| 27 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

পঁচিশে বৈশাখ স্মরণ: রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা । হায়াৎ মামুদ

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

জীবন ও অনুভব-কর্ষিত যত ফসল রবীন্দ্রনাথ ফলিয়েছিলেন পরিমাণ ও প্রাখর্যে তা বিস্ময়কর, তার অশীতিবর্ষী সুদীর্ঘ জীবনসীমা সত্ত্বেও পৃথিবীতে তুলনারহিত। তিনি মুখ্যত শিল্পী ছিলেন- এই অসংশয়িত সত্যের বাইরেও আরেক রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে থাকেন, যিনি রসস্রষ্টা নন বলে শিল্প-ভোক্তার অনুকম্পায়ীও নন। গগনবিহারী, শিল্পচৈতন্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভূকে এড়িয়ে, আমরা ইচ্ছা করলে, শুধুমাত্র এক ধীমান, প্রখর বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন, পরম সামাজিক ও কর্মিষ্ঠ বাঙালির মুখোমুখিও আমরা দাঁড়াতে পারি। তাঁরও নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভাবতে প্রলুব্ধ হই, বাণী ও বর্ণের শিল্পী যদি তিনি না হতেন তাহলে চেনা-রবীন্দ্রনাথের যেটুকু অবশিষ্ট থাকবেন তাও কি ‘অন্য-এক’ অথচ ‘সম্পূর্ণ’ রবীন্দ্রনাথ নন? কবি বা শিল্পী বা সুরকার হয়তো নন, তবু রাজনীতিক, সংগঠক, প্রজ্ঞাবান দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী রূপেও অ-খণ্ডিত ও পূর্ণ এক সামাজিক ব্যক্তি- সেও কি কম আকর্ষণীয়? এমন ব্যক্তি তো থাকতেই পারেন, সব সমাজের মতো আমাদের সমাজেও, যিনি শিল্পসংবেদী নন;- তাঁর কাছেও তা হলে থেকে যান আরেক জন, অ-কবি, হৃতশিল্প, কিন্তু সমাজলিপ্ত জাগতিক, রবীন্দ্রনাথ।

আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই যে, শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর ধারণাগত (conceptual) সংশ্লেষণকে স্ব-কল্পনায় চাক্ষুষ করা ও তা বাস্তবায়নের জন্যই তিনি বঙ্গসংস্কৃতির ইতিহাসে প্রাতঃস্মরণীয় পুরুষরূপে গণ্য হতেন; এবং এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি পর্যায়ে তার সামাজিক-রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও প্রত্যক্ষ কর্মসাধনার জন্য তিনি ভবিষ্যপ্রজন্মের নিকট অবশ্যপঠনীয় বলে সুদীর্ঘকাল বিবেচিত হতেন। রবীন্দ্রপ্রতিভার প্রধান অসুবিধে তার বিশালত্ব, বহুমাত্রিকতা ও শাবল্য; একসঙ্গে সবটুকু রবীন্দ্রনাথকে আলিঙ্গন আমাদের সাধ্যের বাইরে থেকেই যায়। রবীন্দ্রজীবনের পাঠকমাত্রেই জানেন যে, তার চরিত্রে শৈথিল্য ও অন্যমনস্কতা স্বভাবপরিপন্থী ছিল। সারা জীবনে দায়িত্ব-এড়ানোর নজির তিনি কোথাও রাখেননি। প্রথম বিলেত গিয়েছিলেন সতেরো বছর বয়সে :জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির মুখচোরা ছেলেটি লজ্জা কাটিয়ে মেমসাহেবদের সঙ্গে নেচেছে, খোশগল্প করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে হেনরি মর্লির ক্লাস করতে গেছে, পাশ্চাত্য সঙ্গীতে তালিম নিয়েছে- বয়োধর্মে এই সবই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত। অতিরিক্ত দুটি ঘটনায় আমাদের মন আটকে যায়, যেহেতু বয়োধর্মের ব্যাকরণে তা মেলে না। সে সময়ে লিপিবদ্ধ কড়চাতে দেখি ঐ তরুণ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ ইংরেজ সমাজের যেমন তীব্র সমালোচক, তৎসঙ্গে প্রবাসী ইঙ্গবঙ্গ সমাজেরও; তেমনি পার্লামেন্টে গিয়ে গ্গ্ন্যাডস্টোনের বক্তৃতা শুনতেও ভোলে না, নিজের পক্ষপাতিত্ব জানায় বঞ্চিত আইরিশদের প্রতি। ইত্যাকার ঘটনাবলি এই অর্থে প্রতীকী যে, এই তরুণ পরবর্তী জীবনেও যে সর্বতোভাবে নির্মোহ ও সময়স্পর্শিত হয়েই কাটাবেন, তার ইঙ্গিত এখানে মিলছে। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ তার জীবদ্দশায় দেশে কি বিদেশে সংঘটিত যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় সর্বদা সাড়া দিয়েছেন। স্বদেশের ভাবনাজগতে ও বিভিন্ন রাষ্ট্রিক-সামাজিক কর্মপ্রবর্তনায় তাঁর অংশগ্রহণ সর্বদাই স্বতঃস্ফূর্ত থেকেছে।

যেখানে তিনি শিল্পী নন, শুধুই সমাজকর্মী ও দেশচিন্তক এবং মননে ও অনুভবে বিশ্বনাগরিক, সেই স্বল্পচেনা রবীন্দ্রনাথের নিকটেও বাঙালির বৈদগ্ধ্যঋণ অপরিশোধ্য। কিন্তু সেই প্রসঙ্গটি দৈশিক শিল্পজগতের নয়; তার ক্ষেত্রে সভ্যতাবিবর্তনের আলোকে দেশ ও লোক-সাক্ষিক সমাজভাবনা, রাষ্ট্রচিন্তা। এবং সেখানেও যিনি সম্রাট, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে জনৈক দেশপ্রেমী ও বিশ্বমানবিক বাঙালি ভাবুক।

‘বাল্যকাল থেকে আজ পর্যন্ত দেশের নানা অবস্থা এবং আমার নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দীর্ঘকাল আমি চিন্তা করেছি এবং কাজও করেছি। […] যে মানুষ সুদীর্ঘকাল থেকে চিন্তা করতে করতে লিখেছে, তার রচনার ধারাকে ঐতিহাসিকভাবে দেখাই সঙ্গত। […] রাষ্ট্রনীতির মতো বিষয়ে কোনো বাঁধা মত একেবারে সুসম্পূর্ণভাবে কোনো-এক বিশেষ সময়ে আমার মন থেকে উৎপন্ন হয়নি- জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে নানা পরিবর্তনের মধ্যে তারা গড়ে উঠেছে।’

-‘রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক মত’, ‘কালান্তর’

বার্ধক্যের স্মৃতিচারণে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন :’কবে যে গান গাহিতে পারিতাম না তাহা মনে পড়ে না।’ একটু ঘুরিয়ে এ-কথাটিই তিনি তার স্বদেশানুভূতি বিষয়ে বলতে পারতেন- ‘কবে যে দেশকে জানিতাম না তাহা মনে পড়ে না’, কারণ বুদ্ধি ও জ্ঞান-বাহিত উপলব্ধির বহু পূর্বেই তিনি আনন্দানুভূতির সূত্রে দেশকে বোধের মধ্যে অনুভব করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার শৈশব-বাল্য-কৈশোরের সবটুকুই কেটেছিল স্বদেশপ্রেমে মাতাল পারিবারিক আবহাওয়ায়। ‘জাতীয় মেলা’ বা ‘হিন্দু মেলা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঠাকুরবাড়িরই আনুকূল্যে ১৮৬৬ সালে, রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন পাঁচ এবং আট বৎসর পরে তেরো-পেরুনো সদ্য-কিশোর তিনি পাঠ করেছিলেন তাঁর প্রথম মুদ্রিত কবিতা :’হিন্দুমেলার উপহার’। অনেক পরে, তেষট্টি বৎসর বয়সে, বৃদ্ধ কবি তাঁর এক আত্মজৈবনিক ইংরেজি রচনায় ঐ বিশেষ শৈশবপরিবেশ ব্যাখ্যা করেছিলেন : There was yet another movement started about this time in my country which was called National. It was not fully political, but it began to give voice to the mind of our people trying to assert their own personality.

দেশহিতৈষণার এই ভাবতরঙ্গ উদীয়মান তরুণ কবিকে উদ্দীপিত করেছিল অবশ্যই, কিন্তু বাৎসরিক ঐ মেলা যথোচিতকালে স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করলে তিনি দুঃখিত হননি, কারণ বিশ/বাইশ বছর বয়সে পেঁৗছুতে-পেঁৗছুতে তিনি জেনেছিলেন যে, ‘জাতীয় মেলা’ যত আদর্শিকই হোক না কেন বৃহত্তর জনগণের সঙ্গে তার কোনো নাড়ির বন্ধন নেই। তাঁর বয়স যখন প্রায় তিরিশ, তখন তেকে আমরা তাঁকে দেখি এ দেশের ব্রিটিশ রাজত্বের বিভিন্ন ত্রুটি, হৃদয়হীনতা ও অমানবিকতা সম্পর্কে তীব্রভাবে সমালোচনা-মুখর। আমাদের মনে না পড়েই পারে না যে, এ সেই সময় যখন তিনি পারিবারিক দায়িত্ব পালনে জমিদারি তদারকিতে গ্রামবাংলা ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সমাজকর্মী ও রাজনীতিক হিসেবে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন অনতিদূরে অপেক্ষমাণ। রাজনীতির উপরে তাঁর আস্থা এ সময়েই হ্রাস পেতে থাকে। ১৯১৬ সালে মার্কিন দেশে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন :Our real problem in india is not political. It is social. This is a condition not only prevailing in India but among all nations. I do not believe in an exclusive political interest.

তাঁর এই অবস্থান প্রত্যক্ষ অনভিপ্রেত অভিজ্ঞতার ফসল :দেশের হিতের সঙ্গে দেশনেতাদের রাষ্ট্রভাবনা ও রাজনীতিবিজ্ঞানের যে কোনো সম্পর্ক নেই, তা তিনি অনেক ঠেকে শিখেছিলেন। তাঁর ‘স্বদেশী সমাজ’ (১৩১১) প্রবন্ধ এবং পাবনা প্রাদেশিক সম্মিলনীতে (১৩১৪) তাঁর সভাপতির ভাষণ পাঠ করলেই তাঁর তীক্ষষ্ট পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণক্ষমতা এবং মোহমুক্তির ছবি স্পষ্ট হবে। ‘বিদেশী রাজা চলিয়া গেলেই দেশ যে আমাদের স্বদেশ হইয়া উঠিবে তাহা নহে।… একবার সত্য করিয়া ভাবিয়া দেখো, দেশ আমাদের হইতে কত দূরে, কত সুদূরে’- এই ছিল তাঁর সত্যকার উপলব্ধি (দ্র. ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’)। অতঃপর ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন স্বনিষ্ঠ থাকবার জন্যই। আর সেই একই কারণে দেশের হিতসাধন বলতে তিনি যা বোঝেন তারই বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে হাতে-কলমে লেগে রইলেন শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের পিছনে। এই ব্রতসাধন চলেছিল আমৃত্যু।

রাষ্ট্রনেতা বা রাজনীতিজ্ঞ রূপে বরেণ্য হবার কোনো স্বপ্ন সুপ্ত ছিল, এমন কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর্মপ্রচেষ্টার প্রমাণ রবীন্দ্রজীবনে দেখি না। অথচ পরবর্তীকালেও বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলন বা রাষ্ট্রিক প্রশ্নে তিনি নানাভাবে অংশ নিয়েছেন :সন্ত্রাসবাদে অনাস্থা বা অসহযোগ আন্দোলনে তাঁর নেতিবাচক ভূমিকা সমালোচনাবিদ্ধ; তেমনি জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ বর্বরতার প্রতিবাদে খেতাব বর্জনের মাধ্যমে পরাধীন দেশবাসীর আত্মমর্যাদা রক্ষাও স্মরণীয়। অর্থাৎ তিনি প্রচণ্ড রূপে রাজনীতি-সচেতন, তবুও দেশের রাজনৈতিক গতিধারার সুফল বা শুভত্বে আস্থা জ্ঞাপন করেননি। কারণ তিনি নিশ্চিন্তভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে, বিদেশি শাসকের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রনীতি এবং দেশপ্রেমী রাষ্ট্রনেতাদের ইউরোপদীক্ষিত রাষ্ট্রনীতিজ্ঞান- উভয়ের মধ্যে স্বদেশের ধ্বংসবীজ লুকোনো আছে। উপরন্তু তিনি মনে করতেন :ইউরোপ ও এশিয়ায় সভ্যতা বিকাশের ধারার গতিপ্রকৃতি ভিন্ন হওয়ায় এ দুই মহাদেশের প্রবাহিত সমাজজীবনে ও মননধর্মে যে-পার্থক্য ঐতিহ্যপরম্পরায় ও ইতিহাসগতভাবে মৌলিক, সেখানে ইউরোপীয় অভিজ্ঞতার মডেল ব্যর্থ, অপচয়িত ও বিধ্বংসী হতে বাধ্য।

Nationalism in India নামে প্রদত্ত ভাষণে (১৯১৬) এই মৌলিক অসঙ্গতিটি তিনি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছিলেন।

পার্থক্য যেখানে মৌলিক সেখানে যে কোনো সমস্যারই সমাধান ভিন্ন ভিন্ন হতে বাধ্য। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমী রাষ্ট্রনৈতিক মতাদর্শ বা political institution সম্পর্কে তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছে :

‘চিরদিন ভারতবর্ষে এবং চীনদেশে সমাজতন্ত্রই প্রবল, রাষ্ট্রতন্ত্র তার নিচে। দেশ যথার্থভাবে আত্মরক্ষা করে এসেছে সমাজের সম্মিলিত শক্তিতে। সমাজই বিদ্যার ব্যবস্থা করেছে, তৃষিতকে জল দিয়েছে, ক্ষুধিতকে অন্ন, পূজার্থীকে মন্দির, অপরাধীকে দণ্ড, শ্রদ্ধেয়কে শ্রদ্ধা- গ্রামে গ্রামে দেশের চরিত্রকে রক্ষিত এবং তার শ্রীকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। দেশের ওপর দিয়ে রাজ্য-সাম্রাজ্যের পরিবর্তন হয়ে গেল, স্বদেশী রাজার রাজায় নিয়তই রাজত্ব নিয়ে হাত-ফেরাফেরি চলল, বিদেশী রাজারা এসে সিংহাসন-কাড়াকাড়ি করতে লাগল, লুটপাট অত্যাচারও কম হলো না, কিন্তু তবু দেশের আত্মরক্ষা হয়েছে- যেহেতু সে আপন কাজ আপনি করেছে- তার অন্নবস্ত্র ধর্মকর্ম সমস্তই তার আপনারই হাতে। এমনি করে দেশ ছিল দেশের লোকের; রাজা ছিল তার এক অংশে মাত্র, মাথার উপর যেমন মুকুট থাকে তেমনি। রাষ্ট্রপ্রধান দেশে রাষ্ট্রতন্ত্রের মধ্যে বিশেষভাবে বন্ধ থাকে দেশের মর্মস্থান; সমাজপ্রধান দেশে দেশের প্রাণ সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে থাকে। রাষ্ট্রপ্রধান দেশের রাষ্ট্রতন্ত্রের পতনে দেশের অধঃপতন, তাতেই সে মারা যায়। গ্রীস রোম এমনি করেই মারা গিয়েছে। কিন্তু চীন ভারত রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের ভিতর দিয়েই সুদীর্ঘকাল আত্মরক্ষা করেছে, তার কারণ সর্বব্যাপী সমাজে তার আত্মা প্রসারিত।

পাশ্চাত্ত্য রাজার শাসনে এইখানে ভারতবর্ষ আঘাত পেয়েছে। গ্রামে গ্রামে তার যে সামাজিক স্বরাজ পরিব্যাপ্ত ছিল, রাজশাসন তাকে অধিকার করলে।’

এই ধারণাটি যে বহু দিন ধরে ক্রমশ তার মনে দানা বেঁধে উঠছিল, তার প্রমাণ পাঁচ বৎসর পূর্বে, ১৯২৪ সালে, জাপানে প্রদত্ত International Relations নামে এক ভাষণ :

“Often have my Western friends almost sneeringly said to me that we in the East have no faith in Democracy, and thereupon they have asserted the superiority of their own mind over ours. […] We, who do not profess democracy, acknowledge our human obligations and have faith in our code of honour.”

-অর্থাৎ পশ্চিমী ডেমোক্রেসি এমন কিছু সর্বজ্বরহর বটিকা নয়, বরং তার বিকল্পে আমাদের যা আছে তা আরও বৃহৎ :’Human obligations এবং Faith in our code of honour’ সংক্ষেপে মানবতা ও আত্মমর্যাদা। এই মনোভাবটিকেই অধিকতর সংহত করে প্রকাশ করেছিলেন তিনি চীন দেশে; বলেছিলেন যে ‘ধর্ম’ ও ‘সভ্যতা’ তাঁর নিকট সমার্থক এবং সভ্যতার লক্ষ্য মূল্যবোধের সত্য মান প্রতিষ্ঠা :

“The Sanskrit word Dharma is the nearest synonym in our language that occurs to me for the word civilization.”

“It is the mission of civilization to set for us the right standard of valuation.”

মনে পড়ে যায় সুদূর ১৯০২ সালে রচিত ‘রাষ্ট্রনীতি ও ধর্মনীতি’ প্রবন্ধের তীব্র ধিক্কার :

‘এ কথা ঠিক বটে, পাশ্চাত্য সভ্যতার আধুনিক ধর্মশাস্ত্রের পলিটিক্স্ সর্বোচ্চ, ধর্ম তাহার নিচে। যেখানে পোলিটিকাল প্রয়োজন আসন ছাড়িয়া দিবে সেইখানেই ধর্ম বসিবার স্থান পাইবে। […]

[…] আমরা প্রতিদিন নানা দৃষ্টান্তের দ্বারা শিখিতেছি যে, পোলিটিকাল প্রয়োজনের যে বিধান তাহা ন্যায়ের বিধান সত্যের বিধানের সঙ্গে ঠিক মেলে না।

ইহাতে আমাদের শিক্ষাদাতাদের ইষ্ট ও অনিষ্ট কী হইতেছে তাহা লইয়া দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইবার প্রয়োজন দেখি না। ভয়ের কারণ এই যে, আমাদের মন হইতে ধ্রুবধর্মে বিশ্বাস শিথিল, সত্যের আদর্শ বিকৃত হইয়া যাইতেছে। আমরাও প্রয়োজনকে সকলের উচ্চে স্থান দিতে উদ্যত হইয়াছি। আমরাও বুঝিতেছি, পোলিটিকাল উদ্দেশ্যসাধনে ধর্মবুদ্ধিতে দ্বিধা অনুভব করা অনাবশ্যক। অপমানের দ্বারা যে শিক্ষা অস্থিমজ্জার মধ্যে প্রবেশ করে সে শিক্ষার হাত হইতে নিজেকে রক্ষা করিব কী করিয়া? ধর্মকে যদি অকর্মণ্য বলিয়া ঠেলিয়া রাখিতে আরম্ভ করি তবে কিসের উপর নির্ভর করিব? বিলাতি সভ্যতার আদর্শের উপর? বিশ্বজগতের মধ্যে এই সভ্যতাটাই কি সর্বাপেক্ষা স্থায়ী? দুর্ভাগ্যক্রমে, যে জিনিসটা প্রত্যক্ষভাবে আমাদের বুকের উপরে চাপিয়া বসে সেটা আমাদের পক্ষে পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী- আমাদের পক্ষে হিমালয় পর্বতও তাহার চেয়ে লঘু। সেই হিসাবে বিলাতি সভ্যতার নীতিই আমাদের পক্ষে সব-চেয়ে গৌরবান্বিত- তাহার কাছে ধর্মনীতি লাগে না।’

অগত্যা ধর্ম, সভ্যতাচৈতন্য ও দেশহিতৈষণা মিশ্রিত ও সংশ্লেষিত হয়ে রবীন্দ্র-মানসে রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে এক আদর্শিক প্রত্যয় নির্মাণ করেছিল। সেই বিশ্বাসেরই ফসল তার জাতীয়তাবৈরিতা এবং বিশ্বমানবত্ব ও আন্তর্জাতিকতাবাদ।

“They thought that I did not know the meaning of the word, and accused me of having confused the word Nation with State.”

ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের ওপর কবি-শিল্পী রবীন্দ্রনাথের সর্বগ্রাসী প্রভাবের প্রধান কারণ, সমাজবেষ্টিত এই মানুষটির দ্বিখণ্ডিত সত্তা একই শিকড় থেকে উদ্গত হয়েছিল। তার নাম ঔপনিষদিক বিশ্ববীক্ষা :প্রাণীর চৈতন্যলোকে তো বটেই, পুঞ্জীভূত জড়ে কিংবা জড় ও চেতনের সংলাপে অদৃশ্য মহাজাগতিক সম্বন্ধসূত্র আবিষ্কার- যা বলে যে, ‘মধুময় পৃথিবীর ধূলি’ এবং বিশ্বচরাচর অমৃতপথযাত্রী। ফলে চূড়ান্ত শুভত্বে (ultimate good) বিশ্বাস না-করা সম্ভবই ছিল না রবীন্দ্রনাথের পক্ষে। এবং সঙ্গতভাবেই তিনি ‘একক’ ধরেছিলেন ব্যক্তিকে, ভরসা রেখেছিলেন ‘ব্যক্তি’র হৃদয় ও বিবেকবুদ্ধিতে। ব্যক্তি থেকে সমাজ থেকে রাষ্ট্র থেকে মনুষ্যসভ্যতা- ক্রমবিস্ফার বৃত্তান্তরে বর্ধিত হতে হতে চূড়ান্ত কল্যাণে একদিন মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে শান্তির স্বর্গ নেমে আসবে, মহাবিশ্বের ঘূর্ণাবর্তে এই ক্ষুদ্র পৃথিবী গ্রহের অস্তিত্ব অর্থবহ, সার্থক ও গীতিময় হয়ে উঠবে।

এই যেখানে তাঁর বিশ্বাসের জগৎ, রবীন্দ্রনাথ সেখানে বারেবারেই ব্যাহত হচ্ছিলেন বিদেশী শাসকবাহিত পশ্চিমী সভ্যতা-সংস্কৃতির অন্যতর মূল্যবোধ ও ভাবপ্রবাহের মারে। শাসক হিসেবে ইংরেজের নিকটে তাঁর প্রত্যাশা ক্ষীয়মাণ হতে-হতে শূন্যে এসে ঠেকেছিল; হয়তো-বা সে কারণেই দেশবাসীর কাছে তাঁর আশা ছিল বড়ো বেশি। কিন্তু দেশের লোকও তো সময় নিরালম্ব নয়, শাসন ও শোষণের নিরন্তর অভিঘাত এবং রাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতির ডায়ালেক্টিক্স সে এড়াবে কী করে? হৃতবল দেশবাসীর দারিদ্র্য, ভীরুতা, স্বার্থান্ধতা এবং লক্ষ্যহীনতা ও পঙ্গুত্ব থেকে তাঁর পাবার কিছুই ছিল না। তিনি ব্যাধির মূল শনাক্ত করেছিলেন নষ্টে-যাওয়া পশ্চিমী সভ্যতায়। এই উপলব্ধি থেকেই তৈরি হয়েছিল তাঁর বিখ্যাত তত্ত্ব- প্রাচ্য বাঁচবে তার মৌলিক স্বাতন্ত্র্য নিয়ে এবং পৃথিবীকে তথা পশ্চিমকেও বাঁচাবে। তাঁর এই তত্ত্ব বা ধারণাটি একই সঙ্গে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা ও নন্দনতাত্তি্বক অনুভূতি ও দর্শনাশ্রিত নীতিবোধের সমীকরণে গঠিত হয়েছিল।

ইউরোপের বৈশ্যবৃত্তি, লোভ ও ক্ষমতাদম্ভকে তিনি সংহত দেখেছিলেন পশ্চিমী জাতীয়তাবাদের ধারণায়। দেশ বা জাতি অপেক্ষা ধর্ম ও মনুষ্যত্বকে তিনি শ্রেয় জ্ঞান করেছেন। এক যুগ পূর্বে, ‘দেশের কথা’ (১৯০৪) প্রবন্ধে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন :

“[…] এ কথা যেন না মনে করি, জাতীয় স্বার্থতন্ত্রই মনুষ্যত্বের চরম লাভ। তাহার উপরেও ধর্মকে রক্ষা করিতে হইবে- মনুষ্যত্বকে ন্যাশনালত্বের চেয়ে বড়ো বলিয়া জানিতে হইবে। ন্যাশনালত্বের সুবিধার খাতিরে মনুষ্যত্বকে পদে পদে বিকাইয়া দেওয়া, মিথ্যাকে আশ্রয় করা, ছলনাকে আশ্রয় করা, নির্দয়তাকে আশ্রয় করা প্রকৃতপক্ষে ঠকা। […]

যাহা হউক, আমাদিগকে নেশন বাঁধিতে হইবে- কিন্তু বিলাতের নকলে নহে। আমাদের জাতির মধ্যে যে নিত্যপদার্থটি, যে প্রাণপদার্থটি আছে, তাহাকেই সর্বতোভাবে রক্ষা করিবার জন্য আমাদিগকে ঐক্যবদ্ধ হইতে হইবে- আমাদের চিত্তকে, আমাদের প্রতিভাকে মুক্ত করিতে হইবে; আমাদের সমাজকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও বলশালী করিতে হইবে।”

কিন্তু তাঁর সাবধান-বাণীতে কোনো লাভ হয়েছিল বলে মনে হয় না। স্বদেশেও হয়নি, বিদেশেও হয়নি।

তোকিও ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটিতে ১১ জুন ১৯১৬ তারিখে প্রদত্ত তাঁর প্রথম বক্তৃতার নামকরণ তিনি করেছিলেন :The Message of India to Japan. নিজের ইচ্ছার স্বারূপ্যে তিনি জাপানকে উদ্বোধিত করতে চেয়েছিলেন :

“Asia now feels that she must prove her life by producing living work, she must not lie passively dormant, or feebly imitate the West, in the infatuation of fear or flattery. For this we offer our thanks to this Land of the Rising Sun and solemnly ask her to remember that she has the mission of the East to fulfil. She must infuse the sap of a fuller humanity into the heart of modern civilization.”

নিউইয়র্কের Outlook কাগজে সংবাদ প্রতিবেদন পড়ে সুইৎসার্ল্যান্ডে অবস্থানরত রম্যাঁ রলাঁ মন্তব্য করলেন :এই ভাষণ বিশ্ব-ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলো। না, কিছুই সূচনা করেনি। জাপানে রবীন্দ্রনাথ মোট তিনবার গিয়েছিলেন; প্রথম বারই শুধু জাপান মন দিয়ে তাঁর কথা শুনেছিল, কিন্তু মনে রাখেনি; আর অন্য দু’বার ভালোভাবে শুনতেও চায়নি। চীনেও অনুরূপ অভিজ্ঞতাই হয়েছিল ১৯২৪ সালে, প্রথম যাত্রাতেই। তাঁর বক্তৃতা সভায় দ্বিতীয় দিনে পিকিংয়ের চেন কুয়াং থিয়েটারে চীনে ভাষায় একাধিক হ্যান্ডবিল ছাড়া হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ অভিযোগমালা। একটির শুরু হয়েছিল এভাবে :

‘এই বৃদ্ধ ভদ্রলোক যদি আমাদের দেশের নিসর্গ-শোভা উপভোগের জন্য পর্যটক হিসেবে এসে থাকেন তা হলে আমরা নীরব থাকলেও চলে, কিন্তু যেহেতু তিনি আমাদের বাণী দিতে এসেছেন তাই তাঁর বক্তৃতার বিরুদ্ধে আমরা অসন্তোষ প্রকাশ করতে বাধ্য।’

সমস্ত অভিযোগই ছিল রবীন্দ্রনাথের আদর্শবাদের বিরুদ্ধে, তাঁর অধ্যাত্মদৃষ্টির বিরুদ্ধে। প্রচারপত্রসমূহের বক্তব্য ছিল এ-রকম যে, যে-প্রাচীন সভ্যতার এত জয়গান মিস্টার তাগোর করেছেন সেই সভ্যতাই তো জনজীবনের অবনতি, মানুষের প্রতি মানুষের হৃদয়হীন নির্যাতন ইত্যাদির জন্য দায়ী, বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতার অনুপস্থিতিই সেজন্য দায়ী, মিস্টার তাগোরের সব কথাই চীনা নবীন যুবসমাজের জন্য প্রাচীনপন্থী, গোঁড়া ও প্রতিক্রিয়াশীল। রবীন্দ্রনাথ সব জানতে পেরে আর্তনাদ করে উঠেছিলেন :’এরা আমাকে বুঝবে না বলে পণ করেছে। তাঁর দূরদৃষ্ট যে তাঁকে কেউ বোঝেনি; না বোঝার পণ করেছিল বলে নয়, আসল কারণ সময়- অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আবহাওয়া অনুকূলে ছিল না। তাঁর আশা ছিল, ইউরোপ-আমেরিকা না বুঝুক, চীন-জাপান অন্তত বুঝবে, কারণ ‘এশিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন জাতির মধ্যে একটি গভীর ও বৃহৎ ঐক্য আছে’ (‘চীনেম্যানের চিঠি’/১৩০৯)। তিনি যা বোঝাতে চেয়েছিলেন তা এই :

‘[…] বস্তুপ্রধান শক্তিপ্রধান সভ্যতাই একমাত্র সভ্যতা নহে, ধর্মপ্রাণ মঙ্গলপ্রধান সভ্যতা তাহা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’

‘[…] প্রাচ্যসভ্যতা আত্মরক্ষা করিবে। যেখানে তাহার বল সেইখানে তাহাকে দাঁড়াইতে হইবে। তাহার বল ধর্মে, তাহার বল সমাজে। তাহার ধর্ম ও তাহার সমাজ যদি আপনাকে ঠেকাইতে না পারে, তবে সে মরিল। য়ুরোপের প্রাণ বাণিজ্যে পলিটিক্সে, আমাদের প্রাণ অন্যত্র। […] এইখানে আমরা একাকী নহি; সমস্ত এশিয়ার সহিত আমাদের যোগ রহিয়াছে।’

চীন-জাপানকে তিনি বোঝাবেন কী করে যে, তাঁর এই চিন্তা বা উপলব্ধি নতুন নয়, আকস্মিকও নয়, পনেরো/বিশ বছর ধরেই তিনি এসব নিয়ে ভাবছেন :’চীনেম্যানের চিঠি’ তিনি লিখেছিলেন ১৯১৬ বা ১৯২৪-এ নয়; ১৯০২ সালে।

নিজস্ব জীবনে মনুষ্যত্বসাধনা ও প্রজ্ঞা থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, অগ্রসর পশ্চিমের অনুকরণকেই অনগ্রসর জাতিসমূহ ‘আধুনিকতা’ ও উদ্ধারের উপায় ভেবে চোরাবালিতে নিমজ্জিত হচ্ছে। যথার্থ আধুনিকতা হলো বিজ্ঞানবুদ্ধি, জীবনে বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগ নয়; যথার্থ আধুনিকতা মানে চলতি হাওয়ার পন্থী হওয়া নয়, বরং চৈতন্যের মুক্তি, চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা- Nationalism বক্তৃতামালায় এসব বলেই তিনি বিশ্ববাসীকে সতর্ক করে দিতে চেয়েছিলেন।

সতর্ক কেউ হয়নি, তবে নিজে হয়েছিলেন। রাষ্ট্র নিয়ে দুশ্চিন্তা অতঃপর বাহুল্য জ্ঞান করেছিলেন। রাজনৈতিক অর্থে রাষ্ট্র- পলিটিক্যাল স্টেট- নয়, তাঁর কাছে ক্রমশ মুখ্য হয়ে উঠেছিল সপ্রাণ অনুভব্যগ্রাহ্য স্বদেশ, অর্থাৎ সমাজ ও তার অভ্যন্তরস্থ জীবন্ত ও প্রত্যক্ষ মানুষজন। আইডিয়া বা Concep-এর দিক থেকে এখানে তিনি গান্ধীর সহযাত্রী, গান্ধীর রাজনীতির বাইরে থেকেও। অন্যদিকে তাঁর মনে এই প্রত্যয় জেগেছিল যে, রাষ্ট্র নিয়ে যদি ভাবতেই হয় তা হলে শুধু ব্রিটিশ-ভারত নিয়ে ভাবলে চলবে না, ভাবতে হবে এশিয়া নিয়ে এবং আধুনিক বিশ্বে এশিয়ামাত্র নিয়ে ভাবনা তাৎপর্যহীন যদি-না তাকে ভাবা যায় পশ্চিমের সঙ্গে মিলিয়ে।

অতএব, রবীন্দ্রনাথের সম্মুখে উন্মুক্ত থাকে মাত্র দুটি পথ :মানবতন্ত্র ও বিশ্বপথিকতা।

১৯৩০-এর বসন্তকাল। নিজের আঁকা ছবির প্রদর্শনী করতে গিয়ে পারীতে বললেন :

“The human world is made one, all the countries are losing their distance everyday, their boundaries not offering the same resistance as they did in the past age. Politicians struggle to exploit this great fact and wrangle about establishing trade relationships. But my mission is to urge for a world-wide commerce of heart and mind, sympathy and understanding and never to allow this sublime opportunity to be sold in the slave markets for the cheap price of individual profits or to be shattered away by the unholy competition in mutual destructiveness.”

তিনি আরো এগারো বৎসর বেঁচে ছিলেন। ‘পরস্পরধ্বংসী নোংরা প্রতিযোগিতা’ তাঁর চোখের সামনেই শুরু হয়েছিল :রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে ক্ষমতার লড়াই। পুঞ্জীভূত হতে হতে ১৯৩৯-এ ফেটে পড়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মারণযজ্ঞে। নির্দিষ্ট বা একক কোনো রাষ্ট্রচালনার নীতি নয়, বহুরাষ্ট্রিক পলিটিক্যাল বিশ্বকে চালাবার এক সম্ভাব্য ও বিশ্বাসযোগ্য নীতি তৈরি করে নিয়েছিলেন সভ্যতার ইতিহাসগতি ও মানবধর্ম মিশিয়ে। তাঁর স্বনির্মিত নীতি কোনো দেশ গ্রহণ করেনি এবং তার বিষময় ফল তিনি ঐ যুদ্ধেই চাক্ষুষ করেছিলেন।

১৮৪১-এ, তাঁর মৃত্যুর কয়েক মাস পূর্বে, জীবদ্দশায় তাঁর সর্বশেষ ভাষণ, ‘সভ্যতার সংকট’, তাঁর ভগ্নবিশ্বাসের ইতিহাস ধরে আছে। রাষ্ট্রের উপরে বিশ্বাস তো কবেই গেছে, এখন মানুষের উপর বিশ্বাসও অস্তগামী। ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’_ এই আর্তনাদ মজ্জমান মুমূর্ষুর তৃণখণ্ড অবলম্বনের মতোই। যা উহ্য থেকেছিল, তিনি বলেননি, তা হল :ঐ পাপকে তিনি বহু পূর্বেই অনুভূতি ও মননে প্রত্যক্ষ করে দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন সকলকে সাবধান করে দিতে।

রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তার যাথার্থ্য প্রমাণ করেছিল বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পশ্চাদ্বর্তী শ্রেয়োদর্শনের প্রাসঙ্গিকতা আজ নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিশ্বশান্তির তীব্র আকুতির গভীরে।

মানুষই প্রথম এবং মানুষই শেষ- তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার অণুবিশ্ব ছিল মৃত্তিকাধূলিলিপ্ত ঐ সর্বকালীন ‘মানব’।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত