গল্প: বড়লোক বন্ধু এবং এক সন্ধ্যা । মাহমুদুল হক আরিফ
ঝাক্কাস্!
নতুন গাড়ির মডেল বর্ণনা করতে গিয়ে সাফোয়ান একবার বললো দেখতে অস্থির, আরেকবার বললো ঝাক্কাস্।
ফোনে, আমি শুনলাম আক্কাস, বন্ধু সাফু পূণরায় বললো ‘আক্কাস’ না ‘ঝাক্কাস্’। বন্ধু সাফোয়ান আহম্মেদ কে আমরা সংক্ষেপে সাফু বলে ডাকি। ও আমার প্রথম জেনারেশন বড়লোক বন্ধু। টাকা হয়ে গেলে আমরা যেমন বড়লোক বলি। ওর এখন আরো হয়েছে, তাই সাফু বড়লোক। সাফু আরো প্রায় বছর বিশ আগে আইফোন কিনেছিল, তখন-ই ফোন করে জানিয়েছিল- দেখে যা একবার। এখান থেকে দেখা শুরু। তারপর কত কি নামীদামী ব্রান্ড। একটা ধরে, তো আরেকটা ছাড়ে। নতুন কিছু কিনলে ফুটবল খেলার মতো ধারাবর্ণনা দেয়। সর্বশেষ একটা হাইব্রীড জীপ কিনেছে সে। গাড়ির বর্ণনা করতে গিয়ে অস্থির-ঝাক্কাস্, সেরাম মাটি কামড়ে চলে; একবার চড়ে যা! ভেতরে মেলা স্পেস। সম্পূর্ণ অটোমেশন। ডেকরেশন অন্য মাত্রার- সিটে বসে দারুণ আরাম, একদম তুলতুলে বিড়ালের মতো। বরাবরের মতো এবারও নতুন গাড়ি দেখতে আহ্বান জানালো সাফু। দু’দিন বাদে আমিও উপস্থিত। গাড়ি নিয়ে তিনশো ফিট রাস্তার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম। শহরের স্ট্রিট লাইটের আলো টপকে টপকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। গাড়ির ভেতরে হলকা জেসমিন ফুলের ঘ্রাণ যখন নাক সয়ে গেছে, তখন হিন্দি গজল চলিয়ে দেয়া হল। গোলাম আলী মৃদু-মন্দ বাজছে। কানেও বেশ লাগছে। গাড়ি একটা রেষ্টুরেন্টের সামনে এসে থামলো। সাফুর চোখ সচ্ছ কাচের ন্যায় টলটল করছে- চলতি পথে সাফু একটা ক্যান খুলেছিল, আন্দাজ করি- বিয়ার-ফিয়ার হবে হয়ত। নাকে একটু কুটু গন্ধ পেয়েছিলাম। চোখে মনে হয় ওটার-ই প্রভাব। সন্ধ্যা’ হল সাফুর জন্য গোল্ডেন টাইম। ড্রাইভার ফাঁকা জায়গা দেখে পার্ক করলো, আমরা গাড়ি থেকে নামলাম।
এখানে আগে থেকেই তিনজন অপেক্ষায় ছিল। ওরা এগিয়ে আসার আগেই সাফু বললো তুই রেঁস্তোরার ভেতরে ঢোক। একটা টেবিলে গিয়ে বস। এদের বিদায় করে আসছি। আমি একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম। ওয়েটার এগিয়ে এলো। রেঁস্তোরার পূর্ব কর্ণারে জোরে জোরে বিটসহ গান বাজছে। পাশেই কোন জন্মদিন-টন্মদিন হবে, ইদানীং রেঁস্তোরাগুলোতে নানারকম কর্ণার থাকে। রেগুলার কাস্টমারের পাশাপাশি ছোট ছোট পার্টি সামলায়। রেষ্টুরেন্টের সাজ ধ্রুপদী হলেও পরিবেশ একদম তালগোলে বিপরীত! আমি অত্যাধিক শব্দের কারণে ওয়েটারকে পরে আসতে বলে নিজেই বাইরে চলে এলাম। দেখলাম সাফু দূরে দাঁড়িয়ে ওদেরকে কিছু একটা হস্তান্তর করছে, খাম সদৃশ। সাফু তাদের বিদায় দিয়ে ফিরে তাকালো— আমাকে ইশারায় ডাকলো বললো ভেতরে চল। বললাম এখানে হইচই বেশি, চল অন্য কোথাও যাই। রাজি হয়ে গেল। ঢাকা থেকে মাওয়া নতুন রাস্তা। নতুন গাড়ি রানিং- এ তুলতে ঐ দিকটা বেছে নেয়া হল। আমরা ঢাকা শহরে আর ঢুকলাম না। কাঞ্চন ব্রিজ হয়ে নারায়ণগঞ্জ রুট ধরে একেবারে বুড়িগঙ্গা ব্রিজ টু মাওয়ার পথে চললাম। বললাম ওদের সাথে কি কোন ডিল ছিল?
কাদের সাথে?
বললাম, তিনশো ফিটের তিনজনের কথা বলছি।
ওহ্।
সাফু একটু সময় নিল। পরক্ষণে বললো ও তুই বুঝবি না। ব্যাবসা চালাতে নানা রকম লবিস্ট লাগে একদম রাস্তার মান্তান থেকে আইনজীবী পর্যন্ত। আরো কিছু লাগে, যেমন ব্যাংক লোনের জন্য ব্যাংক পরিচালক, রাজনৈতিক প্রভাবের জন্য বড় দলের নেতা, কাস্টমস সামলাতে আমলা, আর শ্রমিক বিক্ষোভ ঠেকাতে পাতি মাস্তান। ব্যাবসা করা যত সহজ মনে হয়, তত সহজ নয়! এগুলো মেন্টেইন করা যত সুচারু হবে ব্যাবসা তত গতি পাবে। প্রেস-মিডিয়া-বিজ্ঞপন করে করে তোকে কিছু লবিস্ট তৈরি করতে হবে। এটা একটা জালের মতো। কোন একটা গিয়ার আটকে গেলে তেল মবিল নিয়ে মানে টাকা নিয়ে হাজির থাকতে হবে। শুধু টাকা হলেই হবে না, কোন দেবতা কোন ফুলে তুষ্ট তা খেয়াল রাখতে হবে। এগুলো এইচ আর ডিপার্টমেন্টকে নির্দেশ দেয়া থাকে। যেমন আজ এইচ আর থেকে বললো তিনজন আমার সাথে দেখা করতে চায়। অফিসে এদের স্পেস দিতে নেই, তাই এখানে আসতে বলা হয়েছিল। ওদের সাথে কি ডিল হল- তাতো বলা যাবে না। ভেরি কনফিডেনসিয়াল, জমি দখল, নাকি শ্রমিক নেতা পেটাবো- সেটা তো তোমাকে বলা যাবে না বন্ধু। নাও একটা হেনিক্যান বিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো রিলাক্স!
আমরা দু’জনেই এক সাথে চুমুক দিলাম। রিলাক্স কথাটা বলায়, বন্ধু রিলাক্স বলতে কি বোঝে জানতে ইচ্ছে হল।
বললাম, তুই কি কখনো মাছ ধরতে গিয়েছিস। ছিপ ফেলে অপেক্ষা অপেক্ষা অপেক্ষা হঠাৎ একটা রুই-মৃগেল বা কাতল ধরা পরেছে সুতো টানছিস ছাড়ছিস এক সময় দেখতে পেলি মাছটা ভেসে উঠেছে। ক্লান্ত শরীর ছেড়ে দিল- এবার রিলাক্স।
কথা শোনার সাথে সাথে হো হো করে হেসে উঠলো সাফু। আমি-আমরা সব সময়ই তো ছিপ ফেলছি। জনগণ হল মাছ। টোপ দিচ্ছি গিলে নিচ্ছে টোপ দিচ্ছি গিলে নিচ্ছে।
কী সব আবোল তাবোল বলিস! আমি একটু বিরক্ত হলাম।
সাফু বিয়ারের আরেকটি ক্যান ওপেন করতে করতে বললো। জনগণ হল আমাদের কাছে মাছ। প্রডাক্ট কিনলেই না দু-পয়সা হাতে পাই। তাই সারাক্ষণ জনগণের রুচি কীভাবে ধরা যায় এনিয়েই তো গবেষণা। কাজ না হলে সিন্ডিকেট করে বাধ্য করা হয়। মনে কর বড়শিতে গাঁথতে হবেই। যদি না গাঁথে, তাহলে কারেন্ট জাল। হা হা হা করে সাফু হাসলো আরেকবার।
সে আবার কেমন? জনে জনে এতো লোকের রুচি বোঝা কী সহজ!
হুম সহজ। মনে কর, সেন্টের গায়ে লিখে দিল হালাল সেন্ট, সাবানের গায়ে লিখে দিল হালাল সাবান, ব্যাংকের গায়ে লিখে দিল হালাল লাভ। বুঝতে পারছিস মাছ কোন আাদার খায় এটা নিয়ে আমাদের গবেষণা চালাতে হয়। সেদিন দেখলাম একটা টেইলার্সের সাইন বোর্ডে লেখা সুন্নতী টেইলার্স।
আমরা মাওয়া ঘাটে পৌঁছলাম। দূরে ব্রিজের আশেপাশে ক্রেনগুলোতে আলো জ্বলছে। টিমটিমে আলো নিয়ে নৌকাগুলো জাল পেতেছে। আলোগুলো ঢেউয়ের সাথে সাথে দুলছে। ঘাটে ইলিশ পাঙ্গাশসহ একজন বিক্রেতা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলো। সাফু এক হালি ইলিশ কিনে ড্রাইভারকে ব্যাক ডালায় রাখতে বললো। কিছু সময় কাটিয়ে আমরা আবার ফিরতে শুরু করলাম। সাফু বললো পদ্মা ব্রিজও কিন্তু একটা প্রডাক্ট যদি জনগণ…সারা দেয়। জনগণের অর্থে তৈরি রাজনীতির নানা প্রডাক্ট নিয়ে বাকীটা সময় আলাপ করতে করতে যখন ঢাকা পৌঁছালাম, আমাকে বাড়িতে নামিয়ে দিতে চাইলো সাফু। আমি নেমে আসতে চাইলে সাফু বললো মাছগুলো তুই বাসায় নিয়ে যা। আমি রাজি হচ্ছিলাম না। ও বললো আমার বাসায় তো কেউ নেই সবাই দেশের বাইরে। একরকম জোর করেই মাছগুলো দিয়ে দিল।
সাফুর সাথে যতবার ঘুরেছি ও ওর পরিবার নিয়ে কখনও আলাপ করেনি। আজ ইলিশ নিয়ে পরিবার প্রসংঙ্গ আসতেই কেমন ওর মাথাটা নুয়ে গেল। ইলিশ রান্না হবে মৌ মৌ ঘ্রাণ বেরোবে। এক টেবিলে বসবে সবাই, স্বাদ-গন্ধ নিয়ে আলোচনা হবে। ইলিশ ঘরে আসলেই মধ্যবিত্ত পরিবারের খাবারের কক্ষে আড্ডা হবে জম্পেস।
বাসায় ফিরতে ফিরতে মনে হল উঁচু আর নিচু তলায় এগুলো নেই। স্বাদ-গন্ধের বালাই নেই!