সাহিত্য: দুটি দীর্ঘ গদ্য কবিতা । অমিতরূপ চক্রবর্তী

Reading Time: 3 minutes

আঠা

আমি লক্ষ্য করলাম তোমার হাঁটু অবধি দৃশ্যমান পা-টি জলে ডোবানো বৈঠার মতো। কী বিষণ্ণ মুখের একটা দিন লেজের প্রান্তে ঝুমঝুমি বাজিয়ে বাজিয়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল কোথাও। আমরা যেন ভেজা ভেজা মাকড়সার জালের এপারে ওপারে কতদিন, কত যুগ থেকে এমনই টেবিলে প্লেটে তুচ্ছতা, স্বাদ মরে যাওয়া তুচ্ছতা নিয়ে মুখোমুখি বসে আছি। গলার নীচে জনশূন্য মৌচাকের মতো হৃদয়। তার বহু অলিগলি। বহু কক্ষ। গুড় রঙের চওড়া রাস্তাঘাট। অথচ কোথাও কোনো শব্দ নেই। যেন যুদ্ধের পর ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত কোনো মৃত নগরী। যেখানে যতো খুশি চলে যাওয়া যায়, কোনো বাধা নেই। সব রাস্তা কোথাও না কোথাও গিয়ে পরস্পরকে অধিকার করে- এমন। আমি নিজের আঙুলকে মঞ্চের মতো ব্যবহার করে একটি কাল্পনিক মোমবাতির দিকে তাকিয়েছিলাম। কখনো তার আড়ালকে ফাঁকি দিয়ে তোমাকে, তোমার সূচাগ্রসহ তোমাকে দেখছিলাম। তুমি কাছিমের মতো একটি সোফায় কেমন ভঙ্গিতে যেন ঠেস দিয়ে বসেছিলে। পোশাক সরে গিয়ে তোমার উগ্র হলুদ পা ছাই ছাই মেঝেটাকে আলতো স্পর্শ করে ছিল। যেন তোমার দূত তোমার হলুদ উগ্র পা-টি। তোমার যা বলার, সব যেন তোমার পা দেখেই জেনে, বুঝে নিতে হবে। যেন জলের নীচে ঘটে যাওয়া মৎস্য শিকারের মতো। ওপরে সব স্থির, অকম্পিত বা ভীষণ সামাজিক। যা কিছু তোলপাড়, রক্তারক্তি- সব, সব শুধু জলের নীচে, ফিকে সবুজ গভীরে। প্রাচীন পাথর শ্যাওলা বা মসের নেশাতুর দৃষ্টির মধ্যে, তরল নৈঃশব্দ্যের মধ্যে

কতদিন, কত যুগ যেন আমরা ঠিক এভাবেই বসে আছি। দিগন্তে কত সূর্য, কত অবসন্ন চাঁদ, কত ফুলকি দিয়ে ওঠা বিপ্লব বা বিজয়ী জাহাজ ডুবে গেল। আমরা যেন আঠা ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াতেই পারলাম না আর। সেই যে টেবিলে প্লেটে গোল করে সাজান তুচ্ছতা নিয়ে মুখোমুখি এসে কখনো বসেছিলাম- তেমনই থেকে গেলাম। সেই আঙুলের মঞ্চে আমার মুখ। সেই তোমার দিবসশেষের মতো ঢল নামা প্রসাধনব্যতীত ঔৎসুক্য। সেই তোমার জলে ডোবানো বৈঠার মতো একটি পা আর চতুর্দিকে ঝুলে থাকা ভেজা ভেজা মাকড়সার জাল। তোমার স্বাস্থ্যের বিষয়ে আমার কিছু জিজ্ঞাসা ছিল। তোমার পোষ্য দিনগুলির আচরণ নিয়ে আমার কিছু জিজ্ঞাসা ছিল। তোমার সন্তান বা টবে বসান ফুলগাছগুলির বংশ-গোত্র সম্বন্ধে আমার কিছু জিজ্ঞাসা ছিল। জিজ্ঞাসা ছিল তোমার বসার ঘর, কাচের ওপারে সাজান কাঁসা-পেতলের নিশ্চুপ যেসব গ্লাস-বাটি-থালা, ওদের বিষয়ে। এই কি তোমার জগৎ? এমনই স্পষ্ট কোনো প্রয়োজন ছাড়াই ঝলমলে? নাকি তোমার প্রকৃত জগৎ অন্য কোনো ঘরে, অন্য কোনো কাচের ওপারে ভগ্ন ঊরু নিয়ে চিৎকার করছে? ঝাউপাতার মতো মুখ করে আকাশ কেন যে অবাস্তব, অকারণ এখন! বৃষ্টি হবে? বৃষ্টি হলে নিষ্প্রান বস্তুরা বুঝি জীবন্ত হয়ে ওঠে। সম্বিৎ ফেরে তাদের। কেউ দ্রুত তার স্তনের দেউড়ি বন্ধ করে দেয়। কেউ ঝলসে ওঠা লিঙ্গ গুটিয়ে জামার তলানিতে রাখে। তেমনই? তেমনই? কেউ ছায়া টেনে চলে যায়, কেউ বা দানাদার ছায়া ফেলে আবির্ভূত হয়। তাতে কারো বুঝি-বা ভুবন কেঁপে ওঠে

আঠায় দুটো প্রাণি আটকা পড়েছে দেখে হয়তো চকচক করে মধুক্ষরা নরখাদকের চোখ

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla-kobita-kobi-maruf-ahmad

আত্মা

এই মুহূর্তে আমাদের কোনো কথা আর নেই। একটি ধূসর মেঘগঙ্গা আমাদের ছুঁয়ে, চারপাশে কয়েকবার পাক খেয়ে কোথাও চলে গেছে। গলে যাওয়া সাদা সাবানের মতো আজ আমাদের আত্মা। আমরা যে যার জগৎ আলাদা করে পাথরে বা অনুচ্চ কোনো টিলায় বসে আছি। নধর ঘোড়ার মতো একটি সন্ধ্যা হেঁটে হেঁটে পৃথিবী পার হয়ে যাচ্ছে। সেটার হাঁটার গতি দেখে মনে হয় বিশেষ কোনো তাড়া নেই ওর। কোনো একসময় গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছলেই হল। ছেঁড়া উলের একটি চাদর আকাশে টাঙান। তার ছিদ্র দিয়ে দেখা যায় নক্ষত্রগুলি সব আলেয়ার মতো জ্বলছে। আমাদের কি এমন সময় নিজের জন্য করুণাবোধ হয়? তৈলচিত্রের মতো চলমান ঘোড়াটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে? আমাদের কথা আমরা বেহিসাবি ভাবে বলে ফেলেছি। এখন মস্তিষ্ক ফাঁকা। জিভ বেয়াড়া টিনের মতো শুকনো, খটখটে বা হয়তো বিপজ্জনক। পাথরে বা টিলার ওপরে বসে আমরা সমুখে ছড়ান গায়ে অর্বুদ আসা জীবনের কথা ভাবতে চেষ্টা করি। যে কোলাহল আমাদের কানে আসছে না, সেই সম্ভাব্য কোলাহলের উৎস বুঝতে চেষ্টা করি। দূরের অন্ধকরের দিকে সাঁই সাঁই করে চাঁদ উড়ে যায়। বোঝা যায় তার ভয়াবহ কোনো তাগিদ হয়তো আছে। এক ফোঁটা ঘন করুণাবোধ আমাদের কোথাও, হয়তো প্রকাণ্ড অভ্যন্তরে টুপ করে ঝরে পড়ে। তার প্রতিধ্বনি কুয়োয় নিষ্ঠুর বালতি ছুড়ে দেবার মতো

সন্ধ্যার নধর পিঠ কোনো অদৃশ্য আলোয় চকচক করে। নশ্বর ঘোড়ার মতোই তার মেরুদণ্ডের দু’পাশে মাংসের ঢাল, পেশীর নড়াচড়া। ঘোড়াটি পৃথিবীকে পেরিয়ে যাচ্ছে কেমন আচ্ছন্ন পায়ে। এ সময় লবণাক্ত সমুদ্রের মতো এক কাপ চায়ের জন্য আমার মন ছটফট করে ওঠে। তুমি হাতে করে এগিয়ে না দিলে সেই চা রক্তহীন, প্রাণহীন। যেমন রক্তহীন তোমার অবর্তমানে বিছানায় জানালা চুঁইয়ে আসা ফিটকিরি রঙের জ্যোৎস্না। তুলোর অতলান্ত নরম বা দ্রাব্যতা। যেমন প্রাণহীন বালিশের অগাধ যৌবন। বেহিসাবির মতো সব কথা খরচ করে ফেলে আমরা এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে দীনদরিদ্র দুটি ফুল। সবচেয়ে নিঃসঙ্গ দুটি বহুতল বা সবচেয়ে ভূতুড়ে দুটো হলুদ পথবাতি। আমার মতো তোমারও কি এসব মনে হয়? নাকি সমুখে ছড়ান গায়ে অর্বুদ আসা জীবনের দিকে অপলকভাবে শুধু তাকিয়েই থাক? ঘোড়াটি তো তোমারও সামনে দিয়ে চলে যায়। ওর গায়ের গন্ধে সম্বিৎ ফেরে না তোমার? মনে পড়ে না, এখুনি টিভির ভেতরে সুন্দর সুন্দর সব অভিনেত্রীরা এসে অলীক ডানায় উড়তে উড়তে বাজপাখির মতো নখরে নখরে যুদ্ধ শুরু করে দেবে? শুনশান রাস্তায় পড়ে থাকবে অসংখ্য ভাতের থালা। বাথরুমের পেছনে কোনো মানচিত্রের মতো জোনাকি উড়বে। একটি টিকটিকি তার শরীরের দৈর্ঘ্যের চেয়েও আরো বড় লিঙ্গ বহন করে ছুটে যাবে দেওয়ালে আটকে থাকা আরো একটি টিকটিকির দিকে

ঘোড়াটি তখনই যদি একবার বা কয়েকবার আর্তনাদের মতো ডেকে ওঠে?

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>