| 8 মে 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতীর ছোটগল্প: সুঁড়িপথ । ব্রততী সেন দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

কনভেয়র বেল্ট থেকে স্যুটকেস ব্যাগ সংগ্রহ করে ট্রলি নিয়ে গেটের কাছে এসে রাধিকা দেখতে লাগল চেনা মুখ কাউকে পায় কিনা। উদয়ন বলেছিল ও এয়ারপোর্টে রিসীভ করতে আসতে পারবে না,জরুরি কাজে আটকে গেছে কিন্তু অফিসের কাউকে নিশ্চয়ই গাড়ি দিয়ে পাঠাবে। আচমকা চোখ পড়ল দীপনের দিকে। দীপন বড়ুয়াকে রাধিকা চেনে। প্রথমবারই যখন এসেছিল তখনই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল উদয়ন।চোখে সান গ্লাস আর জিন্স – সাদা কটন শার্ট পড়া টল ফেয়ার এন্ড টোটালি হ্যান্ডসাম দীপন রাধিকার দিকে এগিয়ে এসে হেসে নমস্কার করল তারপর ট্রলির দিকে হাত বাড়াল। রাধিকা প্রতি নমস্কার করে পদমর্যাদার ভারিক্কি মেজাজটা সান গ্লাসের মত চোখে পড়ে নিল। অথচ আড়চোখে মেপে নিল চর্চিত সুগঠিত দীপনকে।

পাক্কা সাড়ে তিন ঘন্টার রাস্তা,বৃষ্টি হয়েছে তাই সিল্ক মসৃণ পথে একটু সাবধানেই চালাতে হচ্ছে। রাধিকার কোন অসুবিধে হচ্ছে না। দু পাশের মনোরম নিসর্গ দৃশ্য আর আরামদায়ক নরম গদিওয়ালা ল্যাভেন্ডার সুরভিত গাড়ির ব্যাক সিটে গা এলিয়ে বসে আছে রাধিকা আচার্য। টেনশনহীন যাত্রাপথের আরামেই অর্ধেক ক্লান্তি উধাও হয়ে গেছে।

উদয়ন কাজ ভালবাসে, যেখানে দায়িত্বের প্রশ্ন সেখানে কোন রকম সমঝোতা করার কথা ভাবেইনা। রাধিকাও নিজেকে প্রমাণ করতে উচ্চাশার ফানুশ উড়িয়ে আকাশ ছুঁতে চেয়েছে। একা হাতে সাত বছরের পরিশ্রমে সফটওয়্যার-হার্ডওয়্যার কম্পানিটাকে দাঁড় করিয়েছে যার টার্নওভার কোটি ছাড়িয়ে গেছে!তবে রাধিকার অন্য আর একটা পরিচয় আছে,ও অসাধারণ বাচিক শিল্পী। ইউটিউবে ওর কবিতাপাঠ যা যা আপলোড করে তার লাইক্স আর ডিমান্ডস তুমুল।বহু অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করে।পেশা আর প্যাশন নিয়ে সম্পূর্ণ করা এক বৃত্তের কেন্দ্রস্থলে বিরাজ করে রাধিকা। বৃত্তের পরিধি যখন চেপে বসে তখন দম বন্ধ আসে রাধিকার। সেই সময় আট দশ মাস পার করে দূর পাহাড় পেরিয়ে উদয়নের কাছে এসে দু দন্ড বিশ্রাম নিয়ে যায়।

গাড়ি মসৃণ গতিতে চলছে, দীপন সামনে বসা। রাধিকার যাত্রাসঙ্গী হিসেবে নিবিষ্ট হয়ে দায়িত্ব পালন করছে। উদয়ন এই ছেলেটিকে খুব পছন্দ করে।আসামের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা দীপন এখানকার জুনিয়র অফিসার, পরিশ্রম, দায়িত্ববোধ, সততা আর চরিত্রের জোরে খুব অল্পদিনেই কর্তৃপক্ষের মন জয় করে নিয়েছে। এখানকার ডিপার্টমেন্ট এক ডাকে দীপন বড়ুয়াকে চেনে। এত মার্জিত ওর ব্যবহার এবং এতটাই দায়িত্ববোধ ওর যে যেকোন পরিস্থিতিকে অনায়াসে নিজের আয়ত্ত্বে আনতে পারে।উদয়ন তো বলে এগারো বছর এখানে কাটিয়ে দিল শুধু দীপনের সাহচর্যে ও সহযোগিতায়। দীপনের দায়িত্ব-কর্তব্যে মাত্রাবোধ এতটাই তীক্ষ্ণ যে এক পলকের জন্য কোনদিন তার সামান্যতম বিচ্যুতি দেখা যায়নি, এমনকি অফিশিয়াল কার্টসি রক্ষায়ও সে যথেষ্ট তৎপর যা রাধিকার কাছে অবশ্য একটু বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়।
তার মত হিল্লোলিত দেহবল্লরী আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের নারীর সামনে কোন পুরুষমানুষ সামান্যতম বিচলিত হলো না এমনটা রাধিকার অভিজ্ঞতায় বিশেষ নেই।সে ছেলেদের পাত্তা দেয় না, পাত্তা পেয়ে থাকে। বরাবর সে পুরুষের কাছ থেকে রূপমুগ্ধতার নীরব বা সরব স্তুতি পেতে অভ্যস্ত।আননোটিসড সে কখনো হয় না কিন্তু দীপন ব্যতিক্রম, ওর আকর্ষণে দীপনের মত এক যুবাপুরুষের বিন্দুমাত্র হেলদোলহীনতা ওকে তাজ্জব যেমন করে তেমন দীপনের দিকে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ও অস্বস্তিকর ফোকাসও তৈরি হয়ে যায়। অজান্তে মন চলে যায় ওর দিকে যা পদমর্যাদার নিরিখে রাধিকাকে বিব্রত করে। বয়সে বা সম্মানে রাধিকা যেখানেই থাকুক, সর্বোপরি সে একজন সুন্দরী নারী। রূপমুগ্ধতার আঁচে বহু পুরুষকে সে দগ্ধ হতে দেখেছে এবং সেটাই স্বাভাবিক বলেই মানে সে। তাই দীপনের মত রূপবান পুরুষের উদাসীনতা ওর কাছে মনে হয়েছে ইচ্ছাকৃত উপেক্ষা বা ইগো সমস্যা! উলটে এক্ষেত্রে রাধিকার কোথাও যেন এই উদাসীন বা অতিরিক্ত মার্জিত পুরুষটির দিকে একটা ঝোঁক তৈরি হয়েছে।
– ড্রাইভার গাড়ি থামাও।জল কিনতে হবে, রাধিকা বলল।
দীপন নিজেই সটান দোকান থেকে জলের বোতল এনে দিয়ে জিজ্ঞেস করল-ম্যাডাম চা বা কফি খাবেন?
– নো থ্যাঙ্কস
– মোস্ট ওয়েলকাম

যদিও রাধিকার চা তেষ্টা ভালই পাচ্ছিল, একটা রোড সাইড ক্যাফেতে বসে চা বা কফি পান করাই যেতে পারত কিন্তু ও জানে দীপন অবধারিতভাবে ওর সাথে ক্যাফেতে ঢুকত না অথচ উদয়নের আজ্ঞাবাহক হিসেবে কফির দামও কিছুতেই ওকে দিতে দিত না, এ ধরনের অফিশিয়াল ফর্মালিটি রাধিকা পছন্দ করে না তাই ও বারণ করে দিল। ছেলেটি ওর চাইতে বয়সে ছোট কিন্তু ওর এক অদ্ভুত ওজনদার ব্যক্তিত্ব আছে ।

বাংলোতে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। উদয়ন ওদের জন্য বারান্দায় অপেক্ষা করছিল।

 

এক দিন রাতে খাবার টেবলে বসে উদয়ন বলল, দীপন পনেরো দিন ছুটি নিয়ে শিলচর যাচ্ছে।
– কেন,ছুটি কেন?
উদয়ন হেসে জবাব দিল, বিয়ের জন্য ছুটি নিচ্ছে।
– বাঃ! তাই নাকি? আগে বলনি তো, কোথাকার মেয়ে?
– ওদের গ্রামের। শুনলাম নাকি বাল্যপ্রেমিকা।
– বাব্বা! দীপনবাবু তো বেশ ডুবে ডুবে জল খেতে পারেন। দেখে তো কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই, প্রেম করছেন অথচ মুখখানা দেখলে তো মনে হয় ভাজা মাছটি উলটেও খেতে পারেন না!
– হা হা হা, এ কী মাইক নিয়ে ঘোষণা করার মত কথা? ও তো এমন ছেলেই নয় তুমি জানো। আমিই এতদিন জানতাম না, আমাকেই কোনদিন বলেনি। উদয়ন জোরে হেসে উঠল।
-দীপন খুব খুশি জানো, ওর সি আর এত ভাল যে শেষমেশ হয়ত এখানেই পোস্টিং হয়ে যাবে। ও তাই চায়, গ্রামের কাছাকাছি থাকতেই চায়। পরিবারের অনেক দায়িত্ব ওকে বহন করতে হয়।
রাধিকা মনে মনে কিছু ভাবল কিন্তু মুখে বলল- ওকে একদিন আসতে বলো। এই শনিবার সম্ভব?
– এই শনিবার হবে না, আমি জোয়াই যাব, দীপনও যাবে সঙ্গে। পরের শনিবার আসতে পারে। ও নিজেই বলছিল ম্যাডামকে ইনভাইট করতে আসবে।
– আমাকে? বাব্বা! কত্ত কর্তব্যজ্ঞান।
– তা ওর একটু আছে বৈকি। আমি ওকে বলেছিলাম আমাকে কার্ড দিলেই হবে। কিন্তু না, ও বাড়ি এসেই স্পেশালি তোমাকে ইনভাইট করতে চায়।
রাধিকা হেসে বলল
– তা তো হবেই,তুমি ওর ডাইরেক্ট বস, ওর মেন্টর বলে কথা!
– হ্যাঁ, ওর বিয়েতে আমায় যেতেও হবে, ও কতদিন আগে থেকেই বলে রেখেছে। না গেলে কষ্ট পাবে, ছেলেটা ভাল !

রবিবারের সকালটা, দীপন জগিং সেরে এসে র- টির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে নিউজ পেপারে চোখ বোলায়।
প্রতিদিন ভোরে উঠে এক ঘন্টা জগিং করে,প্রায় চার কি মি দৌড়ে বাড়ি ফিরে এসে ঘেমেনেয়ে জবজবে হয়ে যায়। এসে দু কাপ র- টি বানায়। নিজেরটা খায় আর পদ্মিনীরটা ফ্লাস্কে রেখে স্নান সেরে নেয়। তারপর বউকে ঘুম থেকে তোলে।বিয়ের পর থেকে এই ওর ডেইলি রুটিন,একদিনও অন্যথা হয়নি। এরপর সংসারের ব্যাটনটা ধরে পদ্মিনী, সারাদিনের জন্য। ওর শুধু একটাই অসুবিধে ভোরে জাগতে পারে না। ঘুম ভাঙতেই দীপন গান গেয়ে উঠল,  ওঠো ওঠো রাই সুন্দরী, বেলা গেল বইয়া।
পদ্মিনী বরকে পিঠের দিক থেকে গভীর আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ের নীচে চুম্বন এঁকে দিল। স্নান সেরে এলে দীপনের সুগঠিত শরীর থেকে দেহজ পুরুষালি গন্ধ আর মাস্কুলিন সোপের সৌরভ বিকীর্ণ হয় যা পদ্মিনীকে অষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে। তখন পদ্মিনী সর্পিণী হয়ে যায়, কিছুতেই দীপনের থেকে বিযুক্ত হতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে হয় পুরো বেলা… পুরো দিন… না পুরো জীবনটাই জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে কাটিয়ে দিতে।
দীপন মাথায় আলতো করে চাপড় মেরে বলল- ওঠো, আজ তাড়াতাড়ি কাজ সেরে নাও। সন্ধেতে বসের বাড়িতে ইনভিটিশন আছে মনে আছে তো?
পদ্মিনী দীপনের সুগঠিত আঙুল নিয়ে খেলা করতে করতে বলল- আচ্ছা,তুমি ওঁকে বস কেন বল, মিঃ আচার্য বলতে পারো তো।
– না,পারি না। উনি আমার শুধু বস নন। আমার মেন্টর। উনি আমাকে কতবার বাঁচিয়েছেন জানো? এই পাহাড়ের স্থানীয় মানুষজন ভিষণভাবে প্রবাসী বিদ্বেষী। বাইরের লোককে এখানে এরা টিঁকতে দিতে চায় না। আমি যখন প্রথম এখানে পোস্টিং পাই তুমি জানো না, সবাই কীভাবে আমার পিছনে পড়েছিল! জিনা হারাম করে দিয়েছিল।
– তাই নাকি?
– সন্ধেবেলা অফিস ফেরত কতবার ঘেরাও হয়েছি লোকাল লুম্পেনদের হাতে। রাতে বাড়িতে পাথরও ফেলত।
– কেন?
– ভয় দেখাত, যাতে পাহাড় ছেড়ে পালিয়ে যাই বা অন্যত্র ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাই।
-তাতে ওদের লাভ?
– লাভ কী জানি না,ক্ষোভ! ওদের মাটিতে বসে ওদের অন্ন কেড়ে খাচ্ছে বাইরের লোক ওদেরকে এমনটাই কেউ বোঝাচ্ছে। আমাদের কারণে ওরা বেকার, কাজকম্ম নেই তাই মেরে হটাও শালাদের, এই হল ওদের যুক্তি। কিন্তু আমার বস লোকাল পার্টির মেম্বারদের ডেকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমার পোস্টিং এখানেই করিয়ে দিয়েছিলেন। এত সুন্দর জায়গা ছেড়ে কেউ যেতে চায়? আর আমার গ্রামও এখান থেকে বেশি দূর নয়।
– তোমার বসও তো বাইরের লোক, কলকাতার। তাঁকে কিছু বলে না?
-না, আমার বস হল হায়ার ডেজিগনেশনের, এঁদের সাথে এরা সংঘাতে নামবে না। অত ধ্বক ওদের নেই। আর এঁরা হলেন দিল্লীর ক্যাডার। যত রাগ তার নীচের লেভেলের অফিসারদের ওপর। বস আছেন বলে আমি এখানে সুস্থ ভাবে কাজ করতে পারছি।
– হুঁ…. তোমার মত দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন অফিসারই বা পাবেন কোথায়?
দীপন পদ্মিনীর প্রতি রুষ্ট হল। স্যারকে ও মন থেকেই সম্মান করে। এমন বড় হৃদয়ের মানুষকে সিনিয়র হিসেবে পাওয়া সৌভাগ্যের কথা।বাকি অফিসারদের ও চেনে তো। পারলে মাসের বাজারটাও কন্ট্রাক্টরদের দিয়ে করিয়ে নেয়। আর উদয়ন আচার্য তো এক কাপ চা খেলেও তার দাম নিজেই দেন।
– ম্যাডামও খুব গুণী শুনেছি। মাঝে মাঝে ওঁর কাছে ঘুরতে চলে যেও। ওঁর কবিতা শুনেছো তুমি?
– না
– শুনেছি ম্যাডামের পাঠের সিডি রিলিজ করেছে,আজ একটা চেয়ে নেব।
– না, বাণীতীর্থ থেকে কিনে নেব পরে।

আজ ঠান্ডাটা অনেক কম। নিরিবিলি রাস্তা,জনমানুষ নেই কোথাও। শুধু দুজনের পায়ে চলার শব্দটুকু কানে আসে। আজ বোধহয় পূর্ণিমা, মেঘ আর কুয়াশা মিলে চাঁদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। একটা শিরশিরে হাওয়া বইছে কিন্তু তাতে ঠান্ডা নয়,আরাম লাগছে।
পদ্মিনী আজ একটু আনমনা হয়ে হাঁটছে,কিছুটা সরে সরে। দীপন হাত ধরে কাছে টানল- কী গো বৌ, অত চুপ কেন?কাছে এসো।
আজ দীপন ড্রিঙ্ক করেছে। উদয়নের পেড়াপেড়িতেই প্রথমে এক পেগ নিয়েছিল। তারপর নীট খেয়ে ফেলেছে দু পেগ। একটু টিপ্সি হয়ে গেছে। পদ্মিনী সারাক্ষণই রাধিকার পাশে পাশেই ছিল।

রাতে ডিনার করে দুজনে হেঁটেই ফিরছে।উদয়ন গাড়ি বার করে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল কিন্তু এমন সুন্দর চাঁদনি রাত,পাহাড়ি পথ আর সঙ্গে সদ্য ফোঁটা বিবাহের নতুন বৌয়ের মৌতাত কি আর বৃথা বইতে দেওয়া যায়! আর তারপর পেটে হুইস্কি পড়েছে আর অমন সুন্দর ডিনার খেয়ে কি গাড়ি চড়ে হুঁস করে বাড়ি ফিরতে মন চায়? হেঁটেই যাওয়া যাক, প্রেম করাও হল, খাবারও হজম হলো। কিন্তু পদ্মিনীর মুড অফ বুঝে সেদিন প্রেমটা তেমন জমল না।

 

ড্রেসিং টেবলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে দীপন একটা লঘু শিস দিচ্ছিল। আয়নায় রাধিকাকে দেখে বলল- যাবে নাকি?
– নাহ্,! তুমি একাই যাও
– গেলে ভাল করতে, ওদেরও ভাল লাগত, তোমারও একটু হাঁটা হতো।
– হাঁটার অনেক জায়গা আছে, পরে যাব।
দীপন পদ্মিনীকে কোমড় ধরে আটকালো- একটা কথা বল তো মণি বস আর ম্যাডামকে তোমার ভাল লাগেনি, না? তাই তুমি ওদের অ্যাভয়েড করো?
পদ্মিনী মাথা নীচু করে মৃদু স্বরে বলল- পারলে তুমিও কম যাও।
– কেন, ওরা কি তোমায় কিছু বলেছেন?
– ওরা তোমায় বলেছেন
– কী? কী বলতে পারেন আমার ব্যাপারে….দীপন চিন্তিত হল।
পদ্মিনী বলল- তুমি ঘুরে এসো, সব বলব।

রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে রুম হীটারটা বাড়িয়ে দিয়ে সোফায় বসে গায়ের চাদরটা ভাল করে জড়িয়ে নিল পদ্মিনী। দীপন ল্যাপটপে কাজ করছিল। কাজ সেরে একটা সিগারেট ধরিয়ে পদ্মিনীর দিকে চেয়ে ভাবল কী আছে এই মেয়েটার মধ্যে যে ওকে এত আকর্ষণ করে। রাস্তাঘাটে কত সুবেশা, সুন্দরীদের দেখে। কত মেয়ে যেচে এগিয়ে এসে ওর সাথে আলাপ করতে চায় কিন্তু ওর সেভাবে কাউকে দৃষ্টি আকর্ষণকারী তো মনে হয় না। আর হলেও বেশিক্ষণ তা মনে থাকে না। এমন কি অমন যে ঝাঁ চকচকে শহুরে জৌলুসের বিদূষী আচার্য ম্যাডাম তিনিও ওর মনোযোগ প্রত্যাশী ও টের পায় কিন্তু তিনিও ম্লান হয়ে যান পদ্মিনীর কাছে।
পদ্মিনী বৃষ্টি ধোওয়া নবদুর্বাদলশ্যামের লাবণ্যে ভরপুর, ফুলদানিতে সাজানো প্লাস্টিক ফুল নয়। ওর ত্বকের গভীরে মাটির সোঁদা গন্ধ টের পায় যেমন কস্তুরী মৃগের নাভির পদ্মমূল থেকে সৌরভ বিকীর্ণ হয়। কোন ছোট্টবেলায় খেলার ছলে কথা দেওয়া হয়ে গেছিল অথচ আজকে মনে হয় এই তো সেদিনের কথা।
– বলুন ম্যাডাম কী বলছিলেন সকাল?
পদ্মিনী খাওয়ার পর মৌরী খায়, তাই খানিক মুখে দিয়ে শুরু করল, জানি না তুমি কতদূর বিশ্বাস করবে কিন্তু তোমার মুখে তোমার আচার্য সাহেবদের কথা যতখানি শুনে সেদিন গিয়েছিলাম আমার কাছে সত্যি বলছি তেমন কিছু মনে হয়নি। বরং উল্টোটা। তুমি বলেছিলে বলে আমি সেদিন সেজেগুজে গিয়েছিলাম। পড়েছিলাম বৌভাতের তত্ত্বের কাতান বেনারসিটা। রংটা তোমার খুব পছন্দের, আমাকে নাকি খুব মানায়, তাই পড়েছিলাম।
আমায় দেখেই ম্যাডাম বলেছিলেন, ভাল মানিয়েছে তোমায়, এর সঙ্গে একটু মেটে সিঁদুর হলে আরো ভাল লাগত। ও ক’ঘন্টার মোলাকাতে আমার আরো কিছু ত্রুটি বার হয়েছিল। আচ্ছা, ছাড়ো সে সব কথা!- আচ্ছা, তোমার স্যারের এক আত্মীয় কখনও এসেছিলেন যাঁদের সঙ্গে একজন এসেছিল যার ডান পা টা একটু টেনে চলত?
– হ্যাঁ এসেছিল। স্যারের ছোটমামার ছোট মেয়ে। ডান পা পোলিওতে অ্যাফেক্টেড।
– হ্যাঁ, ওই মেয়ের তোমাকে ভিষণ পছন্দ হয়ে গেছিল এবং সে নাকি বাড়ি গিয়ে জেদ ধরে তোমাকেই সে বিয়ে করতে চায়। এবং তুমি যে পছন্দসই জায়গায় থাকার আনন্দে মশগুল হয়ে আছো দুদিন পরে এর পেছনের ষড়যন্ত্র টের পেয়ে সারাজীবন কাঁদতে!
-মানে, আমায় ফাঁসিয়ে দিয়ে ওই মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিত?
– হ্যাঁ
– তোমায় কে বলল? ম্যাডাম?
– আমি কথার ফাঁকে জেনেছি তোমার আচার্য সাহেবের এক দিদির এ ভাবেই বিয়ে হয়েছিল এক জুনিয়র অফিসারের সাথে, নতুন পোস্টেড এক অফিসারকে অফিশিয়াল ঝামেলা থেকে উদ্ধার করার শর্তে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল দিদির সাথে। তুমি বলতে ওর সঙ্গে কথা বলতে। আমি ফোন করে করে নানা কথার ফাঁক দিয়ে ওঁদের মনের কথা বার করে নিয়েছি। আরো কথা আছে।
– কী?
– আমার তো সন্দেহ হয়, তোমায় লোকাল গুন্ডা দিয়ে ঘিরে ফেলে ভয় দেখান কোন যড়যন্ত্র কিনা। আর কারুর সাথে হল না, তোমার সাথেই হতে হল!
এবার দীপন চিন্তিত হল, কপালে গভীর চিন্তার কুঞ্চন দেখা গেল। খুব গম্ভীর হয়ে বলল- তুমি যা বললে আমি শুনলাম। কিন্তু সবটাই কোন সরলরেখায় ফেলে দেখলে চলবে না। প্রতি মোড়ে বাঁক আছে। জটিল মনস্তত্ত্বের বাঁক… নারী পুরুষের চিরন্তন আকর্ষণ – বিকর্ষণের নিগূঢ় রহস্য। ইগোর লড়াই। হয়ত তুমি যা শুনছ তা হয়ত কোন বিজিতার প্রতিহিংসার চরিতার্থতার কাহিনি।
পদ্মিনী বিস্ময়াহত চোখে তাকাল
– অমন করে তাকিও না সুন্দরী, আমার কিছু করার নেই। তোমার স্বামীটির দিকে যদি কারোর চোখ পড়ে এবং স্বামী যদি তাকে মন না দিতে চায় তবে দোষ কার? বুকের ভেতর হিরামন পাখি যে ক্রমাগত বলে যাচ্ছে তার পদ্মিনীর কথা সেখানে দোষ কার? শোন, যে জ্বলে সে জ্বালায়। তোমায় কেউ জ্বালাচ্ছে। তুমি এসবে কান দিও না। আমিও দেব না।
– হ্যাঁ, সেই ভাল।
– আর চলো আমরা অন্য কোথাও চলে যাই। এই ছোট্ট শহরটি সুন্দর কিন্তু এর কোন ব্যাপকতা নেই। সুন্দর মানেই যে তার মধ্যে প্রসারতা থাকবে তা নাও হতে পারে। আজ ভাল লাগছে কিন্তু থাকতে থাকতে দেখবে আমরা অনেক সংকীর্ণতর হয়ে যাচ্ছি। আমরা দুজনেই গ্রাম থেকে বড় হয়েছি তাই জানি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর ক্ষুদ্রতা কাকে বলে। আমরা ঘুরে ঘুরে থাকব। কত কী শিখব, বাঁচার মত করে বাঁচব!
-সেই ভাল। তুমি ট্রান্সফারের জন্য দরখাস্ত দিয়ে দাও। কারোর মর্জি মাফিক চলার দায় আমাদের নেই।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত