| 26 এপ্রিল 2024
Categories
নিজের কথা

বাঙালির আড্ডা

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

আব্দুল করিম কিম

 

আড্ডা বাঙালির প্রাণ ভোমরা। প্রিয় মানুষের সাথে আড্ডা দেয়ার আনন্দে বাঙালির কোন ক্লান্তি নেই। নেই একঘেয়েমি। আড্ডা একমাত্র বাঙালিরাই মারতে জানে এমন মেটাফিজিক্যাল দাবি নিয়ে নয় বরং আড্ডার সাথে বাঙালি চরিত্রের অবিচ্ছেদ সম্পর্ক তুলে ধরা ও আড্ডার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করাতেই এ রচনা।
আড্ডার ইতিহাস মানুষের সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাসের ইতিহাসের সমসাময়িক। তবে আড্ডা নিয়ে কিছু বলতে হলে সক্রেটিসকে স্মরণ করতে হবে। প্রাচীন গ্রীসে মহান দার্শনিক সক্রেটিস তাঁর শিষ্যদের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা প্রদান করতেন না। তিনি আড্ডার ছলে নিজের দর্শন চিন্তা ছড়িয়ে দিতেন। রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজারই ছিল তার শিক্ষায়তন। তিনি যেখানেই যাকে পেতেন তাঁর সাথেই আড্ডায় মেতে উঠতেন। তিনি মৌলিক কিছু প্রশ্ন করে আড্ডার সূচনা করতেন। প্রথমে প্রতিপক্ষের উত্তর শুনে তাঁর মত স্বীকার করে নিতেন, কিন্তু এর পর যুক্তির মাধ্যমে সেই মতকে খন্ডন করতেন। তাঁর এই পদ্ধতির একটি প্রধান বাহন হল প্রশ্ন-উত্তর। সক্রেটিস প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমেই দার্শনিক আড্ডা চালিয়ে যেতেন। যা ঘন্টার পর ঘণ্টা ধরে চলতো। নগরের যেখানেই লোকজনের ভিড় সেখানেই খুঁজে পাওয়া যেত সক্রেটিসকে। প্রাণ খুলে লোকজনের সঙ্গে গল্প করছেন। আড্ডা দিচ্ছেন, মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছেন, নিজে এমন ভাব দেখাতেন যেনকিছুই জানেন না, বোঝেন না। লোকের কাছ থেকে জানার জন্য প্রশ্ন করছেন। প্রথমে প্রতিপক্ষের জন্য যুক্তির ফাঁদ পাততেন এবং একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকতেন। যতক্ষণ না প্রতিপক্ষ পরাজিত হয়ে নিজের ভুল স্বীকার করে নেয় ততক্ষণ প্রশ্ন চলতেই থাকতো। সক্রেটিসের সাথে আড্ডার কথোপকথনই দার্শনিক প্লেটো লিখে গেছেন। আড্ডার মধ্য দিয়ে তর্ক বিচারের পদ্ধতিকে দার্শনিকরা আস্তি নাস্তিমূলক পদ্ধতি নাম দিয়েছেন, সক্রেটিস এই পদ্ধতির সূত্রপাত করেছিলেন। পরবর্তীকালে তার শিষ্য প্লেটো, প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটল সেইধারাকে পরিপূর্ণরূপে বিকশিত করেছিলেন।
বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান রোটারি ইন্টারন্যাশনাল বা রোটারী ক্লাব-এর জন্ম হয়েছে আড্ডা থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের মার্কিন অ্যাটর্নি পল পি. হ্যারিস ১৯০৫ সালে রোটারী ক্লাব-এর জন্ম দেন। ভিন্ন পেশার তিন বন্ধুর সাথে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সপ্তাহান্তে আড্ডা দিতে দিতে সেবার মাধ্যমে বন্ধুত্ব সৃষ্টির প্রত্যয় নিয়ে এ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। উচ্চস্তরের পেশাগত মানদন্ড রক্ষা, সমাজ সেবা ও আন্তর্জাতিক বোঝাপড়ায় এ সংগঠনের ভূমিকা অপরিসীম। বর্তমান সময়ে বিশ্বের দুই শতাধিক দেশ ও ভৌগোলিক এলাকায় প্রায় ১.২২ মিলিয়নেরও অধিক সদস্য নিয়ে প্রায় বারো হাজার রোটারী ক্লাব প্রতি সপ্তাহে ঘন্টাব্যাপি সাপ্তাহিক সভায় আড্ডাই দিয়ে থাকে।
আড্ডা নির্মল ও নির্ভেজাল আনন্দের বিষয়। আড্ডা দিয়ে শুধু সময়ই কাটানো হয় না, আড্ডা থেকে অনেক সময় অনেক কিছু জানা যায়, শেখাও যায়। সহজ কথায় আড্ডা বলতে খোশ-গল্প, কথা-বার্তা, গপ্প-সপ্প ইত্যাদি বোঝায়। আড্ডা সরাসরি কারো বিরুদ্ধে হয় না এবং আপাতঃ দৃষ্টিতে এতে কারো কোনো ক্ষতি হওয়ারও কথা নয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা থেকে শুরু করে ভ্রমণ বর্ণনা, রোমাঞ্চ, প্রেম, দেশ, ভাষা, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, চলচ্চিত্র, সমসাময়িক প্রসঙ্গ, সমাজ, শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত এর যে কোনো কিছুই হতে পারে আড্ডার উপাদান। সিরিয়াস এবং হালকা বিষয় সবই আলোচিত হয় আড্ডার আসরে। কেউ কেউ আবার সিরিয়াস কথাকে হালকাভাবে রসিয়ে রসিয়ে আকর্ষণীয় করে আড্ডায় উপস্থাপন করতে পারে। এমনও লোক আছে যারা কৌতুক এবং চুটকি  বলে আড্ডাকে জমিয়ে রাখে। আবার কারো কারো স্বাভাবিক কথায় অন্যরা আড্ডায় আমোদিত হয়। আড্ডা নানা প্রকারের হতে পারে। সাহিত্যের আড্ডা, স্মৃতিমন্থনের আড্ডা, নির্মল খুনসুটির আড্ডা, রাজনীতির আড্ডা, পেশাগত আড্ডা। আড্ডায় মানুষের জ্ঞানভা- ঋদ্ধ হয়। ভালো আড্ডা ভালো কাজের সূচনা করে। আবার মন্দ আড্ডা সমাজের ক্ষতি সাধন করে। পাড়া-মহল্লার কিশোর-তরুণ-যুবকদের ‘রকের আড্ডা’ অভিভাবকদের জন্য আতংকের। মদের আড্ডা, জুয়ার আড্ডা, অশ্লীল আড্ডা সমাজের জন্য ভয়ংকর। আবার আড্ডা থেকে মহৎ কাজেরও সূচনা হয়।
বাঙালির সত্ত্বাকে আড্ডা ছাড়া কল্পনা করা যায় না। বাঙালি দেশে হোক বা বিদেশে হোক, বিয়ে বাড়িতে হোক বা মৃতের বাড়িতে হোক- কোন না কোনভাবে সে আড্ডায় মজে যাবে। বাঙালি সুখে আড্ডা দেয়; অসুখেও আড্ডা দেয়। তাই বাঙালি রোগীকে ঘিরে হাসপাতালে আড্ডাবাজ শুভাকাঙ্খীদের ভিড় হয়। বাঙালির আড্ডা দু’জন মানুষে হয় না। জম্পেশ আড্ডা দিতে প্রয়োজন হয় একমনের একাধিক মানুষের। স্বার্থপরতার কালো ছায়া থাকলে আড্ডা দীর্ঘস্থায়ী ও প্রাণবন্ত হয় না। ব্যাক্তিস্বার্থ উদ্ধারের জন্য আড্ডায় কেউ অংশ নিলে আড্ডা নষ্ট হয়। আড্ডায় সবার কথা বলার সুযোগ থাকতে হয়। ছোট-বড় সকল সদস্যের পরস্পরের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ থাকলে আড্ডার প্রাণশক্তি বাড়ে। আবার কেউ এককভাবে আড্ডার কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করলে আড্ডা ক্রমান্বয়ে নির্জীব হয়ে যায়।
বাঙালির আড্ডায় ঘুরে ফিরে যে বিষয়টি বেশী আলোচিত হয়- তা হল রাজনীতি। গ্রামীণ হাঁটুরে আড্ডা হোক, অফিসার্স ম্যাসের আড্ডা, প্রবাসী বাঙ্গালির আড্ডা সর্বত্র বাঙালির আড্ডায় একটা বিষয় ঘুরেফিরে আলোচিত হয়। আর তা হল- দেশের পরিস্থিতি অর্থাৎ রাজনীতি।
শিক্ষিত-রুচিবান বাঙালির আড্ডা ও অশিক্ষিত-রুচিহীন বাঙ্গালির আড্ডার মেজাজে ভিন্নতা থাকে। বাঙালি পুরুষের আড্ডা ও বাঙালি নারীর আড্ডায়ও আলোচ্য বিষয়ে পার্থক্য থাকে। পুরুষের আড্ডায় সুন্দরী নারীর উপস্থিতি উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। আবার নারীর আড্ডায় একক পুরুষকে খাপছাড়া লাগে। শিক্ষিতের আড্ডায় মুর্খ বুঝে না বুঝে হাসে। কিশোরীদের আড্ডায় কথার চেয়ে হাসি হয় বেশী। আবহমান বাঙালি জীবন চক্রে শিশুদের আড্ডা হয় শীতের রাতে। সে আড্ডায় ঠাকুমার ঝুলি, আরব্য রজনীর গল্প আর ভুত-পেত্নীর গল্প শোনাতে হয় দাদু-দিদাকে।
বাঙালি পেশাজীবীদের মধ্যে আইনজীবী, সাংবাদিক ও শিক্ষক পেশাগত কারণে সবচেয়ে বেশী আড্ডাবাজ। পেশাজীবীদের আড্ডায় পেশাগত বিষয়েই বেশী আলোচনা হয়। চাকরীজীবী বাঙ্গালির আড্ডায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ্য অর্থাৎ ‘বস’কে নিয়ে আলোচনা হয়। গৃহিণীদের আড্ডায় ঘুরেফিরে আসে ‘কাজের মানুষ’-এর প্রসঙ্গ। সক্ষম পুরুষের আড্ডায় ‘নারী’ থাকবেই। তরুণীদের আড্ডায় ‘ফ্যাশন’ থাকবে। হুজুরদের আড্ডায় ‘বেপর্দা নারী’।
বাংলা ভাষাতে চাপামারা, গুলতানি, গ্যাজানো, প্যাঁচালপাড়া, বকবক বলে কিছু শব্দ আছে যা আড্ডার সাথে সম্পৃক্ত। চাপামারা ও গুলতানি দেয়া সদস্যরা আড্ডা জমায়। আবার গ্যাজানো, প্যাঁচালপাড়া, বকবক করা সদস্যরা আড্ডাকে করে বিরক্তিকর ও বিব্রতকর। বাঙালির আড্ডায় সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় পরচর্চা, পরনিন্দা। পরচর্চা ও পরনিন্দা ব্যাতিত বাঙালির আড্ডা অপূর্ণ থাকে।
জাতীয় সংসদ বাঙালির জাতীয় আড্ডাস্থল। কার্যকর সংসদে কার্যকর আলোচনা হয়, আইন প্রণয়ন হয়। আর অকার্যকর সংসদ মূলত সাংসদদের অর্থহীন আড্ডাখানা। রাজনীতিবিদদের আড্ডাখানা মূলত দলীয় কার্যালয়। বিত্তবানদের আড্ডা খানা সুরাপানের অনুমোদিত ক্লাব ভবন। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আড্ডাখানা ক্যান্টিনরুম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন ছাত্র রাজনীতির কিংবদন্তীর আড্ডাখানা।
বাঙালি কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীদের জন্য আড্ডা হল সঞ্জীবনী সুধা। একুশের বই মেলা দেশের কবি-সাহিত্যিকদের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত আড্ডাস্থল। বইমেলায় কেন আসেন -এ প্রশ্নের জবাবে সবাই একবাক্যে বলেন বন্ধু, শুভাকাঙ্খি ও পাঠকদের সাথে আড্ডা দেয়ার লোভে। দেশের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকরা নিয়মিত আড্ডা দেন। তাঁদের এ আড্ডাস্থল গুলোও একসময় খ্যাতি লাভ করে।
বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর জোড়াসাকোর ঠাকুর বাড়ি আড্ডার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। ভারতবর্ষ জুড়ে এই বাড়ির সাহিত্য আড্ডার সুনাম ছিল। এপার বাংলা হোক আর ওপার বাংলা হোক বাঙালি মানেই আড্ডা। তাই মান্না দে’র কণ্ঠে ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই…’ গানটি শুনলেই শহুরে বাঙালির মন উচাটন হয়। বাঙালির গ্রামীণ জীবনেও অতীত আড্ডার স্মৃতিতে হুতাশন হয়। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের জনপ্রিয় লোকগান ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ মূলত অসাম্প্রদায়িক চিরায়ত বাংলার গ্রামীণ আড্ডারই স্মরণ।
আড্ডা শারীরিক সুস্থতা ও মানসিক প্রশান্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যাবতীয় হতাশা ও দুঃশ্চিন্তা দূর করার জন্য আড্ডার ভূমিকা অসামান্য। আড্ডার মধ্য দিয়ে পারস্পারিক ভাবনা-চিন্তা, ধ্যান-ধারনা প্রকাশিত হয়। তাই কেউ ভুল পথে, ভুল চিন্তায় নিমগ্ন হলে অন্যরা তা উপলব্ধি করতে পারে। আড্ডায় আড্ডায় অভিজ্ঞতা ও যুক্তির কাছে ভ্রান্তি পরাস্থ হয়। কিন্তু হালের ডিজিটাল নাগরিক জীবনে আড্ডা দেয়ার জন্য কেউ ঘরের বাইরে যেতে চায় না। অনেকের মধ্যে থেকেও সবাই আলাদা আলাদা হয়ে গেছে। এখন শিশুরা মা-বাবার সাথে কোথাও বেড়াতে যেতে চায় না। মা-বাবাও খুশি। বাচ্চা যন্ত্রণা করে না। লক্ষ্মী, চুপচাপ থাকে আর ল্যাপটপে বা মোবাইলে একটু আধটু গেইম খেলে। এই একাএকা থেকে থেকে একসময় এ শিশুরা নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। কোথাও বেড়াতে গেলে সমবয়সীদের সাথেও মিশতে পারে না। যা তাদেরকে অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত করে। তাই ঘরোয়া ভাবে হলেও পারিবারিক আড্ডায় শিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ঘরোয়া আড্ডায় প্রবীণদের মাধ্যমে ধর্মের মানবিক দিক তুলে ধরা ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ক আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন। শিশুদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানিয়ে দেয়া জরুরী। পাকিস্তানীদের শাসন-শোষণ-নিপীড়নের গল্প পরিবার থেকে জানতে পেলে সে শিশু পাকপ্রেমিক হবে না। পারিবারিক আড্ডায় শিশুদের সামনে বাঙ্গালির বীরত্বের গল্প, ভালো ভালো অর্জন ও বাঙালি মনিষীদের জীবন কাহিনী আলোচনা করা উচিৎ। ঘরোয়া আড্ডায় সংস্কৃতিচর্চার প্রচলন করা প্রয়োজন। এতে গান বা আবৃত্তি বা গল্প বলার সুযোগ পেলে শিশুরা পরবর্তীতে মঞ্চে দাঁড়ানোর সাহস অর্জন করবে।
জীবনকে সতেজ ও প্রাণবন্ত করতে নিয়মিত নির্মল আড্ডা হোক। পরিবারের সদস্যদের বন্ধন দৃঢ় করতে বেশি বেশি পারিবারিক আড্ডা হোক। ভালো মানুষদের আড্ডা সমাজকে পরিশীলন করে। তাই বাঙালিকে আড্ডা অব্যাহত রাখতে হবে। আড্ডার মাধ্যমে সাহিত্য চর্চা, সংস্কৃতি চর্চা, ইতিহাস চর্চা ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা চালিয়ে যেতে হবে। পরিশিলিত নির্মল আড্ডা অব্যাহত থাকলে হাজার বছরের বাঙালি সমাজকে কোনভাবেই ঘুণে ধরবে না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত