজ পান এবং সেখানকার ট্রেড ইউনিয়নে যোগ দ্যান। সেই সামান্য রোজগারেই গৌরী ক্রমবর্ধমান সংসারের যাবতীয় প্রয়োজন মেটাচ্ছেন এবং ফুটিফাটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মোটামুটি সামলে নিচ্ছিলেনও গৌরী, ইতিমধ্যে কম্যুনিস্ট পার্টি বেআইনী ঘোষিত হলো—সুরথ গেলেন জেলে। মাইনে বন্ধ—সংসার চলবে কি করে? চোখে অন্ধকার দেখলেন গৌরী। কিছু কিছু আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ততদিনে যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু তাঁদের কারোরই এমন সঙ্গতি নয় যে তাঁরা নিয়মিত আর্থিক সাহায্য দিতে পারেন। অথচ ঘরে রয়েছে ক্ষুধার্ত ক’টি শিশুমুখ—কি করবেন তিনি?

কিন্তু সহজে ভেঙে পড়ার মানুষ নন গৌরী। কোথাও থেকে তিনি শুনেছিলেন যে রাজনৈতিক বন্দীদের নানারকম সুযোগ সুবিধা প্রাপ্য। দেশ তখন স্বাধীন হয়েছে, নিজের দেশের শাসকদল তাঁর স্বামীকে এই অধিকারটুকু দেবে না? যেমন ভাবা তেমন কাজ। আবেদন করলেন গৌরী। তারপর শহরতলী থেকে ট্রেন ধরে তিনি এলেন কলকাতায়, রাইটার্স বিল্ডিং-এ গিয়ে দেখা করলেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান রায়ের সঙ্গে।

বুঝিয়ে বললেন তাঁর সংসারের অবস্থা।….কাজও হলো। মাসিক ভাতা বরাদ্দ হলো রাজবন্দী বসুর পরিবারের জন্য। প্রথম মাসের টাকাটা হাতে নিয়ে, হাসিমুখে বাড়ী ফিরলেন গৌরী। আপাতত কিছুদিন নিশ্চিন্ত! শিশুসন্তানদের অন্তত অনাহারে থাকতে হবে না!

কেটে গেলো দিন। সুরথ ফিরলেন জেল থেকে, কিন্তু ফ্যাক্টরির কাজে আর যোগ দিলেন না।

ততদিনে কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হতে শুরু করেছে তাঁর। সুরথনাথ বসু হয়েছেন সমরেশ বসু। পাঠকেরা মুগ্ধ। জ্ঞানীজনেরাও মানতে বাধ্য হয়েছেন যে তাঁর কলম অত্যন্ত শক্তিশালী। কাজ শুরু করলে লেখায় পড়বে বাধা, অথচ সংসারের চাহিদাকেও উপেক্ষা করা যায় না……কি করবেন সমরেশ?

এই দ্বন্দ্ব থেকে তাঁকে বাঁচালেন গৌরী। বলে দিলেন যে তাঁকে কাজ করতে হবে না, তিনি যেন শুধু লেখাতেই মন দেন। কোথা থেকে এই সাহস এসেছিলো গৌরীর মনে জানা নেই, কিন্তু তাই হলো। সমরেশ ডুবে গেলেন লেখায়, সংসারের হাল ধরে রইলেন গৌরী। বুলবুল এবং দেবকুমার ছাড়াও, সংসারে ততদিনে এসেছে তৃতীয় সন্তান নবকুমার এবং কনিষ্ঠা কন্যা মৌসুমী।…..

কোনো সুনির্দ্দিষ্ট রোজগার ছাড়া, চারটি সন্তান নিয়ে সবকিছু সামাল দেওয়া সহজ নয়। বন্ধুরা সাহায্য করেন, গৌরীও টুকটাক রোজগারের চেষ্টায় থাকেন। তবুও লাগাতার অর্থনৈতিক চাপ লেগেই থাকে। মতের অমিল হওয়ায় কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে একসময় বেরিয়ে এলেন সমরেশ—সেখানেও তৈরী হলো কিছু চাপ। গৌরী যদিও সমরেশকে আড়াল করে রাখতে চান সংসারের সব যুদ্ধ থেকে — ঘরের দরজা বন্ধ করে মাটিতে বসে লেখেন সমরেশ, বারান্দায় রান্না করেন গৌরী। কখনো বা সমরেশ বারান্দায় এসে বসেন, লেখা পড়ে শোনান—গৌরী সুচিন্তিত মতামত দ্যান।

প্রকাশিত হলো ‘উত্তরঙ্গ’, ‘নয়নপুরের মাটি’, ‘জগদ্দল’, ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’—অপূর্ব সব জীবনধর্মী, কালজয়ী লেখা।

সাফল্য এলো, কিন্তু একদিনে নয়। তিলে তিলে, যুদ্ধ করতে করতে।

সমরেশ যুদ্ধ করেন বাইরে—পায়ের জুতো ছিঁড়ে ফেলেন প্রকাশকদের থেকে টাকা আদায় করতে।

গৌরী যুদ্ধ করেন ঘরে—বাড়ন্ত চারটি সন্তানকে কখনো আধপেটা কখনো ভরপেটা খাবার দেন, নিজের চোখের জল আর ক্ষিদে লুকিয়ে। কোন যুদ্ধটা যে বেশী কঠিন ছিলো সেটা বলা মুস্কিল। একজন গড়ে তুলছেন তাঁর স্বপ্নের মঞ্জিল—আরেকজন সেই স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য বিকিয়ে দিচ্ছেন নিজের জীবনের চাহিদাগুলোকে, ভুলে যাচ্ছেন নিজের স্বপ্নগুলোকে।

যাঁর গান শুনে একদিন মুগ্ধ হয়েছিলেন ইন্দুবালা দেবী, পাহাড়ী সান্যালের মতো মানুষেরা—তিনি নিজেও হয়তো গানের জগতে একজন নামজাদা পেশাদার শিল্পী হতে পারতেন, যদি তিনিও ছুটতেন নিজের স্বপ্নের পেছনে। সমরেশ তাঁকে উৎসাহ দিতেন, কিন্তু তবুও হলো না।

তাহলে সংসার সামলাবে কে? চারটি সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে বড়ো করে তুলবে কে? শহরতলী থেকে কলকাতায় দৈনন্দিন যাতায়াত করা সমরেশের জন্য সম্ভব হলেও, গৌরী কিভাবে সেটা করবেন?

আর পেশাগত উন্নতির জন্য কলকাতায় বা কোনো বড়ো শহরে যাওয়াটা প্রায় বাধ্যতামূলক।

অতএব স্বপ্ন দেখা আর হলো না, গৌরীর গান সীমাবদ্ধ রইলো শুধু গানের শিক্ষকতায়—যা তাঁকে জীবনের বিভিন্ন সময়ে অর্থনৈতিক দিক দিয়েও কিছুটা সাহায্য করেছিলো।

সমরেশের লেখার চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু যে সংসারে টাকার স্বাচ্ছল্য এলো তাই নয়, সমরেশের ব্যস্ততাও বেড়ে গেলো বহুগুণ। প্রকাশকরা ছাড়া, চলচ্চিত্র পরিচালকরাও ঔৎসুক্য দেখাচ্ছেন তাঁর লেখা নিয়ে। সেই নিয়ে দৌড়াদৌড়ি লেগে থাকে—নৈহাটি থেকে কলকাতা প্রতিদিন যাতায়াত করে সব সামাল দেওয়া সহজ কথা নয়। এদিকে হাতে আসা টাকাকে সঠিকভাবে আটকে ফেলার জন্য, নৈহাটিতে জমি কিনেছেন গৌরী—মাথা গোঁজার আস্তানাকে বাড়িয়ে একটি বড়োসড়ো খোলামেলা বাড়ী বানানোর ইচ্ছে। সমরেশ এবং গৌরী, দু’জনেরই বন্ধুবান্ধব সব নৈহাটিতে। তাছাড়া নৈহাটিতে গৌরীর বাপের বাড়ী—পিতা যোগেন্দ্রনাথের জ্ঞানভাণ্ডারে শুধু নাতি-নাতনিরা নয়, সমরেশকেও উঁকি দিতে হয় প্রায়শই…সুতরাং নৈহাটিই ভালো। দৃঢ় বিশ্বাস আর প্রবল ইচ্ছাশক্তি নিয়ে চিরদিন প্রায় একাই সব কাজ করে এসেছেন গৌরী। নৈহাটির বাড়ী তৈরীর কাজও তিনি একাই করছেন।

জীবনকে শৃঙ্খলায় বাঁধতে চাইতেন গৌরী—ভুলটা কি সেখানেই হয়েছিলো?

শৃঙ্খলার মধ্যে যে শৃঙ্খলটুকু আছে, সেটা সবাই মানতে পারেন না। হাল-ধরা নৌকায় কিছুদূর যাওয়ার পর আসে ক্লান্তি। ‘টুকরো করে কাছি আমি ডুবতে রাজী আছি…’ বলে জোয়ারের ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে দেওয়াতেই তখন মেলে পরম আনন্দ। সুপুরুষ, প্রথিতযশা সাহিত্যিক সমরেশকে টেনে নিয়ে সেই জোয়ারের জলে ভেসে পড়ার লোকেরও তখন অভাব ছিলো না আশেপাশে। মনের দিক থেকে তিনি নিজে ছিলেন ভবঘুরে। কখনো বিবরে ঢুকে, কখনো অমৃতকুম্ভের খোঁজে, চলে তাঁর জীবনের সন্ধান। নিজের ভেতরে আগুন নিয়ে আকাশগামী একক রকেটের মতো ছুটে চলাতেই তাঁর আনন্দ।


সুরসম্রাজ্ঞী ইন্দুবালা দেবীর সঙ্গে গৌরী বসু

নৈহাটির বাড়ী তাঁকে আটকে রাখতে পারলো না। বাস্তব প্রয়োজনের তাগিদে তাঁর কলকাতায় থাকার মেয়াদ বাড়তে লাগলো, নৈহাটি থেকে দৈনন্দিন যাতায়াত করা আর হয়ে ওঠে না। পার্টি এবং হুল্লোড় লেগে থাকে—কিছুটা বা পেশার প্রয়োজনে, কিছুটা বা স্বভাবের তাগিদে, গা ভাসিয়ে দ্যান তাতে সমরেশ। গৌরীর কানে আসে নানা কথা। প্রথমে ভাবেন উড়িয়ে দেবেন—লেখকরা তো আর সাধারণ মানুষ নন, ভেতরের আলো জ্বালাতে তাঁদের অনেক জ্বালানির প্রয়োজন হয়। নারী-পরিবৃত সমরেশকে তো তিনি আজ নতুন দেখছেন না! আবার কখনো সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেলে হয়তো বা কিছু প্রশ্ন করে বসেন। জ্বলে ওঠে আগুন আর সেই আগুনে ঝলসে পুড়ে যেতে থাকে গৌরীর সব স্বপ্ন, সাধ, সংসার। তার সঙ্গে ভেঙে পড়তে থাকে শরীর —বংশ-ছাড়া রোগে ধরে, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবিটিস্।

ইতিমধ্যে কলকাতার বালিগঞ্জের স্টেশন রোডে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেন সমরেশ। ১৯৬৩-৬৪ থেকেই ঘটনাটা একটু একটু করে রটনা থেকে বাস্তবের রূপ নিচ্ছিলো, কিন্তু এতোবড়ো একটা আঘাত যে সত্যিই আসবে জীবনে, সেটা বোধহয় গৌরী ভাবতে পারেননি। ১৯৬৬ সালে, গৌরী-সমরেশের প্রথমা কন্যা বুলবুলের প্রায় সমবয়সী, গৌরীর সহোদরা ছোট বোনকে নিয়ে কলকাতায় সংসার পাতলেন সমরেশ। পিতা যোগেন্দ্রনাথ এবং মাতা ক্ষেমঙ্করী ছাড়াও, গৌরীর বাপের বাড়ীতে তখন উপস্থিত গৌরীর ভাইয়েরা। সবার সম্মুখ দিয়ে, বড়দি’র স্বামীর হাত ধরে, নৈহাটির পিতৃগৃহ ছেড়ে গেলেন গৌরীর ছোট বোন।


আরো পড়ুন: ধারাবাহিক বধূ পাঁচালি: ভাঙা রূপকথা


এখানেও একটি পারিবারিক কলহ হয়েছিলো, যার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সমরেশ এই চূড়ান্ত নির্ণয়টি নেন—কিন্তু কলহ কোন সংসারে নেই? তাই এই কলহগুলো হয়তো উপলক্ষ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।…

আর গৌরী? বিপজ্জনক সীমায় নেমে যাওয়া ব্লাডসুগার এবং আনুষঙ্গিক শারীরিক সমস্যা নিয়ে, অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায়, তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। সেখানে রইলেন তিনি বেশ কিছুদিন।

সমরেশ এসে বসলেন অসুস্থ স্ত্রীর শয্যার পাশে, পেলব মসৃণতায় তাঁর ‘বুড়ি’কে দিলেন আশ্বাস—কিছুই পাল্টায়নি। সবই এক আছে।….কিন্তু কি করেই বা সব এক থাকে? চারটি সাবালক সন্তান দিশেহারা—কোথায় যেন বিশ্বাস আর নিরাপত্তার খুঁটিটা নড়ে গেছে। ঘরে-বাইরে আলোচনা—অথচ গৌরীর কিছুই করার নেই। নিজের শক্তিতে অটুট আস্থা রাখা গৌরী, আজ কাকে প্রশ্ন করবেন যে ১৯৫৫-৫৬ সালের হিন্দু বিবাহ আইন কি তবে অর্থহীন? চিরদিন সোজা রাস্তায় চলা গৌরী, কি করে আশেপাশের পরিবর্তিত মুখগুলোর মধ্যে খুঁজতে যাবেন অভিসন্ধির ছায়া? অর্থ এবং সম্পত্তির চেয়ে হৃদয়ের সম্পদকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া গৌরী, আজ কি করে অধিকার নিয়ে যুদ্ধ করতে নামবেন ছোট বোনের সঙ্গে?…..

নাঃ, তার চেয়ে সব মেনে নিয়ে সম্মতি দিয়ে দেওয়াই ভালো। ‘ওর মধ্যে সমরেশের মতো গভীরতাসম্পন্ন লেখক কি দেখতে পেলো’ না ভেবে, এটা ভাবাই ভালো যে ‘ভালো-মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে’—গৌরীর জীবনের গুরু, রবীন্দ্রনাথের কথা। আর সমাজের কথা? সংসারের মুখ চেয়ে, সন্তানের মুখ চেয়ে, সব মেনে নেওয়াই তো নারীর ধর্ম! চিরদিনের স্পষ্টবাদী গৌরী তবে আজ আর কি করে ঝড় তুলবেন?

ভগ্ন শরীরে, হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে, হাসপাতাল থেকে গৌরী আবার ফিরে এলেন তিল তিল করে গড়ে তোলা তাঁর সেই নৈহাটির বাড়ীতে—যে বাড়ী তিনি একদিন তৈরী করেছিলেন সন্তানদের এবং সমরেশকে ঘিরে, বাপের বাড়ীর কাছাকাছি। সমরেশের প্রতিপত্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, সাফল্য এবং আর্থিক স্বাচ্ছল্যটুকু তিনি ভাগ করে নিয়েছিলেন সবার সঙ্গে। হৃদয়ের ঔদার্যে এবং মমতায় বাপের বাড়ী থেকে শ্বশুরবাড়ী, পাড়া-প্রতিবেশী, সবাইকে সেই বটগাছের ছায়ায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। অর্থ সমরেশের, কিন্তু সামর্থ্য এবং মনটা ছিলো গৌরীর। আর আজ যখন সন্তানেরা প্রায় স্বাবলম্বী হয়ে গেছে, সংসারে গৌরীর প্রয়োজনও যেন ফুরিয়ে গেছে। সমরেশ চলে গেছেন—এই নিঃসঙ্গ পুরী এখন তাঁকে গিলে খেতে চায় অষ্টপ্রহর।

যদিও সমরেশ প্রতি সপ্তাহে না হলেও প্রায়ই আসেন সপ্তাহান্তে, সংসার খরচের টাকা দ্যান, ছেলে-মেয়েদের খোঁজখবর নেন, দু’হাতে ধরে থাকেন দুই সংসার। মাঝে মাঝে সঙ্গে আনেন গৌরীর ছোট বোনকেও। কিন্তু ঐ আসা আর ফিরে যাওয়ার ঘর্ষণে তাজা হয়ে থাকে ক্ষত, শুকোয় না।

বাইরে সব সামাল দিচ্ছেন গৌরী। কিন্তু মনের ভেতর থেকে কে যেন সারাক্ষণ বলে চলে যে সমরেশের কাছে আজ তিনি অপ্রয়োজনীয়, হয়তো বা অর্থনৈতিক বোঝা। সমরেশের এখন পরিবর্তিত জীবন—সামাজিক উচ্চতার সঙ্গে মানানসই কলকাতার ফ্ল্যাট, নিজের গাড়ী, পুরস্কার-নামডাক।

সেই ফ্ল্যাটে গৌরী কোনদিন পা রাখেননি, সেই গাড়ীতে গৌরী কোনদিন চড়েননি। কলকাতায় বসে সমরেশের ঘর-বার সামলাচ্ছেন তখন নতুন ঘরণী—গৌরী শুধু দূরে বসা এক মফস্বলের দর্শক, যার থাকা না-থাকা অর্থহীন।

কলকাতায় নতুন সংসার পাতার কিছুদিনের মধ্যেই সমরেশের জীবনেও শুরু হয়েছিলো অশান্তি।

লেখা নিয়ে প্রথমে বিতর্ক, পরে মামলা শুরু হলো ১৯৬৭ সালে। আঠারো বছর ধরে চললো মামলা। এক আদালতে থেকে হেরে, সমরেশ আপিল করেন উচ্চতর আদালতে। এরমধ্যেও চলে লেখা, তৈরী হয় অপূর্ব সব কাহিনী, আসে সম্মান, বয়ে চলে অনিয়ন্ত্রিত জীবনধারা। চাপা টানাপোড়েন চলে  কলকাতা আর নৈহাটির সংসারের মধ্যে। চতুর্দিক সামলাতে ব্যতিব্যস্ত সমরেশের শুরু হয় হৃদযন্ত্রের সমস্যা—১৯৭৬ সালে হয় প্রথম হার্ট এ্যাটাক। ব্যক্তিগত জীবনে জ্বেলে তোলা আগুন পোড়াতে থাকে তাঁকে, টেনে ধরে পশ্চাতে। নিকট আত্মীয়রা শুনতে পান তাঁর আক্ষেপ—‘কয়লা খেলে কাঠ বেরোবে’।…..নৈহাটিতে আছে তাঁর শিকড়, আশ্রয়—ছেড়ে থাকবেন কি করে? অথচ কলকাতা তখন তাঁকে জড়িয়ে ধরেছে পাকে পাকে।

অসহায়তার বৃত্তে, অশান্তির ছায়ায় ঘুরতে থাকে ক’টি জীবন—যার থেকে মুক্তির পথ বোধহয় ছিলো একটাই। সেই মুক্তির পথ ধরেই অকালবিসর্জনে চলে গেলেন গৌরী, ১৯৮০ সালের ১১ই জুলাই।

আক্রান্ত হৃদয় নিয়ে, সমরেশ পথ হাঁটলেন আরও কিছুদিন। ১৯৮৫ সালে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলায় জয়ী হলেন সমরেশ। কিন্তু অর্থব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে ততদিনে হয়েছে স্বাস্থ্যক্ষয়। ১৯৮৮ সালের ১২ই মার্চ, মাত্র ৬৩ বছর বয়সে শেষ হলো তাঁর পথপরিক্রমা। রয়ে গেলো তাঁর আর গৌরীর প্রেমের দলিল, ‘তিন ভুবনের পারে’, এক কাব্যিক পরিসমাপ্তি নিয়ে।

 

 

তথ্যঋণ: ডঃ নবকুমার বসু

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>